শিশু-কিশোর-সাহিত্যিক
অজেয় রায়
সমুদ্র বসু
বাংলা সাহিত্যে আদ্যোপান্ত শিশু-কিশোর-সাহিত্যিক বোধ হয় হাতে
গোনা কয়েকজন। যে
পবিত্র কর্মকান্ডকে সফল করে তুলতে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী,
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের মতো আদ্যোপান্ত শিশুসাহিত্যিকরা সেই ধারাটিকে বজায় রাখতে সামান্য
যে কয়েকজন সফল হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই অজেয় রায় অন্যতম। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের
সাহিত্য জীবনে পুরোটাই ছোটোদের কথা ভেবে লিখে গেছেন এই মানুষটা। নামিদামি পুরস্কারের হাতছানিতেও
কখনও বড়োদের জন্য লেখার কথা ভাবেননি তিনি। ১৯৩৫ সালের ২৭ অগস্ট শান্তিনিকেতনে
জন্ম তাঁর। তাঁর
মা লতিকা রায় শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নাট্য অভিনয়ে লতিকা
রায় একাধিক বার নৃত্য পরিবেশন করেছেন। অজেয় রায়ের নামটিও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের
দেওয়া। তাঁর
পিতা পূর্ণেন্দু রায়। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাইবোন। তিনি বিশ্বভারতী ও কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে
বিশ্বভারতীর কৃষি-অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। শিশুসাহিত্যিক অজেয় রায়
অজস্র সাহিত্য সম্মান লাভ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম জগত্তারিণী স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী
প্রদত্ত আশালতা সেন স্মৃতি পুরস্কার, সন্দেশ পত্রিকা প্রদত্ত সুবিনয় রায় স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ
সরকারের বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর
স্বল্পকাল রোগ ভোগ করার পর হায়দ্রাবাদে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।
ছোটোবেলায় একদিকে খেলাধুলো করতে যেমন
ভালোবাসতেন তিনি তেমন অন্যদিকে ঝোঁক ছিল গল্পের বই পড়ার। ছেলেবেলায় জন্মদিনে তাঁর
বাবা অজেয় রায় ও তাঁর অন্য ভাইবোনদের এক গোছা বই উপহার দিতেন যা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে
পড়ার ধূম পড়ে যেত। এডভেঞ্চার
ও রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। হেমেন্দ্রকুমার ও নীহাররঞ্জন
ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয় দুই লেখক। বিশেষত হেমেন্দ্রকুমারের বিমল-কুমার
ও জয়ন্ত-মানিক ছিল তাঁর সব থেকে কাছের। লেখক অজেয় রায়ের আবির্ভাবের অনেক আগেই
গল্পকার অজেয় রায়ের আবির্ভাব হয়েছিল। উনি ছোটোবেলা থেকেই স্বরচিত রহস্য
রোমাঞ্চ এডভেঞ্চার কাহিনি খাওয়ার টেবিলে বসে ভাইবোনদের শোনাতেন রাত্রিবেলায়। মায়ের চোখরাঙানি ভুলে সেই
সব গল্প গোগ্রাসে গিলতেন তাঁর ভাইবোনেরা। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের শুকতারা পত্রিকায়
অজেয় রায়ের প্রথম গল্প “যেমন ইচ্ছা সাজো” প্রকাশিত হয়। তখনও তিনি অজেয় রায় নামে লিখতেন
না। সেই
লেখাগুলো বেরোতো তাঁর ছদ্মনাম অন্তু রায় নামে। একটা স্মৃতিকথা থেকে জানা
যায় যে মেদিনীপুরের পঁচেটগড়ে কোনও এক খররৌদ্রে অজেয় রায় কয়েকজনের সঙ্গে এক পুকুরঘাটে বসে আছেন। সাঁতার কাটার প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন। এমন সময় পোস্টম্যান এসে রেজিস্ট্রি বুকপোস্টে সই করিয়ে তাঁকে
একটা পত্রিকা দিয়ে যায়। সেটাই হল সেই শুকতারা পত্রিকা যেখানে অন্তু রায় নামে তাঁর প্রথম
গল্প প্রকাশিত হয়। অন্যেরা
হৈ হৈ করে উঠলেও ছাপার অক্ষরে প্রথমবার নিজের
নাম দেখেও একটুও উচ্ছাস প্রকাশ করেননি তিনি। শুধু একটু মুচকি হেসেছিলেন। হয়তো তিনি সেদিন বোঝেননি
যে একদিন বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর নাম স্থায়ীভাবে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো থেকে যাবে।
এরপর তিনি অন্তু রায় নামে শুকতারা ও সন্দেশে পরপর বেশ
কিছু লেখা পাঠাতে থাকলেন। সেগুলো সবই ছাপাও হতে থাকল। প্রবল উৎসাহ পেলেন তিনি। এবারে একটা মজার ঘটনা বলা
যাক যা জানা গেছে অজেয় রায়েরই একটা লেখা থেকে। তিনি একসময় একটা স্কুলে
শিক্ষকতার কাজ করতেন। সেখানে ছেলেপুলেরা ছিল ভয়ঙ্কর অবাধ্য। নরম মনের মানুষ অজেয় রায়
তাদের মারধর করা তো দূরের কথা খুব বেশি বকাঝকাও করতে পারতেন না। যার ফলে অনেক সময় ক্লাসের
মধ্যে গোলমাল বা চিৎকার শুরু হয়ে যেত। একদিন হেড মাস্টারমশাই
অজেয় রায়কে ডেকে আরও কড়া হতে বললেন যাতে ক্লাসে ডিসিপ্লিন বজায় থাকে। বেশ বিপাকে পড়া অজেয় রায়
এরপর একদিন যখন ক্লাসের মধ্যে প্রবল গোলমাল হচ্ছে সেদিন ছাত্রদের চুপ করানোর এক নতুন
পন্থা নিলেন। তিনি
সবাইকে একটা গল্প বলতে লাগলেন। রবিনহুডের গল্প। টনিকের মতো কাজ হল তাতে। সবাই গোগ্রাসে গিলল সেই
গল্প। এরপর
সবাই যেন গল্প শোনার নেশায় মেতে উঠল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তাই নতুন নতুন
গল্প বলতে হত তাঁকে। তিনি এইভাবেই একদিন আফ্রিকা অভিযানের একটা গল্প
তাদের বলতে লাগলেন যা কিনা তাঁর নিজের মনগড়া এক কাহিনি। গল্পের নায়ক এক বাঙালি
বৈজ্ঞানিক এবং তার দুই যুবক সঙ্গী। এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূত্র ধরে
তারা বেরিয়ে পড়ল এক রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চারে। আফ্রিকা সম্বন্ধে যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল
অজেয় রায়ের। তাই
থেকে বর্ণনা দিতে লাগলেন অভিযানের পথের, সেখানকার গাছপালা, জীবজন্তু, আদিবাসীদের। বলতে বলতে চরিত্রগুলো দিব্যি জীবন্ত হয়ে উঠল। জমে গেল গল্প। আসলে রহস্য রোমাঞ্চ গল্প
বানাতে তাঁকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কল্পনায় এডভেঞ্চারের জাল বুনতেন তিনি। কত ঝোপ-জঙ্গল ভরা মাঠে-ঘাটে, নদীর তীরে, নির্জন
প্রান্তরে দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গী করে তিনি ঘুরেছেন। পুরোনো বাড়ি পেলেই আঁতিপাঁতি
করে খুঁজতেন গুপ্তধন। আর তাই কল্পনার জাল বুনে তৈরি করা ঐ মস্ত এডভেঞ্চার যখন তিনি
বলা শেষ করলেন তখন ক্লাসের সব ছাত্ররা এক কথায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। একজন ছাত্র তো গোঁ ধরে
বসল যে ঐ বইটা সে কিনবেই। এদিকে অজেয় রায় তো তাকে “পরের দিন বলব”, “দেখে বলব”, “ইংরেজি নামটা ঠিক মনে পড়ছে
না” ইত্যাদি বলে সেই ছাত্রকে এড়িয়ে গেলেন। আর সেই থেকেই তিনি ভাবতে
শুরু করলেন যে এই সুদীর্ঘ কাহিনিটিকে উপন্যাসের আকারে লিখে ফেললে কেমন
হয়। যেমন
ভাবা তেমন কাজ। একটা
জাবদা খাতায় প্রবল উৎসাহের সঙ্গে লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস।
কয়েক মাস পরেই সেই স্কুল ছাড়লেন তিনি। চাকরি বদলালেন। এলেন শান্তিনিকেতনে। হঠাৎ একদিন খবর পেলেন যে
সন্দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদিকা লীলা মজুমদার শান্তিনিকেতনে এসেছেন বেড়াতে। তখন তাঁর খুব ইচ্ছা হল
যদি কোনোভাবে সম্পাদিকার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করা যায়। দূর থেকে তাঁকে দেখে বেশ
ভয় পেলেন তিনি। চশমা
পরা রাশভারী চেহারা। তবুও একদিন বুক ঠুকে ঢুকে পড়লেন আলাপ করতে। ভয় ভেঙে গেল সেদিনই। খুব সহজ সরল মানুষ সেই
সম্পাদিকা। একবারেই
তিনি মনে করতে পারলেন অজেয় রায়ের লেখা গল্প দুটির কথা। উৎসাহ পেয়ে লিখে ফেললেন
আরও বেশ কিছু গল্প। এরপর লীলা মজুমদার শান্তিনিকেতনে
বছরে দু-তিনবার আসতে থাকলেন এবং প্রতিবারই অজেয় রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করে গল্পগুলো সংশোধন
করিয়ে নিতেন। প্রায়
বছর দুই-তিন পর এরকমই একদিন শান্তিনিকেতনে লীলা মজুমদারের কাছে খুব সাহস করে তিনি নিয়ে
গেলেন তাঁর সেই জাবদা বড়ো খাতাটা যাতে তিনি কয়েক বছর আগে সেই বড়ো উপন্যাসটা লিখে রেখেছিলেন। মনে অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও
তিনি সেই উপন্যাসের খাতাটা জমা দিয়ে এলেন লীলা মজুমদারকে। তারপর দিন সাতেক সম্পাদিকার
ধারে কাছেও যাননি তিনি। আবার সাহস করে একদিন হাজির হলেন সম্পাদিকার কাছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা বেশ
ভয়ঙ্কর ছিল সম্পাদিকার – “বড্ডো বানান ভুল।” সম্পাদিকা জানালেন বেশ
কিছু অংশ কাটছাঁট করার জন্য দাগ দিয়ে দিয়েছেন। ভালোমন্দ কিছুই বলেননি
সম্পাদিকা। আর
তাই অজেয় রায় বেশ সংকোচের সঙ্গে সেই খাতাটা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। এর কয়েক মাস পরেই অযাচিত
ভাবে সন্দেশ দপ্তর থেকে লীলা মজুমদারের লেখা এক চিঠি আসে তাঁর কাছে। সম্পাদিকা সেখানে অজেয় রায়কে সেই
উপন্যাসটা পরিষ্কার হাতের লেখায় বানান ঠিক করে এবং অন্যান্য দাগ দেওয়া জায়গা সংশোধন
করে সন্দেশ শারদীয়াতে পাঠাতে বলেন। এই “মেঘ না চাইতে জল” খবরে নতুন উদ্যমে উপন্যাসটা আবার লিখে সন্দেশে
তিনি পাঠিয়ে দিলেন কোনও নাম ছাড়াই। অবশেষে ১৯৭০-এর সন্দেশ শারদীয়াতে প্রকাশ
পেল এক কালজয়ী উপন্যাস “মুঙ্গু”। পাতাজোড়া সুবিশাল নামাঙ্কণ স্বয়ং সত্যজিৎ
রায়ের করা। জানা
গেল নামটাও তাঁরই দেওয়া। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি অজেয় রায়কে। তাঁর কলমে একের পর এক অসাধারণ
কিছু এডভেঞ্চার উপন্যাস প্রকাশ পেতে থাকে – “আমাজনের গহনে”, “ফেরোমন”, “মিস্টার বাসুর ফরমুলা”, “মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে”, “বাস্তেন দ্বীপে অভিযান”, “কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন” ইত্যাদি।
সন্দেশ ও শুকতারার পাশাপাশি সে সময়ের অন্যান্য সমস্ত
শিশু-কিশোর পত্রিকা যেমন আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, ঝলমল, কিশোর মন
ইত্যাদিতে লিখেছেন অজেয় রায়। ভৌগোলিক তথ্য, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং
এডভেঞ্চার - এই তিনের অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মামাবাবু-সুনন্দের
কাহিনিগুলোতে। বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে
ছোট্ট গ্রাম চন্দনার দুই কিশোর শিব ও দেবুর নানান কীর্তিকলাপ নিয়ে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস
লিখেছেন তিনি। তবে
অজেয় রায়ের শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন করা যায় তাঁর লেখা রহস্য রোমাঞ্চ, ভৌতিক এবং হাস্যরসপূর্ণ
ছোটোগল্পগুলি
থেকে। অজেয়
রায় বরাবরই যেন একজন উপেক্ষিত শিশু সাহিত্যিক। ওনার যা সম্মান প্রাপ্য
তা বোধ হয় তিনি পাননি। কিন্তু আমাদের মতো কিছু পাঠকের আজীবন ভালোবাসার মধ্যেই
তিনি বেঁচে থাকবেন শিশু সাহিত্যের একজন মহীরুহ হয়ে।
_____
No comments:
Post a Comment