টেরাকোটার আড়ালে
বিভাবসু দে
।। ১ ।।
“আজ থেকে প্রায়
২২০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল এই মূর্তিগুলো। প্রাচীন চৈনিক শিল্পকলার এক অদ্ভুত
নিদর্শন। একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই আপনারা দেখতে পাবেন যে প্রতিটি মূর্তির চেহারা, উচ্চতা, দেহভঙ্গিমা সবকিছুই আলাদা। ঠিক যেন জীবন্ত মানুষ।
আর এরকম কিন্তু একটা দুটো নয়, পুরো আট হাজারটা পোড়ামাটির
সৈন্যমূর্তি পাওয়া গেছে এখানে। সঙ্গে ১৩০ খানা রথ, ৬৭০টা ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, আরও কত কিছু। সাত লক্ষ মৃৎশিল্পীর প্রায় চল্লিশ বছর সময় লেগেছিল এগুলো গড়তে।
২৪৬ থেকে প্রায় ২০৬ খ্রিস্টপূর্ব অবধি। তখন চিনের শাসনভার সামলাচ্ছেন সম্রাট কিন-শি-হাঙ।”
নড়বড়ে ইংরেজিতে
কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিল লোকাল ট্যুরিস্ট গাইড চিং-লি, সঙ্গে প্রায় দশ-বারোজন ট্যুরিস্ট। প্রত্যেকেই বিদেশি। তাদের কেউ এসেছে ভারত, নেপাল থেকে, আবার কেউ বা সুদূর আমেরিকা, কানাডা বা ইউরোপ থেকে।
মাউন্ট লি-র
পাদদেশে এই অঞ্চলে এটাই রোজকার দৃশ্য। প্রতিদিনই পর্যটকের ঢল নামে এখানে। একটাই
কারণ, ‘টেরাকোটা আর্মি’। চিনের প্রথম সম্রাট কিন-শি-হাঙের নির্দেশেই
তৈরি হয়েছিল এই পোড়ামাটির সৈন্যদল। উত্তর-পূর্ব চিনের শানজি অঞ্চলের রাজধানী হল
সিয়ান। তারই অন্তর্গত লিনটাঙ জেলায় এক বিশাল এলাকা জুড়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই
আট হাজার পোড়ামাটির সেপাই।
চিং-লি
ট্যুরিস্টদের নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগল সেই মূর্তিগুলোর দিকে। দু’পাশে
অগভীর গর্ত খোঁড়া আর মাঝখান বরাবর চলে গেছে সরু রাস্তা। অনেকটা ক্ষেতের মাঝে থাকা
আলপথের মতো। সেই গর্তের মধ্যেই প্রায় ২২০০ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই পোড়ামাটির
সৈন্যদল,
তাদের সম্রাটের আদেশের অপেক্ষায়। সম্রাট কিন-শি-হাঙ
মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করতেন। আর সেই মরণোত্তর জীবনেও যাতে তাঁর রাজশক্তি
অক্ষুণ্ণ থাকে তাই তৈরি করিয়েছিলেন এই অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বিশাল পোড়ামাটির
সৈন্যবাহিনী বা টেরাকোটা আর্মি।
চিং-লি আবার বলতে
লাগল, “এই যে টেরাকোটা আর্মি দেখছেন, এগুলো বহু বছর
মাটির নিচেই চাপা পড়ে ছিল। কেউ জানতই না। হঠাৎ এই এলাকার কিছু কৃষক একদিন ক্ষেতে
কাজ করতে গিয়ে প্রথম এই মূর্তিগুলোর খোঁজ পায়। সালটা ১৯৭৪। তারপর থেকে তো এই আস্ত
তল্লাটে পুরাতত্ত্ববিদদের ভিড় জমে যায়। শুরু হয় মাটি খোঁড়ার কাজ। তারপর একে একে
আবিষ্কার হল এই আট হাজার সৈন্যমূর্তি, রথ, পোড়ামাটির ঘোড়া আর তাদের অস্ত্র, অলঙ্কার, আরও সব। এই পুরো এলাকাকে ঢেকে দেওয়া হল বিশাল শেড দিয়ে। ওই যে দূরে মাউন্ট লি
দেখতে পাচ্ছেন, সেখানেই মাটির ভেতর রয়েছে সম্রাট কিন-শি-হাঙের
কবর। বলা হয়, সেখানে আজও বহু গুপ্তধন লুকোনো আছে, আর আছে একশোটা পারদের নদী।”
প্রত্যেকেই মন
দিয়ে শুনছিল চিং-এর কথাগুলো। এমন সময় হঠাৎ দূরে একটা সাইরেনের শব্দ শোনা গেল।
পর্যটকদের মনের প্রশ্ন বুঝতে পেরে চিং নিজে থেকেই বলল, “চিন্তার কিছু নেই। ওটা ওয়ার্নিং সাইরেন। আর একঘণ্টার মধ্যে আমাদের এখান থেকে
বেরিয়ে যেতে হবে, এটা তারই সংকেত। এখন ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা বাজে।”
হাতঘড়ির কাঁচটা মুছতে মুছতে বলল চিং, “আরও কিছুক্ষণ আপনারা নিশ্চিন্তে দেখতে
পারেন।”
নভেম্বরের
মাঝামাঝি। সন্ধের অন্ধকার একটু তাড়াতাড়িই ঘনিয়ে আসে। বাতাসেও বেশ একটা হিমেল পরশ।
ইচ্ছে করেই দিনের এই সময়টা বেছে নেয় চিং। সন্ধের দিকে ট্যুরিস্টের ভিড়টা ধরে আসে
ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অন্য অধিকাংশ গাইডও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির পথে পা
বাড়াতে শুরু করে। আর এখানেই চিং-এর ফায়দা। বিকেল গড়িয়ে যে ক’জন ট্যুরিস্টই আসে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অগত্যা গাইড হিসেবে চিং-কেই ধরতে হয়। প্রয়োজনে একটু
বেশি টাকা দিয়েই। এতে বিকেল থেকে সন্ধে অবধি কাজ করে চিং-এর রোজগার নেহাত কিছু কম
হয় না।
হাতে আর বেশিক্ষণ
নেই। শেষ পঁয়তাল্লিশ মিনিটে এই বিদেশি পর্যটকদের যতটা হয় ঘুরিয়ে দেখাতে হবে এই
পোড়ামাটির মূর্তিগুলি। তাই একটু জোরেই পা চালাল চিং।
“আসুন, এদিকে আসুন। এখানে রয়েছে ১৯৭৪-এ পাওয়া একেবারে প্রথমদিকের টেরাকোটার
সেপাইগুলো।”
ট্যুরিস্টদের
নিয়ে এগোতে লাগল সে। এদিকে তেমন আলো নেই। তাই একজন জার্মান ট্যুরিস্ট ছবি তুলতে
গিয়েও খুব একটা মনমতো শট নিতে পারলেন না। চিং এখন যেদিকটায় এগোচ্ছে সেদিকটা বেশ
আবছা অন্ধকার। বোধহয় পুরোনো ভাঙাচোরা মূর্তিগুলো রাখা বলেই খুব একটা আলোর ব্যবস্থা
আর করা হয়নি এদিকে। সন্ধের দিকে খুব একটা কেউ যায়ও না এই অংশে।
“মিস্টার লি, এই অন্ধকারে তো কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না।” বেশ বিরক্তির সুরেই বললেন এক
মার্কিন ট্যুরিস্ট।
খানিকটা সংকুচিত
গলায় জবাব দিল চিং, “সরি, স্যার। আমি এখনই টর্চটা জ্বালাচ্ছি।”
ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁই ছুঁই।
অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছে। হাতে আর আধঘণ্টা। সন্ধের
অন্ধকারের সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ঠাণ্ডা হওয়ার দাপট। ব্যাগের ভেতর বেশ
কিছুক্ষণ হাতড়ে টর্চটা খুঁজে পেল চিং। কিন্তু জ্বালাতে যাবে এমন সময় হঠাৎ কীসের
যেন একটা খুব জোরালো ধাক্কা লাগল হাতে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারল না চিং। টর্চটা
ছিটকে পাশের গর্তে পড়ে গেল।
“কী হল, মিস্টার লি?” পেছন থেকে
আবার সেই মার্কিন ট্যুরিস্টের গলা ভেসে এল।
“জানি না স্যার, টর্চটা
কীভাবে যে হাত থেকে পড়ে গেল! এই অন্ধকারে এখন আর খুঁজে পাওয়াও সম্ভব না। হাতে বেশি
সময়ও নেই। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত স্যার, আজ আর দেখানো সম্ভব হবে না।” বেশ
ইতস্তত করেই বলল চিং।
“হ্যাঁ, সাতটা পাঁচ বাজে। এখন না বেরোলে পরে সমস্যায় পড়তে হবে।” চিং-এর পাশে দাঁড়ানো
এক ভারতীয় ট্যুরিস্ট বললেন।
“হ্যাঁ, আর দেরি করা যাবে না।” সায় দিল চিংও।
কিন্তু তখনই হঠাৎ
কেমন যেন একটা শব্দ হতে লাগল চারপাশ থেকে। অনেকটা ভারী কিছুর মাটিতে ঘষটানোর মতো
আওয়াজ। কান খাড়া হয়ে উঠল সবারই। আওয়াজটা চিং-এর কাছেও অচেনা।
“চিন্তা করবেন
না। শেয়াল-টেয়াল হবে...”
কিন্তু কথাটা আর
শেষ করতে পারল না চিং। পেছন থেকে দলের এক মহিলা পর্যটকের আর্ত চিৎকারে চমকে উঠল
সকলে। আর তখনই সেই আবছা অন্ধকারে যে দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল তা যে
কল্পনারও বাইরে। চিং-এর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। হাত-পা যেন সিঁটিয়ে যাচ্ছিল
ভয়ে। এও কি সম্ভব? যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই সেই একই দৃশ্য। ওরা
আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, ঘিরে ধরছে চারদিক থেকে। চারপাশে শুধু
ট্যুরিস্টদের ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল সে। চিং-এর মাথার শিরাগুলো দপদপ করতে
লাগল। মনে হল মাথাটা যেন ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। ওর চোখের সামনে সন্ধের অন্ধকার আরও
আরও কালো হয়ে উঠতে লাগল। সব একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্যুরিস্টদের কান্না, চিৎকার, তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ সব মিলিয়ে যেতে লাগল সেই
বীভৎস অন্ধকারে।
।। ২ ।।
কফি-মাগে শেষ
চুমুক দিতে দিতে একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন সি. আই. এ চিফ রবার্টসন। রাত প্রায় বারোটা হতে
চলল। সচরাচর এত রাত অবধি অফিসে থাকেন না তিনি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু আলাদা। খবরটা দেখার
পর থেকেই বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটা চিন্তা। তিনি যেটা ভাবছেন সেটা যদি ঠিক
হয় তবে এখনই একটা কিছু না করলে অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকাকে এক ভয়ানক সামরিক
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
হঠাৎ কে যেন
দরজার বাইরে নক করল।
“কাম ইন।” নিজের
স্বাভাবিক গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন রবার্টসন।
সামনের দরজা ঠেলে
ভেতরে ঢুকল বেশ লম্বা-চওড়া গড়নের এক ব্যক্তি। গায়ে কালো কোট। টিকালো নাকের দু’পাশে
বাজপাখির মতো দুটো শিকারি চোখ জ্বলজ্বল করছে। চওড়া কপালের ওপর ব্যাকব্রাশ করা
বাদামি চুল।
“এসো, ফ্রেডরিক। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।” আঙুলের ডগায় কলমটা
নাড়তে নাড়তে বললেন রবার্টসন।
“হ্যাঁ, আপনার মেসেজ পেয়েই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। কিন্তু হঠাৎ...”
“হুম। একটা বিশেষ
কারণেই তোমাকে ডেকেছি। আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?”
টেবিলের ওপাশে
রাখা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর আজকের কাগজটা ফ্রেডরিকের দিকে এগিয়ে দিলেন
রবার্টসন। “নাও, দ্বিতীয় পাতাটা দেখো।”
দ্বিতীয় পাতার
ডানদিক জুড়ে বেশ বড়ো বড়ো হরফে হেড-লাইন দেওয়া, ‘চিনের লিনটাঙে
বারোজন বিদেশি পর্যটকের রহস্যজনক মৃত্যু’।
মিনিট পাঁচেক বেশ
খুঁটিয়েই খবরটা পড়ল ফ্রেডরিক।
“কী বুঝলে?” খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখতেই রবার্টসনের প্রশ্ন
ধেয়ে এল ফ্রেডরিকের দিকে।
একটু সময় চুপ করে
রইল ফ্রেডরিক। তারপর নিজের ধারালো
নাকের ওপর বার দুয়েক আঙুল বুলিয়ে বলল, “পড়ে তো যা মনে
হচ্ছে, খুনগুলো শুধুই লোক দেখানোর জন্য করা হয়েছে। আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু।”
“হুম। আমারও
সেটাই ধারণা। ঘটনাটা ঘটার সময় সেখানে মোট তেরোজন লোক উপস্থিত ছিল। বারোজন
ট্যুরিস্ট আর একজন গাইড। একমাত্র সেই গাইডই প্রাণে বেঁচেছে, বাকি সবাইকে বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর সেই গাইড, চিং-লি না কী যেন নাম, যে বয়ানটা দিয়েছে সেটাই ছাপা হয়েছে কাগজে।”
“কিন্তু স্যার, সে গাইড যা বয়ান দিয়েছে তা তো একেবারেই আজগুবি কাহিনি। সে বলছে, সেদিন সন্ধেয়
নাকি দু’হাজার বছর পুরোনো সে সব টেরাকোটার সৈন্যমূর্তিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল আর
তারাই নাকি খুন করেছে সেই বারোজন বিদেশি পর্যটককে। আজকের যুগে এসব কথায় কে বিশ্বাস
করবে?”
“করবে ফ্রেডরিক, করবে। প্রাণভয় বড়ো ভয়। আর সেই ভয়ে মানুষ সবকিছুই বিশ্বাস করতে পারে। বিজ্ঞানের
প্রফেসরকেও আমি পাদ্রিদের কাছে ছুটতে দেখেছি নিজের ছেলেকে মারণ রোগের হাত থেকে
বাঁচাবার জন্য।”
“তা ঠিক। কিন্তু
এসবে আমরা কেন? এটা তো চিনের ব্যাপার।” বেশ খানিকটা ইতস্তত
করেই কথাগুলো বলল ফ্রেডরিক।
হালকা একটা হাসির
রেখা যেন ঝিলিক দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল রবার্টসনের ঠোঁটের কোণে। গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি বোধহয় লিনটাঙ অঞ্চলের পুরো ব্যাপারটা জানো না। সম্রাট কিন-শি-হাঙ আজ
থেকে ২২০০ বছর আগে শুধু টেরাকোটা আর্মি তৈরি করেননি, তার সঙ্গে নিজের জন্যে এক বিশাল সুসজ্জিত কবরও তৈরি করেছিলেন মাউন্ট লি-র
ভেতরে। চিনের এক প্রাচীন ইতিহাসবিদ শিমা কিয়ানের মতে, সেই কবরের অন্ধকারে বহু
ধনরত্নের সঙ্গেই লুকিয়ে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম পারদ-ভাণ্ডার। সম্রাট হাঙ নাকি একশোটা
পারদের নদী বানিয়েছিলেন সেখানে!”
একটু থেমে
রবার্টসন আবার বলতে লাগলেন, “পারদের নদী ছিল কি না জানি না, তবে সেখানকার মাটিতে যে পারদের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ বেশি, সেটা কিন্তু পরীক্ষিত সত্য।”
ফ্রেডরিকের ভুরু
কুঁচকে উঠল। “তাহলে কি...”
“হ্যাঁ। আমারও
তাই ধারণা। চিন সরকার হয়তো কোনওভাবে সেই লুকোনো পারদ-ভাণ্ডারের খোঁজ পেয়ে গেছে আর
তাই পর্যটকদের ওই অঞ্চল থেকে দূরে সরাবার জন্যই এসব ভৌতিক ঘটনা ঘটিয়ে জীবন্ত
টেরাকোটা আর্মির গুজব ছড়াচ্ছে।”
“হুম। কিন্তু যদি
এর পেছনে চিন সরকারই থেকে থাকে তবে এত কিছু করার প্রয়োজন কী? ওদের নিজেদের দেশে ওরা তো সরাসরিই সেই পারদ বের করে নিতে পারে কবরের ভেতর
থেকে।”
“না ফ্রেডরিক, কাজটা অত সোজা নয়। টেরাকোটা আর্মি যেখানে পাওয়া গেছিল সেই জায়গা এবং তার
আশেপাশের বেশ অনেকটা এলাকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে সংরক্ষিত। তাই সেখান থেকে
একেবারে সবার চোখের সামনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এতটা পারদ বের করে আনা ওদের পক্ষেও সম্ভব
নয়। আর তাই ওরা আঙুল বেঁকিয়ে ঘি তোলার তালে আছে। আশা করি বুঝতেই পারছ, যদি টেরাকোটা আর্মির হাতে পর্যটক খুনের গুজবটা ওরা সুন্দরভাবে রটিয়ে দিতে পারে
তাহলে কাজটা অনেক সোজা হয়ে যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সরকার পর্যটকদের নিরাপত্তার অজুহাতে
খুব সহজেই অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সেই নিদর্শনস্থল বন্ধ করে দিতে পারে। আর বন্ধ
জায়গায় লোকচক্ষুর আড়ালে তো সবকিছুই করা সম্ভব।”
ফ্রেডরিক আরেকবার
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খবরের কাগজটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু এর পেছনে যে চিন সরকারই আছে সেটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?”
“নিশ্চিত নই,
ফ্রেডরিক। অন্য কেউও হতে পারে।
হয়তো কোনও টেররিস্ট গ্রুপ। কিন্তু এই আজগুবি ঘটনার পেছনে যে কোনও গভীর চক্রান্ত
আছে, তাতে আমি একশোভাগ নিশ্চিত।”
কথাগুলো বলতে
বলতে উঠে দাঁড়ালেন রবার্টসন। তাঁর চোখেমুখে উত্তেজনার রেখা। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে
টেবিলে হালকা হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন, ঠিক ফ্রেডরিকের
মুখোমুখি। “পারদ বড়ো অসাধারণ জিনিস, ফ্রেডরিক। এই একমাত্র ধাতু যা রুম-টেম্পারেচারেও তরল
থাকে। এছাড়াও আরও অনেক রাসায়নিক ধর্ম রয়েছে পারদের। যদি ওই বিশাল পারদ-ভাণ্ডার চিনের
হাতে পড়ে তবে তারা সেটা অনায়াসে কিছু ভয়ানক জৈব রাসায়নিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার
করতে পারে। আর আমার ধারণা, তারা সেটাই করতে চাইছে। বুঝতেই পারছ, সেরকম পরিস্থিতিতে চিন আমাদের পক্ষে এক ভয়ংকর সামরিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে, যেটা কখনই কাম্য নয়। আর যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা ঠিক হয়, মানে এর পেছনে যদি কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের হাত থাকে তাহলে কিন্তু বিপদটা আরও
বড়ো। পৃথিবীতে হয়তো কেউ রেহাই
পাবে না সেই সর্বনাশ থেকে।”
একটু সময় চুপ করে
সামনের দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইল ফ্রেডরিক। তারপর বলল, “আমাকে কী করতে হবে, স্যার?”
“আমি জানতাম, তুমিই এ কাজের যোগ্য লোক।” ফ্রেডরিকের কাঁধে হাত রেখে বললেন রবার্টসন। “তোমায়
চিনে যেতে হবে। ট্যুরিস্ট হিসেবেই যাবে তুমি। তোমার সব নকল পরিচয়পত্র, ফ্লাইটের টিকিট, ভিসা কালকের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। পরশু তুমি
ওয়াশিংটন থেকে প্রথমে বেইজিং যাবে। বেইজিং এয়ারপোর্টে সেখানকার একজন ইন্টারপোল
অফিসার শিন জিয়ান তোমার সঙ্গে দেখা করবে। সে আমাদেরই লোক। তার কাছে তোমার সব ডিটেল
আর ছবি দেওয়া থাকবে। বেইজিং থেকে বাকি মিশনে সে তোমার সঙ্গেই থাকবে। তারপর তুমি আর
অফিসার জিয়ান বেইজিং থেকে পরের ফ্লাইটে সিয়ান পৌঁছবে। সেখান থেকে মাউন্ট লি খুব
একটা দূরে নয়। বাকি ডিটেল আমি তোমাকে মেইল করে দিচ্ছি।”
“ওকে, স্যার। আমি
তবে সেইমতোই তৈরি হয়ে নেব।”
“হ্যাঁ, তোমার যা যা প্রস্তুতি দরকার, নিয়ে নাও। আর আরেকটা কথা, এই মিশনটা তোমার আগের মিশনগুলোর মতোই সিক্রেট। কিন্তু তুমি চাইলে যোগ্য কাউকে সাহায্যের জন্য
সঙ্গে নিতে পার।”
“ঠিক আছে,
স্যার।” রবার্টসনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল ফ্রেডরিক।
পেন্টাগনের ফিফথ
গেট দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কালো মার্সিডিজটার দিকে এগোতে লাগল সে। বেশ ঘন
কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে চারদিক। হাতঘড়ির ঝাপসা হয়ে আসা কাচটা একবার মুছে নিল আলতো
করে। রাত দুটো বাজে।
রবার্টসন যাই
বলুন, শুধুমাত্র ওই অচেনা ইন্টারপোল অফিসারের ওপর বিশ্বাস করে এমন একটা মিশনে
ঝাঁপিয়ে পড়া বোকামি হবে। আরেকজন সি. আই. এ এজেন্টকে ব্যাক-আপ হিসাবে রাখতেই হবে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা নম্বর টিপল ফ্রেডরিক।
“হ্যালো, পিটার,
আমি ফ্রেডরিক বলছি। একটা মিশনে তোমার সাহায্য চাই। তৈরি
থেকো। আমি সব ডিটেল তোমাকে
মেইলে জানিয়ে দেব।”
কথা শেষ করে
গাড়িটা স্টার্ট করল ফ্রেডরিক। সামনে নতুন মিশন। ওর চোখের তারায় ভাসছে এক অজানা দেশের ছবি। অদ্ভুত একটা
উত্তেজনা যেন ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়।
নিস্তব্ধ রাতের
বুক চিরে কালো মার্সিডিজটা একটু একটু করে ছোটো হতে হতে মিশে গেল রাতের অন্ধকারে।
।। ৩ ।।
ট্রাকটা হঠাৎ বেশ
জোরে ব্রেক কষে থামল গলিটার মুখে। অন্ধকার একটা গলিপথ। একেবারেই শুনশান। রাতের
অন্ধকার যেন কুয়াশার সঙ্গে মিশে মিশে আরও ঘনিয়ে উঠেছে এই গলির আনাচে-কানাচে। গলির
শেষপ্রান্তে কী আছে দেখবার জো নেই। আশেপাশের রাস্তাগুলোও প্রায় ফাঁকা। জনপ্রাণী
বলতে শুধু ওপাশের ফুটপাতে ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে থাকা একটা গাঁজাখোর আর
ডাস্টবিনের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা দুটো রোগাটে কুকুর। সিয়ান শহরের শেষপ্রান্তে
থাকা এই অঞ্চলটাতে কখনওই তেমন লোকজনের আনাগোনা থাকে না।
আস্তে আস্তে
ট্রাকের দু’পাশের দরজা খুলে গেল। দুটো লোক লাফিয়ে পড়ল দরজা দিয়ে। দু’জনেরই গায়ে
হুডি। মাথা ঢাকা। মুখটাও দেখা যাচ্ছে না আবছা অন্ধকারে। যে লোকটা ড্রাইভারের সিটে
বসে ছিল সে ভাঙা ভাঙা গলায় একটু নিচু স্বরেই দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করল, “ওদের জানিয়ে দিয়েছিলে তো?”
“হ্যাঁ, বস।”
তখনই গলির ভেতর
অন্ধকারে যেন কয়েকটা ছায়ামূর্তি কেঁপে উঠল।
“ওই তো ওরা এসে
গেছে।” সেদিকে তাকিয়ে একইরকম নিচু গলায় বলল দ্বিতীয়জন।
অস্পষ্ট
ছায়ামূর্তিগুলি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে দাঁড়াল গলির মুখে। মাঝারি উচ্চতার পাঁচজন চিনা
লোক। সবারই বয়স প্রায় ত্রিশের কাছাকাছি।
“এত দেরি করলে
কেন?” আগের মতোই ভাঙা গলায় বলল প্রথমজন। “নাও, চটপট মালগুলো নামাও। আর হ্যাঁ, দুটো সীসার বাক্স আছে, বেশ ভারী। সাবধানে কোরো।”
ট্রাকের পেছন
থেকে এক এক করে প্রায় আটটা বাক্স নামানো হল। ছ’টা ফাইবার গ্লাসের, আর বাকি দুটো
সীসার।
“জিং, তুমি গাড়ির কাছেই থাকো, আমি এদের সঙ্গে এগোচ্ছি। এরা ফিরে এলে তুমি
এদের নিয়ে আবার সেখানে চলে যেও। কস্টিউমগুলো ট্রাকের পেছনেই রাখা আছে। গুজবটা
টিকিয়ে রাখার জন্য আরও কিছু লোককে তো মারতেই হবে।” শেষের কথাগুলো বলতে বলতে একটা
কুটিল হাসি যেন ঝলসে উঠল সেই প্রথম ব্যক্তির ঠোঁটে।
“আপনি যাবেন না,
বস?” দ্বিতীয় ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল।
“না। চিফের একটা
সিক্রেট মেসেজ এসেছে। আমাকে চিফের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
কথাগুলো শেষ করে
সেই অন্ধকার গলির দিকে পা বাড়াল এই দলের বস। পেছন পেছন বাক্সগুলো নিয়ে চলতে লাগল
বাকি পাঁচজন।
প্রায় একশো মিটার
লম্বা এই সরু গলির শেষ মাথায় এসে থামল তারা। সামনে উঁচু দেওয়াল। এখানেই গলি শেষ।
কিন্তু সবার জন্যে নয়। সেই প্রথম ব্যক্তি ডানপাশের একটা ভাঙা জলের ট্যাপের হাতলটা দু’বার ডানদিকে
তারপর একবার বাঁদিকে ঘোরাল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা দরজার মতো রাস্তা খুলে গেল সামনে দেওয়ালের মুখে। ভেতরে
হালকা আলো জ্বলছে।
বাক্সগুলো খুব
সাবধানে একটা বড়ো সিন্দুকের ভেতর রেখে বেরিয়ে গেল বাকি পাঁচজন। দেওয়ালের গায়ে খুলে
যাওয়া গুপ্ত রাস্তা আবার বন্ধ হয়ে গেল আগের মতোই। ডেরার ভেতরের ম্লান হলদেটে আলো
গিয়ে পড়ছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড
ভরা কাঠের বাক্স আর আধভাঙা মদের বোতলগুলির গায়ে। চারপাশের জিনিসগুলোর ওপর একবার
চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে চেয়ারটা টেনে বসল মিয়াংজু। দলের সবাই বস বলে ডাকলেও এটাই
তার আসল পিতৃদত্ত নাম। ঠোঁটের ডগায় একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের বড়ো স্ক্রিনটা অন
করল সে। কালো স্ক্রিনটা একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। আলো-আঁধারির
আবছায়ায় একটা ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল স্ক্রিনে। মাথায় হ্যাট, গায়ে কোট। কিন্তু অন্ধকারে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। শুধুই একটা মানব-অবয়ব।
“হ্যালো, চিফ।”
বেশ নরম গলায় বলল মিয়াংজু।
“কাজ কেমন চলছে?” স্ক্রিনের ওপার থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ভেসে
এল। উচ্চারণে বেশ বোঝা যাচ্ছে, লোকটা আমেরিকান।
“আমরা প্রায়
পঁচানব্বই কেজি পারদ বের করেছি। এছাড়া আমাদের লোকরা সেখানে টেরাকোটা আর্মি সেজে
সবসময়ই তৈরি আছে। আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই সরকার সেই এলাকা পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে।
তখন বাকি পারদও বের করে...”
“পারদের কথা ছাড়ো,
মিয়াংজু। ওটা তো উপরি পাওনা। আসল জিনিস কতটা বের করতে পারলে?” বেশ রুক্ষ স্বরেই বলে
উঠল অন্ধকারের আড়ালে বসে থাকা সেই ছায়ামূর্তি।
“পেয়েছি, চিফ। আজ
প্রায় তিন কেজির মতো বের করা গেছে। সীসার বাক্সে রাখা আছে সেগুলো।”
“গুড! এবার আসল
কথা শোনো। মাউন্ট লি-র পুরো দায়িত্ব কিছুদিনের জন্য জিং-এর ওপর ছেড়ে দাও। তোমাকে
একটা জরুরি কাজ করতে হবে।”
“কী কাজ, চিফ?” সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল মিয়াংজু।
“যা বলছি ভালো
করে শোনো। টেরাকোটা আর্মির ঘটনাটা নিয়ে সি. আই. এ কিছু একটা সন্দেহ করছে। আর তাই
তারা একজন অফিসারকে মার্কিন ট্যুরিস্ট হিসাবে সিয়ানে পাঠাচ্ছে। সে প্রথমে বেইজিং
এয়ারপোর্টে নামবে। আর তারপর সেখান থেকে সিয়ানে আসবে। বেইজিং থেকে তার সঙ্গে থাকবে
এখানকার একজন ইন্টারপোল অফিসার শিন জিয়ান।”
একটু থেমে সেই
ছায়ামূর্তি আবার বলতে লাগল, “শিন জিয়ান ও সেই আমেরিকান অফিসারের যাবতীয়
তথ্য, ছবি সব আমি তোমাকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু আমাকে কী
করতে হবে, চিফ?” সরু সরু চোখের ওপর পাতলা
ভুরুদুটো কুঁচকে উঠল মিয়াংজুর।
“ইন্টারপোল
অফিসার শিন জিয়ানের জায়গা নিতে হবে তোমায়। সেই আমেরিকান অফিসারের সঙ্গে তুমিই দেখা
করবে শিন জিয়ান সেজে।”
“কিন্তু আসল শিন
জিয়ান যদি...”
“সে চিন্তা
তোমাকে করতে হবে না, মিয়াংজু। আসল শিন জিয়ানকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হবে।” ওপারের
গম্ভীর গলাটা আরও গম্ভীর শোনাল।
একটু সংশয়ের সুরে
মিয়াংজু জিজ্ঞেস করল, “সেই আমেরিকান অফিসার কি শিন জিয়ানকে চেনে না?”
“না। তার কাছে
শিন জিয়ানের কোনও ছবি নেই। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”
একটু সময় চুপ
থেকে মিয়াংজু বলল, “ওকে, চিফ। কাজ হয়ে যাবে। আপনার পরবর্তী
নির্দেশের অপেক্ষায় থাকব।”
“হুম। কিন্তু একটা
কথা মনে রেখ মিয়াংজু, কাজে কোনও ভুল যেন না হয়। ভুলের শাস্তি তুমি
জানো।” স্ক্রিনের ওপাশে থাকা গলাটা যেন আরও রুক্ষ হয়ে উঠল।
মিয়াংজু কিছু
একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনই সামনের
স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে গেল সেই হ্যাট পরা ছায়ামূর্তি।
ঘরের হলদেটে আলোয়
চিকচিক করছে সামনের টেবিলে পড়ে থাকা রাইফেলের কালো ধাতব নলটা। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস
ফেলতে ফেলতে আবার একটা সিগারেট ধরাল মিয়াংজু।
।। ৪ ।।
সামনে রাখা
ব্ল্যাক কফির পেয়ালায় আলতো করে চামচটা নাড়তে নাড়তে আরেকবার দু’পাশে চোখ ঘোরাল
ফ্রেডরিক। বেইজিং এয়ারপোর্টের
ডোমেস্টিক ট্রান্সফার লাইনের পাশে সি.সি.ডি-র তৃতীয় টেবিল। হ্যাঁ, এখানেই তো বসতে বলেছিলেন রবার্টসন। এখানেই আসার কথা শিন জিয়ানের। ফ্রেডরিকের
কাছে শিনের কোনও ছবি নেই। রবার্টসনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিল যে
রবার্টসনের কাছেও শিনের ছবি নেই। শিনের সঙ্গে রবার্টসনের তথ্য আদানপ্রদানের কাজটা
মূলত গোপন বার্তা বা নন-ট্রেসেবল সিম কার্ড লাগানো মোবাইলের মারফত হয়। আসলে শিন
জিয়ানের ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। যদিও গুপ্তচরবৃত্তির কাজে অনেকক্ষেত্রেই এমনটা হয়। শিনের দুটো পরিচয় আছে। এক, সে একজন ইন্টারপোল অফিসার আর দুই, সে আমেরিকার হয়ে
চিনের ভেতরে থেকে গুপ্তচরের কাজ করে। যদিও সে নিজে চিনেরই লোক। আর তাই বোধহয় এই
বাড়তি গোপনীয়তা। ইন্টারপোল অফিসে সে অবশ্য অন্য নামে কাজ করে। তাই আমেরিকার এই
চৈনিক গুপ্তচর যে একজন ইন্টারপোল অফিসার সেটা খুব সম্ভবত রবার্টসন ছাড়া আর কেউ
জানে না। আর এখন ফ্রেডরিক জানল।
“হাই, মিস্টার
ফ্রেডরিক।”
ফ্রেডরিকের ঠিক
পেছনের চেয়ারটা থেকে প্রায় ফিসফিস করেই ভেসে এল কথাগুলো। উলটোদিকে মুখ করে বসে আছে
একটা লোক। ফ্রেডরিক ফিরে তাকাতেই যাচ্ছিল, সেই ব্যক্তি আবার
বলল, “পেছন ফিরো না। সামনে দেখে কথা বলো। আমি শিন জিয়ান। রবার্টসন তোমার ছবি আর
এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।”
“আচ্ছা!” কফিতে
চুমুক দিতে দিতে ফিসফিসে গলায় বলল ফ্রেডরিক।
“আর একঘণ্টা পরেই
আমাদের সিয়ান যাবার ফ্লাইট। তোমার টিকিট তোমার পায়ের কাছে আছে, তুলে নাও।” পেছন থেকে আগের মতোই নিচু স্বরে বলল শিন।
ডানপায়ের জুতোটার
দিকে চোখ পড়তেই ফ্রেডরিক দেখল সত্যিই সেখানে ফ্লাইটের টিকিট পড়ে আছে।
গুপ্তচরবৃত্তিতে শিন যে যথেষ্ট পাকা লোক তা তার কাজ করার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মিনিট পনেরো পর
শিন উঠে দাঁড়াল। “চলো।”
অন্যদিকে তাকিয়ে
বললেও কথাটা যে ফ্রেডরিকের উদ্দেশ্যে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।
শিন কিছুটা
এগোনোর পর ফ্রেডরিকও আস্তে আস্তে ওর পেছন পেছন এগোতে লাগল। কিন্তু প্রায় দু’মিটার দূরত্ব বজায় রেখে। যেন
কেউ কাউকে চেনে না। শিনের চেহারা এখন অবধি দেখে উঠতে পারেনি ফ্রেডরিক। কিন্তু পেছন থেকে শিনের ঘাড়ের ওপর আঁকা
নীলাভ-কালো রঙের আর গাঢ় সবুজ ডানার ড্রাগন ট্যাটুটা হঠাৎ চোখে পড়ল ওর। ‘আগেও কোথায়
যেন দেখেছি এই ট্যাটুটা!’
সময়মতোই বোর্ডিং
শুরু হয়ে গেল। সিকিউরিটি চেক ইন সেরে দু’জনে এগিয়ে গেল ফ্লাইটের দিকে। ফ্রেডরিকের
সিট নম্বর 7A। ফ্রেডরিক উঠে বসার একটু
পরে শিন ভেতরে ঢুকল। ওর সিট কিছুটা পেছনে, 15D। এই প্রথম শিন জিয়ানের চেহারা দেখতে পেল ফ্রেডরিক। পাতলা গড়ন, কিন্তু শরীরে যে
চিতার মতো গতি রয়েছে তা স্পষ্ট। চেহারায় তেমন
বিশেষত্ব কিছুই নেই, আর পাঁচটা চিনা লোকের যেমনটা হয় তেমনই। সরু
চোখের ওপর পাতলা ভুরু আর ভোঁতাটে নাক। তবে লোকটার চোখে একটা শিকারি-চাউনি আছে।
ফ্লাইটে প্রায়
আড়াই ঘণ্টা লাগল বেইজিং থেকে সিয়ান এয়ারপোর্টে পৌঁছতে। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে শাংরি-লা
হোটেলে যেতে আরও একঘণ্টা মতন। দু’জনেই দুটো আলাদা ট্যাক্সিতে। হোটেলেও আগে থেকেই
রুম বুক করা ছিল। ফ্রেডরিকের রুম হোটেলের থার্ড ফ্লোরে, ৩০৭ নম্বর আর শিন থাকবে সেকেন্ড ফ্লোরে, ২১১ নম্বর রুমে।
হোটেলে চেক-ইন করার সময় ফ্রেডরিক খেয়াল করল, শিন এখানে নিজের রুমটা কিয়ান লি নামে
বুক করেছে।
ফ্রেশ হয়ে নিজের
রুমের বিছানায় বসে ছিল ফ্রেডরিক। আগামী সময়ের খসড়াটা আবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল মাথার ভেতর। সামনে অনেক কাজ। কে জানে
সেই ভৌতিক টেরাকোটা আর্মির আড়ালে কী চক্রান্ত চলছে! এর পেছনে যে আসলে কাদের হাত
আছে সেটাও তো এখনও জানা নেই। তাই আসন্ন ভবিষ্যতের না দেখা ছবিগুলোই একবার কল্পনায়
সাজিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল সে।
টিং-টং। রুমের
বাইরের কলিং বেলটা বেজে উঠল হঠাৎ। উঠে গিয়ে আগে দরজার আই-হোলে চোখ রাখল ফ্রেডরিক। না, অন্য কেউ নয়, শিন দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে সরে দাঁড়াল ফ্রেডরিক। শিন একবার করিডোরের দু’পাশে চোখ ঘুরিয়ে চট করে
ঢুকে পড়ল রুমের ভেতর। দরজাটা বন্ধ করে দিল ফ্রেডরিক।
সামনের সোফায়
গিয়ে বসল শিন। ফ্রেডরিক বিছানায়, শিনের মুখোমুখি। এতক্ষণে
প্রথমবার শিনের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সুযোগ পেল সে।
“টেরাকোটা আর্মির
সেই এলাকায় কখন যাচ্ছি আমরা?” ফ্রেডরিক জিজ্ঞেস করল।
“যদি সব ঠিক থাকে
তাহলে পরশু।” সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করতে করতে বলল শিন। “রবার্টসন
যদিও আমাকে প্ল্যানটা জানিয়ে দিয়েছেন, তবুও একবার আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই,
মিস্টার ফ্রেডরিক।” শিনের গলাটা একটু ভাঙা
ভাঙা। আগে ফিসফিস করে কথা বলায় ঠিক বোঝা যায়নি।
“দেখুন, এটা আশা
করি আপনিও বোঝেন যে টেরাকোটা আর্মির ব্যাপারটা শুধুই একটা চোখে ধুলো দেবার কৌশল।
কিন্তু কে বা কারা কী উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজ করছে আমরা জানি না। আমরা সন্দেহ করছি যে
এর পেছনে চিন সরকার বা কোনও সন্ত্রাসী দল জড়িত থাকতে পারে। এখন আমাদের প্ল্যান হল
যে আমি ট্যুরিস্ট সেজে সন্ধের দিকে সেখানে যাব। যে জায়গায় খুনগুলো হয়েছিল সেখানটা
নিশ্চয়ই পুলিশ পাহারায় থাকবে, মানে সেখানে সরাসরি ঢোকা
সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি যেভাবেই হোক অন্য ট্যুরিস্ট এবং পুলিশের চোখ এড়িয়ে
সেখানে ঢুকে যাব। আপনি আগে থেকেই একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল হাতে সেখানে তৈরি
থাকবেন। আমি যেহেতু ট্যুরিস্ট হিসেবে ঢুকব তাই আমার পক্ষে পিস্তল সঙ্গে রাখা সম্ভব
হবে না,
তবে চেষ্টা করব একটা ছোটো ধারালো ছুরি সঙ্গে রাখার। আমাদের
মেইন টার্গেট থাকবে ওই টেরাকোটা আর্মির অন্তত একজনকে হলেও জ্যান্ত পাকড়াও করা। সেই
হবে আমাদের টেরাকোটা রহস্যভেদের প্রথম ধাপ।” এটুকু বলে একটা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে
থামল ফ্রেডরিক।
এতক্ষণ বেশ মন
দিয়ে শুনছিল শিন। সিগারেটের শেষাংশটুকু অ্যাশ-ট্রেতে গুঁজে দিয়ে সে বলল, “পুলিশ পাহারা থাকায় কাজটা একটু শক্ত হবে, কিন্তু হয়ে যাবে।
আচ্ছা, আপনারা কি নিশ্চিত যে ওখান থেকে পারদ বের করা হচ্ছে? মানে রবার্টসন তেমনটাই বললেন আমাকে।”
“নিশ্চিত নই।
কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা যে রয়েছে সেটা ঠিক। কারণ, মাউন্ট লি অঞ্চলের মাটিতে যে
পারদের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকগুণ বেশি সেটা তো আপনিও জানেন। ১৯৮০-তে হওয়া
মাটির নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেখলেই বুঝতে পারবেন। এছাড়াও যে সেই চিনা সম্রাটের
কবরে আলাদাভাবে সংরক্ষিত পারদ-ভাণ্ডার নেই তাই বা কে বলতে পারে?”
“হুম। বুঝলাম।”
একটু সময় কী যেন ভেবে শিন বলল, “কাইন্ডলি একটু জলের
বোতলটা এগিয়ে দেবেন, মিস্টার ফ্রেডরিক? গলাটা একেবারে
শুকিয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ, শিওর। আমি গ্লাসে ঢেলেই দিচ্ছি।”
বিছানার ওপাশের
টেবিলে বোতলটা রাখা ছিল। আর পাশেই দু-তিনটে কাচের গ্লাস। ফ্রেডরিক উঠে সেদিকে এগোল।
এই সুযোগটাই
খুঁজছিল শিন। মানে শিনের বেশে লুকিয়ে থাকা মিয়াংজু। পেছন থেকেই গুলি করতে হবে
ফ্রেডরিককে। সি. আই. এ এজেন্টরা মার্শাল আর্ট আর শর্ট ডিসটেন্স কমব্যাটে কতটা দক্ষ
হয় সেই ধারণা মিয়াংজুর ভালোই রয়েছে। তাই চোখের সামনে বন্দুক তাক করে গুলি করাটা অত
সোজা হত না। মিয়াংজুর কোমরের পেছন দিকে শার্টের ভেতর গোঁজা রয়েছে সাইলেন্সার
লাগানো Glock-19 সেমি অটোমেটিক পিস্তল। মিয়াংজু সেদিকেই হাতটা বাড়াচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই
সোফার হাতলে রাখা ওর মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। একটা মেসেজ ভেসে উঠল স্ক্রিনে
- ‘হোটেল রুমে নয়, ফ্রেডরিক টেরাকোটা আর্মির হাতে মরবে।’ চিফের নির্দেশ। চিফের কোনও লোক কি তবে নজর রাখছে? দু’পাশের জানালা দিয়ে একবার দূরে তাকানোর চেষ্টা করল মিয়াংজু।
ফ্রেডরিক গ্লাসে
জল ঢালা সেরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। সঙ্গে সঙ্গে কোমরের পেছনদিকে এগিয়ে
যাওয়া হাতটাকে আবার সোফার হাতলে ফিরিয়ে আনল শিন সেজে থাকা মিয়াংজু। আগের মতোই
স্বাভাবিকভাবে ফ্রেডরিকের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
“এই নিন, মিস্টার
জিয়ান।” জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল ফ্রেডরিক।
“অসংখ্য
ধন্যবাদ।”
একটানে পুরো
গ্লাসটা শেষ করে উঠে পড়ল শিন।
“তাহলে সেই কথাই
রইল, মিস্টার জিয়ান। আমরা পরশু যাচ্ছি।” ফ্রেডরিক বলল।
“হ্যাঁ। সময়টা
আমি আপনাকে কাল জানিয়ে দেব।”
।। ৫ ।।
সন্ধে হয়ে এসেছে।
আবছা অন্ধকার একটু একটু করে গাঢ় হতে শুরু করেছে। কুয়াশাও পড়ছে হালকা হালকা।
স্বাভাবিকভাবেই ট্যুরিস্টের ভিড়টাও কমে আসছে আস্তে আস্তে। এমনিতেও সেই বারোজন ট্যুরিস্ট
খুনের ঘটনার পর থেকে বিদেশি ট্যুরিস্টের সংখ্যা বেশ কমে গেছে এখানে। চারপাশে কড়া
পুলিশ পাহারা বসানো। যারা ঢুকছে-বেরোচ্ছে সবাইকে গেটে সার্চ করা হচ্ছে।
ফ্রেডরিক যখন
ভেতরে ঢুকল তখন প্রায় ছ’টা বাজে। আর দেড় ঘণ্টামতন হয়তো খোলা থাকবে। ওর সঙ্গে আরও
তিনজন ট্যুরিস্ট ঢুকল। দু’জন ফ্রান্সের, আর একজন নাইজেরিয়ার লোক।
ঢোকার মুখের মেইন
সিকিউরিটি গেট পেরিয়েই একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল ফ্রেডরিক। নিদর্শনস্থল প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। এইমাত্র
ঢোকা ওরা চারজন ছাড়া আর শুধু পাঁচজন ট্যুরিস্ট ভেতরে রয়েছে। কিন্তু তাদেরও দেখা
প্রায় শেষ,
বেরিয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
একজন রোগা-পাতলামতো
গাইড হনহনিয়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে। “আসুন স্যার, পুরো এলাকা আমি
ঘুরিয়ে দেখাব আপনাদের। সঙ্গে টেরাকোটা আর্মি, সম্রাট
কিন-শি-হাঙের পুরো ইতিহাসটাও জানতে পারবেন। পার-হেড মাত্র ৫০ ইউয়ান।” বেশ পেশাদারি ভঙ্গিতেই কথা বলছিল লোকটা।
চিনের ৫০ ইউয়ান
মানে সাত মার্কিন ডলারের চেয়ে কিছুটা বেশি। আশেপাশে আর দ্বিতীয় কোনও গাইড চোখে না
পড়ায় অগত্যা ওই দরেই রাজি হলেন চারজনে। নাইজেরিয়ান ভদ্রলোকের একটু আপত্তি ছিল,
কিন্তু উপায়ান্তর নেই। গাইডের সঙ্গে এগোতে লাগল চারজনের দলটা। একেবারে পেছনে
ফ্রেডরিক।
গাইড সেই ২২০০
খ্রিস্টপূর্ব থেকে কাহিনি বলতে শুরু করেছে, মন দিয়েই শুনছে
সবাই। শুধু ফ্রেডরিকের চোখ অন্যদিকে। এই এলাকার পুরো নকশাটা ভালোভাবেই মাথায় বসিয়ে
এসেছিল সে হোটেল থেকে বেরোবার আগে। আরও কিছুটা এগোবার পর সেই জায়গাটাও চোখে পড়ে গেল তার। উত্তর-পূর্ব কোণে শেডের
একেবারে শেষ মাথায় বেশ অন্ধকার মতন জায়গাটা। পুলিশি লেবেল লাগানো মোটা হলদেটে
প্লাস্টিক টেপ আর সামনে একটা বোর্ডে লাল কালিতে লেখা ‘প্রবেশ নিষেধ’। কিন্তু যেমনটা সে আশা করেছিল তেমন কোনও পুলিশ
পাহারা নেই। মানে ফ্রেডরিকের কাজ আরও খানিকটা সহজ হয়ে গেল।
ওদের ট্যুরিস্ট
গাইড তখন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সম্রাট কিনের রাজত্বে কীভাবে ও কেন এই বিশাল টেরাকোটা
আর্মি গড়ে উঠেছিল সেটাই বলে চলেছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে
অন্ধকার। বাকি ট্যুরিস্টরা ইতিহাসের গল্পে মশগুল।
হ্যাঁ, এটাই ঠিক সময়। আর দেরি করা চলবে না। ফ্রেডরিক খুব আস্তে আস্তে ওপাশে সরতে সরতে
একসময় প্রায় নিঃশব্দে সবার চোখের আড়ালে একটা টেরাকোটার মূর্তিতে ঠাসা গর্তে নেমে
পড়ল। বাকি ট্যুরিস্টরা ক্রমশ আরও এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
এবার আসল জায়গায়
যেতে হবে। ফ্রেডরিক খুব সাবধানে সেই গর্ত থেকে উঠে প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই এগোতে
লাগল সেই নিষিদ্ধ জায়গার দিকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে এসে পৌঁছল ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা বোর্ডটার কাছে। এখানেই কিছুদিন আগে খুন হয়েছিল বারোজন বিদেশি পর্যটক।
পুলিশি টেপ
লাগানো এলাকার ভেতরে ঢোকার আগে জুতোর কাছে একটা গোপন খাঁজে একবার হাত ঠেকিয়ে কিছু
যেন নিশ্চিত করার চেষ্টা করল ফ্রেডরিক। হ্যাঁ,
ফাইবারের ছুরিটা রয়েছে। যদিও শিন ওখানে আগে থেকেই তৈরি থাকবে, তবুও দরকার
পড়লে কাজে দেবে এটা। ফ্রেডরিকের মতো মার্শাল আর্ট জানা লোকের পক্ষে কম দূরত্বে
কাউকে জোরদারভাবে ঘায়েল করার জন্য ওই ছোটো ফাইবারের ছুরিটাই যথেষ্ট।
বেশ অন্ধকার হয়ে
এসেছে। দূরের জিনিস আর ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিল ফ্রেডরিক, সাতটা বাজে। দু’পাশে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে আগের মতোই কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে, কিছুটা শরীর নুইয়ে বেশ জোরে পা চালিয়ে সে ঢুকে পড়ল সেই পুলিশি টেপ লাগানো
জায়গাটার ভেতরে। ভেতরের চারপাশটা একবার চোখে মেপে নিল ফ্রেডরিক। পাশাপাশি দুটো দুটো করে মোট চারটে গর্ত। তার
মধ্যে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন অস্ত্র হাতে টেরাকোটার সৈন্যমূর্তিগুলো। এতটাই
নিখুঁত যে দেখলে আসল মানুষ বলে ভুল হয়। তার ওপর এই অন্ধকারে মূর্তি আর মানুষে
ফারাক করা তো প্রায় অসম্ভব। গর্তগুলোর মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে উত্তরের
ঝোপঝাড়গুলোর দিকে একবার তাকাল ফ্রেডরিক। কে জানে শিন কোথায় লুকিয়ে আছে বন্দুক নিয়ে! মাউন্ট লি-র রাস্তা দিয়ে এখানে ঢোকার
কথা শিনের। প্ল্যান মোতাবেক সে আগে থেকেই কোথাও লুকিয়ে তৈরি থাকবে যাতে তেমন
বিপদের পরিস্থিতিতে ফ্রেডরিককে সাহায্য করতে পারে। ফ্রেডরিক যতটা সম্ভব অন্ধকারে
গা ঢাকা দিয়ে এলাকাটার এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগল। যেখানে ট্যুরিস্টদের
মৃতদেহগুলি পড়ে ছিল সেখানে মাটিতে সাদা রঙে মৃতদেহের ভঙ্গিমাটা আঁকা আছে। খুনের
কেসে পুলিশ সাধারণত যেমনটা করে থাকে। আশেপাশে কিছু কিছু শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্তের
দাগ। অন্ধকারের জন্য বেশ খানিকটা ঝুঁকলে তবে দেখা যায়।
আরও কিছুটা এগিয়ে
একবার সময় দেখে নিল ফ্রেডরিক। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। মেইন গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এতক্ষণে। কে জানে টেরাকোটা আর্মির দেখা পাওয়া
যাবে কি না! না পেলে হয়তো আবার একদিন আসতে হবে। তবে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করলে এই
রহস্যের কিছু একটা সূত্র পাওয়াও যেতে পারে। তাই আরও কিছুক্ষণ পুরো এলাকাটা খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে ঘুরে দেখতে লাগল সে। কিন্তু তেমন কাজের কিছুই চোখে পড়ল না। খুন হওয়া
ট্যুরিস্টদের জিনিসপত্র, ক্যামেরা এসব তো আগেই পুলিশ নিয়ে গেছে। থাকার
মধ্যে এখন শুধু এখানে ওখানে মাটিতে লেগে থাকা কিছু কালচে রক্তের ছোপ।
‘নাহ্, আজ বোধহয় খালি হাতেই ফিরতে হবে। যাই, একবার ওই ঝোপের
দিকে এগিয়ে দেখি শিনের দেখা পাই কি না।’ নিজের মনেই কথাগুলো বলে ঝোপের দিকে পা
বাড়াল ফ্রেডরিক। কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ
খুব ভারী কিছুর যেন নড়ার শব্দ হল পেছন থেকে। মুহূর্তে স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে উঠল
ফ্রেডরিকের; ধমনীতে যেন রক্তের বেগ বেড়ে গেল। পেছন ফিরতেই
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তার। পাঁচটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার চারপাশে।
সাজপোশাক হুবহু ওই টেরাকোটা আর্মির মূর্তিগুলোর মতো। অন্ধকারে মূর্তি, না জ্যান্ত
মানুষ বোঝা অসম্ভব। ছায়ামূর্তিগুলি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগল ফ্রেডরিকের দিকে।
ফ্রেডরিকও ততক্ষণে পায়ের কাছে লুকোনো ছুরিটা বের করে নিয়েছে। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে
উঠছে তার পেশিগুলো। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমতে শুরু করেছে কপালে। আর মাত্র হাতখানেক দূরে
ওই টেরাকোটা আর্মি। ফ্রেডরিকও তৈরি যে কোনও মুহূর্তের জন্য।
ঠিক এমন সময় হঠাৎ
পেছন থেকে একটা পরিচিত গলা ভেসে এল, “সাবধান ফ্রেডরিক, ওদের ওপর ছুরি চালাবার চেষ্টা একদম কোরো না, নইলে আমার গুলিতে মরবে।”
চমকে পেছন ফিরল
ফ্রেডরিক। ঠিক ওর দিকেই নিজের
পিস্তলটা তাক করে দাঁড়িয়ে আছে শিন জিয়ান।
ভাঙা ভাঙা স্বরে
শিন বলল,
“অবাক হলে বুঝি? সি. আই. এ-র
অফিসাররা যে এত বোকা হয় জানতাম না। আসল শিন জিয়ানকে তো আমরা আগেই সরিয়ে দিয়েছি।
আমি মিয়াংজু। তোমাকে মারার শুভ কাজ আমার ওপরই বর্তেছে।”
একটা হিংস্র হাসি
হেসে সে আবার বলল, “তোমাকে হোটেল রুমে গত পরশুই শেষ করে দিতাম। কিন্তু চিফের ইচ্ছে যে টেরাকোটা আর্মির হাতেই
তোমার ভবলীলা সাঙ্গ হোক।”
ফ্রেডরিক মূর্তির
মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে কিছুই মাথায় আসছে না আর। সামনে পেছনে দু’দিকেই
মৃত্যু। শিনের ইশারায় সেই টেরাকোটা আর্মি সেজে থাকা লোকগুলো আবার ফ্রেডরিকের দিকে
এগোতে শুরু করল।
“আহ্!”
হঠাৎ একটা
কাতরানিমতো আওয়াজ বেরিয়ে এল শিনের ছদ্মবেশে থাকা মিয়াংজুর মুখ থেকে। গুলিটা ওর হাত
ছুঁয়ে গেছে। পিস্তলটাও ছিটকে পড়েছে হাত থেকে। আর তখনই অবস্থা বুঝে ঘুরে দাঁড়াল
ফ্রেডরিক। বিদ্যুতের মতো গতিতে হাত
আর ছুরির ঘায়ে গুরুতরভাবে জখম করে দিল সেই পাঁচ টেরাকোটার সৈন্যকে। মিয়াংজু তখন
হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে আছে, আর তার মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিটার।
তার আঙুলটা এগিয়ে যাচ্ছে ট্রিগার টানতে।
“দাঁড়াও, গুলি কোরো না, পিটার। একে জ্যান্ত চাই।” উত্তেজিত গলায় বলে উঠল ফ্রেডরিক।
“কেন?” ট্রিগারের ওপর আঙুলটা একটু হালকা করে জিজ্ঞেস
করল পিটার।
“এদের আসল মতলবটা
কী জানতে হবে যে। এটাই পালের গোদা, এগুলো তো শুধুই
দাবার ঘুঁটি।”
কথাগুলো বলতে
বলতে একবার পেছনে আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকা সেই ছদ্মবেশী ভাড়াটে খুনিগুলোর দিকে
তাকাল ফ্রেডরিক।
“ঠিক আছে। একে
তাহলে আপাতত অজ্ঞান করে দিচ্ছি।” বলেই পকেট থেকে একটা ছোট্ট সূচের মতো কী যেন বের
করে মিয়াংজুর গলার কাছে ফুটিয়ে দিল পিটার। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মিয়াংজুর
অসাড় শরীর। ফ্রেডরিক ততক্ষণে এগিয়ে এসে মিয়াংজুর পিস্তলটা হাতে তুলে নিল। তারপর এক
এক করে সেই টেরাকোটা আর্মি সেজে থাকা লোকগুলোকে গুলি করে শেষ করে দিল সে।
“বুঝলে কীভাবে যে
এই লোকটা আসল শিন জিয়ান নয়?” পিটার জিজ্ঞেস করল।
“হোটেলে গিয়ে সব
বলছি। কিন্তু আগে এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরোনো দরকার।”
“চিন্তা নেই।
একটু দূরেই আমার গাড়ি দাঁড় করানো আছে।”
“গ্রেট! তাহলে আর
দেরি না করে তোলো একে।” মিয়াংজুর কাঁধের দিকটা ধরে তুলতে তুলতে বলল ফ্রেডরিক।
সেখান থেকে প্রায়
এক কিলোমিটার দূরে রাখা ছিল পিটারের গাড়ি। মিয়াংজুকে ধরাধরি করে সেখান অবধি নিয়ে
যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল।
গাড়িতে উঠে আর
দেরি করল না পিটার। বেশ জোরেই ছোটাল গাড়িটা। তবু সেখান থেকে শাংরি লা হোটেলে
পৌঁছতে অনেকটাই সময় লেগে গেল। হোটেলের পার্কিং লটে যখন এসে গাড়ি থামল তখন রাত দশটা
বাজে।
এখন দ্বিতীয় কাজ
হল মানুষের চোখ এড়িয়ে এই মিয়াংজুকে অজ্ঞান অবস্থায় হোটেলের রুমে নিয়ে যাওয়া।
আইডিয়াটা পিটারই বাতলে দিল। “যেভাবে এনেছি সেভাবেই ধরাধরি করে নিয়ে যাব। কেউ
জিজ্ঞেস করলে বলা যাবে যে অতিরিক্ত মদ খেয়ে হুঁশ রাখতে না পারায় এই অবস্থা। একথার
পর আশা করি আর কেউ খুব একটা নাক গলাতে আসবে না।”
ব্যবস্থাটা ভালোই
কাজ করল। হোটেলের রিসেপশনে থাকা ভদ্রলোক ছাড়া আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
“রুমে তো আনা গেল, এবার কী করবে ?” পিটার জিজ্ঞেস করল।
একটা চেয়ারে
অজ্ঞান মিয়াংজুকে বসিয়ে ফ্রেডরিক বলল, “আলমারিতে একটা
মোটা দড়ি রয়েছে। নিয়ে এস।”
মিয়াংজুকে
চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে মুখে কাপড় চেপে দিল ফ্রেডরিক। “এভাবেই থাক ব্যাটা, যতক্ষণ জ্ঞান না ফেরে।” তারপর চেয়ারসহ মিয়াংজুকে বাথরুমে রেখে দরজা বন্ধ করে
দিল সে।
“এর ব্যবস্থা তো
করলে, এবার গল্পটা বলো। বুঝলে কীভাবে যে এই ব্যাটা আসল লোক নয়?”
সামনের সোফায় বেশ
আয়েশ করে বসে জিজ্ঞেস করল পিটার। ফ্রেডরিকও বিছানায় গিয়ে বসল। তারপর একটু হেসে বলল, “একেবারে যে একশোভাগ নিশ্চিত ছিলাম তা নয়। শিন জিয়ানকে আমি দেখিনি, রবার্টসনের কাছেও তার কোনও ছবি নেই, আর সেই সুযোগটাই
নিয়েছিল এরা। কিন্তু ছোট্ট একটা ভুলে ধরা পড়ে গেল। একটা ট্যাটু। ওই লোকটার ঘাড়ের কাছে একটা ড্রাগনের ট্যাটু
আঁকা। বেইজিং এয়ারপোর্টেই দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন ঠিক মনে করতে পারছিলাম না
এই ট্যাটুটা এর আগে কোথায় দেখেছি। গত পরশু হোটেলে আসার পর লোকটা যখন আমার সঙ্গে
আজকের প্ল্যানের ব্যাপারে কথা বলে বেরিয়ে গেল তারপর আমি ল্যাপটপে সি. আই. এ-র
মাস্টার ডাটাবেসটা খুলে বসলাম। আর সেখানে একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম জিনিসটা। ওই
ট্যাটুটা কুখ্যাত ড্রাগনোস গ্যাংয়ের চিহ্ন।”
“ড্রাগনোস? এটা সেই দল না যারা পৃথিবীর সব সন্ত্রাসবাদীদের অস্ত্র, বোমা এসব সাপ্লাই করে?”
“হ্যাঁ, পিটার। এ
সেই ড্রাগনোস দলেরই লোক। রবার্টসনের সন্দেহ অমূলক ছিল না। এরা নিশ্চয়ই মাউন্ট লি
থেকে পারদ বের করে সন্ত্রাসবাদীদের কাছে বিক্রি করছে।”
একটু থেমে
ফ্রেডরিক আবার বলল, “তোমার সাহায্য দরকার পড়বে জানতাম, কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবতে পারিনি। আসলে ট্যাটুটা ড্রাগনোস
গ্যাংয়ের সেটা জানার পর এই লোকটার ওপর সন্দেহ ঘনিয়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই এক
ট্যাটু ছাড়া আর কোনও প্রমাণ ছিল না হাতে। আর শুধু একটা ট্যাটুর ভিত্তিতে তো কাউকে
সন্ত্রাসবাদী ঠাওরে গুলি করতে পারি না। তাই তোমাকে বলেছিলাম ওই টেরাকোটা আর্মির
জায়গাটার কাছাকাছি বন্দুক হাতে তৈরি থাকতে। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, লোকটা ওখানে গিয়েই আমার ওপর আক্রমণ করবে, তার আগে নয়। আর
তখনই হাতেনাতে ধরতে পারব একে।”
“হুম, বুঝলাম।” খসখসে গালের ওপর আলতো করে একবার তর্জনীটা ঘষে বলল পিটার।
ফ্রেডরিকের
ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসির রেখা ভেসে উঠল। “তবে আজ তুমি ঠিক সময়ে না এলে আমার
বেঁচে ফেরা মুশকিল হয়ে যেত।”
পিটারও একটু
হাসল। “ওসব কথা ছাড়ো।” তারপর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ অনেক ধকল গেছে। এবার বিশ্রাম নাও। আমিও আমার হোটেলে ফিরে যাই। আমি এখান থেকে একটু দূরে
গ্রান-মেলিনা হোটেলে আছি। কাল সকাল ন’টা নাগাদ আসব আবার।”
“ওকে। গুড নাইট,
পিটার।”
“গুড নাইট। আর
সাবধানে থেক ফ্রেডরিক, লোকটার ওপর নজর রেখ।”
।। ৬ ।।
টিং-টং। হোটেল
রুমের কলিং বেলটা বেজে উঠল। বাঁদিকের দেয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল ফ্রেডরিক। ন’টা পাঁচ। নিশ্চয়ই পিটার হবে। তবুও দরজা খোলার
আগে একবার আই-হোলে চোখ ঠেকিয়ে নিল সে। হ্যাঁ, পিটারই দাঁড়িয়ে
আছে বাইরে। দরজাটা খুলে দিল ফ্রেডরিক। “গুড মর্নিং, পিটার। এস। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
ভেতরে ঢুকেই
পিটার জিজ্ঞেস করল, “খবর কী? জ্ঞান ফিরেছে?”
দরজাটা ভালোভাবে
লক করে এসে বসল ফ্রেডরিক। “হ্যাঁ, জ্ঞান তো ভোররাতের দিকেই ফিরেছে।”
“কিছু জানতে
পারলে?”
“উঁহু। তেমন
কিছুই না। একেবারে পাকা লোক। কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি নয়।”
“মাথায় বন্দুক
ঠেকিয়ে দু-চারটে চড়-চাপড় মারলে হড়হড় করে সব বলতে শুরু করবে।” ভুরু কুঁচকে বেশ
উত্তেজিত গলায় বলল পিটার।
“তুমি কি ভাবছ
সে সব করিনি আমি? সব চেষ্টাই করা হয়ে গেছে।” একটু থেমে কিছু একটা
যেন ভাবল ফ্রেডরিক। তারপর আবার বলল, “কিন্তু দুটো জিনিস বেশ বুঝতে পারছি।”
“কী?”
“এই লোকটা শুধুই
টেরাকোটা আর্মির সেনাপতি। রাজা অন্য কেউ। টেরাকোটা আর্মির ভয় ছড়িয়ে সম্রাট কিনের
কবর থেকে পারদ বের করার পেছনে আসল মাথাটা অন্য কারোর।”
“একটু খোলসা করো
তো ব্যাপারটা।”
পাশে রাখা জলের
বোতলটা থেকে একটু গলা ভিজিয়ে নিয়ে ফ্রেডরিক বলল, “গতকাল লোকটা যখন আমার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়েছিল তখন সে একবার বলেছিল যে
তাদের কোনও এক চিফের নির্দেশ, আমার মৃত্যু টেরাকোটা
আর্মির হাতে হোক। তুমি তখন আড়ালে লুকিয়ে ছিলে, তাই হয়তো শুনতে পাওনি। আজ অনেক
চেষ্টা করলাম সেই চিফ কে তা জানার, কিন্তু কোনও লাভ
হল না। লোকটা বারবার বলছে যে সে জানে না। এমনকি চিফ কে তা নাকি এই দুনিয়ায় কেউ
জানে না! আর সেখানেই খটকাটা লাগছে আমার।”
“কীসের খটকা?” পিটার জিজ্ঞেস করল।
“আমার মনে হচ্ছে,
লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে আসলেই জানে না, চিফ কে। হতেই
পারে যে এই চিফ এমন কেউ যে অন্য কোনও দেশে বসে ভার্চুয়াল কমিউনিকেশনের মাধ্যমে
এদের নির্দেশ দেয়। আর এরা শুধু টাকার বিনিময়ে সেই নির্দেশমতো কাজ করে যায়। হয়তো এই
সেই ড্রাগনোস গ্যাংয়ের মাথা যাকে আমরা অনেকদিন ধরে খুঁজছি। বুঝতে পারছ পিটার, যদি একবার ওই চিফের নাগাল পাই তাহলে এটা আমাদের কাছে কত বড়ো সাফল্য হবে!
পৃথিবীর চৌত্রিশটি দেশে ছড়িয়ে থাকা ড্রাগনোস গ্যাংয়ের শাখাগুলি এক ঝটকায় অকেজো হয়ে
পড়বে। আর ড্রাগনোস গ্যাং ভেঙে পড়া মানে অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী দলগুলোও অনেকটা
দুর্বল হয়ে পড়বে। কারণ, ওদের অস্ত্রশত্রের সিংহভাগ এই ড্রাগনোস গ্যাং-ই সাপ্লাই
করে। সি. আই. এ চিফ রবার্টসন অনেকবার ওই ড্রাগনোস গ্যাংয়ের ওপর আঘাত হেনেও তাদের
লিডারকে ধরতে পারেননি। হয়তো এবার এই কাজটা আমরা করতে পারব।”
“কিন্তু ফ্রেডরিক, লোকটা তো ওদের চিফের ব্যাপারে কিছুই বলে উঠতে পারছে না। তাহলে এগোবে কীভাবে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে
কী যেন ভাবল ফ্রেডরিক। তারপর বলল, “হুম, সেখানেই তো আটকে
গেছি, পিটার। তবে একটা কথা বারবার আমার মাথায় পাক খাচ্ছে। মাউন্ট লি অঞ্চল থেকে
প্রচুর পরিমাণে পারদ সরিয়ে এনে রাতারাতি বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এখানে, এই সিয়ান শহরে
নিশ্চয়ই এদের কোনও গোপন ডেরা আছে যেখানে ওই কাঁচা পারদ মজুত করে রাখে।”
“হুম, কথাটা ভুল বলনি, ফ্রেডরিক। কিন্তু সেই ডেরার ঠিকানা কিছু জানতে পারলে?”
“না ভায়া। এই
লোকটা যা ঠ্যাটা, মরে গেলেও মুখ খুলবে না।” একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস
ফেলে বলল ফ্রেডরিক।
“তাহলে?”
“কিছু একটা তো
করতেই হবে। কারণ, আপাতত ওই ডেরাটাই আমাদের হাতের কাছে একমাত্র সূত্র। ওই ডেরায়
পৌঁছতে পারলে হয়তো ড্রাগনোস গ্যাংয়ের সেই চিফের ব্যাপারেও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।”
“সবই তো বুঝলাম
ফ্রেডরিক, কিন্তু কাজটা করবে কীভাবে?” বেশ উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল পিটার।
আবার কিছুক্ষণ
চুপ করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল ফ্রেডরিক। তারপর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখা যাক কী করা
যায়। আপাতত চলো, বেশ জমিয়ে একটু চাইনিজ ডিস চেখে আসা যাক।”
“মানে? এখানে এমন একটা কেস ফেলে তুমি খাবারের চিন্তা করছ! আর এই লোকটাকে এখানে রেখে
কোথায় যাবে?” অবাক চোখে ফ্রেডরিকের দিকে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল পিটার।
“এর আর কী হবে? চেয়ারে যেমন বাঁধা আছে তেমনই পড়ে থাকবে। আর এমনিতেও লোকটা এখন অজ্ঞান। তুমি
আসার কিছুক্ষণ আগে আমি আবার ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছি একে।” তারপর একটু
হেসে ফ্রেডরিক বলল, “খালি পেটে মাথা কাজ করে না ভায়া। খিদেয় পেট চোঁ
চোঁ করছে। তাই বলছি আগে ভালো কিছু খেয়ে আসি, তারপর না হয় ওই
ডেরা খোঁজার ব্যাপারে ভাবা যাবে’খন।”
কথা শেষ করেই উঠে
দাঁড়াল ফ্রেডরিক। পার্সটা পকেটে গুঁজতে
গুঁজতে বলল, “নাও নাও, উঠে পড়ো। আজ আমি
খাওয়াচ্ছি।”
অগত্যা পিটারও
উঠে দাঁড়াল। “তোমার হাবভাবে মাঝে মাঝে তাজ্জব বনে যাই, ফ্রেডরিখ।”
ওরা যেখানে খেতে
এসেছে, জায়গাটা শাংরি লা হোটেল থেকে খুব একটা দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। তবুও
ফ্রেডরিক গাড়ি নিয়েই এল।
শিং-লুসিয়ান রেস্তোরাঁ। ফ্রেডরিক এক প্লেট কুং পাও চিকেন অর্ডার করল,
আর পিটার মা পো তোফু। ওয়েটার বলল, এটা নাকি এই রেস্তোরাঁর বিশেষ ডিশ।
খেতে খেতে
ফ্রেডরিক পিটারের দিকে তাকিয়ে বলল, “যে ডিশটা খাচ্ছ
তার রেসিপি একশো বছর পুরোনো। একেবারে সাবেকি চিনা ডিশ।” তারপর নিজের প্লেটের দিকে ইশারা করে বলল, “আমি যেটা নিলাম, সেটা আমেরিকায় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু অন্য
নামে। চিনের কুং পাও পাশ্চাত্যদেশে গিয়ে গং বাও হয়ে গেছে। স্বাদ আর রেসিপি সবই পালটে
গেছে সেখানে গিয়ে।”
পিটার খেতে খেতে
কথাগুলো শুনছিল ঠিকই, কিন্তু ওর মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে মনটা এখনও হোটেল
রুমেই পড়ে আছে।
দু’জনেরই খাওয়া
প্রায় শেষের পথে, এমন সময় হঠাৎ ফ্রেডরিকের পকেটে কীসের যেন একটা
শব্দ হতে লাগল। একটা স্মার্টফোনের আকারের যন্ত্র, মাথায় আবার ছোটো একটা অ্যান্টেনার মতো লাগানো। পকেট থেকে বের করে সেটার
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই মুখের ভাবটা পালটে গেল ফ্রেডরিকের। গম্ভীর গলায় বলল, “পিটার, মাছ টোপ গিলেছে। চলো, আর দেরি করা চলবে না।”
“হঠাৎ কী হল?” পিটারের গলায় বিস্ময়ের সুর।
“পরে বলছি। এখন
ঝটপট উঠে পড়ো।”
টেবিলে খাবারের
দাম রেখে প্রায় দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল ফ্রেডরিক। পিটার ড্রাইভিং সিটে বসল। ফ্রেডরিক আগের মতোই
গম্ভীর গলায় বলল, “পরে সব বুঝিয়ে বলব, এখন যেদিকে বলছি সেদিকে গাড়ি ছোটাও। বেশি দেরি হয়ে গেলে ফসকে যেতে পারে।”
ফ্রেডরিকের
নির্দেশমতো গাড়ি স্টার্ট করল পিটার। ফ্রেডরিক হাতের যন্ত্রটার স্ক্রিনে চোখ রেখে
বলতে লাগল,
“সামনের ওই রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে সেকেন্ড রিং রোড বরাবর যেতে
থাকো।”
রেস্তোরাঁর
সামনের রাস্তাটা দিয়ে সোজা কিছুটা এগোলেই সেকেন্ড রিং রোড। বেশ জোরেই গাড়ি ছুটিয়ে
এগোতে লাগল পিটার। কিছুটা গিয়ে ডানে বাঁক নিল রাস্তা। তারপর সোজা আরও কিছুটা
এগোবার পর ফ্রেডরিক বলল, “দাঁড়াও, এবার ডানদিকে
ডকিং রোড বরাবর এগোও।”
ডকিং রোড দিয়ে
কিছুক্ষণ চলার পর একটা সার্কেল সামনে পড়ল। ফ্রেডরিকের নির্দেশমতো সেটা পেরিয়ে গাড়ি
এবার লিয়ানহু রোডে উঠল।
“আরও জোরে চালাও,
পিটার।” ফ্রেডরিক বলল।
গাড়ি সাঁ সাঁ করে
ছুটতে লাগল। হঠাৎ সাজিঙ্কিয়াও স্টেশনের কাছাকাছি এসে ফ্রেডরিক বলল, “গাড়ি থামাও। মনে হচ্ছে জায়গায় এসে পড়েছি। একটা গলির ভেতর ঢুকছে লোকটা।”
তারপর চট করে
গাড়ি থেকে নেমে প্যান্টের পেছনে গোঁজা পিস্তলটা বের করে নিল ফ্রেডরিক। পিটারও তাকে অনুসরণ করতে লাগল। রাস্তার পাশে
বেশ কয়েকটা গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে একটা সরু ঘুপচি গলির সামনে এসে দেয়ালের আড়ালে
থামল ফ্রেডরিক। পিটারও নিজের পিস্তল
হাতে ওপাশের দেয়ালটার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়াল। কেউ একজন বেশ জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে
যাচ্ছে গলির ভেতর দিয়ে। ফ্রেডরিকও খুব সাবধানে গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। বেশ জোরে
কিন্তু নিঃশব্দে এগোতে লাগল সে। ঠিক চিতাবাঘ যেমনভাবে এগোয় নিজের শিকারের দিকে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে আস্তে আস্তে পিটারও গলির ভেতর ঢুকল। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখা
গেল রাস্তা বন্ধ। সেই তৃতীয় লোকটাও দাঁড়িয়ে পড়ল গলির শেষ মাথার দেয়ালটার সামনে।
ফ্রেডরিক তখনও অন্ধকারে গা ঢাকা দিকে একদৃষ্টে সেই লোকটার দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটা
বার দুয়েক এদিক সেদিক দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে দেয়ালের ডানপাশের একটা ভাঙা জলের ট্যাপের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ট্যাপের হাতলটা দুয়েকবার এদিক ওদিক ঘোরাতেই সামনের
দেয়ালে ঘড়ঘড় করে একটা রাস্তা খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ঝলসে উঠল ফ্রেডরিকের
সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। সেই গোপন রাস্তার মুখে দাঁড়ানো লোকটা লুটিয়ে পড়ল
মাটিতে। গুলি পিঠ ফুঁড়ে বুক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
“চলো, পিটার। কাজ
হয়ে গেছে।”
ফ্রেডরিক এগোতে
লাগল। পেছন পেছন পিটারও। কাছে গিয়ে পিটার দেখল, এ তো সেই লোকটা যাকে তারা গতকাল
থেকে হোটেল রুমে বেঁধে রেখেছিল। পিটারের প্রশ্নভরা চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্রেডরিক বলল, “আগে ভেতরে ঢুকি, তারপর সব বলছি।”
আস্তে আস্তে বেশ
সতর্কভাবেই পিস্তল তাক করে সেই গুপ্ত রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকল দু’জনে। আবছা
অন্ধকার। কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। এপাশ ওপাশ তাকাতেই ফ্রেডরিকের চোখে পড়ল
একটা সুইচ বোর্ড। দুয়েকটা সুইচ টিপতেই আলো জ্বলে উঠল ঘরে। বেশ ম্লান হলদেটে মতো
একটা বালব। তবে এখন সবকিছুই স্পষ্ট
দেখা যাচ্ছে।
চারদিকে তন্নতন্ন
করে খুঁজে দেখল তারা, কিন্তু কোথাও কেউ নেই। শুধু কিছু অস্ত্রশস্ত্র, রাইফেল আর বাক্সভর্তি হ্যান্ড গ্রেনেড। হঠাৎ একটা বেশ চওড়া লোহার সিন্দুক চোখে
পড়ল ফ্রেডরিকের। বাইরে তালা দেওয়া। গুলি করতেই ভেঙে গেল সেটা। তারপর খুব সাবধানে
সিন্দুকের ঢাকনাটা তুলল ফ্রেডরিক। ভেতরে ছ’টা বিশেষ ধরনের ফাইবার গ্লাসের বাক্সে তরল পারদ ভরা রয়েছে। পিটারও গিয়ে
দাঁড়াল ফ্রেডরিকের পাশে। পারদের বাক্সের পাশে আরও দুটো ছোটো ছোটো বাক্স রাখা।
“এগুলোর ভেতর কী
আছে? দেখে তো বাক্সগুলো ধাতব বলেই মনে হচ্ছে।” হাত দিয়ে তুলতে গিয়েই ফ্রেডরিক বুঝল,
তার অনুমান ভুল নয়। বাক্সদুটো নিশ্চয়ই সীসার তৈরি, নইলে এতটা ভারী হতে পারে না। কিন্তু সীসার বাক্স কেন? তবে কি তেজস্ক্রিয় পদার্থ? ইউরেনিয়াম! কথাটা ফ্রেডরিকের মাথায় যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল।
“সর্বনাশ!”
“কী হয়েছে,
ফ্রেডরিক?
ব্যাপার কী?” উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল পিটার।
“এই যে দুটো
বাক্স দেখছ, এগুলো সীসার। মানে নিশ্চয়ই ভেতরে ইউরেনিয়াম
জাতীয় কোনও তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে। এই ড্রাগনোস গ্যাং আসলে এই মতলবেই মাউন্ট
লি-তে হানা দিচ্ছিল। এই জিনিস সন্ত্রাসবাদীদের কাছে গেলে সারা বিশ্বে বিপদ ঘনিয়ে
আসবে।”
“বাপ রে! আমরা
এখান অবধি না পৌঁছলে তো বিরাট বিপদ ঘটতে চলেছিল!”
একটু থেমে পিটার
আবার বলল,
“এবার তোমার হঠাৎ করে হোটেল ছেড়ে খেতে বেরোবার কারণটা বুঝতে
পারলাম। তুমি ওই লোকটাকে ইচ্ছে করেই পালাবার সুযোগ দিতে চাইছিলে। আর
ট্রান্সমিটারটা তো বোধহয় ওর গায়ে আগেই জুড়ে দিয়েছিলে তুমি, মানে যখন লোকটা অজ্ঞান ছিল।”
“হ্যাঁ, এছাড়া এদের এই গোপন ডেরায় পৌঁছোবার আর কোনও রাস্তা ছিল না। আমি জানতাম ওর কখন
জ্ঞান ফিরবে। গায়ের বাঁধন আগেই কিছুটা আলগা করে রেখেছিলাম। আর বাকিটা তো নিজের
চোখেই দেখলে।”
“হুম। কিন্তু এই
ড্রাগনোস গ্যাংয়ের আসল লিডারের খোঁজ তো পাওয়া গেল না এখনও।” পিটার বলল।
“পাওয়া যাবে ভায়া, এখান অবধি যখন পৌঁছে গেছি তখন এদের নাড়িনক্ষত্র সব জেনেই ফিরব।”
বাঁদিকের বড়ো
স্ক্রিন আর তার সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার সিস্টেমটার দিকে ইশারা করে ফ্রেডরিক বলল, “একটু সময় লাগবে, কিন্তু এই কম্পিউটার থেকেই এই দলের আসল মাথার
খোঁজ পাওয়া যাবে।”
ফ্রেডরিক এগিয়ে
গিয়ে কম্পিউটারটা অন করল। “আমার ধারণা, এর মাধ্যমেই সেই লিডারের সঙ্গে এদের
যোগাযোগ হত। এখন বাকিটা শুধু
হ্যাকিংয়ের খেলা। ঠিকমতো করতে পারলেই সেই ব্যক্তির আই. পি অ্যাড্রেস পেয়ে যাব।”
“কাজটা কিন্তু অত
সোজা নয়। তুমি তো ভালো করেই জানো যে এসব টেররিস্ট গ্রুপগুলো ডার্ক-ওয়েব মারফত
নিজেদের কাজ চালায়।”
“জানি পিটার। তবুও
চেষ্টা তো করতেই হবে। আর হ্যাকিংয়ের কাজে আমিও একেবারে কাঁচা নই।”
ফ্রেডরিখ সেই
কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে কিবোর্ডে হাত চালাতে শুরু করল। স্ক্রিনের ওপর একের
পর এক টার্মিনাল খুলে যাচ্ছে। অদ্ভুত সব সংখ্যা আর লেখা ভেসে উঠছে সেসব
টার্মিনালে। সময় তরতর করে এগোতে লাগল। পাশের চেয়ারে বসে পিটারও একদৃষ্টে স্ক্রিনের
দিকেই তাকিয়ে আছে। ফ্রেডরিকের কপাল আর হাতের ওপরটা ঘেমে উঠতে লাগল।
প্রায় একঘণ্টা
পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ ফ্রেডরিকের গলাটা যেন ভয়ে বিস্ময়ে কেঁপে উঠল। “ওহ্ মাই গড!
ইম্পসিবল!”
“কী হল, ফ্রেডরিক?” তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল পিটার। তারপর
আপনা-আপনি তার চোখ দুটো গিয়ে পড়ল স্ক্রিনের ওপর। ভূত দেখার মতো তার চোখও যেন আটকে
গেল স্ক্রিনের ওপর ফুটে ওঠা একটা নামে। রবার্টসন! জেমস এফ. রবার্টসন।
।। ৭ ।।
কালো মার্সিডিজটা
তিরবেগে ছুটে চলেছে ডালাস এয়ারপোর্ট থেকে পেন্টাগনের দিকে। পেছনের সিটে বসে আছে
ফ্রেডরিক আর পিটার। দু’জনেরই চোখমুখ থমথমে। গাড়িতে বেশ পুরোনো দিনের একটা অপেরা
মিউজিকের সিডি বাজছিল। ফ্রেডরিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
“মিউজিকটা প্লিজ
বন্ধ করে দিন। ভালো লাগছে না।” জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই কথাগুলো বলল ফ্রেডরিক।
ড্রাইভার একবার
আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে মিউজিকটা অফ করে দিল।
“ফ্রেডরিক, এখনও সময় আছে, আরেকবার ভেবে নাও।” পাশ থেকে মৃদু গলায় পিটার
বলল।
“না পিটার, আমি যথেষ্ট ভেবেছি। এছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। ডিফেন্স সেক্রেটারির কাছে গেলেও
শুধুমাত্র একটা আই. পি অ্যাড্রেসের ভিত্তিতে রবার্টসনকে আমরা দোষী প্রমাণ করতে পারব
না। ডিফেন্সে রবার্টসনের মতো পুরোনো অফিসারের যথেষ্ট চেনাশোনা আর ক্ষমতা রয়েছে।
খবরটা কোনও না কোনওভাবে তার কানে পৌঁছেই যাবে। আর তখন সে হয় আমাদের সরিয়ে দেবে,
নয়তো নিজে ড্রাগনোস দলের কোনও গোপন ডেরায় গিয়ে গা ঢাকা দেবে। মানে এককথায় আমরা ওর
কিছুই করতে পারব না। তাই একটাই রাস্তা হল ওর নিজের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি।”
“ও কি এত সহজে
বলবে?” পিটার জিজ্ঞেস করল।
“জানি না, তবে চেষ্টা করতে দোষ কী? প্ল্যানটা মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। ওর রুমে
ঢুকেই আমি আগে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেব আর তুমি রবার্টসনের দিকে পিস্তল তাক
করে দাঁড়াবে।”
পাশের জানালার
কাচে আঙুল ঘষতে ঘষতে ফ্রেডরিক বলল, “হুম। আশা করি
মাথায় বন্দুক ঠেকালে প্রাণভয়ে সব স্বীকার করে নেবে।”
কপাল কুঁচকে তাকাল
পিটার। “কিন্তু যদি না করে?”
“তাহলে শেষ করে
দেব।” একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল ফ্রেডরিক। “শুধুমাত্র পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই বলে সবকিছু জেনেও এমন একটা ছদ্মবেশী
সন্ত্রাসবাদীকে আমি পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে দেব না। আইনত না হলে বেআইনিভাবেই
কাজটা করতে হবে।”
“কিন্তু...”
কথাটা শেষ করতে
পারল না পিটার। ফ্রেডরিখ বলল, “জানি, পিটার। সেরকম
পরিস্থিতিতে পুলিশ আমাকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করবে এবং আদালতের বিচারে আমার
মৃত্যুদণ্ড হওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।”
একটু থেমে
ফ্রেডরিক আবার বলল, “তাতেও আপত্তি নেই। এমনিতেও তো আমরা দেশের
জন্য প্রাণ দেবার শপথ নিয়েই কাজে নামি। ধরে নেব, আমার জীবনে সেই শপথ সত্যি হল।”
পিটার আর কিছু
বলল না। চোখদুটো পাশের জানালা দিয়ে বাইরে এলিয়ে দিল।
বাড়িঘর, গাছপালা সব পেছনে ফেলে ছুটে চলছে গাড়িটা। আর মাত্র মিনিট দশেকের পথ, তারপরেই পেন্টাগনের পার্কিং এরিয়ায় ঢুকে পড়বে তারা।
কিছুক্ষণের
মধ্যেই পেন্টাগনের ফিফথ গেটের কাছাকাছি এসে থামল মার্সিডিজটা। গাড়ি থেকে নামার আগে
ফ্রেডরিক একবার নিজের পিস্তলের গুলিভরা ম্যাগাজিনটা দেখে নিল। ফুললি লোডেড।
“চলো। এগোনো যাক
এই মিশনের শেষ পর্বের দিকে।”
ফিফথ গেট দিয়ে
ঢুকে ফ্রেডরিক আর পিটার দু’জনেই এগোতে লাগল পেন্টাগনের কোর এরিয়ার দিকে। যেখানে
রয়েছে সি. আই. এ হেড অফিস। তারপর ডানদিকের প্রথম করিডোরটার শেষ রুম। সি. আই. এ চিফ
জেমস এফ. রবার্টসনের রুম।
“পিটার, তুমি তৈরি তো?” দরজার কাছাকাছি পৌঁছে
খুব মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল ফ্রেডরিক।
“হুম।”
তারপর সোজা
রবার্টসনের রুমে ঢুকে পড়ল সে। পিটারও ঢুকল এবং দরজাটা লক করে দিল ভেতর থেকে।
“ফ্রেডরিক! তুমি
কখন ফিরলে সিয়ান থেকে?” বেশ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন রবার্টসন। “আর
পিটার, দরজাটা বন্ধ করলে কেন?”
ফ্রেডরিখ কোনও
জবাব না দিয়েই সোজা পিস্তলটা রবার্টসনের দিকে তাক করে ধরল। “স্যার, আপনিই যে সেই টেরাকোটা আর্মির পেছনে লুকিয়ে থাকা আসল মাথা তা আমরা জেনে গেছি। ড্রাগনোস
গ্যাংয়ের লিডারও আপনিই।”
“কী আবোলতাবোল
বকছ, ফ্রেডরিক? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পিটার, একে বোঝাও।”
“চালাকি করার চেষ্টা
একদম করবেন না। আপনার আই. পি অ্যাড্রেস থেকেই সব নির্দেশ দেওয়া হত সেই ড্রাগনোস
দলের লোকেদের। সেই প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। তাই ভালোয় ভালোয় সব স্বীকার করে নিন,
নইলে গুলি চালাতে হাত কাঁপবে না আমার।”
“তাই নাকি? এত সোজা?” কথাটা শেষ করতে না করতেই
কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নিলেন রবার্টসন। কিন্তু ফ্রেডরিকের দিকে তুলে ধরার
আগেই চোখের পলকে একটা গুলি এসে লাগল তার বুকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন
রবার্টসন।
“ডোন্ট মুভ। ইউ
আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”
চমকে পাশ ফিরল
ফ্রেডরিক। পিটারের গুলির নিশানায়
দাঁড়িয়ে আছে সে।
“এ কী করছ, পিটার?” ঘটনার আকস্মিকতায় যেন গলাটা কেঁপে গেল ফ্রেডরিকের।
“অফিসার
রবার্টসনকে খুনের দায়ে তোমাকে গ্রেপ্তার করছি।” তারপর ঠোঁটের কোণে একটা ক্রুর হাসি
খেলিয়ে পিটার বলল, “না গ্রেপ্তার নয়, বরং গুলিই করব ভাবছি। অনেকগুলো লোক মেরেছ আমার। এবার তুমি মরবে। সি. সি. টিভি
ফুটেজ থেকে আমি প্রমাণ করে দেব যে তুমি অফিসার রবার্টসনকে মেরেছ আর তারপর তোমাকে
গ্রেপ্তার করতে গেলে তুমি আমাকেও মারার চেষ্টা করো। আর তখন আমি তোমাকে গুলি করি।”
“কী বলছ এসব? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” ফ্রেডরিক চিৎকার করে উঠল।
“হাহ্! এখনও
আমার খেলাটাই বুঝতে পারলে না, ফ্রেডরিক! রবার্টসন নির্দোষ ছিল। ড্রাগনোস গ্যাংয়ের
আসল চিফ তো আমি। আর আমার জালে তুমি খুব সুন্দরভাবে ফেঁসে গেছ।” পিটারের কুটিল
চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করতে লাগল। “এবার মরবার জন্যে তৈরি হও।”
ট্রিগারের ওপর
আঙুলটা ঠেকাল পিটার। সামনে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেডরিক। তারপর একটা গুলির শব্দে পুরো ঘর কেঁপে উঠল।
কিন্তু গুলিটা ফ্রেডরিকের বুকে লাগেনি। লেগেছে পিটারের হাতে। পিস্তলটাও ছিটকে পড়ে গেছে। এবার পিটারের অবাক
হবার পালা। পিস্তল হাতে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রবার্টসন!
যে ক্রুর হাসিটা
এতক্ষণ পিটারের ঠোঁটে লেগে ছিল, এবার তা ফ্রেডরিকের মুখে ঝলসে উঠল।
“কী হল, পিটার? বুঝতে পারছ না তো? প্ল্যানটা খুব নিখুঁত ছিল তোমার। প্রায় শেষমুহূর্ত
অবধি নাটকটাও দারুণভাবেই চালিয়ে গেছিলে। কিন্তু ভাগ্য বেশিদিন খারাপ লোকের সঙ্গ
দেয় না।” তারপর একবার রবার্টসনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ফ্রেডরিক আবার বলল, “সেদিন সেই গোপন ডেরায় যখন কম্পিউটার হ্যাক করে অফিসার রবার্টসনের আই. পি অ্যাড্রেস
পেলাম, আমার যেন মাথায় বাজ পড়ল। কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলাম না। আমি অফিসার
রবার্টসনকে অনেকদিন ধরে চিনি পিটার, একসঙ্গে অনেক
কাজও করেছি। এই লোকটা যে দেশের জন্য কতটা নিবেদিতপ্রাণ তা আমার চাইতে ভালো কেউ
জানে না। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে ওঠা প্রমাণ বলছে রবার্টসনই ড্রাগনোস গ্যাংয়ের
নেতা। একদিকে আমার চেনা অফিসার রবার্টসন, আরেকদিকে এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। একদিকে মন
বলছে রবার্টসন কখনোই দেশদ্রোহী হতে পারেন না, কিন্তু প্রমাণ অন্য কথা বলছে। সেদিন
রাতে হোটেলে গিয়ে আর ঘুমোতে পারিনি, এই একই চিন্তা
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে নিজের মনের কথা বিশ্বাস করব,
না চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রমাণের ওপর ভরসা রেখে রবার্টসনের বিরুদ্ধে
অ্যাকশন নেব। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, একবার ঝুঁকি নিয়ে
মনের কথা শুনেই দেখি। ব্যস, সব জানিয়ে দিলাম অফিসার রবার্টসনকে। তারপর বাকি
কাজ রবার্টসন করলেন।” শেষ কথাগুলো বলতে বলতে রবার্টসনের দিকে ফিরে তাকাল ফ্রেডরিক।
পিটারের দিকে
তাকিয়ে রবার্টসন বললেন, “ফ্রেডরিকের কাছে সবকিছু জানার পরই বুঝে
গেছিলাম কেউ এক তিরে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে। এর পেছনে যে ড্রাগনোস গ্যাংয়ের
সেই চিফই রয়েছে তাও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেটা যে তুমি হতে পার তা
স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। ড্রাগনোস দলের যে লিডারকে আমরা এতদিন দেশে দেশে খুঁজে
বেরিয়েছি সে কিনা আমাদের সি. আই. এ-রই একজন এজেন্ট!
“সি. আই. এ-র একজন
প্রোফেশনাল হ্যাকারকে কাজে লাগিয়ে দিলাম আমি। পিটার, তুমি দারুণ হ্যাকার হতে পার, কিন্তু তোমার চেয়েও অনেক বড়ো বড়ো ওস্তাদ
হ্যাকাররা সি. আই. এ-র জন্য কাজ করে। সেই হ্যাকারই জানাল যে কেউ আমার কম্পিউটার
হ্যাক করেছে। ফলে সেই ব্যক্তি নিজের আই. পি অ্যাড্রেস থেকে যা কিছু করছে সেটা আমার
আই. পি অ্যাড্রেসে রেজিস্টার্ড হয়ে যাচ্ছে। আর সেই ব্যক্তির ঠিকানা খুঁজতেও
বেশিক্ষণ লাগল না আমাদের হ্যাকার বন্ধুর। সেটা ছিল তোমার বাড়ির ঠিকানা, পিটার।
সেখান থেকে আরও অনেক গোপন তথ্য পেয়ে গেলাম ড্রাগনোস গ্যাংয়ের ব্যাপারে। আর সঙ্গে
সঙ্গে আমি সবকিছু জানিয়ে দিলাম ফ্রেডরিককে। তারপর বাকিটা অবশ্য ফ্রেডরিকের প্ল্যান
ছিল। তুমি অনেকদিন ধরে আমাদের সামনে একটা নাটক করছিলে, তাই ভাবলাম নাটকের ক্লাইম্যাক্সটা তোমাকে আমরাই দেখাব। আর সেই প্ল্যান মোতাবেকই আমি আজ বুলেট প্রুফ
জ্যাকেট পরে তৈরি ছিলাম।”
“আচ্ছা, একটা কথা বলো তো পিটার, তুমি তো হোটেল রুমে আমাকে যে কোনও সময় খুন করে
অনেক আগেই সরে পড়তে পারতে। তাহলে এত সব করার কী প্রয়োজন ছিল?” ফ্রেডরিক জিজ্ঞেস করল।
পিটার এতক্ষণ
বোকার মতো দাঁড়িয়ে রবার্টসনের কথাগুলো শুনছিল। ফ্রেডরিকের প্রশ্নে একটা ম্লান হাসি
হেসে বলল,
“হ্যাঁ, সেখানেই ভুল করে ফেলেছি।
তোমাকে আমি নই, মিয়াংজুই অনেক আগে শেষ করে দিত। কিন্তু যখন
তুমি ফোন করে বললে যে মিয়াংজু আসল শিন জিয়ান নয় সেটা তুমি বুঝে গেছ, তখন ভাবলাম
খেলাটা তাহলে আরেকটু চলুক। আর তারপরই ওই এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতলবটা মাথায় এল।
রবার্টসনের কারণে আমার ড্রাগনোস গ্রুপের অনেকবার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই তোমার হাতে
রবার্টসনকে খুন করিয়ে আর তারপর সেই দায়ে তোমাকে জেলে পাঠাবার ছকটা কষে ফেললাম।
জানতাম, তুমি যেভাবেই হোক মিয়াংজুর মাধ্যমে আমাদের গোপন ডেরায় পৌঁছে যাবে, আর তাই রবার্টসনের আই. পি অ্যাড্রেস আগে থেকেই হ্যাক করে আমার সব কাজকর্মের
রেকর্ড ওই অ্যাড্রেসে চালান করে দিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সব গোলমাল হয়ে গেল।”
শেষের কথাগুলো আক্ষেপের ভঙ্গিতেই বলল পিটার।
“ঠিকই বলেছ,
পিটার। মগজের খেলায় তোমার কাছে হেরেই গেছিলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে
মনের কথা শুনে জিতে গেলাম।” ফ্রেডরিকের গলায় বিদ্রূপের হাসি বেজে উঠল। “তুমিও এবার
মনে মনে তৈরি হয়ে নাও। দেশদ্রোহিতা আর সন্ত্রাসবাদের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা
করছে তোমার জন্যে।”
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
besh bhalo ekta spy galpo porlam,bhalo laglo
ReplyDelete