কাপাডোকিয়ায় সেই রাত
দেবদত্তা ব্যানার্জী
কুট্টিমামা এলেই আমাদের বাড়িতে একটা উৎসব শুরু হয়ে যায়। মায়ের এই খুড়তুতো ভাইটির বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা ও সারা পৃথিবী ঘোরার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসলে তো আর কথাই নেই।
এবার কুট্টিমামা বহুদিন পর আমাদের বাড়ি এসেছিল। আমি সবে একটা নামী ম্যাগাজিনের দপ্তরে চাকরি পেয়েছি শুনে মামা খুব খুশি। রাতের খাওয়া শেষ হতেই আমরা ছাদের ঘরে মামাকে নিয়ে জমিয়ে বসলাম।
আমি প্রথমেই বললাম, “এবার তোমার মুখ থেকে একটা সুন্দর ভ্রমণের গল্প চাই, যেটা আমাদের ম্যাগাজিনের পরের ইস্যুতে আমি লিখতে পারব। ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, এমন একটা জায়গার গল্প বলো যেটায় বাঙালি ট্যুরিস্ট কম যায়। লোকে পড়ে উপভোগ করবে এমন জায়গা।”
আমার বোন রিন্টি সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কাটল, “কুট্টিমামা পিগমিদের দেশের গল্প বা উত্তর মেরুর গল্প বলো।”
“না, না, কুট্টিদাদু, তুমি জাপান বা চায়নার গল্প বলো,” বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য ফড়িং, আমার বড়দার মেয়ের দুনিয়া সিনচেন আর ডোরেমনকে নিয়ে। তাই ওর উৎসাহ ওই দেশগুলো নিয়ে। মামা ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলল, “গল্প তো তোদের অনেক বলেছি এর আগেও!
আজ তোদের এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলব যেটা ব্যাখ্যা আমি আজও পাইনি।”
গল্পের গন্ধ পেয়ে আমরা বেশ গুছিয়ে বসলাম। মামা এক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, “কাপাডোকিয়ার নাম শুনেছিস তোরা?”
“তুর্কীর একটা হেরিটেজ সাইট, এটুকুই জানি,” রিন্টি বলে উঠল।
“ফেয়ারি চিমনি আর মাটির নিচের শহরের জন্য বিখ্যাত শুনেছি,” আমি বলে উঠলাম।
“ওটা কি পরিদের দেশ দাদু, ফেয়ারি মানে তো পরি!!” ফড়িং চোখ দুটো বড়ো করে বলল।
“ওখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা পরিদের দেশ বলে। ওরা মনে করে মাটির নিচে পরিরা থাকত। ঐ সব গুহা পরিদের তৈরি। তবে আমি ওখানে পরির দেখা পেয়েছিলাম।”
আমরা সবাই অবাক হয়ে কুট্টিমামার কথা শুনছি। বৌদিও হাতের কাজ সেরে আমাদের দলে যোগ দিয়েছে।
‘অটোমান সাম্রাজ্য যা বর্তমানে তুরস্ক, সেখানে হঠাৎ করেই গত বছর আমায় যেতে হয়েছিল একটা কাজে। শহরের কাজ মিটে যেতেই আমি ইস্তাম্বুল সাবিনা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে কাপাডোকিয়ার কায়সেরী বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। ইচ্ছা ছিল দু-দিন থেকে অঞ্চলটা ঘুরে দেখব, অবশ্য পকেটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমার এক বন্ধু ঐ অঞ্চলে একটা রিসর্টে কাজ করত। সে বলেছিল থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, লোকাল গাড়িতে বাকিটা ঘুরে নিতে। আসলে যুদ্ধের পর কাপাডোকিয়ায় পর্যটক খুব কমে গেছে। এদিকে হোটেলের খরচ, জিনিসের দাম বেড়েছে। পর্যটন শিল্পের ওপর এদের অর্থনীতির একাংশ নির্ভর করে। দেশটা তো আগ্নেয়গিরির পুরু ছাইয়ের নিচে চাপা ছিল। সে সবের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে
গুহা বানিয়ে বসবাস করত একসময় ধর্ম-সঙ্কটে পালিয়ে আসা খ্রিষ্টানরা। এর পর আবার ধর্মযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয় অধিবাসীরা। বর্তমানে হাতে গোনা কিছু খ্রিস্টান পরিবার রয়ে গেছে এই পাহাড়ের খাঁজে-খন্দে। চাষাবাদ বলতে শুধু আঙুর, এপ্রিকট আর আলুবোখরা। বর্তমান অধিবাসীদের কার্পেট বুনে আর সিরামিকের জিনিস বানিয়ে সে সব পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে ওদের আয় হয়। আর আছে পর্যটন ব্যাবসা। আমার যা পকেটের হাল, গাইড নিয়ে, নিজস্ব গাড়ি নিয়ে ওভাবে ঘুরতে পারব না। হাতে সময়ও কম। আমার সেই বন্ধু বলেছিল ওর পরিচিত কাউকে সঙ্গে দেবে। কিন্তু কায়সেরী পৌঁছে ওর সঙ্গে
যোগাযোগ
করেই উঠতে পারলাম না। ও থাকে নেভশেহর শহরে। বাধ্য হয়ে একটা গাড়ি জোগাড় করতে গেলাম। কপাল ভালো যে একটা ফিরতি খালি গাড়ি কম টাকায় পেয়ে গেলাম, চললাম নেভশেহরের দিকে। পথের দু’পাশে বার্লি আর আঙ্গুরের খেত আর আলুবোখরার গাছ চোখে পড়ল। আমি যার গাড়িতে যাচ্ছিলাম তার নাম রিহাদ, অল্প ইংরাজি জানে। আমার বন্ধু এলেক্সের নাম বলায় চিনতে পারল না। এলেক্স যে রিসর্টে কাজ করে সেখানে আমায় ছেড়ে দেবে বলল। প্রায় দু-ঘণ্টা পর পাহাড় দেখতে পেলাম। রিহাদ বলল আমরা নেভশেহরে ঢুকে পরেছি, সামনেই ইমাজিনেশন ভ্যালি। ওখানেই এলেক্স একটা রিসর্টে কাজ করে। আমায় নামিয়ে একটা টি-স্টলে লোকাল তুর্কীটি পান করে রিহাদ চলে গেল। আমি এলেক্সের খোঁজে উপত্যকার দিকে চললাম। চারদিকের পাহাড়গুলোর আকৃতি কোনোটা মাশরুম, কোনোটা গাছ আবার কোনোটা উট বা ঘোড়ার মতো। যেমন ইচ্ছা কল্পনা করে নাও। চারদিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। আবহ-বিকারের ফলে আগ্নেয় পাথর ক্ষয়ে এই সুন্দর প্রকৃতির সৃষ্টি হয়েছে। বায়জেন্টাইন সভ্যতার উপর একটা বই পড়েছিলাম, মনে পড়ে গেল। ঘুরে ফিরে সব দেখছিলাম। অ্যালেক্সের খোঁজ পাইনি। ভাবছিলাম রাতটা কাটাবার জন্য একটা সস্তার আস্তানা খুঁজতে হবে। মাঝে মাঝে এক দু-পশলা বৃষ্টি হচ্ছিল, না হলে প্রকৃতির কোলেই কাটিয়ে দিতাম রাতটা।
চারপাশে বেশ কিছু হাতের কাজ আর পোরসেলিন আর সিরামিকের জিনিসের পসরা নিয়ে বিক্রি করছে লোকাল লোকেরা। বেশ কয়েকটা হাতে বোনা কার্পেট ফ্যাক্টরি চোখে পড়ল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দোনের আর বার্লির সবুজ স্যুপ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে আশ্রয়ের খোঁজ শুরু করলাম। একটা এপ্রিকট গাছের নিচে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসেছিল। সব শুনে বলল কাছেই ফেয়ারি চিমনির দিকে কিছু গুহায় এখনও কিছু লোকাল লোক থাকে। ওখানে অল্প লিরার বিনিময়ে রাত কাটাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ও ছবি তুলে ছুটে চললাম ‘ফেইরি চিমনি’ দেখতে। এটি নিকটে অবস্থিত। লোকগাথা হিসেবে এই সব পর্বতে পূর্বে পরিদের বসবাস নিয়ে বিভিন্ন গল্প চালু আছে। পাথরের উঁচুনিচু বিভিন্ন আকৃতির পাহাড়গুলো সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে রং পরিবর্তন করে এক চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবতারণা করে। বহু বছর পূর্বে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পুরো কাপাডোকিয়া পুরু ছাইয়ের ভস্মে আবৃত হয়ে যায়। যা পরে শক্ত হয়ে জমাট বাঁধে এবং লাভা জমে গিয়ে নরম পাথর তৈরি হয় যাকে ট্যাফ্ বলা হয়। বছরের পর বছর ঝড় বৃষ্টি বাতাসে এই নরম পাথরের উপরের অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে আজকের এই ‘ফেইরি চিমনি’-র সৃষ্টি হয়। যাদের উচ্চতা প্রায় ১৩০ ফুটের মতো। মানুষের বুদ্ধিমত্তাও এই পর্বতগুলোকে যাদুকরি ছোঁয়া দেয়। গুহাগুলোকে বর্তমানে বুটিক হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। গুহাগুলোর ভেতরে গরমে ঠাণ্ডা এবং শীতে গরম রাখার ব্যবস্থা আছে। শুধু তাই নয় হোটেল কক্ষ থেকে কাপাডোকিয়ার মনোরম দৃশ্যও উপভোগ করা যায়। কিন্তু আমার জন্য তা বেশ খরচ সাপেক্ষ। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি লোকালয় ছেড়ে উপত্যকার বুকে নেমে গেছিলাম। একটা গির্জা মতো চিমনির ভেতরে ঢুকেছিলাম। বড়ো পাথরের উপর একসময় শোয়ানো হত মৃতদেহ। পশ্চিম দিকের এই চিমনিগুলো কবর হিসাবেই ব্যবহৃত হত। কিছু কঙ্কাল এখনও রয়েছে। বেশ একটা শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে বাইরে এলাম। আকাশের গায়ে
হাজার চুমকির কাজ ঝলমল করছে। এক অসাধারণ সুন্দর উপত্যকার মাঝে আমি একা। সব পর্যটক বহু আগেই ফিরে গেছে। বৃষ্টি না হলে রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়।
হঠাৎ দেখি একটি মেয়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির পরনে সাদা গাউন ও গলায় ক্রস, সন্ন্যাসিনীর মতো চেহারা। ইউরোপিয়ান একসেন্টে
আমায় বলল, “তুমি কি পর্যটক? একা একা এভাবে ঘুরছ?”
আমি মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম, বললাম, “থাকার জায়গা খুঁজছি। এক বন্ধুর ভরসায় এসেছিলাম, দেখা হয়নি।”
“রাত কাটাবার অনেক হোটেল রয়েছে লোকালয়ে। তোমার গাইড কোথায়?” মৃদু কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
“আমি গাইড নিইনি। সস্তায় একটা রাত কাটানোর জায়গা খুঁজছিলাম। হোমস্টে টাইপ।”
মেয়েটি অবাক হয়ে আমায় দেখছিল। বলল, “এভাবে একা ঘুরো না, রাতের বেলা এই অঞ্চল নিরাপদ নয়। তুমি চাইলে আমার সঙ্গে
এসো।”
আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম।
ও বেশ কিছুটা ভেতরে পাহাড়ি গুহা শহরের কাছে নিয়ে গেল আমায়। গুহাগুলো বেশ পুরোনো, তবে মনুষ্য বসবাসের চিহ্ন রয়েছে। গুহাগুলোর ভেতরে কোথাও কোথাও কালো কালির দেয়াল দেখে এটি যে রান্নাঘর ছিল বোঝা যায়। দেয়ালে বিভিন্ন ছিদ্রগুলো বাতাস চলাচলের জন্য করা হয়েছিল। মেয়েটি বলল তার নাম মারিয়া, ও যেতে যেতে বলে চলেছে, “এই জায়গার নাম ছিল সুন্দর ঘোড়ার দেশ। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই জায়গা হিথিস জাতি, তারপর পার্সিয়ানরা, আলেকজান্ডার, রোমানরা, এরপর বাইজেন্টাইনরা এবং অটোম্যানরা নিজেদের বলে দাবি করে। বর্তমানে কাপাডোকিয়ার এই অপূর্ব পাথুরে পর্বতের এলাকা এবং গরিমি ন্যাশনাল পার্ককে ইউনেস্কো পৃথিবীর সবচেয়ে অভিনব এবং বড়ো গুহার কমপ্লেক্স হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ‘ফেইরি চিমনি’-গুলো এক সময় প্রকৃতির সৃষ্ট আশ্চর্যজনক বস্তু ছিল। কিন্ত সময়ের আবর্তে মানুষ এগুলোকে তাদের বসবাসের স্থান বানিয়ে নিজেদের করে ফেলে। এভাবে এক সময়ের রিফুজিদের আশ্রয়স্থল আজকের পর্যটকদের জন্য হট এয়ার বেলুনে চড়ে এর অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করার আকর্ষণীয় কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।” ওর বলার মধ্যে একটা আকর্ষণ ছিল। এমন অনেক মেয়ে গাইডের কাজ করে শুনেছিলাম। আমিও সেই আকর্ষণেই চলেছি। একেকটা গুহা মাটির নিচে আট দশ তলা, হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়, দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে জ্বলছে মোম। মারিয়ার সঙ্গে একটা বড়ো ঘরে প্রবেশ করলাম।
ততক্ষণে ও আমার পরিচয় জেনেছে। আমি ভারতীয় শুনে ও আপ্লুত। বলল, “ভারত প্রেম আর ভালোবাসার দেশ, ভারতীয়রা শান্তিপ্রিয় হয় শুনেছি।”
কিন্তু আমার ঐ মাটির নিচের গুহায় বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সেটা বলায় আমাকে মারিয়া আরেকটা রাস্তা দিয়ে বাইরে নিয়ে এল। এই গুহাগুলো মাকড়সার জালের মতো একটার সঙ্গে একটা যুক্ত। বাইরে এসে দেখলাম ভূপ্রকৃতির এক অসাধারণ রূপ। আন্ডারগ্ৰাউন্ড সিটি বোধহয় একেই বলে। মারিয়া একটা ঝোপের মতো বাদাম গাছের পাশে আমায় নিয়ে বসল। ও বলছে এক পুরাণের গল্প, “রোমানদের সাম্রাজ্যকালে তৎকালীন খ্রিষ্টানরা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষার্থে এই সব পাথুরে পর্বতে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা খুব দ্রুত বসবাসের উপযোগী করার জন্য পর্বতের নরম অংশে গুহা ও প্রার্থনা ঘর, পশু-পালনের ঘর, গুদাম ঘর ইত্যাদি তৈরি করেছিল। এগুলো অনেকটা মৌমাছির চাকের মতো। এই নরম পাথরের ট্যাফগুলো খুঁড়ে সহজেই গুহা বানানো যেত। লুকিয়ে থাকার জন্য এ এক সুন্দর জায়গা। চিমনিগুলোর ভেতর সে সময় মৃতদেহ রাখা হত, কোনও চিমনি গির্জা বা উপাসনাকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হত। খাবার বলতে এই পাথুরে অঞ্চলে হত আঙুর, এপ্রিকট আর বার্লি, অবশ্য পশুপালন করা হত। তবে সারাক্ষণ একটা ভয় থাকত সবার মনে। ঐ বোধহয় শোনা যায় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ঐ বোধহয় রোমান সৈন্যদল আক্রমণ করল আমাদের।”
মারিয়া এমনভাবে কথা বলছিল যেন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম ঐ ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। হঠাৎ এক বৃদ্ধ এসে আমাদের বলল, “তোমরা এখনও বাইরে রয়েছ। তাড়াতাড়ি ভেতরে চল। আজ রাতেই আক্রমণ হতে পারে।”
আমি কিছু বোঝার আগেই সামনের একটা গুহায় আমাদের ঢুকিয়ে বড়ো একটা গোল পাথর দিয়ে দু’জন গুহামুখ বন্ধ করে দিল। সরু পথে কিছুটা চলার পর আবার একটা বড়ো ঘরে ঢুকলাম আমরা, বেশ কিছু ইউরোপীয় বাচ্চা, বুড়ো ও মহিলা রয়েছে ঘরে। তবে সবার পোশাক সেই পুরোনো দিনের, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্রদের মতো।
মারিয়া আমার পরিচয় দিল ভারতীয় পর্যটক, ওর অতিথি বলে। আমায় নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে, একটা বায়ু চলাচল করে এমন গর্তের পাশে বসল ও। আমি ফোন বার করে দেখলাম চার্জ শেষ। এই গুহায় ইলেকট্রিক লাইন নেই।
এক মহিলা আমাদের এক ধরনের মাংসের পুর দেওয়া রুটি, দুধের মিষ্টি আর আঙুরের পানীয় দিয়ে গেল। আমি প্রশ্ন করতেও ভুলে গেছি। খেতে খেতে মারিয়া বলল, “ওদের হাত থেকে লুকিয়ে আমরা মাত্র এই কয়েকশো জন এখনও টিকে রয়েছি এই মাটির নিচের গুহা শহরে। আমরা এখন রোমানদের সঙ্গে আরবদেরও ঘৃণা করি। আরবদের অত্যাচারে ধর্ম বদলিয়েছে আমাদের কয়েক হাজার শরণার্থী। জানি না এভাবে পালিয়ে আর কতদিন আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারব!”
ওর গলায় ছিল বিষাদের এক করুণ সুর। মনটা ভার লাগছিল। বললাম, “কেন এভাবে লুকিয়ে আছ? এখন তো বাইরে সব শান্ত। সরকারকে বলো তোমাদের কথা।”
হঠাৎ দেখি ওর চোখ-মুখ বদলে গেছে, ও বলল, “ঐ শোন আবার, ওরা আসছে, ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছ তুমি?”
ওর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল আমিও শুনতে পাচ্ছি সেই শব্দ। ও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল গুহার অলিগলি ধরে আরও গভীরে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে। ভীত নারীরা শিশু কোলে ছুটে চলেছে আরও গভীরে। পুরুষের সংখ্যা খুব কম। শুনলাম পুরুষদের ধরে নিয়ে যায় ওরা। আমার আবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি বললাম, “আমায় বাইরে যেতে দাও। আমি ট্যুরিস্ট, আমার কিছুই হবে না।”
মারিয়া অবাক হয়ে তাকাল আবার। তারপর গোলকধাঁধা পথে এ গলি সে গলি পার হয়ে আমায় নিয়ে আরেকটা গুহামুখের কাছে এল। বাইরে এসে আমি প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম। ভাবছিলাম কী করে তখনকার দিনে সবাই এই গুহায় থাকত? তখন তো শুনেছি হাজার হাজার লোক থাকত এই সব গুহায়। এই কয়েকশো লোকের গুহাতেই আমার দমবন্ধ লাগছিল। ঐ সব শিশু, বৃদ্ধ, নারী এদের কষ্ট হত না ঐ বদ্ধ জায়গায়! হঠাৎ খুব কাছাকাছি ঘোড়ার খুরের আওয়াজে আমরা সচকিত হলাম। মারিয়া বলল, “আবার লুকাতে হবে। সামনেই একটা বড়ো আলুবোখরা গাছ ফলে ফলে লাল হয়ে আছে। আমি মারিয়াকে নিয়ে সেদিকে গিয়ে লুকালাম। ছ-জন ঘোড়সওয়ারকে হঠাৎ দেখতে পেলাম, পোশাক সেই পুরোনো দিনের মতো। ওরা খুব ভালো করে গুহাগুলো লক্ষ করতে করতে এক অচেনা ভাষায় কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। মারিয়া ওর গলার ক্রুশটা শক্ত করে ধরে আছে। ফিসফিস করে বলে চলেছে প্রার্থনা মন্ত্র। ওর দু’চোখে ভয়। আমি কিছুতেই বুঝে পাচ্ছিলাম না এই যুগেও ওরা কেন এভাবে লুকিয়ে আছে পাহাড়ের গুহায়!
ঘোড়সওয়াররা চলে গেল চিমনিগুলোর দিকে। রাত শেষ হয়ে আসছিল। মারিয়া আমায় বলল, “তোমায় এগিয়ে দিই
শহরের দিকে। আর এদিকে এসো না রাতের বেলায়। সামনের উপত্যকায় হট এয়ার বেলুনের ট্রিপ শুরু হবে একটু পরেই। তোমায় ওখানে পৌঁছে দিতে পারি।”
আমি ওর সঙ্গে হেঁটে চললাম সেদিক পানে। একটা পাহাড়ের বাঁকের শেষে এসে মারিয়া বলল, “বিদায় ভারতীয় বন্ধু। এবার তুমি একাই যেতে পারবে। আমার এই ক্রসটা তোমায় দিলাম। এটা তোমায় রক্ষা করবে বিপদের হাত থেকে। তোমার বন্ধুর দেখা পাবে আশা করি।”
আমি ওকে ঠিক কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারিনি। ক্রসটা নিয়ে পকেটে রাখলাম। আর আমার পকেটে একটা ভালো পেন ছিল, সেটা ওকে দিলাম উপহার হিসাবে। আর ব্যাগে কিছু কুকি বিস্কুট ছিল। তা দিয়ে বললাম ওদের শিশুগুলোকে দিতে। ও খুব খুশি হয়েছিল বিস্কুটগুলো পেয়ে। আরেকটু নিচে নেমে পেছন ফিরে আর ওকে দেখতে পেলাম না। সামনেই একে একে ট্যুরিস্ট গাড়ি আসছে বেলুন রাইডের জন্য। পূব আকাশে লেগেছে রঙের ছোঁওয়া।
বেলুন রাইডের জন্য দু-এক জায়গাতে কথা বললাম, কিন্তু খরচ শুনে আমি পিছিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ ওখানেই
দেখা হল অ্যালেক্সের সঙ্গে। ও একটা গাড়িতে ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছিল। আমায় দেখেই বলল ও খুব দুঃখিত, ওর ফোন খারাপ হয়ে গেছে বলে ও যোগাযোগ করতে পারেনি। আমরা একটা গাছের পাশে টি-স্টলে বসলাম তুর্কিটিকে নিয়ে। ও জানতে চাইল কোথায় উঠেছি? এত ভোরে এখানে কী করে এলাম? লোকালয় এখান থেকে বহুদূরে!
আমি ওকে মারিয়ার কথা বললাম। রাতের আতিথেয়তার গল্প করতেই দেখলাম ওর চোখ-মুখ পরিবর্তন হচ্ছে। ও আমায় বলল, “ঠিক বলছ, ঐ দূরের পাহাড়ের নিচে যে আন্ডারগ্ৰাউন্ড সিটি তুমি ওখানে রাত কাটিয়েছ?”
“হ্যাঁ, কয়েকটা খ্রিস্টান পরিবার আছে এখনও ওখানে, মারিয়া বলে একটি মেয়ে আমায় নিয়ে গেছিল কাল।” ওকে ক্রসটা বার করে দেখালাম।
ক্রসটা দেখে ওর চোখমুখ বদলে গেল। ওর গলার ক্রসটা বার করে দেখাল ও। হুবহু এক ধরনের। ও বলল, “ঐ গুহাগুলো পরিত্যক্ত। কেউ থাকে না ওদিকে। ঐ উপত্যকার বদনাম আছে বন্ধু। ওখানে অনেকেই আজও ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পায়। আজও ঐ উপত্যকার গুহায় কিছু বৃদ্ধ ও নারীদের দেখা পায় রাতের বেলায় অনেকেই। কিন্তু সবটাই আমরা ভাবতাম লোকেদের কল্পনা। ঐ অঞ্চলটা ভালো না।”
আমি কী উত্তর দেব বুঝে পাচ্ছিলাম না। দিনের আলোয় খুব যেতে ইচ্ছা করছিল ঐ গুহাগুলোয়। অ্যালেক্সকে বলতেই ও
বলল ওর হাতে চার ঘন্টা সময় আছে। আমরা আবার চললাম ঐ মাটির নিচের শহরে। বড়ো আলুবোখরা গাছটা দেখে জায়গাটা চিনেছিলাম। কিন্তু গুহায় কেউ নেই। লোক বসবাসের চিহ্ন নেই কোথাও। বেশ কিছু গুহায় রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর। অন্ধকার গুহায় পথ হারিয়ে ফেলব বলে বেরিয়ে এলাম আমরা। বেরোবার পথে একটা বড়ো ঘরের কোণে দেখলাম কুকিজের খালি প্যাকেট পড়ে রয়েছে। আর একটা কুলুঙ্গিতে রাখা আমার পেনটা।
অ্যালেক্স বলল, “আমার পূর্বপুরুষরা এসব গুহায় ছিল। আজ তুর্কীতে মাত্র এক শতাংশ খ্রিস্টান টিকে আছে। অথচ হাজার হাজার খ্রিস্টান একদিন এখানে এসেছিল। কয়েক শতাব্দী আগেই ওরা সবাই শেষ হয়ে গেছে। এসব গুহা এখন পরিত্যক্ত। শহরের দিকের গুলোয় হোটেল হয়েছে।”
আমি আজও জানি না সেদিন রাতে আমি ঠিক কী দেখেছিলাম, কে আমায় অতিথি বানিয়ে নিয়ে গেছিল। শুধু জানি কাপাডোকিয়ায় আমি যা দেখেছি সবাই দেখতে পায় না। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।’
কুট্টিমামা গল্পের শেষে সেই ক্রসটা বার করে দেখাল। বলল, “এটা না থাকলে আমিও ভাবতাম সেদিন আমি স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু অ্যালেক্স বলেছিল এই লকেট বহু পুরানো, ওর পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন করে এ লকেট। আরেকটা ছিল বংশপরম্পরায় ওর কাছে। হয়তো ওর সঙ্গে দেখা হয়নি বলেই ওর পূর্বপুরুষরা আমায় সেদিন রাত কাটাবার সুযোগ দিয়েছিল। কারণ ঐ অঞ্চল তো আসলে ওদেরই ছিল।”
_____
ছবিঃ রুমেলা দাশ
mone holo samay ta te giye porechilam,opurbo
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদারুণ লাগলো। ছোট্ট করে একটা টাইম ট্র্যাভেল হয়ে গেল।
ReplyDelete