ম্যাজিক লন্ঠনের কেরামতি
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
।। এক ।।
মামার বাড়ি পান্ডুয়া থেকে
ফিরছে সৌরভ। ফিরবে রিষড়ায় তাদের নিজেদের বাড়ি। বড়োদিনের
সপ্তাহ খানেকের ছুটিতে মামার বাড়ি এসেছে মামিমার ডাকে। মামিমা তাকে খুব ভালোবাসে।
যত্ন করে রেঁধে খাওয়ায়। সৌরভেরও পেটুক বলে সুখ্যাতি আছে। কিন্তু তার মা অসুস্থ বলে
নিজে রাঁধতে পারে না। একজন রান্নার মাসি আছে বটে, তবে সে দুটো বা তিনটের বেশি পদ
কিছুতেই রাঁধবে না। আর সে রান্নাও তেমন মুখে দেওয়ার মতো নয়। সে রান্না খেতে খেতে
চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে সৌরভের। আর ভাবে শুধু সেই দিনগুলোর কথা, যখন তার মা তার জন্য কতরকম সুন্দর সুন্দর খাবার করে দিত। মায়ের ওপর খুব
অত্যাচার করত। অত্যাচার মানে অবশ্য ‘এটা করো, ওটা করো’
বলে আবদার। শেষদিকটায় মায়ের খুব কষ্ট হত বুঝত সৌরভ। নিজের অত বড়ো
অসুখের কথাটা মুখ ফুটে জানায়নি তার মা। কিন্তু একসময় আর পেরে উঠল না। বিছানাই নিয়ে
নিল প্রায়। পাকাপাকি বিছানা নেওয়ার আগে হাসপাতাল থেকে দিন দশেক ঘুরে আসতে হয়েছিল।
ডাক্তার খুব শক্ত কী একটা অসুখের কথা বলেছিল। কিন্তু ক্লাস নাইনের সৌরভ অত মনে
রাখতে পারেনি। তখন থেকে কাজের মাসির সঙ্গে রাখা হয়েছিল রান্নার মাসিও। মন এতটুকু
ভরে না তার। মাসিও রান্না করে সয়াবিন না কীসের ধোকার ডালনা। কিংবা কখনও সজনে-ডাঁটা
পোস্ত। কিন্তু তার মনে হত মায়ের করা সেই রান্নাগুলোয় যেন কেমন মা মা গন্ধ থাকত।
থাকত একটা মা মা স্বাদ। সে কি কখনও ভোলার?
তার মামিমা এই পেটুক ভাগনের
খাবার কথা জানে ভালো করে। তাই প্রায়ই তার জন্য মামার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নিজের
হাতের ভালোমন্দ রান্না। মামা কলকাতায় চাকরি করে। রিষড়ার ওপর দিয়েই তো যেতে হয়
তাকে। আর তাদের বাড়ি স্টেশনের একেবারে কাছে চার বাতিতে। তাই খুব একটা অসুবিধে হয়
না।
সৌরভের মনে হয় রান্না শুধু
রান্নাই হয় না। সেটা সুখাদ্য তখনই হয় যদি এতে মিশে থাকে স্নেহ-ভালোবাসা। মায়ের
রান্নায় যা থাকে। মামির রান্নাতেও থাকে। মামি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসে। মামির
কোনও ছেলেমেয়ে নেই। তাই সব ভালোবাসা তাকে উজাড় করে দেয়।
আজ এই দিন চারেক ধরে মামার
বাড়ি মামির আদর খেয়ে সে খুব খুশি। শুধু আদরই নয়, সেই সঙ্গে নিত্যনতুন রান্না। আজ
ফেরার দিনের সন্ধেতে এক পেট শুধু খাওয়াই হয়নি, সেই সঙ্গে টিফিন
কৌটোয় ভরে দিয়েছে চিকেন-বিরিয়ানি আর কষা মাংস। সেই সঙ্গে বড়ো কিছু রাজভোগ। আরও
অনেক মিষ্টি। রাস্তায় যদি খিদে পায় তো খায় যেন সে।
সৌরভ বলল, “রাস্তায় আর খেতে পারব না গো, মামি। একেই যা খাইয়েছ তাতে আজ রাতেই আর কিছু
খেতে পারব কি না ঠিক নেই।”
“পাগল ছেলে। এইটুকু বাচ্চা
ছেলে! এই তো তোদের খাওয়ার বয়েস,” মামি হেসে বলেছে, “বেশ, আজ না
পারিস, কাল অন্তত খেয়ে নিস সোনা। নষ্ট করিসনি। আর বাবা-মাকেও দিবি।”
পাগল নাকি? মামির হাতের খাবার আর স্বর্গের লক্ষ্মীর হাতের অমৃত এক কথা। সে কি নষ্ট
করতে পারে কখনও? বলল, “তুমি ভেব না গো,
মামি। আমি সব খেয়ে নেব।”
আজ মামার অফিসের ছুটির দিন।
ভাগনেকে স্টেশনে দিয়ে গেল। একেবারে ট্রেনে তুলে দিয়ে হাত নেড়ে তবে গেল সে স্টেশন
ছেড়ে। আর আজ ছুটির দিন, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। বেশ আরাম করে জানালার ধারে বসল সে।
মামি বারবার বলে দিয়েছে যদিও, “মানা সোনা, এই শীতে একেবারে
জানালার ধারে বসিস না। আর বসলেও উলটোদিকের সিটে বসবি। মানে ট্রেন যেদিকে যাচ্ছে
তার উলটোদিকে।”
এমনিতেই সে দেখেছে, জানালার
ধারে দু’রকম সিট থাকে। একটা গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে মুখ করে, আর একটা
তার উলটোদিকে। শীতকাল বা গরমকাল অনুযায়ী মানুষ সিটগুলো পছন্দ করে। গরমকাল হলে গাড়ি
যাওয়ার দিকে আর শীতকালে তার উলটোদিকে।
সে উলটোদিকেই বসেছে। গাড়ি
ফাঁকা তাই, নাহলে এই শীতকালে এই সিট আগে ভর্তি হয়ে যায়। তবুও গায়ে ভালো করে জড়িয়ে
নিয়েছে একটা মোটা চাদর। একে ঠাণ্ডা, তাতে সন্ধে পেরিয়ে রাত বেশ একটু হয়েছে। এমনিতে
শীতকাল হলেও ঠাণ্ডা হাওয়া তার দিব্যি লাগে। কিন্তু মামিকে সে কথা দিয়েছে ঠাণ্ডা
লাগাবে না। মামি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসে। তার দেওয়া কথা কি সে ফিরিয়ে দিতে পারে?
।। দুই ।।
আদি সপ্তগ্রাম পর্যন্ত দিব্যি
এল গাড়িটা। তারপর আর নড়ে না। আধঘন্টার ওপর হয়ে গেল। নানা কানাঘুষোয় শোনা গেল হুগলী
না কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একটা মালগাড়ি উলটে গিয়ে আপ-ডাউন সব লাইন ব্লক করে
দিয়েছে। তাই ব্যান্ডেলে একটাও প্ল্যাটফর্ম খালি নেই যে গাড়ি ঢোকাবে।
খুব চঞ্চল হয়ে উঠল সৌরভ। ইশ্,
এমন একটা ছোটো স্টেশন যে এখান থেকে যাওয়ার অন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। মগরা হলেও না হয়
কথা ছিল। মগরা স্টেশন থেকে বাস ছাড়ে। কিন্তু এখন বাজে প্রায় ন’টা চল্লিশ। ইশ্, এখন
কী হবে! বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে। বাবা অফিস থেকে ফিরে দৌড়োদৌড়ি করছে। হয়তো মামার
বাড়ি ফোন করছে। মামাও নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা করছে।
এই সময় একটা মোবাইল থাকলে
ভালো হত। কিন্তু বাবা তাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয় না। বলে
মোবাইল খুব খারাপ। খুব বেশি ব্যবহার করলে নাকি চোখ খারাপ হয়, ঘুম কমে যায়। আর কী কী সব হয়, কোথায় পড়েছে নাকি কার কাছে শুনেছে সৌরভ।
ঠিক বলতে পারবে না। কিন্তু এই সময় সেটা থাকলে কত ভালো হত। খবর একটা পাঠানো যেত।
আবার ভাবে, খবর পাঠিয়েই বা কী
হবে? এমন জায়গায় গাড়ি আটকেছে যে নিজের বাড়ি বা মামার বাড়ি কোথাও
থেকেই এসে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাতে রাত এখন বেশ হয়ে গেছে।
সবাই অধৈর্য হয়ে নিচে নেমে
পড়েছে। স্টেশনের অফিস থেকে মাঝে মাঝে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে যে গাড়ি কখন ছাড়বে তার
ঠিক নেই। সৌরভও নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। গিয়ে বসল একটা গাছের নিচে কতগুলো লোহার রেলিং
যেখানে ফেলা ছিল তার ওপর। নাহলে তো বসার জায়গা এতটুকু নেই কোথাও।
একটা একটু ময়লা ছেঁড়া পোশাক
পরা লোক তার কাছে ভিক্ষে চাইল। লোকটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হল সত্যি কিছু খাওয়া
হয়নি বেচারির। একে আর এক টাকা দু’টাকা ভিক্ষে দিয়ে কী হবে? লোকটা খাবার জন্য কিছুই পাবে না সামান্য এক টাকা বা দু’টাকা দিয়ে। তার খুব কষ্ট হতে লাগল ভিখিরিটার জন্যে।
আচমকা তার সঙ্গের মামির দেওয়া
খাবারটার কথা মনে পড়ে গেল। পেট যা ভর্তি, তাতে আজ আর তাকে কিছু খেতে হবে না। ব্যাগ
থেকে কৌটো বার করে খাবার দিল খেতে। কিছু রাখল মা আর বাবার জন্যও। বাবাও
মামির খাবার খেতে খুব ভালোবাসে। আর এখন বাড়িতে তেমন ভালোমন্দ কিছু হয়ও না।
ভিখিরিটা যেন গোগ্রাসে গিলছে।
তাকে অবাক করে দিয়ে কৌটোর সব খাবার খেয়ে নিল। একটু মনখারাপ লাগছিল তার বাবা-মা
খেতে পাবে না বলে। কিন্তু ভিখিরিটার দিকে চেয়ে দেখল, খুব খুশি খুশি মুখ। তার মনে
হল, মানুষ সবচেয়ে খুশি হয় যখন সে খেতে পায়। বিশেষভাবে ক্ষুধার্ত কেউ যখন কিছু খেতে
পায়।
ভিখিরিটার মুখের দিকে তাকিয়ে
খুব ভালো লাগল সৌরভেরও।
“আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার
খাবার খেয়ে,” লোকটা বলল, “প্রায় দিন দুয়েক কিছু খেতে পাইনি। তোমার
ভালো হোক এই কামনা করি।”
সৌরভেরও খুব ভালো লাগল। লোকের
ভালো করলে খুব ভালো লাগে তার। সে একটু লজ্জার হাসি হাসল। ঘাড় নেড়ে জানাল, তারও খুব
ভালো লেগেছে খাওয়াতে পেরে।
সেই পড়ে থাকা রেলিংয়ের ওপর
বসে সৌরভ। লোকটা মাটিতে বসে। তারপর উঠে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের কল থেকে মুখ ধুয়ে আর এক
পেট জল খেয়ে এল।
“এত ভালো খাবার আমি বহুদিন
খাইনি, জানো ভাই।” লোকটা বলল।
বেশ কৌতূহলী হল সৌরভ। অন্য
ভিখিরি হলে তো খাবার নিয়ে বা খেয়েই চলে যেত। এতক্ষণ অপেক্ষা করত না। খাবারের
প্রশংসা করত না, আবার তাকে ভাই বলে ডেকে আলাপ জমাতে চাইত না। তা গাড়ি যে কখন নড়বে
তার তো কোনও ঠিক নেই। সময় কাটানোর পক্ষে একটা সঙ্গী পাওয়া ভালো। অন্তত
কয়েকটা কথা তো বলা যাবে। জিজ্ঞেস করল, “কোথায় থাক তুমি?”
“আমি?”
কাকে বলছে ঠিক যেন বুঝতে না
পেরে লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন নিশ্চিন্ত হল যে কথাটা তার উদ্দেশেই বলা তখন সে
বলল, “ভগবানের আশ্রয়ে।”
সৌরভ ঠিক বুঝতে পারল না।
ভগবান অনেকের নাম হতে পারে। তাহলে সেই ভগবান বলে মানুষটার কাছেই থাকে নাকি? কিন্তু ভগবান লোকটাই বা কেমন যে একটা লোককে খেতে দেয় না? সে কিছু বলল না। শুধু বলল, “ভগবান কে?”
লোকটা কিছু বলল না। কিন্তু
তার ময়লা থলি থেকে কী একটা জিনিস সৌরভের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নাও।”
সৌরভ তো অবাক। যে লোকটা তার
কাছ থেকেই চেয়ে খাবার খেল, তার কাছে আবার উপহার দেবার মতো কী থাকতে পারে সে বুঝতেই
পারে না। সকৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”
“দেখো, তুমি তোমার জন্যে রাখা
সব খাবার আমাকে দিয়ে আমার এত উপকার করলে, আমারও তো তোমাকে কিছু দেওয়া দরকার, বলো?”
কিন্তু বেশ রাগ হল সৌরভের।
একটু আগে লোকটাকে খাওয়াবার জন্য মনে যে আনন্দ হয়েছিল এখন সেটা হাওয়া হয়ে গেল। বেশ
একটু চুপসে পড়ল। বাবা বলে, কোনও লোকের উপকার করে প্রতিদানে কিছু নিও না। তাহলে
তাকে সাহায্য করার কোনও মানেই হবে না।
“নাও, ধরো এটা,” লোকটা আবার
তাকে বলল। এবার এমন করুণ সুরে যে সৌরভ জিনিসটার প্রতি আগ্রহী না হয়ে পারে না।
“বাবা বলেছে, কাউকে সাহায্য
করে বিনিময়ে কিছু নিতে নেই।”
“আরে দূর। তুমি তো বিনিময়ে
আমার কাছে কিছু চাইছ না। আমি নিজে দিচ্ছি। তুমি যেমন ভালোবেসে
আমাকে খাওয়ালে, আমি তেমনি ভালোবেসে তোমাকে এটা দিতে চাইছি। যদি না নাও তো ভাবব ভিখিরি
বলে আমায় তুমি অবহেলা করছ।”
ভালোবাসার কথা শুনে মন একটু
নরম হল সৌরভের। ভালোবাসার কথায় মায়ের কথা মনে পড়ল। মামির কথা মনে পড়ল। বাবার কথা
মনে পড়ল। সে কিন্তু এদের কাছে কোনওদিন কিছু চায়নি। ভালোবেসেই এরা যা দেবার তা
দিয়েছে। কিন্তু এই ভিখিরি যার কাছে নিজের খাবার জন্য একটা পয়সা থাকে না, তার কাছ
থেকে কিছু কি নেওয়া উচিত? একবার ভাবল, কিছু না নিয়ে জোর করে উঠে চলে
যায় অন্য জায়গায়। কিন্তু আবার ভাবল, লোকটা যদি কিছু মনে করে? লোকটা গরিব বলে কি তার কোনও সম্মানবোধ থাকতে নেই?
জিনিসটা কী এই আবছা অন্ধকারে
সে তেমন বুঝতে পারছে না। মনে হল একটা টর্চ জাতীয় কিছু। কিন্তু এত জিনিস থাকতে একটা
টর্চ তার কীরকম উপহার হতে পারে সে বুঝতে পারছে না।
“নাও, রাখো,” সস্নেহে বলল
লোকটা।
টর্চটা হাতে নিয়ে জ্বালল সে।
বেশ মিষ্টি একটা নীল আলো জ্বলছে। অদ্ভুত রকমের।
“এটা নিয়ে আমি কী করব? আমার বাবার তো দু-দুটো টর্চ।”
এই আধা অন্ধকারেও লোকটার
মুখের হাসি দেখতে পেল সৌরভ। “এটা যেমন তেমন টর্চ নয় গো।”
“তবে?”
“এটা হল ম্যাজিক লন্ঠন।”
এবার সৌরভ খুব আগ্রহী হয়ে
পড়ল। হাতে নিয়ে নাড়তে-চাড়তে বলল, “এটা ম্যাজিক দেখাবে? কী ম্যাজিক গো?”
“সময়েই সব জানতে পারবে। তবে
মনে রেখ, এর আলো শুধু যার হাতে থাকে সে ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। আর একে কখনও
খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার কোরো না। তাহলে এই ম্যাজিক লন্ঠন কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে
যাবে চিরদিনের মতো।” বলতে বলতে লোকটার গলার স্বর ক্রমশ কমতে কমতে
মিলিয়ে গেল। টর্চ থেকে মুখ তুলে সৌরভ দেখল, কোথাও লোকটার চিহ্নমাত্র নেই।
।। তিন ।।
পরে দেখা যাবে বলে টর্চটা
আপাতত চেন খুলে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল সৌরভ। উঠে পড়ল সে। কী জানি এবার দেখতে হয় ট্রেন
ছাড়ল কি না। ট্রেনের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু
লোকগুলো জড়ো হয়ে আছে ট্রেনের আশেপাশে। ভেতরে
বসে খুব অল্প লোক। বেশিরভাগ বাইরে ট্রেনের দরজা বা জানালার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে।
অনেকের চোখ ঠায় সিগন্যালের দিকে। লাল চোখ কখন করুণার দৃষ্টি পেয়ে সবুজ হবে এই
আশায়।
বেশ কিছুক্ষণ সিগন্যালের দিকে
তাকিয়ে ছিল সৌরভও। কিন্তু কিছু হয়নি দেখে ভাবল ট্রেনে উঠে গিয়ে বসে। কিন্তু এমন
সময় কয়েকজন লোক বলাবলি করতে লাগল, তারা নাকি এনকোয়ারিতে জিজ্ঞেস করে আসছে। ওরা
বলেছে ট্রেন ছাড়ার আপাতত কোনও ভরসা নেই। তেমন হলে এই ট্রেনটাকে আবার উলটোদিকে,
মানে বর্ধমানের দিকে ঘুরিয়ে দেবে।
অগত্যা আবার গিয়ে আগের জায়গায়
বসে পড়ল সৌরভ। এদিকটায় একটু আবছা অন্ধকার, তাই কারোর চোখে পড়েনি বিশেষ। এখনও
ফাঁকাই আছে।
কিছুক্ষণ বসে বসে খুব একঘেয়ে
লাগল। হঠাৎ মনে পড়ল সেই ভিখিরিটার কথা। তার দেওয়া ম্যাজিক লন্ঠনের কথা। খুব কৌতূহল
হল তার। ব্যাগ থেকে বার করল সেটা। একটা সুন্দর ঝকঝকে রঙিন টর্চ। নানারকম নকশা করা।
টিপে দিল বোতাম। সুন্দর
মিষ্টি একটা নীল আলো। কী খেয়াল হল, টর্চের আলোটা সে একদিক থেকে অন্য আরেকদিকে
ফেলতে লাগল। ছেলেমানুষি খেয়াল যাকে বলে।
একটা লোকের গায়ে গিয়ে আলোটা
হঠাৎ সবুজ হয়ে গেল। আর স্থির হয়ে গেল সেখানে। আর সৌরভের চোখের সামনে কেমন একটা
সিনেমার মতো ছবি চলে এল।
সে আর প্রকাশকাকু একটা টোটোয়
উঠে যাচ্ছে। টোটো গিয়ে হাজির হল চুঁচড়ো স্টেশনে। প্রকাশকাকু বাবার বন্ধু। চুঁচড়ো
খাদিনা মোড়ে থাকে। প্রকাশকাকু তাকে চুঁচড়ো স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে দিয়ে গেল। আবার
নিজের মোবাইল থেকে বাবাকে ফোন করে সব জানিয়ে তাকে চিন্তা করতে বারণ করল।
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হুগলীতে। যে গাড়িগুলো হাওড়ার দিক থেকে আসছে সেগুলো সব চুঁচড়ো
স্টেশন থেকে ঘুরে যাচ্ছে। রাত এগারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল সৌরভ।
কিন্তু এই যা। এটা তবে স্বপ্ন
ছিল নাকি? সে তো আদি সপ্তগ্রামেই বসে আছে। তবে যার পিঠে টর্চের আলো পড়ে
সবুজ হয়েছিল তাকে হঠাৎ যেন প্রকাশকাকু বলেই মনে হল তার। দৌড়ে সামনে গিয়ে দেখল,
সত্যি তো প্রকাশকাকু! তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে
তুই এখানে? এত রাতে?”
খুব ভরসা পেল সৌরভ একজন চেনা
লোককে দেখে। সংক্ষেপে সব সে বলল। শুনে কাকু বলল, “শোন, আমাকে
তো বাড়ি পৌঁছতেই হবে। আমি একটা টোটো কি অটো ভাড়া করছি। একজন বলল, পাওয়া যেতেও
পারে। আর শুনলাম, হাওড়ার গাড়িগুলো সব চুঁচড়ো থেকে ফিরে যাচ্ছে। আর এদিকের গাড়িও আর
যাবে না অথবা যেতে যেতে কাল সকাল হয়েও যেতে পারে। আমি বরং তোকে চুঁচড়ো স্টেশনে
তুলে দিয়ে বাড়ি চলে যাব।”
চুঁচড়ো স্টেশনে একটা গাড়ি
দাঁড়িয়ে। এটা হাওড়া থেকে এসেছে। এক্ষুনি আবার হাওড়ায় ফিরে যাবে। স্টেশন থেকে নিজের
মোবাইলে বাবাকে ফোন করে দিল প্রকাশকাকু। বাবাকে এসে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রিষড়া স্টেশনে। রাত সাড়ে এগারটায় সে বাড়ি পৌঁছে গেল।
রাত্রে তার ভালো করে ঘুম হল
না। ভাবছিল প্রকাশকাকু স্টেশনে ছিল বটে, কিন্তু ওই ভিড়ে তাকে
তো সত্যি খুঁজে পেত না সে যদি না টর্চের আলো পড়ে রঙ পালটে সবুজ হত। আর সেই
স্বপ্নটা? সেটা তো আর স্বপ্ন থাকল না, পরে তো সত্যি হয়ে গেল।
তার মানে এই টর্চ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? কিংবা দেখাতে পারে তা
টর্চের মালিককে?
সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যেতে
লাগল তার। সত্যিই তো, এই টর্চ না থাকলে সারারাত যে তাকে স্টেশনে বসে থাকতে হত। আচ্ছা,
এটা কোনও ভূতুড়ে টর্চ নয় তো? যে লোকটা দিল সে মানুষ, নাকি
কোনও ভূত? কিন্তু ভূতে কি চিকেন-বিরিয়ানি আর কষা মাটন খায়?
নাকি রাজভোগ খায় গপগপ করে?
একসময় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল
সে।
।। চার ।।
এই টর্চের কথা কাউকে সে
বলেনি। কিন্তু নিজে মনে রেখেছে। সব সময় এটা তার ব্যাগে থাকে। কী জানি কখন কী দরকার
হয়। তবে এর মধ্যে সে এটা নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। ভিখিরিটার কথা তার শুধু মনে
পড়ে। সে বলেছিল, দরকারের সময় শুধু এর ব্যবহার কোরো। একে
খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার কোরো না। আর তো কিছুই বলেনি সে। কিন্তু নিজেই জেনে যাচ্ছে
সৌরভ। ভবিষ্যৎ ঘটনা কিছু না কিছু আগাম জানা যায় এই ম্যাজিক লন্ঠনের সাহায্যে।
বিষয়টা আশ্চর্যজনক হলেও খুব সত্যি।
সেদিন বাবার এক বন্ধুর বাড়ি
তাদের নেমন্তন্ন ছিল। বাবার আর তার। মায়েরও ছিল, কিন্তু মা তো আর এখন কোথাও যেতে
পারে না। বন্ধুর বাড়ি কোন্নগরে জি.টি. রোডের ওপর। বেশ কিছুটা আছে একেবারে ফাঁকা
জায়গা দিয়ে যেতে হয়। রিক্সা করে আসছিল তারা। রিক্সাটা যাচ্ছিল একটা বড়ো পুকুরের
পাশ দিয়ে। রাস্তাটা ভালো নয়। খুব নির্জন। প্রায়ই চুরি-ছিনতাই হয়। রাস্তার আলো
প্রায় সময় খারাপ থাকে। একটু হালকা জঙ্গলও আছে। কেউ কেউ নাকি বলে, রাত একটু গভীর
হলেই ওখানে ভূত দেখা যায়।
রত্না বুড়ি ভিক্ষে করে অনেক
টাকা জমিয়েছিল। নিজে একটা পাঁউরুটি কি মুড়ি খেয়ে থাকত। লোকে বলে, সে নাকি অনেক
টাকা তার কুঁড়েঘরের পেছনে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। একদিন সেই টাকার লোভে কেউ তার গলায়
ছুরি বসিয়ে যায়। বুড়িকে অনেকেই নাকি পছন্দ করত না। বলত, বেশ হয়েছে। যেমন কিপটেমি
করে শুকনো পাঁউরুটি চিবিয়ে টাকা জমানো। তার টাকা চোর-ডাকাতে নেবে না তো কে নেবে? খুনি নাকি মাটি খুঁড়ে টাকার সন্ধান করেছিল। কিন্তু পায়নি। ধরাও পড়েনি।
কিছুদিন পরে সেই কুঁড়েতে নাকি বুড়ির ভূত দেখা যায়। বুড়ি নাকি হা হা করে হাসে জোরে
জোরে আর বলে, ‘পারলি না তো আমার টাকা নিয়ে পালাতে? এমন জায়গায় লুকিয়েছি যে কেউ পাবি না তোরা।’
রিক্সাওয়ালা বলছিল গল্পটা।
আরও বলল, “রাত ন’টার পর আর কেউ এদিক দিয়ে যায় না।”
সৌরভের খুব ভূতে ভয়। গা-টা
তার ছমছম করে উঠল। বাবার মুখের দিকে চাইল। বাবা নির্বিকার। সত্যি তো, এত বড়ো
মানুষটার কি আর ভূতে ভয় করলে চলে?
বুড়ির ভূত কি সত্যি আছে এখানে? সৌরভ ভাবল, যদি সত্যি জানা যেত তবে হয়তো অন্য রাস্তা দিয়ে যাবার কথা
রিক্সাওয়ালাকে বলা যেত। কিন্তু কেমন করেই বা সেটা সম্ভব।
এমন সময় তার মনে এল ম্যাজিক
লন্ঠনের কথাটা। এ তো ঠিকঠাক বলে দিতে পারে।
ব্যাগ থেকে সাবধানে বার করল
টর্চটা। দেখে নিল বাবা দেখছে কি না। হাতের আড়াল করে আলো ফেলল একেবারে সামনে এপাশ
ওপাশ। নীল আলো ঝরঝর করে যেন ঝরে পড়ল চারদিকে। সেই লোকটি তাকে বলেছিল, অন্য কেউ এ-আলো
দেখতে পাবে না। সেটাই যা ভরসা। তার মানে বাবা এ-আলো দেখতে পাচ্ছে না।
নীল আলো পড়ছে রাস্তার ওপর।
কায়দা করে বাঁদিক ডানদিক দিয়েও ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটু দূরে একটা বড়ো বটগাছের তলায় আলো
পড়তেই সে আলো লাল হয়ে গেল। সৌরভ তো অবাক। আলো তো নীল থেকে সবুজ হয়। লাল তো হয় না।
তাহলে?
বেশি অপেক্ষা করতে হল না।
দেখা গেল এক ভয়ংকর দৃশ্য। ঠিক যেন একটা সিনেমা। কয়েকটা লোক, হাতে তাদের চকচকে
ছুরি। সেই ছুরি দেখিয়ে লোকটা পকেটের সব টাকা কেড়ে নিল। তারপর চলে গেল।
একটু পরেই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য
হল এই দৃশ্য। ও, এই ব্যাপার! তার মানে সামনে বিপদ আছে। সেইজন্যই নীল আলো লাল হয়ে
গেছে। মানে রাস্তার ট্র্যাফিক সিস্টেমে যা হয় আর কী। কিন্তু
বাবাকে এই ছিনতাইয়ের কথা বললে তো বাবা বিশ্বাস করবে না। কারণ, ঘটনাটা তো এখনও
ঘটেনি। কিন্তু ঘটবে। তাহলে কী করা যায়? মাথায় এল একটা
জিনিস।
বাবার হাত চেপে ধরল। যেন ভয়ে
আঁকড়ে ধরার মতো। বাবা অবাক হয়ে বলল, “কী রে, কী হল তোর?”
“বাবা, আমার খুব ভয় করছে।”
“কীসের ভয়?”
“মনে হচ্ছে বুড়ির ভূত সত্যি
আছে। আমি এদিক দিয়ে যাব না।”
বাবা একটু ধমক দিল, “আহ্, কী ছেলেমানুষ হচ্ছিস দিন দিন? ভূত বলে আবার
কিছু আছে নাকি? ওসব বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য হয়।”
“না না বাবা, আমি এদিক দিয়ে
যাব না।”
তার ভয় দেখে বাবা আর কী করে।
রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল অন্য পথ আছে কি না।
রিক্সাওয়ালা বলল, “হ্যাঁ, তা আছে। কিন্তু সেটা অনেক ঘুরে ঘুরে যায়। এটা অল্প রাস্তা।”
শেষে তাকে বেশি পয়সা দিয়ে
যেতে বলা হল সেই ভালো রাস্তা দিয়ে। অনেক পিছিয়ে এসে একটা গলি ধরল সে। গলির মুখে
টর্চের আলো ফেলল সৌরভ। অনেকদূর পর্যন্ত। দেখল, নীল আলো সবুজ হয়ে গেল। আর দেখল,
তাদের রিক্সা গলি দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। তার মানে কোনও বিপদ নেই।
তিনদিন পরে জানা গেল, ওই
গলিতে পুকুরের ধারে সেই বটগাছের তলায় একজনকে ছুরি দেখিয়ে অনেক টাকা লুঠ করে নিয়েছে
একদল ডাকাত। আরেকজন টাকা দিচ্ছিল না কিছুতেই। তাকে ছুরি মেরে ফেলে চলে গেছে তার
সর্বস্ব নিয়ে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সৌরভের।
তার মানে সেই ম্যাজিক লন্ঠন না থাকলে তাদেরও একই অবস্থা হত যা ওই লোকটির হয়েছে।
ছুরির ঘা খেয়ে সে এখনও হাসপাতালে ভর্তি। বাঁচবে কি না সেটা নিয়ে নাকি প্রশ্ন উঠে
গেছে ইতিমধ্যেই।
।। পাঁচ ।।
মাকে ডাক্তার নাকি চেঞ্জে
নিয়ে যেতে বলেছে। সমুদ্রের মুক্ত হাওয়া একটু হলে খানিকটা ভালো হতেও পারে। কিছুতেই
তো কিছু হচ্ছে না। এখন দেখা যাক।
ঠিক হল পুরী নিয়ে যাওয়া হবে।
দিন সাতেকের জন্য যাওয়া। সৌরভ বায়না ধরল সে যাবে। অতএব বাবা আর কী করে! বড়োদিনের
ছুটিই বাছা হল। তাহলে যেতে কোনও অসুবিধে হবে না সৌরভের। আর সে থাকলে খুব ভালো করে
দেখাশোনাও করতে পারবে মায়ের। তাছাড়া আর কিছুদিন পরেই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু
হচ্ছে। আর তো বেরোতে পারবে না বেশ কিছুদিন।
বাবা জিজ্ঞেস করল, “কী রে, পারবি তো? পড়াশোনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?”
যদিও মায়ের যে দেখাশোনা করার
আয়া-মাসি আছে তাকে যেতে হবে। কিন্তু সারাদিন মাকে কাছে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। সৌরভ
লাফিয়ে উঠে বলল, “পারব না? কী যে বলো,
বাবা!”
সমুদ্রের ধারে একটা ছোটো ঘর
ভাড়া করা হয়েছে। বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সকালে উঠে স্নান করা মায়ের
অভ্যাস। আয়া-মাসি সেটা এখানেও তেমন করিয়ে দেয়। তারপর বারান্দায় বসে থাকে ইজি চেয়ারে।
আপাতত হুইল চেয়ার দরকার না হলেও বেশি চলাফেরা তো করতে পারে না। তাই আয়া-মাসিকে
রাখতে হয়েছে। রান্নার মাসি তো আসেনি, তাই খাবার হোটেল থেকেই নিতে হয়। ইতিমধ্যে গাড়িতে
করে মাকে মন্দির দর্শন করানো হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছে কোনারক সূর্যমন্দির, চিড়িয়াখানা, নন্দনকানন এইসব।
সেদিন বেলা এগারোটা নাগাদ মা
বলল, “তুই আর কেন ঘরে বসে থাকবি বাবা রোজ? যা
না, সমুদ্রে একটিবার চান করে আয় না। ছেলেমানুষ, ঘরে বসে থেকে আর কী হবে?”
সৌরভ আপত্তি করল, “না না, এই তো বেশ। সমুদ্র তো বেশ দেখা যাচ্ছে, মা। তাছাড়া তুমি তো আছ,
নাকি?”
বাবা বলল, “চল, আমি আর তুই চান করে আসি।”
মা সাবধান করল, “ওকে কিন্তু একা ছেড়ো না। নুলিয়া ডেকে নেবে একটা।”
সমুদ্রকে বেশ ভালোবাসে বটে সে,
তবে ভয়ও করে। মায়ের মুখে নুলিয়ার নাম শুনে বাবার দিকে তাকাল ভয় ভয় চোখ নিয়ে। বাবা
সাহস দিল, “আচ্ছা আচ্ছা, সে না হয় হবে। চান না করিস, বিচে একটু
হাঁটাহাঁটি কর না! আমি যতক্ষণ চান করব, তুই বিচে ঘোরাঘুরি করিস, আর নয় ডাব খাস।”
পুরীতে খুব চিংড়ির চপ হয়।
সৌরভের চিংড়ির চপ খেতে খুব ভালো লাগে। জিজ্ঞেস করল, “তুমি যতক্ষণ
চান করবে আমি ততক্ষণ চিংড়ির চপ খাই বাবা?”
বাবা মনে মনে হাসল, কিন্তু
মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, “বেশি নয় কিন্তু। মাত্র
গোটা দুয়েকের বেশি নয়।”
বাবা জলের দিকে গেল। সে উঠে
যেদিকে চিংড়ির চপ পাওয়া যায় সেদিকে যাচ্ছিল। গোটা দুয়েক চপ খাওয়ার পর মনে হল, একা
একা বাবা চান করছে, বাবার তো খারাপ লাগতে পারে। তার চেয়ে সে যদি পাড়ে গিয়ে বাবাকে
একটু উৎসাহ জোগাতে পারে তো ভালো হয়। তাছাড়া একা একা এখানে চপ খেতে তার ভালোও লাগছে
না।
দৌড়ে চলে এল বীচে। দেখল,
বাবা পাড়ে দাঁড়িয়ে যেন ঢেউ গুনছে। এদিকটায় তেমন ভিড় নেই। মানে এখানে কোনও লোক চান
করছে না। বাবা আবার তার মতো ঠিক মিশুকে মানুষ নয়। একা একা থাকতেই ভালোবাসে। ভালোই
হয়েছে, বাবার সঙ্গে তবে কথা বলতে পারবে সে।
বাবা এবার নামল। সে বসে রইল
বালির ওপর। বালি জড়ো করে একটু খেলা করার চেষ্টা করছিল। সে ভাবছিল, এই যে বালিশিল্পীরা
বালি নিয়ে এত সুন্দর শিল্প করে, সেটা কী করে? সে তো একটা বাড়িও
তৈরি করতে পারছে না।
হঠাৎ তার মনে হল, ম্যাজিক
লন্ঠনটা একটু বার করা যাক তো। ছোট্ট টর্চ। পকেটেই ছিল। বার করে আলো ফেলল সমুদ্রের
জলে। খেলাচ্ছলেই ফেলল। এমনিতে দিনের বেলা সে আলো তো দেখা যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু
এটা যে ম্যাজিক লন্ঠন। তাই পরিষ্কার নীল আলো দেখা গেল। আর সৌরভ জানে, এই আলো
একমাত্র সে-ই দেখতে পাবে, অন্য কেউ নয়।
জল নীল ছিল। সে দেখল, বাবা
আরও একটু গভীর জলের দিকে যাচ্ছে। আলোটা সেদিকে ফেলল সৌরভ।
কী আশ্চর্য, সে আলো একেবারে
টকটকে লাল হয়ে গেল! আর স্থির সেই আলোর ভেতর দিয়ে ম্যাজিকের মতো বেরিয়ে এল একটা
ভয়ানক দৃশ্য। বাবা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে জলের ভেতরে। আঁকুপাঁকু করছে। সৌরভ চেঁচিয়ে
উঠল পাড় থেকে। কেঁদেও উঠল। তার কান্নাকাটিতে কিছু লোক ছুটে এল। তার মধ্যে একটা
নুলিয়াও ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে টায়ার নিয়ে ঝাঁপ দিল জলে।
অতিকষ্টে বাবাকে জল থেকে তুলে এনে বালিতে শোয়ানো হল। সবাই উলটো করে শুইয়ে পেট চেপে
জল বার করতে লাগল।
খানিক পরে বাবা একটু সুস্থ
হল। সবাই বকাবকি করতে লাগল সেদিকে যাওয়ার জন্য। ওদিকে
যাওয়া বারণ। নোটিশ সাঁটা আছে, দেখেননি।
লজ্জা পেল বাবা। সবাইকে
ধন্যবাদ দিল। নুলিয়াকে একটা একশো টাকার নোট দিল তাকে খুশি করতে। আর বলল, “যদি তোমার আর কিছু দরকার লাগে তো বলো ভাই। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।
তোমার যে কোনও দরকার হলে আমাকে বলো।”
ম্যাজিক লন্ঠনের দেখানো দৃশ্য
শেষ হতেই আতঙ্কে একেবারে লাফিয়ে উঠে পড়ল সৌরভ। ম্যাজিক লন্ঠন মিথ্যে দৃশ্য দেখায়
না, এ বিশ্বাস তার হয়ে গেছে। অতএব বাবার খুব বিপদ। পাড় থেকে চিৎকার করে বাবাকে
ডাকল সে।
“কী হল, ডাকছিস কেন? তুই যা না, আরেকটা চপ খেয়ে আয়। আমাকে চান করতে দে।”
“ওদিকে যেও না বাবা, ওদিকে
বিপদ!” চেঁচিয়ে বলল সৌরভ। খুব উদ্বিগ্ন সে। কেঁদেই ফেলল ঝরঝর করে।
বাবা এবার কান দিল কথাটায়। ছেলে
তো আজেবাজে কথা বলার ছেলে নয়। তাছাড়া ওর কান্নাকাটিটাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে না গিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, “কেন, কী আছে
ওদিকে? কাঁদছিস কেন? কী বোকা ছেলে রে!”
“বলছি।
আগে তুমি ওদিক থেকে সরে এস। ওই জাল দিয়ে ঘেরা জায়গায় ঢুকো না।”
সেদিকে গেল না তার বাবা। কোনওরকমে
চান সেরে পড়িমরি করে পাড়ে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কী আছে
ওদিকে?”
“ওদিকে চোরাবালি, বাবা। ওদিকে
গেলে তুমি ডুবে যেতে।”
“কী?” বাবা তো চিৎকার করে
উঠল।
কিছু লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
তারা বলল, “দ্যাখেননি জাল দিয়ে ঘেরা আছে জায়গাটা? নোটিস দেওয়া আছে?
চোরাবালি বড়ো ভয়ংকর জিনিস মশাই। পা পড়লেই তলিয়ে যেতেন। এ জীবনে আর
উঠতে হত না।”
বাবার মুখের দিকে তাকানো
যাচ্ছে না। যেন খুব বড়ো বিপদ থেকে একটুর জন্য বেঁচে গেছে এমনি অপ্রস্তুত অবস্থা।
তবুও বলল, “কিন্তু তুই জানলি কী করে? এতদূর থেকে
তুইই বা নোটিশ পড়লি কী করে?”
একটু প্যাঁচে পড়ে গেল সৌরভ।
এখন এসব জানাতে গেলে তো অনেক কথা বলতে হয়। তাই বলল, “তুমি নামার
পর কতগুলো কাকু বলাবলি করছিল যে।”
“কী বলাবলি করছিল?”
“এই যে এখানে চোরাবালি আছে,
জলে নামা বারণ, তা কি উনি জানেন না?”
“ঠিক।
আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ভাবছি, তোর চপ খাওয়া হল না তাই। তুই বোধহয় চপ খেতে
আর যাসনি?”
চেপে যাওয়াই মঙ্গল বলে ভাবল
সৌরভ। বলল, “সে না হয় অন্য একদিন খাব, বাবা। আজ তুমি এত বড়ো বিপদ থেকে
বাঁচলে, আজ থাক।”
“আহা, থাকবে কেন? চল চল।”
।। ছয় ।।
সৌরভের কাছে এই ম্যাজিক লন্ঠন
আজ এক পরম বন্ধু। এই নিষ্প্রাণ বস্তুটা তার এত প্রিয় যে সেটাকে নিষ্প্রাণ বলে মনেই
করে না। যেন মনে হয় এরও প্রাণ আছে, আর এটা তার সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে। ভবঘুরে
লোকটা তাকে বারবার সতর্ক করেছে, ম্যাজিক লন্ঠন বার বার ব্যবহার করবে না, আর খারাপ
উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না। সে কথা ভালো করে মনে রেখেছে সে। তাই এটাকে কখনওই খেলনার
মতো সর্বদা ব্যবহার করে না।
রাত তখন ন’টা। গেটে কলিং বেল।
বাবা গেল। অন্য বাড়ির মতো তাদের বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা নয়। মানে ফাঁকা ফাঁকা
নয়। ঘেরা আগেকার দিনের দরদালানের মতো। দু’পাশে
দুটো জানালা আর মাঝে দরজা। তাই বাইরে থেকে কে বা কারা আসছে ভেতরের লোকের পক্ষে তা
দেখা সম্ভব নয়। সে জন্য দরজার পাশে একটা ছোটো জানালা আছে। সেখান দিয়ে আগে আগন্তুককে
দেখে নেওয়া হয় ভালো করে। জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় তার পরিচয়। তারপর প্রয়োজন
বুঝলে খুলে দেওয়া হয়।
“আমরা আপনার টিভি সারাতে
এসেছি। রতনদা পাঠাল।”
তাদের টিভিটা গোলমাল করছে
কিছুদিন ধরে। মেকানিক রতনের নিজেরই একটা টিভি-ফ্রিজের দোকান আছে। আগে নিজেই গিয়ে
সারিয়ে আসত দোকান বন্ধ করে। এখন কয়েকজন লোক রেখেছে। একা আর পেরে ওঠে না। তাছাড়া
দোকানে নিজে না বসলে হয় না। দোকানে খদ্দের টানা একটা অন্য জিনিস। সেটা সকলে পারে
না।
গতবার যখন টিভি খারাপ হয়েছিল
সেই সাত-আট মাস আগে, তখন সে এসেছিল এইরকম রাত প্রায় দশটায়। বাবা
খুব বিরক্ত। এমন সময় কেউ কারোর বাড়ি আসে? কিন্তু রতন বলেছিল,
“কী আর করি বলুন, দাদা? দোকানে কাস্টমারের চাপ। তাও আপনার জন্য আজ
ন’টাতেই বন্ধ করে চলে এসেছি।”
অগত্যা কী আর করা যায়! তাছাড়া
রতন পাড়ারই ছেলে। তাই তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল। তাই রতনদার স্বভাব বিলক্ষণ জানা
বাবার। এবার নিজে আসেনি। পাঠিয়েছে দুটো লোককে। অতএব খুলে
দেওয়া হল গেট। লোকদুটো ব্যাগ হাতে নিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। ব্যাগ খুলে যন্ত্র বার করে
টিভি সারাতে বসে গেল।
সৌরভের পড়ার ঘরের জানালা থেকে
দেখা যায় ডাইনিং, যেখানে টিভি রয়েছে। সে একেবারে সামনে আসেনি। সে তো এখন পড়ছে। পড়া
এখনও চলবে। আটটার পরে মায়ের আয়া-মাসি চলে যায়। সাড়ে আটটায় বাবা অফিস থেকে ফিরে
আসে। নিজেই চা করে খায় আর মা'কে দেয়। সৌরভ চা খায় না। সন্ধেবেলা এক গ্লাস হরলিক্স
করে মাকে দিয়েছে, আর এক গ্লাস সে নিজে খেয়েছে।
এখন থেকে কাল সকাল আটটা
পর্যন্ত মায়ের সব দেখাশোনার ভার বাবার ওপর। চা খেতে খেতে মায়ের বিছানায় বসে মায়ের
সঙ্গে গল্প করে বাবা। তখন মায়ের মুখটা বেশ উজ্জ্বল দেখায়। যেদিন বাবার আসতে দেরি
হয় সেদিন মায়ের মুখখানা একটু কেমন কালো কালো দেখায় দেখেছে সৌরভ। বাবাই রাত দশটায়
খেতে দেয় তাদের। রান্না অবশ্য রান্নার মাসি করে রেখেই যায়। খেয়েদেয়ে একটু টিভি
দেখে রাত এগারোটায় শুয়ে পড়ে।
সে কৌতূহলী ছিল খুব টিভি
সারানোর ব্যাপারটায়। কিন্তু বাবা এখন রয়েছে। সে তো পড়া ছেড়ে উঠতে দেবে না। অতএব
তার মন উসুখুসু করতে থাকে। পড়তে পড়তেও টিভি সারানোর লোকগুলোকে দেখতে থাকে সে।
খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ তার মনে
হল যে সেই লোকগুলোও যেন ঠিক মন দিয়ে টিভি সারাচ্ছে না। তারা উসুখুসু করছে আর এদিক
ওদিক তাকাচ্ছে। বাবা নিজের ঘরে কাজ করছে। সৌরভের সন্দেহ হল। মেকানিকরা তো নিজের
কাজ তাড়াতাড়ি সেরেই পালাতে চায়। কিন্তু এরা অনর্থক দেরি করতে চাইছে কেন?
ব্যাগ থেকে বার করল সেই
ম্যাজিক টর্চটা। আলোটা চুপি চুপি কায়দা করে ফেলল
লোকদুটোর ওপর। অবশ্য জানে, আলো পড়লেও সে ছাড়া অন্য কেউ তা দেখতে পাবে না।
কিন্তু এ কী! নীল আলোটা তাদের
গায়ে পড়ামাত্র লাল হয়ে গেল। আর সে দেখল এক ভয়াবহ দৃশ্য। দেখল, লোক দু’জনের হাতে
রয়েছে ধারালো ছুরি। মুখে সাংঘাতিক হিংস্রতার চিহ্ন। একজন ছুরি চেপে ধরেছে বাবার
গলায় আর একজন মায়ের। সে যে বাড়িতেই আছে এটা হয়তো ওরা কেউ টের পায়নি। একজন মাকে
বলছে, “চেঁচিয়েছ কি মরেছ।”
আরেকজন বাবার গলার কাছে ধরে
বলছে, “কাল বাড়ি সারানোর জন্য পঞ্চাশ হাজার ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিস,
আমরা সে-খবর পেয়েছি। সে টাকা কোথায়?”
বাবার তো ভয়ে মুখ শুকিয়ে
গেছে। কোনোরকমে বলল, “সে টাকা তো মিস্তিরিদের দিয়ে দিয়েছি।”
লোকটা বলল, “ছুরি খাওয়ার আগে ঠিক কথাটা বলবি, নাকি পরে?”
সৌরভ এক বুদ্ধির কাজ করেছে।
সে বেশ বুঝতে পেরেছে, সে যে বাড়িতে আছে তা লোকদুটো বুঝতে পারেনি।
অথবা ভেবেছে, একটা বাচ্চা ছেলে আর তাদের কাজে কী বাধা দিতে পারে। তার ওপাশের জানালা
থেকেও রাস্তা দেখা যায়। একটা মুদির দোকান আছে, অনেক রাত পর্যন্ত ওখানে লোক থাকে।
সেই জানালা দিয়ে সে চিৎকার করতে লাগল, “ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে! বাঁচাও বাঁচাও!”
বলে।
আর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাইরে
মহা শোরগোল। বাইরে দরজায় ধাক্কা। একগাদা লোক এসে পড়েছে। তারা চেনে সৌরভদের ভালো
করে। ভেতরের লোকগুলো এবার যেন পালাবার পথ খুঁজছে। তাড়াতাড়ি তারা বাথরুমে লুকিয়ে
পড়ে। বাথরুমে আছে স্কাইলাইট, তবে একটু বড়ো আকারের। তাতে গ্রিল নেই, আছে একটামাত্র
লোহার রড। এদের কায়দা ভালো জানা আছে যা দিয়ে সেই শিক খুলে ফেলতে পারে।
মুহূর্তে সৌরভ ছুটে গিয়ে দরজা
খুলে দিয়েছে। বাইরে অন্তত গোটা দশ-বারো লোক। হাতে লাঠি, বাঁশ যে যা পেরেছে নিয়ে
এসেছে। ওরা বাথরুমের দরজায় দুটো জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। বাথরুমের
সিনট্যাক্সের দরজায় ছিটকিনি এমনিতে খুব একটা মজবুত কিছু হয় না। দড়াম করে খুলে গেল
দরজাটা।
দুটো ছেলেই সম্মিলিত জনতার
হাতে বেধড়ক পিটুনি খেল। তারপর একজন বলল, “এবার ক্ষান্তি দে,
নাহলে মরে যাবে। বরং পুলিশের হাতে দিয়ে দে। ওরা যা করার করুক।”
মার খেয়ে ওরা স্বীকার করল যে
তারা রতনের দোকানের কেউ নয়। এ-বাড়ির দিকে নজর তাদের বহুদিনের। সেই থেকেই সৌরভের
বাবাকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে আনতে দেখেছিল। আর প্ল্যান ভাঁজছিল কী করে ডাকাতিটা
করবে। এমন সময় বাইরে থেকে তারা শুনতে পেল সৌরভ বাবাকে বলছে, “বাবা টিভিটা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমি খেলা দেখতে পারব না। পোগো, কার্টুন
নেটওয়ার্কই বা দেখব কী করে?”
বাবা বলেছিল, “দাঁড়া, তোর রতনদাকে খবর দিচ্ছি।”
ছবিটা মিলিয়ে গেল। ম্যাজিক
লন্ঠনের কৃপায় এই অতীত আর ভবিষ্যৎ দেখেই নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিয়েছে সৌরভ।
লোকগুলো তখনও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কাজে একেবারেই মন নেই। এবারে হয়তো ছুরি বার করবে
আচমকা। গা শিউরে উঠল তার।
সৌরভ জানালার সামনে গিয়ে
চিৎকার জুড়ে দিল, “ডাকাত, ডাকাত! হেল্প, হেল্প!”
দোকানের সবাই তাকিয়েছে সেদিকে।
একটা জামা নাড়তে থাকে সৌরভ।
“ডাকাত, ডাকাত! হেল্প,
হেল্প!” আবার চিৎকার জুড়ল সৌরভ।
মুহূর্তে একটা রে রে করে তেড়ে
আসার শব্দ। আর এদিকে টিভি মেকানিক ছেলেদুটোর বাইরের খোলস খসে পড়েছে। ওরা ছুরি বার
করেছে। একজন বাবার দিকে, আরেকজন মায়ের দিকে। কিন্তু তাকে তেমন খুঁজে পায়নি তারা।
ম্যাজিক লন্ঠনের দেখানো ছবির ঘটনা বাস্তবে ঘটতে চলেছে।
ওদিকে দরজায় ধাক্কার পর
ধাক্কা। ছেলে দুটো বিপদ বুঝে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঝটপট শিক খুলতে শুরু
করেছে স্কাইলাইটের। বাইরে থেকে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল
সৌরভ। হুড়মুড় করে বাঁধভাঙা জলের বেগে ঢুকে পড়েছে বাইরের লোক। ইঙ্গিতে তাদের
বাথরুমটা দেখিয়ে দিল।
তারপর আর কী? বেশ কিছুক্ষণ পেটাই চলার পর চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সৌরভ। সে একটু নরম
মনের ছেলে। এইসব মারাদাঙ্গা সহ্য হয় না। পুলিশের হাতেই তুলে দেওয়া হল ছেলে দুটিকে।
দারোগা সাহেব তার কাঁধে হাত
রেখে তার সাহসের প্রশংসা করেছেন। এই সাহস না দেখালে একটা ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যেতে
পারত। সৌরভ জানে, কাল সন্ধেবেলা মিস্তিরিরা
এসে বাবার কাছ থেকে সব টাকা নিয়ে গেছে। এই লোকগুলোর কাছে সে খবর নিশ্চয়ই ছিল না। এখন
টাকা না পেয়ে ছেলে দুটো যদি তার বাবা আর মায়ের গলায় সত্যি সত্যি ছুরি বসিয়ে দিত! আর
ভাবতে পারে না সে।
আবার ভাবল, তা হয়তো হত না।
কারণ, তেমন হলে তার ম্যাজিক লন্ঠন সে ছবি আগেই দেখিয়ে দিত। মনে মনে ম্যাজিক লন্ঠন
আর সেই লোকটির উদ্দেশে মাথায় হাত ঠেকাল সে।
পরের দিন বাবা অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, ছেলেগুলোকে তো তেমন ডাকাত ডাকাত
মনে হচ্ছিল না। তুই হঠাৎ চিৎকার করলি কী ভেবে? কী করে বুঝলি?”
কী বলবে সৌরভ? ম্যাজিক লন্ঠনের কথা তো আর ফাঁস করে দেওয়া যায় না। সে বলল, “ছেলেগুলোর হাবভাব আমার ভালো লাগছিল না, বাবা। মাঝে মাঝে ওরা নিজেদের
মধ্যে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ফিসফিস করছিল।”
বাবা বলল, “বেঁচে থাকিস, বাবা। এমন করে
লোকের যেন কাজে লাগিস।”
।। সাত ।।
সেদিন মানে সেই রাত্রে
সৌরভদের মনের ওপর বেশ একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে তার অসুস্থ মায়ের ওপর। খুব
কষ্ট পেয়েছে মা। আর সেটা ভেবে সৌরভের খুব কষ্ট হয়েছে।
“আমারই ভুল হয়েছিল। তোর
রতনদাকে একবার ফোন করে জেনে নিয়ে তবে দরজা খোলা উচিত ছিল,” বাবার গলায় ছিল আক্ষেপ।
সৌরভ জিজ্ঞেস করেছিল, “তা তুমি পরে জিজ্ঞেস করেছিলে, বাবা?”
“না রে, না। আমি জিজ্ঞেস
করেছিলুম। রতন কাউকে পাঠায়নি। আসলে কী জানিস, আমিই তো রতনকে টিভি সারানোর কথা বলতে
ভুলে গেছিলাম। সে পাঠাবে কী করে?”
আর টিভি দেখে না সৌরভ। আর
ভালো লাগে না। চালালেই তো আবার খারাপ হবে। আর খারাপ হলেই আবার খবর দিতে হবে। আর
দিলেই...
এখনও কেঁপে কেঁপে ওঠে সেই
রাতের ঘটনায়। আর প্রত্যেকবার সে ধন্যবাদ দেয় তার ম্যাজিক লন্ঠন আর সেই লোকটিকে যে
তাকে দিয়েছিল এমন উপকারী জিনিসটা।
সেই রাত্রের পর থেকে মা আরও
অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বোধহয় প্রচণ্ড ভয়ে। অসুস্থ মানুষের ওপর কী সাংঘাতিক
মনের চাপ। পুরীর সেই চোরাবালির ঘটনা সে কিংবা বাবা কেউ বলেনি মাকে। বললে
দুশ্চিন্তায় মায়ের ঘুম না হয়ে শরীর আরও খারাপ হবে।
সৌরভ রাত্রে এখন নিজে মায়ের
সঙ্গে থাকে। কী জানি রাত্রে মায়ের কী দরকার হয় না হয়। মায়ের খাটের উলটোদিকে একটা
ছোটো খাট আছে যাতে বাবা শুত। এখন বাবাকে বলেছে
তার ঘরে তার বিছানায় শুতে।
বাবা একে সারাদিন অফিসে কাজ
করে। বাবা আবার অফিসে বেশ উঁচুদরের কর্মী শুনেছে সে। অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব। সে সব
সামলেও সন্ধেবেলা মাকে দেখতে হয়। তাদের খেতে দিতে হয়। বাবার জন্যও তার খুব কষ্ট
হয়। তাই সে এমন ব্যবস্থার কথা বাবাকে বলতে বাবাও রাজি হয়ে গেছে।
সেদিন রাতে মায়ের বিছানার দিক
থেকে একটা কী খুট খুট শব্দ পাওয়া গেল। ঘুমটাও ভেঙে গেল। সাধারণত ঘুম তার ভাঙে না,
কিন্তু সেদিন অসহ্য গরম ছিল। মাথার ওপর পাখার হাওয়া যেন আগুন ছড়াচ্ছিল। তার মাথার
বালিশের নিচে একটা টর্চ থাকে। একবার ভাবল, সেই টর্চ জ্বেলে মায়ের খাটের দিকটা
একবার দেখে নেয়। কিন্তু এত ঘুম পেল যে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু পরে আবার শব্দ। ঘুম আবার
ভাঙল। ঘুম-চোখে বালিশের নিচ থেকে টর্চটা জ্বেলে ফেলল মায়ের দিকে। কিন্তু সেই
ঘুমের কারণেই এমনি টর্চের বদলে ম্যাজিক লন্ঠনটাই জ্বেলে ফেলল।
ম্যাজিকের নীল আলো পড়ল মায়ের
খাটের ওপর। সেটা সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মায়ের ওপর ফেলল। কিন্তু কী আশ্চর্য! নীল আলোটা
কেমন সবুজ রঙে বদলে গেল মনে হচ্ছে! ঘুম-চোখে ঠিক যেন বুঝতেও পারছে না। সাংঘাতিক
ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তার। আর পারা গেল না। তার মাথা পড়ে গেল বালিশের ওপর। আবার
নেতিয়ে পড়ল গভীর ঘুমের মধ্যে।
।। আট ।।
স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে
গেল সেই লোকটির সঙ্গে যে তাকে এই ম্যাজিক লন্ঠন দিয়েছিল। প্রথমে তো চিনতেই পারেনি।
সেবার সেই আদি সপ্তগ্রামে প্ল্যাটফর্মে আবছা অন্ধকারে কিছু সময়ের জন্যে দেখেছিল।
আর এখন রিষড়া স্টেশনের এই বিকেলের আলোতে।
তা এরা ভবঘুরে ভিখিরি। এদের
কাছে আদি সপ্তগ্রাম আর রিষড়ায় কোনও ফারাক নেই। ট্রেনে ক’টা স্টেশনই বা? আর ট্রেনে কি এদের কাছে চেকার টিকিট চাইবে? খাবারই
পয়সা নেই তো টিকিট কাটবে কী করে?
বেশ ভালো লাগল। ম্যাজিক লন্ঠন
তার এত কাজে লাগছে যে লোকটিকে ধন্যবাদ দেবার জন্য তার মন ছটফট করছিল। সে কিছু
বলার আগেই লোকটি সামান্য হেসে বলল, “কী, চিনতে পারছ?”
সে তো থতোমতো খেয়ে গেল। লোকটার
পরনে সেই ছেঁড়া পোশাক। আজ যদি কিছু খেতে চায় তো খুব মুশকিল। কারণ, টিফিনে রান্নার
মাসি যা করে দিয়েছিল তা সব শেষ হয়ে গেছে। ইশ্, খারাপ লাগছে তার এই না দিতে পারার
জন্যে। একটু আমতা আমতা করে বলল, “কাকু, তোমার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিদে
পেয়েছে। কিন্তু আমার কাছে তো...”
“না বন্ধু, আমার খাবার দরকার
নেই,” লোকটা বলল।
হঠাৎ তার মনে হল, আচ্ছা,
লোকটা তার কাছ থেকে ম্যাজিক লন্ঠন ফেরত নিতে আসেনি তো? ইশ্, সত্যি যদি ফেরত চায়? হয়তো ফেরত চাইতেই এসেছে! তারপর
ভাবল, কিন্তু তার বাড়ি যে রিষড়ায় লোকটা জানবে কী করে? সেদিন
তো তেমন কথা হয়নি। দুরু দুরু বুকে বলল, “তবে কি তোমার দেওয়া
ম্যাজিক লন্ঠন ফেরত চাইতে এসেছ?”
লোকটা এবার বেশ রেগে উঠল। “তোমায়
দিয়ে আবার আমি ফেরত নিতে আসব? ছিঃ, এমন কি কেউ করতে পারে?
তুমি কী করে সেটা ভাবলে বলো তো?”
বেশ লজ্জিত সৌরভ। সত্যি এমনটা
তার ভাবা ঠিক হয়নি। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “সরি।”
“আমি তোমায় আরেকটা জিনিস দিতে
এসেছি। আরও দামি। খুব দামি।”
“খুব দামি? কিন্তু কী সেটা?”
“গুপ্তধন,” লোকটা প্রায়
ফিসফিস করে বলল।
এবার কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হল
না কথাটা। গুপ্তধনের কথা কিছু গল্পের বইয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু কেউ সত্যি সত্যি
পেয়েছে বা এনেছে সেটা সে এখনও পর্যন্ত দেখেনি। সে চুপ করে রইল।
“বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“মানে, কাউকে পেতে
দেখিনি তো, তাই।”
লোকটা আবার রেগে উঠল। “তুমি কি এ পর্যন্ত ম্যাজিক লন্ঠন কাউকে পেতে দেখেছ?”
কথাটা ঠিক। সৌরভ তাড়াতাড়ি বলল, “গুপ্তধন পেতে আমার খুব ভালো লাগে।”
“তবে চলো।”
“কোথায়, কাকু?”
সৌরভ তো অবাক। “কিন্তু এখন তো ইস্কুল থেকে
আসছি। পিঠে ব্যাগ। এগুলো রেখে না হয়...”
“আরে, বেশিক্ষণ তো
লাগবে না। চলো না, চলো।”
সৌরভ ভাবতে লাগল। যদি ফিরতে
দেরি হয়? তাছাড়া সে শুনেছে, গুপ্তধন নাকি সহজে পাওয়া যায় না। অনেক দূরে
গিয়ে অনেক কষ্ট করে তবে পেতে হয়। পথে আপদ-বিপদ, সাপখোপ কতকিছু
থাকে। এমনকি ভূত-টুত পর্যন্ত। গল্পের বইতে কতকিছু পড়েছে সে।
“চলো চলো, বেশি দেরি
করা যাবে না কিন্তু,” লোকটা তাড়া দিল।
“কিন্তু যদি কিছু বিপদ
হয়?”
লোকটা চোখ পাকাল। “কেন, ম্যাজিক লন্ঠনের ওপর ভরসা নেই?”
লজ্জা পেল সৌরভ। ম্যাজিক
লন্ঠনের উপকারিতা সে কি ভুলতে পারে?
“সেটা সঙ্গে আছে তো?”
“সেটা আমার ব্যাগে
থাকে। তবে মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়।”
“কেন, কেন? ভয় হয় কেন?”
“যদি হারিয়ে যায়?
যদি ব্যাগ থেকে পড়ে যায়? কিংবা ধরো, যদি কেউ
চুরি করে নেয়?”
হা হা করে এমন হাসতে লাগল
লোকটা যে আশেপাশের সব লোকের কৌতূহলী দৃষ্টি তার ওপর গিয়ে পড়ল। ছেঁড়া পোশাক, ভবঘুরে চেহারা, লাল লাল চোখে বড়ো বড়ো দাঁত বার করে
যদি কেউ এমনভাবে হেসে ওঠে তো লোকে তাকে পাগল বলে ভাবতে পারে। সবাই ভাবতে বসল, এমন
একটা ভবঘুরের পেছন পেছন এমন একটা সুন্দর বাচ্চা ছেলে যায় কী করে? তবে কি ছেলেধরা নাকি? তারা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল
লোকটাকে।
“তুমি এমন করে হেসো না
তো!” সৌরভ এবার খুব বিরক্ত হয়ে বলল।
হাসতে হাসতেই বলল লোকটা, “কেন, কেন?”
ফিসফিস করে সৌরভ বলল, “আহা, দেখতে পারছ না সবাই আমাদের দিকে দেখছে? সবাই
গুপ্তধনের কথাটা জেনে ফেললে ভালো হবে বুঝি?”
“তা বটে,” বলে হাসি
থামাল লোকটা।
“কিন্তু আমার কথায় অমন
হেসে উঠলে কেন শুনি?”
“তুমি ম্যাজিক লন্ঠন
নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না, বন্ধু। কেউ তোমার থেকে এটা কেড়ে নিতে পারবে না। আর এটা
তোমার ব্যাগ থেকে পড়ে বা হারিয়েও যাবে না কখনও।” লোকটা এবার বেশ গম্ভীরভাবে বলল।
শুনে খুব স্বস্তি পেল সৌরভ।
তবুও আরও নিশ্চিন্ত হবার জন্য সে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী করে হবে?”
“মন্ত্রপূত এটা।
মন্ত্রপূত বোঝো তো?”
কথা আর বাড়াল না সৌরভ।
দু’জনে চলতে শুরু করল। প্রথমে
দুয়েকটা চেনা গলির পরেই সব অচেনা লাগল তার। ভাবল, এই জায়গাটা তাদের রিষড়াই তো!
নাকি? নাকি অন্য অচেনা কোনও জায়গায়? তেমন হলে
তাদের কোনও গাড়িতে করে আসতে হবে। পায়ে হেঁটে অনেক দূরে আর কোথায় যাবে?
একটা জঙ্গল পেরিয়ে এল। তাদের
বাড়ির কাছে এত বড়ো জঙ্গল আছে সে তো কোনওদিন শোনেনি এ পর্যন্ত!
।। নয় ।।
এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। সৌরভের
বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। একবার ভাবল, এটা কি ঠিক হচ্ছে? একজন অচেনা
অজানা মানুষের সঙ্গে এমন একটা জিনিসের সন্ধানে চলে যাওয়া যার অস্তিত্ব কেবল গল্পের
বইয়েই পাওয়া যায়।
অনেক পথ চলে এল তারা। মনে হল
বেশ কয়েক ঘণ্টা হবে। কিন্তু হাতের ঘড়ি তা বলছে না। দেখাচ্ছে সবেমাত্র মিনিট
দশ-পনেরো হয়েছে। তবে কি লোকটা জাদু জানে? ঘড়ির কাঁটাগুলোর ওপর
জাদু করে তাদের থামিয়ে রেখেছে? কী একটা মন্ত্রের কথা বলছিল
বটে তখন। তাহলে কি সে ঘড়িটার ওপরেও মন্ত্র পড়ে দিয়েছে? কাঁটাগুলো
আস্তে আস্তে ঘুরছে তার জন্যে? তা, যে লোকটা একটা জাদু লন্ঠন
দিতে পারে সে জাদুও দেখাতে পারে। যাই হোক, এখন যাওয়া যাক ওর পেছন পেছন। গুপ্তধন কী
বা কেমন সেটা দেখার কৌতূহল হচ্ছে। ভয়, আনন্দ আর কৌতূহল
মিলেমিশে মনের অবস্থা যে কী হয়েছে সেটা সে কাউকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারবে না।
চমকের পরে চমক। জঙ্গল শেষ
হতেই একটা পাহাড়। হঠাৎ পাহাড় কী করে এল এখানে? পাহাড় অবশ্য খুব ছোটো। একটা টিলা
বলা যায়। বিহারের টিলার কথা সে পড়েছে ভূগোল বইতে। শুধু পড়া কেন, রীতিমতো মুখস্থ
করে পরীক্ষার খাতায় লিখেছে।
তাকে নিয়ে লোকটা উঠতে লাগল
সেখানে। চড়াই উৎরাই, আবার চড়াই। বেশ একটু কষ্ট হতে লাগল তার। এমন তো ওঠা অভ্যাস
নেই। কিন্তু লোকটা দিব্যি হাঁটছে। হাঁটছে তো নয়, যেন একটা ঘোড়া দৌড়চ্ছে। সৌরভ ভাবল,
লোকটা সত্যি ম্যাজিক জানে। তার পা দু’খানাও বোধহয় মন্ত্রপূত। আচ্ছা, এই গুপ্তধন কি
তবে ম্যাজিক লন্ঠনের মতো আরেকটা কিছু? বেশ মজা হয় কিন্তু
তেমন কিছু পেলে। এমনিতেই ম্যাজিক লন্ঠন যথেষ্ট মজার। তার ওপর আবার ঠিক এমন একটা
জিনিস যদি পাওয়া যায়।
কখনও বাঁ দিকে খাদ তো কখনও
ডান দিকে। কত গাছ, কত ফুল, কত পাখি।
মাথার ওপর সুন্দর নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভাসছে। মাঝেমধ্যে আবার এদিক ওদিক থেকে
কলকল করে হালকা আওয়াজ আসছে ঝরনার। একেবারে
মোহিত হয়ে গেল সৌরভ।
মা যখন সুস্থ ছিল তখন একবার
দার্জিলিং গিয়েছিল তারা। দার্জিলিং অবশ্য বেশ উঁচু পাহাড়। খুব ঠাণ্ডা, আর এর থেকে
অনেক সুন্দর। এমন করে হেঁটে হেঁটে যাওয়া যায় না। শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি
করে যেতে হয়। তারা যাবার সময় টয় ট্রেনে করে গিয়েছিল। ফিরেছিল মোটরে করে।
কিন্তু পাহাড় তার ভালো লাগে।
দেখল, যত ছোটো পাহাড় সে ভেবেছিল তত ছোটো পাহাড় এটা নয়। তারা ওপরে উঠছে তো উঠছেই।
এবার একটু কষ্ট বাড়ছে যেন। বলল, “আর কতদূর গো? রাস্তা তো শেষ হচ্ছেই না!”
“এর মধ্যেই হাঁপিয়ে
পড়লে?” লোকটির চোখেমুখে হাসি। “গুপ্তধন চাও, আর একটু কষ্ট
করবে না? হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ‘আবার
যখের ধন’ পড়নি?”
অবাক হল সৌরভ। লোকটা বলে কী? খেতে পায় না, চেয়েচিন্তে খায়, আবার তাও বই পড়ে? বলল,
“তুমি বইও পড়ো নাকি?”
“হ্যাঁ, পড়ি। আমাদের
ছেলেবেলায় হেমেন্দ্রকুমার খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলেন ছোটোদের। এখন অবশ্য অনেক অনেক
অন্য লেখক আছেন। কিন্তু আমি বলতে চাইছি গুপ্তধন উদ্ধারের কোনও বই কি তুমি পড়নি?”
তা পড়েছে সে। কিন্তু এখন কথা
কইতে তার ভালো লাগছে না। কতক্ষণে পৌঁছবে গুপ্তধনের কাছে তাই ভাবছে। তার আর তর সইছে
না যেন। একটু মন খুঁত খুঁত করছে তার। যদি টাকাপয়সা হয় তো বাবাকে দিয়ে দিতে হবে। সে
তো বাচ্চা এখন। টাকাপয়সা নিয়ে সামলাতে পারবে না। সোনাদানা-মণিমুক্তো হলে মাকে দিয়ে
দেবে। কতদিন স্বপ্ন দেখে, মা আবার তার সুস্থ হয়ে উঠবে। মুক্তোর মালা গলায় পরে বাবা
আর সৌরভের সঙ্গে অনেক দূরে বেড়াতে বেরিয়েছে।
দূর ছাই, মা যদি সুস্থ না হয়
তো মণিমুক্তো পেয়েই আর কী হবে? তবে যদি সে পায় আলাদিনের মতো
একটা জাদু প্রদীপ বা জাদু আয়না বা এমন কোনও জাদু ছড়ি যা মায়ের গায়ে বুলিয়ে দিলে মা
আবার সুস্থ হয়ে ঘুরে বেড়াবে! আবার তাকে আদর করে কত ভালো ভালো
খাবার রান্না করে খাওয়াবে। বাবার মুখের সবসময়ের দুশ্চিন্তাটাও তবে আর থাকবে না।
এমন যদি সত্যি সত্যি একটা গুপ্তধন পাওয়া যায়? তবেই তো তাকে কাজে
লাগান যাবে, নাকি?
কিন্তু একটু পরেই বাবা ফিরবে
অফিস থেকে। যদি দেখে স্কুল থেকেই ফেরেনি সৌরভ, তো খুব চিন্তায় পড়বে বাবা আর মা দু’জনেই।
আবার তাদের হবে ছোটাছুটি। বাবা এদিক ওদিক রাস্তায় আর মা বিছানায় ছটফট করে গড়াগড়ি
খাবে।
মন চঞ্চল হয়ে উঠল। কতক্ষণে
পাবে সে গুপ্তধন?
।। দশ ।।
পাহাড়ের একটা গুহা। একটা
পেল্লায় পাথর চাপা দেওয়া ছিল। এক ধাক্কায় সেটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল লোকটা। সে অবাক
হয়ে গেল তার গায়ের জোর দেখে। যে লোকটা খেতেই পায় না রোজ তার গায়ে এত জোর কোথা থেকে
আসে ভেবেই পায় না সৌরভ।
এই গুহার ভেতরেই সেই গুপ্তধন
আছে তবে? সে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটা কিন্তু গম্ভীর। খুব সিরিয়াস।
সিরিয়াস হবারই কথা। কারণ, যেখানে গুপ্তধন থাকে সেখানে অনেক বিপদও থাকে। হয়তো ভেতর
থেকে বেরিয়ে আসবে কোনও বিরাট আকারের দৈত্য কি দানব! তাদের দু’হাতে তুলে ছুড়ে
ফেলে দেবে খাদের অনেক নিচে।
আরও একবার তাকাল লোকটার দিকে।
এক ধাক্কায় গুহার মুখের অত বড়ো পাথর অনায়াসে সরিয়ে ফেলেছে যে, হয়তো সে পারবে এই
দত্যি-দানবগুলোর সঙ্গে টক্কর দিতে। কিন্তু যদি
না পারে?
কিংবা কোনও ভয়ংকর ভূত হয়তো তাদের
দেখে হাড় হিম করা ভয় দেখাবে। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে তারা নিজেরাই গড়িয়ে পড়বে পাহাড় থেকে
নিচে। কোনও বড়ো পাথরে মাথা ঠুকে মারাও যেতে
পারে। কিংবা থেঁতলে যেতে পারে সারা শরীর। দেখে কেউ চিনতেও পারবে না যে বাবা-মাকে
গিয়ে খবর দেবে।
কিংবা একটা রক্তমুখো ড্রাগন
যদি মুখ দিয়ে গলগল করে আগুন ছিটোতে থাকে অনবরত? দেখেছে সে ছবিতে। কী
বিশাল পরিমাণ আগুনের হলকা! গায়ের জোরে কি লড়া যাবে এই আগুনের সঙ্গে?
অথবা যদি ধরো, বিরাট একটা
অজগর যদি তাদের দু’জনকে গিলে ফেলতে আসে? অথবা তাদের পাকিয়ে
ধরে? তবে তো শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়তে হবে!
প্রাণীভূক অনেক গাছের কথা
জেনেছে সৌরভ। তারা তাদের ফুলের বিরাট পাপড়ি বিস্তার করে প্রথমে পতঙ্গদের আকর্ষণ
করে, তারপর ফুলের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তাদের শরীর পিষে দেহের সব রস শোষণ করে নেয়।
আবার একসময় তা বার করেও দেয়।
আবার কিছু গাছ নাকি মানুষের
শরীর জড়িয়ে ধরে অজগরের মতো। তারপর তার
শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়ে তাকে ছিবড়ে করে ফেলে দেয়।
যদি এমন কোনও বিপদ লুকিয়ে
থাকে গুহার ভেতরে?
“এসো ভেতরে।”
সৌরভ অন্যমনস্কতা ভেঙে দেখল,
লোকটা তাকে ডাকছে। তার সঙ্গে গুহার ভেতরে যেতে বলছে। পা সরছে না, তবুও তো তাকে
যেতেই হবে। কেননা, গুপ্তধন নিতে যেতে হবে যে ভেতর থেকে। যত বিপদ থাক না কেন এগিয়ে
যেতেই হবে।
হঠাৎ মনে হল, আরে, তাই তো!
ভেতরে বিপদ আছে কি না কিংবা কী বিপদ ওত পেতে বসে আছে তাদের জন্য সেটা দেখার তো
সহজ রাস্তা আছে। তার ম্যাজিক লন্ঠন।
কিন্তু এই রে। এই প্রথম বোধহয়
সে হারিয়ে ফেলেছে তার পরম বন্ধুকে।
“দাঁড়াও, দাঁড়াও।”
পেছন ফিরে লোকটা বলল, “কী হল?”
“আমার ম্যাজিক লণ্ঠন!
কোথাও পাচ্ছি না।”
“রাখো তো তোমার
ম্যাজিক লন্ঠন! এখন এসো ভেতরে।”
গলা কেঁপে উঠল সৌরভের।
কান্নাধরা গলায় সে বলে উঠল, “কিন্তু তুমি যে বলেছিলে ম্যাজিক লন্ঠন
হারায় না? ওটা মন্ত্রপূত?”
লোকটা হাসল। “বলেছি বুঝি?”
“আমার এই বিপদে তুমি
হাসছ?”
“আহা, বলেছি যখন তখন
ঠিকই বলেছি। দেখ না, ঠিক সময়েই তুমি পেয়ে যাবে। এখন ভেতরে এসো। ওর চেয়ে দামি
জিনিসটা তুমি নেবে না? তোমার গুপ্তধন?”
ম্যাজিক লন্ঠনের কথা ভুলে গেল
সৌরভ। লোকটার পেছন পেছন ঢুকে গেল গুহার ভেতরে।
।। এগারো ।।
একটা ভারী পর্দা টাঙানো। একটা
পাহাড়ের প্রায় অন্ধকার গুহা, তার মধ্যে আবার পর্দা এল কোথা থেকে? এর ভেতরেই কি তবে আছে সেই গুপ্তধন? সৌরভের মনের
ভেতরটা উত্তেজনায় কেমন করে উঠছে সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে
তার বুকের ধুকপুক আওয়াজ।
পেছন ফিরে সে লোকটার দিকে
তাকাল। হাসিমুখে সে বলল, “যাও না, যাও ভেতরে। নিয়ে নাও তোমার
গুপ্তধন। এ-জগতের সবচেয়ে দামি জিনিসটা।”
“ক-কিন্তু তুমি?”
“আমি এখানেই
দাঁড়াচ্ছি। এই গুপ্তধনে আমার কোনও অধিকার নেই। সবটাই একা তোমার।” কথাটা বলে খুব
সুন্দর হাসছে লোকটা।
কিন্তু গুপ্তধন কোথায়? এ তো একজন মানুষ মনে হচ্ছে। একজন মহিলা। এতদূর হাঁটিয়ে এনে লোকটা তাকে
এমনভাবে ঠকাল? তার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু এই মহিলা কে?
সে শুনেছে, পাহাড়ের গুহায় মায়াবী রাক্ষসীরাও থাকে। তাহলে এই লোকটা
কি আসলে একটা মায়াবী দৈত্য? হতেও পারে। যেভাবে অত বড়ো
পাথরটাকে সরিয়ে দিল এক ধাক্কায়, তাতে তো সেই সন্দেহই আসে মনে। কিন্তু কী ক্ষতি সে
করেছে লোকটার? সে তো নিজে থেকে তার কাছে কোনও উপহার চায়নি! আর
সামান্য খাবার দেবার বদলে কিছু চাওয়ার কথা সে তো ভাবতেই পারে না। বাবা শুনলে তাকে
আর আস্ত রাখবে? কান্না পেয়ে গেল সৌরভের। এখন
এই মায়াবী দেশের মায়া থেকে সে কী করে ছাড়া পায়? ম্যাজিক লন্ঠনটাও
নেই।
এমন সময় আলোয় ভরে উঠল সারা
গুহাটা। শুরু হল তবে মায়ার খেলা। সৌরভ ভয়ে কাঁটা হল। সেই মহিলা এদিকে ফিরল।
বিস্ময় তার বাগ মানছে না যেন।
এ যে, এ যে তার মা! কিন্তু এই অজানা অচেনা জায়গায় মা এল কী করে? মা হাসিমুখে এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, “এসেছিস
বাবা? আয় আয়।”
একেবারে সুস্থ মানুষের মতো
হাঁটছে-চলছে-বেড়াচ্ছে মা। সে এখানে এই পাহাড়ের গুহায় এল কী করে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা, যে মানুষটা রোগে এত কাবু, যে বিছানায় ভালো করে শুতে
পর্যন্ত পারে না, সে একেবারে সুস্থ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কিন্তু আজ সকালে স্কুল যাবার
সময়ও দেখেছিল বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মা। কীসের ছোঁয়ায় মা ভালো হয়ে গেল
তার?
আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরল সে। “মা, তুমি ভালো হয়ে গেছ? আমরা তো ভেবেছিলুম আর তুমি
ভালো হবে না।”
“পাগল ছেলে।”
“তা ভালো হলে কী করে,
মা? তোমার কাছে তো কোনও ম্যাজিক...”
বলেই ফেলছিল কথাটা। সামলে নিল
সৌরভ। মা বলল, “ম্যাজিকের ছোঁয়া? তাও
বলতে পারিস, বাবা। আসলে কী জানিস? ভালো ডাক্তারের ছোঁয়া ম্যাজিকের ছোঁয়ার মতোই কাজ
করে। দাঁড়া, দেখাচ্ছি কার ওষুধ খেয়েছি আমি।”
একটা প্রেসক্রিপশন আর অন্য
কাগজপত্র বার করল মা। ক্লাস নাইনের ছেলে সৌরভ আর সে সবের অত কী বুঝবে? কিন্তু
ডাক্তারের নামধাম সে ভালো করে দেখে নিল। বেশিদূর নয়। কলকাতাতেই আছে। দক্ষিণ
কলকাতায়। ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। বলা যায় না, অন্য কারোর কাজেও তো লেগে যেতে পারে।
সৌরভ ব্যস্ত হল। “এখন এসব রাখো, মা। আমি এখন গুপ্তধন আনতে যাচ্ছি। ফেরার সময় তোমাকে নিয়ে
যাব বাড়িতে।”
“গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন?” পেছন থেকে লোকটা বলল তাকে।
খুব রেগে গেল সৌরভ। পেছনে
তাকিয়ে বলল, “তার মানে? গুপ্তধন
আনতে তুমি আমাকে নিয়ে এতদূর যে এলে?”
মুচকি হাসল লোকটা। “গুপ্তধন তুমি পাওনি বুঝি?”
লোকটা আচ্ছা বদ তো! খুব রাগ
হতে লাগল। রেগে বলল, “কী করে পেলুম শুনি?”
“নিজের সুস্থ মাকে
দেখেও বলছ এ কথা? তোমার মা ভালো হয়ে গেছে সৌরভ।” লোকটা বলল,
“যে রোগ সারবার ছিল না সেই রোগ ভালো হয়ে গেছে। নিজের সুস্থ মায়ের
থেকে দামি এমন কোনও গুপ্তধন আছে নাকি? দেখলে তো, তোমাদের
কাছেই কলকাতার এক ডাক্তারের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে তোমার মা। একজন
অসুস্থ রুগীর কাছে একজন ভালো ডাক্তার আর ভালো চিকিৎসার সন্ধান পাওয়া আর গুপ্তধন
পাওয়া কি এক নয়, বন্ধু?”
কথাটা তো এত ভেবে দেখেনি
সৌরভ। সত্যি তো, নিজের সম্পূর্ণ সুস্থ মায়ের থেকে কোনও গুপ্তধন বেশি দামি হতে পারে
নাকি? মা যে আবার কোনওদিন সুস্থ হয়ে উঠবে এ তো কোনওদিন স্বপ্নেও
ভাবা যায়নি।
“তুমি ঠিক বলেছ,
বন্ধু। একেবারে ঠিক বলেছ।” কথাটা বলেই তার দিকে ফিরে দেখে লোকটা আর নেই। যেন
বাতাসে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেছে। তা যাক। ম্যাজিক লন্ঠনের লোক ম্যাজিকের মতো
হাওয়া হয়ে যাক। এখন তার পরম সম্পদ সুস্থ মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এদিকে ফিরে দেখল, আরে, কোথায়
মা! কেউ তো কোথাও নেই। আর কোথায় গেল পাহাড় আর সেই গুহা? সে তো শুয়ে আছে নিজের বিছানায়। ভোরের আলো এসে পড়েছে ঘরে। পুবের লাল আকাশটা
কেমন হাসছে যেন। পাখির কিচকিচ ডাক আর বাতাসে দোল খাচ্ছে জানালার বাইরের বড়ো
বকুলগাছটার ডাল।
সেই টর্চ তখনও জ্বলছে।
ম্যাজিক লন্ঠনের আলো তখনও মায়ের গায়ে পড়ে আছে। আর আশ্চর্য, সে আলো একেবারে সবুজ।
উপসংহার
স্বপ্নে দেখা সেই ডাক্তারের
নাম-ঠিকানা ভালো করেই মনে ছিল সৌরভের। বাবাকে বলে সেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা
হয়েছিল। বেশ কয়েক মাস চিকিৎসা করিয়ে মা এখন অনেক সুস্থ। ডাক্তারবাবু নাকি বলেছেন,
আর ক’টা মাস পরেই সৌরভের মা সৌরভকে নিজের হাতে ভালোমন্দ রান্না করে
খাওয়াতে পারবেন।
বাবা আর মা এখন সৌরভের
ম্যাজিক লন্ঠনের ব্যাপারটা জেনে গেছে। তা হোক, তারা যে আপনজন। তাদের কাছে লুকোনো
কি ঠিক? তবে কথাটা পাঁচকান না হলেই মঙ্গল।
সৌরভ এখন রোজ টিফিন কৌটোয়
মায়ের করে দেওয়া খাবার বেশি করে নিয়ে যায়। কোনও ভবঘুরে যদি হাত পাতে তবে বঞ্চিত
করে না তাকে। আর সাগ্রহে তার মধ্যে খুঁজে বেড়ায় তার সেই উপকারী পরম বন্ধুকে।
_____
ছবিঃ রুমেলা দাশ
No comments:
Post a Comment