মেড ডে ও লিরিকদা
অভিষেক সেনগুপ্ত
।। ১ ।।
পুরোপুরি সাইলেন্ট মোডে চলে
গেছে লিরিকদা। এতক্ষণ বসে আছি, অথচ ওর মুখে একটাও শব্দ নেই। উদাস দৃষ্টি। চোখে স্পষ্ট
যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছি! এই সময়গুলোয় লিরিকদাকে আমরা বুঝতে পারি না! কী যে হয় ওর!
বর্ধমানে এখন উৎসবের সময়।
ময়দানে এম্পায়ার সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। বইমেলা চলছে টাউনহলের মাঠে। কৃষ্ণসায়র
পার্কে ফুলমেলা। এ পাড়ায় ও পাড়ায় ফিস্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই আছে। আজ দল বেঁধে
বইমেলা যাওয়ার কথা। ক্লাবে লাইব্রেরি করা হবে। শাঁখারি পুকুর হাউজিং কমপ্লেক্সের অনেক আবাসিক এগিয়ে এসেছেন সাহায্যের
জন্য। দু’হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে আমার দাদুই। আরও অনেক টাকা উঠেছে। কী কী বই কেনা হবে, লিস্ট বানাতে আজকের এই সভা।
কিন্তু লিরিকদা তো মিটিংয়ে থেকেও নেই!
ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ
চলছে। আমি, সামু, সুবায়ু, বাপ্তু সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছি। কচা আর অরি আমাদের থেকে
ছোটো। ওরা এইটে। বাপন এক বছরের বড়ো। ওর
ক্লাস টেন। রেজাল্ট আউট হওয়ার পর স্কুলে এখন ছুটি। নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে
নতুন সেশন। তার আগে ‘দিনরাত’ ক্লাবটাই আমাদের বাড়ি-ঘর। আজ মৌদিও
এসেছে। ও আর ওর বোন সুমি এখন আমাদের ক্লাবের সদস্য। সুমি সিক্সে উঠল। আর মৌদি
কলেজে পড়ে।
কচা মিহি গলায়, ‘তাহলে
বইয়ের তালিকাটা বানিয়ে ফেলি’, বলার পরও হেলদোল নেই লিরিকদার। যে চেয়ারে ও বসে, তার একটা পা ভাঙা। নড়বড়ে। টাল সামলাতে না পেরে বেশ
কয়েকবার পড়েও গেছে লিরিকদা। গদি ছিঁড়ে গিয়ে স্পঞ্জ বেরিয়ে গেছে। তবু এটা ওর প্রিয়।
দিনরাত ক্লাবে এটাই লিরিকদার ময়ূর সিংহাসন।
তাতেই চোখ বুজে এলিয়ে বসে। আমাদের
কথা বোধহয় কানেও যাচ্ছে না ওর।
হঠাৎ ফোঁৎ করে দীর্ঘশ্বাস
ফেলে চোখ মেলে তাকাল লিরিকদা। আমরাও তাকালাম ওর দিকে।
কী আশ্চর্য, লিরিকদার চোখে জল!
মৌদি অবাক হয়ে বলল, “এ কী লিরিকদা, তুমি কাঁদছ?”
পুকুরের ধারে ক্লাবটা বলে
সবসময় আলোবাতাস খেলে। শীতকালে জানালা দিয়ে হইহই
করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। জ্যাকেট-চাদর চড়িয়েও রীতিমতো কাঁপছি। তার মধ্যে লিরিকদার কান্নাকাটি
ঘাবড়ে দিয়েছে।
পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের জল মুছল লিরিকদা। তারপর নাক টেনে
বলল, “লোঁকে
লঁক লেঁকে লেঁকো লেঁ!”
লিরিকদাকে নিয়ে এই এক
মুশকিল। ভয়ঙ্কর তোতলা। কথা বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে যায়। ল আর ক দিয়ে তখন পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করে। প্রতিটা শব্দে থাকে
চন্দ্রবিন্দু। যে ভাষায় ও কথা বলে, সেটা হিব্রুও হতে পারে! আমরা ছাড়া আর কেউ
উদ্ধার করতে পারে না। লিরিকদা যা বলল এইমাত্র, বাংলায়
তার অর্থ, চোখে জল এসে গেল রে!
“তোমার
সঙ্গে কি কারও কিছু হয়েছে?” একটু
উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম আমি। লিরিকদাকে আমরা অত্যন্ত ভালোবাসি। আমাদের হিরো। ওর
কান্নাকাটির পিছনে নিশ্চয় বড়ো ঘটনা
আছে।
জলভেজা গলায় লিরিকদার
উত্তর, “মুনাইয়ের
মাকে দেখে!”
মুনাইয়ের মা? সে আবার কে? মুনাইয়ের
মা কি খুব অসুস্থ? কার জন্য প্রাণ কেঁদে উঠেছে লিরিকদার?
আমাদের চোখে-মুখে হাজারো প্রশ্ন।
লিরিকদা বিরতি নিয়ে বলল, “মুনাইয়ের
মা আমাদের বাড়িতে কাজ করে।”
ও হরি, বাড়ির কাজের লোক!
সে তো আমার বাড়িতেও আছে! পলাপিসি আমাদের বাড়ির কাজ করে। আমার ডাকনাম রিন। সেটা কিছুতেই
বলতে পারে না। হয় লিন বলবে, না হলে ইন! আমার হেব্বি রাগ হয়। তবে মানুষটা সরল। সবার
বাড়িতেই কেউ না কেউ কাজ করে। তাদের জন্য লিরিকদা কেঁদে ফেলল!
গলাটা নরম করে আমি বললাম, “মুনাইয়ের মা কি অসুস্থ?”
লিরিকদা একইরকম মুখে ল আর
ক মিশিয়ে বলল, “না রে রিন, অসুস্থ নয়। বলতে পারিস,
ওদের জীবনটাই অ-সুখের। সুখের মুখ ওরা দেখেইনি কখনও!”
তাজ্জব ব্যাপার। হঠাৎ দার্শনিক হয়ে গেল নাকি ক্লাব প্রেসিডেন্ট? অবশ্য কথাটা ভুল বলেনি। নেহাত পেটের দায়ে লোকের বাড়িতে কাজ করতে আসে ওরা। পলাপিসিই যেমন। ওর স্বামী
রাইস মিলে চাকরি করত। সুখের সংসার ছিল।
হঠাৎই একদিন মিল বন্ধ হয়ে যায়। পরিবার চালাতে না পেরে
আত্মহত্যা করে পলাপিসির বর। সেই থেকে লোকের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মানুষ করছে।
“মুনাইয়ের
মাকে দেখে আজ খুব কষ্ট পেয়েছি। এই শীতকালেও ভোরবেলায় কাজে আসে। দেখলাম,
ঠান্ডা জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাতে হাজা হয়েছে। ক’টা দিন
বিশ্রাম নিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। বেচারির সে
সুযোগও নেই।”
সত্যিই খারাপ লাগার মতো ঘটনা। মৌদি বলল, “আমাদের বাড়িতে কাজ করে মালতিমাসি। ওর কয়েকদিন ধরে জ্বর। তার মধ্যেও কাজে
আসছে। মা কাল জানতে পেরে ওষুধ কেনার টাকা দিয়েছে। একটা দিনের ছুটিও।”
লিরিকদা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলে উঠল, “মৌ, অনেক বাড়িতে এদের অবস্থা খুব খারাপ।
ছুটি চাইলে পায় না। না বলে ছুটি নিলে মাইনে কাটা যায়। মরতে-মরতেও কাজে আসতে হয়।”
দাদু বলে, মনখারাপ নাকি
ছোঁয়াচে রোগ। আজ বুঝতে পারলাম। লিরিকদার
মনখারাপটা আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।
আমি বললাম, “আচ্ছা, এদের জন্য আমরা কিছু করতে পারি না?”
লিরিকদা
উজ্জ্বল চোখে তাকাল। “ঠিক
বলেছিস, রিন। কিন্তু কী করব?”
আজ সকালে ‘দিনরাত’-এর কার্যকরী সমিতির সভা ছিল বইমেলা
নিয়ে। লাইব্রেরির প্রসঙ্গ হারিয়ে গেল।
অরি এমনিতে চুপচাপ। সে হঠাৎই বলল, “ধরো, যদি কোনও হেলথ ক্যাম্প করা
যায়। বিনামূল্যে ডাক্তার দেখাবে। ওষুধ পাবে।”
বাপন বলল, “এই শীতে কম্বল দেওয়া যায়।”
তুমুল উৎসাহে সামুর পরামর্শ,
“ওদের ছেলেমেয়েদের স্কুলের বই দিতে পারি।”
মৌদি বলল, “কিন্তু একবার এইরকম কিছু করলে ওদের খুব একটা সুরাহা হবে কি? বরং একটা ফান্ড
তৈরি করে ওদের নিয়মিত হেল্প করা যেতে পারে।”
লিরিকদা গলা ঝেড়ে বলল, “কথায় বলে, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট
হোম। আমরা সেটাই শুরু করব। কিন্তু আমার পরিকল্পনা অন্যরকম। বছরের একটা দিন যদি
এদের নামে ডেডিকেট করা যায়, কেমন হয়?”
আমরা সবাই হাঁ। দিন
ডেডিকেট করাটা আবার কী রকম?
লিরিকদা সবার দিকে তাকিয়ে
বলল, “ইন্ডিপেনডেন্স ডে, রিপাবলিক ডে যেমন
আছে। আবার ধর মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে পালন হয়। চিলড্রেন্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ও আছে। ঠিক এইরকমই যদি আমরা ‘মেড ডে’ চালু করি?”
প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে
পারিনি। এবার ভোরের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। অসাধারণ
প্ল্যান!
লিরিকদা বলে চলেছে, “যত দূর জানি, ইউরোপের অনেক দেশে মেড ডে পালন হয়। কিন্তু সেটা ঘর পরিষ্কারের
দিন। কারণ, ওসব দেশে মেড সারভেন্ট
কনসেপ্টটাই নেই। আমাদের সমাজ অন্যরকম। তাই যে সব মহিলারা আমাদের বাড়িতে কাজ করে, তাদের
জন্য একটা দিন পালন করা যায়। এক সপ্তাহ পর নতুন বছরে পা দেব। নতুন বছরের প্রথম দিনটাই
হতে পারে মেড ডে।”
মৌদি চেঁচিয়ে উঠল, “দারুণ ভেবেছ। থ্রি চিয়ার্স ফর লিরিকদা।”
আমরা কোরাস তুললাম, “হিপ হিপ হুরররররে!”
।। ২ ।।
লিরিকদার কোনও ভেঞ্চার
মানে, শেষ পর্যন্ত ঝামেলায় ভেস্তে যাওয়া। এর
আগেও হয়েছে। এবার যাতে না হয়, আটঘাট বেঁধে নামলাম আমরা। প্রথমেই যে সমস্যাটার
মোকাবিলা করতে হতে পারে, সেটা হল, পয়লা জানুয়ারি
যদি মেড ডে হয়, পলাপিসি, মুনাইয়ের মা, কমলামাসিদের ছুটি দিতে হবে। আমাদের মায়েরা এটা না-ও মানতে পারে। মৌদি
সমাধানসূত্র বার করল। হাউজিংয়ে পৌষ সংক্রান্তির
দিন ফিস্ট হয়। রাতে সোসাইটির হল ঘরে
খাওয়াদাওয়া হয়। ওটা পয়লা জানুয়ারিতে করার প্রস্তাব দেওয়া হবে। যদি দু’বেলাই খাওয়ার
আয়োজন করা হয়, বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে না।
শুভস্য শীঘ্রম! মেড ডে-র
পুরো ভাবনা ফেঁদে ফেলার জন্য হাউজিং সোসাইটির সেক্রেটারি প্রথমেশ হালদারের সঙ্গে
দেখা করতে গেলাম সবাই মিলে।
প্রথমেশকাকুকে দেখতে
অনেকটা কুড়ি-তিরিশের দশকের বাঙালিবাবুদের মতো। চুপচুপে তেল দিয়ে পেতে চুল আঁচড়ান। সরু ফিনফিনে গোঁফ। সবসময় গিলে
করা সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি পরেন। খুব পান খান
বলে ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল। গলার আওয়াজটা চমৎকার। আকাশবাণীর ঘোষক ছিলেন। সদ্য অবসর
নিয়েছেন। কিন্তু অভ্যেসটা থেকে গেছে। সোসাইটির
অফিসঘরই এখন তাঁর অবসরযাপন। আমাদের দেখে চবনবাহারের গন্ধ ছড়িয়ে প্রথমেশকাকু নাটকীয়ভাবে
বললেন, “জাওয়ানদের মার্চপাস্ট আজ এদিকে কেন?”
তোতলামির জন্য লিরিকদা প্রকাশ্যে
খুব বেশি কথা বলে না। পুরো ব্যাপারটা প্রথমেশকাকুকে বুঝিয়ে বলল মৌদি। অবাক
হয়ে দেখলাম, প্রথমেশকাকুর মুখ ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে!
প্রথমেশকাকুর বউ, মানে
মিনিকাকিমার দজ্জাল হিসেবে এলাকায় বেশ নামডাক আছে। নিন্দুকেরা বলে, ওঁর তিরিক্ষি
মেজাজের জন্য নাকি ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে কাকও বসে না! কাজের লোকের সঙ্গে অহরহ
ঝামেলা। কেউ কাজ করতে চায় না। সপ্তাহে-সপ্তাহে
মেড বদলায় মিনিকাকিমা। প্রথমেশকাকু হাউজিংয়ের সমস্ত অনুষ্ঠানে অঘোষিত ঘোষক। কিন্তু
মিনিকাকিমার সামনে ভুলেও মুখ খোলেন না।
মৌদির প্রস্তাব শুনে ভড়কে
গিয়ে প্রথমেশকাকু বললেন, “কাজের লোকগুলো ভারী নচ্ছার। মাইনে নিয়ে গোলমাল করে। তোমাদের কাকিমা ভীষণ
বিরক্ত। তাদের নিয়ে আমি মাতামাতি করছি, মিনি জানতে পারলে রক্ষে নেই।”
মৌদি বলল, “দেখুন কাকু, কেউ কেউ খারাপ, সবাই নয়। ওরা ভীষণ কষ্টে জীবনযাপন করে। তাদের
জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। কয়েকজনের জন্য সেটা বন্ধ করা ঠিক হবে না।”
প্রথমেশকাকুর পাশের চেয়ারে
সোসাইটির প্রেসিডেন্ট বিজন দাশগুপ্ত। পঁয়ষট্টি
পেরিয়ে গেলেও ভীষণ হ্যান্ডসাম। বিজনজেঠু কর্মজীবনে একটি বড়ো কোম্পানির রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার ছিলেন। আলপিন টু এলিফেন্ট সব বিক্রি
করে দিতে পারেন। আমাদের প্রস্তাব শুনে তাঁর সেলস সত্ত্বা জেগে উঠল।
গুটিয়ে থাকা প্রথমেশকাকু
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বিজনজেঠু বললেন, “অতি উত্তম ভাবনা। এটা সেলেবল প্রোডাক্ট। দারুণভাবে বিক্রি করা যায়। আমি
নিজে এটার সেলস পার্টটা দেখব।”
তারপর প্রথমেশকাকুর দিকে
তাকিয়ে বললেন, “প্রথমেশ, তোমার এত ভয় পাওয়ার কিছু
নেই। দরকার পড়লে আমি নিজে মিনির সঙ্গে কথা বলব।”
প্রথমেশকাকু মিনমিন করে কী
বললেন, বোঝা গেল না। আমরা মাথা ঘামালাম না। লিরিকদার নতুন ভাবনায় যখন শিলমোহর মেরে
দিয়েছেন বিজনজেঠু, আর চিন্তা নেই। পৌষ সংক্রান্তির বদলে পয়লা জানুয়ারিতেই ফিস্টের
দিন ঠিক হয়ে গেল। দু’বেলাই খাওয়ার ব্যবস্থা হবে আবাসিকদের। বিজনজেঠু আমাদের স্পনসরশিপ
জোগাড় করে দেবেন, কথা দিলেন।
হাতে মাত্র সাত দিন। দ্রুত কাজ
গোছাতে হবে। হাউজিংয়ে সব মিলিয়ে
দু’হাজার ফ্ল্যাট। নয়-নয় চার-পাঁচশো কাজের লোক
নিয়মিত কাজ করতে আসে হাউজিংয়ে। সেদিক থেকে
দেখলে মহাযজ্ঞ। সব গোছাতেই সাত দিন কেটে গেল।
।। ৩ ।।
হাউজিংয়ে দুটো মাঠ আছে। একটা
পার্ক মতো। অন্যটা বড়ো। ওখানে আমরা ফুটবল, ক্রিকেট খেলি। বড়ো মাঠটাতেই মেড ডে-র অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাঠের একপ্রান্তে বিশাল শামিয়ানা টাঙানো। সকাল
থেকে জমায়েত শুরু হয়েছে পলাপিসি, কমলামাসি, মালতিমাসি, মুনাইয়ের মায়েদের। ‘দিনরাত
ক্লাব’-এর ব্যানারে তিন দফায় চলবে অনুষ্ঠান। সকালে হেলথ চেক আপ। জলখাবার
স্পনসর করছে ‘কিছুমিছু’ নামে একটা রেস্তোরাঁ। দুপুরে মেডদের কৃতি সন্তানদের
পুরস্কৃত করা, পড়াশোনার বইপত্র বিতরণ। সেটার স্পনসর ‘ডুব সাঁতার’ নামের একটা বইয়ের দোকান। তারপর লাঞ্চ - বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ সহকারে। সেটার
জন্য এগিয়ে এসেছে ‘চোখের খিদে’। বিকেলের পর থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কম্বল বিতরণ ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান। ডিনার দিয়ে মেড ডে শেষ। রাতের খাবারের যা মেনু,
বিয়েবাড়ির ভোজ বলা যেতে পারে।
বিজনজেঠু কথা রেখেছেন।
একটা নামী মোবাইল সংস্থা আমাদের পুরো অনুষ্ঠানটা স্পনসর করছে। আমাদের অনুষ্ঠানের
বাজেট অবশ্য অনেক। সোসাইটি থেকে কিছুটা হেল্প করেছে। বাকিটা লিরিকদার ক্যারিশমা।
হাউজিংয়ের মেন গেটটার
মাথায় একটা বিরাট হোর্ডিং লাগানো হয়েছে। ফুল দিয়ে ‘মেড ডে’ লেখা। সারা হাউজিং ছেয়ে গেছে ফেস্টুনে। রাস্তার
ধারে ধারে মুনাইয়ের মা, পলাপিসিদের বড়ো কাট আউট।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ব্রিগেডে এসে পড়েছি!
সকাল দশটায় মেড ডে-র
শুভারম্ভ। প্রধান বক্তা শিউলি চক্রবর্তী। ইনি হাউজিংয়েরই বাসিন্দা। কাকিমা একাধারে নারীবাদী নেত্রী। পিছিয়ে পড়া মহিলাদের
অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছেন দীর্ঘদিন। সেই কারণেই
হয়তো বাড়ির কাজের লোককেও শিউলিকাকিমা ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। কাকিমা
আবার লেখিকাও। সুতরাং ‘মেড ডে’ অনুষ্ঠানের সূচনার জন্য যোগ্য লোক তিনি।
মেড ডে যখন, তাদের একজনকেই
অনুষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট করা উচিত। সেই মতো মুনাইয়ের মাকে প্রথম মেড ডে-র সভাপতি
করা হয়েছে। সে বেশ সেজেগুজে এসেছে। গালটাও
লাল-লাল লাগছে! কী লাগিয়েছে কে জানে!
সারা বিশ্বের দায় নিতে
পারছি না, তবে এই ধরনের ব্যাপার বোধহয় ভারতে প্রথম। সকাল থেকে টিভি চ্যানেল আর
প্রিন্ট মিডিয়ার ভিড় দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। মুনাইয়ের মা’র কয়েকটা ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলেছে চ্যানেলগুলো। সে লিরিকদার প্রচুর গুণগান করেছে।
সবমিলিয়ে আমাদের লিরিকদা আবার হিরো।
একটা সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি
পরে বরকত্তার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে লিরিকদা। হাতে
অনুষ্ঠানসূচির একতাড়া কাগজ। আমাদেরও বেজায় কাজ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে প্রথমেশকাকুকেই
ভাবা হয়েছিল। মিনিকাকিমার ভয়ে তিনি কয়েকদিন গা
ঢাকা দিয়েছেন। বাড়িতে গিয়েও পাইনি ওঁকে।
মৌদি আর সুমি যৌথভাবে ব্যাপারটা সামলাচ্ছে।
ঠিক দশটায় শুরু হয়ে গেল
অনুষ্ঠান। মেড ডে-র প্রধান বক্তা
শিউলিকাকিমা মঞ্চে উঠতেই হাততালির বন্যা। বাইরের অনেকে, যারা নানা বাড়িতে কাজ করে,
তারাও ঢোকার চেষ্টা করেছিল। যেহেতু এবার প্রথম। এবং শুধুমাত্র হাউজিংয়ের মেডদের
নিয়ে। অন্যরা ঢুকে পড়লে হাউজিংয়ের
কাজের লোকেরা বঞ্চিত হবে। এটা অনুমান করে আগে থেকেই পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়েছিল।
সেই কার্ড বুকে ঝুলিয়ে এসেছে প্রত্যেকে। ফলে অবাঞ্ছিত কোনও ঝামেলার মুখে এখনও পড়তে
হয়নি। যা হালচাল দেখছি, এবার কোনও অশান্তি হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
মেড ডে-র সভাপতি মুনাইয়ের
মাকে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নিল মৌদি। মঞ্চের সামনেটা যেমন লোকে লোকারণ্য, তেমনই মাঠের লাগোয়া ফ্ল্যাটগুলোর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
অনুষ্ঠান দেখছেন আমাদের মা-কাকিমারা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করলেন শিউলিকাকিমা।
“নারীরা
যুগে যুগে বঞ্চিত। পুরুষশাসিত সমাজ তাদের কথা কখনও ভাবেনি। লিরিকের উদ্যোগকে
সাধুবাদ জানাই। মুনাইয়ের মায়েরা এতদিন আমাদের ঘরের কাজ করছেন। ওঁরাই আমাদের আলো। ওঁরা না থাকলে আমরা অন্ধ। ওঁদের সম্মান জানাতে পেরে ভালো লাগছে।
আমি গর্বিত। আমরা এঁদের তুইতোকারি করি। অনুরোধ করব, এঁদের
প্রাপ্য সম্মানটুকু দিন। আর, মুনাইয়ের মায়েদের বলব, আপনারা অবলা নন। নিজেদের দাবি
সংগঠিত করুন। তুলে ধরুন।”
শিউলিকাকিমার বক্তব্য শেষ
হওয়ার পর পলাপিসি, কমলামাসিরা হাততালি দিতে ভুলে গেছে। শাড়ির
খুঁট দিয়ে অনেকেই চোখের জল মুছছে। মঞ্চে বসেই মুনাইয়ের মা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। আমরাও রীতিমতো বিস্মিত। মৌদি
প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে হাততালি দিতেই সারা মাঠ আপ্লুত।
সূচনা হয়ে গেল প্রথম ‘মেড
ডে’-র। হেলথ চেক আপ ক্যাম্পগুলোতে সবাই ডাক্তার দেখাতে ব্যস্ত। দুপুরের অনুষ্ঠানে মেডদের কৃতি সন্তানদের পুরস্কৃত করা হল। বইপত্র দেওয়া হল
তাদের ছেলেমেয়েদের। পুরো ব্যাপারটা খুব
মসৃণভাবে এগোচ্ছে। আমরা সবাই খুশি। লিরিকদাও হাসি হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুনাইয়ের মায়েরা আমাদের অনেক আশীর্বাদ করেছে।
আমাদের বাবা-মায়েরাও ‘মেড ডে’ নিয়ে বেশ সন্তুষ্টই মনে হল।
।। ৪ ।।
বিকেল পাঁচটা থেকে সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান। শুরুটা হল মৌদির রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে, ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’।
বড্ড ভালো গায় মৌদি। বছরের প্রথম সন্ধেটা ওর গলার মৌতাতে ম-ম করছে। এরপর গান গাইবে পলাপিসি। ও ছেলেবেলায় গান শিখেছিল। মেডদের
বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ‘আতাগাছে তোতাপাখি’, ‘শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে’ গোছের আবৃত্তি
করবে। তারপর ‘দিলখুশ’ নামে একটা ব্যান্ডের লাইভ পারফরম্যান্স। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবে মুনাইয়ের মা। কী বলতে হবে, লিরিকদা একটা
কাগজে লিখে দিয়েছে। মুনাইয়ের মা আবার
পড়তে পারে না। দুপুর থেকে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের ভাষণ তাকে মুখস্থ করিয়েছে সুমি।
জমজমাট অনুষ্ঠান হল।
‘দিলখুশ’-এর লাইভ পারফরম্যান্স দারুণ উপভোগ
করেছে সবাই। কমলাপিসিরা নেচে-টেচে
একসা! এবার মেড ডে-র সভাপতি হিসেবে মুনাইয়ের মা বক্তব্য রাখবে। অনুষ্ঠান এখানেই
শেষ। তারপর ডিনার।
এই অনুষ্ঠানের জন্য
লিরিকদার মা একটা পুরোনো সিল্কের
শাড়ি উপহার দিয়েছে মুনাইয়ের মাকে। ওটা পরে মাইকের সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে।
হবেই তো, বক্তব্য রাখা কি চাট্টিখানি ব্যাপার!
মুনাইয়ের মা নীচুগলায় বলতে শুরু
করল, “জীবনে ভাবি নাই, মাইকের সামনে
ডাঁইরে কতা কইব। লিরিকের জন্য হয়েচে। ওদের জন্য একটা হাততালি দাও সবাই।”
মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা সবাই। একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছে।
দু’হাত তুলে হাততালি
থামিয়ে মুনাইয়ের মা আবার বলতে শুরু করেছে। “কত কিচুই
তো হয়। কিন্তু আমাদের লিয়ে কেউ ভাবে নাই। আজ নতুন জনম হল আমাদের। আমার চোকে জল চলে
আসচে। কচিবেলা থিকে কাম করসি। কোনওদিন ভাবি নাই, আমাদের লিয়ে একটা দিন হবে।”
আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে
মুনাইয়ের মা। গলা কাঁপছে। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নিল। লিরিকদার লেখা
নোটটা বোধহয় খুব একটা মুখস্থ হয়নি ওর। তবু
ম্যানেজ করে নিচ্ছে। মুনাইয়ের মাকে এই প্রথম বেশ বুদ্ধিমান
মনে হল আমার।
“নোকে
বড্ড অবহেলা করে। পবলেম হয় কাজ করতে এসে। মুক বুজে সইতে হয়। বাসন মাজতে মাজতে হাতে
হাজা পড়ে গেচে। সরিলটাও খারাপ। কিন্তু ছুটি দিবে না কেউ। না বলে নিলে মাইনা কেটে
লিবে। ঘরে এতগুলো প্যাট, তাদের মুকে কী দিব? মাইনা বাড়াতে কইলে বাড়ায় না। আমাদের কতা কেউ ভাবে না।”
মঞ্চের সামনে হাউজিংয়ের নানা
ফ্ল্যাটে কাজ করা চার-পাঁচশো মেড বসে। তারা যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। ‘মুনাইয়ের মা
ঠিক কইসে’ বলে উঠছে কেউ কেউ! পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে গেল।
মুনাইয়ের মা তার জলভেজা গলা
হঠাৎ খাদ থেকে চড়াইয়ে তুলে বলল, ‘আমরা আর সইব
নাই। পাইট না কি কয় যেন ওটারে, হ্যাঁ, নড়াই করতে হবে। আজ আমাদের দিন। আজ থিকা আমরা
শপত লিচি, আমাদের মাইনা যতদিন না পাঁচশো টাকা করে বাড়ানো হচ্ছে, কাম বন্দ। আজ থিকা
হরতাল শুরু।’
আমরা সবাই লিরিকদার দিকে
তাকালাম। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে, সেটা লিরিকদাই লিখে দিয়েছিল। সুমি সেটা মুখস্থ করিয়েছে। ওতে কি এসব লেখা
ছিল নাকি? লিরিকদাও দেখলাম ফ্যাল ফ্যাল
করে তাকিয়ে রয়েছে মাইকের সামনে দাঁড়ানো মুনাইয়ের মায়ের দিকে। ওর চোয়াল ঝুলে পড়েছে।
আমরা সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছি বুঝেই আরও ঘাবড়ে গেল। ল আর ক দিয়ে কোনওক্রমে বলল, “আমি এসব লিখিনি। সুমিকে জিজ্ঞেস কর তোরা!”
লিরিকদার সমর্থনে সুমি
ততক্ষণে বলে উঠেছে, “স্পিচটাতে এসব লেখা ছিল না।
মুনাইয়ের মাকে এগুলো কে শেখাল, বুঝতে পারছি না।”
তবে কী শিউলিকাকিমা? আমি
দেখেছি, বিকেলের এই অনুষ্ঠান শুরুর আগে মুনাইয়ের মা, পলাপিসি, কমলামাসিদের সঙ্গে কথা
বলছিলেন শিউলিকাকিমা। গুরুত্ব দিইনি। তাছাড়া কাজের চাপও ছিল তখন আমাদের। এখন মনে
হল, শিউলিকাকিমাই হয়তো মুনাইয়ের মায়েদের ভিতরের প্রতিবাদী নারীকে জাগিয়ে তুলেছেন।
কে শিখিয়েছে, অপরাধী
খোঁজার সময় নেই! লিরিকদার মায়ের দেওয়া সিল্কের
শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিয়েছে মুনাইয়ের মা। মুষ্টিবদ্ধ ডানহাতটা রাজনৈতিক নেতাদের
মতো শূন্যে তুলে গর্জে উঠল, “তোমরা কি
আমার সঙ্গে পাইট করতে নেডি?”
মঞ্চের সামনে যেন সুনামি
উঠেছে। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “নেডি-নেডি-নেডি!”
হাউজিংয়ের আবাসিকরা, যারা
এতক্ষণ অনুষ্ঠানটা উপভোগ করছিল, তাদের চোখ-মুখ শক্ত
হয়ে গেছে। ভিড়ে মিনিকাকিমাকে দেখতে পেলাম। উনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছেন। নিশ্চয়
লিরিকদাকে।
মঞ্চটা হঠাৎই ছোটো হয়ে এল আমাদের কাছে। বুঝতে পারছি, বিপদ ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় কে যেন
আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। তাকিয়ে দেখি, মৌদি!
রাতের অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে
এসেছে। শীতের রাত বলে কুয়াশার ছেঁড়া ছেঁড়া চাদর উড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা দশজন তাতেই মিশে
যেতে লাগলাম একে একে। মিনিকাকিমারা ধরতে পারলে বেইজ্জত হয়ে যাবে। আমাদের মায়েদের হাতেও চড়চাপ্পড় খেতে পারি।
ঠিক তখনই শুনতে পেলাম,
রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে মঞ্চ থেকে স্লোগান তুলেছে মুনাইয়ের মা, “আমাদের দাবি…”
পলাপিসি, কমলামাসিরা গলা
মেলাচ্ছে, “মানতে হবে, মানতে হবে!”
মুনাইয়ের মা ফের গর্জে উঠল,
“ইলকিলাব…”
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কোরাস উঠল,
“জিল্লাবাদ, জিল্লাবাদ!”
_____
ছবিঃ পার্থ
মুখার্জী
No comments:
Post a Comment