আসিরগড়ের চিরঞ্জীবী
দীপিকা মজুমদার
।। ১ ।।
ইন্দোর থেকে গাড়িতে যখন রওনা
হলাম তখনও ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি এতটা সময় লেগে যাবে বুরহানপুর পৌঁছোতে। গুগলে
সার্চ করে দেখেছিলাম চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। কিন্তু আমাদের সময় লাগল প্রায়
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ আছে, শুরু থেকেই অনিমেষ গাড়িটা একটু
ধীরেই চালাচ্ছিল।
ইন্দোরের মূল শহর ছাড়িয়ে দু-একটা
মফঃস্বল আর গ্রাম পেরিয়ে এলে বাকি রাস্তাটা প্রায় নির্জন। সময়টাও বর্ষাকাল,
আশেপাশের জঙ্গল থেকে সবুজের বাহার রাস্তায় উপচে পড়ছে। আবহাওয়া
অনুযায়ী আগামি দু-তিনদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা তেমন
নেই, আকাশও মেঘমুক্ত। সপ্তাহান্তের দুটো দিন ছুটিটা একটু অন্যরকম ভাবে কাটাব বলে
বদরউদ্দিন সাহেবের পরামর্শে আমরা দু’জন বুরহানপুর চলে এলাম। আমি আর অনিমেষ
জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের আর কর্মসূত্রে ইন্দোরে, যদিও আমাদের পরিচয় চাকরিক্ষেত্রে
আসার পর। দু’জনে দুটো আলাদা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে এক সঙ্গে এক ফার্মে।
দু’জনেই বাঙালি বলেই পরিচয়টা প্রথমদিনেই, তারপর বন্ধুত্ব গাঢ় হলে দু’জনে একটা দু’কামরার
বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস থেকে উঠে আসি। তারপর থেকেই সপ্তাহের শেষের ছুটির দুটোদিন কোথাও
না কোথাও বেরিয়ে পড়ি। তবে এতটা দূরে এর আগে কোনোদিন আসা হয়নি। বদরউদ্দিন সাহেবের
গল্পে অনুপ্রাণিত হয়েই দু’জনে এই ঝুঁকিটা নিয়ে নিই।
বদরউদ্দিন সাহেব হলেন আমাদের
বাড়ির মালিক। একতলায় নিজের পরিবার নিয়ে থাকেন হাসি খুশি নির্বিবাদী মানুষটা। ভিন্ন
ধর্মের লোক হয়েও আমাদের নিজের বাড়িতে ভাড়া দিয়েছিলেন। ভীষণ মনখোলা মানুষ, মাঝে
মাঝে সন্ধেবেলায় আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দোতলায় উঠে আসেন। ওঁর জীবনের নানারকম
বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে দেন।
ইন্দোরে আসার পর থেকে
আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো আমি আর অনিমেষ মোটামুটি ঘুরে ফেলেছিলাম। আমরা এখন
খুঁজছিলাম নতুন কোনও জায়গা। আমাদের ইচ্ছাটা জানার পর বদরউদ্দিন সাহেবই বললেন,
“একটা জায়গা আছে, একটু দূরে, কিন্তু অসাধারণ একটা থ্রিল পাবে।”
আমার অনিমেষের মধ্যে এই একটা
বিষয়ে খুব মিল আছে, যে কোনও বিষয়েই আমাদের থ্রিল চাই, তা সে
কোনও সিনেমা দেখাই হোক অথবা বই পড়া। অনিমেষ বলে উঠল, “দূর হোক, জায়গায় থ্রিল থাকলে
আমি অফিস কাটিয়েও যেতে পারি।”
তখনই বদরউদ্দিন সাহেব
বুরহানপুরের আসিরগড় কেল্লার কথা বললেন। অনিমেষ আর আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে এর ইতিহাস
ছবি সম্পর্কে যা জানলাম তাতে আমাদের ভেতরে থ্রিলটা তখনই শুরু হয়ে যায়।
আয়োজন যা করার অনিমেষই
করেছিল, বদরউদ্দিন সাহেবের গাড়িটাও একদিনের জন্য কী ভাবে
যেন ব্যবস্থা করে নিল। শুক্রবার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে
যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে একটু তাড়াতাড়িই ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবুও পরের দিন
সকালে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। শেষমুহূর্তে
আরও কিছু জিনিস ব্যাগে নেওয়ার বাকি ছিল অনিমেষের।
স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে
মোবাইলটা হাতে তুলে একবার দেখল অনিমেষ, “সাড়ে তিনটে বাজে। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী আমরা
বুরহানপুর এলাকায় ঢুকে পড়েছি। কিন্তু
রাস্তায় একটাও লোকের দেখা নেই কেন বল তো?”
আমি গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম,
সত্যিই তেমন একটা লোক দেখা যাচ্ছে না রাস্তায়। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি হুশ করে
বেরিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশ বেশ মনোমুগ্ধকর, একপাশে সবুজ বনবীথি, অন্যপাশে
সাতপুরা পর্বতমালার গিরিশ্রেণী মাথা তুলে দিনের শেষ সূর্যালোককে স্যালুট জানাচ্ছে।
মনে মনে বললাম, অপূর্ব!
কিছুটা এগিয়ে যেতেই রাস্তার
ধারে একটা ছোট্ট চায়ের গুমটি দেখা গেল। অনিমেষকে
বললাম, “ওই দোকানিকে একবার জিজ্ঞেস করাই যায়। লোকটা সম্ভবত বুরহানপুরেরই হবে।”
অনিমেষ গাড়িটা ধীরে রাস্তার
ধারে থামিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল, “চাচা, বুরহানপুর জানা
হ্যায়, কিতনা দূর হ্যায়?”
বৃদ্ধ দোকানি আমাদের দিকে
একবার চোখ তুলে তাকিয়ে যেমন কাজ করছিলেন আবার তেমনই কাজে মন দিলেন। “আশ্চর্য
তো! রাস্তাই তো জিজ্ঞেস করেছি। ওর দোকানে ফ্রিতে চা খেতে চেয়েছি কি?” অনিমেষ অধৈর্য হয়ে পড়ে।
গাড়ি থেকে দু’জনেই নেমে যাই
দোকানের সামনে। অনিমেষকে থামিয়ে আমি বলি, “চাচা, বুরহানপুরকা রাস্তা ইয়ে হি হ্যায়
না?”
এবার বৃদ্ধ আমার দিকে সরাসরি
তাকালেন। মাথায় একটা ছাপা সুতির কাপড়ের পাগড়ি,
গায়ে সাদা ফতুয়া আর খাটো ধুতি। হাত তুলে বললেন, “বুরহানপুরমে কিসকে ঘর জানা হ্যায়?
রাস্তা তো ইয়ে হি হ্যায়।”
লোকটার বলার মধ্যে কেমন যেন সন্দেহের
ভাব।
আমি বললাম, “জানা তো আসিরগড়
হ্যায়...”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃদ্ধর
মুখে একটা হাসির রেখা দেখা দিল। বললেন, “পতা
হ্যায় সাহাব, ইহা সব উস কিলামে জানে কে লিয়েই আতে হ্যায়।” তারপর খানিক থেমে বললেন,
“সিধে রস্তে সে চলে যাইয়ে বুরহানপুর, আজ রাত হোটেল মে রুকিয়ে, সুবাহ কিলা দেখ লেনা
সাহাব।”
এবার অনিমেষ ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
“কিউ? রাত কো কিলে মে ভূত তাণ্ডব করতা হ্যায় কেয়া?”
বৃদ্ধ বললেন, “ভূত? না সাহাব,
আসিরগড় কিলা পবিত্তর জাগা হ্যায়, ওয়াহা ভূত-বুত নেই আতা। পর শাম হোনে কে বাদ কোই
ইনসান ভি নেহি যাতা।”
অনিমেষের যে রাগ হচ্ছিল সেটা
বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম। এমনিতেই ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে ওর বিশ্বাস নেই, পাক্কা
যুক্তিবাদী। ওকে বললাম, “তুই গাড়িতে যা, আমি দেখছি।”
অনিমেষকে গাড়িতে যেতে বলে আমি
দোকানিকে বললাম, “চাচা, রাত কো কিলে মে ঠেহেরনা হ্যায়। পানি কা বটল মিলে গা?”
আমার কথাটা শুনে বৃদ্ধ ডান
হাতের তর্জনী তুলে বললেন, “পছতাওগে সাহাব।”
আমি চার বোতল জল কিনে টাকা
মিটিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার সময় বাঁ দিকে রিয়ার ভিউ মিররে দেখলাম
বৃদ্ধ দোকান ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে দু’হাত মাথার কাছে ঠেকিয়ে প্রার্থনা করার
ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাপারটা আমার ঠিক ভালো লাগল না, অনিমেষকে বললাম, “কেল্লায়
ফটোগ্রাফি করাটাই তো তোর উদ্দেশ্য। কাল ভোরের দিকে গেলেই হয়, আজ না
হয় বুরহানপুরের অন্যান্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখি।”
অনিমেষ দাঁত বার করে হেসে
বলল, “এই জন্যে বাঙালির বদনাম, জানিস তো। এসেছি থ্রিল করতে। আর পাঁচটা পর্যটকের
মতো এলে তো মধ্যপ্রদেশের অন্য জায়গাগুলোও দেখতে যেতে পারতাম।”
আমি জানি অনিমেষকে বারণ করা
বিফলে যাবে, এই ক’দিন ওর সঙ্গে থেকে
বুঝেছি যে কোনও ব্যাপারে জেদ জিনিসটা আমার চেয়ে
ওর অনেক বেশি।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে
অনিমেষ বলল, “চিন্তা করিস না। ভূত যদি থাকেও আজ তারও নিস্তার নেই। সব ব্যবস্থা
আছে।” তারপর পেছনের সিটে রাখা বড়ো কালো ব্যাকপ্যাকটার দিকে ইশারা করল। আমার
মনে আছে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ও বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে কিছু জিনিস নিয়ে
আসে। ব্যাগে কী আছে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, “এখন
খুলে দেখানোর সময় নেই।”
কী এমন জিনিস
থাকতে পারে ওই ব্যাগে!
।। ২ ।।
“আসা আহির নামের এক জমিদার
পঞ্চদশ শতকে বুরহানপুরে এই কেল্লা স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারে এই কেল্লার নাম হয়
আসিরগড় কেল্লা। এরপর খান্দেশের নবাব নাসির খান আসা আহিরকে পরাজিত করে কেল্লার দখল
নিলেন। আসিরগড় কেল্লায় প্রবেশ করা নাসির খানের পক্ষে
সহজ ছিল না। শোনা যায়, নাসির খান আসা আহিরকে পত্র পাঠান যে, তিনি খবর পেয়েছেন সম্রাট
আকবর খান্দেশ জয় করার জন্য রওনা হয়েছেন। তাই খান্দেশের নারীদের আসিরগড় কেল্লায়
সুরক্ষিত রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। খান্দেশের নারীদের জন্যে আসিরগড় কেল্লার
দরজা খুলে দিলেন আসা আহির। কিন্তু সেদিন নারীদের পোশাকের আড়ালে আসলে নাসির খান
তাঁর সৈন্যদের পাঠিয়েছিলেন।
“এরপর নাসির খানের উত্তরপুরুষ
মিরন বাহাদুর ১৫৯৬ থেকে ১৬০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিজেকে মুঘলদের থেকে স্বাধীন
ঘোষণা করেন এবং সম্রাট আকবর ও তাঁর তৃতীয় পুত্র দানিয়েলকে কেল্লায় প্রবেশ করতে বাধা
দেন।
“প্রায় ১৫৯৯ সাল নাগাদ সম্রাট
আকবর তাঁর সৈন্য নিয়ে বুরহানপুর দখল করেন এবং ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তার করেতে
সক্ষম হন এবং ১৬০১ সালের ১৭ই জানুয়ারি আসিরগড় কেল্লা অধিকার করেন।
“কয়েকশো শতাব্দী পর দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের সময় ১৮ই অক্টোবর ১৮০৩ ব্রিটিশ সেনা আসিরগড় কেল্লার
পাট্টা নেয়। এই যুদ্ধে দু’জন ইংরেজ সেনা নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছিলেন, মৃত ইংরেজ
সেনাদের সমাধি কেল্লার ছাদে অবস্থিত।
“কেল্লার গঠনশৈলী মূলত মুঘল
শিল্পকলা দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এতে ইসলাম, পার্সি,
তুর্কি ও ভারতীয় শিল্পরীতির মিশ্রণ দেখা যায়। কেল্লাটি প্রধানত তিনটি স্তরে গঠিত।
একদম নীচে ভূগর্ভের স্তরের নাম হল কমলগড়, দ্বিতীয় মালাইগড় এবং তৃতীয় ও
সর্বোচ্চ হল আসিরগড়। কেল্লার ভেতরে একটি পুকুর দেখা যায় যার তিনদিক পাথর দ্বারা
বাঁধানো ও একদিকে বিস্তৃত ঢালু জমি যেখান দিয়ে বৃষ্টির জল অনায়াসে পুকুরে এসে গড়িয়ে
যায়। শোনা যায় এই পুকুর কোনোদিন শুকিয়ে যায় না।”
ভিডিও ক্যামেরাটা চালু করে
অনর্গল বকে গেল অনিমেষ। ওর পেছনে বিশালাকার সুউচ্চ আসিরগড় কেল্লার মাথা দেখা
যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল কেল্লার মাথার উপরে ঘাস ও বড়ো বড়ো বৃক্ষ ডালপালা
বিস্তার করে আছে।
গাড়ি থেকে আমাদের দু’দুটো
ভারি ব্যাকপ্যাক আর জলের বোতল নিয়ে কেল্লায় ওঠার পাথুরে পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম।
পুরো রাস্তাটা শুট করবে বলে অনিমেষ ভিডিও ক্যাম চালু রেখেছে। কিছুটা সোজা পথ
হাঁটার পরেই এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ ক্রমশ চড়াই। কিছুটা এগিয়ে যেতেই কেল্লার ভাঙা
দরজা দেখা গেল। অনিমেষ হাত দিয়ে দরজাটা সরিয়ে দিতেই
ঘুটঘুটে
অন্ধকারে প্রবেশ করলাম আমরা। চলার সময় পায়ের নীচে খেয়াল রাখতে হচ্ছিল বেশি, একে তো
ছোটো বড়ো পাথর ছড়িয়ে আছে রাস্তায়, তার ওপর বর্ষাকাল। ভূত না হয়, সাপের কামড়েই নির্জন জায়গায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে।
কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরই
দেখলাম একটা খাড়া সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে ছাদের দিকে। পড়ন্ত সূর্যের কমলা আলো কেল্লার
ঘুলঘুলি দিয়ে সিঁড়ির উপরে এসে বৃত্তাকার আলপনা তৈরি করেছিল। মনে হল আমি যেন সেই সম্রাট আকবর অথবা নাসির খানের সময় পঞ্চদশ
শতকে পৌঁছে গিয়েছি।
খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই খোলা
ছাদে উঠে এলাম আমরা। অনিমেষ ভিডিও ক্যামটা বন্ধ করে একটা ছোটো গর্তের দিকে এগিয়ে
গিয়ে বলল, “এটা কী বল তো?”
আমি কাছে গিয়ে দেখলাম চৌকো
একটা বাঁধানো ছিদ্র কেল্লার ছাদে, ঠিক যেন রাস্তার উপরে খোলা ম্যানহোল। আমাকে কিছু
বলতে দেওয়ার আগেই অনিমেষ বলল, “কেল্লার ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলোতে আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা।”
পুরো ছাদটাই ঘাসে ঢাকা, এদিক
ওদিক বড়ো বড়ো গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। আমার মনে হল কোনও কেল্লা নয়, যেন টেবিল টপ
মাউন্টেনের উপরে উঠে এসেছি। পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস যেন আরও শিহরণ তুলছিল। সত্যি
অসাধারণ একটা পরিবেশ। মনে মনে বদরউদ্দিন সাহেবকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না।
হঠাৎ অনিমেষকে
ইতস্তত এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করতে দেখলাম, কিছু যেন খুঁজছে। আমি বললাম, “কী হল? কী খুঁজছিস?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে
অনিমেষ যেন নিজেকেই বলল, “এই তো। এটাই হবে।”
ব্যাপারটা দেখার জন্য কাছে
এগিয়ে যেতেই দেখি ও আবার ভিডিও ক্যাম অন করেছে। বলল, “কেল্লার ছাদে অবস্থিত এই
শিবমন্দিরের নাম হল গুপ্তেশ্বর মন্দির। আসা আহির এই মন্দির স্থাপন করেন। এরপর কেল্লায়
মুসলিম অধিপত্য স্থাপন হলে একটা মসজিদ বানানো হয়, ইংরেজরা আসার পর এখানে চার্চও
বানিয়েছিল। কিন্তু সে সব সম্ভবত নীচের দিকে আছে, নীচের ঘরগুলোর ভগ্নস্তূপে যাওয়ার
রাস্তা বন্ধ।”
সূর্যাস্ত হয়ে আসছিল। আমরা
কেল্লার ছাদেই থাকব মনস্থির করলাম। অনিমেষ ওর বিশাল ব্যাগ থেকে একটা ক্যানভাসের
তাঁবু বার করে টাঙ্গাতে লাগল। যদিও এই
খোলা হাওয়াই আমার বেশ ভালো লাগছিল, তবুও বৃষ্টি হলে এই তাঁবুই ভরসা।
।। ৩ ।।
কেল্লার ছাদের উপরে
গুপ্তেশ্বর মহাদেব মন্দিরের সামনের চাতালেই আমাদের তাঁবু খাটানো হয়েছিল। কেল্লার
মাথা থেকে আশেপাশের জঙ্গল ও পাহাড়ের গায়ের সূর্যাস্ত দেখা এক অনন্য সাধারণ
অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে অন্ধকার যত গাঢ় হতে লাগল ততোই যেন আশেপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ
হতে শুরু করেছে, তবুও প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতার মধ্যেও যেন অদ্ভুত একটা শব্দ আছে।
রাত ঘন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
বাতাসের তীব্রতা একটু কমেছে, আমরাও তাঁবুর ভেতরে জিনিসপত্র রেখে বাইরে দুটো
মোমবাতির আলো নিয়ে বসে আছি। আমাদের মোবাইল দুটো এতক্ষণ ছবি তোলার কাজে সাহায্য
করেছে, কিন্তু খেয়ালই হয়নি কখন যেন নেটওয়ার্ক চলে গিয়েছে। সাধারণত এসব ঘন জঙ্গল
এলাকায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আমি অনিমেষকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম।
সূর্যাস্তের পর থেকে কেমন যেন চুপ করে আছে, হাতের মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছে।
বললাম, “কী রে, কী ভাবছিস?”
“উম! কিছু না, ছবিগুলো
দেখছিলাম,” সংক্ষেপে জবাব দিল অনিমেষ।
বললাম, “কফি বানাব? খাবি
একটু?”
আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর না
দিয়ে অনিমেষ বলল, “আচ্ছা মহাভারতের গল্পগুলো সম্পর্কে তোর কী ধারণা?”
এখন মহাভারতের প্রসঙ্গ কী কারণে আমার ঠিক বোধগম্য হল না। বললাম, “মহাভারত? তুই এখন
মহাভারত নিয়ে ভাবছিস?”
অনিমেষ দূরে একটা পাহাড়ের
দিকে তাকিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়েই বলল, “এই যে সাতপুরা রেঞ্জ দেখছিস, এর আশেপাশের
জঙ্গল এলাকা মহাভারতে উল্লিখিত খাণ্ডব বনের একাংশ।”
বললাম, “হ্যাঁ, সে এককালে
নিশ্চয়ই ছিল হয়তো।”
অনিমেষ বলল, “মহাভারতে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষের গল্পটা জানিস তো?”
মহাভারত সম্পর্কে কোনও
বিস্তারিত ধারণা না থাকলেও গল্পগুলো মোটামুটি আমার জানা ছিল। মহাভারত কোনও একটা
গল্প নয়, অনেক ঘটনাবলীর সমষ্টি। অনিমেষকে বললাম, “ঠিক কী
বলতে চাইছিস সেটা বল তো?”
“গুরু দ্রোণাচার্য কৌরব এবং
পান্ডবদের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় হস্তিনাপুর রাজ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হবার কারণে
দ্রোণাচার্য কৌরবদের পক্ষে এবং পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
“পান্ডব সেনারা দ্রোণাচার্য ও
অশ্বত্থামা অর্থাৎ পিতা এবং পুত্রের দ্বারা বারংবার বিধ্বস্ত অবস্থায় পৌঁছে
অত্যন্ত নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন এবং তাই দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্রোণাচার্যকে বধ
করবার জন্য একটি কৌশল গ্রহণ করেন।
“ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কখনোই
মিথ্যা কথা বলতেন না এবং তাঁর সত্যনিষ্ঠা সম্পর্কে সকলেই অবহিত ছিলেন। অত্যন্ত
চাতুর্যের সঙ্গে তাঁকে ব্যবহার করে, কৌশলগতভাবে
দ্রোণাচার্যকে শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় পাণ্ডবরা বধ করেন। দ্রোণাচার্য ধর্মরাজ
যুধিষ্ঠিরকে অশ্বত্থামার মৃত্যুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির জবাব দেন ‘অশ্বত্থামা
হত ইতি গজ’ অর্থাৎ
‘অশ্বত্থামা মারা গেছেন কিন্তু তা নর নাকি হস্তী তা জানা নেই’। এই খবর শুনে
দ্রোণাচার্য অস্ত্রত্যাগ করে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় যুদ্ধভূমিতে বসে পড়েন এবং
সেই অবসরে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন।
“পিতার এই মৃত্যু সংবাদ
অশ্বত্থামাকে অত্যন্ত বিচলিত করে। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য অশ্বত্থামা
সকল পাণ্ডব পুত্রদের হত্যা করেন এবং উত্তরার গর্ভে প্রতিপালিত হওয়া অভিমন্যুর
পুত্র পরীক্ষিৎকে
হত্যার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন। ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরীক্ষিৎকে রক্ষা করেন। শাস্তিস্বরূপ
শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামার শিরস্থিত মণি তুলে ফেলে তাকে তেজহীন করে দেন এবং তাঁকে অমরত্বের
অভিশাপ দেন।”
এই অবধি বলে অনিমেষ থামল।
আমি বললাম, “হ্যাঁ, এই গল্পটা
আমার জানা। কেন কী হয়েছে?”
এবার অনিমেষ আমার দিকে
সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, “আসিরগড় আসার আগে বদরউদ্দিন সাহেব আমাকে আসিরগড় সম্পর্কে আরও
একটা তথ্য দিয়েছিলেন যেটা তোকে আমি জানাইনি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা অভিশপ্ত
হয়ে অশ্বত্থামা পাঁচ হাজার বছর ধরে মৃত্যু রহিত অবস্থায় অমর হয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছেন। এরকম মনে করা হয় যে, এই বুরহানপুরের আসিরগড় কেল্লার গুপ্তেশ্বর শিব
মন্দিরে রোজ ভোরবেলায় সবার অলক্ষে দিনের সর্বপ্রথম পুজো করতে আসেন অশ্বত্থামা। স্থানীয়
লোকজনের মতানুসারে কখনও কখনও নিজের মাথায় শ্রীকৃষ্ণকৃত ঘায়ের যন্ত্রণার উপশম করার
জন্য এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য তিনি স্থানীয় লোকেদের থেকে হলুদ আর তেল চেয়ে
থাকেন। গ্রামের বৃদ্ধ ব্যক্তিরা এই কথা মানেন যে যারা অশ্বত্থামাকে একবার দেখে
তারা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।”
এবার অনিমেষের কথায় আমি না
হেসে পারি না।
“ও, এই জন্য তুই সেই থেকে চুপ
করে বসে আছিস। তোর মনে হয় এত বছর পর
অশ্বত্থামা বেঁচে আছে আর এখানে আসবে মন্দিরে পুজো দিতে, আর তুই অশ্বত্থামার ছবি
তুলবি। তাই তো? আরে তোর মতো যুক্তিবাদী ছেলে যে এইসব ভড়ং বিশ্বাস করবে আমি জানতাম
না সত্যি।”
অনিমেষ আমতা আমতা করে বলল,
“না, প্রথমে বিশ্বাস আমিও করিনি, আর সেই কারণেই আসিরগড় আসার জেদটা ছিল। কিন্তু...”
সামান্য থেমে অনিমেষ আবার বলল, “বিকেলে যখন মন্দিরের ভেতরে গেলাম তখন স্পষ্ট
দেখেছিলাম শিবলিঙ্গের চারপাশে টাটকা ফুল ছড়ানো। তুই ভাব, এই নির্জন জায়গায় টাটকা
ফুল দিয়ে কে পুজো করে যাবে?”
আমি বললাম, “বুরহানপুর এখান
থেকে মাত্র মিনিট কুড়ির রাস্তা। আর তাছাড়া ভুলে যাস না, সকালের দিকে কিন্তু অনেক
পর্যটক আসে। জায়গাটা নির্জন হলেও একেবারেই যে কেউ আসে না তা নয়। দেখছিস না,
আশেপাশের দেওয়ালগুলোয় কেমন নিজেদের নাম খোদাই করে গেছে, এদিক ওদিক প্লাস্টিকের
বোতল ফেলে রেখে গেছে। ওদের মধ্যেই কেউ ফুল দিয়ে গেছে।”
“তুই মন্দিরের ভেতরে ফুলগুলো
একবার দেখে আয়। ওইরকম ফুলের গাছ এই জঙ্গলে তো দূর আমি জন্মেও কোথাও দেখিনি,”
অনিমেষ জোর গলায় বলল।
ওর কথা রাখার জন্য একটা
মোমবাতি হাতে নিয়ে ঢুকলাম মন্দিরের গর্ভগৃহে। অপ্রশস্ত মন্দিরের ঠিক মাঝখানেই কালো
পাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত, শিবলিঙ্গ ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানারকম রঙের ফুল ও বেলপাতা।
এরকম ফুল সত্যি আমিও কোনোদিন দেখিনি, কিন্তু অবাক হলাম না। জঙ্গলের সব গাছগাছালি
যে চিনব তা তো নয়। সেরকমই কোনও নাম না জানা ফুল দিয়ে কেউ হয়তো সকালে পুজো দিয়ে
গেছে।
মন্দির থেকে বাইরে এসে বললাম,
“তাহলে ওই রাস্তার ধারের দোকানি এই কারণেই রাতে
থাকতে বারণ করছিল আমাদের। কী বলিস?”
“হুম তাই হবে।” অনিমেষকে
অন্যমনস্ক মনে হল।
অনিমেষকে বেশ সাহসী বলেই
জানতাম। এরকম একটা উড়ো কথায় যে ও বিশ্বাস করবে আমি ভাবিনি। ওর কাঁধে হাত রেখে
বললাম, “পাঁচ হাজার বছর ধরে কোনও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না।”
এবার ও একটু চঞ্চল হয়ে উঠে
বলল, “একজ্যাক্টলি। আমিও তাই বলেছিলাম বদরউদ্দিন সাহেবকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে
নিশ্চয়ই ভয় দেখানোর জন্য মানুষেই এই কাজ করে, তবে ওঁর ধারণা এই কেল্লায় কোন আত্মার
বসবাস। তাই...”
“তাই? তাই কী?”
অনিমেষ ওর ব্যাকপ্যাক থেকে
একটা বাক্স বার করে এনে দেখাল। বলল, “বদরউদ্দিন সাহেব দিয়েছেন। এই যন্ত্রটার সাহায্যে
লাল আর সবুজ আলোর মাধ্যমে কোনও আত্মার উপস্থিতি চিহ্নিত করা যাবে। সবুজ জ্বললে ঠিক
আছে, কিন্তু লাল জ্বললে ধরে নিতে হবে আশেপাশেই কোনও আত্মা উপস্থিত আছে।”
“আর তুই এসব বিশ্বাস করে নিয়ে
এলি? আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না।”
“নিতে চাইনি। বদরউদ্দিন সাহেব
দিলেন। তবে ওই ফুলগুলো দেখে...” অনিমেষকে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে।
দু’হাত দিয়ে ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে
দিয়ে বললাম, “শোন জঙ্গলের মাঝে এত বড়ো একটা কেল্লার অস্তিত্বকে লোকচক্ষুর আড়াল
থেকে বাঁচাতে হয়তো গ্রামবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে এই গল্প ফেঁদেছে। মানুষ মাত্রই
মরণশীল। আর মহাভারতের ঘটনাগুলো আমার সবসময় আংশিক সত্য বলে মনে হয়। যা কিছু অলৌকিক
বর্ণনা আছে তার কোনও সঠিক ব্যখ্যাই হয় না বুঝলি।” কথাগুলো অনিমেষকে বললাম বটে।
কিন্তু ওর এই অর্ধেক বিশ্বাস ও সংশয়কে দূর করতে পারলাম না বলে এই অদ্ভুত সুন্দর
পরিবেশেও মনটা তেতো হয়ে রইল।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে
অনিমেষ বলল, “তুই চাইলে ঘুমোতে পারিস, আমি কিছুক্ষণ জাগব।”
আমি অনিমেষের প্রস্তাব শুনে
কিছু বললাম না। এমনিতেও আগামীকাল ইন্দোর অবধি আমাকেই ড্রাইভ করতে হবে। দেখলাম
তাঁবুর বাইরে ক্যানভাসের চেয়ারটায় পা তুলে বসে আছে অনিমেষ, ওর পাশে রাখা বদরউদ্দিন
সাহেবের দেওয়া ভূত চিহ্নিত করার যন্ত্রটায় সবুজ আলো জ্বলছে। মনে মনে বললাম, “ওটা
কোনোদিনই লাল হবে না।”
তাঁবুর ভেতরেও যে খুব
তাড়াতাড়ি আমার ঘুম এল তা নয়। অচেনা জায়গা আর মশার কামড় খেয়ে এ পাশ ও পাশ করতে করতে
একসময় ক্লান্তিতে চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ তাঁবুর বাইরে ভারি
কিছু একটা পড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। বাইরে
গিয়ে দেখি অনিমেষ যে চেয়ারটায় বসে ছিল সেটা উলটে পড়ে আছে, পাশে ভূত ধরার যন্ত্রটায়
সবুজ আলো জ্বলে আছে তখনও, অনিমেষ কোথাও নেই।
আমি মোবাইলে সময় দেখি, প্রায়
সাড়ে চারটে বাজে, আকাশ সামান্য ফরসা হয়েছে। মোবাইলেই টর্চটা জ্বালিয়ে একবার হাঁক
দিলাম “অনিমেষ।” কোনোদিকে কোনও সাড়া নেই। আমি কেল্লার ছাদের উলটো দিকের ঘাসজমিটার
দিকে পা বাড়ালাম, ওদিকে হয়তো গিয়েছে প্রাতঃকৃত্য সারতে। ছোটোখাটো ঝোপঝাড়ের আড়ালে গিয়ে
খুঁজলাম, অনিমেষ কোথাও নেই।
তাঁবুর কাছে ফিরে আসতেই কী মনে হল একবার মন্দিরের ভেতরটা দেখা উচিত। মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ
করতে গিয়েই চমকে গেলাম। শিবলিঙ্গের পাশে একটা প্রদীপ জ্বলছে, আমার অস্তিত্ব টের
পেয়ে একটা বিশালদেহী কালো ছায়া যেন দেওয়ালের দিকে মিশে গেল। মেঝেতে
অনিমেষ লুটিয়ে পড়ে আছে আর ওর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে নাম না জানা ফুল ও বেলপাতা।
অনিমেষকে কোনোরকমে তুলে নিয়ে তাঁবুর কাছে এনে ওর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিলেও ওর
যেন ঘোর কাটছিল না। আকাশে ভোরের আলো দেখা দিয়েছে ততক্ষণে, কিন্তু অনিমেষ সেই সামান্য
আলোটুকুও সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে ফেলছিল বারবার।
কাঁধে ভর দিয়ে অতিকষ্টে
তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে ওকে নীচে নামিয়ে এনে গাড়িতে বসালাম। গাড়ির চাবি ঘোরাতে যাব,
এমন সময় দেখি জঙ্গলের সরু পথ দিয়ে দুজন হেঁটে কেল্লার দিকে আসছে। লোকগুলো কিছুটা
এগিয়ে আসতেই আমি একজনকে চিনতে পারলাম, গতকাল রাস্তার ধারে দোকানে দেখা বৃদ্ধ।
ওঁরা এগিয়ে আসতেই আগের দিনের
বৃদ্ধ বললেন, “মুঝে পতা থা আজ কিলে মে কুছ না কুছ হোনেওয়ালা হ্যায়। মানা কিয়া থা
না আপকো।”
আমি কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধ ও
তাঁর সঙ্গীর সহায়তায় অনিমেষকে বুরহানপুরের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা
করে বললেন কোনও ভারি কিছুতে আঘাত লেগে অনিমেষের বাঁ
হাত সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। বিকেলের দিকে অনিমেষ কিছুটা ধাতস্থ হলে বলল, “ভোরের
দিকে কিছু একটার শব্দ পেয়ে মন্দিরের দিকে গিয়ে দেখি একজন হলুদ কৌপীন পরা সুদর্শন
দীর্ঘদেহী সুপুরুষ প্রদীপ জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে শিবলিঙ্গের উপাসনা করছেন। আমি দরজার
আড়াল থেকে দেখছিলাম, সেই সময় এক দমকা হাওয়া এসে আমার চেয়ার উলটে দেয়। সেই শব্দে
আমিও ধরা পড়ে যাই, চোখাচোখি হয় ওঁর সঙ্গে। লোকটির কপালের মধ্যভাগে বিশাল একটা ক্ষত
থেকে রক্ত আর পুঁজ ঝরছিল। আমাকে দেখে কাছে এসে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু চাইলেন, আমি
ভয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়ে যাই। তারপর আর
কিছু মনে নেই।”
অনিমেষ যখন কথাগুলো বলছিল তখন
সেই বৃদ্ধও উপস্থিত ছিলেন। সব শুনে বললেন, “তেল হলদি মাঙ্গতে হ্যায়।” তারপর আমার
দিকে ফিরে বললেন, “বাপ দাদাকে জামানে সে শুনতে আয়ে হ্যায় কে উস মন্দিরকে অন্দর সে
এক খুফিয়া রাস্তা হ্যায় যো খাণ্ডভ বনকে সাথ জুড়া হুয়া হ্যায়। হর রাত বারা সে লে কর
সুবাহ পাঁচ বজে কে বীচ মে অশ্বত্থামা ইস মন্দিরমে আকে শিভজি যা পূজন করতে হ্যায়
মুক্তি কে লিয়ে।”
অনিমেষ এরপর বহুদিন অবধি চোখে
পরিষ্কার দেখতে পেত না। দৃষ্টি ধীরে ধীরে কিছুটা ফিরে এলেও ওর বাঁ হাতটা সম্পূর্ণ
প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু গুপ্তেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহ আমি নিজের চোখে
দেখেছি তাই বলতে পারি তিনতলার ওপরে অবস্থিত ওই মন্দিরের সঙ্গে লাগোয়া এমন কোনও
দরজাই ছিল না যেখান দিয়ে একজন মানুষ বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেদিন অনিমেষ বা ওই
স্থানীয় বৃদ্ধের মুখে যা শুনেছিলাম সেটা একেবারে অবিশ্বাস করারও কোন অবকাশই আমার
ছিল না, কারণ মন্দিরের গায়ে প্রদীপের আলোয় একটা ছায়াকে মিশে যেতে আমিও দেখেছিলাম।
_____
ছবিঃ লেখক
বাঃ, ইতিহাস, পুরাণ, আর রোমাঞ্চ মিশিয়ে একটা চমৎকার গল্প পড়লাম।
ReplyDeleteBes Sundor
ReplyDeletedarun,chayachobir moto dekhte pelam jeno..khub sundor
ReplyDeleteসত্যি ছোটবেলায় এরকম গল্প অনেক পড়েছি। এরকম গল্প পড়তে পড়তেই বই পড়ার নেশা জন্মেছিল। বহুদিন পর ঠিক সেরকম স্বাদের একটা গল্প পড়লাম। ভালো লাগল খুব।
ReplyDelete