গল্পের ম্যাজিক:: ক্ষমা নেই - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ


ক্ষমা নেই
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে আরাম করে বসার ঘরের সোফায় বসলেন শোভনবাবু। টিভিতে নিউজ চলছে। একটু পরে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ আছে। রুমিদেবী ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে গেলেন।
বাবা, তোমার একটা পার্সেল এসেছে,বিট্টু লাফাতে লাফাতে এসে বলল।
পার্সেল? কীসের?” অবাক হলেন শোভন কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “ওহ্‌ বুঝেছি, অনলাইনে সেদিন একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক অর্ডার করেছিলাম, সেটা এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি ডেলিভারি দিয়ে দিল তো!
না গো, বাবা। এমনি একটা ছেলে দিয়ে গেল। পাওয়ার ব্যাঙ্ক এলে তো টাকা দিতে হতবলল, তোমার জন্য একটা গিফট আছে। তুমিই যেন প্যাকেটটা খোলো। আনব বাবা প্যাকেটটা?উৎসাহিত হয়ে বলল বিট্টু।
আন। দেখি কী এমন আছে যে আমাকেই খুলতে হবে। বোম-টোম নয় তো?” বিট্টুকে ভয় দেখানোর জন্য বললেন শোভন
কী বলছ, বাবা!বিট্টুর মুখে আশঙ্কার ছাপযেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়েছে সে।
হা হা করে হেসে উঠলেন শোভন। আরে বোকা, তোর বাবা এমন কেউকেটা নয় যে কেউ বোম পাঠাবে। যা নিয়ে আয়।
বিট্টু দৌড়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। ফিরে এল হাতে একটা সবুজ রঙের রাংতায় মোড়া সরু প্যাকেট নিয়ে। শোভন প্যাকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন কোথাও প্রেরকের নাম লেখা নেই।
বাবা, তাড়াতাড়ি খোল না।বিট্টুর আর তর সইছে না।
আচ্ছা, আচ্ছা।
প্যাকেটটা খুলে শোভন অবাক হয়ে গেলেন। একটা সোনালি রঙের জাপানি ফাউন্টেন পেন।
তোমাকে পেন গিফট করল কে? ফাউন্টেন পেনে তো এখন কেউ লেখেই না।
বুঝতে পারছি না রে। জানিস, আমি যখন এইচ.এস পড়ি, আমার মামা আমাকে এরকম একটা পেন উপহার দিয়েছিলেন। আচ্ছা, ছেলেটা কিছু বলেনি কে পাঠিয়েছে?”
সেরকমভাবে কিছু না আমাকে শুধু বলল, শোভনকে এটা দিয়ে দিও, বোলো সজল এসেছিল। ছেলেটা কী অভদ্র! আমার চেয়ে একটু বড়ো ছেলেটা, তোমাকে নাম ধরে ডাকছিল।
চমকে উঠলেন শোভনকী নাম বললি?”
সজল।
দেখতে কেমন ছেলেটা?” উত্তেজিত প্রশ্ন শোভনবাবুর।
রোগা-পাতলা, ফরসা। আমার চেয়ে একটু বেশি হাইট আর গালে একটা লাল দাগ।
ক-কী বললি তুই!উত্তেজনায় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শোভন। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে পর্দা সরিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। বিট্টু আন্দোলিত পর্দাটার দিকে একটু তাকিয়ে রিমোটটা নিয়ে খেলার চ্যানেল ধরাল।
পাগলের মতো কাবার্ডটা ঘাঁটতে লাগলেন শোভন। খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পেয়ে গেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি।
বিট্টু, এই বিট্টু, একবার ভেতরে আয়,ডাক দিলেন ছেলেকে।
ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। বিট্টুর একদম উঠতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু বাবার ডাকে বাধ্য হয়ে ভেতরে গেল।
একটা বহু পুরোনো অ্যালবামের একটা পাতা খুলে নিয়ে বসে আছেন শোভন। ছবিগুলোতে হলদেটে ছাপ বয়ে যাওয়া সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে।
কী বলছ, বাবা?”
এই অ্যালবামটা দ্যাখ। আমার স্কুল লাইফের ছবি আছে।
বাবা, কাল দেখব। ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে।
বিট্টু ভেবে পায় না বাবা এইসময় তাকে ফোটো দেখতে ডাকলেন কেন। ম্যাচ দেখবে বলে সে দুপুরে না ঘুমিয়ে পড়াশোনা করেছে। তার মাধ্যমিক পরীক্ষার এখনও ফল বের হয়নি, কিন্তু কয়েকটা টিউশন শুরু হয়ে গেছে।
দেখতে বললাম, তুমি দেখবে,গম্ভীর স্বরে বললেন শোভন।
বাবার ব্যবহারে কষ্ট পেলেও বিট্টু মুখে কিছু না বলে অ্যালবামটা হাতে নিল।
আরে, এ তো সেই ছেলেটা! যে প্যাকেটটা দিয়ে গেল! একটা গ্ৰুপ ফটোর মধ্যে একজনকে নির্দেশ করে বলল বিট্টু।
শোভনের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এ কী করে সম্ভব!
বিট্টু, তুই এখন যা,মৃদু স্বরে বললেন শোভন।
তাঁর আচরণে বিস্মিত হলেও ম্যাচ দেখার আনন্দে আর কিছু না বলে বিট্টু বেরিয়ে গেল।

*            *            *            *            *

বর্ধিষ্ণু গ্রাম শ্যামলপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কংসাবতী নদী। এই গ্রামের সবচেয়ে সম্পন্ন পরিবার হল রায়দের। তিন শরিকের মধ্যে ছোটো তরফের মহাদেব রায়ের একমাত্র আদরের নাতি হল শোভন। মহাদেব রায় শ্যামলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হওয়ায় তাঁর নাতি শোভনের আলাদা খাতির স্কুলে। তাছাড়া শোভন পড়াশোনাতেও ভালো। প্রতিবছর নিজ যোগ্যতাতেই ক্লাসে ফার্স্ট হয়। বংশ কৌলিন্য এবং অর্থের অহংকার শোভনের মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তার ওপর নিজে ভালো পড়াশোনা করায় সেই অহংকার যেন উপচে পড়ত। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যথারীতি স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল করল শোভন কিন্তু তারপরেই তার সাম্রাজ্যে অনুপ্রবেশ করে তার সর্বস্ব হরণ করল সজল। পিতৃহীন দীনদরিদ্র বিধবা মায়ের আশার আলো সজল।
সজল আর উজ্জ্বল - দুই ভাই এসে ভর্তি হল শ্যামলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। সজল একাদশ শ্রেণীতে আর উজ্জ্বল অষ্টম শ্রেণীতে। শ্যামলপুর স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মানসবাবু ওদের মামার বন্ধু। একই গ্রামে বাড়ি ওঁদের। তাই মানসবাবু ওদের দুই ভাইয়ের ফ্রিতে হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সজল মাধ্যমিকে শোভনের চেয়ে অনেক নাম্বার বেশি পেয়ে এখানে এসেছে।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, সজল শুধু পড়াশোনাতেই ভালো নয়, সে খুব ভালো আবৃত্তিও করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, অল্পদিনেই সে তার সহজ-সরল ব্যবহারে শিক্ষক থেকে ছাত্র সকলের মন জয় করে ফেলেছে। ক্লাসের পেছন বেঞ্চের যে সমস্ত ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকানোটাও অনুচিত মনে করত শোভন, সজল অবলীলায় তাদের সঙ্গে মিশে তাদের পড়ায় সাহায্য করতে লাগলশোভনের চোখের সামনেই সজল সারা স্কুলের সবার নয়নের মণি হয়ে উঠলশিক্ষকরাই শুধু নয়, শোভন নিজেও বুঝতে পারল, মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা সবদিকেই সজল তার চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে। সজল হল আকাশের সেই চাঁদ যাকে হাজার চেষ্টা করলেও শোভনের পক্ষে ছোঁয়া সম্ভব নয়। অসাধারণ তার বুদ্ধিবৃত্তি, তার ওপর মিষ্টি ব্যবহার। শোভন ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে গেলেও মুখে তার বহিঃপ্রকাশ করত না।
একাদশ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, স্বাভাবিকভাবেই শোভন তার একনম্বর সিংহাসন হারিয়েছে। সজল তার চেয়ে অনেক নম্বর বেশি পেয়ে প্রথম হয়েছে। স্কুলের স্যাররা ওকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছেন। লজ্জায় শোভনের মুখ তুলতে ইচ্ছে করছে না। আর সহ্য করতে পারল না সে। সজলকে সকলের সামনে ছোটো করার উপায় খুঁজতে লাগল।
শোভনের একটি স্তাবক বন্ধুবৃত্ত ছিল। তারাও সজলকে পছন্দ করত না। একদিন আচমকা শোভনের হাতে সুযোগ এসে গেল। তার মামা তাকে একটা দামি জাপানি ফাউন্টেন পেন উপহার দেন। শোভন বন্ধুদের দেখাবে বলে সেটা স্কুলে নিয়ে আসে। বাকিদের সঙ্গে সজলও আগ্রহ ভরে সেটা দেখে। পড়াশোনার দিকে খুব বুদ্ধিমান হলেও সজলের মনটা ছিল সরল। কোনও প্যাঁচ-পয়জার জানত না সে তাই সহজ মনে শোভনকে বলে, “একলাইন লিখতে দিবি ভাই? ভারি সুন্দর পেনটা।
শোভন লিখতে দেয় তাকে। ফেরত দিয়ে সজল বলে, “খুব ভালো লেখা পড়ে পেনটায়।
শোভন মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। সেদিন টিফিনের পর ক্লাসে এসে শোভন সকলকে জানায় পেনটা খুঁজে পাচ্ছে না সে। মহাদেব রায়ের নাতির দামি পেন হারিয়েছে, তাই স্বয়ং হেডমাস্টারমশাই তদন্তে আসেন এবং সকলের ব্যাগ খুঁজে দেখার নির্দেশ দেন। শেষমেশ পেনটা বেরোয় সজলের সস্তা দামের ছেঁড়া ফাটা ব্যাগটা থেকে। ঘটনার অভিঘাতে সজল হতভম্ব হয়ে যায় আর শোভনের মনের গোপনে খুশির ফোয়ারা ছুটতে থাকে। শোভনের সঙ্গীসাথীর দল মহা উৎসাহে হেডমাস্টারমশাইকে জানায় সজল কেমন লোভে পড়ে পেনটায় লিখতে চেয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। সামান্য একটা ব্যাপার শোভন এবং তার বন্ধুদের অতিরঞ্জিত উপস্থাপনার গুণে হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছে অন্য রূপ ধারণ করল। ক্লাসের অন্য ছেলেরা জানায়, ওদের কথা হয়তো মিথ্যে নয় সজলের পেনটা ভালো লেগেছিল, কিন্তু তাই বলে সজলের মতো ছেলে চুরি করতে পারে না।
বন্ধুদের বিশ্বাস সজলকে বাঁচাতে পারল না। প্রমাণ তার বিপক্ষে। টিফিনের সময় সবাই মিলে যখন খেলছিল, সে একবার জল খাওয়ার জন্য মাঠ ছেড়ে এসেছিল আর জলের কলটা তাদের ক্লাসের কাছেই।
হেডমাস্টারমশাই কড়া ধাতের মানুষ, কোনওরকম অন্যায়কে তিনি প্রশ্রয় দেন না। ফার্স্ট বয় হলেও সজলকে তিনি কড়া শাস্তি দেবেন স্থির করলেন। অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন। মানসবাবুর মতো কেউ কেউ মনে করতেন, পৃথিবী উলটে গেলেও সজল এ কাজ করতে পারে না আর বাকিরা সজলকে ভালোবাসলেও ভাবলেন অনেক সময় তো অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। বাচ্চা ছেলে ভুল করে ফেলেছে আর মহাদেব রায়ের নাতি মিথ্যে বলছে এটা কেউ ভাবতেই পারলেন না। সজল যেহেতু পড়াশোনায় খুবই ভালো তাই সবাই মিলে হেডমাস্টারমশাইকে বুঝিয়ে ঠিক করলেন ওকে একটু বকাঝকা করে সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হবে।
একথা শোভনের কানে যেতেই জ্বলে উঠল সে। এত সুন্দর পরিকল্পনা করে সজলকে ফাঁসাল, কিন্তু তার পরিণাম এই! সেদিন টিফিনের সময় সকলের শেষে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিল সে আর তখনই সজলের ব্যাগে শোভন খুব ভালো করেই জানত, আর যাই হোক, কেউ ভাবতেও পারবে না যে সে সজলের ব্যাগে পেনটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার ধারণা ছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের মতো মানুষ সজলকে অবশ্যই স্কুল থেকে বের করে দেবেন।
এখন তার একমাত্র ভরসা দাদু। অহংকার, দম্ভ এসব শোভন উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিল। একটা সামান্য হাড়-হাভাতে ছেলে এসে তাঁর নাতির জায়গা দখল করে নিয়েছে এটা মানতে মহাদেব রায়ের মতো দাম্ভিক লোকের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তিনিও সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাঁর চাপে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হলেন হেডমাস্টারমশাইমহাদেব খুবই চতুর লোক। সজলের মতো ছেলেকে সরাসরি শুধুমাত্র একটা পেন চুরির জন্য স্কুল থেকে বের করতে বললে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলতে পারে তাই ঠিক করলেন, সজলকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেবেন। মহাদেব নির্দেশ দিলেন, সজলকে প্রার্থনার লাইনে সবার সামনে নিজের দোষ স্বীকার করতে আর ওর মাকে এসে মুচলেকা দিয়ে যেতে হবে।
সারা শরীরে ওতপ্রোতভাবে দারিদ্র্যের চাদর জড়ানো সজলের মা তাঁর ভাইয়ের পিছু পিছু ধীর পদক্ষেপে ঢুকলেন স্কুল বাউন্ডারিতে। মানসবাবু খবর পাঠিয়েছিলেন, তাঁর সজল নাকি কোন বড়ো মানুষের ছেলের কলম চুরি করেছে, তাই হেডস্যার তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মিনতির সবকিছু ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। তাঁর সজল এমন কাজ কী করে করতে পারে? মানসবাবু অবশ্য বলেছেন, তাঁরও বিশ্বাস হয়নি কথাটা, কিন্তু কিছু নাকি করার নেই। তিনি বলেছেন, মিনতি ইস্কুলে গিয়ে দু’কলম লিখে দিলে সজলকে হেডস্যার ক্ষমা করে দেবেন। মানসবাবু আশ্বাস দিয়েছেন, এরপর তিনি সজলের খেয়াল রাখবেন। একবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই, ব্যস।
হঠাৎ কোথা থেকে কয়েকটা কথা উড়ে এল, “ওই দ্যাখ, চোরের মা যাচ্ছে।
সজল চোরের মা যাচ্ছে রে।
বলা বাহুল্য, শোভনের দলবলের কাণ্ড ছিল এটা। মিনতি লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। হেডস্যারের কাছে সব শোনার পর মরমে মরে গিয়েছিলেন মিনতি। মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, “কেন এ কাজ করলি, বাবা? তুই তো আমার গর্ব ছিলি।
আর কিছু বলতে পারেননি মিনতি। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে পথের বাঁকে মা আর মামার অবয়বটা মিলিয়ে যাওয়ার পরও তাকিয়ে ছিল সজল।
পরের দিন সকালে সজলকে তার হোস্টেলের ঘরে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার সঙ্গে যারা থাকত তারা জানায়, সকাল থেকেই সজলকে দেখেনি তারা। চারদিকে সজলের সন্ধানে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। অবশেষে হোস্টেলের পাশের পুকুর থেকে সজলের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। গ্রামের ছেলে হলেও ছোটো থেকেই জলে ভয় ছিল সজলের তাই সাঁতার শেখা হয়নি তার। নিজের জীবনদীপ নিভিয়ে ফেলার জন্য সেই ভয়ের জায়গাটাই বেছে নিয়েছিল সে। তার সবচেয়ে প্রিয় অঙ্কের বইটার পাতার ফাঁকে রেখে গিয়েছিল তার অন্তিম আর্তি – ‘আমি চুরি করিনি। আমি চোর নই। পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করুক না করুক, মা তুমি অন্তত বিশ্বাস কোরো তোমার শিক্ষায় কোনও ত্রুটি ছিল না। তোমার সজল চোর নয়।’
এই পৃথিবীতে কবেই আর হতদরিদ্র মানুষগুলো সুবিচার পেয়েছে? তাই স্বাভাবিক নিয়মেই সজলের মামা এসে মানসবাবুর সাহায্যে সজলের মৃতদেহ আর উজ্জ্বলকে নিয়ে চুপচাপ চলে গেলেন। ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শব্দ পাওয়া যায়নি তাঁর কাছ থেকে। হেডস্যার সহ সবাই বুঝলেন, সামান্য একটা পেন চুরিকে কেন্দ্র করে মহাদেব রায়ের কথায় সবার সামনে দোষ স্বীকার, মাকে দিয়ে মুচলেকা লেখানো - এসব অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাঁরা এটাও জানেন, এই গ্রামে নিশ্চিন্তে চাকরি করতে হলে রায়বাড়ির লোকজনকে চটানো চলবে না। শুধু মানসবাবু কিছুদিনের মধ্যেই অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজে চলে গেলেন
সজলের মৃত্যুতে শোভনের পথ হল নিষ্কণ্টক। সবাই দু-চারদিন হা হুতাশ করল, তারপর আস্তে আস্তে সকলের মন থেকে সজলের মৃত্যুর ছবিটা ফিকে হয়ে গেল। শোভন তার হৃত সিংহাসন পুনরুদ্ধার করল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে কলেজে পড়ার জন্য গ্রাম ছাড়ল।

*            *            *            *            *

সজলের মৃত্যুর জন্য কোনওদিনই নিজেকে দায়ী মনে হয়নি শোভনের। চিরদিনই তাঁর মনে হয়েছে, সজলের মা তাকে অবিশ্বাস করেছিলেন, তাই সজল আত্মহত্যা করেছিল এতে তাঁর কোনও দোষ নেই। একটু আধটু অপমান গরিবদের সহ্য করতে হয়। ওটা তো ওদের অভ্যেস। অত মান-অপমান, অভিমান বোধ থাকলে গরিবদের চলে না। রায়বাড়ির ছেলে স্কুলের সেরা ছাত্র হিসেবে না থাকলে পরিবারের মানসম্মান থাকত না সেদিক থেকে সজলের বলার মতো কোনও পরিচয়ই ছিল না। বাবা কবেই মারা গেছে আর মা সামান্য জমিতে চাষ করে, মুড়ি ভেজে দিন গুজরান করত।
কী গো, ঘর অন্ধকার করে কী ভাবছ?”
রুমিদেবীর ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরলেন শোভন। নাহ্‌, কিছু না। মাথাটা ধরেছে, তাই লাইট অফ করে রেখেছিলাম।
পরের দিন অফিসে প্রচুর কাজ ছিল। কাজের চাপে আগেরদিনের ঘটনা মনের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল শোভনের। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে ডাক দিলেন, “এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দাও তো।
রুমি ডান হাতে জলের গ্লাস আর বাঁ হাতে আগেরদিনের মতো একটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকলেন।
একটা ছেলে এসে তোমার জন্য এই প্যাকেটটা দিয়ে গেল।
চমকে উঠে প্যাকেটটা খুলে দেখলেন শোভন। সেই একই পেন। রুমি যা বর্ণনা দিলেন, অবিকল আগের দিনের বিট্টুর বর্ণনা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে শোভনের। মনে একটাই প্রশ্ন ধাক্কা দিচ্ছে, ‘কী করে সম্ভব! সাতাশ বছর আগে মৃত সজল সেই একই চেহারায় কী করে ফিরে আসতে পারে!’
শোভনের মাথাটা দপদপ করছে। সেদিন সঠিক কী ঘটেছিল সেটা একমাত্র জানেন তিনি নিজে। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, এমনকি দাদুও জানতেন না প্রকৃত সত্যটাতবে সজল বোধহয় আঁচ করতে পেরেছিল কারণ, সবার সামনে ক্ষমা চাওয়ার পর তাঁকে বলেছিল, “কেন আমার সঙ্গে এমন করলি শোভন?”
শোভন উত্তর না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না শোভন। এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল। ইন্টারনেট সার্চ করে দেখেছেন, এখন ওই কোম্পানি আর এই ধরনের ফাউন্টেন পেন তৈরিই করে না। কুড়ি বছর আগে এই পেন তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে দু-দুটো পেন... চোখ বন্ধ করলেই সজলের সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট সরল মুখটা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সকাল থেকেই আনমনা শোভন যা হোক অল্প দুটি খেয়ে অফিসে চলে গেলেন। একটা মিটিং সেরে নিজের কেবিনে এসে বসতেই ক্রিং ক্রিং করে ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। কিছুটা বিরক্তি সহকারে ফোনটা ধরে বললেন, “হ্যালো।
ও-প্রান্তে গুব গুব করে একটা আওয়াজ হচ্ছে। অনেকটা ওই জলে কলসি ডোবালে যেমন আওয়াজ হয়, সেইরকম।
হ্যালো,আবার বললেন শোভন।
আমার উপহার পেয়েছিস?”
ক-কে?”
তোর স্মৃতির পাতা থেকে আমার নামটা বোধহয় মুছে ফেলেছিস। তাই না রে? কিন্তু দ্যাখ, আমি তোকে আজও ভুলতে পারিনি। জলের তলায় শ্যাওলা আর পাঁকের মধ্যে যখন আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসছিল তখনও শুধু তোর মুখটা আর তোর সেই দা-আ-আ-মি জাপানি ফাউন্টেন পেনটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল,ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল সে।
সজল!কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন শোভন।
যাক, নামটা মনে আছে তোর। তুই আজ খুব সুখী, তাই না রে? ভালো মাইনের সরকারি চাকরি, আরামের জীবন। আমিও ভেবেছিলাম অনেক বড়ো হব। আমার অভাগী মাকে খুব আরামে রাখব কিন্তু দ্যাখ, কিচ্ছু হল না। কেন হল না বল তো? কার জন্য হল না?”
শোভনের গলা শুকিয়ে আসছে। অসম্ভব! এ কী করে হতে পারে!
কিছুক্ষণ দু-প্রান্তেই নীরবতার পরে অনেক কষ্টে শোভন নিজেকে শক্ত করলেন। সজল কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না। নিশ্চয়ই কেউ তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে। যদিও তাঁর মন জানে, যা ঘটেছিল তা অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় তাও কড়া গলায় বললেন, “এসব ফাজলামি বন্ধ করুন। যেই হন আপনি, আমি কাউকে ভয় পাই না।
তাই নাকি! ঠিক আছে, দেখা হবে।
ফোনটা কেটে গেল।
শোভন চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলেন। কী বলতে চাইল ও?

লক্ষণ সুবিধার নয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটাতেই যেন সন্ধের অন্ধকার নেমেছে। কালবৈশাখী ধেয়ে আসবে মনে হয়। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিলেন শোভন। ফট ফট আওয়াজ করে তাঁর এনফিল্ড বাইকটা রাজকীয় ভঙ্গিমায় পিচ ঢালা পথ চিরে এগিয়ে চলল।
শোভনদের পাড়াটা মূল রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। বাড়িগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। প্রতিটা বাড়ির সামনে পেছনে খানিকটা করে জায়গা আছে। শোভন যখন পাড়ায় ঢুকলেন তখন বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে ঝাঁপ দিতে আরম্ভ করেছে সঙ্গে ঝোড়ো হওয়া। কড় কড় শব্দে কোথাও একটা বাজ পড়ল। লোডশেডিং হয়ে গেছে রাস্তার আলোগুলোও জ্বলছে না। বাইকটা থামিয়ে পাঁচিলের গেটটা খুলছেন শোভন, এমন সময়, “কী রে, চিনতে পারছিস, শোভন?”
হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে যে কথাটা বলল, আলো-আঁধারির মধ্যেও তার চেহারাটা চিনতে ভুল হল না শোভনের। আজও তাঁর পুরোনো অ্যালবামটা খুললে বহু বছর আগে শ্যামলপুর বিদ্যালয়ের রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তোলা ছবিতে এই চেহারাটা উঁকি দেয়। কিন্তু এই মুখটা তো পৃথিবীর ক্যানভাস থেকে সাতাশ বছর আগে মুছে গেছে!
কী রে, ভয় লাগছে নাকি?” বাঁকা হেসে বলল সে। তার সস্তা দামের জামা-প্যান্ট থেকে জল ঝরছে। গায়ে জড়িয়ে আছে শ্যাওলা, মাথার চুলে কয়েকটা কচুরিপানা।
স-সজল! ত-ত-তুই!শোভনের গলার কাছে একদলা ভয় চেপে বসছে। হৃৎপিণ্ডটা পাঁজরের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
তোর ছেলেটা ভারি মিষ্টি। ও এখন সেই বয়সে পৌঁছে গেছে যে বয়সে তোর মতো শয়তানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।কেটে কেটে কথাগুলো বলল সে। সজলের চোখ দুটো লাল হয়ে জ্বলছে।

চোখের পাতাদুটো আস্তে আস্তে খুললেন শোভন। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে।
জ্ঞান ফিরছে ওর। কেমন লাগছে এখন?”
বাবা, তোমার কী হয়েছিল?”
স্ত্রী-পুত্রের উপর্যুপরি প্রশ্ন ছুটে এল শোভনের দিকে। শোভন দেখলেন, ঘরের মধ্যে রুমি আর বিট্টু ছাড়াও স্থানীয় ডাক্তার হরিদেব সেন, পাশের বাড়ির ভাড়াটে তমাল আর সুজয় উপস্থিত।
ডাক্তার সব দেখেশুনে জানালেন, ব্লাড প্রেসার একটু বেশি ছাড়া আর কিছু অসুবিধা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। কয়েকটা টেস্ট প্রেসক্রাইব করে, এক-দু'দিন রেস্ট নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার বিদায় নিলেন।
শোভন রুমির মুখে শুনলেন যে তমাল আর সুজয় বাড়ি ফিরছিলেন। ওঁরা দেখেন, হঠাৎ করে শোভন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গেটের সামনে পড়ে গেলেন। ওঁরা তাড়াতাড়ি বাইক থামিয়ে কাছে এসে দেখেন, শোভন চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ করছেন। ওঁরাই ঘরে নিয়ে আসেন, ডাক্তার ডাকেন।
শোভনদা, কী হয়েছিল আপনার?” তমাল প্রশ্ন করেন।
কই, কিছু না তো মানে, ওই মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল।আমতা আমতা করে বলেন শোভন।
আচ্ছা, আপনি তাহলে বিশ্রাম নিন। আমরা এখন আসি। এরপর রুমির দিকে তাকিয়ে সুজয় বলেন, “বৌদি, কোনও অসুবিধা বোধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন। কোনও সংকোচ করবেন না।

শোভন প্রায় দিন পাঁচেক অফিসে যাননি। তাঁর মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। এই পাঁচদিনে নতুন করে আর কিছু অবশ্য ঘটেনি। কাল থেকে আবার অফিস যাবেন ভাবছেন।
বাড়িতে এখন তিনি একা। রুমি একটু দোকানে গেছেন চানাচুর-বিস্কুট এইসব কিনতে। শোভনকে যেতে দেননি, আর বিট্টু একটু আগে ফোন করে জানাল, টিউশন থেকে ফেরার পথে তমালদের বাড়িতে ঢুকেছে।
সুজয় আর তমাল দুই বন্ধু এখানে নতুন ব্যাবসা করার উদ্দেশ্যে এসেছেন। পৈতৃক ব্যাবসা ওঁদের আর ভালো লাগছে না। শোভনদের পাশের খালি একতলা বাড়িটা মাসখানেক হল ভাড়া নিয়ে দু’জনে আছেন। দু’জনেরই পরিবার কলকাতার বাড়িতে থাকেপ্রচুর পয়সা আছে বোঝাই যায়। ব্যাবসার জন্য ভালো জায়গা খুঁজছেন। এই অল্পদিনের মধ্যেই শোভনদের সঙ্গে, বিশেষ করে বিট্টুর সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে ওঁদের।
সন্ধেবেলা চা খেতে খেতে শোভন খবর দেখছিলেন। কলিং বেলটা বেজে উঠল। রুমি দরজা খুলতে গেলেন।
আরে, আপনারা? আসুন আসুন।
শোভন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, তমাল আর সুজয় দরজায় দাঁড়িয়ে।
ভেতরে আসুন! বাইরে কেন?” শোভনের ডাকে ভেতরে ঢুকলেও দাঁড়িয়ে রইলেন ওঁরা।
আরে, বসুন!
আমরা বসতে আসিনি। বিট্টুকে ডাকুন।সুজয়ের গম্ভীর গলা আর এরকম আচরণ দেখে শোভন আর রুমি দু’জনেই অবাক হয়ে গেলেন।
রুমি বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছে বলুন তো?”
কী হয়েছে সেটা আপনার সুপুত্রকে ডাকলেই জানতে পারবেন।তমাল রাগত স্বরে বলেন।
রুমি আর কথা না বাড়িয়ে বিট্টুকে ডাকতে চলে যান, যদিও ভেবে পান না বিট্টু এইমাত্র সুজয়দের বাড়ি থেকে ফিরল, আর তক্ষুনি ওরা এভাবে তাকে ডাকতে চলে এল কেন।
বিট্টু ঘরে ঢুকতেই সুজয়বাবু কোনওরকম ভনিতা না করে সরাসরি বলে উঠলেন, “বিট্টু, আমার নতুন ফোনটা কোথায়?”
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রাঘাত হলবিট্টুর চোখেমুখে প্রবল বিস্ময়, “কাকু, তোমার ফোন তো আমি টেবিলের ওপর রেখে চলে এসেছিলাম!
তাই নাকি! তাহলে তুমি চলে আসার পর ফোনটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন?” বাঁকা স্বরে বললেন সুজয়।
বিশ্বাস করো, কাকু। আমি কিছু জানি না।কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে বিট্টু।
এবার মুখ খুললেন রুমিকী বলতে চাইছেন আপনারা? আমার ছেলে আপনার ফোন চুরি করেছে?”
ধরতে গেলে সেটাই। ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না, ফোনটা ওর খুব পছন্দ হয়েছিল কি না। অনেকগুলো সেলফিও তো তুলেছে ও। দাম কম নয় ফোনটার, তিরিশ হাজার।
ও একটা ভদ্র পরিবারের ছেলে,গর্জে উঠলেন রুমি।
এসব তো বলবেনই কথায় আছে না, চোরের মায়ের বড়ো গলা,ব্যঙ্গের সুরে বললেন তমাল।
কী যা তা বলছেন তখন থেকে?” গর্জে উঠলেন শোভন।
আমরা যা তা কিছু বলছি না। আপনার ছেলে যদি ধোয়া তুলসীপাতা হয় তাহলে আমাদের ওর রুম সার্চ করতে দিন।
ঠিক আছে, তাই চলুন।
বিট্টুর দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তমালকাকু আর সুজয়কাকুর এরকম দাঁত-নখসর্বস্ব চেহারা ও কল্পনাও করতে পারেনি। বিট্টুর রুমে ঢুকে খাটের ওপর রাখা ওর ব্যাগটা দেখিয়ে তমাল বললেন, এটা নিয়েই আমাদের বাড়ি গিয়েছিল না?”
হুম, এটা দিয়েই খোঁজা শুরু করি,সুজয় বললেন।
ব্যাগটার চেনগুলো খুলে খুলে দেখতে লাগলেন ওঁরা। অবশেষে ব্যাগের একটা ছোটো পকেট থেকে বেরোল পাতলা ফোনটা। ফোনটা হাতে নাচিয়ে সুজয়বাবু বাঁকা হেসে বললেন, “এবার কী বলবেন? ভদ্র পরিবারের ছেলে!
মা, বিশ্বাস করো, আমি নিইনি!বিট্টু আর্তনাদ করে উঠল।
রুমি নির্বাক হয়ে ফোনটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শোভনের মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
ছিঃ! বিট্টু, ছিঃ! তোমাকে কত স্নেহ করতাম আমরা, আর তুমি তার এই প্রতিদান দিলে!
কাকু, বিশ্বাস করো…”
বিশ্বাস করার জায়গায় তুমি আর নেই, বিট্টু।
এসবের মাঝেই শোভনের ফোনটা বেজে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাতে নিয়ে দেখলেন, অজানা নম্বর। ধরবেন কি ধরবেন না ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরেই ফেললেন। আবার সেই জলের আওয়াজ আর তারপর, “কী রে, এবার নিজের ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ কর।”
তু-তুই!
হ্যাঁ, আমি রে। বেঁচে থাকতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারিনি কিন্তু দ্যাখ, মরণের ওপার থেকে তোর ছেলেকে চোর বানিয়ে দিলাম। তুই এখন চোরের বাবা। খুব কষ্ট হচ্ছে, অপমানিত লাগছে, না রে? আমার মায়েরও লেগেছিল। যাই হোক, আমার কাজ শেষ। গুড বাই।
না না, সজল শোন!চিৎকার করে উঠলেন শোভন।
ও-প্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হয়েছে। শোভন জানেন, কল ব্যাক করেও লাভ নেই। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলেন শোভন, সব আমার জন্যে। আজ আমার দোষে বিট্টু…”
এ আবার কী নতুন নাটক শুরু করলেন আপনি?বিরক্ত হয়ে বলেন সুজয়।
রুমি আর বিট্টুও অবাক। শোভন কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন তারপর বললেন, “আমি কিছু বলতে চাই প্লিজ, একটু সময় করে শুনবেন। প্লিজ।
সুজয় আর তমাল পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে বললেন, “তাড়াতাড়ি বলুন, কী বলবেন।
শোভন বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শুরু করলেন। একেবারে সেই কিশোরবেলার শ্যামলপুরের ঘটনা থেকে শুরু করে একটু আগের ফোন কল পর্যন্ত বলে থামলেন। ঘরের মধ্যে শুধু একটা টিকটিকির টিক টিক আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পরে শোভন নিজেই নীরবতা ভঙ্গ করলেনজানি আপনারা বিশ্বাস করবেন না কিন্তু এটাই সত্যি।
বাবা, তুমি তো খুনি! তোমার জন্য একজনের জীবনটাই…” কথা শেষ করতে পারল না বিট্টু।
তুমি এত হিংসুটে আমি কোনওদিন ভাবতেই পারিনি!রুমিদেবীর গলা থেকেও বিস্ময় ঝরে পড়ে।
তোমরা আমাকে ক্ষমা করো
ক্ষমা চাইতে হলে সজলের মায়ের কাছে গিয়ে চাও,রুমি বলেন।
অনেক দেরি হয়ে গেছে, বৌদি। সজলের মা আর এই পৃথিবীতে নেই।তমাল বললেন।
সজলের মা ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারেননি। পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বলতেন, তাঁর সজল জলের তলায় লুকিয়ে আছে। সজলের মৃত্যুর ছ’মাস পরে একদিন ছেলেকে খোঁজার উদ্দেশ্যে সবার চোখ এড়িয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন।ধরা গলায় বললেন সুজয়।
শোভনরা তিনজনে চরম বিস্ময়ে সুজয়দের দিকে তাকালেন। সুজয় এবার সোজাসুজি শোভনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বড়োলোক বাড়ির আলালের দুলাল শোভন রায়ের হয়তো মনে নেই, সজলের একটা ভাই ছিল, উজ্জ্বল।
উজ্জ্বল!শোভন চমকে ওঠেন।
হুম আমি উজ্জ্বল তবে এখনও তোমার আমার সামাজিক অবস্থানে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আর এই পার্থক্যের পার্থক্য হল, সেদিন তুমি ওপরে ছিলে বলে আমার দাদা শেষ হয়ে গিয়েছিল আর আজ আমি ওপরে বলে তোমার স্ত্রী-পুত্রের সামনে তোমার কদর্য রূপটা প্রকাশ হয়ে গেল।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!রুমি বলে ওঠেন।
তাহলে শুনুন, বৌদি। আমি উজ্জ্বল জানা। শ্যামলপুর স্কুলের সেই সজল জানার ছোটো ভাই, আর তমাল বলে যাকে আপনারা জানেন সে আমার মামাতো ভাই কাজল। আমার দাদা পড়াশোনায় ভীষণ বুদ্ধিমান হলেও মনটা খুব সরল ছিল তাই শোভনদাকে চিনতে ভুল করেছিল কিন্তু আমি অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, শোভনদার আপাত নিরীহ চেহারার পেছনে একটা হিংসুটে মন আছে। দাদাকে বলেওছিলাম কিন্তু দাদা তখন বিশ্বাস করেনি। পরে মৃত্যুর আগে অবশ্য দাদাও বুঝে গিয়েছিল।
সজল বলে যে বাবাকে...
বিট্টুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুজয় ওরফে উজ্জ্বল বলে ওঠেন, “জানো বিট্টু, তোমার বাবার ওই অকারণ হিংসের কারণে আমি অনাথ হয়ে গেলাম। অনেক ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। মা আর দাদাই ছিল আমার দুনিয়া। একদিন দেখলাম আমি সম্পূর্ণ একা। আমার মামা-মামিমা দু’জনেই খুব ভালো মানুষ, না হলে আমি যে কোথায় ভেসে যেতাম তার ঠিক নেই। মামার স্বল্প আয়ের মধ্যে আমাকে আর কাজলকে মানুষ করতে কী কষ্টটাই না করেছেন। ঈশ্বর আমাদের অর্থ না দিলেও তিন ভাইকেই মাথাটা দিয়েছিলেন। তাই দারিদ্রের মধ্যেও নিজেদের চেষ্টায় আর কিছুটা মানস স্যারের সাহায্যে আজ আমি ভারতের সেরা হার্ট স্পেশালিস্টদের মধ্যে একজন, আর কাজল কলেজের প্রফেসর। আজ আমাদের অনেক টাকা কিন্তু প্রতিদিন যখন ভালো ভালো খাবারগুলো মুখে তুলি, চোখের সামনে আমার মায়ের অনাহারক্লিষ্ট মুখটা ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় দাদার কথাগুলো। দাদা বলত, ভালো পড়াশোনা করে অনেক বড়ো চাকরি করবে তখন মায়ের কোনও কষ্ট থাকবে না। অর্থ, নাম, যশ, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার - সব আছে আমার কিন্তু তাও এতবছরে আমার চোখের জল শুকোয়নি আর তাই বোধহয় ভগবান আমার সামনে পথ খুলে দিলেন
একটানা এতটা বলে উজ্জ্বল একটু থামতে কাজল বলতে শুরু করলেন, “একদিন আমার কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট-এর এক প্রফেসর একটা অনুরোধ নিয়ে এলেন ওঁদের ডিপার্টমেন্ট-এর ফার্স্ট ইয়ারের একটি মেধাবী ছেলের মায়ের গুরুতর হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে। বাড়ির অবস্থা ভালো নয় আমি যদি আমার দাদাকে বলে কিছু ব্যবস্থা করতে পারি। ছেলেটি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার সামনে অবিকল আমার বড়দা দাঁড়িয়ে ছিল, শুধু গালের দাগটা বাদ দিয়ে। আমার সেই বড়দা যাকে চোখের সামনে একমুঠো ছাই হয়ে যেতে দেখেছিলাম। ছোড়দাকে দিল্লিতে ফোন করে সব জানালাম, আর তারপরেই আমাদের প্ল্যান তৈরি হল
প্ল্যান?” বিট্টুর অবাক প্রশ্ন।
এবার উজ্জ্বল বললেন, “হ্যাঁ, প্ল্যান। অর্থ বাড়লে বোধহয় মানুষের মনুষ্যত্ব কমে যায়। আমারও কমে গেছে, তাই বোধহয় পারলাম অসুস্থ মাকে নিয়ে অসহায় ছেলেটাকে প্রস্তাবটা দিতে। রাজু, মানে ওই ছেলেটিকে এবং ওর বাবাকে বললাম, ওর মায়ের চিকিৎসার সব খরচ আমার। দিল্লি নিয়ে গিয়ে দরকারে নিজের বাড়িতে রেখে ওঁকে সুস্থ করব। রাজুর লেখাপড়ার সব খরচ দেব পরিবর্তে আমার মৃত দাদার আত্মার ভূমিকায় কয়েকদিনের জন্য অভিনয় করতে হবে। ওদের কাছে আর রাস্তা ছিল না, তাই রাজি হয়ে গেল।
“কাজল এখানকার সমস্ত খবর জোগাড় করল। ফেসবুক থেকে শোভনদা এখন কোথায় কী করছে প্রাথমিক সমস্ত খবর পেয়ে গেল। বাকি খবরারাখবর একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে টাকা দিয়ে জোগাড় হয়ে গেল। একজন পেন সংগ্রাহকের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ওই পেনদুটো সংগ্রহ করলাম। রাজুর মায়ের অপারেশন করে দিয়ে আমি লম্বা ছুটি নিয়ে এখানে এলাম। কাজলও ছুটি নিল আর আমরা ভাগ্যক্রমে তোমাদের পাশের বাড়িটাই পেয়ে যাওয়ায় আরও সুবিধা হল আমাদের। রাজুকে অন্য একটা জায়গায় রাখলাম। ঈশ্বরও প্রতি পদে আমাদের সহায় হয়েছেন। সেদিন ওইরকম ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় লাল রঙের কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে রাজু ভালোই ভয়টা দেখিয়েছিল। শোভনদা ভয়ে হার্ট ফেল করলেও আমার খুব একটা দুঃখ হত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও হৃদয়হীন হয়ে গেছি বোধহয়।
“তোমাদের হয়তো খুব অবাক লাগছে এই ভেবে যে আমরা শুধু শুধু এত কিছু করলাম কেন? কী লাভ হল আমাদের? সত্যি কথা কী জানো, আমি চেয়েছিলাম একবার অন্তত শোভনদা নিজের মুখে নিজের অপরাধ স্বীকার করুক। বলতে পার, শুধু নিজের মানসিক শান্তির জন্য আমি এসব করেছি। একটা চোদ্দ বছরের ছেলে আচমকাই তার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল। আজ তার কাছে অনেক কিছু থাকলেও তার মা আর দাদা নেই। বহু গরিব মানুষকে আমি সাহায্য করি, কিন্তু তাও যেন আমার মনের জ্বালা জুড়োয় না। আমি চাইলে আরও অনেক লোকজনের সামনে শোভনদাকে ফাঁদে ফেলে অপমান করতে পারতাম কিন্তু তাহলে মহাদেব রায়ের নাতি শোভন রায় আর মিনতি জানার ছেলে উজ্জ্বল জানার মধ্যে কোনও তফাত থাকে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উজ্জ্বল।
আমাকে ক্ষমা করে দিস, উজ্জ্বল,ধরা গলায় বললেন শোভন।
আমার কাছে তোমার ক্ষমা নেই, শোভনদা। তবে আজ অল্প সময়ের জন্য হলেও আমার মায়ের সেদিনের যন্ত্রণা তুমি উপলব্ধি করেছ তাছাড়া আজ তোমার নিজের ছেলে তোমাকে খুনি বলেছে কিছুটা শাস্তি বোধহয় তুমি পেয়েই গেছচললাম আর কখনও হয়তো দেখা হবে না।
উজ্জ্বল আর কাজল বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফোনটা বিট্টুর হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোর জন্যই কিনেছিলাম। তুই খুব মিষ্টি আর সরল ছেলে। চিরকাল এই বিট্টু হয়েই থাকিস। রায় বংশের ধ্বজাধারী হয়ে উঠিস না।
_____
ছবিঃ দীপিকা মজুমদার

No comments:

Post a Comment