দুধে মঙ্গল
সৌম্যকান্তি জানা
বাংলায়
একটা প্রবাদ আছে, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”। তার মানে, দুধ আর ভাত জুটলেই
কেল্লা ফতে! আর কিছু না হলেও চলে। ওতে পেট তো ভরবেই, মিলবে অফুরান পুষ্টি। সুস্থ থাকতে হলে, বাচ্চাদের বুদ্ধির গোড়ায় সার দিতে হলে দুধের
বিকল্প নেই। তাই তো “দুধ না খেলে হবে না ভালো
ছেলে” – চন্দ্রবিন্দু বাংলা ব্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় গানটি কিছুদিন আগেও অনেকের
মুখে মুখে ফিরত। যে বীরেন্দ্র শেহবাগ গ্লেন ম্যাকগ্রা, শোয়েব আখতার, শন পোলক, শেন
বন্ডের গোলার মতো ডেলিভারিকে অনায়াস দক্ষতায় বাউন্ডারির ওপারে ফেলে দিতেন তার
রহস্য কিন্তু রয়েছে ওই দুধেই। শেহবাগ নিজেই বহুবার বলেছেন যে তাঁর প্রিয়তম পানীয়
হল দুধ। ১৯৮৩-র ক্রিকেট বিশ্বকাপ উঠেছিল যাঁর হাতে সেই অবিসংবাদী অলরাউন্ডার
কপিলদেবেরও প্রিয় পানীয় ছিল দুধ। বিশ্বকাপ জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে
শ্যাম্পেনের অভাবে ভারতীয়রা বোতল থেকে দুধ ছিটিয়েই আনন্দে মেতেছিলেন। কারণ ভারতীয়
ড্রেসিংরুমে দুধ থাকত পর্যাপ্ত। শোনা যায় কপিলদেব নাকি প্রতিদিন ৫ লিটার দুধ
খেতেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকতে হলে দুধ যে সেরা পানীয় এ কথা দাদু-ঠাকুরমা-দিদিমাদের
মুখ থেকেও সবাই শুনে এসেছি। তবে এ দুধ বলতে সাধারণতঃ গোরুর দুধকেই বোঝানো হয়েছে।
আর হবে না-ই বা কেন, পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মানুষ তো গোরুর দুধই পান করে। গোরুর দুধ যে
মানুষের উপকারি পানীয় এ ধারণা কবে থেকে তৈরি হল? সত্যিই কি গোরুর দুধ পুষ্টিগুণে
অনন্য? কী আছে এতে? গোরুর দুধের ভালো দিক কিছু আছে কি? খারাপ দিক? এসো, এসব নিয়ে
একটু খোঁজ খবর করে দেখি।
ইতিহাসের
পাতা থেকেঃ
প্রত্নতাত্বিকদের
মতে, প্রায় ১০,০০০ বছর আগে নতুন প্রস্তর যুগের
মানুষ কৃষিকাজ শুরু করার সময়েই গবাদি পশুপালন শুরু করে। যাযাবর মানুষ যখন কৃষিকাজ
করতে শুরু করল তখন থেকে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল। সঙ্গে শুরু করল পশুপালন। খ্রিস্টের জন্মের ৮০০০ বছর আগেকার মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়
গবাদি পশুপালনের প্রমাণ মিললেও পানীয় হিসেবে দুধ গ্রহণ করার প্রমাণ মেলে না। তবে
খ্রিস্টের জন্মের ৩০০০ বছর আগে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় সুমেরিয় সভ্যতায় দুধের জন্য
যে প্রথম গবাদি পশু হিসেবে গোরু, ভেড়া ও ছাগল পালন করা শুরু হয় তার প্রমাণ মেলে। খননকার্যে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক মৃৎপাত্র পরীক্ষা করে তার ভেতর লিপিডের
অবশেষ মেলায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয় যে খ্রিস্টের জন্মের ৩০০০ বছর আগে দক্ষিণ
পশ্চিম এশিয়ায় গবাদি পশুর দুধপান প্রচলিত ছিল। তবে প্রথম প্রথম ভেড়ার দুধই ছিল
বেশি প্রচলিত। চতুর্দশ শতক থেকে গোরুর দুধ মানুষের কাছে বেশি আদরনীয় হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া থেকে দুধপ্রদায়ী গবাদি পশুপালনের রীতি ধীরে ধীরে পৃথিবীর
অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তারলাভ করে। খ্রিস্টের জন্মের ৪০০০ বছর আগে মধ্য আরব অঞ্চলে
দুধের জন্য উটপালনও প্রচলিত হয়। প্রাচীন গ্রিক, রোমান, সুমেরিয়, মিশরীয়, মোঙ্গলীয়
বা ভারতীয় সভ্যতায় দেবতার খাবার হিসেবে দুধকে স্থান দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুধকে
শ্রেষ্ঠ খাদ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ৩০০০ বছর আগে মিশরীয়দের মধ্যে দুধপানের যে
বহুল প্রচলন ছিল তার প্রমাণ উপাসনালয়গুলোর দেয়ালে উৎকীর্ণ অসংখ্য চিত্র। তখন
গোরুকে মিশরীয়রা সত্যিই দেবতার আসনে স্থান দিয়েছিল। তারা গোরুকে হাথর নামে এক
দেবীর মর্যাদা দেয় যে জমির উর্বরতা বজায় রাখে। স্বভাবতই যে প্রাণীকে দেবতার আসনে
বসানো হয়েছে, তার দুধও মহার্ঘ্য। তাই দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য আর কেউ পাক না পাক
রাজপরিবারের সদস্য, পুরোহিত ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হত। ভারতে গোরুকে গৃহিপালিত জীব হিসেবে পালনের ইতিহাস আর্যদের আগমনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২০০০ বছর আগে আর্য সভ্যতায় গোরু
ও গোজাত দ্রব্যের উপর মানুষ অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিল। সম্ভবতঃ এই কারণেই আর্যরাও
গোরুকে পবিত্র প্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
কথিত আছে, সুমেরিয় রাজারা নিজেদের বলশালী ও অমর করে তোলার জন্য নিয়মিত দুধ
পান করতেন। প্রাচীনকালে গ্রিকরা দুধকে ওষুধ হিসেবে জ্ঞান করত। এজন্য অলিম্পিক
খেলোয়াড়েরা প্রাচীনকাল থেকে নিয়মিত দুধ পান করত নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য। শোনা
যায় রোম সম্রাট নেরো-এর স্ত্রী স্ট্যাশিলিয়া মেসালিনা এবং মিশরীয় সম্রাজ্ঞী
ক্লিওপেট্রা নিজের রূপ ধরে রাখতে নিয়মিত দুধ দিয়ে স্নান করতেন। স্ট্যাশিলিয়া নাকি
এজন্য ৫০০ গাধাও পুষেছিলেন। আর ক্লিওপেট্রার স্নানপাত্র নাকি সবসময় গাধার দুধে
পূর্ণ থাকত। জুলিয়াস সিজারের নাকি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে সেল্ট ও জার্মানদের বড়োসড়ো চেহারা হয়েছে গবাদি পশুর দুধ ও মাংস খেয়ে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে
অন্ততঃ পঞ্চাশ জায়গায় দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুণগান করা হয়েছে। তবে বাইবেলে
গোরু বা মোষের দুধ নয়, ভেড়া ও ছাগলের দুধের কথা উল্লেখ রয়েছে।
চতুর্দশ
শতক থেকে মানুষ গোরুর দুধের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে শুরু করলেও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু
করে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকে। এই সময় ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের প্রচলন না থাকায় পুকুর,
নদী ইত্যাদির জল পান করে প্রচুর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর তাই জলের থেকে মদে
মানুষের আগ্রহ ছিল বেশি। দুধের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এই সময় মদের জনপ্রিয়তায় ভাগ
বসায়।
তবে প্রাচীনকালে গোরুর দুধ খাওয়ানোর প্রচলন ছিল কেবল বাচ্চাদের। কারণ বড়োরা
দুধ খেয়ে হজম করতে পারত না। দুধে থাকা ল্যাকটোজ নামক শর্করা হজম করার জন্য দরকার
যে এনজাইম তার নাম ল্যাকটেজ। প্রাচীনকালে মানুষের পরিপাকনালীতে এই এনজাইম তৈরি হত
না। তখন মানুষ দুধকে দইতে রূপান্তরিত করে খেত। তাতে
দুধে থাকা ল্যাকটোজ কমে যেত। আর তাই প্রাচীনকালে দুধের থেকে দই খাওয়ার প্রচলন ছিল
বেশি। কিন্তু কয়েক হাজার বছর আগে ইউরোপ অঞ্চলে হঠাৎই মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষের ডি
এন এ-তে ল্যাকটেজ এনজাইম উৎপাদক জিনের আবির্ভাব ঘটে। আর তার
পর থেকে যে সব মানুষের মধ্যে এই জিনটি থাকে সে দুধের ল্যাকটোজ হজম করতে সক্ষম হয়।
আর তারপর থেকেই সব বয়সের মানুষের মধ্যে দুধ খাওয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ একটা ধারণা
গড়ে ওঠে যে যে-সব মহিলা গোরুর দুধ দোহন করে তাদের গুটি বসন্ত হয় না। এই
প্রচার ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনারকে কৌতূহলী করে তুলল। তিনি জানতেন গোরুর
গোবসন্ত রোগ হয়। তাহলে কি ওই দোহনকারী মহিলারা গো-বসন্তে
আক্রান্ত হন বলে গুটি বসন্তের আক্রমণ থেকে রেহাই পান? পরীক্ষা করার জন্য ১৭৯৬ সালে
তিনি আট বছরের একটি ছেলে জেমস ফিপস-কে বেছে নিলেন। তিনি বাচ্চাটার শরীরে প্রথমে
গোবসন্তের জীবাণু ইনজেক্ট করে দিলেন। এর কয়েকদিন
পর তিনি বাচ্চাটার শরীরে গুটি বসন্তের জীবাণু ইনজেক্ট
করে দেখলেন যে তার গুটি বসন্ত হল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি নিজের সন্তানসহ মোট
তিনটে বাচ্চার ওপর একই পরীক্ষা করলেন। ফল হল একই। এভাবে আবিষ্কৃত হল প্রথম টিকা –
গুটিবসন্তের টিকা।
স্তনগ্রন্থি
ও দুধের সৃষ্টিঃ
দুধ হল
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের স্তনগ্রন্থি থেকে ক্ষরিত এক প্রকার পুষ্টিগুণসম্পন্ন সাদা
রঙের তরল যা সন্তানকে পুষ্টি জোগায় ও বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষা দেয়। প্রাণীজগতের লক্ষ লক্ষ প্রাণীর লক্ষ লক্ষ
বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে অষ্টাদশ শতকে সুইডিশ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস
স্তনগ্রন্থি আর দুধ – এই দুটি বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে একটা
প্রাণীগোষ্ঠী তৈরি করলেন যাদের বলা হল স্তন্যপায়ী বা ম্যামালস (Mammals)। এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য যা অন্য কোনও
প্রাণীগোষ্ঠীর নেই। পোকামাকড় থেকে শুরু করে মাছ, উভচর,
সরীসৃপ, পাখি – সব প্রাণীর ডিম ফুটে বাচ্চার জন্ম হয়। ডিমের মধ্যে থাকে কুসুম।
ভ্রূণের পরিস্ফুরণের সময় ওই কুসুমই ভ্রূণকে পুষ্টি জোগায়। আর ডিমের বাইরে থাকে
শক্ত একটা খোলক যা ডিমের ভেতরে থাকা ভ্রূণকে শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
কিন্তু স্তন্যপায়ীদের ডিমে অর্থাৎ ডিম্বানুতে শক্ত খোলক ও কুসুম কোনওটাই থাকে না।
তাছাড়া তারা ডিমও পাড়ে না। সুতরাং সদ্যোজাতর পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধের জন্য
বিবর্তনের পথ ধরে সৃষ্টি হয়েছে স্তনগ্রন্থি আর তা থেকে নিঃসৃত পদার্থ দুধ।
বিজ্ঞানীদের মতে, ঘর্মগ্রন্থিই রূপান্তরিত হয়েছে স্তনগ্রন্থিতে, আর ঘর্মগ্রন্থির
ক্ষরণ পরিবর্তিত হয়েছে দুধে।
তবে স্তন্যপায়ীদের সাম্রাজ্যে যে ‘দুধের কারখানা’ গড়ে উঠেছে তার ভিত্তি
কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাবের অনেক আগে, এমনকি ডাইনোসোরদেরও
আগে। প্রায় ৩১ কোটি বছর আগে স্তন্যপায়ীদের কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত পূর্বপুরুষ
সাইন্যাপসিডদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ওদের ডিমের খোলক ছিল
বেশ পাতলা। ফলে ডিমের ভেতর থেকে জল সহজেই উবে যেত। এজন্য সাইন্যাপসিডরা তাদের
ডিমকে সিক্ত রাখার জন্য ত্বকের গ্রন্থি থেকে একরকম জলীয় পদার্থ নিঃসরণ করত। ২১
কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকে আদিমতম স্তন্যপায়ীরা পাতলা খোলকযুক্ত ডিম
পাড়ত, ডিমের ভেতর থেকে জলীয় অংশ উবে যেত, নিজের আকারের তুলনায় অনেক ছোটো ডিম পাড়ত,
ভ্রুণের বিকাশ খুব দ্রুত হত, এবং শিশুর দাঁত অনেক দেরিতে উঠত। এই সময় তাদের ত্বকের
গ্রন্থি থেকে যে তরল ক্ষরিত হত তাতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসসমৃদ্ধ প্রোটিন থাকত। এই
তরল যেমন ডিমের খোলককে শক্ত করতে সাহায্য করত, তেমনই ভেতরে থাকা ভ্রূণকে পুষ্টি জোগাত ও শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করত। তারপর জুরাসিক যুগে
১৭ কোটি বছর আগে আদিম স্তন্যপায়ীদের ডি এন এ থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল কুসুমে
থাকা প্রোটিন উৎপাদনের জন্য দায়ী ভাইটেলোজেনিন জিন। বর্তমানের সমস্ত সরীসৃপ ও
পাখির ডি এন এ-তে তিনটে ভাইটেলোজেনিন জিন সক্রিয়
থাকলেও ডিম পাড়া প্রাচীন স্তন্যপায়ী হংসচঞ্চুর ডি এন এ-তে কেবল একটি ভাইটেলোজেনিন জিন
সক্রিয় আছে। আর সব স্তন্যপায়ীর ডি এন এ-তে তিনটে
ভাইটেলোজেনিন জিনই নিষ্ক্রিয়। তাহলে ভ্রূণ বা সদ্যোজাতের পুষ্টির কী হবে? তখন
ভ্রুণের বিকাশের জন্য জরায়ুর মধ্যে সৃষ্টি হল অমরা (Placenta), আর সদ্যোজাতের পুষ্টির জন্য স্তনগ্রন্থি থেকে সৃষ্টি হল দুধ, যেখানে
রয়েছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন কেসিন।
এতসব কথার প্রমাণ কী? আসলে হংসচঞ্চুরা ছাড়া তো তেমন কোনও জীবন্ত প্রমাণ আজ
আর টিকে নেই। সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ীর বিবর্তনের সন্ধিক্ষণের প্রায় সব প্রাণীই
বিলুপ্ত। তবে কিছু কিছু পাখি (যেমন পায়রা, ঘুঘু, ফ্ল্যামিঙ্গো ও এম্পারার
পেঙ্গুইন) তার সন্তানকে গলার ভেতরে থাকা গ্রন্থি থেকে একপ্রকার গাঢ় পুষ্টিকর তরল
ক্ষরণ করে খাওয়ায়। আবার এক জাতের আরশোলা (Diploptera punctata) তার ভ্রূণের পুষ্টির জন্য দুধের
মতো প্রোটিন সমৃদ্ধ একপ্রকার তরল ক্ষরণ করে। এ থেকে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে দুধ
তৈরির পরিকল্পনা স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই নেওয়া ছিল!
দুধের
উপাদানঃ
দুধের
প্রধান তিনটে উপাদানের একটা হল প্রোটিন। গোরুর দুধে লিটার প্রতি ৩০-৩৫ গ্রাম
প্রোটিন থাকে, আর এই প্রোটিনের ৮০ শতাংশ হল কেসিন। এই প্রোটিনটি ক্যালসিয়াম
ফসফেটের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং কয়েক হাজার
প্রোটিন অণু একসঙ্গে জুড়ে থেকে মিসেল নামে
বৃহৎ কণা গঠন করে। কেসিন ছাড়াও অপর গুরুত্বপূর্ণ দুগ্ধ-প্রোটিন হল
ল্যাকটোগ্লোবিউলিন।
দুধের দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হল ল্যাকটোজ। এটি একটি দ্বিশর্করা। দুধের মিষ্টি স্বাদের জন্য এই ল্যাকটোজই দায়ী। গোরুর দুধ
থেকে প্রাপ্ত ক্যালোরির ৪০% আসে এই ল্যাকটোজ থেকে। এছাড়াও গ্লুকোজ, গ্যালাকটোজ ও
অন্য কিছু শর্করা থাকে।
তৃতীয় প্রধান উপাদান হল ফ্যাট। দুধে যে ফ্যাটের কণা থাকে তা ফসফোলিপিড ও
প্রোটিনের সূক্ষ্ম আবরণে আবৃত দানা আকারে থাকে। দুধে থাকা ফ্যাটের ৯৭-৯৮ শতাংশ হল
ট্রাইগ্লিসারাইড। এছাড়া সামান্য মনো ও ডাই গ্লিসারাইড থাকে। তবে এই ফ্যাটের পরিমাণ
ও ফ্যাট অণুর ব্যাস গোরুর প্রজাতি,
ভ্যারাইটি, খাদ্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। দুধে ফ্যাট ছাড়া সামান্য কোলেস্টেরলও
আছে। আর আছে ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন এ, ডি, ই এবং
কে।
এসব ছাড়াও গোরুর দুধ হল বিভিন্ন খনিজ মৌল যেমন ক্যালশিয়াম, ফসফরাস,
ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি এবং ভিটামিন এ, বি৬, বি১২, সি, ডি, ই,
কে, থিয়ামিন, রাইবোফ্ল্যাভিন, বায়োটিন, ফোলিক অ্যাসিড ও প্যান্টোথেনিক অ্যাসিডের
সমৃদ্ধ উৎস।
দুধে থাকা বড়ো বড়ো ফ্যাটের দানা আর কেসিনের মিসেল দৃশ্যমান আলোর সব তরঙ্গকে
সম্পূর্ণ প্রতিফলিত করে। সেই প্রতিফলিত রশ্মি আমাদের চোখে পৌঁছোলে দুধকে সাদা
দেখি।
যদিও গোরুর দুধই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের পছন্দ, তবে কোথাও কোথাও অন্য
গৃহপালিত প্রাণীর দুধও যথেষ্ট জনপ্রিয়। এশিয়ার উঁচু মালভূমি অঞ্চলের যাযাবর
অধিবাসী এবং পূর্ব ইউরোপের মানুষের মধ্যে ঘোড়ার দুধ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এশিয়ার
উঁচু মালভূমির লোকেদের মধ্যে চামরী গাভীর দুধও জনপ্রিয়। পশ্চিম এশিয়া ও
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ভেড়ার দুধ খাওয়ার প্রবণতা বেশি। এস্কিমোরা তো বল্গা হরিণের দুধ পান করে। পশ্চিমবঙ্গের কথা বাদ দিলে ভারতের
অন্যান্য রাজ্যে গোরুর দুধের চাহিদা মেটায় মোষের দুধ।
বিভিন্ন গবাদি পশুর দুধের উপাদান ও তার পরিমাণ এক নয়। প্রোটিনের উপাদান,
শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাটের অনুপাত, বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ লবনের পরিমাণ এক এক
প্রজাতির দুধে এক এক রকম। আবার বিভিন্ন ব্রিডের গোরুর ক্ষেত্রে এই পরিমাণের কিছু
পরিবর্তন হতে পারে। নীচের সারণিতে দেখে নেওয়া যাক গোরু, ভেড়া, ছাগল ও মোষের দুধে
পুষ্টিকর উপাদানের পরিমাণ।
সারণিঃ ১
– গোরু, ছাগল, ভেড়া ও মোষের দুধের প্রধান উপাদান
উপাদান
|
একক
|
গোরু
|
ছাগল
|
ভেড়া
|
মোষ
|
জল
|
গ্রাম
|
৮৭.৮
|
৮৮.৯
|
৮৩.০
|
৮২.১
|
প্রোটিন
|
গ্রাম
|
৩.২
|
৩.১
|
৫.৪
|
৪.৫
|
ফ্যাট
|
গ্রাম
|
৩.৯
|
৩.৫
|
৬.০
|
৮.০
|
শর্করা
|
গ্রাম
|
৪.৮
|
৪.৪
|
৫.১
|
৪.৯
|
ক্যালশিয়াম
|
মাইক্রোগ্রাম
|
১২০
|
১০০
|
১৭০
|
১৯৫
|
শক্তি
|
কিলো ক্যালোরি
|
২৭৫
|
২৫৩
|
৩৯৬
|
৪৬৩
|
দুধের
দোষ-গুণঃ
খাবার
কিংবা পানীয় হিসেবে দুধ খুবই গুণী খাবার। আর গুণীর কদর কে না করে? তামাম বিশ্বের
সমস্ত মানুষ তাই দুধকে সবার সেরা খাবার হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। তাই সত্যিই দুধ না
খেলে হবে না ভালো ছেলে বা মেয়ে। এসো দেখে নিই, দুধের মঙ্গলকর রূপ।
Ø দুধে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানগুলো এমন অনুপাতে রয়েছে যে একজন মানুষের
যথোপযুক্ত পুষ্টির জন্য তা প্রায় কার্যকরী। এজন্য একজন মানুষ সারাজীবন কেবল দুধ
খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারে।
Ø দুধের অ্যাম্ফোটেরিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, অর্থাৎ দুধ অ্যাসিড ও ক্ষার উভয়
ধর্মই প্রকাশ করে। অম্ল মাধমে এলে দুধ ক্ষার হিসেবে কাজ করে, ফলে অম্লত্ব প্রশমিত
হয়। অথচ কোনও জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া হয় না ও দুধের মানেরও পরিবর্তন হয় না। এজন্য
অম্বলের রোগীকে ডাক্তারেরা দুধ খেতে পরামর্শ দেন। অ্যান্টাসিড খেলে পেটে গিয়ে তা
তাপ সৃষ্টি করে, কিন্তু দুধের বেলায় সেই সম্ভাবনা নেই।
Ø দুধে প্রচুর ক্যালশিয়াম ও ফসফরাস থাকায় তা হাড় ও দাঁতের গঠনে সাহায্য করে।
তাই বাচ্চাদের দুধ খাওয়া একান্ত দরকার। প্যাকেটজাত দুধে আবার ভিটামিন-ডি সংযোজন
করা থাকে বলে তা হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধিতে আরও উপকারী হয়ে ওঠে।
Ø দুধে যথেষ্ট পরিমাণে
পটাশিয়াম রয়েছে যা রক্তবাহের প্রসারণে সাহায্য করে। এর ফলে রক্তচাপ বাড়ে না, আর
তাই হৃদরোগের সম্ভাবনাও কমে।
Ø দুধে থাকা ভিটামিন-ডি কোষের বৃদ্ধি
ও বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর ফলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে। কারণ কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে ক্যানসার হয়।
Ø এক গ্লাস দুধ খেলে অনেকক্ষণ ক্ষিধে পায় না, কারণ দুধে থাকে প্রচুর প্রোটিন
যা থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তির অনেকটাই পাওয়া যায়। আর তখন আমাদের ক্যালোরি
সমৃদ্ধ অন্য খাবার বার বার খাওয়ার দরকার পড়ে না। এতে স্থূলতার সম্ভাবনা কমে।
Ø দুধে থাকা বিভিন্ন উপাদান রক্তে ইনসুলিন হরমোনের সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে
সাহায্য করে। আর তাই যারা নিয়মিত দুধ পান করে তাদের ডায়াবেটিস মেলিটাস বা ব্লাড সুগার
হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
Ø দুধে থাকা ভিটামিন-ডি মস্তিষ্ক থেকে সেরোটোনিন নামক হরমোনের ক্ষরণে সাহায্য
করে। এই হরমোনটি আমাদের মানসিক আবেগ, ক্ষুধা ও নিদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণেও দুধের ভূমিকা রয়েছে।
Ø দুধে রয়েছে সমস্ত অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ উচ্চ গুণমানের
প্রোটিন। এই প্রোটিন পেশির বৃদ্ধিতে দারুণ সাহায্য করে। তাই শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠার সময় দুধ খাওয়া একান্ত
জরুরি।
Ø বয়স্ক ব্যক্তিদের একটা সাধারণ রোগ হল হাঁটুতে আর্থারাইটিস। বিজ্ঞানীরা
দেখেছেন, অস্টিও আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে দুধপান জরুরি।
দুধ
খাওয়া যে জরুরি তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু কতটা খাওয়া জরুরি? নীচের সারণিতে দেখে
নেওয়া যাক।
সারণিঃ২ –
কোন বয়সে কতটা দুধ খাওয়া দরকার
বয়স
|
নিরামিষাশী
|
আমিষাশী
|
৩-৬ বছর
|
৩০০ গ্রাম
|
২০০ গ্রাম
|
৭-১৮ বছর
|
২৫০ গ্রাম
|
২০০ গ্রাম
|
১৯ বছর ও তার ঊর্ধ্বে
|
২০০ গ্রাম
|
১৬০ গ্রাম
|
যদিও
দুধের গুণরাশির তুলনায় দোষের পরিমাণ অনেক কম তাও সেগুলো উল্লেখ করা দরকার। যেমন –
Ø গোপালকরা আজকাল বেশি দুধের জন্য গোরুকে হরমোন ইঞ্জেকশন দেন। ফলে দুধে ওই
হরমোনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই দুধ বেশিদিন পান করলে প্রস্টেট, স্তন ও
কোলন-মলাশয়ে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
Ø দুধে সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকায় বেশি দুধ খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা
বাড়তে পারে। আর তা থেকে হৃদরোগের সম্ভাবনা। অবশ্য মাখন তোলা বা স্কিমড মিল্ক খেলে
সে-ভয় আর থাকবে না।
Ø অনেক মানুষ আছে যাদের দুধ হজম হয় না। এদের পরিপাকনালিতে দুধের ল্যাকটোজ
পরিপাকের জন্য ল্যাকটেজ এনজাইম উৎপন্ন হয় না। আর তাই এরা দুধ খেলে পেটে গ্যাস,
বদহজম, ডায়েরিয়া, আচ্ছন্নতা ইত্যাদি হতে পারে। অনেকদিন দুধ না খেলে অনেক সময়
ল্যাকটেজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বহুদিন পর দুধ খেলে অনেক সময় পেটে গ্যাস হয়।
Ø দুধের প্রোটিন থেকে কারও কারও অ্যালার্জি হতেও পারে।
শ্বেত
বিপ্লবঃ
ভারত
স্বাধীন হওয়ার পর প্রধান যে সমস্যা দেশের সামনে হাজির হয়েছিল তা হল খাদ্যাভাব।
খাদ্যাভাবের হাত ধরেই আসে অপুষ্টি, রোগ ও মহামারি। স্বাধীন দেশের সরকার তাই নজর
দিয়েছিল খাদ্যশস্য ও দুধ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে। দুটি বিশাল প্রকল্প গৃহীত হল – সবুজ
বিপ্লব এবং শ্বেত বিপ্লব। ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (NDDB) ১৯৭০ সালে গ্রহণ করল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডেয়ারি উন্নয়ন প্রকল্প – অপারেশন
ফ্লাড (Operation Flood)। এটিই শ্বেত বিপ্লব (White Revolution) নামে
পরিচিতি পায়। লক্ষ্য, দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন। বলতে গর্ব হয়, যে ভারতে ১৯৭০
সালের আগে দুধ উৎপাদনে ঘাটতি হত, বর্তমানে উদ্বৃত্ত তো হয়ই, বিশ্বের মধ্যে দুধ
উৎপাদনে ভারতের স্থান এখন প্রথম। বিশ্বের মোট দুধের ১৭% উৎপাদিত হয় আমাদের দেশেই।
শুধু দুধ উৎপাদন নয়, মাথাপিছু দুধ গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। ১৯৯০-৯১-তে যেখানে মাথাপিছু ১৭৬ গ্রাম দুধ লভ্য ছিল, সেখানে এখন তা ৩০০ গ্রামের
বেশি। তথ্যের খাতিরে হয়তো বলাই যায় যে দেশে কোনও মানুষের দুধের অভাব হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু বাস্তব কি তাই বলে? দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা ক’জন দুধ খাওয়ার সুযোগ পান?
আসলে দুধ উৎপাদনে প্রথম হলে কী হবে,
মাথা পিছু আয়ের নিরিখে বিশ্বে ভারতের স্থান ১৩৯ নম্বরে! বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেওয়া
তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ২২ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ৮০ টাকার কম। এঁদের কাছে
দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যেখানে আকাশের স্বর্গ হাতে পাওয়ার সমান সেখানে দুধের কথা
তাঁদের স্বপ্নেও আসে কি? যতদিন অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট থাকবে ততদিন দুধ মধ্যবিত্ত
ও উচ্চবিত্তের পানীয় হয়েই থাকবে। আর অপারেশন ফ্লাডে ভেসে যাবে দেশের গরিব মানুষ,
অথচ এক ফোঁটাও পেটে পড়বে না।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment