চরকি
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
চন্দ্রায়ণ দাস-এর নাম তোমরা শুনেছ কি? না শুনলে আমার কাছ থেকে শুনে নাও৷
অমন উপকারী ছেলে আর দুটো হয় না৷ গ্রামের দিকে থাকে বলে তোমরা শহুরে ছেলেমেয়েরা ওর
নাম হয়তো শোননি৷ খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল ওর নাম৷ কিন্তু তোমরা তো কাগজ পড় না, তাই জানতে পারনি৷
ভাবছ তো, বাবা কী এমন করেছে এই চন্দ্রায়ণ যে নিউজ পেপারে নাম বেরিয়েছে? সেটাই
বলছি, শোন৷
সুন্দরবনের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে চন্দ্রায়ণদের বাড়ি৷ গ্রামের নামধাম জেনে
কাজ নেই কারণ তোমরা তো আর যাচ্ছ না সেখানে৷ ওর বাবার মুদিখানা আর গম ভাঙানোর দোকান
আছে৷ চন্দ্রায়ণ ক্লাস সিক্সে পড়ে৷ ওর দাদা ক্লাস টেনে পড়ে আর দিদি ক্লাস নাইনে পড়ে৷
তারা দু’জন ঠিকঠাক হলেও চন্দ্রায়ণকে নিয়ে
ওর বাড়ির লোকের মাথাব্যথার শেষ নেই৷ কেন? বলছি এবার৷
চন্দ্রায়ণের নাম বদলে হয়ে গেছে চরকি৷ এর কারণ হল, সারাক্ষণই চরকির মতো পাক খায়
চন্দ্রায়ণ৷ এক মুহূর্তও স্থির থাকে না৷ এই এখানে
তো পরক্ষণেই নেই৷ ওর মা তো পাগল হয়ে যায় ওর এই উৎপাতে৷ ডেকে ডেকে গলা মরুভূমি৷
- চরকিইই... চরকিইইই... ভাত বেড়েছি, খাবি আয়...
যতটা জোরে ডাকা যায় ততটা জোরে ডাক দিলেন ওর মা৷ কিন্তু কোথায় চরকি, আশপাশে থাকলে
তো আসবে! সে তখন সাবুপিসিমার জলের বালতি বয়ে দিচ্ছে৷ সাবুপিসি গ্রামের সব্বার পিসি৷
বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছে সাবুপিসি বলল, “ও বাবা
চরকি, ভাত খেয়েছিস? না যদি খেয়ে থাকিস তো আমার সঙ্গে বসে দু’গাল পান্তা খেয়ে যা৷ বড়ো উপকার
করলি বাবা৷ তুই বড়ো ভালো ছেলে, চাঁদ ছেলে।”
চরকির মনে পড়ে যায় বাড়ি ফেরার কথা৷ এই রে, মা নিশ্চয়ই খোঁজখবর শুরু করে দিয়েছে!
ভাত খেতে ডাক দিচ্ছে৷
“আজ না সাবুপিসি, পরে একদিন খাব’খন,” এই বলে সাইকেলে চেপে পোঁ পাঁ ছুট৷ ফেরার পথে বাড়ির একটু আগেই রায়মঙ্গল নদীর
যে খাঁড়িটা আছে, সেখানে দুটো ডুব মেরে স্নান সেরে নেয়
চন্দ্রায়ণ৷ এমন হাজারটা গ্রামের লোকের উপকারে লাগা কাজ সারাদিন করে বেড়ায় ও, কিন্তু বাড়ির লোক আর স্কুলের মাস্টারমশাইরা, এই দুই
পক্ষ কেবলি ওকে বকাবকি করে৷ ও নাকি লেখাপড়াটাই
ঠিকঠাক করে না৷
আজ শিক্ষক দিবস৷ সব স্কুলেই ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের মনোরঞ্জনের জন্য নানান
রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে৷ গান, আবৃত্তি, নাটক, নাচ - এই সব আর কি৷ চরকি এসবের কোনোটাতেই নেই৷ আবার আছেও৷ সে আবার কেমন করে এটাই ভাবছ তো?
এই যে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে ছেলেমেয়েরা, তার জন্যে অস্থায়ী মঞ্চ বানানো, পেছনে ফেস্টুন টাঙানো, ফুল দিয়ে সাজানো - এই সবই বলতে গেলে একাই করেছে
চরকি৷ বিল্টু ওকে হেল্প করলেও, মূল দায়িত্ব চরকিরই৷
স্কুলের প্রাক্তন হেডস্যার সুনীতি প্রধান-এর অনেক
বয়স৷ বহুদিন হল অবসর নিয়েছেন৷ কিন্তু তিনি এখনও নিজেকে স্কুলের অংশ বলেই মনে করেন৷
তাই স্কুলের যে কোনও অনুষ্ঠানে আসতে চান৷ শরীর বিশেষ ভালো থাকে না বলে একা আসতেও পারেন না৷ এখানেও চরকি৷ ঠিক সুবলের রিক্সা নিয়ে পৌঁছে যায়
সুনীতি স্যারের বাড়ি৷ যত্ন করে নিয়ে আসে স্কুলে৷ অনুষ্ঠান শেষে আবার বাড়ি পৌঁছে
দিয়ে আসে৷
সুবল একটু গাঁইগুঁই করে বটে ভাড়া পায় না বলে৷ চরকির হাতে তো আর পয়সা থাকে না! অন্য স্যারেদের কাছে চাইতে গেলে বলবেন, “ওনাকে আবার কেন টানাটানি করছিস৷ বয়স হয়েছে, শরীর-টরীর খারাপ করলে মুশকিল হবে।”
কেউই আর দায়িত্ব নিতে চান না৷
এদিকে সুবল বলে, “বুঝলি চরকি, রিক্সা চললে তবেই আমার পেট চলে৷ আমার পরিবার খেতে পায়৷ এমন মাগনায় কাজ
করলে আমার চলবে কেন?”
“আরে সুবলদা, এ তো বছরে একবার গো, রোজ তো আর করছ
না৷ কত্ত আশীর্বাদ পাচ্ছ এই ভালো কাজের জন্য তা তুমি নিজেও জানো না।”
“আশীর্বাদে কি আর পেট ভরে রে! সে যাক
গে৷ ছাড়... ,” এক দীর্ঘশ্বাস
ফেলে সুবল৷
খারাপ লাগে চরকির৷ পরের দিন স্কুলে না গিয়ে সাঁপুইদের পুকুরে ছিপ ফেলে বেশ
কয়েকটা তেলাপিয়া, পুঁটি ধরে ও৷ তারপর পুরোনো খবরের কাগজে মুড়ে সোজা চলে যায় সুবলের বাড়ি৷ ওর বৌয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে
বলে, “জমিয়ে রান্না করে খাও সবাই মিলে।”
এক গাল হেসে সুবলের বউ বলে, “তোর মঙ্গল হোক চরকি।” রাতে ফিরে সব শুনে সুবল বোঝে, চরকি আগের দিনের ভাড়া দিয়ে গেছে৷
গ্রামে চন্দ্রায়ণ নামটা ভুলেই গেছে সবাই৷ চরকি নামেই ডাকে এখন৷ চন্দ্রায়ণের
বাবা বলে, “কত চিন্তা করে সুন্দর একটা নাম রাখলাম, আর ছেলে কিনা এমন চরকিবাজ তৈরি হল, যে লোকে ভালো নামটাই ভুলে গেল৷ কী কপাল!”
চরকির তাতে কিছু যায় আসে না৷ আমের
আঁটি চুষতে চুষতে বলে, “একটা কিছু বলে ডাকলেই হল৷ নাম
দিয়ে কী হবে!”
আম খেতে খুব ভালোবাসে চরকি৷ আসলে ফল খেতেই ভালোবাসে৷ আম, কালোজাম, পেয়ারা, সবেদা, কলা৷ শশাটাই কেবল পছন্দ নয় অত৷ জলের মতো স্বাদ লাগে ওর৷
সেদিন মতিকাকাদের আমবাগানের পাশ দিয়ে স্কুলে যাবার পথে চরকি দেখে, মতিকাকা, কাকি, সোনাপিসি একটা আমে ভরা গাছের
দিকে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কৌতূহল হয় চরকির৷
“কী দেখছ গো মতিকাকা?”
“আরে চরকি যে! আয় বাবা আয়৷ এবারে তো আমের ফলন তেমন ভালো নয়, এদিকে আমাদের বংশের
নিয়ম হচ্ছে, গাছে আম ধরলে বোঁটাশুদ্ধু একটা আম কুলগুরুর পায়ে নিবেদন করে তবে বাড়ির
লোকেরা আম খেতে পারবে৷ তা, নীচের দিকের ডালে তো একটাও আম দেখছি না যেটা কিনা আমাদের নাগালে আছে৷ সবই উঁচুতে৷ একখানা ডাঁটিশুদ্ধু
আম পেড়ে দে না চরকি৷ কাঁচা আমের টকঝোল খেতে পারব তাহলে।”
“ও, এই ব্যাপার! আচ্ছা দাঁড়াও৷ আমি পেড়ে দিচ্ছি।”
স্কুলব্যাগ বাগানে নামিয়ে এ ডালে ও ডালে পা দিয়ে খানিক ওপরে উঠে যায় চরকি৷ দু-চারটে বোঁটাশুদ্ধু আম ফেলে ওপর থেকে৷ সোনাপিসি আঁচল বিছিয়ে ধরে নেয় আমগুলো৷
গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সবাই খুব প্রশংসা করে চরকির৷ কাকি বলে, “সময়মতো তুই না এলে আজ আর আম পাড়া হত না৷
তুই একটা আম নে চরকি৷ আম পাকলে আরও দেব।”
প্যান্টে আমটা দু’বার ঘষে সাফ করে কামড় দিতে দিতে
স্কুলের পথে এগোয় চরকি৷ টক স্বাদ ওর বেশ লাগে৷ স্কুলে ঢোকার আগেই রাস্তার মাঝখানে যে
সরু একফালি সিমেন্ট বাঁধানো জমি আছে, যেটা রাস্তাটাকে দু’ভাগ করেছে, সেখানে আঁটিটা ছুঁড়ে ফেলে স্কুলে ঢুকে পড়ে চরকি৷
এইভাবেই দিন কাটছে চরকির৷ বাড়িতে যতটুকু সময় থাকে, বকাঝকার ওপরেই থাকে
বেচারা৷ তবে সুখের কথা একটাই, বাড়িতে ও বেশিক্ষণ থাকেই না৷ গ্রামের কত মানুষের তো
ওকে দরকার, তাই না? তাদের কাজ করে দেয় চরকি৷
প্রকৃতির এবার ঋতু বদলের পালা৷ বেশিরভাগ দিনই আকাশে মেঘ জমছে, বৃষ্টি হচ্ছে৷ গরমকাল গিয়ে বর্ষা আসছে৷ মতিকাকিমা এর মধ্যে একদিন ডেকে
চরকির হাতে পাঁচ-ছ’টা পাকা আম দিয়ে বলেছে, “এ বছর কম
আম ফলেছে তাই বেশি দিতে পারলাম না৷ আগের বছর ভালো ফলন হলে বেশি করে দেব।”
চরকি বাড়িতে পাঁচটা আম দিয়ে একটা খেতে খেতে স্কুলে চলে যায়৷ আঁটিটা ছুঁড়ে
সে এক ফালি জমিতেই ফেলে৷
বেশ কিছুদিন পর চরকি ওই রাস্তা দিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছিল৷ হঠাৎই ওর নজর যায়
এক ফালি জমিটার দিকে৷ ‘আরে, ছোটো ছোটো চারাগাছ বেরিয়েছে মনে হচ্ছে! এগুলো তো আগে দেখিনি!’
দৌড়ে কাছে যায় চরকি৷ দেখে দুটো চারাগাছ বেরিয়েছে৷ কী গাছ
এ দুটো? চরকি চিন্তা করতে থাকে৷ ইতিমধ্যে
গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে ওঠে৷ চরকির বুদ্ধিটাও সজাগ হয়ে ওকে জানায়, ‘তোমার ফেলে দেওয়া আমের আঁটি থেকে চারাগাছ বেরিয়েছে গো!’
চরকির এত আনন্দ হয় যে একপাক ঘুরে নেচে নেয় ও৷ রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল
তারা হয়তো ভাবে, পাগল হয়ে গেছে ছেলেটা৷
সারাক্ষণ ওই চারা দুটোর কথাই মাথায় ঘুরতে থাকে চরকির৷ ওর খালি মনে হয়, গাছ
দুটো বড়ো হবে তো? তাতে আম হবে তো? কার কাছ থেকে জানবে?
বাবার কথাই মাথায় আসে৷ রাত্রে দোকান বন্ধ করে ওর বাবা ফিরলে চরকি জিজ্ঞেস করে, “বাবা, আঁটি থেকে যদি ফলের গাছ হয় তাহলে সেই
গাছ বড়ো হয়ে ফল দেয়?” ওর বাবা হেসে বলেন, “কেন দেবে না? অবশ্যই
ফল দেয়৷ তবে গাছের যত্ন করতে হবে৷ জল যাতে ঠিকমতো পায় সেটা দেখতে হবে।”
শুনে খুশি হয় চরকি৷ এখন তো বর্ষাকাল৷ বৃষ্টির জল তো পাবেই৷ আর স্কুলে যাবার
সময় চরকি দেখে নেবে সব ঠিক আছে কিনা৷ ছুটির দিনে না হয় একবার গাছ দেখতেই যাবে৷ কী মজা! যখন গাছ দুটো বড়ো হবে, আম হবে৷ সব বন্ধুরা মিলে আম খাব৷ সেই আঁটিগুলো আবার
পুঁতে দেব... গাছ হবে৷ বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো মাথায়
একটা ভাবনা খেলে যায় চরকির!
পরের দিন বেশ সকালে সাইকেল নিয়ে চরকিকে বেরোতে দেখে ওর দিদি বলে, “অ্যাই
বজ্জাত, সক্কাল সক্কাল আড্ডা মারতে বেরোচ্ছিস? দাঁড়া, দাদাকে বলছি।”
দিদির কথা গ্রাহ্য না করে বেরিয়ে পড়ে চরকি৷ চেনা জানা বাড়ি বাড়ি ঢুঁ মারে৷
কী বলে আসে তা জানা যায় না৷ বন্ধুদেরও কিছু একটা বোঝায়, তারাও উৎসাহিত
হয়৷ দু-একজন অবশ্য হাসাহাসি করে চরকির কথায়৷
এরপর দেখা যায় বাড়ি বাড়ি থেকে চরকি স্কুল যাবার আগে কাগজের ঠোঙায়, কখনও বা থলেতে করে কী সব নিচ্ছে৷ গ্রামের মানুষদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা খুব বেশি৷ কোথাও কিছু হলেই সবাই জানতে পারে৷ শহরের মানুষদের মতো
নয় মোটেও৷ পাশের বাড়ির লোকের প্রয়োজনেও কেউ গিয়ে দাঁড়ায় না৷
চরকির
বাড়িতেও এসে পৌঁছল সেই খবর৷ চরকির মা বললেন, “হ্যাঁরে চরকি, তুই নাকি জমাদারের কাজ করছিস এখন৷ বাড়ি বাড়ি গিয়ে জঞ্জাল নিচ্ছিস৷
তা ভালো, খাইয়ে দাইয়ে মেথর গড়ছি।”
খুব কষ্ট পায় চরকি৷ মা’কে
জিগ্যেস করে, “জমাদার, মেথররা কি মানুষ নয় মা? ওরা
তো কত ভালো কাজ করে, সব জায়গা পরিষ্কার করে রাখে৷ তুমি এমন বলছ কেন?”
লজ্জা পেয়ে যান চরকির মা৷ বলেন, “তা ঠিক, কিন্তু আমাদের সমাজে তো কাজ ভাগ করা আছে৷ যার যেটা কাজ, সে সেটাই করে৷ তোর কাজ লেখাপড়া করে বাবার পাশে দাঁড়ানো৷ তাই বললাম।”
চরকি আসলে কী করেছে শোনো৷
বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে, “তোমরা যেটুকু
ফল খাবে তার আঁটি বা বীজগুলো জমিয়ে রেখো, আমি এসে নিয়ে
যাব৷ দরকার আছে।” চরকিকে
সবাই ভালোবাসে, তাই সকলেই চরকির আবদার রেখেছে৷
সেই সব আঁটি, বীজ নিয়ে নিয়ে চরকি রাস্তার ধারে ধারে ফেলেছে৷ অনেক খালি জমি
পড়ে আছে বড়ো রাস্তার দু’পাশে৷
এদিকে হয়েছে কী, সেই এক ফালি জমিতে যে চারা গাছ
দুটো বেড়ে উঠছিল, একদিন স্কুল যাবার পথে চরকি দেখে, তার একটাকে ছাগলে চিবোচ্ছে৷
অ্যাই অ্যাই করে তেড়ে যায় চরকি৷ হঠাৎ রাস্তার কোনাকুনি চালাঘরটা থেকে বয়স্ক এক
মহিলা বেরিয়ে এসে বেজায় ধমক দেয় চরকিকে৷
“অ্যাই কে রা আমার গোপালকে তাড়ায়? দ্যাকাচ্ছি দাঁড়া!”
চরকি বোঝে সমূহ বিপদ! দৌড়ে স্কুলে ঢুকে যায় ও৷ কিন্তু চিন্তা ছড়িয়ে যায় মস্তিষ্কের
অলিতে গলিতে৷ একটা দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সবে৷ সেই স্বপ্ন যদি গরু ছাগলে খেয়ে
নেয় তাহলে খুব কষ্ট হবে ওর৷ একটা কিছু উপায় বের করতেই হবে৷
রোলকল করছেন মাস্টারমশাই৷ রবিরাম, দিবাকর, সেলিম... আরে! এই তো পেয়ে গেছি উপায়! এটাকেই কাজে লাগাব৷ চরকি ভেবে নেয়৷
ছড়ানো বীজগুলোর দিকে লক্ষ রাখে চরকি৷ স্কুল থাকলে স্কুল যাবার পথে আর ছুটির
দিনে সাইকেল নিয়ে এক চক্কর মেরে ঠিক দেখে আসে কতটা কী হল৷ ইতিমধ্যে বেশ কিছু কচি
সবুজ মাথা দেখা দিয়েছে মাটি ফুঁড়ে৷ ওহ, চরকির বুক ভরে যায় আনন্দে৷ ‘যা ভেবেছি তা যদি হয়, তাহলে গ্রামের কোনও
মানুষকে আর খালি পেটে অন্তত থাকতে হবে না৷ অনেক গরিব মানুষ
আছে গ্রামে৷ কিন্তু এবারে আসল কাজে নামতে হবে।’
চরকি ওর বন্ধু তাপস আর বলাইকে বলে, “আমাকে
একটু সাহায্য করবি একটা কাজে?”
বলাই বলে, “বল না, কী কাজ?”
“বেশ কিছু কঞ্চি জোগাড় করতে হবে৷ মানে বেশ অনেকগুলো।”
“কেন রে?” তাপস জিজ্ঞেস করে৷
“বেড়া দেব।”
“কোথায় রে?”
“সে দেখাব তোদের৷ কিন্তু তোরা জোগাড় করতে আমাকে সাহায্য করবি কিনা বল।”
দুই বন্ধুই বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ।”
কঞ্চি, দড়ি সব জোগাড় করতে সাত আটদিন পার হয়ে
গেছে৷ ইতিমধ্যে চারাগুলো আরও একটু বড়ো হয়েছে৷ এরপর বলাই, তাপস দেখল চরকি বেশ কিছু শালপাতা আর এক ডিবে সিঁদুর গোলা নিয়ে এসেছে৷
ওরা তো হেসেই মরে৷
“এগুলো দিয়ে কী হবে রে?”
“দেখ না কী হয়।”
একটা ছোটো গাছের সরু ডাল ভেঙে নিয়ে চরকি এক একটা শালপাতা নেয় আর তাতে
নাম লিখতে থাকে৷ কোনোটায় লেখে রবিরাম, কোনোটায় সিরাজ, কোনোটায় মহীন তো কোনোটায় সন্ধ্যা৷ এরপর সেই শালপাতাগুলো এক একটা কঞ্চিতে আটকে দেয় আঠা দিয়ে৷ তারপর
এক একটা চারা গাছের পাশে পাশে পুঁতে দেয় সেগুলো৷
“এদের নাম কেন দিচ্ছিস গাছের পাশে?” আশ্চর্য হয়ে তাপসের প্রশ্ন৷
“যাদের নাম দিলাম, তারা এই আশপাশেই থাকে৷ এদের প্রত্যেকের বাড়িতেই হয় গরু, মোষ
না হয় ছাগল আছে৷ আমার এই গাছগুলো
যাতে না খায় তাই ওদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের নামে করে দিলাম গাছগুলো৷ কেউ কি চাইবে
নিজের বাচ্চাকে ছাগলে গরুতে খাক? বুঝলি এবার?”
“তোর কী বুদ্ধি রে! তুই মনে হয়
অন্য গ্রহ থেকে এসেছিস৷ এমনটা তো আমাদের মাথায় আসে না।”
বন্ধুদের
মুখে নিজের প্রশংসা শুনে একটু যে গর্ব হয় না চরকির সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে৷ কিন্তু সামলে নেয় চট করে৷ বলে, “যদি সব গাছ বাঁচে তাহলে কেউ আর না খেয়ে থাকবে না রে, দেখিস৷ আমাদেরও খুব মজা হবে।”
চরকি অ্যান্ড কোম্পানি নেমে পড়েছে কাজে৷ প্রতিটা চারা ঘিরে গোল করে করে বেড়া
দিচ্ছে তিনজন মিলে৷ এই উপলক্ষে চরকি দু’দিন স্কুল
কামাই করে ফেলেছে৷
সব হয়ে গেলে ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে, তোমাদের
ছেলেদের নামে গাছ লাগিয়েছি৷ দেখে এসো৷ আপাতত গাছগুলো সুরক্ষিত৷
* * *
চরকির স্বপ্ন সফল হয়েছে৷ আম, জাম, আতা, জামরুল, পেয়ারা গাছে ভরে গেছে চরকির গ্রাম৷ ফল ধরতে শুরু করেছে৷ গ্রামের মানুষ
বিনে পয়সায় পেট ভরে ফল খেতে পারবে৷ ফলে কত ভিটামিন আছে, স্যারেরা
পড়াতে গিয়ে বলেন৷ ফল খেলে কত অসুখ হবে না৷ কত রকম পাখিও আসছে ফলের লোভে৷ এক কথায়
চরকির গ্রামটা কেমন স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে এই গাছগুলোর জন্য৷
তাছাড়া আরও একটা চমৎকার রোজগারের উপায় বার হয়েছে৷ এত এত ফল তো খেয়ে শেষ হচ্ছে না৷ বাড়তি ফল ঝুড়ি ভরে আশপাশের গ্রামে, কেউ কেউ বা লরিতে চেপে বসে শহরে গিয়ে বিক্রি করছে৷ যারা গরিব গ্রামবাসী,
তাদের উপকার হচ্ছে৷
গ্রাম থেকে যারা শহরে যায় কাজের জন্য, তাদের মাধ্যমে
খবর ছড়ায় শহরেও৷ খবরের কাগজের দপ্তরেও পৌঁছয় সে খবর৷ রিপোর্টার আসে৷ ছবি তোলে গাছের
আর চরকির৷ ইন্টারভিউ নেয়৷
গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে৷
দু’দিন বাদেই কলকাতার বড়ো কাগজে বড়ো করে খবর বেরোয়৷ কেমন বুদ্ধি করে
একটা বাচ্চা ছেলে গ্রামের সবাইকে বিনা খরচে ফল খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ পরিবেশ নির্মল হয়েছে অত গাছ বাড়ায়৷ চরকির
নামে ধন্য ধন্য করে সবাই৷ গ্রামের লোক দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করে চরকিকে৷ আর চরকির বন্ধুরা? তারা চরকিকে মাথার ওপরে
তুলে “চরকি জিন্দাবাদ, হিপ হিপ হুররে”
বলে ঘুরতে থাকে সারা গ্রাম৷
চরকি এখন আর মাটিতে প্রায় থাকেই না৷ হয় বন্ধুদের কাঁধে চড়ে ঘোরে নয়তো গাছের
ওপরে বসে ফল খায়৷ তা, এমন ছেলের নাম খবরের কাগজে বেরোবে না তা কি হয়!
_____
ছবিঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment