সাগরপারের বেহুলা
দেবব্রত দাশ
।। এক ।।
একুশে এপ্রিল, ২০১৭। কাকভোরে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুম ভাঙল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী দ্বৈপায়ন দাশের।
আসলে, রাতভরই
তিনি বিছানায় ছটফট করেছেন। বছরের শুরু থেকেই যেভাবে একের পর এক গ্রহাণু (Asteroid) ধেয়ে আসছে সৌরমণ্ডলের এই নীল গ্রহের
দিকে, তাতে
যে কোনও সময় বড়োসড়ো বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এখনও যে ঘটেনি,
সেটাই আশ্চর্যের!
বিজ্ঞানের পরিভাষায় যে গালভরা বুলিটা রয়েছে
- চান্স-ফ্যাক্টর, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্ভাবনার
নিরিখে বলা হবে - পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহাণুগুলির সংঘর্ষের সম্ভাবনা ছিল লাখে এক
কিংবা বড়ো জোর দশ হাজারে এক।
দ্বৈপায়ন এসব তাত্ত্বিক হিসেব-নিকেশ সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। চান্স-ফ্যাক্টর-এর অনিশ্চয়তা নিয়েই দুনিয়া চলছে আদিম সে কোন
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। কিন্তু আজ এই উন্নত টেকনোলজির যুগে এসে বিজ্ঞানীরা
তো আর হাত-পা গুটিয়ে
বসে থাকতে পারেন না! সম্ভাবনা যত কমই হোক, সংঘর্ষ ঘটতেই পারে যে কোনও মুহূর্তে। তাই,
অতন্দ্র প্রহরীর মতো আমাদের এই গ্রহের
বিভিন্ন প্রান্তের মানমন্দিরগুলোর (Observatory) অতি আধুনিক টেলিস্কোপ নজর রাখছে অনাহূত
আগন্তুকদের গতিবিধির উপর। বিপদ আঁচ করলেই বিপদ-এড়ানোর উদ্দেশ্যে খবর চলে যাবে রকেট-উৎক্ষেপণ-কেন্দ্রে এবং অতি দ্রুত ছুটে যাবে
শক্তিশালী রকেট, ঘুরিয়ে দেবে হানাদার গ্রহাণুর অভিমুখ,
রক্ষা পাবে আমাদের সুজলা-সুফলা ধরিত্রী-মা।
এত সতর্কতা সত্ত্বেও এই তো সেদিন... চার বছর আগে ২০১৩-র ১৫-ই ফেব্রুয়ারি ঘটে গেল ভয়ঙ্কর বিপর্যয়।
রাশিয়ার Chelyabinsk শহরের আকাশে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ২০ মিনিটে প্রবেশ করেছিল ২০ মিটার দীর্ঘ
গ্রহাণু... Near-Earth
Asteroid... সংক্ষেপে NEA,
যার গতিবেগ ছিল বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের
মুহূর্তে ঘণ্টায় ৬০,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি।
দ্বৈপায়নের চোখের সামনে চার বছর পরেও ভেসে উঠছে সেই ভয়ঙ্কর
দৃশ্য। ঘটনাক্রমে, সে সময় তিনি রাশিয়ার ওই শহরের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে উরাল
অঞ্চলে ছিলেন।
চেলিয়াবিন্সকের আকশে প্রায় ২৯.৭ কিলোমিটার উঁচুতে আইফেল টাওয়ারের চেয়েও
ভারী গ্রহাণুটি বিস্ফোরিত হয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র আলোক-দ্যুতি, যার উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার চেয়েও
ছিল বেশি এবং তিনি দেখেছিলেন এক ভয়ানক ফায়ার-বল, যা সৃষ্টি করেছিল ধুলো,
গ্যাস আর তপ্ত মেঘপুঞ্জ।
আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি,
তার কারণ - গ্রহাণুটি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের মুহূর্তে
টেলিস্কোপের চোখেও দৃশ্যমান হয়নি সূর্যের সে সময়কার অবস্থানের দরুন।
১৯০৮ সালে রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে তুঙ্গুস্কা অ্যাস্টেরয়েড
বিস্তীর্ণ বনভূমিকে ধ্বংস করেছিল। তুঙ্গুস্কার পর চেলিয়াবিন্সকের গ্রহাণুটি এ যাবৎ
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশকারী বৃহত্তম আগন্তুক।
দ্বৈপায়ন গিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে,
যেখানে ১৪৯১ জন মানুষ কমবেশি আহত হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে ৭২০০টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল, উড়ে গিয়েছিল বহু কারখানার ছাদ,
ভেঙেছিল অসংখ্য জানালা।
২০১৭তে যা ঘটেছে... ঘটে চলেছে... এমন ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রহাণু-হানা অতীতে কবে হয়েছে,
মনে করতে পারেন না দুঁদে
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী দ্বৈপায়ন দাশ।
জানুয়ারির ৯ তারিখে প্রায় ৩০ মিটার দীর্ঘ - মানে বহুতল বাড়ির সাইজের একটি গ্রহাণু,
যার নাম ‘ASTEROID
2017 AG 13’ মাত্র ১,৯২,০০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে চলে গিয়েছিল,
যা কিনা পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যেকার
দূরত্বের অর্ধেক। যদি এটি আঘাত করত পৃথিবীকে, তাহলে সংঘটিত বিস্ফোরণের শক্তি হত
নাগাসাকিতে অ্যাটমবোমা বিস্ফোরণের শক্তির চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি,
অর্থাৎ, ৭০০ কিলোটন T.N.T-র সমান।
এর পর ২ ফেব্রুয়ারিতে অতিক্রম করেছে পৃথিবী-চাঁদের অর্ধেক দূরত্বের চেয়েও কম দূরত্ব
দিয়ে যে অ্যাস্টেরয়েড, তার নাম ‘2017 BS 32’। প্রায় ১২ মিটার ব্যাস-বিশিষ্ট এই গ্রহাণুটির আকার ছিল একটি
পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাস-এর সমান।
ঠিক একমাস পরে মার্চের ২ তারিখে সব ছাপিয়ে চাঁদের দূরত্বের
২০ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম দূরত্ব দিয়ে... বলতে গেলে পৃথিবীর গা ঘেঁষে শিস দিতে
দিতে চলে গেছে ৩ মিটার বিস্তারের গ্রহাণু ‘ASTEROID 2017
EA’ এবং
ভয়ের ব্যাপার ছিল এটাই যে, এই গ্রহাণুটি তার নিকটতম দূরত্বে আসার মাত্র ৬ ঘণ্টা আগে
দৃশ্যমান হয়। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল এই কারণে যে, ভূ-সমলয়কক্ষে বিচরণরত কৃত্রিম উপগ্রহগুলির
যে বলয় রয়েছে, তার চেয়েও অনেকখানি নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছে এই গ্রহাণুটি।
ধাক্কা লাগতেই পারত উপগ্রহগুলির সঙ্গে, ঘটতে পারত যে কোনও ধরনের বিপর্যয়। কিন্তু, বাস্তবে তা ঘটেনি।
এত ঘন ঘন গ্রহাণু-হানা কি সত্যিই কাকতালীয়?
এছাড়া, বিজ্ঞানে তো অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই! দ্বৈপায়ন জানেন,
বিশ্বের সব অবজারভেটরিগুলোর বিজ্ঞানীদেরও
চোখ কপালে উঠে গেছে... তাঁদের বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে... আস্থা হারিয়ে ফেলছেন তাঁরা এই ‘কাকতালীয়’ শব্দটির উপর।
।। দুই ।।
সমগ্র বিশ্ববাসীর নিরাপত্তার চিন্তায় মানবদরদী বিজ্ঞানী
দ্বৈপায়ন দাশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বছরভর তাঁকে অস্থির করে রাখলেও নির্বিঘ্নে পার হয়ে
গেল ২০১৭ সাল এবং ২০১৮-র বারোটা মাসেও কোনও বিপর্যয় ঘটল না। তারপর... ২০১৯-এর শুরুতে হানাদার গ্রহাণুর সংখ্যা যখন
উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে এসেছে, তখনই বিনামেঘে বজ্রপাত। ১১-ই মার্চ তারিখে চেলিয়াবিন্সকের গ্রহাণুর
চেয়েও বড়ো আকারের ও ওজনের একটি গ্রহাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে বিস্ফোরণ
ঘটাতে ঘটাতে নেমে এল থাইল্যান্ডের ফুকেত শহরের অদূরে খাড়া দক্ষিণে আন্দামান-সাগরের জলে যে জায়গায়,
তার স্থানাঙ্ক ৬.৯ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ (Latitude)
এবং ৯৮.৪ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ (Longitude)। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪০। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হল বিধ্বংসী ভয়ঙ্কর সুনামি। ২০০৪ সালের ছাব্বিশে ডিসেম্বর
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জের কাছে প্রায় ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পের দরুন জন্ম নিয়েছিল
যে সুনামি, তার
চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর সুনামি আছড়ে পড়ল আশেপাশের সব দেশগুলোতে।
সেই মুহূর্তে দ্বৈপায়ন রয়েছেন বেঙ্গালুরু শহরে। একটু পরেই
শুরু হবে সেমিনার, কিন্তু তার আগেই এল গ্রহাণু-হানার খবর। আসতে লাগল একের পর এক বিবরণ।
সুনামির আঘাতে ২০০৪-এর মতন এবারেও বিধ্বস্ত হয়েছে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আর শ্রীলঙ্কার পূর্ব
উপকূল। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ভারতের পূর্ব উপকূলের মধ্য ও দক্ষিণ-ভাগ। প্রাণহানি ঘটেছে উপকূলবর্তী হাজার
হাজার মানুষের। লোকালয়গুলির কোনও বাড়ি-ঘরই আর অক্ষত নেই।
টেলিভিশন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরের আপডেট দেখতে দেখতে অসহায়
দ্বৈপায়ন সেমিনার হলে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“২০১৭-র জানুয়ারি থেকেই আমি আশঙ্কা করছিলাম এমন
এক ভয়ানক আঘাতের এবং এ বিষয়ে অনেকগুলো আর্টিকেল লিখেছিলাম দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে,
কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না।
বায়ুমণ্ডলে গ্রহাণুটির প্রবেশ-মুহূর্তের আগে তার উপস্থিতির জানান দিতে পারল না কোনও
অবজারভেটরির টেলিস্কোপই! যখন দিল, তখন আগন্তুকের গতিমুখ পরিবর্তনের কোনও সুযোগই আর হাতে ছিল
না রকেট-উৎক্ষেপণকেন্দ্রগুলির।”
এক জুনিয়র বিজ্ঞানী বললেন, “স্যার, আপনি কি সাংবাদিকদের মিট করবেন?
অনেকেই বাইরে অপেক্ষা করছেন।”
“যতই তেতো হোক,
বড়িটা যখন গিলতেই হবে,
তখন দেরি করার কোনও মানে হয় না,” বললেন
দ্বৈপায়ন, “বলুন,
আমি সবাইকে ভেতরে আসতে বলছি।”
প্রেস কনফারেন্সে সুনামির মতোই আছড়ে পড়তে লাগল প্রশ্নবাণ।
দ্বৈপায়ন ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করলেন তাঁদের ব্যর্থতা,
জানালেন - আজকের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে
ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি তৈরি করবেন তাঁরা। মডার্ন টেকনোলোজি আরও মডার্ন হবে। একবার
ব্যর্থ হতে হয়েছে মানে এই নয় যে, বারবারই তাঁরা ব্যর্থ হবেন! গুহামানবের যুগ থেকে সুদীর্ঘ পথ হেঁটে
বিজ্ঞানই মানুষকে এনেছে আজকের অবস্থানে।
সারারাত বিছানায় ছটফট করলেন দ্বৈপায়ন,
দু’চোখের পাতা এক হল না। ভোরের আলো ফোটার
আগেই উঠে পড়লেন তিনি এবং অফ করে রাখা স্মার্টফোনের সুইচ অন করলেন। আসলে,
বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত অসহায় মানুষজনকে কতখানি সহায়তা
দিতে পেরেছে প্রশাসন, সেটা জানাই তাঁর উদ্দেশ্য।
ইন্টারনেটের ‘নিউজ-আপডেট’-এ প্রথমেই চোখে পড়ল আন্দামান-নিকোবরের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির খবর,
স্ক্রল করতেই স্ক্রিনে ফুটে উঠল - সুনামির তাণ্ডবে তছনছ সৈকত-শহর ফুকেত। দ্বৈপায়ন বিস্তারিত বিবরণ
পড়তে লাগলেন। গতকাল সুনামি যখন আছড়ে পড়ে, তখন স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৫০। হোটেল-রিসর্টগুলিতে তিলধারণের স্থান নেই। সমুদ্র সৈকতে এবং
পথেঘাটে মানুষের ঢল। ২০০৪-এ সুনামির পূর্বাভাস না পেলেও মানুষজন প্রবল ভূমিকম্পের
দোলা অনুভব করেছিল ভালোরকম। এবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই সকলে দেখল,
বিশাল এক পাহাড় অতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে
আসছে তটভূমির দিকে...
আরো পড়তে যাচ্ছিলেন দ্বৈপায়ন, কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনে পর পর ফুটে উঠল
লালবিন্দু। ফেসবুকে ঢুকে তিনি দেখলেন - ফুকেতের বিদেশী এক পর্যটক-যুগলের খবর এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায়
ভাইরাল...
সৈকতের খুব
কাছের এক বহুতল হোটেলের তিনতলার ব্যালকনিতে বসে সবে ব্রেকফাস্ট শেষ করেছে
ব্রিটিশ-দম্পতি ডেভিড উইলিয়ামস ও সারা জোন্স। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া-ভ্রমণে এসে
সুনামির আগের দিন সন্ধে নাগাদ পৌঁছেছিল ফুকেত-শহরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথায় এমনই
বুঁদ হয়ে ছিল যে, সামনের
সমুদ্রের দিকে তাকায়নি। যখন নীচ থেকে ভেসে এসেছিল বহু মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি-আর্তনাদ, তখন অনেক
দেরি হয়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পর্বত-প্রমাণ ঢেউ ধেয়ে এসে
আছড়ে পড়েছিল তিনতলার ব্যালকনিতে। জলের প্রবল ধাক্কায় ডেভিড এবং সারা - দু'জনেই ছিটকে
যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে একে অপরের হাতটুকু ধরতে পেরেছিল শুধু। কিন্তু স্রোতের মুখে
খড়কুটো যেমন ভেসে যায়,
ওরাও তেমনই ভেসে যেতে লাগল সৈকতের বিপরীতে স্থলভূমির দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর
মরিয়া সারা প্রাণপণ চেষ্টায় এক মহীরুহের শক্তপোক্ত ডাল আঁকড়ে ধরতে পারল আর তাতেই
প্রবল ঝাঁকুনির সঙ্গে রুদ্ধ হল তাদের ভেসে যাওয়া। আশপাশ দিয়ে অসংখ্য মানুষ আর্তনাদ
করতে করতে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে দুরন্ত গতিতে ধাবমান।
শরীরের
সবটুকু শক্তি নিংড়ে সারা এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে গাছের ডাল আর অন্য হাত দিয়ে ডেভিডের
একটা হাত। ডেভিড সাঁতার জানে না, সারা ভালো সাঁতারু। সারার আত্মবিশ্বাস তাই কিছুটা হলেও ডেভিডের চেয়ে বেশি।
ভেসে যাওয়ার
সময় ডেভিড হাবুডুবু খেতে খেতে প্রচুর পরিমাণে জল গলাধঃকরণ করে ফেলেছিল... সমুদ্রের
তীব্র লবণাক্ত জল। তাই গা গুলিয়ে উঠছিল তার এবং শেষমেশ বমির বেগ সামলাতে না পারায়
শরীরের ঝাঁকানিতে সারার হাতের মুঠো থেকে ছিটকে গেল তার হাত। স্প্লিট সেকেন্ডের
মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের নিরাপত্তার কথা একবারের জন্যও না ভেবে সারা গাছের ডাল
থেকে অন্য হাতটা সরিয়ে নিল। ওই প্রবল জলরাশির মধ্যে নিজের গতি ত্বরান্বিত করে খুব
অল্প সময়ের মধ্যেই নাগাল পেয়ে গেল ডেভিডের, শক্ত হাতে চেপে ধরল তার চুলের মুঠি।
তারপর... কত কত সময় ধরে যে ভেসে রইল দু’জনে... ! সংবিৎ যখন ফিরে পেল, তখন দেখল - কাদা-মাটিমাখা
অবস্থায় এক জায়গায় পড়ে আছে তারা দু’জনে পাশাপাশি। ডেভিডের চোখের পাতা বন্ধ। নাকের
কাছে হাত নিয়ে গিয়ে সারা বুঝল - নিশ্বাস পড়ছে। খানিক নিশ্চিন্ততা। চারপাশে
স্তূপাকারে মানুষের দেহ। নারী-পুরুষ। এমনই নিঃসাড়ে পড়ে আছে তারা যে, বোঝার উপায়
নেই কে বেঁচে আছে আর কে মৃত।
উদ্ধারকারী
দল যখন ডেভিড আর সারাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন দুপুর
গড়িয়ে বিকেল।...
ফেসবুক থেকে
চোখ সরিয়ে নিলেন দ্বৈপায়ন। তাঁর বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছবিতে
দেখা সারার মুখটা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় তাঁর অকাল-প্রয়াতা একমাত্র কন্যা ইরিনাকে, শত
চেষ্টাতেও যাকে মারণ-ব্যাধির হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি।
দ্বৈপায়ন
ভাবেন - জীবন-মৃত্যু তো এমনই... দিনের শেষে রাতের মতন... তবু এ পৃথিবীর কিছুই থেমে
থাকে না। আজ পেরিয়ে আসবে আগামীকাল, তারপর আগামী সপ্তাহ... মাস... বছর...
নীল গ্রহ সমানে লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে এগিয়েই চলবে, থামবে না...
থামবে না কোনোদিনও।
।। তিন
।।
২৬-এ
ডিসেম্বর, ২০১৯।
পৃথিবী থামেনি, ক্লান্তিহীন
সূর্য-পরিক্রমায় তার নিজের অক্ষের চারপাশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে লাট্টুর মতো
পাক খেয়ে পুরো ন’টা মাস আর পনেরোদিন পার করে পৌঁছে গিয়েছে এই দিনে। আজ
বলয়গ্রাস-সূর্যগ্রহণ। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে দৃশ্যমান। চাঁদের
প্রচ্ছায়ার ভিতরে প্রায় মধ্যরেখায় অবস্থান উটি-শহরের। আগের দিন বিকেল বিকেল পৌঁছে
গিয়েছেন দ্বৈপায়ন ও তাঁর সহযোগী কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।
উটিতে ‘ফার্স্ট
কন্ট্যাক্ট’
অর্থাৎ, গ্রহণ-শুরু
ভারতীয় সময় সকাল আটটা বেজে সাত মিনিটে। ‘সেকেন্ড কন্ট্যাক্ট' অর্থাৎ, বলয়গ্রাসের
শুরু অনেক পরে। আসলে,
অমাবস্যার অদৃশ্য চাঁদ ৮:০৭ থেকে একটু একটু করে ঢাকতে আরম্ভ করে দেবে সূর্যকে।
কিন্তু শেষমেশ পারবে না পুরোপুরি ঢেকে ফেলতে, কারণ, ডিসেম্বরের এই সময় সূর্য রয়েছে
পৃথিবীর খানিক কাছে... প্রায় ৫০ লক্ষ কিলোমিটার কম দূরত্বে এবং তাই সূর্যের
আলোকমণ্ডলের সবটুকুনি ঢাকা পড়বে না আর সেজন্যই অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল করোনা
দৃশ্যমান হবে না, দেখা
যাবে না হীরের আংটি। তবে,
আকাশে ভাসমান একটি সোনালি বলয়ের সৌন্দর্যও কম নয়নাভিরাম নয়!
আটটা বাজার
অনেক আগেই দ্বৈপায়ন তাঁর দলবল নিয়ে চলে এলেন উটির লেকের ধারে। প্রায় চার বর্গ কিলোমিটার
জুড়ে লেক। চারপাশে বনানীঘেরা সবুজ প্রান্তর।
দেশ-বিদেশের
বহু পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষজন এসে জড়ো হয়েছেন গ্রহণ দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। সকলের
হাতেই আধুনিক ডিজিটাল ‘এস.
এল. আর’ ক্যামেরা, হ্যান্ডিক্যাম...
মায় পিনহোল ক্যামেরা পর্যন্ত রয়েছে। এছাড়া, ‘১৩ মেগা পিক্সেল’-এর
মোবাইল-ক্যামেরা তো প্রায় সবার সঙ্গেই আছে।
দ্বৈপায়ন তো
শুধু সুন্দর দৃষ্টিনন্দন সোনালি বলয়ের টানেই আসেননি, এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়েও। যে
দল সঙ্গে রয়েছে, তাদের
তোলা স্টিল ছবি এবং ভিডিও বিশ্লেষণ করে চাঁদ ও সূর্য-সম্পর্কিত নানান প্রয়োজনীয়
তথ্যও সংগ্রহ করবেন তিনি।
এই
বলয়গ্রাসের সর্বাধিক স্থায়িত্বকাল ৩ মিনিট ৪০ সেকেন্ড সেই জায়গায়, যার
স্থানাঙ্ক ১ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ও ১০২.৩ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। উটিতে অবশ্য ৩
মিনিট ৭ সেকেন্ড সময় ধরে সোনালি বলয়টিকে আকাশে ভেসে থাকতে দেখা যাবে।
গতকাল রাতের
আকাশে টুকরো মেঘের দল ঘুরে বেড়ালেও আজ সূর্যোদয়ের আগে থেকেই আকাশ পরিষ্কার, স্বচ্ছ ঘন নীল
পটভূমিকায় শৈলসুন্দরী অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে। উৎসবের চেহারা নিয়েছে লেককে ঘিরে
থাকা সবুজ প্রান্তর।
গ্রহণ শুরুর
খানিক আগে দ্বৈপায়নের হঠাৎ নজর গেল দুই সুদর্শন তরুণ-তরুণীর দিকে। বিদেশ থেকে যে
তারা গ্রহণ দেখতে এসেছে,
তা তাদের দেহের গড়ন,
চামড়া ও চুলের রঙ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দ্বৈপায়নের মনে হল, খুব চেনা
যেন এই যুবক-যুবতী... কোথায় যেন দেখেছেন! ভাবতে ভাবতেই বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতোই ঝিলিক, স্মৃতিপটে
ফুটে ওঠে সেই দু’জনের
ছবি, যাদের
তিনি দেখেছিলেন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ন’মাস আগে। ব্রিটিশ-যুগল ডেভিড উইলিয়ামস আর
সারা জোন্স।
খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন দ্বৈপায়ন। না - কোনও ভুল নেই... হতে পারে, ওরা সেদিন
তাঁর সামনে সশরীরে উপস্থিত ছিল না, কিন্তু অত্যাধুনিক টেকনোলোজির
কল্যাণে ডেভিড এবং সারার নিখুঁত মুখাবয়ব ফুটে উঠেছিল মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। শুধু
স্মার্টফোনেই নয়, তিনি
বহুবার দেখেছেন টেলিভিশনের পর্দায় আর বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতায়।
দ্বৈপায়নের
মনে পড়ে ‘মনসামঙ্গল’-এর বেহুলাকে।
গাঙ্গুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে বেহুলাই তো স্বামী লখিন্দরের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে গিয়েছিল
দেবলোকে ইন্দ্রের সভায়,
যেখানে অপরূপ নৃত্যকলা প্রদর্শন করে সন্তুষ্ট করেছিল যমরাজ-সহ সব দেবদেবীগণকে
এবং তাই পুনর্জীবিত লখিন্দরকে নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল মর্ত্যলোকে।
খুব ইচ্ছে
করলেও দ্বৈপায়ন দ্বিধা কাটিয়ে ডেভিড-সারার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারলেন না। তাঁর বারবার
মনে হতে থাকে, যদি
ওরা না হয়... যদি... ইচ্ছেটা তাই দমন করে ভাবলেন - কী দরকার সামনে যাওয়ার! এই তো
মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে দেখছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতিকে।
ফার্স্ট
কন্ট্যাক্টের মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে গেছে সূর্যের খণ্ডগ্রাস। ক্যামেরায় ছবি উঠছে
পটাপট, মোবাইলে
আর হ্যান্ডিক্যামে ভিডিও তোলাও চলছে।
সূর্য-চাকতির
৫০ শতাংশ ঢাকা পড়ার পর দ্রুত কমে আসতে লাগল আলো। শৈলশহরে ক’দিন ধরেই জাঁকিয়ে শীত
পড়েছে। এখন শীতল হাওয়ায় কনকনানি হঠাৎ করে অনেকটাই বেড়ে গেল।
দ্বৈপায়ন
ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঠিক ৯টা ২৯ মিনিটেই ঘটল সেকেন্ড কন্ট্যাক্ট... বলয়গ্রাসের শুরু, অর্থাৎ, অমাবস্যার
চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন কৃষ্ণবর্ণের পূর্ণ শরীর টুক করে ঢুকে পড়ল সূর্য-চাকতির ভিতর।
আর সামান্য
সময় পরেই চাঁদ সূর্য-চাকতির ঠিক মাঝখানে চলে এল, ঢাকা পড়ে গেল সূর্যের প্রায় ৯৭ শতাংশ।
মনে হতে লাগল - ঠিক যেন সোনার একটা বালা ভেসে আছে ঘন কৃষ্ণবর্ণের আকাশে। অপরূপ
নয়নাভিরাম মহাজাগতিক দৃশ্য! সব কিছু ছাপিয়ে দ্বৈপায়নের চোখের সামনে ওই সোনালি
বলয়ের ভিতরে যে মুখ ফুটে উঠল, তা দেখে চমকে ওঠেন তিনি। মৃত্যু-শয্যায় শেষ-বিদায়ের আগে
তাঁর প্রয়াত কন্যা ইরিনাকে যেমনটা দেখেছিলেন... যে দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে ছিল তাঁর
মুখের দিকে, সেই
মুখ যেন একই ভাবে তাকিয়ে আছে এই মুহূর্তে। নিজের অজান্তেই বিজ্ঞানীর গাল বেয়ে
গড়িয়ে নামে অশ্রুধারা। ইরিনা আর সারার মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
হঠাৎই ‘সায়লেন্ট
মোড'-এ
রাখা দ্বৈপায়নের স্মার্টফোন কেঁপে ওঠে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আলোকিত
স্ক্রিনের দিকে চেয়ে চমকে ওঠেন তিনি। শ্রীহরিকোটার রকেট-উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে ফোন
করেছেন ‘ইসরো’-র
বন্ধু-বিজ্ঞানী কিরণকুমার সাহা।
রিসিভ করা
মাত্রই অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে এল কিরণকুমারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, “একটু আগে
ঘটতে যাচ্ছিল ভয়ঙ্কর বিপর্যয়, কিন্তু ঘটেনি... এবার আমরা সফল হয়েছি দ্বৈপায়ন..."
"আরে হেঁয়ালি না করে বল - কোন বিপর্যয়ের কথা বলছিস তুই কিরণ!”
"আরে হেঁয়ালি না করে বল - কোন বিপর্যয়ের কথা বলছিস তুই কিরণ!”
“পৃথিবী থেকে ৫০,০০০ কিলোমিটারের চেয়েও কম দূরত্বে হানা
দিয়েছিল বিশাল এক অ্যাস্টেরয়েড। কোদাইকানালের অবজারভেটরি সময়মতো তার আগমনবার্তা
জানাতে পেরেছিল বলেই আমরা রকেট উৎক্ষেপণ করে অ্যাস্টেরয়েডটির অভিমুখের পরিবর্তন
ঘটাতে পেরেছি। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এটি বিস্ফোরিত হলে বিপর্যস্ত হত দক্ষিণ ভারতের
বিস্তীর্ণ অঞ্চল।”
“বলছিস কী কিরণ!”
বিস্মিত দ্বৈপায়ন বলে ওঠেন,
“ভয়ানক বিপদ থেকে তোরা তাহলে রক্ষা করেছিস
অসংখ্য মানুষকে! কিন্তু দিনের বেলায় কেমন করে টেলিস্কোপে...”
“সেটাই তো মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন রে দ্বৈপায়ন!”
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন কিরণকুমার, “কোদাইকানালের আকাশে তখন সূর্যের প্রায় ৭৫
শতাংশ ঢাকা পড়ে যাওয়ার ফলে দৃশ্যমান হয়েছে ওই অনাহূত ভয়ঙ্কর আগন্তুক।”
সেই ‘চান্স-ফ্যাক্টর’! অনিশ্চয়তা বোঝাতে বিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত দুটি শব্দ। হতবাক দ্বৈপায়ন
কান থেকে সেলফোন সরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পান - হাত ধরাধরি করে তাঁরই দিকে এগিয়ে আসছে
সারা জোন্স আর ডেভিড উইলিয়ামস... আশ্চর্য! তবে কি টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ওদের চোখেও তিনি
পরিচিত এক মুখ!
* * * * * *
ফুকেতে ২০০৪-এর ২৬-এ ডিসেম্বর আছড়ে পড়া সুনামিতে সৈকত-সংলগ্ন হোটেলের ব্যালকনি থেকে ভেসে যাওয়া
এক ব্রিটিশ-যুগলের জীবনের সত্যিকারের কাহিনির অনুসরণে এ গল্পের দুটি চরিত্র-চিত্রণ - ডেভিড উইলিয়ামস ও সারা জোন্স। নাম দুটি
কাল্পনিক। আর ১১ই মার্চ, ২০১৯-এর গ্রহাণু-হানা যে পুরোপুরি কল্পনা-আশ্রিত, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
পড়ছিলাম এখনই। খুব ভালো লেগেছে।
ReplyDeleteশক্তিশালী কলমে অপূর্ব গল্প।
ReplyDeleteDurdanto
ReplyDeleteEta ektu onno swad er golpo. Kichuta kolpona ar sotti ghotonake miliye ei odbhut golpota Porte besh bhaloi laglo.
ReplyDeleteবাংলায় science fiction.
ReplyDeleteভালো লাগলো--