পঞ্চতন্ত্রের গল্প
ব্যাঙ রাজা ও সাপ
রাখি পুরকায়স্থ
গঙ্গাদত্ত নামে এক ব্যাঙ রাজা
ছিল। একটি কুয়োর মধ্যে ছিল তার রাজত্ব। সেই কুয়ো রাজ্যের কিছু ব্যাঙ প্রজা গঙ্গাদত্তের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এতে গঙ্গাদত্ত মোটেই খুশি ছিল না। রাজত্ব কী ভাবে
রক্ষা করবে সেই কথা ভেবে-ভেবে তার নাওয়া-খাওয়া ভুলবার জোগাড় হল। এদিকে
সেই বিদ্রোহী ব্যাঙ প্রজাদের সাহস উত্তরোত্তর বেড়ে যেতে লাগল। গঙ্গাদত্তের
সঙ্গে তারা প্রায়শই নানান অজুহাতে
ঝগড়াঝাঁটি বাঁধিয়ে রাখত।
বিদ্রোহী ব্যাঙেদের অত্যাচার
সহ্য করতে না পেরে একদিন গঙ্গাদত্ত রেগেমেগে তার স্ত্রীকে বলল, “কী আস্পর্ধা দেখ! আমি
ওদের রাজা, আর আমার সঙ্গেই কিনা এমন ব্যবহার করছে! এসব করবার সাহস ওদের হয় কী করে?
ওদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে, বুঝলে রানি?”
ব্যাঙ রানি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। গঙ্গাদত্তকে বোঝাবার চেষ্টায় সে বলল, “ঠান্ডা
মাথায় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। ওদের সাজা দিতে গিয়ে আবার আমাদের জন্যও বিপদ ডেকে
নিয়ে এসো না যেন।”
রানির
উপদেশ গঙ্গাদত্তের মোটেই পছন্দ হল না। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সে কুয়োর বাইরে
বেরিয়ে এল। আর ঠিক তখনই তার নজর পড়ল প্রিয়দর্শন নামে সাপটির ওপর।
কুয়ো থেকে সামান্য দূরেই দাঁড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন এক বট গাছ। সেই গাছের কোটরেই
প্রিয়দর্শনের আস্তানা। গঙ্গাদত্ত
দেখল, প্রিয়দর্শন খুব ধীরে ধীরে এঁকেবেঁকে বট গাছের কোটরে ঢুকে পড়ছে। হয়তো
সারাদিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে আস্তানায় ফিরেছে সে।
ঠিক সেই মুহূর্তে গঙ্গাদত্তের
মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে মনে মনে বলল, ‘এই তো সমস্যার সমাধান পেয়ে
গিয়েছি। আর কী চিন্তা! একে আমার কুয়ো রাজ্যের অতিথি হতে অনুরোধ করব। তারপর...
।’ সে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে গেল বট গাছের দিকে। প্রিয়দর্শনের আস্তানাটি মাটির প্রায়
কাছাকাছি। গঙ্গাদত্ত এবার কোটরের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে হাঁকতে লাগল, “ও প্রিয়দর্শন
ভায়া, কোথায় তুমি? দয়া করে বাইরে এসো শিগগির।”
এদিকে কোটরের বাইরে থেকে অচেনা
গলার ডাক শুনে প্রিয়দর্শন বেশ ঘাবড়ে গেল। ‘এটা তো সাপের গলা বলে একেবারেই মনে
হচ্ছে না! আর আমার তো সাপ ছাড়া অন্য কোনও বন্ধুও নেই যে এমন করে ডাকবে। তবে
আমায় ডাকছেটা কে রে বাবা! কোন সাপুড়ে-টাপুড়ে নয় তো?’
ওপাশ থেকে গঙ্গাদত্ত আবার
হাঁকল, “জলদি বাইরে বেরিয়ে এসো প্রিয়দর্শন ভায়া। আমি ব্যাঙ রাজা গঙ্গাদত্ত। তোমার সঙ্গে
বন্ধুত্ব করতে চাই।” এই কথা শুনে প্রিয়দর্শন আঁতকে উঠল, ‘ব্যাঙের সঙ্গে সাপের
বন্ধুত্ব! অসম্ভব ব্যাপার! আগুনের সঙ্গে খড়ের বন্ধুত্ব পাতানোর গল্প কি কেউ
কস্মিনকালেও শুনেছে?’
গঙ্গাদত্ত বুঝতে পারল
প্রিয়দর্শনকে এত সহজে দলে টানা যাবে না। এবার তাই প্রিয়দর্শনের সামনে সে আসল কথাটা
পাড়ল, “আমি মানছি, আমদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। তবু
বলছি, আমি তোমার সাহায্য চাই ভাই। দয়া করে তুমি আমার শত্রুদের খেয়ে শেষ করো।”
গঙ্গাদত্তের মুখে এই কথা শুনে
খানিকটা যেন কৌতূহলী হয়েই প্রিয়দর্শন কোটরের বাইরে
মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার শত্রু আবার কারা?” গঙ্গাদত্ত মুখ কালো করে বলল, “আমার
কুয়ো রাজ্যের বেশ কিছু প্রজা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। আমাকে একেবারেই
মানতে চাইছে না। নিত্যদিন আমার হাড় জ্বালিয়ে মারছে। এর
একটা বিহিত করতে চাই!” শুনে প্রিয়দর্শন চোখ কপালে তুলে বলল, “ও বাবা! তুমি কুয়োর
মধ্যে থাক নাকি? এত গভীর কুয়োর মধ্যে আমি নামব কী করে? আর যদিও বা নামতে পারি, তোমার শক্রুদের মারার সময় আমি থাকবটা কই?” তারপর হঠাৎ
জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে সে গঙ্গাদত্তকে বলল, “না, না, এসব অসম্ভব কথাবার্তা। তুমি
এবার এখান থেকে ভালোয় ভালোয় যাও তো দেখি ভায়া!” এই বলে সাপটি আবার কোটরের মধ্যে
সেঁধিয়ে গেল!
তবে গঙ্গাদত্ত মোটেই এত সহজে
হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে কাকুতিমিনতি করে প্রিয়দর্শনকে বলল, “একটু ধৈর্য্য
ধরো বন্ধু, আমি তোমাকে ঠিক দেখিয়ে দেব কুয়োতে কীভাবে নামতে হয়। তাছাড়া, সেখানে
তোমার জন্য একটা জুতসই গর্তও দেখে রেখেছি। কুয়োর জলের সামান্য ওপরেই একটা ভালো
গর্ত আছে। বিশ্বাস করো, তোমার বেশ পছন্দ হবে সেই নতুন আস্তানা। খুব আনন্দে থাকবে
সেখানে। এখন দয়া করে আমার সঙ্গে চল দেখি।”
সাপটি এবার যেন গভীর চিন্তায়
ডুবে গেল। সে ভেবে দেখল, তার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। শরীরে আগের
মতো আর তাকৎ নেই। মাঝেমধ্যে এক-দুটো ইঁদুর ধরে খায়,
তাও অনেক কষ্টেসৃষ্টে। অনেক আকাশ পাতাল ভেবে গঙ্গাদত্তের প্রস্তাব তার কাছে বেশ
লোভনীয় বলেই মনে হল। তাই কোটরের ভেতর থেকে মাথা বার করে সে গঙ্গাদত্তকে বলল, “ঠিক
আছে গঙ্গাদত্ত ভায়া, আমি তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। তোমার সঙ্গে কুয়োর ভেতরে যেতে আমি রাজি। আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।”
প্রিয়দর্শনের মুখে এমন কথা
শুনে গঙ্গাদত্ত তো যারপরনাই খুশি। আনন্দে
দিশাহারা হয়ে গঙ্গাদত্ত বলল, “তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাই বন্ধু।” তারপর
যেন প্রিয়দর্শনকে খানিকটা বোঝানোর চেষ্টায় সে বলল, “তবে
একটা কথা তোমাকে বলার ছিল। তোমায় কথা দিতে হবে, আমার পরিবার-পরিজনদের কোনও ক্ষতি
তুমি কক্ষনো করবে না। আমি যাদের খেতে বলব কেবলমাত্র তাদেরই খাবে তুমি, কেমন?”
সব শুনে প্রিয়দর্শন হেসে বলল,
“কী যে বল ভায়া! তুমি হলে কিনা আমার বন্ধু! আমি কি তোমার পরিবার-পরিজনদের ক্ষতি
করতে পারি? নিশ্চিন্ত থাকো। তাদের সামান্যতম ক্ষতিও হবে না।” খুশি হয়ে গঙ্গাদত্ত
বলল, “তবে আর কী? চল তাড়াতাড়ি।” “অবশ্যই। আর
দেরি কেন?” এই বলে সাপটিও গর্ত থেকে বেরিয়ে এল।
সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে
চলল গঙ্গাদত্ত, পেছনে এঁকেবেঁকে চলতে লাগল প্রিয়দর্শন। কুয়োর ধারে এসে গঙ্গাদত্ত
যত্নসহকারে প্রিয়দর্শনকে বুঝিয়ে দিল কুয়োতে নামবার বিশেষ উপায়। সেই পদ্ধতি অনুসরণ
করে প্রিয়দর্শন এসে পৌঁছল কুয়োর ভেতর। কথামতো গঙ্গাদত্ত কুয়োর গায়ে একটি গর্ত
দেখিয়ে দিল তাকে। প্রিয়দর্শনেরও বেশ পছন্দ হল গর্তটি।
থাকবার জন্য সেটি সত্যিই বেশ আরামদায়ক।
সাপটি কুয়োর গর্তে গুছিয়ে
বসতেই ব্যাঙ রাজা লেগে পড়ল আসল কাজে। প্রতিদিন সে আঙ্গুল
তুলে একটি করে শত্রু ব্যাঙকে দেখিয়ে দিতে লাগল। আর সাপটিও পটাপট সেই ব্যাঙকে পেটে
পুরতে লাগল। এইভাবে এক-এক করে ব্যাঙ রাজার প্রায় সব কটি শত্রু ব্যাঙকেই সাবাড় করে
ফেলল প্রিয়দর্শন। কিন্তু ততদিনে তার লোভ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। রোজ কেবলমাত্র একটা
ব্যাঙ খেয়ে মোটেই তার আর খিদে মিটছে না। তাই গঙ্গাদত্তের অনুপস্থিতিতে এক-দুটো
বন্ধু ব্যাঙকেও পেটে চালান করবার মতলব আঁটল সে।
গঙ্গাদত্ত সামনে আসতেই
প্রিয়দর্শন ভালো মুখ করে তাকে জানাল, “বন্ধু, তোমার জন্য সুখবর আছে। আমি তোমার সব
শত্রুকে নিকেশ করে দিয়েছি।” শুনে গঙ্গাদত্ত স্বভাবতই ভীষণ খুশি হল। আনন্দে নাচতে
নাচতে সে প্রিয়দর্শনকে বলল, “কী ভীষণ আনন্দের খবর দিলে বন্ধু! আর তোমাকে এখানে জোর
করে আটকে রাখব না। অনেক কষ্ট করেছ আমার জন্য, এবার তুমি নিজের গর্তে ফিরে যাও ভাই।”
গঙ্গাদত্তের মুখে একথা শুনে
প্রিয়দর্শন তো আকাশ থেকে পড়ল, “এসব কী কথা বলছ তুমি, হ্যাঁ? আমি আবার পুরোনো গর্তে
ফিরে যাব? আমার সঙ্গে তুমি মজা করছ নাকি? দেখো গিয়ে, কবে সেই গর্ত বেহাত হয়ে গিয়েছে।
নিশ্চয়ই অন্য কোনও সাপ এখন সেই গর্তের দখল নিয়েছে। এতদিন কি সেই গর্ত খালি পড়ে
থাকবে নাকি?”
সব কথা শুনে গঙ্গাদত্ত থ বনে
গেল। সে বোকার মতো প্রিয়দর্শনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনও জুতসই উত্তরই সে
খুঁজে পাচ্ছিল না। এদিকে গঙ্গাদত্তকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রিয়দর্শন আবার বলতে
লাগল, “না, না, এ হয় না। আমি এই কুয়োতেই থাকব। কিছুতেই অন্য কোথাও যাব না। আর
যেহেতু তুমি আমাকে আমার সাধের আস্তানা থেকে বের করে এখানে নিয়ে এসেছ, আমার খাওয়া-দাওয়ার
ব্যবস্থা করাটাও কিন্তু তোমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বুঝলে?”
ঘটনাটা যে এমন মোড় নেবে
গঙ্গাদত্ত তা কল্পনাও করতে পারেনি। ভয়ে তার হাত-পা যেন পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে
লাগল। গঙ্গাদত্তকে ভয় পেতে দেখে প্রিয়দর্শন
মনে মনে খুব খুশি হল। কিন্তু ইচ্ছে করে চোখ পাকিয়ে গঙ্গাদত্তকে সে বলল, “তোমার
বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে প্রতিদিন আমাকে অন্তত একখানা করে ব্যাঙ
খেতে দিতে হবে। তবে খুব সাবধান! একদম চালাকি করবার চেষ্টা করবে
না বলে দিচ্ছি। নাহলে কিন্তু আরও বিপদে পড়বে। আমি তোমাদের সব কটাকেই তখন একসঙ্গে
সাবাড় করে দেব। মনে থাকে যেন!”
কী আর করে গঙ্গাদত্ত! মন
খারাপ করে সেখান থেকে সরে পড়ল সে। বড়ো অসহায় লাগছিল তার। কুয়োর
অন্য পাশে বসে সে ভাবতে লাগল, “ইস্! কী বোকা আমি। কেন যে ওকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম।
এখন মহা বিপদে পড়েছি। কিন্তু আমার সামনে কোনও রাস্তাই যে আর খোলা নেই। ওকে
সন্তুষ্ট রাখতে হলে রোজ একটা করে ব্যাঙ ওর কাছে পাঠাতেই হবে।”
বাধ্য হয়ে গঙ্গাদত্ত রোজ একটি
করে ব্যাঙ পাঠাতে লাগল প্রিয়দর্শনের কাছে। তবে
কেবলমাত্র একটি ব্যাঙ খেয়ে সাপটি মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না। ব্যাঙ রাজার চোখের আড়ালে রোজই
সে আরেকটি করে ব্যাঙ পেটে চালান করতে লাগল।
একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তেমনই একটি
ব্যাঙ খাওয়ার সময় প্রিয়দর্শনকে হাতেনাতে ধরে ফেলল গঙ্গাদত্ত। দুঃখের
বিষয়, সেদিনের সেই হতভাগ্য ব্যাঙটি ছিল গঙ্গাদত্তের একমাত্র পুত্র! সেই ভয়ঙ্কর
দৃশ্য দেখে গঙ্গাদত্ত আর্তনাদ করে উঠল, “না, না, ওকে খেও না। ও আমার ছেলে। ওকে
ছেড়ে দাও, তোমার পায়ে পড়ি।” কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
গঙ্গাদত্ত হাজার কাঁদলেও তার একমাত্র ছেলে আর কক্ষনো ফিরে আসবে না!
“হায়, হায়, এ আমি কী ভুল করলাম,”
এই বলে গঙ্গাদত্ত মাথা চাপড়াতে লাগল। তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এখন আর কেঁদে
কী হবে? কে আসবে তোমায় সাহায্য করতে? তুমি নিজের জ্ঞাতিভাইদের নিঃশেষ করতে
চেয়েছিলে। আমি তখনই জানতাম, তোমার সঙ্গে এমনটাই হবে। তাই আগেই সাবধান করেছিলাম।
শোনোনি তুমি। এখন প্রাণে বাঁচতে চাইলে হয় এখান
থেকে পালাও, নয় তো ওই পাজি সাপটাকে মারবার মতলব আঁটো।”
এক-এক করে দিন চলে যেতে লাগল।
কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও গঙ্গাদত্তের মাথায় প্রিয়দর্শনকে মারবার মতো কোনও
জুতসই ফন্দি এল না। এদিকে আবার ততদিনে গঙ্গাদত্ত বাদে কুয়োর সব ব্যাঙকে সাবাড় করে
ফেলেছে প্রিয়দর্শন!
একদিন খিদের জ্বালায়
প্রিয়দর্শন গঙ্গাদত্তকে ডেকে নরম গলায় বলল, “ভাই গঙ্গাদত্ত, আমার ভীষণ খিদে
পেয়েছে। দয়া করে আমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর। দ্যাখো, তুমিই তো আমাকে এখানে এনেছ,
তাই আমার জন্য খাবার জোগাড় করা তোমারই দায়িত্ব। এখন
এসব ভুলে গেলে চলবে কী করে ভায়া?” এই কথাগুলি শুনে গঙ্গাদত্তের মন আনন্দে নেচে
উঠল। এটাই তো পালাবার সুবর্ণ সুযোগ। সুযোগ কী আর জীবনে বার বার আসে? তাই সুযোগের
সদ্ব্যবহার করতেই হবে। এবারে তাই খুব সাবধানে খুশিকে মনের কোণে লুকিয়ে গঙ্গাদত্ত
মুখখানা ভীষণ গম্ভীর করে বলল, “প্রিয়দর্শন ভায়া, যতদিন আমি বেঁচে আছি, তোমাকে
একবেলাও না খেয়ে থাকতে হবে না। নিশ্চিন্ত থাকো। আমাকে এখান থেকে একবার বেরুবার অনুমতি
দাও, আমি আশপাশের কুয়োগুলো থেকে তোমার জন্য অনেক ব্যাঙ ধরে নিয়ে আসব।”
গঙ্গাদত্তের মুখে এমন কথাবার্তা
শুনে প্রিয়দর্শন তো যারপরনাই খুশি। আনন্দের
চোটে সে গঙ্গাদত্তকে বলল, “তুমি আমার ভাইয়ের মতো গঙ্গাদত্ত। আর সে
কারণেই তোমাকে খাওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না। জেনে
রাখো ভাই, যদি তুমি ঠিক সময়মতো আমাকে খাবারের জোগান দিতে থাকো, তোমাকে আমি নিজের বাবার মতো সম্মান করব।”
একটি মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে
ব্যাঙ রাজা গঙ্গাদত্ত কুয়ো থেকে পালিয়ে গেল। কুয়োর
বাইরে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল, ‘বাব্বা! জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছি। রাজ্য
গিয়েছে যাক! ভাগ্য ভালো পৈত্রিক প্রাণখানা বেঁচে গিয়েছে। শান্তিতে
থাকবার জন্য এখন না হয় আরেকটি নিরাপদ কুয়ো খুঁজে নেওয়া যাবে।’
এদিকে কুয়োর মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে
বসে বসে গঙ্গাদত্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল প্রিয়দর্শন। দিন
আসে দিন যায়, অথচ গঙ্গাদত্ত আর ফিরে আসে না।
একে বেশ বয়স হয়েছে প্রিয়দর্শনের, তায় আবার এতদিন ধরে খাওয়া নেই! না খেতে পেয়ে প্রিয়দর্শন
ক্রমশ দুর্বল হতে লাগল। কুয়ো থেকে বেরোবার
শক্তিটুকুও ফুরিয়ে গেল তার। একদিন
সে দেখতে পেল কুয়োর দেওয়াল বেয়ে একটি টিকটিকি হেলেদুলে উপর দিকে উঠছে। সে টিকটিকিকে
ডেকে বলল, “বোন টিকটিকি, দয়া করে আমার একটা উপকার করবে?” টিকটিকি সেই ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাকাল। ভরসা
পেয়ে প্রিয়দর্শন তাকে বলল, “আমি জানি বোন, তুমি আর
ব্যাঙ রাজা গঙ্গাদত্ত বহু পুরোনো বন্ধু। জানো
নিশ্চয়ই, অনেকদিন হল সে তার রাজত্বে ফেরেনি! দয়া করে তাকে খুঁজে বার
করবার চেষ্টা কর। খুঁজে পেলে তাকে
বোলো, সে যেন খুব তাড়াতাড়ি তার কুয়ো রাজ্যে ফিরে আসে। সেই
কবে থেকে তার অপেক্ষায় বসে আছি আমি। অন্য
ব্যাঙ জোগাড় করতে না পারলেও কোনও ক্ষতি নেই, সে ফিরে এলেই আমি খুশি। তাকে
এই কথাগুলো বলবে তো বোন?” সম্মতি জানিয়ে টিকটিকি মাথা নাড়তেই প্রিয়দর্শন
আরও উৎসাহিত হয়ে বলল, “তাকে আরও বোলো, আমি
তার কোনও ক্ষতি করব না। তার
সামান্যতম ক্ষতি করবার কথাও আমি ভাবতে পারি না। তার
কথা খুব মনে পড়ে। তাকে ছাড়া আমি আর বাঁচব না। ওকে
বুঝিয়ে বোলো, কেমন?”
টিকটিকির মনটা খুব ভালো ছিল। সাপটির
শারীরিক অবস্থা দেখে তার খুব কষ্ট হল। সে সত্যি-সত্যি
গঙ্গাদত্তের খোঁজ করতে লাগল। আশপাশের
সবগুলি কুয়ো খুঁজে টিকটিকি শেষমেশ একটি কুয়োতে গঙ্গাদত্তের সন্ধান পেল। সেই
কুয়ো রাজত্বে গঙ্গাদত্ত কিন্তু ব্যাঙ রাজা নয়, সেখানে সে একজন সাধারণ
প্রজা। তবে রাজা না হলে কী হবে, তাকে দেখে বেশ বোঝা যায় সে সেখানে বেশ সুখে শান্তিতে নিরাপদে আছে। এতদিন
পর পুরোনো বন্ধুকে দেখে টিকটিকিও খুব খুশি। সে বলল, “ভাই গঙ্গাদত্ত, নিজের রাজ্যপাট ছেড়ে এখানে কী করছ তুমি?
ওদিকে যে তোমার বন্ধু প্রিয়দর্শন তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। সে
প্রতিজ্ঞা করেছে, তোমার কিচ্ছুটি ক্ষতি করবে না। নিজের রাজত্বে ফিরে যাও বন্ধু।”
গঙ্গাদত্ত করুণ মুখে জোড়হাত
করে বলল, “না বন্ধু, ক্ষুধার্তকে কক্ষনো বিশ্বাস করতে নেই। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা
থেকে আমি এই শিক্ষা পেয়েছি। পরিবার-পরিজন সব হারিয়ে শেষমেশ কেবলমাত্র পৈত্রিক
প্রাণটি নিয়ে কোনও মতে পালিয়ে এসেছি এখানে। বাবা রে
বাবা! ভুলেও আর কোনদিনও ওর কাছে যাব না আমি।” তারপর মাথায় জোড়হাত ঠেকিয়ে সে বিড়বিড়
করে বলল, “রক্ষে করো ভগবান।”
_____
ছবিঃ পুষ্পেন মন্ডল
No comments:
Post a Comment