মন্ত্রশক্তি
সহেলী
চট্টোপাধ্যায়
।। ১ ।।
ভদ্রলোককে
বেশ অদ্ভুত লাগে ঋষির। একটু যেন ছিটিয়াল টাইপের। তা হবে নাই বা কেন, উনি আবার নামকরা পেইন্টার। বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই
বিদেশে থাকেন। মাঝে মাঝে বিদেশ থেকে বন্ধু-বান্ধব এসে দেখা করে যায়। একমাত্র পোষ্য
টমিকে নিয়ে রোজ সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোন। ভদ্রলোক একদমই মিশুকে নন। এই
সব শিল্পী মানুষজন তেমন মিশুকে হয় না। নিজেদের জগতে থাকতে ভালোবাসেন। বাড়ির সামনে
নেমপ্লেটে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে অরিজিৎ রায় চৌধুরী।
বিখ্যাত পেইন্টার অরিজিৎবাবু। কাগজে মাঝে মাঝেই তাঁকে নিয়ে লেখালেখি হয়। ঋষি বেশ
কয়েকবার আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে ওঁর প্রদর্শনী দেখে এসেছে। ঋষি নিজেও অল্পবিস্তর
আঁকিবুকি নিয়ে থাকে। বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগের অলঙ্করণ করে দেয়। আর্ট কলেজের ছাত্র
ঋষি একটি প্রাইভেট স্কুলে ড্রয়িং শেখায় শনি ও রবি।
বাড়িতে মা আর ঋষি। মা স্কুলে পড়ান। অরিজিৎবাবু বিয়ে থা করেননি। বয়স বছর পঞ্চাশ
হবে। দেখতে সুদর্শন। চাপ দাড়ি ফর্সা চেহারায় দারুণ লাগে। ঋষির অন্তত তাই মনে হয়। টমি আর
একমাত্র পরিচারক রমেশকে নিয়ে দিব্যি আছেন। পাড়া প্রতিবেশীদের যত দূর সম্ভব এড়িয়ে
চলেন। ঋষির কৌতূহলটা একটু বেশিই। অরিজিৎবাবুর সঙ্গে জোর করে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। সে
যখন উচ্চ মাধ্যমিক দেবে তখন অরিজিৎবাবু তাদের পাশের পোড়ো বাড়িটি কিনে নেন। এবং বেশ
সারিয়ে সুরিয়ে বসবাসযোগ্য করে তোলেন। দুর্গাপুজোর চাঁদা কাটার সময় ঋষিরা অনেকবার
অরিজিৎবাবুর বাড়ি গেছে। অরিজিৎবাবুও তাদের দরজা থেকেই বিদেয় করেছেন তবে চাঁদা দিতে
কখনও কার্পণ্য করেননি।
ঋষির
সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে অরিজিৎবাবুর আলাপ হয়। পাড়ার আর কারোর সঙ্গে না মিশলেও
ঋষিকে ওঁর ভালো লাগে। কারণ ঋষিও একই পথের পথিক। ঋষির আঁকাগুলো বেশ ভালো লাগে
ওঁর। আর সমঝদার
লোক পেলে প্রত্যেকেরই গল্প করতে ভালো লাগে।
পার্কের বেঞ্চিতে মাঝে মাঝে দুজনের আড্ডা বসে।
অরিজিৎবাবু ঋষিকে কখনও বাড়িতে ডাকেন না। ফেসবুকেও
দুজনের যোগাযোগ আছে।
বিদেশ
থেকে মাঝে মাঝেই অনেক রকম পার্সেল আসে অরিজিৎবাবুর বাড়ি। এই গতবার যখন বিদেশ থেকে
ফিরলেন, অরিজিৎবাবুর সঙ্গে ছিল বেশ বড়োসড়ো একটা
বাক্স। তা এইরকম বাক্স-টাক্স অবশ্য মাঝেসাঝেই আসে।
বেশ
কয়েকমাস অরিজিৎবাবু এই বাড়িতেই রয়ে গেলেন। কালীপুজোর পর বেশ শীত পড়েছে। খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে বেরোলো এক
সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ডের কথা। একজন বিখ্যাত লেখকের অস্বাভাবিক মৃত্যু। নীলাদ্রি ব্যানার্জি জনপ্রিয় লেখক। ছোটোদের জন্য ভূতের গল্প লিখতেন প্রধানত। বড়োদের
জন্যও অনেক লিখেছেন। বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন কয়েকবার। বয়স
হয়েছিল পঞ্চান্ন। সল্টলেকের এক নির্জন বাড়িতে একাই থাকতেন। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা
ছিল না। সারাদিন ভালোই ছিলেন। রাতেই হার্ট অ্যাটাক করে। কোনও কিছু
দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন। পরের দিন কাজের লোক এসে বেল দেয় আটটা নাগাদ। দরজা না
খোলাতে সে কিছু লোক জড়ো করে। পুলিস এসে দরজা ভেঙ্গে নীলাদ্রিবাবুর
বডি উদ্ধার করে। ঘরে প্রচুর বই আর লেখার খাতা। একটা ল্যাপটপও ছিল। ঋষির ওঁর লেখা
তেমন ভালো লাগত না। বড়োদের গল্পগুলো তো জঘন্য, ছোটোদেরগুলোও
একইরকম একঘেয়ে। এই লোক যে কী করে এত পপুলার হলেন কে জানে!
।। ২ ।।
কুশল
থানায় বসে চিন্তা করছিল। নীলাদ্রি ব্যানার্জির কেসটা তার এক্তিয়ারেই পড়েছে।
লোকাল থানার ওসি হিসেবে তাকেই সলভ করতে হবে। সব চেয়ে ভাবাচ্ছে বডির পাশে পড়ে থাকা
একটা সাদা কাগজ। কাগজের ওপর একটা মুখ আঁকা। একটা বাচ্চা মেয়ের মুখ। কুশল আপনমনে
কাগজটা দেখতে থাকে। হয়তো নীলাদ্রিবাবুর কোনও গল্পের
অলঙ্করণ। মিষ্টি মেয়েটির মুখে কেমন একটা বীভৎস পৈশাচিক হাসি। চুলগুলো চোখের সামনে
ঝুলছে। ছবিতে শিল্পীর সই আছে এ আর সি।
কুশল কিছুই বুঝতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ে তার মাসতুতো ভাই ঋষির কথা। সে পেইন্টার
জগতের প্রত্যেককে চেনে। তার কাছে কিছু ইনফো তো থাকবেই। কুশল ঋষিকে ফোনে ধরার
চেষ্টা করে।
ঋষির
সব কিছু শুনে মনে হয় এ আর সি আসলে অরিজিৎ রায় চৌধুরী। এর
চেয়ে বেশি আর এগোতে পারে না। এর মধ্যে একটা ব্যাপার হয়। এপ্রিলের গরম বেশ
ভালোই পড়েছে। তবে মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এই হাওয়ার
লোভে ঋষি ছাদে ক্যাম্প খাট পেতে শোয় এক-একদিন রাতে। মশার ধূপ
জ্বালিয়ে নেয়। মা অনেকবার বারণ করলেও ঋষি শোনে না। সেই রাতেও বেশ হাওয়া দিচ্ছে।
ঋষির ঘুমটা ভেঙ্গে গেল মশার কামড়ে। ধূপ বোধহয় হাওয়ায় নিভে গেছে। ঘুম ঘুম চোখে ঋষি উঠে
দেখতে গেল। তখন তার চোখ পড়ল পাশের বাড়ি অর্থাৎ অরিজিৎবাবুর বাড়ি। বাড়ির ছাদে সাদা
রঙের একটা নারীমূর্তি। লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে। চুল না থাকলে সে বুঝতে পারত না
নারীমূর্তি কিনা। হঠাৎ একটা জিনিস মনে আসতেই ওর গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল।
অরিজিৎবাবুর বাড়ির ছাদে ওঠা যায় না। সিঁড়ি নেই। তাহলে ওটা কী? সাদা কুয়াশা এসে
মূর্তিকে অদৃশ্য করে দিল। ঋষি আর ছাদে শোবার সাহস পেল না। ঘরে চলে এল। পরের দিন তার
মনে হল সে বুঝি স্বপ্ন দেখেছে।
চা
খেয়ে ও পেপার তুলে নিল। ইস কী লিখেছে পেপারে! একজন পেইন্টারের সেই একই ভাবে
মৃত্যু। কোনও ভয়ানক কিছু দেখে তার হার্ট থেমে গেছিল। এই ঘটনা ঘটে কল্যাণীতে।
শিল্পী অনিরুদ্ধ পাল একা থাকতেন না। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে সেই রাতে বাড়ি ছিল না।
বডির পাশে একটা সাদা কাগজে পেনসিলে আঁকা একটা ছবি পাওয়া গেছে। একটা ভয়ানক
মুখ। ছবিতে কোনও সই নেই। মিসেস পাল এবং তাঁর মেয়ে জানায় এই ছবি অনিরুদ্ধ
বাবুর আঁকা নয়। কুশল এই ঘটনার পর উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আগের ঘটনার সঙ্গে যথেষ্ট
সাদৃশ্য ছিল।
ঋষির
মনে হয় পর পর দুটো ঘটনায় অরিজিৎবাবুর যোগ আছে। কুশলদা তাকে সেই বাচ্চা মেয়েটির
ছবি দেখিয়েছিল। অরিজিৎবাবুর কাছে একবার চাকরির জন্য আবেদন করলে কেমন হয়? হয়তো উনি
এক কথায় নাকচ করে দেবেন, কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী? ওনার তো অনেক
চেনাশোনা। এই প্রাইভেট স্কুলে ছোটোদের ফুল, পাতা, বাড়ি-ঘর আঁকাতে আর ওর মন সায়
দিচ্ছে না। ঋষি একদিন সন্ধ্যায় অরিজিৎবাবুর দরজায় বেল বাজাল। মিনিট পাঁচেক বাজাবার
পরও কেউ খুলল না। ঋষি ভাবছিল এবার চলে আসবে কিনা, ঠিক সেই
মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার, দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল। ঋষি অবাক হল না। এ তো খুব
স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক সাধারণ বাড়িতেও দরজা খোলার এই রকম সিস্টেম চালু আছে। কত কীই তো হতে পারে। ভেতরে হালকা একটা
আলো জ্বলছে। তাকে কেউ ওপরে চলে আসার নির্দেশ দিল। ঋষি অবাক হল না, কারণ
অনেক গল্পের বইয়ে সে এইরকম সিচুয়েশানের কথা পড়েছে। আস্তে আস্তে ও দোতলায় চলে এল।
বিশাল একটা ঘরে সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করে
যাচ্ছেন অরিজিৎবাবু। টমি তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে। মুখ তুলে একবার ঋষিকে দেখল, তারপর
আবার শুয়ে পড়ল। ঘর ভর্তি পেইন্টিং। বেশির ভাগই ভূতুড়ে। এর
মধ্যে সেই মেয়েটিও আছে। কুশলদা যার ছবি দেখিয়েছিল। ঋষি দেখছিল। সাউন্ড সিস্টেমে
কেমন একটা একঘেয়ে মন্ত্র বাজছে। শুনতে শুনতে ঝিমুনি লাগে। ঋষি
জানে না এই মন্ত্র কী। হয়তো কোনও স্পিরিচুয়াল ব্যাপার হবে। ঘরে সুগন্ধি ধূপ
জ্বলছে।
অরিজিৎবাবুর
মুখ ঋষিকে দেখে উজ্বল হয়ে গেল। ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার
ঋষি? কেমন আছ? আমার কাছে কী মনে করে?”
এই
ঘরেও আলো বেশ কম। জোরালো লাইটে কি কাজ করতে অসুবিধে হয় ওনার?
ঋষি
নিজের কথা কিছুই বলতে পারল না।
অরিজিৎবাবু
নিজে থেকেই বললেন, “আমি নিজের সমস্ত কাজ নিজেই করি, না হলে
তোমাকে সেক্রেটারি করে নিতাম। আমি দেখছি কী করতে পারি তোমার জন্য। আমার খুব খারাপ
লাগে তোমার মতো একটা প্রতিভা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ে আছে! আমি তোমার জন্য
চেষ্টা করতে চাই। আমাকে তোমার সিভি দিয়ে যেও। এখনকার দিনে জব পাওয়া খুব শক্ত। যাই
হোক, একটু চা খেয়ে যেও।” বলে
উনি উঠে পড়লেন। খুব সম্ভব চায়ের জন্য বলতে গেলেন। ঋষির খুব অবাক লাগছিল। অরিজিৎবাবু তার
মনের কথা কী করে জানলেন! একটু পরেই আবার
ফিরে এলেন। ঋষির সঙ্গে সাধারণ গল্পগুজবে মেতে উঠলেন। একটু পরে একজন মহিলা এসে
দু’কাপ চা আর দু’প্লেট পকোড়া ধরিয়ে দিয়ে গেল। ঋষি লক্ষ করল অল্পবয়সি মেয়ে, বেশ
সুন্দর দেখতে। তবে চোখ দুটো যেন কেমন। একদম পলক পড়ে না। আর হাঁটাচলাও যেন কেমন।
মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করছে মেয়েটি। বা ওর হয়তো খুব ঘুম পেয়েছে বা অসুস্থ।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল ঋষি। অরিজিৎবাবুর ডাকে সম্বিত ফেরে ওর। বললেন, “খেয়ে নাও, চা যে
জুড়িয়ে জল হয়ে গেল।”
“আপনার
দেখাশোনা করত যে লোকটি, রমেশ, তাকে দেখছি না কেন?”
“রমেশ
ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। বাসন্তীকে দিয়ে গেছে।”
এরপর
আর বহুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। ঋষির মনে হল রমেশের কথা না তুললেই বোধ হয় ভালো ছিল। ঋষি
এবার সরাসরি সেই মেয়েটির ছবির দিকে আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞাসা করল, “এই
ছবিটা...”
“এটা আমার করা একটা গল্পের অলঙ্করণ। নীলাদ্রি
ব্যানার্জির গল্প। তা লেখক তো মারাই গেলেন,” মুখ দিয়ে আক্ষেপের শব্দ করলেন অরিজিৎবাবু।
এরপর
আর কিছু বলা উচিত নয় ভেবে ঋষি চুপচাপ বসে রইল। হঠাৎ বল
খেলতে খেলতে একটি ন-দশ বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকল। মুখের সঙ্গে
ছবির সেই মেয়েটির খুব মিল। ঋষি আশ্চর্য হয়ে গেল। চোখ দুটো কেমন যেন পলকহীন। মেয়েটি
ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে উগ্র একটা গন্ধ পেল ও। বাসন্তীর কাছ থেকেও একই গন্ধ পেয়েছে
ও। কেমন যেন ওষুধ ওষুধ গন্ধ। অরিজিৎবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাইরে
গিয়ে খেলো রুমু।” ঋষির
দিকে ফিরে বললেন, “বাসন্তীর মেয়ে রুমু।” মেয়েটা বাইরে চলে গেল।
।। ৩ ।।
পরের
দিন খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে বেরোল এক অধ্যাপকের রহস্যজনক মৃত্যুর কথা। ঋষি পুরোটা
খুঁটিয়ে পড়ল। সেই একইরকম ঘটনা। কোনও
ভয়ানক কিছু দেখে ডক্টর দেবেশ ব্যানার্জির হার্ট চিরদিনের মতো থেমে
যায়। তিনি একজন বিখ্যাত পদার্থবিদ ছিলেন। নিজের ল্যাবেই তাঁর বডি পড়ে ছিল। চোখ
দুটোতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের দেওয়ালে একটা অস্পষ্ট ভূতের মুখের ছবি, যেটা
নাকি আগে ছিল না। পুলিশ উঠে পড়ে লেগেছে এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কিনারা করার জন্য।
দেবেশ ব্যানার্জির বাড়ি খুব একটা দূর নয়। ঋষি অরিজিৎবাবুর বাড়ি গেল। কোনও কারণ
ছাড়াই। বাড়ির দরজা বন্ধ। তালা দেওয়া। সে একটা ঝুঁকি নিল। সামনের বড়ো আমগাছটায় উঠে পড়ল। দোতলার ঘরের জানালাগুলো সব বন্ধ। তবু চেষ্টা করল যদি খুলে ভেতরে
ঢোকা যায়। ঋষির মাথার মধ্যে মাঝে মাঝে সত্যান্বেষী অর্জুন ভর করে। একটা ডালে বসে
সে হাত বাড়িয়ে জানালাটার একটা পাল্লা খোলার চেষ্টা করল। জোরে একটা
শব্দ করে দুটো পাল্লাই খুলে গেল। ঋষি লাফ
দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা কী অন্ধকার! এই ঘরের মধ্যে অনেকগুলো প্যাকিং বাক্স।
ঋষি কৌতূহলের বশে একটা বাক্সের ডালা খুলে ফেলল। ভেতরে সে যা দেখল বিশ্বাস করতে
পারল না। বাসন্তী শুয়ে আছে। মৃত সে বহুদিন আগেই। কড়া ওষুধের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল
ঋষির। আরেকটা বাক্স খুলে দেখল সেখানে একটা বাচ্চা মেয়ের বডি। একেও ঋষি চেনে, রুমু।
তাড়াতাড়ি জানালা গলে বেরিয়ে গেল ও।
দুপুরে
খাওয়াদাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল ঋষি। জ্বর এসে গেছে ওর। বিকেল পাঁচটার সময় মা
এসে বললেন, “অরিজিৎবাবু এসেছেন তোর সঙ্গে দেখা
করতে।” মায়ের পেছন পেছন দীর্ঘদেহী অরিজিৎবাবু ঢুকলেন। ঋষি
উঠে বসল। মায়ের বেরিয়ে যাওয়া লক্ষ করলেন অরিজিৎবাবু। তারপর বললেন, “তোমার
মাকে দেখে আমার বোনের কথা মনে পড়ছে। আজ আমি এসেছি সব কনফেস করব বলে।
তুমি খুব নির্মল মনের ছেলে। আর অনেক কিছু ধরেও ফেলেছ।”
ঋষি
উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, “কী ধরে
ফেলেছি আমি?”
“বাসন্তী ওর নাম নয়। ওর নাম বাণী। আমার বোন, যার
বিয়ে হয়েছিল নীলাদ্রি ব্যানার্জির সঙ্গে। কিন্তু নীলাদ্রি
কিছুদিন যেতে না যেতেই ওর ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে নানা ভাবে। একমাত্র মেয়েরও
দায়িত্ব নেয়নি সে। আমি তখন নতুন এই জগতে। আমার গল্পের খাতাগুলো নীলাদ্রি
আমার থেকে কেড়ে নেয়। না দিলে বাণীর ওপর আরও টর্চার করবে বলে ভয় দেখাতে থাকে। নীলাদ্রিকে
এই কাজে মদত দিত ওর দুই বন্ধু পেইন্টার অনিরুদ্ধ এবং দেবেশ। তখনও ওদের এত নাম ডাক
হয়নি। রোজই ওদের মদের আসর বসত এবং আরও নানারকম বাজে নেশা ছিল ওদের। নীলাদ্রিকে
ভালো ছেলে বলেই জানতাম এবং সেই জন্যই ওর সঙ্গে বোনের বিয়ে
দিই। একসময় ও আমার ভালো বন্ধু ছিল। কিন্তু আমার এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য
আমার বোন আর ভাগনির জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আমার গল্পগুলোই নিজের নামে চালাতে
থাকে নীলাদ্রি। তারপরও ওর এই
স্বভাব যায়নি। প্রতিভাময় কোনও তরুণ লেখকের থেকে টাকার বিনিময়ে প্লট কিনে নিত।
আর যেগুলো নিজে লিখত সেগুলো জঘন্য হত।”
ঋষির
মনে হয় অরিজিৎবাবু মিথ্যে বলছেন না। একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, “তারপর ভাগনি রুমুকে
নিয়ে বোন একদিন সুইসাইড করে। আমাদের মা শোকে দুঃখে
পাগল হয়ে যান। এখনও তিনি রিহ্যাবে। বাবা হার্ট অ্যাটাকে শেষ। সেই সময় এক কাপালিকের
সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। দীর্ঘদিন
আমার সঙ্গে থেকে তিনি আমাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক শেখান। এই কাপালিক মমি বানাতে পারত।
বাণী আর রুমুকে আমি সৎকার করিনি। প্রথমে বরফ দিয়ে কিছুদিন
রেখে দিই। তারপর মমি তৈরি করি। বড়ো একটা বাক্সে রেখে দিতাম। আধুনিক কিছু মেডিসিন
প্রয়োগ করি। আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছি একসময়। তারপর শিখলাম মন্ত্রের সাহায্যে
ওদের জাগিয়ে তুলতে। বাণী আর রুমুর আত্মাকে ওই মমির মধ্যে বন্দি করে
ফেললাম। ওরা চলাফেরা করতে পারে। এই সময় আর্থিক দিক দিয়েও উন্নতি হয় আমার। বিদেশে
যাওয়া-আসা চলতে থাকে। প্যারিসে অনেকদিন থাকার পর দেশে ফিরে
আসি। এই তিন শয়তানের ছবি একদিন একটা ম্যাগাজিনে দেখি। তারপর থেকেই মনে প্রতিশোধের বাসনা
জেগে ওঠে। বাড়ি কিনি এখানে। বাণী আর রুমু আমার পুরোনো
বাড়িতে ছিল। ওদের নিয়ে এলাম। রমেশের কিছু সন্দেহ হওয়াতে কাজ ছেড়ে চলে যায়। তবে বাণী
আর রুমুর সঙ্গে আমার ভালো কাটত। কিন্তু ওরা কথা বলতে পারত না। জীবন্ত মড়া
হয়েই থাকল। এই তিনজনকে শেষ করেছে রুমু আর বাণী। বেশি কিছু করতে হয়নি। ওদের দেখেই
শয়তানগুলো হার্টফেল করে। আমি শুধু মন্ত্রবলে ওদের জাগিয়ে দিয়েছিলাম। আজ তুমি সব বুঝতে
পেরেছ। কিন্তু ওদের বডি আমি পুড়িয়ে দেব রাত হলে। ওদের আত্মা মুক্তি লাভ করুক এই
কামনা করি। অনেকদিন ওরা বদ্ধ হয়ে থেকেছে। এসবের চর্চা আমি ছেড়ে দিলাম জন্মের মতো।
আবার ছবি আঁকা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ক’দিন পর আবার প্যারিস চলে যাচ্ছি। ওখানে একটা আর্ট
কলেজে আঁকা শেখাব। আর ফিরব না। এদেশে প্রতিভার কদর নেই। তোমার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকবে। তুমি আমার কাছে আসতে
পারো। তোমার সব দায়িত্ব আমার।”
অরিজিৎবাবু
চা-টা খেয়ে মায়ের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ঋষি অরিজিৎবাবুর অজান্তে নিজের মোবাইলের রেকর্ডিং সুইচ অন করে দিয়েছিল। ভেবেছিল
কুশলদাকে পাঠাবে। কিন্তু কী মনে হতে আবার সব ডিলিট করে দিল। এই ঘটনা কে আর বিশ্বাস
করবে? আর অরিজিৎবাবু ভুল কিছু করেননি।
।। ৪ ।।
পরের
দিন হই হই কাণ্ড। অরিজিৎবাবুর স্টাডি রুম পুড়ে গেছে। অনেক জিনিস নষ্ট হয়েছে। তার
মধ্যে আঁকাও ছিল ওঁর কিছু। তবে উনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। শর্ট সার্কিট
থেকে আগুন লাগে। আসল ব্যাপারটা জানে ঋষি আর অরিজিৎবাবু। দিন পনেরো পর ওলা
ডেকে বিশাল একটা ট্রলি ব্যাগ ঠেলতে ঠেলতে অরিজিৎবাবু চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ঋষির
দিকে ফিরে হাত নাড়লেন। ঋষির মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেল।
_____
ছবিঃ মৈনাক
দাশ
No comments:
Post a Comment