পেন
সায়নদীপ সেনগুপ্ত
“গাদিয়ারা, গাদিয়ারা,” - জোর চিৎকারে চমকে উঠল
অসীম। বাসের কন্ডাকটার জোরে জোরে ডাকছে, “কে নামবেন? উঠে আসুন, উঠে আসুন।”
নেমে
পড়ল অসীম। লাগেজ বেশি নেই তার। ছোট্ট একটা পিঠব্যাগ। কী আর নিয়ে আসবে সে? দেনা শোধ করতে করতে প্রায়
সব জিনিসই তো বিক্রি করে দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে শুধু বাড়িটা। বাবা মারা গেছেন
ছোটোবেলাতেই আর মায়ের হয়েছিল কোলন ক্যানসার। কেমোথেরাপি চলেছে প্রায় বছর দু’য়েক। সামান্য একটা
কোম্পানিতে সেলস-এর কাজ করে অসীম। এত বড়ো খরচ সামলানো তার কাছে কঠিন কাজ ছিল। তাই
অগত্যা ধারের রাস্তা নিতে হয়েছে। অফিস কলিগ, বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকেই ধার
করতে হয়েছিল। ছ’মাস হল মায়ের মৃত্যু
হয়েছে। আর তারপর থেকেই ধারগুলো শোধ করতে করতে অসীমের অবস্থা খুবই খারাপ। অফিসে
ওভারটাইম করে,
ব্যাঙ্কে
রাখা সামান্য টাকা থেকেও সব ধার শোধ করতে পারেনি সে। এখনও দু-তিন জনের টাকা দেওয়া
বাকি। খুবই কাছের বন্ধু তারা। তাই সামনে কিছু বলে না। কিন্তু মনে মনে টাকাটা কবে
পাবে এটাই ভাবে। অসীম তাদেরকে বলেছে এই মাসের মধ্যেই তাদের টাকা শোধ করে দেবে।
অফিসে কয়েকদিনের ছুটি পাওনা ছিল তার। সেই ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার প্ল্যান কোনও
একটা শান্ত নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে কয়েকটা গল্প কবিতা লিখবে। সেগুলো ছাপিয়ে যদি দুটো
টাকা আয় করা যায় তবে ধারগুলো শোধ করতে পারে সে। এক সময় কিশোর ভারতী, শুকতারার মতো ম্যাগাজিনে
লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার। তাই আত্মবিশ্বাসটা আছে।
বাস স্ট্যান্ডে
নেমে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে অসীম। গাদিয়ারা হাওড়া জেলার একটা খুব ছোট্ট গ্রাম। পাশ
দিয়ে বয়ে গেছে রূপনারায়ণ নদ। লোকবসতি খুব কম। বাইরের লোকের জন্য থাকার জায়গা বলতে
সরকারি ট্যুরিস্ট লজ। বাস স্ট্যান্ডের একমাত্র চায়ের দোকনের মালিককে ঠিকানাটা বলতে
তিনি বললেন, “ডান দিকের রাস্তা ধরি
মিনিট দশেক সোজা হাঁটলেই লজ দেখতি পাবেন।”
দশ-পনের
মিনিট হাঁটার পর অসীম যখন ট্যুরিস্ট লজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তখন কিছুটা হতাশই হল
সে। এইটুকু জায়গায় কেমন যেন একটা শহর শহর ভাব। গেট দিয়ে ঢুকে ডান দিকে একটা
নীলকুঠি,
যেখানে
ব্রিটিশ আমলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার করা হত। আরও কিছুটা এগিয়ে ট্যুরিস্ট লজের
বিশাল বিল্ডিং। চারদিকে অনেক লোক। অসীম আশঙ্কিত হল, নিশ্চুপ পরিবেশ পাবে তো সে?
রিসেপশনে
ঘর বুক করার সময় অসীম বলল তাকে যেন একটা কর্নার রুম দেওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে দোতলার
কোনার ঘরটা ফাঁকা ছিল। তাই সেই ঘরটার চাবি অসীমের হাতে দিয়ে ম্যানেজার বললেন, “দু’দিনের ভাড়া একহাজার টাকা, আপনি যদি এখন কিছুটা দিয়ে
দেন তাহলে ভালো হয়।”
সই
সাবুদ, টাকাপয়সার ঝামেলা শেষ করে
অসীম যখন ঘরে এল তখন প্রায় দুপুর আড়াইটে বাজে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এত ক্লান্ত
লাগছে যে খেতেও ইচ্ছে করল না অসীমের। কোনোরকমে স্নান সেরে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘুম
যখন ভাঙল তখন প্রায় বিকেল ছ’টা। বেশ ভালো লাগছে এবার শরীরটা অসীমের, চাঙ্গা লাগছে বেশ। সে
ভাবল রূপনারায়ণ কাছেই, একটু
হেঁটে আসা যাক তার পাড়ে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, একটা পায়জামা আর গেঞ্জি পরে
বেরিয়ে পড়ল অসীম।
নদীর
পাড়টা একদম ফাঁকা। সেখানে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকল সে। একটা বেশ জম্পেশ গল্পের
প্লটের আটঘাট বাঁধল নদীর পাড়ের নির্মল হাওয়ার মশলা দিয়ে। তারপর উঠে পড়ল অসীম।
দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি, তাই রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে এগ রোল খেয়ে লজে ঢুকে
পড়ল সে।
রিসেপশনটা
যখন পার হচ্ছে তখন ম্যানেজার ডাকলেন, “এক্সকিউজ মি, আপনই কি অসীম দত্ত?”
অসীম
উত্তর দিল,
“হ্যাঁ।”
ম্যানেজার
ডেস্কের ভেতর থেকে একটা প্যাকেটে মোড়া বাক্স বার করে সেটা অসীমের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা আপনার নামে
ক্যুরিয়ারে এসেছে।”
পুরো
তাজ্জব বনে গেল অসীম। সে যে এখানে এসেছে সেই খবর তো কেউ জানে না। তবে কি কোনও
পাওনাদার এটায় করে হুমকি মতো কিছু পাঠিয়েছে? এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরে
চলে এল অসীম। ঘরে এসেই প্যাকেটটা খুলে ফেলল সে। এবার আরও অবাক হবার পালা। একটা
পেনের বাক্স। বাক্সটা খুলতে দেখা গেল যে একটা কালো রঙের ফাউন্টেন পেন। পেনের
ঢাকনাটায় সোনার জল করা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে পেনটা। টানা দু’মিনিট ধরে অসীম শুধু পেনটাকে
দেখেই গেল। তারপর হঠাৎ কী মনে হল ব্যাগ থেকে একদিস্তা সাদা কাগজ বার করে পেনটা
দিয়ে লিখতে শুরু করল অসীম। কী অদ্ভুত কান্ড! গড়গড় করে লেখা এগোচ্ছে। পাতার পর পাতা
শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সময়ের
দিকে খেয়ালই থাকল না অসীমের। সে ভুলেই গেল যে রাত্রে কিছুই খাওয়া হল না। তার চোখের
সামনে তখন শুধুই কাগজ আর পেন। অসম্ভব গতিতে লিখতে থাকল অসীম।
ভোর
চারটে নাগাদ যখন তার পেন থামল তখন সে বুঝতে পারল গোটা একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছে
সে। কিন্তু একদম পরিশ্রান্ত লাগছে না, বরং এক অজানা আনন্দে মনটা ভরে উঠছে। এক
ঘন্টা মতন চোখ বুজে পড়ে থাকল সে। এই উত্তেজনায় ঘুম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাড়ে
পাঁচটা বাজতেই ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামল সে। বাকি টাকা মিটিয়ে, সই-টই শেষ করতে আর দশ
মিনিট মতো লাগল। তারপর অসীম প্রায় একরকম দৌড়েই পৌঁছোল বাস স্ট্যান্ডে। সূর্য সবে
উঠছে তখন।
ছ’টার কলকাতাগামী বাসে উঠে
এসপ্ল্যানেড পৌঁছোতে পৌঁছোতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল। বাস থেকে নেমেই অসীম মেট্রো ধরে সোজা চলে এল
টালিগঞ্জ। সেখানে তার অফিসের পাশেই ‘মহামায়া পাবলিশিং হাউজ’-এর অফিস। দশটায় সেই অফিস খুলতেই
লেখাটা নিয়ে সোজা সম্পাদকের কাছে হাজির হল অসীম।
সম্পাদক
রাশভারী মানুষ,
বললেন, “লেখা রেখে চলে যান, আর আপনার ঠিকানা আর ফোন
নম্বর দিয়ে যান। আমি মতামত জানিয়ে দেব।”
অসীম
লেখাটা তার হাতে দিয়ে বলল, “স্যার, একটাই কপি, তাই বলছিলাম আপনি যদি একটু দেখে বলে দেন তাহলে আমি এক সেট
জেরক্স করে দিয়ে যেতাম আপনাকে।”
সম্পাদক
মুচকি হেসে বললেন, “চিন্তা
করবেন না,
এখানে লেখা
যত্নে থাকে।”
অসীম “আচ্ছা, ঠিক আছে” বলে ব্যাগ থেকে কাগজ পেন
বার করে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখতে লাগল।
“লেখাটার ব্যাপারে আমি কবে
নাগাদ খোঁজ নেব স্যার?” লিখতে
লিখতে মাথা নিচু করেই প্রশ্নটা করল অসীম। কিন্তু ও পাশ থেকে কোনও উত্তর নেই। মাথা
তুলে অসীম দেখল সম্পাদক মহাশয় উপন্যাসটা গোগ্রাসে পড়ছেন।
প্রায়
এক ঘন্টা ধরে দু’কাপ
চা সহযোগে লেখাটা পড়ে এক অন্যরকম দৃষ্টিতে সম্পাদক তাকালেন অসীমের দিকে। সে দৃষ্টি
সম্ভ্রমের দৃষ্টি। তিনি বললেন, “এ লেখা তো গোল্ড মাইন মশাই! না না, এ লেখার পান্ডুলিপি
এখানে রেখে যাবেন না। আপনি কালকের মধ্যে এক সেট জেরক্স করে দিয়ে যান। আলাদা হার্ড
কভারে বেরোবে আপনার উপন্যাস।”
আজ
এক মাস হল অসীমের বই বেরিয়েছে এবং এই এক মাস ধরে টানা বেস্ট সেলার। বেশ ভালো
পরিমাণ টাকা পেয়েছে সে। ধারগুলো সব শোধ করেছে, ব্যাঙ্কে আগের চেয়ে বেশি টাকা
দিয়ে একটা একাউন্ট খুলেছে। আর বাকি টাকায় ভেবেছে বাড়িটা একটু সারাবে।
সেদিন
ছিল রবিবার। অসীম তার টেবিলে বসে সেই পেনটা আর তার বাক্সটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।
হঠাৎ পেনের বাক্সটা হাত থেকে পড়ে গেল, আর পড়ে যেতেই তার ভিতর থেকে একটা চিঠি বেরিয়ে এল। একটু
অবাক হল অসীম। চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল সে...
প্রিয় অশু,
জানি এই অদ্ভুত উপহার
পেয়ে তুই খুবই অবাক হচ্ছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর তুই আমার জন্য যা করেছিস তার তুলনায়
এ উপহার কিছুই না। সেদিন আমি হয়তো নদীতে ডুবেই যেতাম যদি না তুই আমাকে বাঁচাতিস।
তুই নিজেও ভালো সাঁতার জানতিস না। তাও কিচ্ছু না ভেবে জলে ঝাঁপ দিয়েছিলি শুধুমাত্র
আমাকে বাঁচানোর জন্য। তোর এই উপকার আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না রে।
হাই স্কুলের পর থেকে তোর সঙ্গে
দেখাই হয়নি,
কারণ আমি
বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। লেখক হতে চেয়েছিলাম। বাবা রাজি হননি। তাই বেরিয়ে গেলাম
বাড়ি থেকে। তবে কলকাতাতেই ছিলাম। যেটুকু টাকা জমানো ছিল তা দিয়ে একটা হোটেলের ঘর
ভাড়া নিলাম। তারপর থেকে শুরু হল লেখা। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন। তাই আর পেছন ফিরে
তাকাতে হয়নি।
‘পলাশ সেন’ ছদ্মনামে না হলেও খান
কুড়ি উপন্যাস লিখেছি। রোজগারও করেছি বিস্তর।
কিন্তু আজ সব টাকা শেষ।
লিউকোমিয়া হয়েছে আমার। তার চিকিৎসাতেই গেছে সব টাকা। এখন শেষ স্টেজ। আমার হাতে সময়
খুব কম। তাই এই পেনটা, যেটা
দিয়ে আমি লিখতাম সেটা দিয়ে গেলাম তোকে। কারণ আমি জানি একমাত্র তুইই এর মূল্য
বুঝবি।
ইতি
তোর সমু
(সৌমেন্দু সেন)
চিঠিটা
পড়া শেষ করতেই একটা জিনিস মনে পড়ল অসীমের। গাদিয়ারা যাবার পথে
বাসে একজনের কাছ থেকে খবরের কাগজ চেয়ে নিয়ে দেখেছিল সে। সেখানে একটা খবর
বেরিয়েছিল - ‘লেখক পলাশ সেনের
অকালপ্রয়াণ’। কিন্তু মনের অবস্থা ভালো
ছিল না বলে খবরটা পড়েনি। ইস! কেন পড়ল না সেটা, অন্তত নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে
শেষ দেখাটা দেখতে পেত। চোখ দুটো জলে ভরে গেল অসীমের। মুখ দিয়ে একটা কথাই বেরোল, “সমু, আমার লেখার মধ্যে দিয়ে
বেঁচে থাকবি তুই।” অসীমের
চারিদিকে সব কিছু ঝাপসা লাগলেও একটা শব্দ তার চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেটা
টেবিলের ওপর রাখা তার বেস্টসেলার উপন্যাসের শিরোনাম - ‘বন্ধুত্ব’।
_____
ছবিঃ দ্বৈতা গোস্বামী
No comments:
Post a Comment