জাদু চশমা
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
সইফুলভাই
গাড়ির গতিটা একেবারে কমিয়ে এনে ডানদিকে হাত দেখিয়ে কিছু একটা বলল। কানে
ইয়ারফোন গোঁজা ছিল বলে কথাটা শুনতে পেলাম না। ইয়ারফোনটা
খুলে বললাম, “কিছু বললে সইফুলভাই?”
সইফুলভাই
একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, “এই যে ডানদিকের
রাস্তাটা দেখছ অঙ্কুশদা, ওইখানটা দিয়ে
ডানদিকে গেলে দারকেশ্বর নদীর একটা বাঁক আছে। তোমার কম্পিউটারে
যে ছবিটা লাগিয়ে রেখেছ, সেটা ওখানেই
তুলেছিলাম। ওখানেই শিমুল গাছটা আছে।”
সইফুলভাই
আমাদের অফিসের গাড়ির পুরোনো ড্রাইভার। বয়সে আমার চেয়ে
খানিকটা বড়ো। আমি অনেকবার বারণ করা সত্ত্বেও আমাকে ‘অঙ্কুশদা’ বলে সম্বোধন
করে। তবে আমাদের সম্পর্কটা একেবারে বন্ধুর
মতো। সইফুলভাইয়ের একটা নেশা আছে। ছবি
তোলার নেশা। ছবি তোলার জন্য সইফুলভাইয়ের কাছে কোনও
দামি ডিএসএলআর ক্যামেরা নেই। একটা সাধারণ
স্মার্টফোন আছে। সইফুলভাই প্রমাণ করে দিয়েছে ভালো ছবি
তোলার জন্য দামি ডিএসআলআর ক্যামেরা নয়, চোখটাই আসল।
আমাদের
অফিসে একটা ফটোগ্রাফি ক্লাব আছে। প্রতিবছর তারা
একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। গত কয়েক বছর
ধরে সেই প্রতিযোগিতায় সইফুল ভাইয়ের ফার্স্ট প্রাইজ একদম
বাঁধা। সইফুলভাইয়ের প্রিয় বিষয় হচ্ছে প্রকৃতি আর যেহেতু ওর পেশা হচ্ছে গাড়ি চালানো, তাই পশ্চিমবঙ্গের নানান জায়গায় যাওয়ার ওর সুযোগ
ঘটে। যেখানেই যায় দুর্দান্ত সব ছবি তোলে। তবে এবার যে
ছবিটার জন্য সইফুলভাই ফার্স্ট প্রাইজ
পেয়েছে, সেটা যেন সেরার সেরা।
সইফুলভাই ছবিটা গত মার্চ মাসে তুলেছিল। সবুজ খেতের মধ্য
দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে একটা নদী। নীল আকাশ। একটা শিমুল গাছ। সেটা লাল শিমুল ফুলে ভরে রয়েছে। অসাধারণ সব রঙের
ছটা ছড়ানো ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। সইফুলভাইয়ের
কাছে ছবিটা আমি চেয়ে নিয়ে অফিসের পিসি’র ডেস্কটপে ওয়াল পেপার করে রেখেছি। যখনই খুব স্ট্রেসড
হয়ে যাই, ওই ওয়াল পেপারটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে
থেকে সব ক্লান্তি দূর করি। সইফুলভাইয়ের সঙ্গে ছবি তোলার জায়গাটা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। নদীটার নাম জেনেছি, দারকেশ্বর। সইফুলভাই
প্রশংসা শুনে বিনয় করে বলে, ছবিটা তোলার
মধ্যে ওর কোনও কৃতিত্ব নেই, কিছু কিছু জায়গায় ম্যাজিক থাকে। শুধুই ম্যাজিক। সেই থেকে
অনেকবার সইফুলভাইকে
বলেছি, কখনও সুযোগ হলে জায়গাটায়
নিয়ে গিয়ে দেখাতে।
সেই সুযোগটাই আজ আচমকা হয়ে গেল। বাঁকুড়ায় এসেছিলাম
অফিসের কাজে। বিষ্ণুপুর – দুর্গাপুর
হয়ে কলকাতায় ফিরছিলাম। তার মধ্যেই সইফুলভাই জায়গাটার কথা বলে বলল, “দেখবে নাকি ওখানটা?”
আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই। চল, চল। তোমাকে কবে থেকে বলে রেখেছি।”
গাড়িটা বড়ো রাস্তা থেকে ডানদিকে ঘোরাল সইফুলভাই। দুপুর গড়িয়ে
বিকেল হয়ে আসছে। আকাশে এক কোণে কালো মেঘ ভেসে আছে বলে আলোর তেজ কম। জায়গাটা নির্জন। দূরে কয়েকটা
গ্রাম দেখা যাচ্ছে। দু’দিকে ধানখেতের মধ্যে
লাল কাঁকর বিছানো রাস্তা। তাতে গাড়ির চাকার মসমসে আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। কিছুক্ষণ যাওয়ার
পর রাস্তাটা দু’দিকে ভাগ হয়ে গেল। তার একদিকে গাড়িটা
থামিয়ে সইফুলভাই বলল, “এবার একটু হেঁটে যেতে
হবে। সামনে একটা সাঁকো আছে। সেটা পেরিয়ে
পাঁচ মিনিট।”
গাড়ির থেকে নেমে সরু একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে একটা খালের
ওপর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে কিছুক্ষণের
মধ্যেই পৌঁছে গেলাম দারকেশ্বর নদীর ধারে। তারপর শিমুল
গাছটার কাছে এসে বুঝতে অসুবিধা হল না এই সেই জায়গা যার ছবি ধরা আছে আমার ডেস্কটপে। তবে সেই ছবির
সঙ্গে চাক্ষুষ যা দেখছি তার কোনও মিল নেই। সইফুলভাই ছবিটা তুলেছিল মার্চ মাসে। তখন শিমুল গাছটায়
লাল ফুলে ভর্তি। এখন সেপ্টেম্বর, গাছটায় শুধু সবুজ পাতা। দারকেশ্বর নদীটা ছিল সরু আঁকাবাঁকা। এখন বর্ষার জলে
নদীটা ফুলেফেঁপে রয়েছে। এত অমিলের মধ্যে অবশ্য নতুন জিনিসও একটা আছে, নদীর এপারে ওপারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু কাশ
ফুলের গাছ। সাদা কাশ ফুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।
নদীর ধারে দেখলাম কয়েকটা হোগলার ছাউনি। সেগুলোর তলায় ইঁটের বেদী। সইফুলভাই জানাল, জায়গাটা একটা পিকনিক স্পট। শীতকালে অনেকে চড়ুইভাতি করতে আসে। আমি একটা হোগলার তলায় বেদীতে বসলাম। সইফুলভাই দেখলাম মোবাইল বার করে ছবি না তুলে একটু উসখুস করতে
থাকল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখানে কিছুক্ষণ বসতে চাও অঙ্কুশদা? আমি তাহলে একটু ঘুরে আসব?”
“কোথায়?”
“এই তো পাশের গ্রামটায়। হীরেনদার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।”
আমার কোনও আপত্তি হল না। তবে হীরেনদা নামটা শুনে আমার কীরকম একটা মনে হল। এই নামটা কোথায় যেন শুনেছি। কার যেন নাম। মনে করতে পারলাম না। সইফুলভাইকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “হীরেনদা কে?”
“এই তো এখানকারই মানুষ। ট্রেনে আলাপ হয়েছিল। হীরেনদাই তো আমাকে এই জায়গাটা
চিনিয়েছিল। এখানে ছবি তুলে কত
সম্মান-পুরস্কার পেলাম। হীরেনদা শুনে খুব খুশি হয়েছিল। বলেছিল, এদিকে এলে
যেন দেখা করে যাই।”
হেসে বললাম, “যাও।”
আসলে সইফুলভাই যতই সজ্জন মানুষ হোক না কেন, এই জায়গাটাকে উপভোগ করতে আমিও একটু একা থাকতে
চাইছিলাম। সইফুলভাই চলে যেতেই আমি ইয়ারফোনটা
কানে লাগিয়ে মোবাইলে আমার প্রিয় গান শুনতে শুরু করলাম। গানের সঙ্গে চারদিকটা দেখতে দেখতে মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে উঠতে
লাগল।
আকাশের আলোটা আরও কমে আসছিল। কালো মেঘটা একটু একটু করে আকাশটাকে আরও ছেয়ে ফেলছে। একটা ভিজে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। কোথাও হয়তো বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে একজন মানুষ কাঁধে লম্বামতো কিছু একটা নিয়ে
নদীর ধার বরাবর হন হন করে হেঁটে আসছে। মানুষটা আরেকটু কাছে আসতে
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। মানুষটার কাঁধে লম্বা জিনিসটা
আমার খুব চেনা।
লম্বা লাঠিটা থেকে ঝুলছে নানানরকম খেলনা। প্লাস্টিকের পুতুল, ভেঁপু, টিক-টাক-টো, ক্যালিডিওস্কোপ, হাওয়ায় ঘোরা
পাখা, রাংতার টুপি ইত্যাদি। আর তখনই মনে পড়ে গেল ‘হীরেন’ নামটা। আমি যখন প্লে-স্কুলে পড়তাম, তখন স্কুলের বাইরে হীরেনকাকা বলে একজন
ছিলেন, তিনি স্কুলের বাইরে ঠিক কাঁধে এরকম একটা লাঠি নিয়ে খেলনাপাতি
বিক্রি করতেন। আমাদের রোজ ওর কাছ থেকে জিনিস
কিনতে ইচ্ছে করত। মা মাঝে মাঝে কিনে দিত। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই কিনে দিত না, অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে বলে। সে দিনগুলোয় আমি খুব মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
খেলনাপাতিগুলো আর নামটা মনে থাকলেও হীরেনকাকার মুখটা কেমন একদমই
মনে নেই। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে
শুরু করল। তার মধ্যেই উঠে গিয়ে মানুষটার
সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “আপনি কি হীরেনকাকা?”
মানুষটার চোখে একটা ঘোলাটে চশমা। আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “তুমি অঙ্কুশ না?”
আশ্চর্য! বাইশ বছর
আগে আমি প্লে-স্কুলে পড়তাম। হীরেনকাকা এখনও নাম মনে রেখেছেন আমার? তাছাড়া তিন বছরের
আমার মুখের সঙ্গে আজকের আমার মুখের কোনও মিল আছে নাকি? হীরেনকাকা আমার মনের কথাটা যেন পড়ে নিয়ে বললেন,
“আছে। আছে। আমার এই চশমাটা দেখছ, ভাবছ এই ঘোলাটে চশমার কাচ দিয়ে আমি কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু এই চশমাটা জাদুচশমা। এই চশমা দিয়ে আমি তোমার কচি মুখটা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। এই নাও সেই টিভিটা। তোমার মা এটা কিনে দেননি
বলে তোমার খুব অভিমান হয়েছিল।”
হীরেনকাকা লাঠিতে ঝোলনো একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের টিভি বার
করে আমার হাতে দিলেন। টিভিটার মাথায় দু’দিকে দুটো
রোলার। সেগুলো ঘোরালে স্ক্রিনের
ওপর দিয়ে একেকটা ছাপানো ছবি সরে সরে যায়। কোনওটা বাঘের ছবি, কোনওটা টিয়াপাখি বা ময়ূরের। মনে পড়ে গেল পুষ্পল হীরেনকাকার কাছ থেকে এরকম একটা টিভি কিনেছিল। ক্লাসে দেখাত। আমি খুব বায়না ধরেছিলাম মায়ের
কাছে এরকম একটা টিভি কিনে দেওয়ার জন্য। মা দেয়নি। সত্যিই খুব অভিমান হয়েছিল। তাই আর কোনোদিন মায়ের কাছে ওটা কিনে দেওয়ার বায়না করিনি। স্কুল থেকে বেরোনোর সময় রোজ হীরেনকাকার লাঠিতে ঝোলানো এই টিভিটা
দেখতাম আর ভাবতাম, বড়ো হয়ে যখন মায়ের
মতো চাকরি করব, তখন নিজেই এই টিভিটা ঠিক কিনব।
টিভিটা হাতে নিয়ে আশ্চর্য এক অনুভূতি হল। আবেগতাড়িত গলায় হীরেনকাকাকে বললাম, “এত দিন ধরে এই টিভিটা এখনও বিক্রি হয়নি?”
ব্যথিত মুখ করে হীরেনকাকা বললেন, “আজকাল বাচ্চারা আর এসব খেলনা কেনে কই?
সবাই এখন মোবাইল ফোন নিয়ে খেলে। এই টিভিটায় তো মাত্র দশটা স্থির পশুপাখির ছবি। মোবাইলে কত লক্ষ লক্ষ ছবি, গান, সিনেমা। আমরা সবাই তাই এখানে চলে এসেছি।”
“সবাই মানে?”
“ছোটো স্কুলের পর তোমরা বড়ো স্কুলে গেলে। তোমার বড়ো স্কুলের সামনে কারা আলুকাবলি, বিটনুন মাখানো শুকনো কুল, কুল্ফি মালাই বিক্রি করত মনে নেই?”
“মনে আছে। সুরেনদা, রামপেয়ারীদা, খোকাদা…”
“ওই দ্যাখো ওদের…”
টিপটিপে বৃষ্টিটা পড়েই চলেছে। আকাশটা কালো মেঘ আরও ঢেকে ফেলেছে। কালো মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে সাদা কাশ ফুলগুলোর ওপর সূর্যাস্ত হতে
চলা কমলা রঙের আলোর ফলা পড়ছে। এরকম কমলা রোদ – বৃষ্টি - কালো মেঘের প্রকৃতির
খেলা আমি কখনও দেখিনি। ভেজা হাওয়াটা ক্রমশ আরও জোরালো
হচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে মুখে। কাশ ফুলগুলো দুলে দুলে ঢেউ তুলছে। হীরেনকাকার লাঠির ওপর ঝোলানো খেলনাগুলোও দোল খেতে খেতে টুং-টাং আওয়াজ করছে। তার মধ্যেই হীরেনকাকা যেদিকে দেখালেন সেদিকে দেখলাম দূরে নদীর
চর দিয়ে তিনজন মানুষ হন হন করে এদিকে এগিয়ে আসছেন। তাদের কারও মাথায় হাঁড়ি, কারও মাথায় ডেকচি, কারও মাথায় কাচের বাক্স।
হীরেনকাকার মুখটা মনে না থাকলেও কাছে আসতে বাকি তিনজনকে চিনে
নিতে আমার একটুও অসুবিধা হল না। সুরেনদা, রামপেয়ারীদা, খোকাদা। আমাদের স্কুলের সামনে বসত। তিনজনের মুখেই শুধু একটা পরিবর্তন হয়েছে। হীরেনকাকার মতো ঘোলাটে কাচের চশমা পরে রয়েছে সবাই।
“অঙ্কুশ না?” তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল।
অবাক বিস্ময়ে বললাম, “তোমরাও আমার নাম মনে রেখেছ? তোমাদের চোখেও কি জাদুচশমা?”
তিনজনেই হাসল। হীরেনকাকা ব্যস্ত হয়ে বলে
উঠলেন, “তোমরা কথা বল। আমি তাহলে যাই। বৃষ্টিটা জোরে আসছে। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার একটা ছবি তুলে রাখি।”
মোবাইলটা বার করে হীরেনকাকার একটা ছবি তুললাম। তারপর উনি যেরকম হন হন করে এসেছিলেন সেরকমই হন হন করে এগিয়ে
যেতে থাকলেন। টিপটিপে বৃষ্টিটা ক্রমশ বাড়ছে। সোঁ সোঁ করে হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু সে সব উপেক্ষা করে ততক্ষণে সুরেনদা, রামপেয়ারীদা, খোকাদা আমার
সামনে ওদের পসরা সাজিয়ে ফেলেছে। আলুকাবলি, বিটনুন মাখানো শুকনো কুল, কুল্ফি মালাই। সুরেনদা ডেকচি থেকে আলুকাবলি বার করে একটা শালপাতায় আমাকে দিল।
শালপাতা থেকে কাঠি দিয়ে একটুকরো আলু মুখে দিতেই আমার চোখ দুটো
আপনা থেকে বুজে এল। আঃ! কী স্বাদ। মা কোনোদিন আমাকে এই আলুকাবলি খেতে দিত না। বলত ব্যাকটেরিয়া কিল্বিল্ করছে। শৈবালের কাছ থেকে নিয়ে মাঝে মাঝে লুকিয়ে খেতাম আর ভাবতাম বড়ো
হয়ে যখন মায়ের মতো চাকরি করব রোজ সুরেনদার কাছে আলুকাবলি, রামপেয়ারীদার
কাচের বয়ামের সব কুল, আচার, তেঁতুলবড়ি, খোকাদার কুল্ফি মালাই শুধু কিনে কিনে খাব।
আমি ওঁদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমরা এখনও এইসব বিক্রি কর?”
তিনজনেই মুখ ছোটো করে বলল, “আজকাল শহরের বাচ্চারা আর এসব খায় না। সবাই প্যাকেটের
চিপস, মুরগি ভাজা, দোকানের আইসক্রিম খেতে চায়। তাই এদিকে চলে
এসেছি। এদিকেও বিক্রি কমে আসছে। তবু আমরা রোজ ফেরি করতে বেরোই। যদি তোমার মতো
কাউকে দেখতে পাই।”
কী যে আনন্দ হচ্ছিল ওদের দেখে! বললাম, “দাঁড়াও তোমাদের
সঙ্গে একটা ছবি তুলি।”
ছবি তোলা শেষ হতে না হতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিটা ঝর ঝর করে পড়তে
আরম্ভ করল। সুরেনদা, রামপেয়ারীদা,
খোকাদা
তাড়াতাড়ি নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। তারমধ্যেই রামপেয়ারীদা আর খোকাদা
আমাকে বিটনুন মাখানো শুকনো কুল আর কুল্ফি মালাই দিল। হীরেনকাকা যেদিকে
গিয়েছিল নদীর চর দিয়ে সেদিকেই হন হন করে
হেঁটে যেতে থাকল।
ঝরঝরে বৃষ্টিটা আস্তে আস্তে ঝম ঝম করে
নামতে থাকল। সেইসঙ্গে ঝড় উঠল। দারকেশ্বরের জল উথালপাথাল হতে আরম্ভ করল। আমি হোগলার তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই
বৃষ্টির সঙ্গে এমন ঝড়ের তেজ বাড়ল যে দু‘হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
হোগলার তলাতে দাঁড়িয়ে ঝড়বৃষ্টি থেকে কোনোরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে
থাকলাম। তার ওপর অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে থাকল। আমি চুপ করে অসহায় দাঁড়িয়ে
আছি। বৃষ্টিটা কমলে নিশ্চয়ই সইফুলভাই আসবে।
একটু পরে টর্চ হাতে একজনকে সঙ্গে নিয়ে সইফুলভাইকে দৌড়ে দৌড়ে আসতে দেখলাম। তবে যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেই দিক দিয়ে নয়, নদীর ধার দিয়ে। জুবজুবে ভিজে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সইফুলভাই বলল, “তুমি ঠিক আছ তো অঙ্কুশদা? কী বিপত্তি বল তো, বাঁশের সাঁকোটা ঝড়ে ভেঙে যাওয়াতে অনেক ঘুরে আসতে হল। এদিকে মোবাইলে কিছুতেই টাওয়ার পাচ্ছি না যে তোমাকে বলব। ভাগ্যিস হীরেনদা ছিলেন।” সঙ্গের ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সইফুলভাই বলল, “এই, এনার বাড়িই গিয়েছিলাম।”
না, নাম এক হলেও, উনি আমার হীরেনকাকা নন। এই হীরেনবাবু কাঁধের থেকে গামছাটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, “নিন, আপনার চশমাটা আগে মুছে নিন। জলের ফোঁটায় ভর্তি হয়ে একেবারে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে।”
বৃষ্টিটা থামল। দারকেশ্বরের পার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির দিকে ফিরতে থাকলাম। এক ফাঁকে মোবাইল বার করে হীরেনকাকা, সুরেনদাদের
ছবিগুলো দেখতে খুললাম। কিন্তু সেই ছবিগুলোতে ওরা
কেউ নেই। তার বদলে আছে অদ্ভুত সুন্দর
খেয়ালি প্রকৃতির ছবি। ঠিক সইফুলভাই যেরকম তোলে। ঠিকই বলে সইফুলভাই। কিছু কিছু জায়গায় ম্যাজিক
থাকে। শুধুই ম্যাজিক।
_____
ছবিঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
অসামান্য! অনেকদিন পর এমন মন কেমন করা গল্প পড়লাম। সত্যি, ছোটবেলায় কত ভাবতাম বড় হয়ে এটা করব ওটা করব। তখন কি আর জানতাম বড় হয়ে গেলে আর সেসব করা যায় না!
ReplyDeleteআহা যদি একটা জাদু চশমা পাওয়া যেত।
ReplyDeleteশুধুই ম্যাজিক
ReplyDeleteসত্যিই অনেক ভালো লাগলো
ReplyDelete