তুষের
আগুন
প্রতীক
কুমার মুখার্জি
।। ১
।।
আমি নন্দন।
মনে পড়ে তীর্থঙ্কর বসুর কেস? মনে পড়বেই বা কী করে, সেবার তো আলাপের কোনও সুযোগই হয়নি।
আমি নিজেই হতভম্বের মতন রিন্টুদার কাণ্ডকারখানা দেখে গেছি। রিন্টুদাকেও চিনলে না? যে ফেলুদায়
অনুপ্রাণিত হয়ে টিকটিকির কাজ করছে পি.সি.এম. হিসাবে, ভুলে গেছ! সত্যজিৎবাবুর প্রতিটা
রহস্যকাহিনি যার পাতা-কে-পাতা মুখস্থ! তাঁর সৃষ্ট অপরাধীদের ক্রাইম, তাদের মোডাস
অপারেন্ডি - সবই যার নখদর্পণে, সেই প্রভাত চন্দ্র মাখাল।
এফ ডি
৭৭৭-এর কেসটার পর থেকে রিন্টুদার নাম ছড়িয়েছে বাংলা সহ অন্যান্য রাজ্যেও। হাতে
কেসের অভাব নেই, ফলে
রিন্টুদা আর আমি, ফেলুদা
আর তোপসেদার মতোই ঘুরেফিরে বেড়াই। আরও একটা ‘কাক বসল তাল পড়ল’ ধরনের
ব্যাপার আছে জানো কি?
হর্ষবর্ধন পাড়ুইমশাই আমাদের সাথে ঝুলে থাকেন জটায়ুর মতোই। ফলে পুরোপুরি না
হলেও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে কিছুটা। রিন্টুদার ভাষায় এটা নাকি ওর ‘ফেলু ফিলিং’!
সেদিন বসে
আছি আমাদের বাগুইহাটির তিনতলার ফ্ল্যাটের বাক্স বারান্দায়। জিভ বার করে কাঁচি আর
কাগজ নিয়ে লড়ে যাচ্ছি চিনে লণ্ঠন বানাবার মরিয়া চেষ্টায়। রিন্টুদার আগের কেস শেষ।
ও ঘন্টা খানেক শরীরচর্চার নানান সরঞ্জাম নিয়ে কসরত করার পর স্নান-টান সেরে গুগলে
বারমুডা রহস্যের উপরে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুজো পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড়মাস আগে, তাই শহরের
সঙ্গে শহরের মানুষও যেন বেশ ঢিমেতালে চলমান। বাইরে কাঁচামিঠে রোদ্দুরে মাঝে মাঝে
গড়িয়ে পড়া ঘাম আর রাতে হালকা চাদর ঢেকে শোওয়ার আয়োজনে সকলে শীতের অপেক্ষায়।
লিফটটা
ওঠানামা করলে এত শব্দের ভিতরেও একটা হালকা কাঁপুনি টের পাওয়া যায়। হয়তো সেটা পেয়েই
রিন্টুদা বলল, “নন্দন, তোকে উঠে
দরজা খুলতে হবে। থ্রি-সিতে গেস্ট আসছেন।”
আমি চমকে
তাকাতেই ও কপালে ডানহাত ঠেকাল বিশেষ মুদ্রায়। “আমার গুরু পারত, আর তাঁর
গুরু তো পারতই। আমি স্রেফ ঢিল মারলাম। শোন, অজয়মোহন দে বলে একজন আসার কথা আছে
সাড়ে বারোটায়। ফোন করেছিলেন গতকাল রাতে। তাই দুয়ে দুয়ে চার করার চেষ্টা করলাম
মাত্র। এখন বারোটা চল্লিশ। তুই দরজাটা খোল, আমি তৈরি হয়ে আসছি এক্ষুনি।”
খুব রাগ হল
আমার। খালি খালি আমায় চমকে দিয়ে ভীষণ মজা পায় লোকটা। আগে বললেই হত যে মিস্টার দে
আসতে পারেন। যাক, এ
নিয়ে পরেও লড়া যাবে।
লিফট
থেমেছে। পায়ের শব্দ এগিয়ে এসে থেমে গেল। তারপর বেল বাজল, কিন্তু
থ্রি-ডিতে। রিন্টুদার ব্যুৎপত্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের আগেই আবার বেলের আওয়াজ।
এবার আমাদের দরজায়! খুলতেই এক ষাটোর্ধ্ব, সামার স্যুট ও হাই পাওয়ারের চশমা পরা
সুঠাম চেহারার ভদ্রলোক,
মুখে অপ্রস্তুত হাসি। “আসলে
প্যাসেজটা অন্ধকার তো,
তাই ভুল করে আর কি...”
বলেই হয়তো আমায় দেখে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে, “মিস্টার মাখাল?” বলে উঠলেন
অনাবশ্যক ভারী স্বরে।
ওঁকে বসালাম
ড্রয়িং রুমে, আর
সঙ্গে সঙ্গেই রিন্টুদার উদয় হল উলটোদিকের ঘর থেকে। সে আর এখন আমার চেনা আটপৌরে
রিন্টুদা নয়, পেশাদারি
মোড়কে সুসজ্জিত। সেই মার্কামারা পাঞ্জাবী, জিনস, নরম স্লিপার। হাতে ‘সিগনেচার’ চারমিনারের
প্যাকেট, আর
সিগারেট লাইটার।
নমস্কার
বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গেই দেবাবু একটা হঠকারী প্রশ্ন করে বসলেন, “একটা কথা
জিজ্ঞেস করি, কিছু
মনে করবেন না। আপনি ঠিক কতদিন থেকে গোয়েন্দাগিরি করছেন? না মানে, এত কম
বয়সে...”
রিন্টুদার
মুখে একচিলতে হাসির আভাস ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। বলল, “আপনি আজ ভীষণ তাড়াহুড়ো করে এসেছেন
মিস্টার দে, আর
রাস্তায় আপনার গাড়ি খারাপ হয়েছিল, সম্ভবত পাংচার। গাড়ি লক করে তড়িঘড়ি পাবলিক বাস ধরেছেন, তাই তো?”
দেবাবুর
যতটুকু সপ্রতিভতা অবশিষ্ট ছিল, কোথায় যেন উড়ে গেল। উনি আমতা আমতা করতে রিন্টুদা বলল, “আমি জাদুকর
নই, নিজেকে
জাহিরও করছি না। শুধু এই পেশায় থাকতে হলে যতটা সজাগ থাকতে হয় সেই চেষ্টাই করেছি।
দেখুন, আপনার
এক স্লিভে কাফ লিংক,
আরেকটা ভুলে গেছেন বা পড়ে গেছে। ঘড়ি হয়তো দম দেওয়ার অভাবে বন্ধ, ট্রাউজারের
পকেট থেকে গাড়ির চাবির রিং বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। আপনার পোশাক জায়গায় জায়গায় কুঁচকে।
স্ট্রেস পয়েন্টগুলো ভীষণরকম অবিন্যস্ত, আর ট্রাউজার্স-এর হাঁটুর পিছনে, গোড়ালির
কাছে টায়ারের কাদা-ছোপ। মানে চাকা বদলাবার চেষ্টা নিজেই করেছিলেন, আর হাতের
নখে কালির দাগ সেটাকে কনফার্ম করছে। অর্থাৎ নিজেই ড্রাইভ করেন। হাতের আংটিতে বাসের
টিকিট গোঁজা এখনও, আর
পালিশ করা জুতোর উপর অনেক পায়ের ছাপ - পাবলিক বাস ছাড়া এ-জিনিস হয় না। আর হ্যাঁ, এত কষ্ট
আপনি করেছেন সময়ে পৌঁছোবার জন্য। আপনি সময়ের মূল্য বোঝেন। এখন বারোটা চল্লিশ বাজে।”
দেবাবু
রুমালে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছে নিয়ে হাতজোড় করে বললেন, “আমি আমার
কথা উইথড্র করছি। কিছু মনে করবেন না দয়া করে।”
আমার বুকটা
নিদেনপক্ষে দু-ইঞ্চিটাক ফুলল।
পরক্ষণেই এই
অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে সোজা চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে। “আমার বাড়ি
হল গিয়ে ঢাকুরিয়া লেকের পাশেই, ওখানটা কাঙ্কুলিয়া রোড বলে। একটা বিচ্ছিরি সমস্যা নিয়ে
আপনার কাছে আসা।”
অখিলদা এর
মধ্যে গরম গরম চা আর নিমকি দিয়ে গেছে টেবিলে।
রিন্টুদা
পায়ের উপর পা চাপিয়ে বসেছিল ফেলুদার মতন। ওই অবস্থাতেই দেবাবুকে ইশারা করল টেবিলের
দিকে। তারপর সেগুলোর সদব্যবহার করতে করতেই গোড়াপত্তন হল নতুন কেস হিস্ট্রির।
আচ্ছা, আমার গল্প
বলাটা তোপসেদার মতো কিছুটা হলেও হচ্ছে কি? রিন্টুদার আইডল যেমন ফেলু মিত্তির, আমার তেমনি
তপেশরঞ্জন মিত্তির - এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই।
দেবাবু বলতে
শুরু করলেন, “বউবাজারের
কাছে আমাদের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট হাউস - দ্য ইম্পিরিয়াল এক্সপোর্টস লিমিটেড। প্রায়
আঠারো বছর ধরে আমাদের কোম্পানি চুটিয়ে ব্যাবসা করে চলেছে এশিয়ায় জাভা, সুমাত্রা আর
বোর্নিও সহ দক্ষিণ আমেরিকায়। ওখানে আমাদের কাজ হয় মূলত ব্রাজিল, পেরু আর
বলিভিয়ার সাথে। এই কোম্পানি একা হাতে শুরু করেছিলেন শ্রী দিগ্বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়।
ব্যাঙ্কের উঁচু পদের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে উনি এই আমদানি-রফতানির ব্যাবসা
শুরু করেন। ঠিক আট মাস পরে ইম্পিরিয়ালে যোগ দিই আমি, ডাইরেক্টর হিসেবে। কোনও পরিচিত
সূত্রে আসিনি আমি, বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেব নিজের হাতে আমায় বেছে নিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে কোম্পানির প্রসার ঘটতে থাকায়
প্রয়োজন হয় আরও দায়িত্ব সামলাবার লোকের - আসেন একে একে শ্যামল শূর, আরও পরে
আসেন নিখিলরঞ্জন দত্ত। এই চারজন মিলেই আমাদের বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস, আর এখনও
বোর্ডের চেয়ারম্যান-কাম-প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবার মাথার উপর রয়েছেন সেই
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব।”
এই পর্যন্ত
শুনে উসুখুসু করে উঠে রিন্টুদা বলে উঠল, “মানে আপনি ঠিক কী সমস্যা নিয়ে আমার
কাছে এসেছেন সেটা জানতে পারলে ভালো হত, মিস্টার দে। তবে আমার স্মৃতিশক্তি
যদি ভুল না বলে তাহলে সপ্তাহ দুয়েক আগেই কাগজে কী যেন একটা খবর এসেছিল দ্য
ইম্পিরিয়াল নিয়ে... আচ্ছা,
কোনও ডাইরেক্টরের কি...”
উত্তেজিতভাবে
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইটার
জন্যই আপনার কাছে আসা। শ্যামল... মানে মিস্টার শ্যামল শূরের আকস্মিক মৃত্যুর
কিনারা করার জন্যই আপনার কাছে ছুটে আসা। দু’সপ্তাহ আগে ও গেছিল বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেবের কাছে কোম্পানির নতুন পলিসি নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু ওঁর সাথে কথা বলতে
বলতেই হৃদরোগে মারা যায় শ্যামল। এক ফোঁটা সুযোগ দেয়নি কাউকে। আর এই শকে সাহেবও
অসুস্থ হয়ে পড়েন।”
“একটা প্রশ্ন
আর একটা সন্দেহ আছে আমার,”
রিন্টুদা থামাল মিস্টার দেকে, “প্রথমত, শূরবাবু কেন ওঁর বাড়িতে গেছিলেন? ওঁদের তো
রোজই অফিসে দেখা হবার কথা। আর দ্বিতীয়ত, ব্যানার্জিবাবু কি খুব নার্ভাস ধরনের
মানুষ? মানে, চেয়ারম্যান-কাম-প্রেসিডেন্ট-এর
এতটা স্নায়বিক দুর্বলতা আমার বেশ একটু অদ্ভুতই ঠেকছে।”
দেবাবু
অপ্রস্তুতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “দেখেছেন মাখালবাবু, আসল কথাটাই বলা হয়নি আপনাকে। আমাদের
কোম্পানির সব ডাইরেক্টর কাজে যোগ দেওয়ার চার বছর পরে ব্রাজিলে একটি দুর্ঘটনায়
মৃত্যুবরণ করেন শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়। রিভার সাফারি করতে গিয়ে স্টিমার থেকে
খরস্রোতা টোক্যান্টিন্স নদীতে পড়ে যান এবং তলিয়ে যান কয়েক মুহূর্তের ভিতর। আমরা
সবাই সেই সময় একসাথেই ছিলাম সেই স্টিমারে। এই দুর্ঘটনার আঘাত বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব
কোনওভাবে সামলে নিলেও ঘটনার আকস্মিকতায় সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গিয়ে নিজেকে খোলসে গুটিয়ে
নেন।
“এর ঠিক দেড়
বছর পরে ওঁর একমাত্র ছেলে শৈবাল কিডন্যাপড হয়। কোনওভাবে বিশাল অর্থব্যয় করে খুব
গোপনে উনি তাকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন।
আমরা কেউ আর কখনও শৈবালকে এদেশে দেখিনি। কিছুদিন পর সাহেবের সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়
এবং ডানদিকটা পুরোপুরি পড়ে যায়। তাই আজ তিনি আক্ষরিক অর্থেই বাড়িতে হুইল চেয়ারে
বসা চেয়ারম্যান। কিন্তু বাঁদিকটা সম্পূর্ণ সচল আর বুদ্ধি আগের মতোই ক্ষুরধার।
তিন-চারজন পুরনো চাকরের ভরসায় থাকেন একডালিয়ার বাড়িতে। বড্ড কষ্ট পেয়েছেন জীবনে।
ছেলেটাও এমন অমানুষ যে বিদেশ থেকে এসে একটিবার অথর্ব বাবার খোঁজও নেয় না। যা কথা
হয় ফোনেই, আর
বাবাই ছেলেকে ফোন করেন বরাবর, ছেলে করে না। কী অদ্ভুত জীবন!”
কিছুটা
অবাকই হচ্ছিলাম। পুরোটাই যেখানে অফিশিয়াল রিলেশন, সেখানে এই ভদ্রলোকের এতটা মায়ার
বোধহয় একটাই কারণ - এতদিনের বন্ধন। একেবারে একাত্ম হয়ে গেছেন কোম্পানির সঙ্গে।
এই পর্যন্ত
শুনে রিন্টুদা বলল,
“তাহলে আপনারা চান আমি শূরবাবুর মৃত্যুর তদন্ত করি, এই তো? কিন্তু
আপনারা এই মৃত্যুকে সন্দেহের চোখে দেখছেন কেন? উনি তো হৃদরোগেই মারা গেছেন এবং
সেটার নিশ্চয়ই ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে?”
একথায় যেন
ফুঁসে উঠলেন দেবাবু। “একমাত্র
আমি সন্দেহ করছি যে এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কারণ, সুস্থ সবল একটা মানুষ হঠাৎ বলা নেই
কওয়া নেই, দুম
করে মারা যাবে কেন, আর
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের ফ্যামিলি ডাক্তারই বা কেন চটজলদি ডেথ সার্টিফিকেট লিখে
দেবেন?”
“শ্যামলবাবু
কি কলকাতারই বাসিন্দা ছিলেন?”
জিজ্ঞেস
করতে দেবাবু বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, কলকাতারই।
অবশ্য যদি বাঘা যতীনকে কলকাতা বলা যায় তবেই।”
প্রয়োজনে
নমনীয় হলেও শানিত নাক উঁচু ভাবটা লুকোতে পারলেন না ভদ্রলোক।
“তাহলে কি
আপনি ব্যানার্জিকেই সন্দেহ করেন নাকি, দেবাবু?” অতর্কিতে
বোমা ফাটাল পি.সি.এম।
“কী বলছেন
আপনি জানেন? স্যারকে
সন্দেহ করব আমি? উনি
আমায় হাতে করে গড়েছেন,
আজ আমি যা সব ওঁর দয়ায়। কক্ষনও কারও সঙ্গে গলা তুলে কথা বলতে দেখিনি ওঁকে।
শুধু ম্যাডামের দুর্ঘটনার সময় ওঁর চিৎকার শুনেছিলাম - সে এক অমানুষিক আর্তনাদ! আর
এখন উনি চলৎশক্তিরহিত প্রায়, শূরের মৃত্যুর পর আরও ভেঙে পড়েছেন। দেখুন না যদি কিছু করতে
পারেন শূরের মৃত্যুর ব্যাপারে। সাহেবও রাজি ছিলেন না আমি আপনার কাছে আসি। বললেন, কী আর করা
যাবে, সূর
কি ফিরবে? তাও
এলাম মনে জোর নিয়ে। আপনার সুনাম ও কাজের ব্যাপারে আমরা ওয়াকিফহাল, উপযুক্ত
পারিশ্রমিক আর খরচাপাতি দ্য ইম্পিরিয়াল বহন করবে।” থামলেন দেবাবু।
“চতুর্থ জনের
সম্বন্ধে বললেন না তো আমায়?
তদন্তের খাতিরে যদি প্রত্যেক ডাইরেক্টরের বাড়ি যেতে হয়, তাহলে সেটা
কীভাবে সম্ভব হবে?”
বলতে দেবাবু
রহস্যের হাসি হেসে বললেন,
“কেস যখন আপনার, এটা
আপনাকে বার করে নিতে হবে নিজেই। আর হ্যাঁ, এই আমার ভিজিটিং কার্ড। দরকারে
নিশ্চয়ই ফোন করবেন। আসি।”
বলে দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরলেন। “আচ্ছা, ‘ক’ বললে কি সবসময়ে কলকাতাই বোঝায়? কানপুর, কেরালা, কোচিন তো
হতে পারে, তাই
না মিস্টার ডিটেক্টিভ?”
ফ্ল্যাট
নম্বর থ্রি-সি আবার অতিথি-শূন্য হল। শুধু যোগ হল একটি বিশাল ভ্রূকুঞ্চন আর একটা
সুদীর্ঘ ‘হুমমমমমম!’
।। ২
।।
কে জানত
রিন্টুদা আদাজল খেয়ে লেগে পড়বে? পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমায় ঘুম থেকে তুলে, “শোন আমি
একটু বেরোচ্ছি। তুই রেডি থাকিস, আমরা আজ একটু পরে সন্তোষপুরের দিকে যাব।” বলেই
হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন বেরোল।
তৈরি হতে
হতে ভাবলাম, সন্তোষপুর
কেন? ওখানে
আবার কীসের জন্য যেতে হবে?
তাহলে কি আবার নতুন কোনও কেস নাকি?
রিন্টুদা
ফিরতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আমার কাছে। ও সকালে দেবাবুকে ফোন করে নিয়ে নিখিলরঞ্জন
দত্তর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ফেলেছে, সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
জিজ্ঞেস
করলাম, “এঁর
বাড়িতে কেন আমরা সবার আগে যাচ্ছি?”
রিন্টুদা
বলল, “তুই
বল দেখি, আমার
সঙ্গে এতদিন থেকে আদৌ কিছু শিখলি কি না?”
বললাম, “ওই যে
দেবাবু ভদ্রলোক রহস্য তৈরি করে গেলেন, তার নিরসন করতেই ওই বাড়ি যাচ্ছি কি?”
একটা
স্নেহের চাপড়ে পিঠের ডানদিকটা টনটন করে উঠল।
মৃদু হেসে
রিন্টুদা বলল, “পাড়ুইমশাইও
ফোন করেছিলেন। ওঁকে জানাতেই আসতে চেয়েছিলেন সঙ্গে। না করে দিলাম বুঝলি? প্রথমদিন, নিজেরা
দেখেশুনে আসি, তারপর
তিনজনেই নয় যাব।”
বলল বটে, কিন্তু
পরক্ষণেই আবার বলল,
“কিন্তু উনি না থাকলে যেন ঠিক ‘লালমোহনবাবু লালমোহনবাবু’ ব্যাপারটা
আসে না। ঠিক আছে, পরদিন
থেকে উনি থাকবেন সাথে।”
সুলেখা
ব্রিজ শেষ হতেই সন্তোষপুর বটতলা স্টপেজে নামলাম আমরা। তারপর ডানদিকে দ্বিতীয় গলি
দিয়ে ঢুকতেই চারদিকে ফ্ল্যাটের ভিড়ের মাঝে ছোট্ট একটি হলুদ দোতলা বাড়ি। রিন্টুদা
বলল, “দারুণ
লোকেশন তো!”
বেল বাজাতে
একজন কাজের লোক আমাদের নামধাম জিজ্ঞেস করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসাল। বোঝা গেল, আমাদের আসার
খবর দত্তবাবুর কাছে আগেই ছিল।
ছোটো ঘর, কিন্তু বেশ
রুচিশীল জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো এঁর বৈঠকখানা। পরে রিন্টুদা বলেছিল, বেশিরভাগ
জিনিসেরই জাভা, সুমাত্রা
ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগমন।
দুই থেকে
তিন মিনিটের ভিতর এলেন নিখিল দত্ত। দস্তুরমতো দশাসই সাহেবি কেতার মানুষ, টি-শার্ট আর
ঢোলা কার্গোস পরা, কাঁচাপাকা
ফ্রেঞ্চ কাট আর হাতে চুরুট - বেশ একটা রিটায়ার্ড কর্নেলের মতো গেট-আপ। এসে একটা ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে
সঙ্গেই চমকে উঠলাম। ভীষণ বিসদৃশ! ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর যে একেবারে মহিলাদের মতো
রিনরিনে! আড়াল থেকে কথা বললে মনেই হবে না ঐ স্বরের পিছনে একজন এত বড়োসড়ো চেহারার
মানুষ আছেন।
আমার হাসি
পাচ্ছিল, কিন্তু
রিন্টুদার গম্ভীর মুখ দেখে আমি যারপরনাই সাবধান হয়ে গেলাম। তবে তোমাদেরও চুপি চুপি
বলে রাখি, পরে
রিন্টুদাও আমাকে ওই একই কথা বলেছিল। ও নাকি প্রাণপণে হাসিই চাপছিল।
হয়তো এই
পরিস্থিতি কাটাবার জন্যই রিন্টুদা বলে উঠল, “লন টেনিসের নিয়মিত অভ্যেস আছে মনে
হচ্ছে, দত্তবাবু?”
একটুও না
চমকে উত্তর এল ধারালো,
সুরেলা গলায়। “সাত
বছর হয়ে গেল একদিন বাদ দিইনি জানেন। এই কবজি আর কাঁধের যথেষ্ট জোর, সাথে
সাঁতারটাও কাটি। সব মিলিয়ে দু-তিনজনের মহড়া একাই পারব বেশ কিছুক্ষণ। অবশ্য কেউ
আক্রমণ করলে চট করে আমার মুখের নাগাল পাবে না, আমার ছয় দুই। আপনার বোধহয় পুরোপুরি
ছয়, তাই
তো?”
রিন্টুদা
হেসে ঘাড় কাত করল। “পারফেক্ট
টু দ্য ইঞ্চ, স্যার!”
কথাবার্তা
শুরু হল ভিজিটিং কার্ড বিনিময় পর্বের পরে। ফ্লুরিসের পীনাট বাটার প্যানকেক আর
চিকেন বার্গার সহযোগে ধোঁয়া ওঠা কফি খেতে খেতে শুনতে লাগলাম আর নোট নিতেও শুরু
করলাম। ফোনেই সম্ভবত ওঁকে আমাদের আসার কারণটা বলেছিল রিন্টুদা। আর সেই জন্যই কোনও
ভূমিকা ছাড়াই দ্য ইম্পিরিয়ালে ওঁর যোগ দেওয়ার দিন থেকে বলতে লাগলেন ভদ্রলোক।
“আমি চারজন
ডাইরেক্টরের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র। প্রথমে আমাদের কোম্পানি এত বড়ো ছিল না জানেন, কিন্তু
বিজুদা পরের দিকে একা সামলাতে না পেরে আমায় নিয়ে আসেন কোম্পানিতে।”
শুনেই চমকে
গেলাম। বিজুদা! মনে পড়ল দেবাবুর শ্লেষের হাসিটুকু। কী ব্যাপার? রিন্টুদার
মনে হয়তো একই প্রশ্ন জেগেছিল, তাই কালবিলম্ব না করে ওর প্রশ্ন উড়ে এল, “আপনাদের
ডাইরেক্টরদের ভিতর নিশ্চয়ই ভীষণ সুসম্পর্ক। কারণ, আপনি আপনাদের চেয়ারম্যানকে যেভাবে
সম্বোধন করলেন, একান্ত
হৃদ্যতা না থাকলে এভাবে ডাকা যায় না, তাই না দত্তবাবু?”
“মোটেই না, মোটেই না।
আর কারও সঙ্গে এরকম ব্যবহার বা সম্বোধন করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ কী, জানেন? বিজুদা তো
আমার আপন জামাইবাবু,
তাই। আমার চেহারার আর খেলাধুলার জন্য আমি মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম, হয় ডিফেন্স, নয় পুলিশেই
আমার ভবিষ্যৎ। তিনবার পরীক্ষায় সফল হয়েও আমার কণ্ঠস্বর আমায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছতে
দিল না। ডাক্তার দেখিয়েও কিচ্ছু হল না। দিদি যদি বিজুদাকে বলে আমার সুরাহা না করত, তাহলে আমি
আজ কোথায় থাকতাম বলুন দেখি?
আপনারা হয়তো ভাবছেন যে একজন ডাইরেক্টর পর্যায়ের মানুষ গড়গড় করে নিজের সমস্ত
কিছু সবার সামনে উজাড় করে দিচ্ছে। আসলে বিজুদাকে আমি ভগবান মানি। আর তাই উনি আমায়
বলে দিয়েছেন যা যা সত্যি তাই আপনাদের বলতে। সত্যি যদি শ্যামলবাবু খুন হয়ে থাকেন, কোথাকার জল
কোথায় গড়াবে ঠিক নেই। তবে আমি যখন একবার সাফল্যের মুখ দেখেছি, আমি একেবারে
শীর্ষে গিয়ে থামতে চাই,
বুঝলেন মশাই? দেখিয়ে
দেব আমার কণ্ঠস্বরের খামতি আমায় হারাতে পারেনি।”
ভদ্রলোকের
চুরুট নিভে গেছিল। আরেকটা নতুন চুরুট এনে ধরালেন আর রিন্টুদাকেও একটা অফার করতে সে
হাসিমুখে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের চারমিনারের প্যাকেট থেকে একটা বার করে ধরাল। ভালো
করে একটা টান দিয়ে হঠাৎ কথা বলল রিন্টুদা। “শূরবাবুর মৃত্যুর পর আপনাদের মধ্যে
সেই ঘটনা নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া?” গোয়েন্দা সুলভ প্রথম প্রশ্ন এবার।
“বিজুদার
হালই সবচেয়ে খারাপ। কারণ,
ওঁর চোখের সামনেই হৃদরোগে মারা গেছেন কোম্পানির সবচেয়ে বড়ো পলিসি মেকার আর
স্ট্র্যাটেজিস্ট শূরবাবু। রাজি ছিলেন না একেবারেই যখন অজয়বাবু ওঁকে আপনার সাহায্য
নিতে বলেন। বলেছিলেন,
কী হবে? শূর
কি আর ফিরবে? বাকি
রইলাম দেবাবু আর আমি। কেন যে দেবাবুর মনে হচ্ছে এটা খুন, বুঝতে পারছি
না। পরিষ্কার কার্ডিয়াক ফেলিওর, ডাঃ সেনও একবার দেখেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। কে জানে মশাই, বেশ ছিলাম
রয়ে-বসে, জানি
না কপালে কী আছে এবার। এই আমি আপনাকে বলে রাখলাম মাখালবাবু, আমি এসবের
ভিতর নেই। দিদি নেই,
তোতোনের খবর কেউ জানে না, বিজুদা অর্ধমৃত প্রায় - এর ভিতর এবার চোর-পুলিশ খেলা কেন?”
“তোতোন মানে
নিশ্চয়ই আপনার ভাগনে?”
বলল রিন্টুদা।
“হ্যাঁ, দিদি মারা
যাওয়ার ঠিক দেড় বছর পরে হঠাৎ কিডন্যাপ হয়ে গেছিল। মুক্তিপণ, থানাপুলিশ -
সবার সাথে একা হাতে লড়ে বিজুদা তোতোনকে কীভাবে যেন উদ্ধার করেই কানাডা পাঠিয়ে দেন।
তারপর থেকে ও আর এদেশে পা দেয়নি। যোগসূত্র বলতে শুধু ফোন বাপ ছেলের ভিতর। তবে
জানেন তো, এক্কেবারে
হার্টলেস আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো। একটিবার অসুস্থ বাবাকে দেখতেও আসে না!”
আর
উল্লেখযোগ্য সেরকম কোনও কথাবার্তা এগোল না। ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণ সহযোগিতার
আশ্বাস নিয়ে দত্ত সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলাম সেদিনের মতো।
বেরিয়ে বাস
স্টপে পৌঁছোবার আগেই রিন্টুদার মুখে ক’টা শব্দ শুনলাম, স্বগতোক্তি, “ইন্টারেস্টিং!
ভগবান, অমানুষ, হার্টলেস, সূর কি আর
ফিরবে? কানপুর, কেরালা, কোচিন -
মন্দ বলেননি মশাই, অজয়বাবুর
দেখার চোখ আছে!”
সারাটা পথ
আমি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলাম, আর রিন্টুদা ব্যোম ভোলে হয়ে গুম মেরে
বসে থাকল।
।। ৩
।।
বাড়ি ফিরে স্নান
করে খাওয়াদাওয়া সারা হল। মেনুতে ছিল আমাদের প্রিয় নটেশাক ভাজা, ভাজামুগের
ডাল, সুক্তো
আর দইমাছ। শেষপাতে ঘরে পাতা টক দই। তরিবৎ করে খেলাম। রিন্টুদাও খেল, কিন্তু ওর
হাবভাব যেন রিমোটে মিউট টেপা টিভি প্রোগ্রামের মতো। খেয়ে উঠেই আমি বাঁচিয়ে রাখা
শারদীয়া নিয়ে বসলাম,
আর উনি মাথায় এক হাত ঢেকে চিত হয়ে শুলেন। ধূম্র উদ্গিরণ করতে লাগল একটা
চারমিনার, ঠিক
যেন গান স্যালুট! এতটাই ফেলুদা-মনস্ক, যে চিন্তা করার ধরনটাও তারই মতো।
হালকা শীতের
দুপুর, পেটে
অতগুলো সুখাদ্য, শারদীয়া
পড়তে পড়তে তন্দ্রা এসে গেছিল। হঠাৎ দেখলাম, রিন্টুদা আমায় ডেকে তুলল। বলল, “ওঠ, ইন্টারভিউ
আছে।”
এটা হল
রিন্টুদা আর আমার ভিতর একটা ডায়াগনস্টিক প্রসিডিওর। ও যেভাবে কেস নিয়ে ভাবে, সেই অনুযায়ী
আমায় প্রশ্ন করে যায়,
আমি আমার বুদ্ধি অনুযায়ী উত্তর দিই, যদি মেলে তাহলে ওর মতে লজিক ঠিক, নয়তো আবার
অন্য রাস্তায় ভাবা।
সুতরাং হাতে
মুখে জল দিয়ে এসে বসে পড়লাম চেয়ারে দু’জন মুখোমুখি।
“চার
ডাইরেক্টরের মিল কোথায়?”
“চারজনের
সঙ্গে দেখা হল কোথায়?
আরেকজন তো ইতিমধ্যেই...” বললাম আমি।
“আরে না দেখা
হলেও চারজনকে কীভাবে এক জায়গায় আনা যায়, এটা তো বলবি?”
“চারজনই
উচ্চপদস্থ, আর
চারজনই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা।”
“হয়েছে। তোর
উত্তরের প্রথম অংশটা পাড়ুইমশাই দিলেও আশ্চর্য হতাম না। দ্বিতীয় অংশ সঠিক।” কিঞ্চিৎ
নিশ্চিন্ত মুখে বলল রিন্টুদা।
“বন্দ্যোপাধ্যায়কে
সবাই কী চোখে দেখে?”
“ভীষণ
শ্রদ্ধা করে সবাই। কারণ,
যে দু’জনের
সঙ্গে দেখা হয়েছে এখনও পর্যন্ত, দে আর দত্ত, দু’জনেই ভীষণ অনুগত ওঁর এবং তাঁদের
আজকের অবস্থার জন্য তাঁর কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ। দত্তবাবু তো নিকট আত্মীয়, আর তাঁর যে
বোলবালাও সেটা যে সম্পূর্ণ তাঁর দিদি ও জামাইবাবুর জন্য তা তো তিনি মুক্তকণ্ঠে
স্বীকারই করলেন।”
“ভালোই বললি।
কিন্তু আমায় ভাবাচ্ছে দেবাবুর ওই রহস্যটা। ওঁকে বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের হাতেই শুধু
বাছেননি, গড়ে
নিয়েছেন নিজের মতো করে। আমার চিন্তা অনুযায়ী, দেবাবু কিন্তু জেনুইন চয়েস। কিন্তু
দত্তকে যা দেখলি, তা
কিন্তু একেবারেই না মিলতে পারে, উলটোটাও হতে পারে। আমার অবজার্ভেশন বলছে, এই লোকটির
নার্ভ ভীষণ শক্ত। ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছি। যতটা খোলা বইয়ের মতো নিজেকে মেলে ধরলেন, ততটা উনি
নন। আবার নিজের শারীরিক ক্ষমতা নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন দাম্ভিকতা আছে, দেখলি তো?”
রিন্টুদা
একটু থামল।
“কাল তাহলে
কি একডালিয়া না ঢাকুরিয়া,
না সোজাসুজি বাঘা যতীন?”
জিজ্ঞেস করল রিন্টুদা।
“কেন, বাঘা যতীন
গিয়ে কী হবে? মানে
শূরবাবুকে তো পাচ্ছি না। বাকিগুলো দেখলেই তো হয়।” আমি বললাম বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
“ইউ আর
রিজেক্টেড ইন দ্য ইন্টারভিউ টুডে। একটা কেসে নেমে সবদিকগুলো না ভেবে আন্দাজে ঢিল
মেরে যদি কেস চালাতে হয় তাহলে ফেলুদার অপমান, সত্যজিৎবাবুর অপমান, আমার
গোয়েন্দা হওয়ার অপমান। তোপসের কথা ভাব। কখনও এইভাবে ভাবত কি ব্যাপারটা? শূর মারা
গেছেন বলেই তো ওঁর বাড়ি যাওয়াটা জরুরি। তারপর ওই অঞ্চলের ফাঁড়ি, সেখানকার
ওসি, তারপর
ডাঃ সেন। তুই এগুলো না ভেবেই এত কথা বলে দিলি, নন্দন?”
বকুনিটা
ভীষণ যুক্তিপূর্ণ মনে হল কারণগুলো বলার ফলে। তবে ঠিক তার পরমুহূর্তে দরজায় বেল।
হর্ষবাবুর প্রবেশ, আর
এক বাক্স কড়া পাকের সন্দেশ আমায় আরও লজ্জা থেকে তাৎক্ষণিক বাঁচাল।
“আজ আমি বলি
প্রভাতবাবু, আমায়
বলতে দিন, প্লিজ!” ঢুকেই এক
হাত নাটকীয়ভাবে তুলে বললেন পাড়ুইমশাই।
রিন্টুদা
অবাক মুখে আমার দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি হেনেই সম্মতি জানাল মাথা নেড়ে।
বলে চললেন
পাড়ুইমশাই, “যতদূর
আমি বুঝছি, নন্দনভাই
কিছু একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলে আপনার কাছে বকুনি খাচ্ছিল। মানে আপনি বেচারিকে
বকাবকি করছিলেন, আর
আপনিও চটে আছেন। আমি আসায় ব্যাপারটায় ভাটা পড়ল। কী, কেমন দিলাম?”
রিন্টুদা
যারপরনাই চমৎকৃত হয়েই হঠাৎ পিছনে অখিলদাকে দেখেই গলা ঝেড়ে আবার গম্ভীর। একটাই কথা
বলল, “বাঘের
ঘরে ঘোগ!”
“ও স্যার, রাগ করলেন
নাকি? আমি
তো নিছক মজার ছলে... মানে...” সপ্রতিভতার ওখানেই ইতি।
“কাল আমরা
একটু বাঘা যতীন যাব নতুন কেসের ব্যাপারে। আমাদের সঙ্গে যাওয়ার সময়...” রিন্টুদার
গলা গম্ভীর।
“কী বলছেন
মশাই, নতুন
কেস আর পাড়ুইমশাই যাবে না আপনাদের সঙ্গে! কদাচও নয়, কদাপি নয়! বলুন, কাল কখন
হাজির হতে হবে?” পাড়ুইমশাই
আবার ফর্মে।
আস্তে আস্তে
সমস্ত ঘটনার একটা ব্রিফ করলাম ওঁকে। উত্তেজনায় তাঁর অদ্ভুত অভিব্যক্তিগুলোর পূর্ণ
সদ্ব্যবহার করে উনি পুরোটা জানলেন। তারপর রিন্টুদার সঙ্গে একপেশে একটু আড্ডা দিয়ে, দু’রাউন্ড চা
খেয়ে ভদ্রলোক প্রায় লাফাতে লাফাতে বিদায় নিলেন সেদিনের মতো।
পাড়ুইমশাই
যাওয়ার পর আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে রিন্টুদা এবার কী বলে আমায়। কিন্তু দেখলাম, আগের
ব্যাপারটায় আর আমল না দিয়ে আমায় বলল, “আচ্ছা বল তো, দত্তকে
কীরকম দেখলি। ভুল বললে আমার সঙ্গে কাল থেকে আর যাবি না কোথাও।”
গলা ঝেড়ে
প্রাণপণ মানসিক শক্তি দিয়ে বলতে শুরু করলাম, “লোকটা শক্তি ধরে, পড়াশোনা
মোটামুটি, পুলিশ
আর আর্মির এন্ট্রান্স পাশ করেছে যখন, জামাইবাবুর দয়ায় বড়লোক, স্ট্যাটাস
রাখতে অনেক কিছু করে,
সাংঘাতিক ধূর্ত। তুমি টেনিসের কথা হঠাৎ বলতেও টসকাল না একটুও, আর মুখ হঠাৎ
দেখে মনে হয় খারাপ কাজ করতে পিছপা হবে না। তবে দিদি-জামাইবাবুকে বেশ শ্রদ্ধা করে।”
“তাহলে ‘ক’ বললে কি
সবসময়ে কলকাতাই বোঝায় বলছিস? কিন্তু একটা জায়গায় খটকা লাগছে আমার। দেবাবু নয় বাইরের লোক, তিনি শৈবাল
ওরফে তোতোনের সম্পর্কে অতটা খোঁজ নাই রাখতে পারেন, কিন্তু দত্ত, পরিবারের
লোক হয়ে, মামা
হয়ে ভাগনের কোনও খবর জানে না? আবার দু’জনেই কিন্তু ছেলেটির উপর বেশ বিরূপ বোঝা গেল। এখন সেটা কি
তার ব্যবহারের জন্য,
না বাবার খোঁজখবর না রাখার জন্য বোঝা গেল না। চল, কাল কী হয়
দেখি বাঘা যতীনে। যা,
অখিলদাকে জিজ্ঞেস কর রাতে কী বানাল ডিনারে।”
বুঝলাম, এ-যাত্রায়
পাশ করে গেছি। তাই ওর চোখ এড়িয়ে উচ্ছ্বাসে তিন লাফে পৌঁছে গেলাম রান্নাঘরে।
।। ৪
।।
পরদিন সকালে
তাঁর সবুজ মার্ক ২ অ্যাম্বাসেডর নিয়ে এলেন পাড়ুইমশাই ঠিক সকাল সাড়ে ন’টায়। অবাক
হবার কিছুই নেই। ওঁর বাড়ি শ্যামবাজার, মিষ্টির দোকান হাতিবাগানে, খুব নামকরা
দোকান হবার জন্য রোজগারপাতিও বেশ হ্যান্ডসাম। ওঁর আরও দুটি গাড়ি আছে। রিন্টুদার
ফেলুদা-প্রীতি দেখে এই গাড়িটা কোথা থেকে সেকেন্ড হ্যান্ডে কিনে, তাতে ওই
বিশেষ সবুজ রঙ করিয়েছেন। অভিপ্রায় ছিল রিন্টুদাকে উপহার দেওয়ার। কিন্তু বলা
বাহুল্য, ও
গররাজি হওয়ায় শুধু তদন্তের সময় এটি ব্যবহার হয়। এটায় চাপলে রিন্টুদার কক্ষনও মেজাজ
খারাপ হয় না। আমিও ভুলে যাই যে আমি তোপসেদা নই। শুধু হরিপদবাবুর অভাব মেটাতে হয়
স্বয়ং পাড়ুইমশাইকে।
যাই হোক, বাগুইহাটি
থেকে সোজা ভি.আই.পি রোড ধরে বাইপাসে পড়লাম। শয়ে শয়ে বিলিতি গাড়িতে কলকাতার রাস্তা
ভরপুর। তাদের ভিতর দিয়েই এগিয়ে চলল আমাদের বাহন। আস্তে আস্তে রুবির মোড় পেরিয়ে
আমরা এসে পড়লাম সন্তোষপুর কানেক্টরে। আগেরদিনই এদিকটায় এসেছিলাম। ভাবতে ভাবতে
এগিয়ে চলেছি সন্তোষপুরের ভিতরের রাস্তা ধরে। বটতলার কাছে আসতেই দেখি দত্তবাবু!
একটা কালো এনফিল্ডে চেপে রাস্তা পেরিয়েই হুশ করে বেরিয়ে গেলেন বটতলা মোড় থেকে।
সোজা সুলেখা ব্রিজ ধরলেন। চেহারা বটে একখানা! ওই বাইকে মানাচ্ছেও চমৎকার, শুধু কথা
বললেই বিড়ম্বনা। আবার হাসি পেয়ে গেল।
রিন্টুদাকে
দেখাবার আগেই ইশারা করে চুপ করিয়ে দিল আমায়। কারণ, পাড়ুইমশাইয়ের নার্ভ। হঠাৎ করে সাসপেক্টকে
সামনে দেখলে হয়তো উত্তেজনায় ব্রিজ থেকে গাড়ি নিচেই ফেলে দেবেন।
যাক, আমাদের গাড়ি
বাঁক নিল বাঁদিকে। আড়চোখে দেখলাম, দত্তবাবুর বাইক ঘুরে গেল ডানদিকে। অর্থাৎ যাদবপুরের দিকে।
আর ভেবে লাভ নেই। আমরা ব্রিজ থেকে নেমে বাঁদিকে বাঘা যতীনের দিকে ঘুরে গেলাম।
প্রায়
পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করার পর শূরবাবুর বাড়ি খুঁজে পেলাম। বুঝলাম, এই কয়েক
বছরে, দ্য
ইম্পিরিয়াল তার মালিকদের বহুকিছু দিয়েছে, বা তাঁরা ভালোভাবেই নিংড়ে নিয়েছেন
তাঁদের লভ্যাংশ।
শূর
ম্যানশনের বেল বাজাতে অনেক পরে এক বৃদ্ধের মুখ দেখা গেল ঝুল বারান্দায়। “কোথা থেকে
আসছেন? কাকে
চাই আপনাদের?”
নিচে থেকে
চেঁচিয়ে তো কথা বলা যায় না,
তাই রিন্টুদা মিথ্যে (এটা নিয়ে অনেকে ভ্রূ কোঁচকাতে পারেন, কিন্তু ওর
গুরু হোমস আর ফেলুদাকেও তদন্তের খাতিরে মিথ্যে বলতে হত। কারণ ওদের কাজটাই হচ্ছে
অপরাধীর সাথে লড়ে সত্যি বার করে আনা। তাই ওতে চরিত্রে কালি পড়ে না।) করে বলল, “মেসোমশাই, আপনার ছেলের
অফিস থেকে আসছি আমরা। কিছু পাওনাগণ্ডার ব্যাপার আছে তো, তাই।”
পুত্রশোকের
চেয়েও যে অর্থ বড়ো, তাই
প্রমাণ করতেই যেন আধ মিনিটের ভিতর উপর থেকে সোজা নিচে এসে সদর দরজা খুলে দিলেন
বৃদ্ধ। ঢুকে পড়লাম শূর ম্যানশনে। ছবির মতো সাজানো বাড়ি, কিন্তু
লোকজনের বড়োই অভাব। ঢুকেই অবশ্য রিন্টুদা সত্যি কথাটা বলে দিল। আর এও বলল, ও কাজ করছে
যাতে শূরবাবুর অকালমৃত্যুর একটা সুরাহা হয়, দোষী শাস্তি পায়। বৃদ্ধ প্রথমে ক্রোধ
সংবরণ না করতে পেরে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ দু’হাত দিয়ে
মুখ চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন।
“সংসারও করল
না শ্যামল, বাবা-মাকেও
দেখল না। পাগলের মতো টাকা টাকা করে শেষ হয়ে গেল নিজেই। কার জন্যে এই বাড়ি-গাড়ি
বলতে পার তোমরা? ওর
মাও তো অনেকদিনই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি কী জন্য পড়ে আছি কে জানে? জানো, ও শেষে
অর্থপিশাচ হয়ে গেছিল। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করত, সবকটাকে শেষ করব, সবটা হবে
আমার। পিনবলের মতো সবগুলোকে ছিটকে ছিটকে ফেলব আমি। আমার বুদ্ধিতেই কোম্পানির আজ এত
নামডাক দেশে বিদেশে,
আর সেই ক্রেডিট অন্যে নিয়ে যাবে? আমি হচ্ছি কোম্পানির মগজ। তাহলে আমিই
হব শেষ কথা। শেষে আমায় যক বানিয়ে রেখে গেল। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কাছে
আমার পেনশন আর জমানো টাকায় করা পোস্ট অফিসের বই ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।”
রিন্টুদা
জিজ্ঞেস করল, ওঁর
শরীর-স্বাস্থ্য কেমন ছিল। উনি বললেন, “মাথাটা পরিষ্কার ছিল বরাবর, একেবারে কাজ
পাগল ছিল খোকা। প্রথম চার বছর ওর উত্থান হয়েছিল স্বপ্নের মতন। ওদের কাজে তো বারবার
বিদেশ যেতে হত, তাই
যখন ফিরত তখন গাদা বিদেশি জিনিস নিয়ে ফিরে আসত। একবার ওরা সবাই দক্ষিণ আমেরিকা
গেছিল কাজেই। হ্যাঁ,
সেবারই তো ওদের বসের স্ত্রী নদীতে পড়ে গিয়ে মারা গেলেন। ভয়ংকর একটা দুর্ঘটনা।
তারপর থেকেই যেন আমার ছেলেটা কেমন বদলে গেল। অর্থপিশাচ হয়ে উঠল। আর দেখো, এই পরিণতি
হল ওর শেষে। আমি জানি না ওর টাকাপয়সা কোথায় আর কীভাবে রেখেছে ও। বিশ্বাস করো, টাকাপয়সার
বড্ড অভাবে রয়েছি আমি। ঝি-চাকররা রোজ হুমকি দেয় কাজ ছেড়ে দেবার। জানতে চেষ্টা করে
ছোটোবাবুর অত টাকা কোথায় গেল। আমি ভীষণ বিপন্ন। কোনওদিন হয়তো কাগজে পড়বে অসহায় এই
বুড়োকে খুন করে রেখে গেছে কাজের লোকেরা।”
আর বিশেষ
কিছু জানার ছিল না, তাই
ভদ্রলোককে সান্ত্বনা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। পাড়ুইমশাই মাঝে মাঝে আলটপকা মন্তব্য
করে থাকেন। কিন্তু আজ কেন জানি না উনিও এই অবস্থায় পড়ে মৌনব্রত ধারণ করেছিলেন।
গাড়িতে বসে
যাদবপুর থানায় যাবার কথা বলল রিন্টুদা। জানতাম ওখানে ওর বন্ধু হলেন ওসি দীপ্তবাবু।
তা যাদবপুর থানায় গিয়ে সেখান থেকে খবর পাওয়া গেল না কিছুই। মানে পুলিশ শূরবাবুর
লাশের কোনও ফরেনসিক করতে পারেনি। কারণ, ডেথ সার্টিফিকেটে পরিষ্কার লেখা ছিল
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কথা।
চা খেয়ে খানিক গল্প করে
রিন্টুদা দীপ্তবাবুকে বলল শূর ম্যানশনের দিকে একটু নজর রাখার জন্য। একেবারেই
সাধারণ রুটিন ভিজিলেন্স। তারপর হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরোলাম আমরা।
পাড়ুইমশাই
বললেন, “তাহলে
আর কী, ব্যাক
টু প্যাভেলিয়ন? আনোয়ার
শাহ্ রোড ধরি, সাহেব?”
আর ঠিক
তক্ষুনি রিন্টুদার মোবাইল বেজে উঠল, সেই ফেলুদা থিম।
“হ্যালো
দেবাবু, বলুন।
হোয়াট? কখন? ঠিক আছে, আপনিও পৌঁছন, আমি
কাছাকাছি আছি, একডালিয়া
যেতে খুব বেশি হলে দশ মিনিট লাগবে।” তারপর ফোন কেটে বলল, “পাড়ুইমশাই, আপনি পাশে
বসুন, এটুকু
আমি চালাই। নন্দন, দত্ত
ইজ ডেড! আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, আবার সেই বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।”
এক মিনিটে
ঘেমে উঠলাম। কেন জানি না দত্তকেই খুনি ভাবতে শুরু করেছিলাম। গাড়ি ঢাকুরিয়া ব্রিজে
উঠতে খেয়াল করলাম, পাড়ুইমশাই
সিটের সাথে পুরোপুরি সেঁটে বসে কুলকুল করে ঘেমে চলেছেন, স্পিকটি নট।
তখন যদি
জানতাম যে দত্তবাবু একডালিয়ার দিকে যাচ্ছেন আর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেই যাচ্ছেন, আর ওই ওঁকে
আমরা শেষবার জীবিত অবস্থায় দেখছি, তাহলে কি কখনও বাঘা যতীন যেতাম? কিন্তু
মানুষ জানে না পরমুহূর্তে তার কী হতে চলেছে। আর তাই ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনাও।
কিন্তু এবার মন অশান্ত হয়ে উঠল। পরপর দুটো সুস্থ-সবল মানুষের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট? তাও একই
জায়গায়, সেই
একই বাড়িতে?
না, রহস্য
লুকিয়ে আছে তাহলে একডালিয়াতেই। আমাদের গাড়ি গড়িয়াহাট পেরিয়ে একডালিয়ার দিকে মোড়
নিল।
।। ৫
।।
শুধু বাড়িতে
ঢোকার আগে এক ঝলক তাকিয়ে নিলাম। কারণ, যে পরিস্থিতিতে আর যে মনের অবস্থা
নিয়ে ও-বাড়ি ঢুকেছিলাম তখন আর কিছু লক্ষ করার মতো অবস্থা ছিল না। একটু আগে যে
জলজ্যান্ত মানুষটাকে তার দশাসই চেহারায় বাইক চালাতে নিজের চোখে দেখলাম, কয়েক
মুহূর্তের অন্তরেই সেই মানুষটা হঠাৎ ‘নেই’ হয়ে গেল কী করে?
দৌড়ে দোতলায়
উঠে প্রথমবার পৌঁছলাম বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের, আর শেষবারের মতো দত্তবাবুর নিথর
দেহের সামনে।
দত্তবাবু
ঠিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের হুইল চেয়ারে উলটোমুখে বসেছিলেন। এখনও আছেন, কিন্তু মাথাটা
একটু হেলে আছে ডানদিকে। বিশাল হাতদুটো ঝুলে পড়েছে চেয়ারের হাতলের দু’দিকে। এছাড়া
শরীরের কোনও বিকৃতি নেই। এরকমভাবে হামেশাই বাস, ট্রেনে মানুষকে ঘুমোতে দেখা যায়।
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের বাঁদিকটা থরথর করে কাঁপছে, বাঁ চোখটা ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, মুখ থেকে
অস্ফুট, দুর্বোধ্য
কিছু আওয়াজের সাথে গলায় বাঁধা বিবের উপর লালা ঝরছে। আমাদের এই হঠাৎ উপস্থিত হওয়াটা
তাঁর ওপর কোনও প্রভাবই ফেলল না। বাঁদিকে পায়ের কাছে একটি সুদৃশ্য হাতির দাঁতের
পাইপ দু’টুকরো
হয়ে ভেঙে গড়াচ্ছে। তার থেকে এখন ধোঁয়া বেরোচ্ছে অল্প অল্প। আর বাঁদিকেই টেবিলের
উপর রাখা একটা পুরনো আমলের টেলিফোন সেট রয়েছে, কিন্তু ক্রেডেল ফাঁকা। কারণ, রিসিভারটা
ঝুলছে নিচ অবধি।
আরও কিছু
পায়ের শব্দে বোঝা গেল দেবাবুও এসে পড়লেন। অমানুষিক একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
বাড়ির চাকরদের সামনে যদিও আর এটা নতুন দৃশ্য নয়, তাও প্রত্যেকে যেন অজানা আতঙ্কে
স্তব্ধ হয়ে গেছে।
হঠাৎ এক
ভদ্রলোকের আবির্ভাব ঘটল ঘরে, হাতে ব্রিফ কেস। ওঁকে দেখেই গর্জে উঠলেন দেবাবু, “আপনাকে কে
খবর দিল, ডাঃ
সেন? আপনি
এত তাড়াতাড়ি কী করে এখানে এসে পৌঁছলেন? যাক, আপনি আগে ওঁকে দেখে বলুন কী অবস্থায়
আছেন উনি।”
ডাঃ সেন
তাড়াতাড়ি গিয়ে দত্তবাবুর জুগুলার ভেইন আর কশেরুকা পরীক্ষা করে মাথা নেড়ে বললেন, “সরি, কিছু করার
নেই, হি
ইজ নো মোর।”
মিস্টার দে
বললেন, “আপনার
কাজ শেষ ডাঃ সেন, আপনি
আর ডেথ সার্টিফিকেট লিখবেন না এবার, যেমন মিস্টার শূরের বেলায় লিখেছিলেন।”
হঠাৎ ঘড়ঘড়ে
গলায় একটা অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “কেনওওও?”
সবার মাথা
একযোগে ঘুরে গেল। দৃষ্টি নিবদ্ধ হল বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের দিকে।
“কারণ একই
জায়গায়, একইভাবে, পারিপার্শ্বিক
এক অবস্থায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে দুটো মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটাকে
অস্বাভাবিক ঘটনা বলে,
মিস্টার ব্যানার্জি। নমস্কার, আপনি আমার নাম শুনলেও মুখোমুখি এই প্রথম। আমার নাম হল
প্রভাত চন্দ্র মাখাল। শূরবাবুর মৃত্যু আর এই মুহূর্ত থেকে দত্তবাবুর মৃত্যুর
তদন্তে আমি তদন্তে বহাল আপনার কোম্পানির পক্ষ থেকে। আমি গড়িয়াহাট থানায় ফোন করে
দিচ্ছি, পুরো
ব্যাপারটা পুলিশ এসে দেখুক। আর এই মৃতদেহের পোস্ট মর্টেম হবে। তা ডাঃ সেন, আপনার মতে
কীভাবে মারা গেলেন ভদ্রলোক?
আর দু’নম্বর
খটকা, আপনি
খবর পেলেন কী করে?” এক
নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামল রিন্টুদার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর।
ডাঃ সেন
জানালেন, “দেখুন, আমি আমার
কাজে যথেষ্ট সুনামধারী একজন চিকিৎসক। আমি বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের পারিবারিক
ডাক্তার, তাই
উনি আমায় ফোন করে জানালেন যে ওঁর গেস্ট হঠাৎ করে কেমন যেন নিঃস্পন্দ হয়ে গেলেন।
শুনেই আমি দৌড়ে এলাম। আসলে ঠিক এরকমই একটা ঘটনা ক’দিন আগেই ঘটে গেছে কিনা। জানি না
মিস্টার দে আমায় আজ একথা বললেন কেন, আর কী কারণেই বা ওঁর সন্দেহের উদ্রেক
হল। আমার এখনও স্থির ধারণা যে এঁর কার্ডিয়াক অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে। আর আগের
ভদ্রলোকেরও ঠিক তাই হয়েছিল।”
“ধন্যবাদ, ডাঃ সেন।
আপনার কার্ডটা আমায় দেবেন। আর এখনকার মতো আপনি আসতে পারেন, কারণ এই
ঘটনার তত্ত্বতালাশ করব আমি,
আর তার সাথে পুলিশ। আর এই নিন আমার কার্ড, কোনও দরকারে আমায় ফোন করবেন।” এই বলে
রিন্টুদা ডাঃ সেনকে প্রায় রওনা করিয়েই দিল।
হঠাৎ আমার
পিঠের উপর একটা ভারী কিছু ঠেস দিতেই আমি কোনওমতে ঘুরেই দেখলাম পাড়ুইমশাই কোল্যাপ্স
করতে করতে সামলে নিচ্ছেন কোনওমতে।
“আসলে মাথাটা
কেমন যেন...”
আমি ওঁকে
একটা চেয়ারে বসিয়ে একজন কাজের লোককে বললাম একটু জল এনে দিতে।
“আপনাকে কে
খবর দিল দেবাবু? আর
হার্টফেলই যে হয়েছে সে কথাটাই বা কে বলল আপনাকে?” দেবাবুর দিকে ঘুরে প্রশ্ন রিন্টুদার।
“কেন, আমায় তো
বন্দ্যোপাধ্যায় স্যারই ফোন করলেন! আর উনি বললেন এটার কথা। কোনও সন্দেহ আছে কি? আমি যে
কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছি তা আমি জানি। আর মনের উপর দিয়ে যে কী ঝড় যাচ্ছে যদি আপনি
বুঝতেন।”
দেবাবু মনে
হল রিন্টুদার এই প্রশ্নটা শুনে বিশেষ আনন্দ পেলেন না। কারণ, তাঁর
ভ্রূকুঞ্চন বোঝাতে চাইল যেন আপনাকে বহাল করলাম আমি, আর আমাকেই কিনা সন্দেহ?
“ব্যানার্জিবাবু, এবার পুলিশ
আসার আগে আপনার অনুমতি চাইছি যাতে আপনি এই ঘর একটু খালি করার ব্যবস্থা করেন। কারণ, আমায় কিছু
জিনিস অবজার্ভ করতে হবে। আশা করি আপনি গোয়েন্দার কাজটা বুঝবেন।” বলল
রিন্টুদা।
দেবাবু
ইশারা করতে একজন লোক ওঁকে হুইল চেয়ার ঠেলে বাইরে নিয়ে গেল। আর দেবাবুও বেরিয়ে
গেলেন ঘর থেকে। এইসব পরিস্থিতিতে আমি থাকি ওর সঙ্গে। কিন্তু আজ রিন্টুদা বলল, “তুই
পাড়ুইমশাইকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বস। তোদের কাজ হল কাজের লোকগুলো, দে আর
ব্যানার্জিকে দেখা আর পারলে কথা বলা।”
আমরাও
বেরিয়ে গেলাম।
রিন্টুদা
ঘরের দরজা বন্ধ করে কাজ করতে লাগল, আর আমরা ঘরের বাইরে বসলাম। কাজের
লোকগুলোকে আমাদের ভীষণ গোবেচারা মনে হল। আর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব রীতিমতো ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করায় দেবাবু যেভাবে ওঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, তাতে আমার
মনটাও যেন কেমন হয়ে গেল।
“শূরও গেল, আজ পাপনও
চলে গেল তার দিদির কাছে। আমি আর কী করে একা একা বাঁচব? বাঁচতে চাই
না আমি ভগবান! আর কেউ নেই আমার এই পৃথিবীতে। আমি একা!” হঠাৎ থেমে
গিয়ে বললেন, “যাই, তোতোনকে ওর
মামার খবরটাও জানিয়ে আসি। নইলে ও আর জানতেই পারবে না।”
এখানে বলে
রাখি, আমায়
ভীষণ কষ্ট করে বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের কথা বুঝতে হচ্ছিল। একে কান্নাভেজা গলা, তারপর
একদিকে পক্ষাঘাত হবার দরুন এমনিতেই অস্পষ্ট উচ্চারণ।
পাড়ুইমশাই
এতক্ষণে একটু সুস্থ হয়ে এদিক ওদিক জুলজুল করে দেখছিলেন। জিজ্ঞেস করতে ফিসফিসিয়ে
বললেন, “আরে
লাশ অনেক দেখেছি ছোটোবেলা থেকে। ছোটোবেলায় পাড়ায় কেউ মারা গেলে কারা নিয়ে যেত
শ্মশানে? এই
শর্মা আর দলবল। আজ আমার শরীরটা কেমন করে উঠল ওই ডেডবডির মুখ থেকে লালা পড়া দেখে।
আর সেটার রঙটা কেমন যেন সবজে সবজে মতন। মানে, বুঝছ তো, পিত্তি
রঙের!”
শুনে চমকে উঠলাম আমি।
রিন্টুদাকে বলতে হবে তো এই ব্যাপারটা।
কিছুক্ষণ
পরেই রিন্টুদা বেরোল। আমি উঠে গিয়ে কানে কানে ওকে পাড়ুইমশাই এর কথা বলতেই ও মাথা
নাড়ল। তারপর বসে দেবাবু আর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের সঙ্গে কিছু দরকারি কথা সেরেই
উঠে পড়ল। বলল, “চল, এখানকার কাজ
আপাতত শেষ। পুলিশ আসুক,
দেখুক, আমরা
চল বাড়ির দিকে যাই। ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে।”
রিন্টুদার
সঙ্গে মিশে মিশে ওর মেজাজ এর নানান দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিফহাল আমি। তাই
ওর এই মেজাজ দেখেই বুঝলাম,
ও বেশ একটা আলো দেখতে পেয়েছে, আর সেই আলোটা বেশ উজ্জ্বল। উলটোডাঙা আসতে রিন্টুদা নেমে গেল
গাড়ি থেকে। বলল, “তোরা
বাড়ি চলে যা, আমি
একটা ছোট্ট কাজ সেরে বাড়ি চলে যাব।”
প্রায় দেড়
ঘণ্টা পরে রিন্টুদা এলে পরে দুপুরে ভালো করে ঘি, আলুভাজা, নারকেল-কোরা, কাঁচকলার
কোফতা আর পারশে মাছের ঝাল দিয়ে তরিবৎ করে খেলাম তিনজন মিলে। কারণ, পাড়ুইমশাইকেও
না খাইয়ে ছাড়িনি আমরা। উনি যেতে চাইলেও রিন্টুদা যখন মুচকি হেসে বলল, “গেলে কিন্তু
আমার রহস্যভেদের ধাপগুলো আপনার কাছে অধরাই থেকে যাবে, পাড়ুইমশাই!” তখন কি আর
উনি না থেকে পারেন? যাক, খাওয়াদাওয়া
সেরে সকলে মিলে গোল করে বসলাম নরম রোদ্দুরে, আর যথারীতি চারমিনারে অগ্নিসংযোগ করে
রিন্টুদা শুরু করল তার প্রাথমিক ডায়াগনসিস।
“চারজন
ডাইরেক্টর, একটা
সফল সংস্থা, প্রচুর
টাকাপয়সার লেনদেন - একদম স্বপ্নের উড়ান। হঠাৎ ছন্দপতন এক ডাইরেক্টরের মৃত্যুতে।
একজন ডাইরেক্টর তাদের চেয়ারম্যানের দ্বিধার বিরুদ্ধে গিয়েও আমার কাছে আসেন সেই
মৃত্যুর কিনারা করতে। আরেকজন ডাইরেক্টর, যিনি ঘটনাচক্রে চেয়ারম্যানের আপন
শ্যালক, তিনিও
জামাইবাবুর হাত ধরে উঠে জীবনে আরও বড়ো কিছু করতে চান। এই দু’জনই সাহেবকে
ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করেন। যিনি মারা গেছেন প্রথমে, তিনি এবার শেষের দিকে অর্থের লালসায়
পাগলের মতো হয়ে গিয়ে সকলকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, তাঁর নিজের বাবার কাছ থেকে শোনা।
এসবের মধ্যেই দ্বিতীয় মৃত্যু। জলজ্যান্ত তাগড়া মানুষ, তাঁরও
একইভাবে মারা যাওয়া। দুটো মৃত্যু একই জায়গায়, একইভাবে, আর সবচেয়ে
বড়ো কথা, একই
আসনে বসে। এখন কথা হচ্ছে,
চারজনের ভিতর দু’জন
মৃত। বাকি দু’জনের
ভিতর একজন দেবাবু, কোম্পানির
একনিষ্ঠ সেবক, ব্যানার্জির
একমাত্র ভরসা এবং ভীষণ কাজের মানুষ। উনিই একমাত্র রাইট চয়েস, কারণ
শূরবাবু যতই বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা হন না কেন, ওঁর ভিতর লোভ ঢুকে গেছিল। ওঁকে ছেড়েও
বাকি থাকল দু’জন...”
এই অবধি
শুনেই হঠাৎ পাড়ুইমশাইয়ের নিদ্রাভঙ্গ। “আরও দু’জন কোথায়
পাচ্ছেন মশাই? একজন।
একজন। ওই প্রতিবন্ধী বুড়ো। খুন যদি হয়েই থাকে, তাহলে উনি তো অসহায় মানুষ, উনি কি
করে...”
রিন্টুদা
ওঁকে থামিয়ে বলল, “আপনার
ভিজিটিং কার্ডটা দেখি,
পাড়ুইমশাই।”
“মানে... কেন?” আমতা আমতা
করা শুরু হল।
“আহা, দিন না
মশাই। কাজে লাগবে আমার।”
আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিল রিন্টুদা।
পাঞ্জাবীর
পকেট থেকে রাবার ব্যান্ড লাগানো একগোছা কাগজ বার করে তার মধ্যে থেকে খুঁজেপেতে
একখানা কার্ড বার করলেন পাড়ুইমশাই। মুখে টেনশন। নিজেই বললেন, “আমার তো
কার্ড নেই, মশাই।
তাই তারা মার ছবি দিয়ে আর আমার দোকানের নাম, ঠিকানা আর ফোন নম্বর দেওয়া এই কার্ড।
পিছনে আবার কায়দা করে পকেট ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে দিয়েছি, লোকের পকেটে
পকেটে ঘুরবে।”
গম্ভীর হয়ে
রিন্টুদা বলল, “ওতে
আপনার পেশাটা কি দেওয়া আছে,
পাড়ুইমশাই? নেই।
কিন্তু আমারটাতে আছে। তাই দয়া করে পুরোটা না শুনে রায় দেবেন না। ডিটেকটিভটা কে
বলুন দেখি?”
ঈষৎ রাগান্বিতভাবে
গজগজ করতে করতে চুপ করে গেলেন পাড়ুইমশাই। “এটা বলার জন্য খামোখা আমায় এতগুলো
কাগ... যাহ্, গার্ডারটা
ছিঁড়ে গেল যে! ও নন্দনভাই,
একটা গার্ডার যে আমার চাই!”
ভদ্রলোকের
এই গুণটা আছে। সহজে রাগেন না। কারণ, রিন্টুদা মাঝে মাঝে ভীষণ নাটকীয়ভাবে
মানুষকে ইচ্ছেমতন যা তা বলে দেয়, ঠিক ফেলুদার স্টাইলে।
উঠে গিয়ে
ওঁকে একটা গার্ডার এনে দিলাম।
আবার বলে
চলল রিন্টুদা, “ব্যানার্জিবাবু
একজন, আর
শেষজন হল শৈবাল, ওরফে
তোতোন। তাকে আমরা কেউ দেখিনি। শুধু শুনেছি এবং সে কোথায় থাকে জেনেছি শুধু। তার
সঙ্গে যোগাযোগ করেন একমাত্র তার বাবা। আচ্ছা, কেউ কি জোর দিয়ে বলতে পারবে ও এদেশে
থাকে না? পারবে
না। কারণ, কোম্পানির
ঘনিষ্ঠ লোকজন থেকে ওর নিজের মামা পর্যন্ত কারও কাছেই ওর কোনও খোঁজখবরই নেই।”
আমাদের দু’জনের
একেবারে সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা।
“এ তো গেল
চরিত্রদের কথা। এবার আমি বলতে চলেছি ব্যানার্জির ঘরে আমি কী কী পেলাম। শুনলে চমকে
উঠবেন। হ্যাঁ পাড়ুইমশাই,
আপনি যেটা লক্ষ করেছেন ব্যানার্জির মুখ থেকে লালা পড়ার ব্যাপারটা, আমিও সেটাই
করেছিলাম। কিন্তু পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মুখ থেকে লালা পড়েই। কারণ, একদিকে
পক্ষাঘাত হবার ফলে মুখের আর ঠোঁটের একদিকের কোনও পেশীই কাজ করে না। এবার লাশের মুখ
থেকে গড়ানো সবজেটে লালা সংগ্রহ করে ফরেনসিকে দিয়ে এলাম আসার সময়। সমস্ত ঘরে সেরকম
কিছু না পেলেও পেলাম একটা দু’টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়া হাতির দাঁতের শৌখিন পাইপ। আর যেটা
শুনলে হয়তো অবাক হবেন,
সেটা হল দত্তর গলায় একটা আলপিনের ডগার চেয়েও মিহি ছিদ্র, তাতে এক
ফোঁটা রক্ত। হতেও পারে সেটা শেভিংয়ের ফল, বা অন্য কোনও কিছু। একটা সন্দেহ
হচ্ছে। আরেকটা জিনিস পেলে সেটারও নিরসন হবে, আর অপেক্ষা করতে হবে ময়না তদন্তের।
আমার সন্দেহ সত্যি হলে তো অপরাধ একটা নতুন মাত্রা পাবে!”
“সে-সেটা কী, মশাই?” উৎকণ্ঠার
কণ্ঠ পাড়ুইমশাইয়ের।
“যতদূর অবধি
এগিয়েছি আপনাদের বললাম। এরপর আর বললে আন্দাজের উপর বলা হয়ে যাবে। তাই আজ এটুকু
থাক। আরেকবার যেতে হবে ব্যানার্জির বাড়ি। ওঁর সাথে আর একটু কথাবার্তা চালাতে হবে।
লোকটাকে এখনও তো সেভাবে বুঝেই উঠতে পারলাম না!” বলে রিন্টুদা শেষ করল।
আরও
কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে,
যার বেশিরভাগটাই দ্য ইম্পিরিয়াল সংক্রান্ত, বিকেল বিকেল সবুজ বাহনে চেপে
পাড়ুইমশাই রওনা দিলেন শ্যামবাজার অভিমুখে।
রিন্টুদা
গুগলে বসল আবার। তার ফোকাস এখন বারমুডা থেকে আমাজনের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। আমি
নিরুপায় হয়ে রুবিক্স কিউব নিয়ে পড়লাম। আমাকেও একটু মাথা খাটাতে হলেও হতে পারে, তারই
সম্ভাব্য প্রস্তুতি।
।। ৬
।।
পরদিন আবার
অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল রিন্টুদা। আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আবার পাড়ুইমশাই আর
তাঁর সবুজ গাড়ি। তবে এবার রুবি মোড় দিয়ে ঘুরে সোজা গড়িয়াহাট হয়ে একডালিয়া পৌঁছনো
হল। আজ আমরা নিজেরাই দোতলায় উঠে গেছিলাম কাজের লোক দরজা খোলার পরে। কিন্তু সেখান
থেকে আবার আমাদের উঠতে হল তিনতলায়। বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব নাকি বেশ অসুস্থ। তাই উনি
শোবার ঘরেই আছেন। সেখানেও পৌঁছলাম আমরা। উনি শুয়ে আছেন। পাশে হুইল চেয়ার ভাঁজ করে
রাখা। আমাদের দেখে বাঁহাত তুলে বসার জন্য ইশারা করলেন। বাঁহাতে একটা বাজার চলতি
পাইপ ধরা আছে।
“মুখ থেকে
লালা পড়ে, একদিক
নড়ে না, আবার
শুয়ে শুয়ে পাইপ ফুঁকছে বুড়ো, যত্তসব!” পাক্কা উত্তর কলকাতার ঢঙে ফিসফিস করে উঠলেন পাড়ুইমশাই।
শুরু হল
রিন্টুদা আর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের কথোপকথন। আর আমরা নীরব দর্শক সেজে বসে থাকলাম।
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের কথা কিন্তু খুবই অস্পষ্ট ও জড়ানো আগেও বলেছি, তাও যা
বলছিলেন তা হুবহু লিখে দিলাম এখানে।
“ব্যানার্জিবাবু, আপনার যে
এরকম শরীরের অবস্থা,
আপনার দেখাশোনা কি কাজের লোকেরাই করে?”
“হ্যাঁ, এরা ছাড়া
আমার আর কে আছে? আমি
না মরে শুধু বেঁচে আছি। সব্বাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”
“কেন? আপনি আপনার
ছেলেকে কেন আপনার কাছে এসে থাকতে বলছেন না? দেখুন, আপনার এই বিশাল কোম্পানি চালাবার
জন্য তাকে তো একদিন না একদিন আসতেই হবে। দু-দু’জন ডাইরেক্টর চলে যাওয়ার পর তাকেই তো
এসে তার বাবার বিশাল কোম্পানি দেখতে হবে। আপনি পারেন না, উনি তো ফিরে
এসে দেবাবুর সাথে আবার কোম্পানির হাল ধরতেই পারেন।”
“ও আসতে
পারবে না। ও আসতে চায় না। আমি এখন একেবারেই একা। আর এখানে এলেই তো ওর এবার অনিষ্ট
হবে। ওকে আর আমি দ্বিতীয়বার বাঁচাতে পারব না, মাখালবাবু।”
“এই যে আপনার
বিশ্বস্ত দু’জন
লোক মারা গেলেন পরপর,
এতে তো আপনার ভীষণ ক্ষতি হল সবদিক থেকেই, ব্যানার্জি সাহেব। আর কি আপনার
কোম্পানি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? তারপর এই দুটো খুন পরের পর...”
“মার্ডার? কী বলছেন
আপনি, মিস্টার
মাখাল? আমার
চোখের সামনে দু-দুটো তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেল, আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না আর আপনি
বলছেন খুন? কে, কীভাবে আর
কেনই বা খুন করবে? আমি
অথর্ব, অন্যের
সাহায্যে বেঁচে থাকা নিঃস্ব একটা বুড়ো মানুষ। আর কে করবে খুন? কী পাওয়ার
জন্যে বলতে পারেন?” বৃদ্ধ
উত্তেজনায় রীতিমতো ফুটছেন!
“দেবাবুও ও
কাজ করতে পারেন। আপনি ওঁর একমাত্র সিনিয়র বস, তাই অন্যান্যদের সরিয়ে দিতে পারলে
মালিক হবার দৌড়ে উনিই যে এক নম্বর। আপনার পরে উনিই তো কোম্পানির সমস্তটা জানেন
নিজের হাতের তালুর মতো। আর আপনার যা শরীরের অবস্থা, আপনি তো বাধা দিতেও পারবেন না। আর
হয়তো দেখা গেল, দু-তিনদিনের
ভিতর আপনারও ঠিক ওই একইভাবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হল!” তুরুপের তাস
আস্তিন থেকে ছাড়ল আমাদের পি.সি.এম।
“অজয়কে আপনি
কতটুকু চেনেন? ও
আমার মানসপুত্র। আজ এই তিয়াত্তর বছর বয়সে একমাত্র ওর কাঁধে ভর করেই অবশিষ্ট জীবন
স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারি, জানেন?”
“তাহলে বাকি
দু’জনের
উপর কি ঠিক ভরসা করা যেত না, সাহেব? মানে কোনওভাবে কি আভাস পেয়েছিলেন যে ওঁরা আপনার ও আপনার
কোম্পানির ক্ষতিসাধনে উদ্যত?”
“আমি আপনার
প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই!” এই প্রথম ভদ্রলোককে নার্ভাস দেখাল।
রিন্টুদা
বলল, “আচ্ছা
ছাড়ুন, ব্যানার্জি
সাহেব। আপনি কী তামাক ব্যবহার করেন – হাভানা, না স্ট্রং
কিউবান? আসলে
আগেরদিন আমি আপনার এটা ওই ঘরের মধ্যে পাই। ভেঙে গেছিল। দামি জিনিস, তাই কুড়িয়ে
নিয়ে যাই। গন্ধটা শুঁকে যেন কিউবান টোব্যাকোই মনে হল। এই নিন, আপনার আইভরি
পাইপ।”
ভদ্রলোক
রিন্টুদার সাংঘাতিক প্রশ্নবাণের আক্রমণ হঠাৎ প্রশমিত হওয়ায় খুব ক্লান্তভাবে বাঁহাত
বাড়িয়ে ওই পাইপ নিলেন। তারপর হঠাৎ যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লেন ডুকরে কেঁদে উঠে, “আমার আর
কিচ্ছু পাওয়ার নেই প্রভাতবাবু, আমি শারীরিক আর মানসিকভাবে ভয়ংকর বিধ্বস্ত। আপনি গোয়েন্দা, আপনারা
কাউকেই সন্দেহের উপর রাখেন না। হয়তো ভেবেছেন আমি কোনওভাবে এই মৃত্যুগুলির সাথে
জড়িত। কিন্তু না, কোনওভাবেই
না। আপনি এত চেষ্টা করলেন যখন, আর আপনি লড়ছেন যখন আমার কোম্পানির দু’জনের মৃত্যু
রহস্য নিয়ে, তখন
একটা সত্যি কথা অন্তত আপনাকে বলে দেওয়া আমার কর্তব্য। আমার একমাত্র ছেলে শৈবাল
একবার কিডন্যাপ হয়েছিল শুনেছেন নিশ্চয়ই। আজ আপনি বললেন, ও যদি ফিরে
আসে - সবাই বলে জানেন,
আমার ছেলেটাকে কেউ পছন্দ করে না। কী করে আসবে বলুন তো? কিডন্যাপারদের
হাত থেকে তো ওকে আমি রক্ষাই করতে পারিনি। ওরাই তো ওকে শেষ করে দেয় নৃশংসভাবে, আমার চোখের
সামনে। মুক্তিপণের টাকাও হাতিয়ে নিয়ে যায় আমার মাথার পিছনে ভোঁতা রাবারের হাতুড়ি
মেরে অজ্ঞান করে। পার্টনারদের আর পৃথিবীর সামনে এই ঘটনা গোপন রাখতে আমি অনেক লোকের
মুখ বন্ধ করিয়ে কানাডার গল্প তৈরি করি।” বৃদ্ধের চোখে জল ছিল আগেই, এখন কণ্ঠ
রুদ্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি।
ঘরের ভিতর
একটা আলপিন পড়লেও যেন একটা বিস্ফোরণের মতন শোনাত। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা, পাড়ুইমশাই
হতভম্বের মতন এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, আর রিন্টুদার মাথা নিচু, কপালের
শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। উঠে গিয়ে বৃদ্ধের কাঁধে একটা হাত রেখে সমবেদনা জানাবার একটা
ক্ষীণ চেষ্টা করে বলল,
“এটা আমি ভাবতেই পারিনি ব্যানার্জিবাবু, কিছু মনে করবেন না। আমি শৈবালকেও সন্দেহের
তালিকায় রেখেছিলাম। এই কিডন্যাপারদের কি আপনি চিনতেন?”
বৃদ্ধ
হ্যাঁ-বাচক মাথা নাড়লেন। রিন্টুদা এর মধ্যেও বিদায় নেবার আগে দোতলার সেই ঘরটা
আরেকবার দেখতে চাইল বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের কাছে। বৃদ্ধ ভাবলেশহীন মুখে সম্মতি
দিলেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। ওঁর জীবনটা কী ভীষণ কষ্টের! স্ত্রী আর পুত্র চোখের
সামনে মারা গিয়েছে, কিন্তু
ব্যাবসা চালাবার জন্য সেই সত্যকে গোপন রেখে অর্ধেক শরীর নিয়ে উনি মৃত্যুর দিন
গুনছেন, তার
উপর আবার পুলিশ আর গোয়েন্দার ছুরিকাঁচির আঘাত!
রিন্টুদা
বেরিয়ে আসতে আমরা গাড়িতে চেপে বসতেই ওর মুখে একটা অপার্থিব হাসি দেখে স্তম্ভিত হয়ে
গেলাম।
“আমি একেবারে
সঠিক দিকেই যাচ্ছি। জয় বাবা ফেলুনাথ! জয় বাবা মানিকনাথ! জয় বাবা হোমস! শুধু
শৈবালের ব্যাপারটায় একটু ফাঁপরে পড়ে গেছিলাম, কারণ ও যে একেবারেই নেই সেটা একবারও
ধরতে পারিনি। এছাড়া কেস মোটামুটি শেষের দিকে ধরতে পারিস, শুধু
ফরেনসিক রিপোর্ট আসার জন্য বসে থাকতে হবে।”
পাড়ুইমশাই
স্টিয়ারিং ধরতে ধরতে বললেন,
“এবার তো সোজা। খুন করেছেন আপনার মক্কেল নিজেই। আরে, আপনার
বাড়িতে যিনি কেস নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি ছাড়া কেউ করেননি খুন। আর ওই বুড়ো মানুষটাকে
আর বিরক্ত করবেন না,
মশাই। আমার এখনও চোখে জল আসছে। আর যদি বলেন দেবাবুও খুন করেননি, তাহলে মশাই
খুনই হয়নি। ওগুলো অপমৃত্যুই বটে।”
রিন্টুদা
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ প্রবলভাবে অট্টহাস্য করে উঠল এত জোর, যে আশেপাশের
লোকজন চমকে উঠে তাকাল,
আর ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে,
প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে ভদ্রলোক গাড়ির চাবি ঘোরালেন। আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল
রিন্টুদার উপর। এতটা তাচ্ছিল্য ভালো কি?
।। ৭
।।
ঠিক দু’দিন পরে
ফরেনসিক আর পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পেয়েই রিন্টুদা ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে গেল একাই
গড়িয়াহাট থানার উদ্দেশ্যে। দুপুরের দিকে ফোন করে আমায় বলল, “হয়ে গেল
খুনের কিনারা। পাড়ুইমশাইকে নিয়ে এক-দেড় ঘণ্টার ভিতর চলে আয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
আমি দেবাবুকেও ডেকে নিয়েছি। আজ তোদের কল্পনার বাইরের একটা জিনিস ঘটতে চলেছে রে
নন্দন। এই কেসটা আমার জীবনের অন্যতম হয়ে থাকবে।” বলে দুম করে ফোনটা কেটে দিল। আজব
মানুষ। আমি ওর ডানহাত,
আমাকেও বিন্দুমাত্র আভাস দিল না কে খুনি! অবশ্য ঠিকই আছে। নাটকীয়তা তো বজায়
রাখতেই হবে ওকে, ফেলুদা
ফ্যান্টাসি!
কী আর করি।
পাড়ুইমশাইকে খবর দিয়ে চলে আসতে বললাম। ভদ্রলোক সেদিনের পর থেকে কেমন যেন গম্ভীর
হয়ে রয়েছেন। স্বাভাবিক। রিন্টুদার মধ্যে এই চাপা অহংকারের ভাবটাই ওর একমাত্র দোষ।
বিদ্রূপ করার একটা সীমা থাকে। কিন্তু ফেলুদার একনিষ্ঠ সেবক হতে গিয়ে ও যেন একটু
বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলে।
পাড়ুইমশাই
এসেই আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন। আজ মুড হঠাৎ যেন চনমনে। একগাল হেসে বললেন, “হু হু বাবা, চলো
নন্দনভাই, দেখি
তোমার দাদার খেল!”
রিন্টুদার
উপর এতকিছুর পরেও অগাধ বিশ্বাস।
সময়ের ভিতরই
পৌঁছে গেলাম আমরা।
আজ দোতলার
ঘরে গোল করে বসে সবাই। বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব, তাঁর পাশে রিন্টুদা, তার পাশে
গড়িয়াহাট থানার ওসি দীপ্তবাবু, পাড়ুইমশাই, দেবাবু, ডাঃ সেন আর আমি। বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব যথারীতি তাঁর চেয়ারে
বসা, শুধু
তাঁর বাঁহাতে কবজির একটু ওপরে একটা ব্যান্ড-এড লাগানো। ঘরে কোনও কাজের লোক উপস্থিত
নেই। এই পরিস্থিতিতে শুরু হল রহস্য উন্মোচনের পালা।
“দ্য
ইম্পিরিয়ালকে হাতে ধরে চলা শিখিয়েছিলেন ব্যানার্জিবাবু বা বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব।
আট মাস পরে নিজের হাতে পরখ করে বেছে নেন দেবাবু, ওরফে অজয়মোহন দেকে। দু’জনে মিলে
আক্ষরিক অর্থেই জমিয়ে তোলেন কোম্পানির জয়যাত্রা। আস্তে আস্তে ব্যাবসা ছড়িয়ে পড়ে
দেশে ও বিদেশেও। কাজ শুরু হয় জাভা, সুমাত্রা আর বোর্নিওতে। এই সময়ে এই
দু’জন
মিলেই ব্যাবসার প্রসার ঘটান এই সমস্ত জায়গায়। আস্তে আস্তে ব্যাবসা ছড়িয়ে পড়ে
দক্ষিণ আমেরিকায় মূলত ব্রাজিল, পেরু আর বলিভিয়ার সাথেও। স্বাভাবিকভাবেই এইসব অঞ্চল এই দু’জনের প্রচুর
যাওয়া। কিন্তু কাজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দু’জনে আর সামলানো যাচ্ছিল না, তাই
কোম্পানিতে আসেন শূরবাবু,
অর্থাৎ শ্রী শ্যামল শূর। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, সুযোগ সন্ধানী, ব্যাবসার
সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি, সর্বোপরি
অর্থের লোভ, এগুলি
ছিল ওঁর বিশেষ ক্ষমতা। যদি ভুল বলি বা কোনওরকম ত্রুটিবিচ্যুতি হয় আমায় দয়া করে
শুধরে দেবেন আপনারা।”
বলে থামল রিন্টুদা।
সবাই
মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনে যাচ্ছে। আর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব বা দেবাবুর কাছ থেকে কোনওরকম
বাধা না পেয়ে এবার শুরু করল রিন্টুদা। একেবারে অতর্কিত আক্রমণ। উদ্দেশ্য, বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেব।
“আচ্ছা
ব্যানার্জিবাবু, আপনার
স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আপনি কি আর দক্ষিণ আমেরিকা গেছিলেন কাজে?”
“হ্যাঁ
গেছিলাম, মানে
কাজের জন্যই যেতে হয়েছিল আমায়। কেন বলুন তো?”
“না মানে, এত বছর ধরে
আপনি ওখানে ব্যাবসা চালাচ্ছেন তো, ওদেশগুলোতে আপনার চেনা পরিচিত নিশ্চয়ই প্রচুর? আর ওদেশে
নিশ্চয়ই আপনার কোম্পানির জন্য স্থানীয় অনেক কর্মচারী নিতে হয়েছিল?”
“নিশ্চয়ই। এ
আবার একটা বলার কথা?”
উত্তরটা এল দেবাবুর কাছ থেকে।
“আচ্ছা, আপনার হাতের
পাইপটা একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারি?” হঠাৎ বলল রিন্টুদা।
আমি চমকে
উঠে পাড়ুইমশাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখি উনিও আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে।
রিন্টুদা
এলোমেলো প্রশ্ন করে কি সবাইকে ঘাবড়ে দিতে চাইছে? কী করতে চাইছে ও ঠিক বুঝতে পারলাম না
আমি।
একটু অবাক
হয়েই যেন পাইপটা এগিয়ে দিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব।
“এই ধরনের
পাইপ আপনি কোথায় পেলেন,
ব্যানার্জিবাবু?
মানে হাতির দাঁতের তৈরি অপূর্ব এই পাইপ তো সেভাবে পাওয়া যায় না, অর্ডার দিয়ে
বানাতে হয়।”
একদিকে ঠোঁট
ঝোলা বিকৃত একটি শ্লেষের হাসি হাসলেন বন্দ্যোপাধ্যায়। “আপনি সম্ভবত
ওদিকটায় যাননি প্রভাতবাবু,
তাই একথা বললেন। ওখানে চোরা শিকারিদের দৌলতে হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র ভীষণ
সুলভ। তা এরকম পাইপ কি আপনার দরকার? বেশ তো, অজয় পরের
বার গেলে আপনাকে এনে দেবে একটা।”
কথা বলতে
বলতে রিন্টুদা কখন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে তাঁর চেয়ারের পিছনদিক দিয়ে
ঘুরে তাঁর ঠিক বাঁ-পাশটিতে বসে পড়েছে টেলিফোনের সামনে রাখা মোড়ায়। হিসহিসে গলায়
বলে উঠল, “ফরেনসিক
টেস্টের ফল বেরিয়েছে ব্যানার্জিবাবু, আর তার সঙ্গে আপনার পাপনের পোস্ট
মর্টেমের ফলও। ওঁর মৃত্যু যে স্বাভাবিকভাবে হয়নি...”
এই কথাগুলো
বলতে থাকার মাঝেই বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁহাত নিচে নামতে শুরু করেছিল তাঁর পাঞ্জাবীর
পকেটের দিকে। রিন্টুদা হঠাৎ করে সেই হাত ধরে ফেলে সটান পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে
বার করে আনল আরেকটি পাইপের অর্ধেক অংশ। এই অংশটি সাধারণ পাইপের চেয়ে অনেকটা বেশি
লম্বা, প্রায়
ইঞ্চি পাঁচেক। রিন্টুদা বলল, “এইটি বোধহয় ওখানকার সব দোকানেও বেশ দুর্লভ, চাইলেই
পাওয়া যায় না এমনিতে। তাই না, ব্যানার্জি সাহেব?”
বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেবের শরীরে যেন একটা ভূমিকম্প হল। ওঁর জরাজীর্ণ শরীরে যেন হঠাৎ ভূতে ভর করল। এক
চোখ বিস্ফারিত, কপালের
শিরা দপদপ করছে, বড়ো
বড়ো নিঃশ্বাস, মুখ
দিয়ে লালা ঝরতে লাগল,
আর উনি প্রত্যেকের দিকে একটা চোখ দিয়ে যেন অগ্নিবর্ষণ করতে লাগলেন। আর সেই
দৃষ্টি সবার শেষে গিয়ে থামল দেবাবুর দিকে।
রিন্টুদা
বলল, “আমি
আজ স্থান পরিবর্তন না করলে,
বা এই বিশেষ পাইপটি বাজেয়াপ্ত না করলে আপনারও আজ হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত
এতক্ষণে, দেবাবু
!”
দেবাবু
হতভম্বভাবে তখনও চেয়ারের সাথে সেঁটে কাঠের মতন বসে। তাঁর চোখ তখনও বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেবের দিকে নিবদ্ধ,
মুখ পুরোপুরি পাংশু।
“আর আমি কিছু
বলব না, বলবেন
ব্যানার্জিবাবু নিজেই। কী ব্যানার্জিবাবু, আমায় আশা করি আর নতুন করে আপনার
কারুকলার বর্ণনা দিতে হবে না?”
বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেব পাথরের মূর্তি হয়ে মাথা বুকের কাছে ঝুলিয়ে বসে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও
পর্যুদস্ত। উনি যে পি.সি.এম-এর সন্মুখীন হননি এর আগে!
শুরু হল
একটি জীবনের নিদারুণ সংঘাত প্রতিঘাতের রোমহর্ষক কাহিনি। ধুঁকতে ধুঁকতে বলে চললেন
ব্যানার্জি ববু, আর
পুরোটা রেকর্ড হতে লাগল আমার ছোটো রেকর্ডারে।
“আমি আর দে
কোম্পানিটাকে কোথায় তুলে নিয়ে গেছিলাম! আমাদের মধ্যে কোনও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
আমার স্বপ্নের ইম্পিরিয়ালকে আমরা দু’জন আরও অনেক বড়ো করার স্বপ্ন দেখে
চলতাম এবং সে-কাজে আমরা আস্তে আস্তে চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগোচ্ছিলাম। ব্যাবসা যখন
দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে গেল,
বাধ্য হয়েই আমাদের যোগ্য লোক খুঁজতে হল। কোম্পানিতে পা রাখল শ্যামল শূর। সেও
ভালো ছিল, কিন্তু
তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সর্বগ্রাসী। সে চাইত বিলাস, অর্থ, ক্ষমতা, বৈভব আর
মালিকানা - সবকিছুই। কিন্তু ওর মাথাটা ছিল ভীষণ পরিষ্কার আর তাই প্ল্যানিং, স্ট্র্যাটেজি, বিজনেস
এক্সপ্যানশন,
ওভারসিস কমিউনিকেশন,
এসবের দিকে আমাদের আর নজর দিতেও হত না। এরপরে আমার গিন্নির আবদারে আর
পরিস্থিতি বুঝে বাধ্য হয়ে কোম্পানিতে আনতে হল আমার অযোগ্য শ্যালককে। আর সেই
গোড়াপত্তন হল সর্বনাশের।”
দম নেবার জন্য থামলেন ভদ্রলোক।
তারপর আবার
বলে চললেন, “শূর
আসার কয়েকমাস পরেই পাপনকে নিয়ে আসি আমরা কোম্পানির চতুর্থ ডাইরেক্টর হিসাবে এবং
আমার আর দের অগোচরে শুরু হয় ক্ষমতা আর অর্থের জন্য অশুভতম নেক্সাস। ওরা কোম্পানিতে
আসার একবছরের ভিতর আমরা সবাই ব্যাবসা আর বেড়ানোর একটা প্রোগ্রাম বানাই দক্ষিণ
আমেরিকায়, পরিবার
সহ। পরিবার বলতে আমি,
আমার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে তোতোন। দে আর পাপন অকৃতদার। শুধু শ্যামলের কথা
ছিল তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবার, কিন্তু বিশেষ কোনও কারণের জন্য সেও একাই গেছিল। প্রথম ক’দিন বেশ
ভালো ঘোরাঘুরি ও তারই মধ্যে কিছু মিটিং, কন্ট্রাক্টস, আর নতুন
ব্যাবসার আলোচনায় সফল কাজকর্মের পর শেষদিন আমরা একটা রিভার সাফারিতে গেছিলাম
টোক্যান্টিন্স নদীতে। সেদিনটা আমার জীবনে যে কী বিপদ ডেকে এনেছিল এবং সেটা এতটাই
অতর্কিতে এসেছিল,
তা আমি জীবনে ভুলতে পারব না।”
আমরা কাঠের
পুতুলের মতন বসে পুরো গল্প শুনছিলাম। রিন্টুদা ঘরের ভিতর পায়চারি করছিল। ভদ্রলোক
থামতে ও এগিয়ে এসে নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা পুরনো থার্মোমিটারের খাপ বার
করে সেন্টার টেবিলে রাখল। সবাই সেদিকে কৌতূহল ভরে তাকাতে রিন্টুদা মুচকি হেসে বলল, “এটা কী পরে
বলছি, আগে
আপনারা ব্যানার্জিবাবুর পুরো কথাটা শুনে শেষ করুন।”
“সকালে
সাফারি শুরু করেছিলাম আমরা। শ্যামলের আমেরিকা নিয়ে পড়াশোনা থাকায় আমরা সেদিন আর
কোনও গাইড ছাড়াই বেরিয়েছিলাম। নদীবক্ষে চলতে চলতে পৌঁছলাম নদীর সবচেয়ে গভীর আর
খরস্রোতা অংশে। ডেকে বসেছিলাম আমি, আমার স্ত্রী, অজয় আর
পাপন। শ্যামল ছিল তার কেবিনে। তোতোন তার কেবিনে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ বিপদের কোনও আভাস
না দিয়েই ঝড়ের মতন ডেকে উঠে এল শ্যামল। তার হাতে রিভলভার, সেটি আমার
দিকে তাক করা। অতর্কিত এই ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই যেন ঘটে গেল সর্বনাশ। শূর চাপা
হিসহিসে গলায় বলল পাপনকে,
অপারেশন ইম্পিরিয়াল শুরু করো দত্ত।
“পাপনের গায়ে
বরাবরই বুনো মোষের শক্তি। ও আমাকে আর অজয়কে দু’হাতে চেপে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে
লাগল স্টিমারের ধারে,
আর শ্যামল বলে যেতে লাগল, ঠিক এখানেই ফেলতে পারলে কোনও ট্রেস পাওয়া যাবে না দত্ত, তাড়াতাড়ি
করো।
“কিছু বোঝার
আগেই এইসব হল, আর
আমরা সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই দেখলাম পাপনের আসুরিক শক্তি আমাদের দু’জনকে নদীর
অতলান্ত জলের কাছে নিয়ে এসেছে। অমোঘ মৃত্যুকে যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। বাধা
দেওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। ছিল না বাঁচাবার কেউ। শূরের উদ্যত রিভলভার আর পাপনের
অতীন্দ্রিয় শক্তির সামনে আমাদের মৃদু প্রতিরোধের চেষ্টা যেন খড়কুটোর মতন ভেসে
যাচ্ছিল। হঠাৎ কী হল জানি না, আমার স্ত্রীর প্রবল চিৎকার আর এলোপাথাড়ি আক্রমণে পাপনের
হাতের বাঁধন যেন একটু আলগা হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু, সরে যা
দিদি! বলে পাপন তার কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে তার দিদিকে সরাতে যেতেই ঘটে গেল
বিপর্যয়! সবার চোখের সামনে আমার স্ত্রী রেলিং টপকে ছিটকে ওই নদীতে পড়ে গেল। চোখের
সামনে এটা ঘটতে দেখে পাপন আমাদের ছেড়ে দিলেও, কারও কিচ্ছু করার কোনও উপায় ছিল না।
তলিয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে থেকে একটা তরতাজা প্রাণ, আমার
জীবনসঙ্গিনী। নিষ্ফল আক্রোশে আর্ত চিৎকার ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না আমার
জীবনের সবচেয়ে বড়ো বন্ধুর জন্য। পাপনও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল ঘটনার
আকস্মিকতায়। এর পরও বোধহয় আমরা দু’জন খুন হতাম শূরের গুলিতে হঠাৎ ঘুম
ভেঙে ছোট্ট তোতোন ডেকে না উঠে এলে।”
চোখের গড়িয়ে
পড়া জল মোছার কোনও চেষ্টাই করলেন না বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব।
“সেদিন থেকেই
আমরা দু’জন
হয়ে রইলাম সকলের চোখে ডাইরেক্টর, আর আমাদের কাজ করতে হত ওই দুই অপরাধীর বন্দুকের নিচে। ওরা
দু’জনে
এত বড়ো কোম্পানি চালাতে পারবে না বলে আমাদের মারেনি আর, কিন্তু
রাশটা নিজেদের হাতেই নিয়ে নিয়েছিল আমাদের অর্ধেক মেরে ফেলে। ওদের অধীনেই কাজ করতে
বাধ্য হলাম। নিষ্ফল আক্রোশে মনের ভিতর জ্বলতে লাগল তুষের আগুন ধিকিধিকি, নিরন্তর। দে
আর আমার অবস্থাটা ভাবুন একবার, মৃত্যু-ভয়ে নিজেদের হাতে তৈরি কোম্পানির সব মুনাফা তুলে
দিচ্ছি দুই অপরাধীর হাতে। আর কান এঁটো করা শয়তানি হাসি হেসে আমাদেরকে আঙুলের তলায়
পিষে মারছিল আমার নিজের শ্যালক আর শূর।”
“আপনারা দু’জন পুলিশকে
কেন খবর দেননি, বা
আমার কাছেও তো আসতে পারতেন সব জানাতে। সেই এলেনই যখন, আর এই দু’জন মারাত্মক
অপরাধীকে হাতেনাতে ধরিয়ে দেবার জন্য।” বলল রিন্টুদা।
এবার হয়তো
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্যই দেবাবু বলতে শুরু করলেন ধাতস্থ
হয়ে একটু, “কোনওভাবেই
উপায় ছিল না ছাড়া পাওয়ার,
মাখালবাবু। ওরা একেবারেই আঁটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল। সমস্ত মহলের লোককে হাতে
করে রেখেছিল ওরা আর আমাদের একটাই ভয় ছিল, তোতোনকে ওরা না কিছু করে বসে। তাই
আমরা দু’জন
সর্বদা ওকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু ওই ঘটনার দেড় বছর পর একদিন একটা ফোন এল
বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেবের কাছে। তোতোনের স্কুলের ম্যাডাম ফোন করে জানালেন যে স্কুল
থেকে বাচ্চাদের এক্সকার্শনে নিয়ে যাওয়া হবে, আর যাওয়াটা নাকি বাধ্যতামূলক। আমরা
অনেক আলোচনা করলাম, কিন্তু
ম্যাডামকে অনেক অনুরোধ করেও তোতোনের যাওয়া আটকাল না। সেই তোতোনের বাড়ি থেকে শেষ
চলে যাওয়া। প্রভাতবাবু,
আপনি তো দত্তর সাথে কথা বলেছিলেন। ও এতটাই ধূর্ত আর শয়তান, যে দুধের
শিশুটাকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ওর মহিলাসুলভ কণ্ঠস্বরকে কাজে লাগিয়ে স্কুলের
টিচার সেজে তুলে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। আপনারা বলবেন, স্কুলে খোঁজখবর না নিয়ে কেন এত যত্নে
আগলে রাখা ছেলেকে একটা ফোনের ভরসায় যেতে দিলেন আপনারা। উপায় ছিল না। শ্যামল শূর
তখন আমাদের কাছে টেরর,
মূর্তিমান আতঙ্ক বিশেষ। ওরই অঙ্গুলিহেলনে আমাদের অসহায়ভাবে তোতোনকে পাঠাতে হয়।
ওরা অবশ্য এত কাণ্ড না করলেও পারত। কিন্তু সাহেবের গচ্ছিত টাকাপয়সার খোঁজ না পেয়ে
ওঁর কাছে একটা মুক্তিপণ আদায় করার চক্রান্ত করে। উদ্দেশ্য ছিল টাকাও নেবে, ছেলেটাকেও
মারবে আর ওঁকেও সরিয়ে দিয়ে পুরোটা হাতাবে, আর দোষ পড়বে অজানা কিডন্যাপারদের
উপর। মাস্টার প্ল্যান বানাতে জুড়ি ছিল না শূরের। শুধু যদি এত বুদ্ধি ভালো কাজে
লাগাত ও! তাই ওঁর সামনে ওঁর একমাত্র ছেলেকে খুন করে, টাকা নিয়ে, ওঁকে
রীতিমতো ঘায়েল করেই শাসায় ওদের পরিচয় গোপন রাখতে। তারপরের ঘটনা নিশ্চয়ই সাহেব
আপনাদের বলেছেন?”
রিন্টুদা
বলল, “তাহলে
দেবাবু আমাদের কাছে এত ঘটনা গোপন করেছিলেন কেন? সেদিনই তো সব বলতে পারতেন। কারণ, শূরবাবু তো
আর বেঁচে ছিলেন না তখন।”
“কিন্তু ওই
শয়তানটা তো বেঁচে ছিল! দিদির প্রাণের ভাই পাপন!” গর্জে উঠলেন ব্যানার্জি সাহেব।
এবার আবার
শুরু করলেন বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব। “জগতের সামনে এটা প্রচার করা হল যে
আমি তোতোনকে উদ্ধার করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর সেদিন থেকে আমি, হ্যাঁ আমি
একা এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। কী আর ছিল আমার জীবনে
অবশিষ্ট? যাদের
জন্য আমার বেঁচে থাকা,
তাদের খুনিদের শাস্তি না দিয়ে আমি মরব না এই প্রতিজ্ঞায় বেঁচে রইলাম। আস্তে
আস্তে এমন ভাবভঙ্গী করতে শুরু করলাম যেন আমি পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছি; নিজেকে আর
নিজের অদৃষ্টকেও ওদের হাতে তুলে দিয়েছি। এতে আস্তে আস্তে এদের বজ্রকঠিন বাঁধুনিটা
কমে আসতে লাগল। যতই শয়তান হোক, পেশাদার ক্রিমিনাল তো নয়। আস্তে আস্তে ওরাও বিশ্বাস করতে
শুরু করল যে আমি একবারেই নির্বিষ কোমর ভাঙা সাপে পরিণত হয়েছি। এই সুযোগ নিয়েই আমি
একা শেষবারের মতন আবার পৌঁছলাম ব্রাজিল। যেতে দিল ওরা। কারণ, ওই কাজ
সামলানো ওদের এলেমে ছিল না।”
“এখান থেকে
আমি বলি। আপনি তো পুরোটাই বললেন, ব্যানার্জিবাবু। দেখা যাক, আমার অনুমান আর আপনার কর্ম-পদ্ধতি
আমি এক জায়গায় আনতে সক্ষম হয়েছি কি না!” বলল রিন্টুদা।
শুরু করল
রিন্টুদা। “ভাঙা
মন নিয়ে আর প্রতিহিংসার আগুনে পুড়তে পুড়তে ব্যানার্জিবাবু পৌঁছলেন দক্ষিণ আমেরিকা।
দীর্ঘদিন ওদেশে কাজ করার ফলে ওঁর প্রচুর মানুষের সাথে আলাপ হয়েছিল, আর অনেক
দেশি-বিদেশি জিনিসের সুলুকসন্ধানও জানতেন। নানাভাবে কথাবার্তা বলে উনি চোরা
শিকারিদের সাথে মিলেমিশে জোগাড় করলেন এই হাতির দাঁতের তৈরি পাইপের সেট। আর তাদের
দিয়েই বানিয়ে নিলেন এই বিশেষ পাঁচ ইঞ্চি লম্বা পাইপটি। এর বিশেষত্ব হল, এর একদিকে
আছে মুখে লাগাবার মতন সিগারেট হোল্ডার, আর একদিকে আছে প্যাঁচ, যা ওই বিশেষ
হাতির দাঁতের তৈরি পাইপের সাথে লাগিয়ে ফেলা যায়। এই লম্বা পাইপটি আর কিছুই নয়, একটি
মারাত্মক ব্লো-গান। এই ব্লো-গান বা ব্লো-পাইপ ব্যবহার করে দক্ষিণ আমেরিকার
আদিবাসীরা আজও। তারা ছোটোখাটো প্রাণী ও পাখি শিকার করে।”
প্রথম কথা
বললেন গড়িয়াহাটের ওসি। “আপনি
কী করে ধরলেন যে এই সাংঘাতিক অস্ত্র এখানে ব্যবহার হতে পারে, প্রভাতবাবু?”
“দত্তবাবুর
মৃত্যুর দিন আমি ভাঙা পাইপটি সংগ্রহ করি। কিন্তু তাতে কোনওভাবেই কড়া কিউবান
টোব্যাকো ছাড়া আর কিছুর গন্ধ পাইনি, যা আমায় বলে দেয় যে ওই পাইপের বিশেষত্ব
কিচ্ছু নেই। পরে দীপ্তকে দেখিয়ে ওটি রেকর্ড করিয়ে আমি ব্যানার্জিবাবুকে দিই। অথচ
আমি দত্তর মৃতদেহে পরিষ্কার দেখেছি, একটি আলপিনের দাগের মতন ফুটো আর তাতে
রক্ত। তখন আমার মাথায় আসে যে একজন প্রায় চলৎশক্তিহীন মানুষ যদি কাউকে মেরে ফেলার
মতন অপকর্ম করতে চান তিনি কী পন্থা নেবেন। হিসেব কষতে কষতে বেরোয় যে ওঁর কাজের
জায়গাটা ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, আর সেখানকার একটি অতি প্রচলিত অস্ত্র হল গিয়ে এই ব্লো-গান।
তারপর আসে ছুঁচ বা ডার্ট-এর প্রশ্ন, যেটার দ্বারা খুনটা হবে। দ্বিতীয় দিন
যখন আমরা ব্যানার্জিবাবুর কাছে গেলাম, সেখানে শুনলাম তোতোনের মৃত্যুরহস্য, সেদিনও আমি
ও-ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার ভাগ্য বলতে হবে যে আমি ডার্টটিকে খুঁজে পাই পর্দায় গাঁথা
অবস্থায়, সেই
জানালায় যেটা ঠিক দত্তবাবুর আসনের পিছনে ছিল। ওটি ওঁর গলার একেবারে ধার দিয়ে ঢুকে
আবার বেরিয়ে গিয়ে পর্দায় গেঁথেছিল। আপনি ওটাকে আপনার এভিডেন্স হিসেবে সংগ্রহ করতে
পারেন ওসি সাহেব, ওটি
ওই থার্মোমিটারের খাপের ভিতর তুলোয় মোড়া অবস্থায় ভালো করে রাখা আছে।”
বলে চলল
রিন্টুদা, “ব্রাজিল
থেকে ফিরে আসার পর দুর্ভাগ্যের কোপ নতুন করে আবার পড়ল ব্যানার্জিবাবুর উপর।
সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে পঙ্গু হয়ে গেলেন উনি। চালু রইল খালি তাঁর বাঁদিক। কিন্তু
প্রতিহিংসার চরম স্পৃহা আর অদম্য জীবনীশক্তির জোরে ব্যানার্জিবাবু এবার নতুন করে
তাঁর অবশিষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে বাঁহাতে অনুশীলন শুরু করলেন অব্যর্থ লক্ষ্যে
ব্লো-গান থেকে ডার্ট নিখুঁতভাবে ছুড়ে মারার। একাগ্র চিত্তে সমস্ত মনের জোর খাটিয়ে
সেই বিদ্যায়ও পারদর্শী হয়ে উঠলেন তিনি এবং আত্মবিশ্বাস যখন অর্জন করলেন, প্রথম খুনটি
করলেন উনি শূরবাবুকে,
নিখুঁতভাবেই। আর কোনওভাবে ধরা পড়ার থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন তাঁরই বিশ্বস্ত
হাউজ ফিজিশিয়ান, ডাঃ
সেন। কী ডাঃ সেন, আমি
ঠিক বলছি কি?”
মাথা হেলিয়ে
নীরবে সম্মতি জানালেন ডাক্তারবাবু।
হঠাৎ ধড়মড়
করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর শব্দে চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখি পাড়ুইমশাই এমন একটি
অভিব্যক্তি ধারণ করেছেন,
যেটার জন্য একটি বিশেষণই যথেষ্ট - জটায়ুচিত! একগাল হাসি নিয়ে তিনি হয়তো
স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রিন্টুদাকে জড়িয়ে ধরতে পারেন, এই আশঙ্কায় গলা খাঁকরে রিন্টুদা ওঁকে
বিরত করার চেষ্টা করল,
কিন্তু পুরোপুরি আটকাতে পারল না।
“হামারা
গুস্তাখি মাফ কিজিয়ে জাঁহাপনা। আপনি শ্রেষ্ঠ, আমি নিমিত্তমাত্র।”
সবাই ওঁর
দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল বিন্দুমাত্র কিচ্ছু না বুঝে।
রিন্টুদা
প্রাঞ্জল করল, “আলাপ
করিয়ে দিই আবার নতুন করে,
ইনি আমার খুব কাছের মানুষ, শ্রী হর্ষবর্ধন পাড়ুই, উত্তর কলকাতার একটি বিখ্যাত মিষ্টির
দোকানের মালিক, আমাদের
প্রতিটি অভিযানে আমরা তিনজন একসাথে থাকি। আমি নিজে সত্যজিৎ রায় সাহেবের ও তাঁর
সৃষ্ট ফেলুদার বিশেষ ভক্ত। আপনারা জানবেন যে ফেলুদার সহচর যেমন ছিলেন জটায়ু, পাড়ুইমশাই
হলেন গিয়ে আমাদের সেই মহামূল্যবান সঙ্গী। এই কেসেও উনি একটি গুরুত্বপূর্ণ
অবজার্ভেশন করেছেন, আর
তাতেই কিন্তু আমার পক্ষে বিশেষ সুবিধে হয়েছে কিনারা করতে এই রহস্যের।”
ভদ্রলোক
ভীষণ লজ্জা পেয়ে একেবারে মাথা নিচু করে বসে পড়ে নখ খুঁটতে লাগলেন, আর জিভ কেটে
মাথা নাড়াতে লাগলেন।
আজ
রিন্টুদার জন্য গর্ববোধ হল। হাজার অপমান করলেও আসল জায়গায় পাড়ুইমশাইকে স্বীকৃতি
দিল সে। আমি এরমধ্যেই একটা ছোট্ট করমর্দন সেরে ফেললাম ওঁর সঙ্গে। ফিসফিস করে
জানালেন পাড়ুইমশাই,
“আজ ডিনারটা আমার তরফ থেকেই হবে কিন্তু চাংওয়াতে।”
“এবার সকলে
প্রশ্ন করতে পারেন আমায়,
যে একটা ছোট্ট ডার্ট যদি গলার ভিতর দিয়ে আলপিনের মতন ছোটো ছিদ্র করে বেরিয়েও
যায়, তাতে
একজন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ
মানুষের মৃত্যু হয় কী করে! এর উত্তর দেবে দত্তবাবুর মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া সবজে রঙের
লালা। এবার কি আপনি বলবেন?
নাকি আমিই বলব, ব্যানার্জি
সাহেব?”
বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহেব আর কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। হাঁফ উঠছিল। আর
কপালের শিরাগুলি যেন ফুলে উঠেছিল। তা দেখে ডাঃ সেন তাঁকে উঠে দেখতে যেতেই বাঁহাত
বাড়িয়ে তাঁকে নিরস্ত করলেন উনি। এই ধকল আর তাঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না
বোধহয়। তা দেখে রিন্টুদা বলল, “জানি না উনি আমার পুরো কথাটা শুনে যেতে পারবেন কি না, কারণ ওঁর
শরীরে ইতিমধ্যেই বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। উনিও ঠিক একইভাবে ভীষণ কষ্ট পেতে পেতে
আমাদের চোখের সামনে মারা যাচ্ছেন। ঠিক যেভাবে উনি তারিয়ে তারিয়ে ওঁর শত্রুদের
সামনে বসিয়ে তিলে তিলে মরতে দেখেছেন। বিষের নাম বোধহয় কিউরারে, তাই না ডাঃ
সেন?”
সবাই ছিটকে
উঠে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে দেখতে লাগল একটি অভিশপ্ত জীবনের চরম পরিণতি। আর আস্তে আস্তে
তাঁর সমস্ত প্রতিশোধ চরিতার্থ করেই পৃথিবী ছেড়ে চললেন চেয়ারম্যান সাহেব। তাঁর
বাঁহাতের ব্যান্ড-এডের জায়গাটা খালি। কে, কাকে, কেন আর কীভাবে শাস্তি দেবে? অসহায়ভাবে
তাঁর টুপি খুলে হাতে নিলেন ইন্সপেক্টর সাহেব।
“এই বিষ উনি
ওখানেই জোগাড় করেন। এই কিউরারে আমাজন উপত্যকার একটি উদ্ভিদের নির্যাস। ওখানকার
আদিবাসী সম্প্রদায় ব্যবহার করে বিষ হিসেবে। তাদের তিরে বা ব্লো-গানের ডার্ট-এ
শিকারের জন্য। এ এক সাংঘাতিক বিষ। এর একবিন্দু মানুষ সহ যেকোনও বড়ো প্রাণীর শরীরে
গেলে নিউরোমাসকিউলার জাংশনে এসিটিলকোলিন রিসেপ্টরের কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এর
ক্রিয়ায় সারা শরীরের স্কেলিটাল মাসলস দুর্বল হয়ে পুরোপুরি অসাড় হয়ে যায় এবং
এফিক্সিয়েশনের ফলে ডায়াফ্রামের পক্ষাঘাত হয়ে মৃত্যু হয়। তাই তো ডাঃ সেন? আপনার রুগী
এই সত্যিটা চেপে রাখার জন্য আপনাকে ভালো মতন পুরস্কার দিয়েছেন, এটা সহজেই
অনুমেয়। আমার খুঁজে পাওয়া ডার্ট, আর দত্তবাবুর লালার স্যাম্পলে এই কিউরারের ট্রেস পাওয়া গেছে
ফরেনসিকে। ভালোই উপায় ভেবেছিলেন ব্যানার্জিবাবু। ওই বিষের প্রকোপে আপনার
শত্রুদেরকেও নিজের এতকালের অসহায়তাও চাখিয়ে দিলেন মৃত্যুর আগ অবধি!”
বহুদিন ধরে
ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা তুষের আগুন অবশেষে নিভে গেল চিরদিনের জন্য। শেষবারের মতন
একডালিয়ার সেই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। সঙ্গে এলেন দেবাবু।
দেবাবু শুধু
ধরা গলায় জানতে চাইলেন,
“সাহেব আমায় মারতে চেয়েছিলেন কেন? আমি তো কখনও ওঁর পাশ থেকে এক চুলও
সরে যাইনি!”
রিন্টুদা
বলল, “তাঁর
হাতে গড়া সাম্রাজ্য যে অন্য কারও হাতে ছেড়ে দিতে চাননি ভদ্রলোক, কোনওদিনও
চাননি। ওই অভিশপ্ত কোম্পানির আর কোনও দাগ রেখে যাওয়ার রুচি ওঁর ছিল না। আর তার
সাথে আপনারও... উনি হয়তো ভেবেছিলেন আপনি ওঁকে আমার দ্বারা দোষী সাব্যস্ত করিয়ে
কোম্পানি নিজের হাতে নিতে চাইছেন শেষে। এটা এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতন ক্রমাগত
টার্গেট হওয়া মানুষের অন্যায় চিন্তা ভাবা যায় কি?”
আমাদের গাড়ি
স্টার্ট নিল। দেবাবুর চোখে জল। অস্ফুটে বললেন, “আপনার পেমেন্টটা, মাখাল বাবু?”
রিন্টুদার
হাতের একটি বিশেষ মুদ্রায় তিনি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু
করল এবং কয়েক মুহূর্তের ভিতরই ভদ্রলোকের চেহারাটা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গড়িয়াহাটের
জনসমুদ্রে আমাদের চোখের সামনে থেকে আড়াল হতে হতে মিলিয়ে গেল।
রিন্টুদার
এই অভাবনীয় সাফল্যেও যেন আমাদের মধ্যে অলৌকিক এক নৈঃশব্দ বিরাজ করতে লাগল। আমি
আমার রেকর্ডার থেকে পুরো রেকর্ডিংটা নিঃশব্দে মুছে ফেলে সন্ধের কলকাতার
আলোকোজ্জ্বল রাস্তাঘাটের দিকে মুখ বাড়ালাম।
শুধু
আপনভোলা পাড়ুইমশাই নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁর যে ফেলুদার থুড়ি,
রিন্টুদার সার্টিফিকেট পাওয়া হয়ে গেছে!
_____
ছবিঃ
পুষ্পেন মণ্ডল
Prothom thekeei Magic Lamp aamar khub priyo eakti webjin. Ami khub bhalobasi ei webjin er protiti lekhake. Khub valo lage porte. Ami Magic Lamp er dirghojibon kamona kori. Thanks a lot erokom eakti sharodiya sonkhya upohaar debar jonno. Thanks again.
ReplyDelete