ভুলোর
কীর্তি
পল্লব
বসু
।।
১ ।।
ভোম্বলের স্কুল ছুটি হয়
দুটো চল্লিশে। স্কুল থেকে ওর বাড়ি হাঁটা পথে মিনিট দশেক। বাবা-মা দু'জনেই এসময়
অফিসে থাকেন। ভোম্বল একা একাই বাড়ি ফেরে। গরমটা পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। রাস্তার পীচ
গলতে শুরু করেছে। এসময় খাঁ খাঁ করছে রাস্তা। জনমনিষ্যির চিহ্ন
তো নেইই, দু-একটা
পাখি কিম্বা কুকুর বিড়ালও চোখে পড়ছে না। এই সময় রোজ ভোম্বল পাড়ায় ঢুকলেই ভুলো ছুট্টে
আসে ওর কাছে। তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে বাড়ি অবধি পিছন পিছন যায়। ভুলো ওদের পাড়ার
নেড়ি কুকুর। ভোম্বলের সঙ্গে ভুলোর খুব ভাব। রাত্রে ওদের বাড়ির সামনের বারান্দাতেই
ভুলো শুয়ে ঘুমায়। ভোম্বলও রোজ স্কুলের পাশের ঝালমুড়ি-কাকুর থেকে দু-প্যাকেট ঝালমুড়ি কেনে। বাড়ির দরজায় এসেই
ভুলোকে প্যাকেটটা দিয়ে মাথায় গলায় আদর করে ভোম্বল ঢুকে যায়, আর ভুলো গলার ভিতর
থেকে আনন্দসূচক গরররর শব্দ করতে করতে ঝালমুড়ি খায়।
আজ কিন্তু ভুলোর দেখা
নেই। ভোম্বল বেশ অবাক হয়। চিন্তাও হয় একটু। সকালে কিন্তু ভুলো পাড়ার মোড় অবধি
এগিয়ে দিয়েছে ভোম্বলকে। চারিদিকে দেখতে দেখতে ভোম্বল এগোতে থাকে। মিলিদের বাড়ির
পড়েই জঞ্জালের একটা ভ্যাট আছে। তারপরেই ভোম্বলদের খেলার মাঠ। মিলিদের বাড়ি পেরোতেই
চেনা ডাকটা কানে ভেসে আসে ভোম্বলের। ভ্যাটের পাশেই ভুলো দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে বললে ভুল
হয়, কান খাড়া করে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কতগুলো কাককে রীতিমতো তাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
মাঠের পাঁচিলের উপরে একটা চিল তার ছানাকে নিয়ে বসে নিচের দিকে একদৃষ্টে কিছু দেখছে
বলে মনে হয় ভোম্বলের। ও এগিয়ে যেতেই কাকগুলো উড়ে বাড়ির কার্নিশ, পাঁচিলের উপরে
আশ্রয় নেয়। মাটিতে চোখ যেতেই ভোম্বলের মুখটা ফুটবলের মতো হাঁ হয়ে যায়। ভ্যাটের
পাশে পড়ে থাকা যে বস্তুটিকে পরম যত্নে ভুলো সকলের আক্রমন থেকে বাঁচিয়ে আগলে
রেখেছে, সেটা আর কিছু না, একটি সাদা গজ কাপড়ে জড়ানো ফুটফুটে এক মানবশিশু। খুব
ক্ষীণ একটা চিঁচিঁ আওয়াজ শিশুটির মুখ থেকে এতক্ষণে ভোম্বলের কানে এসে বাজে। ভুলো
ভোম্বলকে দেখে পরম আনন্দে লেজ নাড়তে থাকে।
ভুলো পাড়ায় এখন বেশ
কেষ্টবিষ্টু হয়ে গেছে। লোকাল থানার বড়োবাবু আর পাড়ার সবাই মিলে ভুলোকে পাঁঠার মাংস-ভাতের গ্র্যান্ড ফিস্ট
করিয়েছে। মাত্র দু’দিনের মেয়েকে কেউ ওখানে ফেলে দিয়ে গেছিল। ভুলো যদি না রক্ষা করত,
তবে কাকে চিলে ছিঁড়ে খেত শিশুটিকে। এক অর্থে ভুলোই ওর মা। ভোম্বলের কাছ থেকে নিয়ে
শিশুটিকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ।
ভুলো খুবই স্বভাবমিষ্টি
কুকুর। সাধারণত এক পাড়ার কুকুর অন্য পাড়ার কুকুরদের এক্কেবারে সইতে পারে না।
বেপাড়ার কুকুর দেখলেই রে রে করে তেড়ে আসে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, ভুলো
আশেপাশের পাড়ায় অবাধে ঘুরে বেড়ায়। দু’দিন হল, ভুলোর চারটে ফুটফুটে ছানা হয়েছে।
তুলতুলে দুটো বাচ্চা সাদাকালোয় ছোপ ছোপ, একটা লালচে বাদামি আর একটা মেটে রঙের।
ভোম্বলদের বারান্দায় বস্তা পেতে ওদের জায়গা হয়েছে। ভোম্বল প্রত্যেক শনিবার
বিকেলবেলা, মিউনিসিপাল অফিসের কাছে অঙ্ক স্যারের কোচিং-এ যায়। সন্ধ্যার সময় যখন ও কোচিং
থেকে ফেরে, ভুলোও ওর পেছন পেছন যেন পাহারা দিতে দিতে আসে। স্যারের কোচিং-এর সামনের
রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় কালো রঙের একটা কুকুর। কোচিং-এর সবাই ওকে কালু বলে ডাকে। ওরও
দিন কয়েক হল, মিষ্টি তিনটে কুচকুচে কালো বাচ্চা হয়েছে। কালুর সঙ্গে ভুলোর খুব ভাব।
ভোম্বল ব্যাগে করে কালু ভুলো আর তাদের ছানাদের জন্য বিস্কুট নিয়ে যায়। আজ কোচিং
থেকে বেরিয়ে এসে ভোম্বল, মিলি আর বাচ্চু, কালু-ভুলোর কাউকেই দেখতে পায় না। বড্ড
অবাক হয়ে যায় ওরা। প্রবল বৃষ্টির দিনেও ভুলোর রুটিনের কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না।
ওরা কথা বলতে বলতে এগোতে থাকে। শিবমন্দিরের সামনে অনেক মানুষের জটলা। সেখানেই ভিড়ের
মধ্য থেকে ভুলোর গলা পাওয়া যায়। সে অবশ্য ডাক নয়, একটানা করুণ আর্তনাদ, আর সঙ্গে
কয়েকটা কুকুরছানার সমবেত চিৎকার। জটলার মধ্যস্থলে আসতেই কৌতূহল
নিবৃত্ত হয় ওদের। একবার তাকিয়েই ওরা চোখ ফিরিয়ে নেয়। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসা রক্তের
দলার মতো কালুর নিঃস্পন্দ দেহ। কিছু আগেই একটা অ্যাম্বাসাডার পিষে দিয়ে চলে গেছে
কালুকে। বোধহয় সন্ধেবেলা শিবমন্দিরে সন্ধ্যারতির পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে পূজার
ভোগপ্রসাদ পাবার আশায় এসেছিল কালু। সেটাই তার কাল হোল। ভোম্বল মিলিদের চোখগুলো
ভিজে ওঠে কালুর অনাথ ছেলে মেয়েদের কথা ভেবে। একেবারে দুধের ছানা ওরা। ওদেরও বুঝি
চিল শকুন কাকে ছিঁড়ে খাবে......
ভোরবেলা দাঁত মাজতে মাজতে
রাস্তার বারান্দায় আসে ভোম্বল। ভুলো বস্তার উপরে শুয়ে বাচ্চাগুলোর গা চেটে দিচ্ছে,
আর ওরা মায়ের কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে পরম শান্তিতে দুধ খাচ্ছে। ভোম্বলের দাঁত মাজা
থেমে যায়। ও বেশ কয়েকবার চোখ কচলায়। না, কোনও ভুল নেই, চারটে নয়, সাতটা বাচ্চা
নিজেদের মধ্যে দুধ খাওয়ার জন্য মারামারি করছে, আর ভুলো পরম যত্নে একটা মিশমিশে কালো
রঙের ছানার গা মাথা চেটে দিচ্ছে!!!
।। ২ ।।
ভোম্বল হঠাৎ বিকেল থেকে
নিরুদ্দেশ। স্কুল থেকে প্রতিদিন তিনটের মধ্যেই বাড়ি ঢুকে যায় ভোম্বল। বাড়িতে
মানদামাসি থাকে, ভোম্বলের জন্য দুপুরের খাবার বেড়ে দেয়। খেয়ে ঘণ্টাখানেক একটু
বিশ্রাম করে ভোম্বল খেলতে বেরোয়। কিন্তু আজ চারটে বেজে যেতেও যখন ভোম্বল ফিরছে না,
মাসি তখন ভোম্বলের বাবাকে ফোন করে জানায়। তারপর তো কান্নাকাটি, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে
ফোন, থানা-পুলিশ এসব। কিন্তু, কোনও সন্ধানই পাওয়া যায় না ওর। কেবল ভোম্বলের
স্কুলব্যাগ আর জলের বোতল মিলিদের বাড়ির সামনে থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে।
রাত্রিবেলা ভোম্বলদের
ল্যান্ড নম্বরে ফোন এল, ওর মা তনিমা ফোনটা ধরেছেন -
“হ্যালো?”
“আপনার ছেলে ভোম্বল এখন
আমাদের জিম্মায়। ভালোই আছে এখনও, একটু ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করছিল, তা, দুটো থাপ্পড়
মারতেই এক্কেবারে চুপ। এখন বসে বসে কাঁদছে।”
“কী বলছেন কী, ওকে মারবেন
না, আমরাই কখনও ওর গায়ে হাত তুলি না, প্লিজ, আপনাদের পায়ে পড়ি, ওকে ছেড়ে দিন?”
“আরে কাঁদবেন না, কাঁদবেন
না। ওকে আটকে রেখে আমাদের কোনও লাভ নেই। দশ লাখ রেডি রাখুন, এর
পরের ফোনে যেখানে রাখতে বলব সেখানে রেখে দেবেন, দেখবেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।
আপনারা যদি আবার পুলিশ-টুলিশকে এসব কথা জানান, তাহলে কিন্তু ছেলের বাড়ি ফেরার গ্যারান্টি আমি দিতে
পারছি না।”
“আমাকে ওর সঙ্গে একবার
কথা বলতে দিন না, হ্যালো, হ্যালো......?”
ফোনটা ততক্ষণে কেটে গেছে।
।। ৩ ।।
ভোম্বলের বোন তুলি ভুলোকে
নিয়ে মনমরা হয়ে বিকেলবেলা ওদের বাড়ির ঠিক বিপরীতে যে ছোট্ট পার্কটা আছে সেখানে এসে
বসে আছে। আজ অবশ্য ওকে সাহস করে একা বাড়ি থেকে ছাড়েনি, দাদু সঙ্গে এসে বেঞ্চে বসে
আছেন। অন্যদিন ভুলো সারা পার্ক ছুটে বেড়ায় কখনও বেড়ালছানার পিছনে, কখনো তুলির ছুঁড়ে
দেওয়া বলের পিছনে, আবার কখনও নিজের ল্যাজটাকে তাড়া করে বন বন করে ঘুরতে থাকে। তুলি
দোলনায় দোল খায়, কাঠবিড়ালী তাড়া করে ছুটে যায়। আজ কিন্তু চরম ছন্দপতন হয়েছে, চুপটি
করে তুলি দাদুর পাশে বসে ফ্রকের ফিতেটা আঙুলে জড়াচ্ছে। একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায়
আজ পার্ক ফাঁকা, দূরে অন্য একটা বেঞ্চে একটা ভবঘুরে টাইপের লোক বসে, কিন্তু
অন্যান্য দিনের মতো বাচ্চারা নেই। ভুলো অবশ্য এদিক সেদিক ঘুরছে, কিন্তু ওর মধ্যেও
সেই উদ্যমের কোনও চিহ্ন চোখে পড়ছে না।
ক্রমশ সন্ধে নামে পাখির
ডানায়, তুলি আর ওর দাদু সমরবাবু একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই যেন খেয়াল হয় সন্ধে
হয়ে গেছে, তুলির হাত ধরে উঠে পড়েন। কিন্তু আশেপাশে কোথাও ভুলোকে চোখে পড়ে না। তুলি
চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে সমস্ত পার্কটা একবার চক্কর দেয়, কিন্তু ভুলো ছুটে আসে না।
এমনটা কক্ষনো হয়নি আজ অবধি, তুলিকে বাড়িতে পৌঁছে তবে শান্তি পায় ভুলো। ভুলোও কি
তবে হারিয়ে গেল দাদার মতো?
ভবঘুরে লোকটা পায়ে পায়ে
পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। ভোম্বলদের বাড়ির দিকে দেখতে দেখতে খানিকটা এগিয়ে যায়।
রাস্তার ধারে একটা বাইক দাঁড় করানো আছে, সেটাতে বসে ছুটিয়ে দেয় ন’পাড়ার দিকে।
রিলে রেস তোমরা কেউ
দেখেছ? ধর রেসের মাঠে একটা মশাল নিয়ে একজন দৌড়োচ্ছে, কিছুটা দূরত্বে আরেকজন
দাঁড়িয়ে থাকে, সে তার হাত থেকে মশালটা নিয়ে আবার ছোটা শুরু করে, এইভাবে শেষের দড়ি
না ছোঁয়া অবধি চলতে থাকে দৌড়। একটা অদ্ভুত দৌড়ের সাক্ষী থাকল রাস্তার কিছু মানুষ
আর ল্যাম্প পোষ্টের আলোগুলো। ন’পাড়ার লেকের এদিকটা খুবই নির্জন, ভুলো বাইকের পিছু
নিয়ে কিছুদূর এসে থেমে যায়, তারপর ভউ ভউ করে ডেকে ওঠে। রাস্তার ধারে বসে থাকা দুটো
কুকুর ভুলোর ডাক শুনে গা ঝেড়ে ওঠে, তারপর ছুট লাগায় বাইকটার পিছনে। ভুলোও কিন্তু
ছুটতে থাকে। এইভাবে বিভিন্ন পাড়া থেকে কুকুর বাইকের পিছনে ছুটতে থাকে। ওদের মধ্যে
অদ্ভুত এক বোঝাপড়া। বাইকের আয়নায় একবার চোখ পড়ে লোকটির, কিন্তু ভাবে কুকুরগুলোর এই
এক সমস্যা, অচেনা লোক দেখলেই পিছু নেওয়া। রাজীবনগর কলোনির একটু পরেই একটা
পরিত্যক্ত কারখানা আছে, তার সামনে বাইক নিয়ে এসে থামে লোকটি। ভুলো সমেত পাঁচটা
কুকুর এসে একটু দূরে অন্ধকারে মিশে দাঁড়ায়। ওরা পুলিশের ট্রেনিং প্রাপ্ত কুকুর নয়,
ওরা রাস্তায় অবজ্ঞায় উচ্ছিষ্ট খেয়ে বড়ো হয়ে ওঠা সামান্য নেড়ি কুকুর। কিন্তু ওদের কী
অদ্ভুত সমন্বয়, কী অনবদ্য নেটওয়ার্ক!
লোকটি কারখানার ছোটো
লোহার দরজাটায় তিনটে টোকা মারতেই দরজা খুলে যায়। বাইকটা নিয়ে মাথা নিচু করে ও
ভিতরে ঢুকে যায়।
ভুলো বাকিদের পাহারায়
রেখে ছুটতে ছুটতে ফিরে আসে ভোম্বলদের পাড়ায়। তুলি বাড়ির সামনের বারান্দার গ্রিল
ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভুলোকে ছুটে আসতে দেখে গেট খুলে বেরিয়ে আসে।
ভুলো তুলির ফ্রক ধরে
টানতে থাকে, আর মুখ ঘুরিয়ে বারংবার রাস্তার দিকে দেখাতে থাকে। তুলির
মনে হয়, ভুলো ওকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। তুলি ওর পেছু নিয়ে গিয়ে হাজির হয় একেবারে
থানায়। কিন্তু গেটে কনস্টেবল পথ আটকায়, একে একটা বাচ্চা মেয়ে, তায় সঙ্গে আবার একটা কুকুর,
সোজা বড়ো সাহেবের ঘরে ঢুকে যেতে চায়, কী কাণ্ড। তুলি ভুলোকে ডেকে নিয়ে চলেই আসছিল,
ভুলো মাথা নিচু করে তুলির পিছনে আসছিল, কনস্টেবলটিও বেশ খুশি হয়ে একটু বুঝি
অন্যমনস্ক হয়েছে, ভুলো পেছন ঘুরে আচমকা ওর পায়ের ফাঁক গলে সিধে ও সি অতিন ঘোষের
সুইং ডোরের তলা দিয়ে ঢুকে যায়। এই ঘরটা ও খুব ভালো চেনে, কারণ কয়েকদিন আগেই
শিশুটিকে উদ্ধার করার পরে এই ঘরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল ওর।
।।
৪ ।।
একটা মারুতি ওমনি এসে
থামে কারখানার সামনে, একটা লোক নেমে এসে আবার দরজায় তিনটে টোকা দেয়, তার পরে পরেই কারখানার
বড়ো গেটখানা হাট করে খুলে যায়, মারুতিটা ঢুকে যায় ভিতরে, কেউ খেয়ালও করে না দুটো
কুকুর চুপটি করে লুকিয়ে গেছিল মারুতির পিছনে, গাড়ির পিছন পিছন ওরা ভিতরে ঢুকে দ্রুত
লুকিয়ে পড়েছে দুপাশের পাঁচিলের ধারের ঝোপের অন্ধকারে। কারখানার দরজা বন্ধ করতে যায়
একটি লোক, সেই সময় বাইরে অপেক্ষমান আরও দুটো কুকুর ঢুকে আসে গেট দিয়ে, একটা ঝাঁপিয়ে
পড়ে দরজার লোকটির উপরে, বাকি তিনজনে বাকিদের উপরে......।
থানার বড়োবাবু অতীন ঘোষ মানুষটি
একটু ভাবুক প্রকৃতির। থানায় বসে কাজের ফাঁকে যেটুকু অবকাশ পান, তার সদ্ব্যবহার
করেন গল্প-কবিতা লিখে। শুকতারার পুরস্কৃত গল্পের বিভাগে মাঝে মাঝে তার লেখাও
বেরোয়। আজও দুপুরের দিকে একটু হালকা যাচ্ছে থানার পরিবেশ। গরমে মানুষ ডাইরি
লেখাতেও আর আসছে না। অতীনবাবু গুছিয়ে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছেন। বিভোর হয়ে
গেছিলেন, হঠাৎ প্যান্টে টান পড়ল। প্রথমে গ্রাহ্য করেননি। দ্বিতীয়বার টান পড়তে নীচে
তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। জলজ্যান্ত এক নেড়ি কুকুর তাঁর প্যান্ট ধরে টানছে। প্রথমে
খুব একচোট রেগে গেলেন। গেটের কনস্টেবলের চোখ এড়িয়ে এটা ভেতরে আসে কী করে!! চিৎকার
করতে গিয়েও থমকালেন। কুকুরটা দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ওনাকে কিছু ইশারা করছে, আর
করুণ চোখে কিছু একটা বলতে চায়। উনি লেখেন। অনেকপ্রকার ভাবনা মনে
আসে। কুকুরটা একবার ছুটে দরজার দিকে যায় আবার ফিরে এসে এবার মাটিতে আঁচড় কাটে, মুখ
ঘষে আর কুঁই কুঁই শব্দ করতে থাকে।
ভালো
দৌড়ঝাঁপ গেল অতীনবাবুর। এ এস আই জয়ন্ত, দুজন কনস্টেবল আর তুলিকে সঙ্গে নিয়ে
জীপে ভুলোকে ফলো করে গিয়ে পৌঁছেছিলেন পরিত্যক্ত ওই কারখানায়। সেখানে গিয়ে তো একেবারে
তাজ্জব। কারখানার বাইরে জিপ রেখে দেখেন, গেট হাট খোলা পড়ে, ভিতরে একটা ওমনি
দাঁড়িয়ে, আর দরজার সামনেই পড়ে একটি লোক রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে, তার প্রহরায়
একটি বাদামি-সাদা কুকুর। সেটাকে পিছনে ফেলে একটু এগোতেই দেখেন একটা তালা দেওয়া
ঘরের সামনে তিনটে লোক রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় গোঙাচ্ছে, আর তাদের ঘিরে আরও
তিনটি কুকুর পাহারা দিচ্ছে। একজনের পকেট থেকে পিস্তলের বাঁট বেরিয়ে আছে দেখা যায়,
কিন্তু কুকুরে ওর দুটো হাত এমনভাবে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে, যে পিস্তল তো দূরস্থান,
হাত নাড়ানোর ক্ষমতাটুকুও নেই। তুলি ওদের মধ্যে একজনকে ইঙ্গিত করে জানায় ওই লোকটিই
ভবঘুরের বেশে ওদের বাড়ির বিপরীতের পার্কে বসে ওদের বাড়ির উপরে সম্ভবতঃ নজর রাখছিল।
তুলি চেঁচিয়ে ওঠে, “ওই
দেখ, ওর হাতে দাদার রুমালটা বাঁধা, তার মানে দাদাকে ওরাই চুরি করেছে। ও পুলিশকাকু,
দাদাকে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে বোধহয়। দাদা, অ্যাই দাদা, কোথায় তুই, আমি তুলি,
দাদাআআআআআআ.........”
“তাই তো, এবার আমি সবটা
বুঝতে পারছি। এই লোকটির হাত কোনোভাবে কেটে গেছিল, আর সে ভোম্বলের রুমালটাই হাতের
কাছে পেয়ে ক্ষতটা বেঁধেছিল, আর সঙ্গে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছিল। ভুলো পার্কে ঘুরতে
ঘুরতে ওর গা থেকে ভোম্বলের গন্ধ পেয়েই ওর পিছু নিয়েছিল, আর যার এই ফল।”
একটা কুকুরের মুখে একটা
চাবির গোছা, সম্ভবতঃ আহতদেরই কারও কাছ থেকে উদ্ধার করেছে। ওরা চাবি নিয়ে ঘর খুলে
দেখে, দুটি ছেলে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় বন্দি রয়েছে, সম্ভবত ঘুমের ওষুধের ঘোরে অচেতন।
ওদের একজনই ভোম্বল। ওদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে, প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে, ছেলেধরাদের
ব্যবস্থা করে, এসে হাজির হলেন ভোম্বলের পাড়ায়। ভোম্বলের বক্তব্য অনুযায়ী -
স্কুল থেকে ফেরার পথে
পাড়ার মাঠের সামনে থেকে একটা ওমনিতে দু’জন মুখোশ পরা লোক ভোম্বলকে উঠিয়ে নেয়। ভুলো
কোনও কারণে তখন পাড়ায় ছিল না, সারা পাড়া তখন নিস্তব্ধ। ভোম্বলকে ক্লোরোফর্ম করার
আগেই ওর সঙ্গে কিছুটা ধ্বস্তাধস্তি হয়, সেইসময় ভোম্বল ওই ভবঘুরে লোকটির হাতে কামড়ে
দেয়। অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখেছিল, লোকটি ভোম্বলের পকেট থেকে রুমাল
বার করে হাত বাঁধছে আর গালি দিচ্ছে ওকে।”
পরিশিষ্ট
কলকাতা শহরের রাস্তায়
রাস্তায়, পাড়ায় পাড়ায়, পরম অবজ্ঞায় আর নিতান্ত অনাদরে, মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বা
কোনও কোনোদিন উপবাসে বেড়ে ওঠা মানুষের আদি অনন্তকালের পরম বিশ্বস্ত সঙ্গী কুকুর,
বারংবার এই শহরকে ঋণী করে তুলেছে তাঁদের কাছে। কখনও রুখে দিয়েছে, বড়ো কোনও ডাকাতি
কিম্বা জঙ্গি কার্যকলাপ। আবার কখনও, সে পরিত্যক্ত শিশুকন্যাকে মায়ের মতো নিজের
বুকের দুধ খাওয়াতেও কুণ্ঠিত হয়নি। কখনও আবার লুকিয়ে রাখা বোমা টেনে বার করতে গিয়ে
ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কখনও সাপের কামড়ের হাত থেকে ছোট্ট শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে
সাপের বিষে নিজে নীল হয়ে গিয়েছে। আততায়ীর অতর্কিত আঘাতের হাত থেকে মনিবকে বাঁচাতে
গিয়ে সমস্ত ছুরির আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে মৃত্যুবরণও করেছে। তবে, অতীতের সবকিছুকে
ছাপিয়ে, সামান্য নেড়ি কুকুরের দলের এমন সংঘবদ্ধ এবং বুদ্ধিমান পদক্ষেপ, ভুলোর
নেতৃত্বে কলকাতা দেখল এই প্রথম। রাজ্যপালের হাত থেকে ভুলো আর তার দলবলের তরফে, ভোম্বল
যখন সাহসিকতার পুরষ্কার নিচ্ছে, সারা পাড়া তখন চেঁচাচ্ছে হিপ হিপ হুররে। কিন্তু এই শেষ কথা নয়,
আজ প্রমাণ হয়েছে, পাড়ার কুকুরগুলো প্রতিটা পাড়ার সম্পদ, সামান্য খাবার আর একটু
সমাদরের বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ফিরিয়ে দিতে জানে নিঃস্বার্থ
ভালোবাসা। ভুলো জিন্দাবাদ!! কোলকাতার সমস্ত সারমেয় জিন্দাবাদ!!
_____
ছবিঃ রুমেলা
দাশ
No comments:
Post a Comment