পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়…
প্রদীপ্ত ভক্ত
প্রজেক্টের চাপে চেপটে যাচ্ছি অবস্থা। রোজ সাড়ে দশটায় অফিস ঢুকছি আর
রাতে ফিরে শুতে যাচ্ছি দুটোর পর। শনিবারেও অফিস আছে, কিন্তু ওই ‘খেয়াল পোকা যখন আমার মাথায় নড়ে
চড়ে, আমার তাসের ঘরের বসতি হায় ওমনি ভেঙে পড়ে... ।’ মার্চ মাসে রেটিং ব্যান্ড এর
তোয়াক্কা না করেই ম্যানেজারের সঙ্গে বাওয়াল করে বেরিয়ে গেছি।
অনেকদিন পর ড্রাইভারের বদলে খালাসী। বড়ো উঁচু নন এসি গাড়িতে মজা হল হাওয়া খুব লাগবে কিন্তু বিরক্ত
করবে না। পানাগড় অবধি
রাস্তার দু’পাশ
চোখ জুড়ানো, দূরে
দূরে খেজুর গাছ, একটা মেঠো রাস্তায় হঠাৎ কুঁড়েঘর, সবুজ ধানের ক্ষেতে জল সেঁচা
চলছে, একটা গরুর পিঠে বক বসে আরাম করছে... হু হু করে ছিটকে আসছে হাওয়া,
পিছনের সিটের কথাবার্তা।
রুক্ষ পাথর ছড়ানো ছিটোনো টিলার থেকে একটু উঁচু এই পাহাড়গুলো
বড়ো ভালো লাগে।
জঙ্গল আছে, গাছ পালা ছাওয়া রাস্তা, তবুও মোলায়েম না বলেই রুক্ষতা এসে যায়। শাল,
মহুয়া, হরতুকি আরও কী কী যেন গাছের জঙ্গল। পলাশ আছে তবে
পাহাড়টায় না, পাহাড়ের কোলে। দুপুরের রোদে সবাই জিরিয়ে নিচ্ছে, ড্যামের জলে চান
সারছে কেউ কেউ। এ রোদে টই টই করতে হলে ভালো ছিট দরকার। দলের বাকিরা ঘুমোতে
গেল। দ্বৈপায়ন
আরও সরেস, ও নাকি এসব ছোটো পাহাড়ে এনার্জি ইনভেস্ট করে না!
আমি আর সৌরভ পাহাড়টায় ওঠা শুরু করলাম। বড়ন্তি পাহাড় একেবারেই অকৌলীন। তেমন তেমন
পাহাড় চড়িয়েদের কাছে, একে পাহাড় বললে হয়তো মেরেই দেবে। কিন্তু আমাদের কাছে এইই কম
না।
রাস্তা নেই, কারণ পাহাড় চূড়ায় কিছু নেই, বড়ো বড়ো পাথর টপকে টপকে যাচ্ছি, কাঁটা
গাছও আছে অনেক, একটা মাছি সমানে ভোঁ ভোঁ করে তার প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে, “কেন হে দু পেয়ের দল, এদিকে কী? বিরক্ত কোরো না বাপু...” ইত্যাদি বলে।
বাতাসে গরমকালের গন্ধ। গরমকালের গন্ধ মানে রোদের তাতে
চারদিকটা শুকনো হাওয়া দেবে, ঝিম ধরা দুপুরে দূরের থেকে ঘু ঘু ডাকবে, পাগলা কোকিলটা
ডেকেই যাবে ডেকেই যাবে.... আর মন-টন কেমন একটা এলোমেলো হয়ে যাবে। এইখানে গাছে উই
ধরেছে খুব। এদিক ওদিক উই-এর গর্ত না সাপের জানি না। একটা গিরগিটি লাল লাল মাতাল
চোখে টহলে বেরিয়েছে, একটা পাথরে ঝুলে ঝুলে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করছে দেখি
ব্যাটা, গা-টা
পাথর রঙের।
পাহাড় যারা চড়ে, পথ যারা ভালোবাসে তারা জানে গন্তব্য জরুরি, খুব জরুরি, কিন্তু পথের মজাটাই আসল। অন্তত
আমি তাই বুঝি, ওই পাহাড় চড়বই টার্গেট নিয়ে ছুটে ছুটে চলে যাবার থেকে এই যে মাঝ পথে
বসে বসে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা বুকের মধ্যে পুরে নিচ্ছি এইটাই চেয়েছি আমি বরাবর। আমার
এই ঘর ছেড়ে পালাবার নেশা, ঘর না বাঁধার নেশা, এ সব কোনও এক গরমকালের দুপুরই ঢুকিয়ে
দিয়েছিল
বুকের মাঝে, সেই থেকেই আর ঘরে মন টেকে না।
বসে থেকে থেকে ঘুম এসে যাচ্ছিল, এমন গাছের নীচে, পাথরের
উপর আরাম করে ঘুমাবার জো নেই, শোয়ার মতো উপযুক্ত নয় পাথরগুলো। খানিকক্ষণ বসে থেকে
ফের মচমচ শব্দ তুলে নেমে এলাম, বাঁধের ওদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে কোথায় যেন। কাল
আসার পথে দামোদরের ধারে নেমেছিলাম। ভুল করেই আঘাটায় নেমে গেছিলাম। শ্মশানঘাট আসলে।
নদীর ধারে ইতস্তত প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া জামা কাপড়, নদীর জলে পাড়ের কাছেই অর্ধেক গল্পেই ফুরিয়ে যাওয়া ভাঙা চুড়ি, ভাঙা মালসা।
মন খারাপ হয় না,
সে হয়তো দলবল মিলে গেছি বলেই, কিন্তু মনটা ভারী কেমন একরকম হয়ে যায়। লাল এই
চুড়িখানা হয়তো কোনও
একদিন ভাতের হাঁড়ির সামনে বসে গুনগুন করে অপেক্ষা করত, আজ শান্ত হয়ে জলের নীচে
শুয়ে, মন খারাপ করে চুড়ির?
বাঁধের ওই পার থেকে সুর্যাস্ত ভালো দেখা যায় নাকি, আমরা ওই
দিকে হাঁটা দিলাম, রোদের তেজ কমেছে একটু। স্থানীয় একজন আধবুড়ি মহিলা, মাথায় গোবর
সারের ঝাঁকা নিয়ে হনহন করে যাচ্ছে। আমার যেমন স্বভাব, গিয়ে আলাপ শুরু করেছি। কোথায়
যাচ্ছে, কতদূরে ওর বাড়ি, খেতে যে সবজি ফলিয়েছ তা পাখিতে খেয়ে নেয় কিনা... এইসব। সেও আমায় জিজ্ঞেস করে,
কোথায় বাড়ি,
কোথায় উঠেছি। কথার পিঠেই জিজ্ঞেস করে, আমাদের ওদিকে ‘দমে’ পাখি কিনা। দমে কথাটা কতরকম
প্রয়োগ রে বাবা, দমে রান্না বসানো, দম থাকা, আচ্ছা দমদম মানে কি খুব করে দম দেওয়া
জায়গা?
ওদিকে পাশের কয়লা খাদান থেকে কয়লার বস্তা নিয়ে আসা লোকগুলো
স্নান করতে নেমেছে বাঁধের জলে। সাইকেলগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছে। বিকেলবেলার
ঠান্ডা আরামের হাওয়া মেখে মেখে উদোম গায়ে খুব সাবান মেখে মেখে চান করছে। ভারী
হিংসে হয় দেখলে, শহুরে আমি কোনোদিন এরকম আড়ালহীন হয়ে, নিঃসঙ্কোচ হয়ে চান করতে পারব
বলে মনে হয় না। এরপর কী করবে এরা? কোথায় যাবে? এদের মধ্যে বাঁশী বাজিয়ে কেউ আছে
কি?
এ জায়গাটা আজকাল লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে, একটু দূরে
তফাতে বসেছিলাম। এই জায়গাটায় লোক নামে না জলে, তাই পাথরগুলো শ্যাওলা জমে মখমলের চাদর
জড়িয়ে শুয়ে আছে। চুপ করে পা ডুবিয়ে বসে আছি, তিরতির করে জল কাঁপছে, কলকে ফুলের
গাছটা জল ছুঁয়ে শুয়ে আরাম করছে। আমি রাজা হলে এখানে ঠিক একখান হাওয়ামহল বানাতাম।
আমার সবচেয়ে প্রিয় সাদা আর কালো ঘোড়ার মধ্যে একেকবার একেক ঘোড়া নিতাম। মন যখন বেশ
উড়িয়ে ফুরিয়ে দেবার মতো টগবগে তখন কালো ঘোড়া খানা নিতাম, আর যখন উদাস হয়ে বাঁশী বাজাতে
ইচ্ছে করত রাজবেশ ছেড়ে তখন সাদা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসতাম। তারপর একদিন ঘোড়া না
থামিয়ে চলে যেতাম অচেনা কোনও জায়গায়, রাজার সাজ ফেলে বেশ একটা অচেনা জায়গায়।
অনেক অনেকক্ষণ পর, লোকজনওলা জায়গাটায় গিয়ে দেখি, সৌরভ মনের সুখে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে আর
চারদিকে কাচ্চা-বাচ্চা
মিলিয়ে সরগরম হয়ে গেছে জায়গাটা। বেজায় আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। পকেটে ওয়ালেট নেই, ফোন, ক্যামেরাও
নেই যে বন্ধক
রেখে আইসক্রিম খাব। সৌরভের কাছেও নেই, সুতরাং ফের বাঁধের জলে পা ডুবিয়ে ছোটো ছোটো মাছগুলোকে পায়ে ঠুকরোতে দেওয়া
গেল। আস্তে আস্তে সূর্য লাল টুকটুকে হয়ে গেল আর টুপ করে ডুবে গেল।
দলের বাকিরা আসার পর যা হয়, ঠাট্টাতামাশা করতে করতে,
অন্ধকার নেমে এল। দলবেঁধে বাঁধের পাড়ে হাঁটতে শুরু করেছি। ওদিকে একফালি চাঁদ উঠেছে
আকাশে, তারা ফুটতে শুরু করেছে, বাঁধের জলে ঠান্ডা হয়ে হাওয়াটাও রুক্ষতা হারিয়ে
ফেলেছে বেশ। আমি দলছুট হয়ে এগিয়ে গেছি খানিক, পিছনের হাসাহাসির টুকরো, দূর থেকে
ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ, সব জড়িয়ে মড়িয়ে একটা অবয়ব তৈরি হয়েছে। সাইকেলে চলে যাওয়া লোক, ‘সোলার’ আলোর আবছায়া, ঝিঁঝির ডাক সব যেন
সে অবয়বের অংশ।
ফিরতি পথে সৌরভ, রিমা, অমিতা, আমি একসঙ্গে, গান, আড্ডা, ইয়ার্কি সবই হচ্ছে, কিন্তু তবু যেন আমি কিছু ছুঁতে
পারছি না, এ সব থেকে আলাদা হয়ে পাহাড়খানা চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে, ওইখানে মনে হচ্ছে যাই। ছায়া
ছায়া পাহাড়, চাঁদের আলো ওইখানটা অন্য ডাইমেনশন মনে হচ্ছে। যেন কারা কথা বলে চলেছে
ফিসফিসিয়ে,
আমরা গেলেই চুপ করে যায় তারা।
জনাসাতেক ছেলে মেয়ে একসঙ্গে হলে যা হয় আর কি, তারমধ্যে ওরা
সবাই বহুদিনের পুরোনো বন্ধু, খুব আড্ডা, খুব ফুক্কুড়ি হচ্ছে। দ্বৈপায়ন
আসর জমিয়ে দিতে পারে মোটামুটি। আমার অভ্যেসেই আমি একলা হয়ে যাই ফের, সন্ধেবেলার চাঁদের আলো বুকের মধ্যে ঢুকে
গেছে, এ বিশালের সামনে কীরকম পালাই পালাই মন করে। ছাদে গিয়ে দেখি দিব্যি
চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, আকাশে তারা ফুটে গেছে, সামনে পাহাড়টা অন্ধকারে গম্ভীরভাবে
দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে যেন। দীর্ঘদিন আগে কলোরাডোতে থাকতে এরকম রাতবিরেতে আমি
সৌরভদা,
শাওন মিলে হাইক করতে যেতাম। দূরে ডেনভার শহরের আলো দেখা যেত, আর কমলা রঙের চাঁদ
ভাসিয়ে দিত। রঞ্জন প্রসাদ
গাইছেন, ‘পথের
প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়, যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়.... মোর পথ চেয়ে আজও সেই মেয়ে, বুঝি স্বপ্নজাল বোনে গান গেয়ে’। মেয়েটা কতদিন ধরে সন্ধেবেলা আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করেছে
রাতে একসঙ্গে বসে দুটো খাবে। গল্প শোনাবে খুব ছেলেটা মনগড়া বীরত্বের কিংবা
সত্যিকারের। হয়তো ওই যে বাঁধের গায়ে যে গ্রামটা আছে ওখানেই, কয়লা খাদানে কাজ করতে
যাওয়া ছেলেটার জন্য বসে আছে। আচ্ছা আকাশে ওই তারাটা কি ধ্রুবতারা? আমার নিজেকে ভারী অন্ধ
মনে হয়, গাছ চিনি না,
পাখি চিনি না,
তারা চিনি না।
একটু পরেই হই হই করে সবাই চলে এল, “এই ছেলেটা, কী রে! এখানে চলে এসেছিস, আমরা ভাবছি কোথায় গেলি।” গান, আড্ডা চলতে থাকে.... পাহাড়টা কাল চড়তে হবে।
মেয়েগুলো পাশের ঘরে, আমরা চারজন একটা ঘরে। দ্বৈপায়ন
আর দেবরাজ দুপুরে ঘুমিয়ে নিয়েছে, সুতরাং মাথায় তাদের পোকা নড়েছে। আলো-টালো নিভিয়ে মেয়েদের ঘরে জানালায় টোকা মেরে পালিয়ে আসছে। এরা
সব ক’টা
কলেজের বন্ধু, আমার কলেজের বন্ধুরা মিলেও এরকম হুল্লোড় করতুম। আর অদ্ভুত কপাল মেয়ে
তিনটের, তিনজনেই বেজায় ভীতু, ভূতের ভয়ে অমিতা তো এমনই চেঁচিয়েছে ম্যানেজার এসে
হাজির!!
সৌরভটা আবার নাক ডাকে ছন্দে। মানে একবার খানিক পেল্লায়
জোরে হচ্ছে, আমি ভাবছি আচ্ছা এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই, একটু পরে দেখি থেমে গেছে, আবার
খানিক পর আবার শুরু! বাঁদরটার নাকে পাথর আটকে শুলেও হয়!
সকালটা ভারী সুন্দর এখানে, পলাশ ফুলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের
কোলে সকাল, একটা মোষের গাড়ি যাচ্ছে, মহুয়া ফল কুড়োতে গেছে লোকটা। আমার সেই কবে
থেকে লালটেম হবার সাধ, মোষের পিঠে চড়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াব, শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে
দেখতে বাঁশী বাজাব.... বাঁশী আমি বাজাতে পারি না, গান গাইলে ভূমিকম্প থেকে সুনামি সব হয়, তাও মোষের গাড়ি দেখে রোজ
ট্যাগ ঝুলিয়ে চৌখুপিতে
স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটা আর পারল না, ধড়াচুড়ো ছেড়ে ছোটো ছেলের মতো হাপ্প্যানুল আর গেঞ্জি
পরে মোষের পিঠে চড়ে বসল।
মোষটা খুবই প্রতিবাদ জানাল লেজ ঝাপটা দিয়ে, ‘এভাবে হয় না মশাই, দুম করে পিঠে উঠে বসলে
যে? ইয়ার্কি পায়া? আমার পিঠ চুলকায় না নাকি?’ তার প্রতিবাদকে মেনে নিয়ে নেমে
এলাম, থাক বাবা, এক্ষুনি পিঠ ঝাঁকিয়ে ফেলে দিলেই চিত্তির। ওদিকে রোদও চড়া হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে যাব, রিমা আর সৌরভ সঙ্গী
হল।
পাহাড়ের এদিকটায় রাস্তা একেবারেই নেই, পাথর টপকাতে ভারী
আরাম লাগে, সকালবেলায় পাখির কিচিরমিচিরে পাহাড়টা সরগরম। আস্তে-ধীরে করে উঠতে উঠতে মাঝপথে গিয়ে
সৌরভ হাল ছেড়ে দিল, যা ভাই তোরা, আর হবে না। রিমার জুতোটা একটু গোলমেলে, পাথর চড়ার
উপযুক্ত না ঠিক, তা পাথর তো কেউই জুতোয় ডিঙোয় না, ইচ্ছের উপরেই সব। সুতরাং ওঠাই
সাব্যস্ত হল। একেক জায়গায়
পাথরগুলো এমন খাড়াই, মনে হচ্ছে হবে না, কাছে গেলে অবশ্য ঠিক ডিঙোনোর রাস্তা
মিলে যাচ্ছে। আমাদের সব রাস্তাই আসলে তাই, দূর থেকে মনে হয় এ বুঝি আর পারব না, কাছে
গেলে এক-দু
পা করে কীরকম
করে যেন ঠিক হয়ে যায়।
প্রতিটা ধাপ পেরিয়ে ভাবছি আর উঠব না, জাস্ট পরের ধাপটুকু, আসলে এ
এক নেশার মতো, উপরে ওঠার নেশা, চূড়ায় পৌঁছোনোর নেশা বড়ো তীব্র। তাছাড়া হাইক করতে আলাদা
একটা আনন্দ হয়,
ও ঠিক বোঝানো যাবে না। ফাঁদ সরিয়ে কাঁটা গাছে ঠোকর খেয়ে, ধুলো মেখে, পা স্লিপ
করে এগিয়ে যেতে যেতে পাখির ডাক, গাছের ছায়া জড়িয়ে রাখে।
উঠেই পড়লাম শেষতক। পাহাড়টার এই দিকের ঢালটা একটু বেশি রুক্ষ গম্ভীর, ওই দিকটা বেশি সবুজ। আরে, তাই এত চেনা লাগছিল, পাহাড়টা
আসলে আমার মতোই। নীচ থেকে স্পীকারের আওয়াজ আসছে। বিরক্ত করছে। এরা কেন বোঝে না,
এরকম দমাদ্দম করে গান চালালে পাহাড়, আকাশ, হাওয়া, পাখি কেউ আর কথা বলে না!!
নীচে নেমে এসেছি। একটা বুড়ি লগা দিয়ে বটপাতা পাড়ছে
ছাগলকে দেবে বলে। আমি হাত লাগিয়ে দিলাম, প্রথমে আমায় দেখে কনফিডেন্স পাচ্ছিল না, কিন্তু তারপর একটা ছোটো ডালসমেত ভেঙে দিতে ভরসা পেল।
আমাকে মহুয়া গাছ চিনিয়ে দিল, হরতুকি গাছও। একটু এগিয়ে গেছি, অমনি দেখি হরতুকি গাছটা মাথা
নেড়ে একটা হরতুকি গিফট করল। আমি চাইনি সত্যি, কিন্তু ভালোবাসা অগ্রাহ্য করতে এ
শর্মা পারেন কই, ঝুলি
ভরে মাধুকরী করে দিন কাটে। গাছ, মানুষ সব্বার ভালোবাসা নিয়ে পথ চলি। পকেট
আমার বোঝাই হয়ে যায়। ভালোবাসতে শিখলে একদিন সব ফিরিয়ে দেবো’খন। ততদিন অবধি নিয়ে যাই, ফেলে ছড়িয়ে চলতে থাকি...
মাইথনে ভাণ্ডারী পাহাড় বলে একটা এরকম ছোটো টিলা গোছের পাহাড় আছে যার উপর
একটা শিবমন্দির আছে। উপর থেকে নীচের ড্যামটা চমৎকার। পুরোহিত লোকটা সকালে এসে পুজো
করে রেঁধে বেড়ে খায়, আবার বিকেলে নেমে যায়। আমায় এমন একটা কাজ দিলে আমি পারতাম
না মনে হয়। একা লাগার থেকেও বেশি, বোরিং লাগত। অবশ্য আমি নাস্তিক, তাই হয়তো মনে হচ্ছে। এই যদি এ পাহাড়ে কেউ না উঠত পুজোর
ছলে বিরক্ত করতে, পথ ভুলে দু-একজন ছাড়া, নীচে কোল ঘেঁষে এক নদী থাকত শুয়ে, তাহলে
হয়তো আমি থেকে যেতাম কিছুদিন।
একটু আগে আমরা দল বেঁধে নৌকো চড়ে ছোট্ট চড়াটায় গেছিলাম
ড্যামের মধ্যে, সেখানে সকলে মিলে আড্ডা, হই হই, খিল্লি সব করেছি। সেও মন্দ না, আবার একা একা মুখ
বাড়িয়ে
গাড়ি থেকে ফাঁকা হাইওয়ে দেখাও মন্দ না আরকি। গাড়িতে সকলে মিলে ফুক্কুড়ি করা, এর ওর ঠ্যাং টানা, করতে করতে
দেখি বর্ধমানের কাছে ঝড় এল। রাস্তায় ঝড় দেখা এক অদ্ভুত জিনিস। একটু একটু করে মেঘ জমে দুম করে
অন্ধকার, তারপর ধুলোর ঝড়, ক্রমে সব কিছু উড়িয়ে দেবার নেশা থামলে সারেন্ডার করে অঝোর ধারায় বৃষ্টি।
গাড়ির কাচ ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমে, অন্ধকারের বুক চিড়ে করক্কড়াৎ বিদ্যুৎ-এর ঝলকানি। কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু গাড়ি থামাবার উপায় নেই। শো মাস্ট গো অন, না হলেই অন্য কেউ না দেখতে পেয়ে মেরে দিয়ে যাবে, সুতরাং চলতে
থাকো। বাকিরা ভয় পাবে বলে বলছি না কিছু, কিন্তু নিজে গাড়ি চালাই বলেই জানি এ
মুহূর্তটা কতটা চাপের। কিন্তু নির্মলদা দক্ষ চালক, সে এমনিতে ফুক্কুড়ি করে, ‘আমার আঙুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে
আছো’
চললে বলে যা গিয়ে হাত ধুয়ে আয়, কিন্তু রাস্তা থেকে একবারও চোখ ফেরায় না।
আমার বড়ো ভালো লাগছে। কী জানি কেন, যে কোনও বিপজ্জনকের নেশা দিনে দিনে পেয়ে
বসছে। রুদ্ররূপ প্রকৃতি দেখতে মজা লাগে বেশ। এই সগর্জন রোষ, একটু পর সব শান্ত, যেন কিছুই হয়নি।
তারপর
আর কি!
সব পথের শেষে সেই ঘর, হিসেব, অফিস। একদিন কি আসবেই না আর, ফিরব না ঘর, হাজার খেলনাবাটির
লোভেও?
তদ্দিনের
জন্য এরকম পালাই পালাই খেলাই চলুক....
_____
ফোটোঃ লেখক
ফাটায়েস..যথারীতি.. "মার্চ মাসে রেটিং ব্যান্ড" ওই সব জিনিস আমাদের জন্যে নয় হে প্রদীপ্ত
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ সুদীপ।
Deleteoh darun,মেয়েটা কতদিন ধরে সন্ধেবেলা আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করেছে রাতে একসঙ্গে বসে দুটো খাবে,
ReplyDeletedarun dada..khub sundor
অনেক ধন্যবাদ 😊
Delete