আলোর দেবতা
রুমেলা দাশ
সম্বল
বলতে গোটা বিশেক চিঠি। নামহীন ঠিকানা। আর অনন্ত অপেক্ষা। টাস্ককো, কলকাতা থেকে পনেরো হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থিত মেক্সিকোর
ছোটো শহর। সবাই ‘রূপালি শহর’ বলেই চেনে। তাতেই হয়তো লুকিয়ে আমার প্রাণপুরুষ। আমার
আদর্শ। পাহাড়ে ঘেরা পথের বাঁকে বাঁকে কখনও মধ্যবিত্ত, কখনও বিত্তশালীর পাকা বাড়ি।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পথ। ভি.ডাব্লু বাগ ট্যাক্সি ধরে নেমেছি এল মিরাডোরে। মনের
অবস্থা চেহারায় ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। এয়ারপোর্টে নামতে আশেপাশের চাউনিতেই বুঝি। এখনও
তাই! হাঁ করে তাকিয়ে হাতখানেক দূরে বেশ কিছু ছেলের দল। তাদেরই মধ্যে একটা
ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে এগিয়ে আসে আমার দিকে। কী করে বোঝাব ওকে! ট্যাক্সি
ড্রাইভারকে কোনওমতে জায়গার ম্যাপ দেখিয়ে বুঝিয়েছি। কিছুটা শিখেছি ডিকশনারি দেখে।
‘হোলা’ (ইংরেজি মানে হ্যালো) বলে হাতে ধরা হলদেটে কাগজের ঠিকানা দেখালাম আঙুল
দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে কী একটা বলে ছেলেটা ইশারায় ডাকল সামনের সিঁড়িতে বসা প্রৌঢ়কে।
ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ চোখের সামনে কাগজটা ধরে হাত দেখালেন দূরের দিকে।
যতটা বুঝলাম, উনি সোজা গিয়ে তারপর ডানদিকে বেঁকতে বলছেন।
‘গ্রাসিএস’ ( ইংরেজিতে থ্যাঙ্কস) বলে এগোলাম। অবাক হলাম, কাগজটা
আমার হাতে ফেরত দেবার আগে ভদ্রলোক মাথায় ঠেকিয়ে নিলেন! আশ্চর্য! মনে হল, ঠিকানাটা ওদের চেনা। জড়ো হয়ে গেছে আরও আট-দশজন। কাঁধের ব্যাগটা সামলে এগোতে
শুরু করলাম। পাহাড়ের স্তব্ধতা ভয়গুলোকে একজোট করছে। কাঁপছে পায়ের পাতা। এগোনোর
সঙ্গে সঙ্গে কমছে বাড়িঘর। দেখলাম লোক, বাচ্চা সবাই পিছন পিছন
আসছে। নিজেদের মধ্যে গুনগুন, ফিসফাস করেই চলেছে। সোজা গিয়ে
ডানদিকে বেঁকতেই দেখি, খানিকটা পুরোনো গোছের লাল-খয়েরি মেশানো
একটা একতলা বাড়ি। আমাকে ধাক্কা দিয়ে সেই বছর ষোলোর ছেলেটা তরতরিয়ে গেট ঠেলে ঢুকে গেল
ভিতরে। বন্ধ দরজার গোল কড়া ধরে নাড়তে থাকল। উত্তেজনা, ভয় মিশিয়ে অদ্ভূত অনুভূতি চেপে ধরছে আমাকে। বুঝতে পারছি, গলা বসে আসছে।
সঞ্জয়দাদু বারবার বলে দিয়েছেন, ওঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে
আমাকে পাঠাচ্ছেন। তাই সমস্ত পরিস্থিতির জন্য তৈরি
থাকতে হবে। কিন্তু পারছি কই! হাত-পা সিঁটিয়ে আসছে।
দরজা
খুলে গেছে। যিনি ভিতর থেকে বেরিয়েছেন তিনি একজন মহিলা। পরনে ম্যাক্সি টাইপের ঢাকা
পোশাক। চুল রঙিন কাপড়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। ছেলেটির সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছেন। চোখেমুখে
কেমন সংশয়ের চিহ্ন। লালরঙা সূর্যের সিঁদুরে আভা আছড়ে পড়েছে বাড়িটার গায়ে। আগাছা
ঝোপঝাড় থেকে ঝিম ধরা ঝিঁঝিঁর ডাক কানে আসছে।
চারপাশের
গুঞ্জন বাড়ছিল। দরজা ভেজিয়ে মহিলা আরও মিনিট কুড়ি পরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন
ভিতরে। চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে জোরসে গুঁতো খেলাম মাথায়। না
জানি কী আছে কপালে! মিহি ধূপকাঠির মিষ্টি গন্ধ নাকে এল। পর্দা
সরিয়ে ভদ্রমহিলা দাঁড়ালেন। আমি
আর তিলমাত্র অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। বুকের মধ্যে বসে কেউ যেন হাপর টানছিল। কোনওমতে
ঘরে ঢুকতেই বিদ্যুতের মতো শিহরণ খেলে গেল মাথা থেকে পা পর্যন্ত। খুব পুরোনো ছবি
ভেসে উঠল চোখের সামনে। সাদাকালো আবছা ফ্রেমের একটা মানুষ। শাল জড়ানো জবুথুবু শরীর।
কুঁকড়ে যাওয়া অজস্র চামড়া। অটুট সেই হাসি। চিনতে ভুল হতে পারে না। দৌড়ে গিয়ে জাপটে
ধরলাম আমি। ঠেস দেওয়া বালিশ, বিছানাটা অল্প দুলে উঠল যেন। আর
তাতেই চমকে উঠলাম। হিলহিলে ঠাণ্ডায় ঘামে ভেজা সমস্তটা। হাসিমাখা মুখে ঘোলাটে
বেরিয়ে আসা চোখদুটো ততক্ষণে জলে ভিজে গেছে। আমি আপাদমস্তক দেখার চেষ্টা করলাম। এ
কী করে সম্ভব! এ যে বিস্ময়!
* * * * *
সম্ভব
করতেই হবে। যে করেই হোক! ঘরময় পায়চারি করছে মিহির বোস। মেলাতে পারছে না কিছুতেই।
গত কুড়ি বছর এভাবে দিনরাত এক করে, একের পর এক পরীক্ষা করে গেছে।
দরজা বন্ধ করে বসে থেকেছে বাড়ির লোকাচার এড়িয়ে।
পিসিমা বলেছে, অলক্ষুণে কাণ্ডকারখানা। স্ত্রী তো
কেঁদেকেটেই অস্থির। আর বাকিরা? যে যার মতো আজগুবে উদ্ভট বলে
একঘরে করেছে।
এক
সাধনা পেয়ে বসেছে ওকে। টেবিলের উপর সরু লম্বা প্যানেলের মুখটা যেখানে গিয়ে শেষ
হয়েছে, সেখানে সোডা ক্যানের মতো জার। উপরিভাগ ফুটে চলেছে টগবগ করে।
সাদা বুদ্বুদের মতো ফেনা উপচে পড়ছে চারপাশে। মিহির
বুঝতে পারছে, সাফল্যের পথ এখনও অনেকটা বাকি। চাপ এবং
পরিমাণ সমমাত্রায় দিতে পারছে না। বয়েলস ল, চার্লস ল খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখছে।
আজ
বোধন। সবাই ব্যস্ত। বারান্দা দিয়ে দেখবার চেষ্টাও করেছিল মায়ের মুখ।
পারেনি। বোধন না হওয়া পর্যন্ত দেবীর মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে। বোসবাড়ির রীতি। জেদ
চেপে বসেছে। মায়ের জন্যই সব। বুঝে ওঠার ক্ষমতাটুকুই ছিল না দশ বছরে। পরে বুঝেছিল, রাজরোগই মাকে মিহিরের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়। মায়ের শরীরের দুধে আলতা রং হয়ে গিয়েছিল
নিকষ কালো। চামড়া জুড়ে আঁকড়ে বসেছিল রোগটা।
সূর্যের আলো সহ্য করতে পারত না মা। বড়ো কষ্ট পেত। শেষকথাটা
মনে পড়ে বারবার – “বাবা, এ-রোগ যন্ত্রণার। এমন কিছু করিস যাতে এই
রাক্ষুসে রোগের হাত থেকে মানুষ রেহাই পায়!”
বড়ো
বড়ো শ্বাস ভরে নেয় বুকে ও। বাবা বলেছিল কাপড়ের দোকানে বসতে। মিহিরের মন চায়নি।
“মিহির, অ্যাই মিহির! দরজাটা খোল! শিগগির!”
খুব
চাপা স্বরে কে যেন ডেকে উঠল। দরজায় দু-তিনবার
খটখট শব্দও হল।
“তাড়াতাড়ি
খোল! নাহলে মেসোমশাই চলে আসতে পারে।”
দরজাটা
খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সঞ্জয়। ছিটকিনি তুলে হাতের বাক্সটা টেবিলের উপর রেখে
হাঁফাতে থাকল।
“কী রে, এতদিন পর?” বিরক্তির সুরে জিজ্ঞাসা করল
মিহির।
“তা মশাই আপনার জন্যই।”
“দ্যাখ সঞ্জয়, আর যাই কর, আমার এই কাজ নিয়ে মশকরা
ভালো লাগে না।”
“মশকরা করছি কে বলল? তোর জন্য যা এনেছি দেখলে পাগল
হয়ে যাবি। যা ঝুঁকি নিয়ে এসেছি! ঢাক-বাদ্যি, পিসিমা, বৌমা, খোকা সবাইকে পাশ কাটিয়ে। তুই ভাবলি কী করে আমি
তোর সঙ্গে ঠাট্টা করছি? ঘরে কী ছড়িয়েছিস?
গন্ধে টিকতে পারছি না।”
নাক
টিপল সঞ্জয়। মিহিরের বাল্যবন্ধু। ক্লাস পালিয়ে মাছ ধরা, রথের মেলায় পাঁপড় ভাজা, কাচের ভেজা জানালায় কাটাকুটি
খেলা - দুটিতে জমত সেই কোন কাল থেকে। মা-হারা মিহিরের ছায়া সঞ্জয়। কলেজে সায়েন্স
নিয়ে একবছর পড়েছিল মিহির। তারপর আর যায়নি।
পাশও হয়নি। সঞ্জয় কমার্স গ্র্যাজুয়েট করে প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানিগিরি করছে।
“হাঁ করে দেখছিস কী? খুলে দেখবি না?” দাঁড়িয়ে থাকা মিহিরের দিকে বাক্সটা ঠেলে দেয় সঞ্জয়।
“এমন করছিস, যেন চুরি করেছিস আমার জন্য!”
“উঁহু। একদম পাই-পয়সা মিটিয়ে শুধুমাত্র তোর জন্য। হাজার হ্যাপা!”
কী
এনেছে সঞ্জয়? ও তো কিছু আনতে বা কিনতে বলেনি ওকে। যদিও ছোটোখাটো
ল্যাবের দরকারি যাবতীয় ও-ই এনে দেয়। বাইরে বেরোলেই সবাই গাদাখানেক প্রশ্ন করে।
মিহির খুব একটা তাই বেরোয় না।
চারকোনা
কাঠের বাক্স।
“কী আছে ওতে?”
“খুলেই দ্যাখ না!”
মিহির
সটান খুলল বাক্সের ঢাকনাটা। খুলতেই আঁতকে উঠল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “এ তুই কোথায়
পেলি!”
“হুমম বাবা, পেয়েছি!”
“এর তো দাম...”
“ওসব তোকে ভাবতে হবে না। সঞ্জয় কি
পুরো দামে কোনও কিছু নেয়!”
মিহিরের
চোখ চকচক করে উঠল। বাক্সটার মধ্যে আরেকটা কাচের জার।
জলের মধ্যে ছটফট করে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপেয়ে। ফুলকোগুলো ফুলিয়ে ফুলিয়ে কিলবিল করছে।
দেহের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়ো। চেহারার
স্ফীতভাব বোঝায় প্রাণীটা পুরুষ। পুরো দেহটা গাঢ় খয়েরি রঙের। ত্বকের ভিতর থেকে
ঠিকরে বেরোচ্ছে সবজে অলিভ আভা। ঊনিশ শতকে জার্মান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ভন
হামবোল্ট প্রথম এদের মানুষের সামনে আনেন। বোঝান এদের উপকারিতা। অ্যামফিবিয়া
প্রজাতির এই সরীসৃপকে বর্তমানে CITES (দ্য কনভেনশন অন
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন ইনডেঞ্জার্ড স্পিসিস অফ ওয়াইল্ড ফৌনা) এবং IUCN (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অফ নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল
রিসোর্সেস) বিপন্ন প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আর এর থেকে কী হতে পারে, সেটা ভেবেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে মিহিরের। জীবনবিজ্ঞান সম্মত নাম ‘অ্যামবাসটোমা মেক্সিকান’।
আনন্দে মিহিরের মনে হচ্ছে ও সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে! আরও একটু এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে
জারের দিকে। সোৎসাহিত গলায় বলে ওঠে, “অক্সলোটলস!”
* * * * *
“অক্সলোটলস মিহিরের শেষ গবেষণার
বিষয় ছিল, তাই-ই!”
“কিন্তু...”
“এর থেকে একবর্ণও বেশি আমি জানি না, সৌরভ। আর কী করেই বা জানব? কেটে গেছে কতগুলো বছরের কত বোধন। নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছিল ও। শেষের দিকে
আমি এলেও দরজা খুলত না। পিসিমা বলতেন, ওকে ভূতে ভর করেছে।”
“সঞ্জয়দাদু, তুমি তো জানতে! তাহলে তুমি বোঝাওনি কেন সবাইকে?”
“প্রমাণ কোথায়? পাড়া গাঁ-গঞ্জে মানুষ তখন কতটা
বিশ্বাস করত! এখনই বা ক’জন বিশ্বাস করে বলতে পার? আমরা তাবিজ,
মাদুলি, তন্ত্র-মন্ত্র, জ্যোতিষ,
সংখ্যাতত্ত্বে ভবিষ্যৎ দেখি, খুঁজি। একটা মানুষ নাওয়াখাওয়া
ছেড়ে দিনের পর দিন ঘর বন্ধ করে বসে থাকত। মাঝে
মাঝে জানালা-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে বিকট উৎকট গন্ধে, ধোঁয়ায় ভরে
যেত বাড়ি। তখনই সবার সন্দেহটা বেশি হত। পিসিমা
কয়েকবার তান্ত্রিকও এনেছিলেন। আসলে মিহিরের মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওকে কোলেপিঠে
করে মানুষ করেছিলেন পিসিমাই। ওর এই পরিবর্তনটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তার ওপর
পৈতৃক ব্যাবসা দেখত না মিহির।”
“তুমিই তো এনে দিয়েছিলে সরীসৃপটা।”
“হ্যাঁ, আসলে মিহিরের মুখে অনেকবার শুনেছিলাম।
পড়াশুনায় আমরা দু’জনেই ছিলাম মোটামুটি। প্রতিবছর গরমে কাঁচা আম ভাগাভাগি করে
খাওয়ার ছবি আজও চোখের সামনে ভাসে। আর সেই টানেই এগুলো এখনও আসে আমার কাছে।”
চারকোনা
নীলচে লম্বাটে খান দশেক খাম ড্রয়ার থেকে বের করলেন সঞ্জয়দাদু।
“আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ট্র্যাভেলের ব্যাবসা করতেন। ফি-বছর দেশের
নানা রাজ্য এমনকি বাইরেও যেতেন। কলকাতায় এলে
আমাদের বাড়ি থাকতেন। তখনই মিহিরের কাছে শোনা নামটা আমি বলি ওঁকে। কিছুতেই
রাজি ছিলেন না। বিলুপ্ত প্রাণী কেনা বা ঘরে রাখাটা অপরাধ। ধরা পড়লে জেল। সে অনেক
ঝামেলা। তবে কায়দা করে আদায় করে ছাড়ি। বলেছিলাম,
আমার বন্ধু অ্যাকোরিয়ামে রাখবে, পুষবে।”
সঞ্জয়দাদু
একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে খুব হাঁপাচ্ছিলেন। জলের
গ্লাসটা সামনে ধরলাম। এক ঢোঁকে সব জল খেয়ে নিলেন।
তারপর আবার বলতে শুরু করলেন মৃদু অথচ কঠিন গলায়।
“বোসবাড়িতে সেদিন লক্ষ্মীপুজো ছিল। আমিও
পরিবার নিয়ে এসেছিলাম। মিহিরের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। ও দরজা খোলেনি। কোনও
উত্তরও দেয়নি। পুজো শেষের দিকে, তখনই সাংঘাতিক একটা চিৎকার শুনি ওর ঘরের দিক থেকে।
প্রথমটা সবাই থতোমতো খেয়ে গেলেও পরে বুঝি ওটা মিহিরেরই গলার আওয়াজ।
ঠাকুরের অন্নভোগ খেতে এসেছে তখন জনা পঞ্চাশেক লোক। ঊর্ধশ্বাসে ছুটে গেছিলাম।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে কোনওরকমে উঠে বারবার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলাম। গোটা বাড়ির লোক
চলে আসে। খোকা ভয়ে কাঁদতে থাকে। বৌমা, পিসিমাও। সবাই ঠিক
করে দরজা ভেঙে ফেলবে। তখনই মিহির
ভিতর থেকে চিৎকার করে বলে, আমি ঠিক আছি!
“অনেক
অপেক্ষা করে সবাই একে একে চলে গেলেও রাত অবধি আমি একইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। রাত তখন ক’টা
বাজে জানি না। দরজাতে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে এসেছিল। খুট করে
দরজা খোলার শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায়। নিস্তব্ধ
বাড়িতে ঘড়ির কাঁটা আর আমরা দুটো প্রাণী যেন। হাত ধরে
ঘরে টেনে নেয় মিহির। মাথার চুল এলোমেলো। কতদিন স্নান করেনি। চোখদুটো রক্তজবার মতো
লাল। সারা মুখ অস্বাভাবিক ফোলা। দেখেই বুঝতে পারছিলাম, ভিতরে ভিতরে ও খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে। আমি ওর কাছে যেতেই ছিটকে সরে গেছিল। প্রবল
উৎসাহ, উদ্দীপনা ভরা চোখদুটো তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ আমার দিকে। আমাকে বলেছিল, "সঞ্জয়, আমি হয়তো পারব! হয়তো পেরেছি।”
* * * * *
মিহির
বুঝতে পারছে, মানবসভ্যতার ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে অক্সলোটলস। ত্বকের
উপরিভাগ এমনকি নিচের অংশের পচন, ক্ষয় যাই হোক না কেন, সর্বোপরি নতুনভাবে আচ্ছাদিত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই সরীসৃপ। সম্পূর্ণ
সত্য, বাস্তব এটাই। মানবদেহের ক্ষেত্রে যা বিপরীত। কখনওই কোনওভাবেই
নতুন করে গঠন বা পূরণ সম্ভব নয় মানব শরীরের। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে, ‘কম্পেনসেটারি হাইপারপ্লাসিয়া’।
এই
নিয়ে তিন থেকে চার বার দেখেছে। অবাক হয়েছে ধাপে ধাপে। মাত্র একমাসের মধ্যে। ত্রিশ দিনের
মধ্যেই কীভাবে সচল, সক্ষম পুরোপুরি আগের মতোই তৈরি হয়ে যায়
আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গ, কোষ। অভাবনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রাণী সবই
সম্ভব করতে পারে! আর তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো বিষয়টি গুরু মস্তিষ্কে নাড়া দেয়। এই
টিস্যুকেই তো কাজে লাগানো যায়! নিশ্চয়ই পারা যায়! আগামী দশ-বিশ বা তারও বেশি বছরে
পরীক্ষানিরীক্ষায় যা অসম্ভব। অক্সলোটলস তা পারে কয়েকদিনেই।
পথ
একটা পেয়েছে সে। পি-৫৩ এবং পরিবর্তনের সূত্র বিটা-ওয়ান। এটিকেই
পরিবর্তন, পুনরুজ্জীবনের জন্য মানবদেহের কাজে লাগানো যাবে। হ্যাঁ,
ঠিক তাই! মানবকোষে অবশ্য অবশ্যই মিশতে পারে পি-৫৩। ঘেমে ওঠে শরীর
মিহিরের। উল্লাস ফেটে পড়তে চায়! আর একটু... না না, কিছুদিন পরেই ঠিক বুঝতে পারবে, সবকিছু, কর্কট রোগও নির্মূল হবে। হতেই হবে। দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে কপাল। আহ্ মা,
তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমি তো ঠিক পারতাম! পারব। পারব। নিশ্চয়ই।
মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার কেটে ফেলেছিল অক্সলোটলসের সামনের পা। টিজিএফ-বিটাওয়ানের
মাত্রা এতই বেশি যে, সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয়ে গেছে তা। উফ্, কী অসম্ভব ডি.এন.এ পূরণের ক্ষমতা রাখে সরীসৃপটা! বিশ্বাস হয়নি প্রথমে
নিজেকেই। ঠায় কাচের জারের দিকে চেয়ে বসেছিল। চোখের
পাতা পর্যন্ত ফেলেনি। চোখ রগড়ে আবার স্পষ্ট করে দেখেছে। কিন্তু না, কোনও ভুল হয়নি এতটুকু। ব্লাস্টেমা
কাজ করেছে। প্রাণীটা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে না। কেঁচো খাচ্ছে। অন্ততপক্ষে হাজারেরও বেশি
ক্ষমতা রাখে শরীর গঠনের। ঘোলাটে জল বদলে নতুন জলে নুনের পরিমাণ সঠিক রেখে আরও
কৌতূহলে সজাগ থেকেছে। আর বিস্মিত হয়েছে! কাছ থেকে, খুব কাছ থেকে দেখে বুঝেছে ও।
মিহির
চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এর সঠিক প্রয়োগ না করে যে কিছুতেই শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। কীভাবে প্রয়োগ করবে ও! কার উপর? আঙুল
দিয়ে সমানে মাথার চুল ঘেঁটে চলে। দাঁত দিয়ে
কাটতে থাকে নখ। খুব গভীরভাবে বুঝতে হবে মিহিরকে। গঠনের ক্রিয়াগুলোকে সম্পূর্ণভাবে
পরীক্ষা করে যেতে হবে। ও জানে, প্রতিটা কোষেরই নিজস্ব একটা
চরিত্র আছে। তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে অক্সলোটলসের গাঠনিক কোষগুলোকে। প্রভাব কী
পড়বে তাতে! ফেলতেই হবে যে করে হোক। নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হবে। ও তো দেখেছে,
ব্লাস্টেমা কীভাবে ক্ষয়িত অংশের কাঠামো গঠন করতে পারে! তাহলে নয় কেন?
তবুও সংশয়! কোথাও একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে যে! চেষ্টা করে দেখতেই
হবে।
আর
ভাবামাত্রই কাজ। চোখ পড়ল নিজের কাঁপতে থাকা ডান আঙুলের দিকে।
বুকের স্পন্দন বেড়ে চলেছে। ফুলে উঠছে শিরা-উপশিরা। আর কিছুক্ষণ।
তারপরেই তো দিগন্তবিস্তৃত শান্তি!
বাঁহাত
দিয়ে চেপে ধরেছে ডানহাতের তালু। কয়েক সেকেন্ড যন্ত্রণা, প্রবল! কিন্তু এক অদ্ভুত আরাম পাচ্ছে মিহির।
* * * * *
“মিহির যে পারবে আমার আশা ছিল।
এটাই আমি ভেবেছিলাম। বিশ্বাস করতে শুরুও করেছিলাম। কিন্তু আমার আশি বছরের
অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, যেটা খুব মন দিয়ে চাওয়া যায় তার অভিপ্রায়ে
পৌঁছনোর পথে হাজার বাধা। আর সেটাই হল মিহিরের জীবনের বড়ো সর্বনাশ।
লক্ষ্মীপুজোর পর কেটে গেছিল আরও প্রায় দু’মাস।
আমিও বারবার ওর কাছে যাচ্ছিলাম, আর ফিরে আসছিলাম। ভিতরে ভিতরে
একটা মনখারাপ তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আচমকা ফোনটা আসে পিসিমার। প্রচণ্ড কাঁদছিলেন আর
বলছিলেন, তক্ষুনি যেন যাই ওঁদের বাড়ি।
“তখন
ক’টা বাজে! এই ধরো, সকাল আটটা হবে হয়তো। আমি অফিসের
জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ব্যাপারটা কী হয়েছে খোলসা করে বলেননি পিসিমা। আর আমিও বুঝতে
পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল মিহিরের কিছু হয়নি তো!”
“তারপর?”
সঞ্জয়দাদু
পা মুড়ে সোজা হয়ে উঠে বসলেন চেয়ারের উপর। বুঝতে পারছিলাম চরম এক উত্তেজনা আমার মতো
ওঁকেও ঘিরে আছে। পুরনো স্মৃতি ফিরে আসছে মুহূর্তের ঘটনা হয়ে।
“বাড়িতে পা দিতেই কান্নার শব্দটা পাই। মেয়েরা কাঁদছিল। আর
মেসোমশাই, মানে মিহিরের বাবা অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছিলেন দরজার দিকে তাকিয়ে। আমাকে
দেখে এগিয়ে আসেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই নিজে বলে গেছিলেন সবটা।
“মিহির
ঘর থেকে বের না হলেও খাবারটা ঠিক সময়ে চলে যায় ওর দরজার কাছে। দিনুকাকা পিসিমার
সময় থেকেই বোসবাড়ির দেখাশোনার কাজে আছেন। উনি দরজার
কাছে মিহিরের নাম ধরে ডেকে খাবার দিয়ে আসার পর কখনও মিহির ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার
নেয়, কখনও আবার নেয় না। বাসি খাবার নিয়ে চলেও যায় দিনুকাকা। এ তো
রোজকার ঘটনা। এতে অভ্যাসও হয়ে গেছিল বাড়ির সকলের।
“কিন্তু
সেদিন একদম চরম ঘটনা ঘটে যায়। দিনুকাকা
মিহিরকে ডেকে চা দিয়ে আসে সাতটার কাছাকাছি। তারপর যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তার
কিছুক্ষণ পর পিসিমা উপরের ঘর থেকে স্নান সেরে পুজোঘরে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই নাকি
দেখেছেন একটা টকটকে লাল চামড়ার লিকলিকে হাত দরজা ফাঁক করে চায়ের কাপটা নিচ্ছে। ওটা
কার হাত? আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠেন পিসিমা। নিশ্চয়ই কোনও প্রেতাত্মা ভর
করেছে মিহিরের শরীরে! থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওখানেই ফিট হয়ে যান। আর
হাতটাও কাপ-প্লেট মাটিতে ঝনাৎ করে ফেলে দরজা বন্ধ করে দেয়। কোনও সাড়াশব্দ না দিয়ে।
এদিকে পিসিমার জ্ঞান ফেরানো, অন্যদিকে হাতের রহস্য - ডাক পড়েছিল
আমার তাই। মিহিরের দরজার কাছে গিয়ে দেখি বৌমা দাঁড়িয়ে।
দরজার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাচের টুকরো।”
“আমিও শুনেছি কিছুটা সেই গল্প। কিন্তু জানো দাদু, বিশ্বাস করতে মন চায় না। কীভাবে
মানুষ এসব মানে? পাড়াতে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে গেলে বন্ধুরা
কৌতূহলের সঙ্গে সেসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে! কেউ কেউ ঠাট্টাও করে। বলে নাকি বেহ্মদৈত্যের
কাজ! সে মানুষকে দেখা দিলে রাজাও করে, আবার পাগলও!”
“জানি, সৌরভ। পাগল হয়েই
উঠেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা ঠিক কী।
একের পর এক ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো। প্রথমে লক্ষ্মীপুজোর দিন সেই আর্তনাদ, তারপর সেই হাত-রহস্য। পিসিমা
যেভাবে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল না যে তিনি ভুল
দেখেছেন। ভাবছিলাম। অবাক হচ্ছিলাম। সমাধানের উপায়
খুঁজছিলাম। কোনওমতে মেসোমশাইকে আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বলেছিলাম, আমি মিহিরকে বোঝাব। অনুরোধ
করেছিলাম, তার আগে আপনারা ওঝা, তান্ত্রিক এসব
ডাকবেন না।”
“খুব খারাপ লাগে জানো দাদু যখন দেখি, ফটো-ফ্রেমগুলো
পর্দা দিয়ে ঢাকা। কেউ সঠিক উত্তর পর্যন্ত দেয় না। এড়িয়ে যায়। নয়তো ধমকে দেয়। এতবছর
পরেও সেসব পর্দা কেউ সরাতে দেয় না। বলে, নাকি অমঙ্গল হবে। বাড়িতে কু-ছায়া পড়বে।
আমার কৌতূহল আরও দ্বিগুণ হয়। আমি মানি না!
যদি একবার জানতে পারতাম উনি কোথায়, কীভাবে...”
“পারবে তুমি? পারবে মানুষটাকে ফিরিয়ে আনতে?”
“আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব, সঞ্জয়দাদু। পরিবারের এই অপবাদ আমি আর সহ্য
করতে পারছি না। রাতে ঘুম হয় না। মাঝরাতে বিছানায়
উঠে বসি। চোখ জ্বালা করে। আড়াল সরিয়ে সেই সরল মুখের হাসি দেখি।
কারও তো ক্ষতি করতে চাননি। তবে কেন?”
“মিহির আমাকে একদিন বলেছিল, সত্যি সফল হতে পারবে
সেদিনই যেদিন কেউ ওর সাধনাটা বুঝবে। মনে রাখবে। জোর করে নয়। সহজ স্বাভাবিকভাবে ওকে
ফিরিয়ে আনার চেষ্টাই হবে ওর সফলতা। চিঠিতেও লিখত তাই।
তবুও এ অপবাদ নিয়েও জেদ, অধ্যবসায় কমেনি কিছুমাত্র।”
সৌরভের
হাতে এগিয়ে দিলেন চিঠির একটি। ঝাপসা চোখে কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা চোখের সামনে মেলে
ধরল ও।
* * * * *
মিহিরের
চোখের সামনেটা ঝাপসা। এভাবে ঠিক কতক্ষণ ছিল জানা নেই। আস্তে আস্তে বল পাচ্ছে
শরীরে। টেবিলের উপর থেকে মাথাটাকে সামান্য তুলে সোজা হয়ে বসতেই বুকের ভিতরটা হিম
হয়ে গেল আরও একবার। এবারেও সফল! যথাযথ নিখুঁত। ডান আঙুলের সবক’টাই! এমনকি লাল
চামড়াও! একেবারে আগের মতো গজিয়ে উঠেছে
কেটে ফেলার পরেও! কিন্তু ওটা কী? টেবিলের পাশে ওটা কী পড়ে আছে? হাতদুটোকে খানিকটা বুকের কাছে
টেনে এনে ভালো করে দেখল। দরদর করে
ঘামতে শুরু করেছে। তবে কি... অক্সলোটলস তো ঠিকই আছে! তার চেহারা, শরীরে কোনও পরিবর্তন দেখতে পেল না। মেঝে থেকে হাতে তুলে নিল লম্বাটে
প্লাস্টিকের মতো জিনিসটা। খসখসে টাইপের। মাথা ঘুরতে শুরু করল। পাঁচ
থেকে সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। জড়ো হয়ে পড়ে আছে। ছোটোবেলায়
কত দেখেছে বাড়ির বাইরে পড়ে থাকতে। খোলস! কিন্তু কীভাবে? ঘরের মধ্যে! ইউরোডেন সরীসৃপ জাতীয় এই অক্সলোটলস তো খোলস ছাড়তে পারে না। তবে?
কাল
থেকে পরপর কয়েকবার ইওডিওনে ইঞ্জেকশন নিয়েছে। আঙুলগুলো গঠনের সময় যন্ত্রণা করছিল।
সহ্য করতে পারছিল না। এদিকে আগেরদিনের ঘটনার জন্য বাইরে বেরোতেই পারছে না। ভেবেছিল
কেউ নেই, কিন্তু পিসিমা দেখে ফেলেছিলেন। সঞ্জয়ও এসেছিল। মিহির
তারপর আর কিছু জানে না। জ্ঞান ছিল না। শরীরের নতুন অংশ তৈরি হয় বটে, কিন্তু যন্ত্রণা থামে না। আরও কিছু প্রয়োজন। ও বেশ বুঝতে পারছে।
ঘরের বদ্ধ বায়বীয় পরিবেশ ওকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না। জলের মধ্যে কিছুক্ষণ আঙুল
ডুবিয়ে দেখেছে। কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে। শান্তি কি পাবে
মিহির? বুঝে উঠতে পারছে না। মাছ নয়, সরীসৃপ নয়,
এখন মানুষও নয়! তবে ওর শরীরে কীসের লক্ষণ এসব! শুধুমাত্র ফলাফল নিশ্চিত করতে
প্রয়োগ করেছিল নিজের উপর। কীভাবে
বাঁচাবে মানুষকে আঘাতপ্রাপ্ত অথবা ক্যান্সারের পূর্ণ বিষাক্ত কোষ থেকে! সঠিক হয়েও
হচ্ছে না যেন। ভুল থেকে যাচ্ছে বারবার। ভয়
পায় সবাই ওকে। কতদিন খোকার মুখ দেখেনি। জেনেছিল, মেক্সিকোর
সচিমিলকো-তে এই সরীসৃপের আদি বাস ছিল। বর্তমানে লেকের সামান্য দেশের দক্ষিণে
অবস্থিত। জনবসতির বৃদ্ধির কারণে লেক ক্ষয়িত হয়, কমে আসে
প্রাণী। ১৯৯৮, ২০০৩, ২০০৮ সালে কমতে
কমতে অক্সলোটলস ৬০০০, ১০০০, ১০০তে
পৌঁছেছে। জল থেকে বের করে অনেকবার হাতে নিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে মিহির। দেখেছে ওটা
খাবি খাচ্ছে। ফুলকোগুলো দ্রুত ওঠাচ্ছে, নামাচ্ছে। তবে কি মিহির অক্সলোটলস-এর জেনেটিক
কোড ঠিকঠাক ইঞ্জেক্ট করতে পারল না? সস্য কোষ (stem
cell), পুনরায় গঠিত কোষ (prefactory cell) অতি
দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। ইউভি-বি রেডিয়েশন, ওজন লেয়ার থেকে
কোষ গঠনে কোনও পরিবর্তন হয় না। মিহির সাইট্রাইড ফাঙ্গাস থেকেও টিস্যুকে আড়াল করেছিল।
ইঞ্জেকশন সেভাবেই তৈরি করেছিল। যন্ত্রণা আবার হচ্ছে।
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবে কি ওর শরীর খোলস ছেড়েছে? স্পাইনাল কর্ডের নিচে কী একটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হাতটাকে কোনওমতে ঘুরিয়ে
পিছনের দিকে দিতেই চমকে উঠল। প্যান্টের নিচে মাংসের বাড়তি অংশ লেজের মতো বেরিয়ে
আসছে। কী করবে মিহির? কিছু বুঝে উঠতে পারল না। দুমড়ে মুচড়ে
আসছে সমস্ত শরীর। কী করা উচিত ঠিক এখন? সঞ্জয়কে ডাকবে?
ঘরের ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করতে পারে না, যদি ওর কথা অন্য ঘরের কানেকশন
থেকে কেউ শুনে নেয়! তবে কি পালিয়ে যাবে? কীভাবে পালাবে?
কোথায়? নিজের এই উদ্ভাবনকে সফলতা বলবে, নাকি
ব্যর্থতা? মনের নোনতা ভাবটা শরীর জুড়ে। মাত্রাতিরিক্ত টিস্যু
কি খারাপ করল? এই পরিচিতি কীভাবে সবার সামনে আনবে? মিহির কি মা'কে দেওয়া কথা রাখতে পারবে?
* * * * *
“ঠিক পারব আমি! পারব, সঞ্জয়দাদু!”
“কিন্তু... আমি যে মিহিরকে কথা দিয়েছিলাম, আমি কাউকে
জোর করে পাঠাব না ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য!”
“তুমি তো কিছু বলনি। আমি নিজেই এসেছি তোমার কাছে। নিজেই চেয়েছি এই অভিশাপ
থেকে পরিবারকে, বংশকে মুক্তি দিতে। আজ
তিনপুরুষ ধরে যে কুসংস্কার জড়িয়ে আছে, তা সরিয়ে দিতে
চেয়েছি। অথচ দ্যাখো, কী যন্ত্রণায় দূরে সরে গেছেন তিনি!”
“তোমার বাবা-মা রাজী হবে?”
“আমি চাই আগে সত্যিটা সবার সামনে আনতে।
তারপর প্রকাশ করব। তার আগে নয়।”
“কিন্তু ওখানেই যে তুমি তোমার প্রকৃত মানুষকে খুঁজে পাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা
নেই। আর পেলেও সে কী অবস্থায় আছে আমি জানি না।
নিজেকে সবরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি করে রাখবে।
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। সবকিছুই বড়ো ধাঁধার মতো মনে হয়,
সৌরভ!”
আমি
উঠে দাঁড়িয়ে সঞ্জয়দাদুর পায়ে হাত দিলাম। আরও ভালো করে চোখ বুলোলাম খামে লেখা
স্ট্যাম্প আর ঠিকানার উপর। কঠিন কাজ
জানি, তবুও পারতেই হবে। ছোটোবেলা থেকে আমরা মহাপুরুষের জীবনী পড়ি। অথচ
কী ভীষণভাবে বিশ্বাস করি অন্ধ-সংস্কার। ভাবতে অবাক লাগে! নিজেদের মধ্যে যখন দেখি বাড়ির
বড়োরা সেসব মেনে চলে, কেমন একটা অস্থির লাগে! কিশোরকালের না বোঝা প্রশ্নচিহ্ন এখন
অস্থিরতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জার্নালিজম
নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি করার সময়ই মনস্থির করেছিলাম, একটা কিছু
করবই। উপায়টা ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় আরও কয়েকটা বছর। সঞ্জয়দাদুই
একমাত্র পারে, এই আশাতেই আসি। আমার লক্ষ্য সেই মানুষটাকে
সবার সামনে আনা। আমাকেই যে এগিয়ে যেতে হবে! নতুন
শহরে যাবার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি।
* * * * *
তাড়াতাড়ি
এখান থেকে চলে যেতে হবে। এ চেহারা কাকে দেখাবে মিহির? বেরোবার চেষ্টা যতবার করেছে, কোনও না কোনওভাবে বাড়ির
লোকেদের চোখে পড়ে যায়, তাতে বিপত্তি আরও বাড়ে। গতকাল গভীর রাতের দিকে আর কোনও উপায়
না পেয়ে সঞ্জয়কে ফোন করেছিল। সঞ্জয় বলেছে, ও দিনুকাকাকে ম্যানেজ করে ঠিক দরজা খুলিয়ে চলে আসবে।
কিন্তু সঞ্জয়ের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। নাহলে কষ্ট পাবে ও।
একটু
পরেই সঞ্জয় আসবে। মিহির অক্সলোটলস-এর জটিল জিনোমের বিষয়ে আরও বেশি
অধ্যয়ন করেছে। বুঝেছে সরীসৃপটিকে জোরিমিল্ক এবং তার আশেপাশের নিয়ন্ত্রিত খালে
প্রজনন ঘটাতে হবে। বিশেষত জিনগত বৈচিত্র্য ধরার জন্য। আরও কিছুটা সহজ হবে অস্পষ্ট
বিষয়গুলো। মিহিরকে করতেই হবে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেক টেক্সকোকো মক্সসিকো জনগোষ্ঠী
দ্বারা নিষ্পত্তি হয়ে শক্তিশালী শহর সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ১৫২১ সালে স্প্যানিশ জয়
করার পর অঞ্চলটি আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আজ অক্সলোটলস-এর বাসস্থান প্রায় ১৭০ কিলোমিটার
বেড়ি-বাঁধে পরিণত হয়েছে, যা মেক্সিকো সিটির দক্ষিণে বর্তমানে।
প্রাণীটিতে একটি বৃহৎ জিনোম আছে যা ১০ গুণ মানুষের আকার!
মিহিরকে
আরও, আরও অনেকদূর এগোতে হবে। অনেক স্টেম সেল দেহে নির্দিষ্ট
টিস্যুতে পরিণত হয় এবং ভ্রূণকে প্রসারিত করে। সরীসৃপটি টিস্যু তৈরির আগে কোষের
নিঃসৃত এবং প্রসারিত দেখতে পারে। মিহিরকে প্রথমেই অক্সলোটলসের অক্সাইটস থেকে বের
করা একটি টিউমার দমনকারী জিনের উপর সুইচ করার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের সংখ্যা
কমানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে। এমন একদিন আসবে যখন পক্ষাঘাতের রোগ নিরাময়, সুস্থ অঙ্গ বৃদ্ধি, এমনকি ক্ষতিগ্রস্থ সবের জন্য এই আদর্শ প্রাণীর প্রয়োজন
হবে।
“মিহির, আমি এসেছি!”
সঞ্জয়
এসে গেছে। ওকে কী বলবে? অল্প করে দরজা ফাঁক করে মিহির।
“এনেছিস? এনেছিস রেনকোটটা?”
“হ্যাঁ, এনেছি। কিন্তু তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? ঘরে
রেনকোট পরে কী করবি?”
“সে অনেক কথা। আমাকে একটু
বেরোবার ব্যবস্থা করে দিতে পারিস?”
“আরে ঘরের আলোটা তো জ্বালবি! আমি তো তোকে দেখতেই পাচ্ছি না।” সঞ্জয় অধৈর্য
হয়ে ওঠে।
“আলো জ্বালাতে ভাল্লাগছে না। তুই পারবি কি পারবি না তাই বল।”
“আমি তোকে বেরোতে সাহায্য করি, আর সবাই জেনে আরেকটা
ঝামেলা হোক!”
“তাহলে তুই পারবি না!”
“তা কেন? তুই বেরোবি কোথায়, আর লুকিয়েই বা কেন সেটা তো
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। হাজার হোক, বাড়িতে তো আর বাঘ-ভাল্লুক
নেই যে তোকে খেয়ে ফেলবে! তুই যদি আবার আগের মতো সহজ স্বাভাবিক হয়ে যাস, তাহলে সবাই তোকে মেনে নেবে। তুই এরকম ভাবছিস কেন?”
“কেউ মেনে নেবে না!”
“মিহির! পিসিমা কত কাঁদে! মেসোমশাইও...”
“প্লিজ চুপ কর! আমার মায়ের মুখটা মনে পড়ে তোর?”
“দ্যাখ মিহির, তোর মনটা বুঝি। কিন্তু ঐ
রোগ যে কেউ...”
মিহির
আর সঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ করেছিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল মিহির। “আমাকে বেরোতে হবে। নাহলে এ কাজ সম্ভব নয়।
জনন ঘটাতে হবে সরীসৃপের। ক্যানসার বৃদ্ধি দমন তবেই... ওরা
বাঁচলে তবেই আমরা বাঁচব। এর অনন্য শারীরবৃত্তান্ত এবং বিভক্ত
অঙ্গগুলির পুনর্জন্মের অসাধারণ ক্ষমতা সবকিছুই সম্ভব করতে পারে!”
মিহিরের
কথাগুলো সঞ্জয় তেমন ঠিকভাবে বুঝতে পারছিল না। ভাঙা গলার স্বর, ক্রমাগত নিঃশ্বাস
প্রশ্বাস বোঝাচ্ছিল, মিহির যে বাইরে বেরোতে চায় তার একটা সুনির্দিষ্ট
কারণ আছে। সঞ্জয় কীভাবে সে সমাধান করবে?
অন্ধকার ঘরে অস্থিরভাবে মিহিরের পায়চারি ভালো লাগছিল না। নিজেকে
অসহায়ও লাগছিল।
রাত
শেষ হয়ে ততক্ষণে হালকা আভা বোসবাড়ির জানালায় নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। শরৎ শেষের
হালকা হিম ঢুকে পড়ছে গৃহী ঘরের আশেপাশে।
“তুই এখন আয়।”
মিহির
নিচু গলায় কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল। সঞ্জয় ঠিক
ঠাওর করতে পারছে না মিহিরকে। ঘরের পর্দাগুলো পর্যন্ত টানা। ছেলেটা যে কেন এমন
করছে! তাহলে কি ওর আনা সরীসৃপের জন্য আরও ঘরকুনো হল মিহির! কী যে হচ্ছে! সঞ্জয় আরও
একবার মিহিরের দিকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে
পেল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তেতো মনে।
* * * * *
সিঁড়ি
দিয়ে চার-পাঁচ ধাপ নামতেই সামনে বেশ অনেকখানি ফাঁকা মাঠ। এটাকে বাড়ির পিছনই বলা
চলে। মহিলার পিছু পিছু আমি এগোলাম। নিটোল সবুজ ঘাসে ভরা জায়গাটা। মন ভরে পা ডোবানো
যায়। চোখ যতটা যায়, সবুজ আর সবুজ। তার সঙ্গে খেলে
বেড়াচ্ছে জন দশ-বারো পুঁচকের দল। কেউ বেদম দৌড়োচ্ছে। কেউ আবার পায়ের ফাঁকে বল নিয়ে
কেরামতি করছে। বেশ লাগে এমন শৈশব।
এক-পা, দু’পা করে ওদের দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে একটু পরেই ওরা আমাকে
দেখতে পেয়ে থ হয়ে দাঁড়াল। হাজার হোক, অচেনা একটা মানুষ হঠাৎ করে কী করে এল, সেসবই ভাবছে
হয়তো। ওদের পোশাক-আশাক দেখে মনে হল, খুব একটা বড়ো বাড়ির নয়। তবে
প্রাণোচ্ছল দুরন্ত ভাবটা আমাকে কেন জানি না সমস্ত ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। প্রত্যেকেরই
বয়স পনেরোর আশেপাশে। মহিলা ওদের কী যেন বললেন। হয়তো আমার পরিচয়।
মিষ্টি হেসে বিস্ময় চোখে আমাকে দেখতে সার বেঁধে দাঁড়াল ছেলেমেয়েগুলো। ওদেরই মধ্যে
একটা ছয়-সাত বছরের মেয়েকে হাত ধরে মহিলা আমার কাছে নিয়ে এলেন। অন্য কথা তেমন বুঝতে
না পারলেও অঙ্গভঙ্গি ও কথা বলার টোন দেখে, শুনে বুঝলাম মেয়েটির
নাম আবৃল। কী যেন বলতে চাইছিলেন মেয়েটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে। ওঁর চোখে জল চলে
আসছিল বারবার। এখানে আসার আগে সেই প্রৌঢ়র মতো কয়েকবার নিজের মাথাতেও হাত দিলেন
দেখলাম। মেয়েটি একবার মহিলার মুখের দিকে, একবার আমার মুখের দিকে দেখছিল। আমিও
বুঝতে চেষ্টা করছিলাম মহিলার কথা। কিছুক্ষণ
পরেই যখন ওঁর কথা বুঝতে পারছিলাম না, তখন আবার কাজে
লাগালাম ডিকশনারি দেখে শেখা কিছু কথা ‘হাবলা আষ্টেড ইংলেশ’ (ইংরেজি অর্থ, ডু ইউ
স্পিক ইংলিশ?)। ভদ্রমহিলা ক্রমাগত দু’দিকে মাথা
নাড়ছিলেন। তারপর গলার ভেজা স্বর নামিয়ে বললেন, “নো লেনটিএন্ডু।” (ইংরেজি
অর্থ, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড)।
মেয়েটাকে
দেখছিলাম। কী অসম্ভব দীপ্তি ছোটো টানা চোখ দুটোয়!
মহিলা চোখ মুছে আবারও কী যেন বললেন। আমাকে ঘরে
নিয়ে এলেন তারপর। ওদের সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটাতে মন চাইছিল।
ভাবতে
ভাবতে আবার চলে এসেছিলাম সেই মানুষটার কাছে। যার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। হয়তো
আমাদেরও। যে মিথ্যা অপবাদ নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, সেই অপবাদকে সরিয়ে সবার অলক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন এমন এক দুনিয়া, এমন এক
পরিবার যেখানে তিনিই এক, অদ্বিতীয়। এই পথটা ছিল যন্ত্রণার।
যন্ত্রণা শুধু মনের নয়, শরীরেরও।
হ্যাঁ
ঠিকই, আমি তাঁর কথাই বলছি। প্রয়াত রূপনারায়ণ বোসের একমাত্র পুত্র মিহির বোসের কথা।
আমি সৌরভ বোস, তাঁর পৌত্র। পরিবারকে তিনিও ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু সংস্কারকে নয়।
শরীরের পরিবর্তন, আর পরিবার থেকে আলাদা থাকার কারণে অপদেবতার
তকমা দেয় সবাই তাঁকে। গোটা পরিবারে তাঁর জন্য কালো ছায়া পড়বে এমনটাই বিশ্বাস করে
সবাই। জেদ চেপে গেছিল তাঁর। নিজের মাকে হারানোর যন্ত্রণায় এমন এক বিজ্ঞান রেখে
যেতে চেয়েছেন, যার সীমা টানা যাবে না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল
অর্থের। আবারও সঞ্জয়দাদুকে ডাকেন। বাড়ি থেকে কোনওভাবেই কোনও সাহায্যের আশা ছিল না।
মনস্থির করেই নিয়েছিলেন বাড়ি ছাড়বেন। কিছু
সরকারি কাগজপত্রেরও দরকার ছিল। সঞ্জয়দাদু সাধ্যমতো সাহায্য করেছিলেন। কাঠখড় পোড়াতে
হয়েছিল অনেক। সঞ্জয়দাদু ট্র্যাভেলে কাজ করা আত্মীয়কে বলে দেশের বাইরে যাওয়ার কাগজ
করেও দেন। শরীরের অবস্থা ততদিনে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। নিজেই বুঝে উঠতে
পারছিলেন না কী করবেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন সরীসৃপ। একমাত্র
অক্সলোটলসের জৈবিক বৃদ্ধি তাঁর সাধনাকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারে।
এখানে
এসেও বহু প্রতিকূলতায় কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। ঈশ্বরের পরীক্ষাও হয়তো শেষ হয়ে
আসছিল। আবহাওয়া এবং প্রাণীর আদি বাসস্থানকেই
বেছেছিলেন মিহির বোস। খেটে খাওয়া বা পরিশ্রম করবার মতো
শারীরিক ক্ষমতা তাঁর তখন ছিল না। সেই কারণেই নির্জন, নিরিবিলি
স্থান বেছে নেন।
মেক্সিকোর
দক্ষিণ পশ্চিমের টাক্সকো শহর। শরীরটাকে টেনে কোনওমতে আস্তানা বানান। একটা কারখানার
নিচের তলায়, আলো বাতাসহীন ঘরে। অবিশ্বাস্যভাবে ঘটে যায়
একটা ঘটনা। কারখানার মালিকের ছেলের হঠাৎই খেলতে খেলতে ডান হাতের কড়ে আঙুল কেটে যায়
মেশিনে। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যায় ছেলেটা। চিৎকার, চেঁচামেচিতে
কিছুটা বিব্রত হলেও দাদু ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।
প্রয়োগ করেন নিজের জীবনের সেরা ঔষধি। গোটা একটা দিন ছেলেটা অচেতন হয়ে থাকে। জ্ঞান
ফিরতে যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়। বাড়ির লোক
অধৈর্য হয়ে পড়ে। এ-তল্লাটে ডাক্তার বলতে কবিরাজ বা ওই জাতীয় কিছু।
দাদুর কথা আর আত্মবিশ্বাসে এমন কিছু ছিল যাতে তাঁকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারুর ছিল
না। সন্দেহটা শুধু প্রকট হত তাঁর চেহারার আড়ালের কারণে। তৃতীয়দিনের মাথায় ছেলেটা
কেবল সুস্থই হয়নি, পেয়েছিল তার কেটে যাওয়া আঙুলটিও, ছুরিকাঁচির ব্যবহার ছাড়াই! ধন্য ধন্য পড়েছিল আশেপাশে। তারা বিজ্ঞানকে কতটা
মেনেছিল জানা নেই, তবে মেনেছিল দাদুকে, মিহির বোসকে। তারা
বিশ্বাস করেছিল, দাদুর শরীরে ভগবান আছে!
ততদিনে
দাদু যে জেনেটিক কোডের ভ্রান্তির কারণে তাঁর শরীরে পরিবর্তন এনেছিল, তার সামঞ্জস্য
ঘটিয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী অ্যাক্সলোটলস সংগ্রহ করে বৃদ্ধিও ঘটান প্রাণীটির। শারীরিক
অঙ্গ পুনর্জন্মের সঙ্গে সঙ্গে রাজরোগের কোষ দমনেও সক্ষম হন। পক্ষাঘাত, অঙ্গহানি ছাড়াও অন্যান্য কারণেও মানুষ আসতে শুরু করে তাঁর কাছে।
দাদু কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর শরীরের অতিরিক্ত অঙ্গ
যে কোনও মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। প্রকৃতির
সঙ্গে আস্তে আস্তে খাপ খাওয়াচ্ছিলেন নিজেকে। পাশে ছিলেন
এই মানুষগুলো। খোলা মাঠে খেলে বেড়ানো ছেলেমেয়েগুলো কোনও না কোনওভাবে উপকৃত মিহির
বোসের থেকে।
আবৃল, সেই ছোট্ট মেয়েটি জন্ম থেকেই অনুভব করত শরীরের অসম্ভব জ্বালা। সূর্যের আলো
সহ্য করতে পারত না কিছুতেই। দাদুর
আপ্রাণ চেষ্টায় সুস্থ হয়েছে সেও। এখন খেলে
বেড়ায় খোলা আকাশের নিচেই। তারাও দাদুর অস্বাভাবিক সমস্ত কিছুকে মেনে নিয়েই সদস্য
করে নিয়েছে তাঁকে। তাঁর সমস্ত দেখাশোনার ভার নিয়েছে আবৃলের মা।
তাদের বাড়িতেই। আবৃলের শরীরের মারণ অসুখ ত্বক ক্যান্সার আজ
সম্পূর্ণভাবে সুস্থ। তার জীবন মিহির বোসেরই উপহার।
মিহির বোস ভাবেন, তিনি তাঁর মাকেই হয়তো বা ফিরে পেয়েছেন আবারও। সবাই
তাইই মানে। মানি আমিও।
এতবছর পরে এসব অতীত শুধু অতীত নয়, আজকের অবিস্মরণীয় ভবিষ্যৎ হয়ে
থেকে যাচ্ছিল আমার কাছে।
* * * * *
অবিস্মরণীয়
এসবই জার্নালে লিখতে বসেছি মেক্সিকো থেকে ফিরে। একটা মাস হয়ে গেছে। ভালোবাসা ভালোবাসার
মানুষটাকে ফেরাতে পারেনি। হয়তো ওই পরিবেশের মূলেই তিনি নিজস্ব স্বকীয়তা গ্রথিত করে
রেখেছেন। সেখান থেকে তাঁর অপসারণ সম্ভব নয়।
আবার এটাও সত্যি, তাঁকে মেনে নিতে তাদের মতো করে আর কেউ
পারবে না। ছুঁয়ে দেখেছিলাম সেই ঈশ্বরের শরীর। আমারই পূর্বজ! ভাবতে অবাক লাগে। কোনও
খ্যাতি নয়, তবুও বাঁচিয়ে চলেছেন সম্পর্কহীন কিছু মানুষকে। শুধু মানুষের জন্য। যে
সংস্কার তাঁকে ঠেলে দেয় দূরে, তাই তাঁকে আঁকড়ে ঘর দেয় নতুন
করে। আজটেক মাইথলজি অনুযায়ী, অক্সলোটলস মেক্সিকোর মানুষের
কাছে দেবতার রূপক। টেনোচিতলানে মূর্তিও আছে এর।
তবে সে-মূর্তি কিছুটা কুকুরের আর এই সরীসৃপের মিলও বলা চলে।
কুকুর যেভাবে মানুষের উপকার করে স্থলে-জলে, এ সরীসৃপের
পুনর্জন্ম দেবতার আরেক অংশ, লৌকিক মতে তেমনটাই মেনে আসছে তারা। প্রতিদিন সূর্যের
সঙ্গে উদিত হয়ে সূর্যাস্তের কাল অবধি এ-দেবতা আকাশপথে বিরাজ করেন এবং সমস্ত অপদেবতা,
দুর্বলতা, অসুস্থতার হাত থেকে বাঁচান ভূলোককে।
মিহির, আলোর আরেক নাম। সত্যি হয়ে রয়ে গেল। কোনও বাণিজ্যিক প্রচার নয়। মানুষের
মনের গভীরে।
এক অদ্ভুত
শান্তি পাচ্ছি। বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে আমার টেবিলে। জ্বলজ্বল করছে তাঁর
কৃতিত্ব। মলিন হতে দিইনি কোনওভাবেই। সেই ঘরেই যত্ন করে সাজিয়ে চলেছি বিজ্ঞান
ভাবনার পরতগুলো। ছোটো থেকেই। দাদুর ব্যবহৃত ফানেল, সোডা ক্যানের
মতো জার, ড্রেন ট্রাঙ্ক, স্টপ ফুঁ
হিমায়িত প্ল্যাগ সবকিছুকে নেড়ে দেখতে দেখতে বড়ো একাত্ম হয়ে গেছি ওগুলোর সঙ্গে।
খেলাঘর নয়, ওসবেই আমার আনাগোনা দিনরাত। সমস্ত পর্দা সরিয়ে দিয়েছি দাদুর
সাদাকালো ছবি থেকে। স্পষ্ট, নিষ্পাপ প্রাঞ্জল হয়ে ওঠা একটা হাসি। আজ
স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরও একটা মুখ। স্পষ্ট সেই অবয়ব যেন আরও একবার। ছায়া ফেলছে কাচে।
সেই চোখ, সেই হাসি। আর আবছা অবয়বে স্পষ্ট হচ্ছে ফুলকোর মতো কোনাচে
কানদুটো। টুপিটা খুলে হালকা হেসে তাকিয়ে থাকলাম দাদুর দিকে।
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ
অসাধারণ! দারুণ লাগল
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteঅনেক জানা হল। গল্পের পটভূমি খুব ভাল। বিস্তারও সুন্দর। বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পের বিষয়টির জবাব নেই।
ReplyDeleteএভাবে মতামত দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ
DeleteThis comment has been removed by the author.
DeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteগল্পের কন্টেন্ট অসাধারণ । নিঃসন্দেহে অনেক কিছু জানা গেলো । তবে তথ্যপরিবেশনা ও কিছু জায়গায় ভাষার বিস্তার আরো একটু compact হলে আরো ভালো হতো । নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিমত । এমনিতে আমার দারুন লেগেছে । এই জঁরে আরো এরকম গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম ।
ReplyDeleteবেশ। মতামত পেয়ে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
Delete