বেড়া ভাঙল বদ্যিবুড়ি
সৈকত মুখোপাধ্যায়
দেশের পূবদিকে একটা ছোট্ট
রাজ্য। সেই রাজ্যের নাম মুচকুন্দপুর। মুচকুন্দপুরের রাজার নাম
সরলকুমার।
মুচকুন্দপুরের একদম গায়ে-গায়েই
আরেকটা বিরাট রাজ্য। তার নাম বিকটধাম। বিকটধামের রাজার নাম জটিলেশ্বর।
রাজা সরলকুমার মানুষটি
ভারি সাদাসিধে আর হাসিখুশি। তার রাজমুকুটে আর প্রাসাদের সিংদরজায় সাদা পায়রার ছবি
আঁকা আছে। জটিলেশ্বর লোকটি তেমনই হিংসুটে আর কুচুটে। তার রাজমুকুটে আর প্রাসাদের
সিংদরজায় তাই বাজ পাখির ছবি।
কয়েকদিন আগে রাজা
জটিলেশ্বর এই দুই রাজ্যের মাঝখানে মস্ত উঁচু এক কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে দিয়েছেন।
মাইলের পর মাইল ধরে সেই বেড়া চলেছে তো চলেছেই। শুধু যে বেড়াই তুলেছেন তাই নয়, বেড়ার
গা-বরাবর বিকটধামের সৈন্যরা তলোয়ার উঁচিয়ে টহলও দিচ্ছে।
কিন্তু কেন? এত
আটক-বাঁধনের দরকারটা কী? বেশ তো যুগ-যুগ ধরে মুচকুন্দপুরের লোকজন মাছ আর শাকসবজি
বিক্রি করতে বিকটধামে যাচ্ছিল। আবার বিকটধামের লোকজন মুচকুন্দপুরের মন্দিরে যাচ্ছিল
পুজো দিতে। তাতে তো কারুর কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছিল না। তাহলে আজ হঠাৎ
রাজা জটিলেশ্বরের মাথায় এই সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর খেয়াল চাপল কেন?
না না, হঠাৎ তো নয়। হঠাৎ
কেন হবে? রাজা জটিলেশ্বর মোটেই খেয়ালের বশে কিছু করেন না। আসলে হয়েছিল কী,
বিকটধামের প্রজারা রাজামশাইয়ের অত্যাচারে বড্ড কষ্টে ছিল আর তাই তারা সুযোগ পেলেই পালিয়ে
যাচ্ছিল মুচকুন্দপুরে।
তাতে জটিলেশ্বরের মোটেই
কোনও অসুবিধে ছিল না। প্রজারা না থাকলে তিনি বরং নিজের রানি, রাজকুমার, গায়ক,
বিদূষক, কবি আর চাটুকারদের নিয়ে এলাহি রাজপ্রাসাদে ভালোই থাকতেন। এখনকার মতোই রানি
তার জন্য রোজ চর্ব্যচোষ্যের ব্যবস্থা করতেন। চাটুকার আর বিদূষক নানান রসিকতায় তার
মন ভালো রাখত। কখনো ইচ্ছে হলে গায়কের গলায় একটু গান শুনতেন। প্রজা-টজা না থাকলে একটা
সুবিধে হত - রোজ সকালে রাজসভায় গিয়ে একঘন্টা ধরে ওদের অভাব-অভিযোগের ফিরিস্তি
শুনতে হত না।
মুশকিল হচ্ছে, প্রজা না
থাকলে খাটুনির কাজগুলো করবে কারা? এই যে রাজবাড়ির রন্ধনশালায় প্রতিদিন মন-মন বাসমতী
চাল, সোনামুগের ডাল, ঝুড়ি-ঝুড়ি তরিতরকারি লাগে, সে সব ফলাবে কে? দুধ দুইয়ে কারা
বানাবে ক্ষীর, ননী, ঘি? ওসব কাজ তো আর রানি, বিদূষক কিম্বা রাজকবিকে দিয়ে হবে না?
তাছাড়া রাজার কোষাগারে এত যে ধনদৌলত, সেসব রক্ষা করার জন্যে পেয়াদা লাগবে না?
রাজার গোশালা, হাতিশাল ঘোড়াশাল সামলাবার জন্যে আর ফুলের বাগানের পরিচর্যার জন্যে
রাখাল লাগবে না, মালি লাগবে না? সে সব কাজের-লোক তো প্রজাদের মধ্য থেকেই আসে।
তার চেয়েও গুরুতর
ব্যাপার, প্রজা না থাকলে খাজনা দেবে কারা? আর খাজনা না পেলে রাজা জটিলেশ্বরের
সঙ্গীতসভা, কন্দুকক্রীড়া, মৃগয়া-টিগয়ার মতন আমোদপ্রমোদের পয়সা আসবে কোত্থেকে? এইসব
কারণেই সিংহাসনে বসার পর থেকে জটিলেশ্বর প্রজাদের ওপরে খাজনার চাপ বাড়িয়েছিলেন। যে
প্রজা খাজনা দেয় না তাকে পেয়াদা দিয়ে তুলে এনে চাবুক কষানোর ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। কিন্তু
প্রজাগুলো এতই নেমকহারাম, এই সামান্য কারণেই তারা সুযোগ পেলেই মুচকুন্দপুরে পালাতে
শুরু করল।
ওখানকার রাজা সরলকুমার নাকি
ভারী ভালো লোক। প্রজারা নিজে থেকে খুশিমনে রাজামশাইকে যে কর দেয় তার বাইরে তিনি
একটি পয়সাও চান না। সেই কর থেকেও তিনি নাকি আবার প্রথমে প্রজাদের জন্য রাস্তাঘাট,
বিদ্যালয়, দিঘি-পুকুর এইসব বানিয়ে দেন। সাদাসিধে-ভাবে জীবন কাটান বলে রাজামশাইয়ের
নিজের খরচ খুব কম।
তো, সেই প্রজাদের
দেশান্তরী হওয়া আটকানোর জন্যেই রাজা জটিলেশ্বরকে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে
হয়েছে। এখন নিয়ম খুব কড়া। ওই বেড়া পেরোতে গিয়ে কেউ ধরা পড়লে তার পিঠে চাবুক তো
পড়বেই, উপরন্তু কারাদন্ডও হবে।
এই কয়েকদিনের মধ্যেই সেরকম
বেশ কিছু বেয়াদব প্রজা ধরা পড়েছে। তারা এখন বিকটধামের জেলখানায় পচছে।
* * *
মুচকুন্দপুর আর বিকটধামের সীমানায় যে কয়েক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নেই,
সেরকমই একটা জায়গার নাম লালটিলা। রাজা জটিলেশ্বরের স্থপতী ওখানে বেড়া দেওয়ার দরকার
মনে করেননি, কারণ প্রকৃতিদেবী নিজের হাতেই ওখানে একটা পাঁচিল তুলে রেখেছেন –
পাহাড়ের পাঁচিল। বেশ কয়েক-মাইল জুড়ে ছড়ানো একটা বড়োসড়ো পাহাড় রয়েছে ওখানে; তার
দক্ষিণদিকে মুচকুন্দপুর আর উত্তরদিকে বিকটধাম।
পাহাড়টার নাম লালটিলা।
লালটিলা পাহাড়ের দক্ষিণদিক, মানে মুচকুন্দপুরের দিকটা এমন গভীর বনে
ঢাকা যে, উত্তরদিক থেকে রওনা হয়ে, পাহাড়ের চুড়ো টপকে, কেউ যদি ওই দক্ষিণের বন
পেরিয়ে মুচকুন্দপুরের মাটিতে পা রাখার মতলব করে, তাহলে সে নির্ঘাৎ হয় বাঘের কামড়ে
নয় তো সাপের ছোবলে মারা পড়বে। সেইজন্যেই সেনাপতি ওখানে বেড়া দেননি।
আচ্ছা, লালটিলার দক্ষিণ-ঢালে এখনও অমন গভীর বন কেন? কেন ওখানে মানুষ
থাকে না? অন্য সব জায়গাতেই তো মানুষ বন কেটে বসত বানিয়েছে। গাছ কেটে চাষের খেত
বানিয়েছে। এখানে কেন পা দেয়নি?
এর উত্তরটা ভারি অদ্ভুত। ওই দক্ষিণ-ঢালে নাকি বহুযুগ ধরে পরিদের বাস। বনপরি,
জলপরি, ফুলপরি, মেঘপরি, হিমপরি, পক্ষীপরি, মক্ষীপরি ইত্যাদি সতেরো-রকমের পরি থাকে
ওখানে। সেইজন্যই রাজা সরলকুমারের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও কেউ ওখানে কখনও গ্রাম গড়ার
অনুমতি দেননি, আর রাজা সরলকুমার নিজেও প্রজাদের বারণ করে দিয়েছেন ওই বনে পা দিতে।
বারণ করার খুব একটা দরকারও ছিল না অবশ্য। মুচকুন্দপুরের একটা
বাচ্চাছেলেও জানে, পরিরা এমনিতে ভালো। কিন্তু রেগে গেলে বড্ড রেগে যায়। তখন
শাপ-টাপ দিয়ে কাকে যে কী বানিয়ে দেয় কে বলতে পারে। তাই মুচকুন্দপুরে যারা থাকে
তারা নিজেরাই ওই পাহাড়টাকে এড়িয়ে চলে।
তারা জানে লালটিলার বনে শুধু নানান বন্যজন্তু, পাখি, পোকামাকড় আর পরি
থাকে। কোনও মানুষ থাকে না।
* * *
কোনও মানুষ থাকে না, এই কথাটা কিন্তু ভুল। ওই দক্ষিণের বনেরই মাঝামাঝি
জায়গায় একটা পুকুর রয়েছে। তার একধারে একটা কুঁড়েঘরের মধ্যে বাস করে বদ্যিবুড়ি।
বদ্যিবুড়ির বয়সের গাছপাথর নেই, কিন্তু তার চেহারা এখনও দিব্যি শক্তসমর্থ। সে একটু
কুঁজো হয়ে হাঁটে ঠিকই, কিন্তু ওইভাবেই পুকুর থেকে বালতি ভরে জল নিয়ে আসে, নদীর চরা
থেকে বাবুইঘাস তুলে এনে তাই দিয়ে সাজি, চুবড়ি এইসব বানায়। তবে দিনের বেশিরভাগ
সময়টাই বদ্যিবুড়ির কেটে যায় বীজতলায়।
হ্যাঁ গো! বদ্যিবুড়ির কুঁড়েঘরে যদি কোনোদিন তোমরা যেতে পারতে, তাহলে
দেখতে সেই কুঁড়েঘরকে ঘিরে ছোটো-ছোটো চৌকো-চৌকো বেড়া ঘেরা জমি। একেকটা জমিতে একেক
রকমের গাছের চারা ফন ফন করে মাথা তুলেছে। তার মধ্যে বড়ো গাছের চারাও যেমন রয়েছে,
তেমনি আবার ঘাসজাতীয় নানারকমের শস্যের চারাও আছে। তাছাড়া রয়েছে ঔষধিবৃক্ষের চারা –
মানুষের রোগবালাই সারাতে যেসব গাছের শেকড় আর পাতাপুতা কাজে লাগে।
ওই লালটিলার বনে বহু হাজার বছর ধরে বদ্যিবুড়ির পরিবারের বাস।
বদ্যিবুড়ির বাবা, তার বাবা, তার বাবা সকলেই ওই লালটিলার বনে থাকত। তারা সকলেই ছিল
বদ্যি, মানে তারা বনের গাছপালা থেকে রোগের ওষুধ বানাত।
বদ্যিবুড়িও ওষুধ বানায়।
কিন্তু সেই ওষুধ খায় কে? একটু আগে বললাম যে, ওই বনে তো কেউ পা দেয় না।
তাহলে একটা মজার কথা বলি শোনো। ‘কেউ পা দেয় না’ – এই কথাটাও ভুল। বছরে
দু’বার, একবার রথযাত্রার দিন, আরেকবার মকরসংক্রান্তিতে, তিনজন মানুষ একসঙ্গে
বদ্যিবুড়ির ঘরে পা রাখেন। তাদের একজন হলেন মুচকুন্দপুরের সবচেয়ে বড়ো চিকিৎসক
মিহিরাচার্য। আরেকজন রাজ্যের ক্ষেত্রপাল ধর্মদাস। ক্ষেত্রপাল মানে রাজ্যের
চাষবাসের ভালোমন্দ যিনি দেখেন। আর একজন স্বয়ং রাজা সরলদেব।
বুঝতেই পারছ, ওনারা তিনজনেই লালটিলার পাহাড়ে আসেন ছদ্মবেশে। গ্রামের
কৃষক সেজে, গোরুর গাড়িতে চেপে, ওনারা পাহাড়ের পায়ের কাছে আসেন। তারপর পায়ে হেঁটে
চড়াই ভেঙে পৌঁছোন বদ্যিবুড়ির কুঁড়েঘরে।
তখন হয়তো দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বিকেলের দিকে। চারিদিক থেকে শাল-সেগুনের
ছায়া লম্বা হতে হতে ঢুকে পড়েছে বুড়ির উঠোনে। সেই উঠোনেই চাটাই পেতে বসেছেন রাজা
সরলদেব, মিহিরাচার্য আর ধর্মদাস। তাদের মুখোমুখি আরেকটা চাটাইয়ে বসে আছে
বদ্যিবুড়ি।
মিহিরাচার্য শুনে নিচ্ছেন গত কয়েকমাসে বদ্যিবুড়ি আর নতুন কোন ওষুধের
গাছ খুঁজে পেল। সেই যে অদ্ভুত জ্বরটার কথা গত মকরসংক্রান্তিতে তিনি বদ্যিবুড়িকে
বলে গিয়েছিলেন, সেই জ্বর সারাবার মতন কোনও ভেষজ কি বদ্যিবুড়ি পেয়েছে?
ধর্মদাস জিজ্ঞেস করেন নতুন কোনও শস্য কিম্বা আনাজের কথা। বনের ভেতর
থেকে কি বদ্যিবুড়ি তেমন কোনও ফলমূল, কন্দ কিম্বা শাক খুঁজে পেয়েছে যা মানুষ খেতে
পারবে? যা হবে প্রচলিত শাকসবজির থেকে সস্তা কিন্তু বেশি পুষ্টিকর এবং মুখরোচক?
রাজা সরলদেব কিছু বলেন না। তিনি উঠোনের ধার বরাবর পায়চারি করতে করতে
দেখেন, বনভূমি অক্ষত রয়েছে কিনা। মুচকুন্দপুর রাজ্য যেদিন প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিনই
মুচকুন্দপুরের বুদ্ধিমান প্রথম-রাজা বুঝেছিলেন, এই লালটিলার আদিম বনভূমি যুগ যুগ
ধরে তার প্রজাদের নতুন-নতুন খাদ্য আর ওষুধের প্রয়োজন মেটাবে। একে রক্ষা করা দরকার।
আর রক্ষা করা দরকার সেই বৈদ্য-পরিবারটিকে যারা বহুপুরুষের বনবাসের অভিজ্ঞতায় এই
লালটিলার বনকে হাতের তালুর মতন চেনে।
রাজা সরলদেবও এই কথাটা বোঝেন। বোঝেন বলেই মহাচিকিৎসক আর ক্ষেত্রপালের
সঙ্গে তিনি নিজেও এখানে আসেন। দেখে যান বন আর বৈদ্যপরিবারের শেষ
বংশধর বদ্যিবুড়ি ভালো আছে কিনা।
রাজামশাই যতক্ষণ বনভূমি নিরীক্ষণ করেন, বদ্যিবুড়ি ততক্ষণে চাটাই ছেড়ে
উঠে টুকটুক করে তার নতুন বানানো বীজতলাগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটা গাছের চারা এনে
মহাচিকিৎসকের হাতে তুলে দেয়। বলে, এই নাও বাছা তোমার ভূতুড়ে জ্বরের ওষুধ। এই গাছের চাষ কোরো তোমার
বাগানে। তারপর ক্ষেত্রপালের হাতে তুলে দেন শালপাতার একটা মোড়ক। বলেন মিছরিঝরনার
ধারে এই বেগুন-গোত্রের গাছটা খুঁজে পেলাম। শুঁয়োপোকার দল যখন চারিদিকের সমস্ত ঝোপঝাড়
পেটে পুরে ফেলেছে, তখনও এই বাবাজীর পাতায় জিভ ঠেকাতে পারেনি। তুমি তোমাদের
মুক্তকেশী বেগুনের সঙ্গে এই গাছের জোড় মেলাও দেখি। আমার মনে হয় তাতে ওদের যে
ছানাগাছ তৈরি হবে, সেই গাছে আর পোকা লাগবে না।
বিকেল পড়ে এলে বদ্যিবুড়ির দান মাথায় ঠেকিয়ে তিন রাজপুরুষ রাজধানীর দিকে
রওনা দেন। চলে আসার আগে সরলরাজা নিজের হাতে বদ্যিবুড়িকে শুধু কয়েকটা ভালো শাড়ি দিয়ে
আসেন। পরার কাপড় ছাড়া বদ্যিবুড়ি রাজামশাইয়ের কাছে আর কিচ্ছুটি নেবে না। দিতে
গেলে বলবে, এই বন আমার মা। আমি মায়ের কোলে থাকি। আমার অভাব কীসের?
রাজামশাইরা চলে যাওয়ার পরেই লালটিলার বনে ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে।
গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় পাহাড়ের চুড়োর ঠিক ওপরটিতে হিরের মতন সন্ধ্যাতারা।
সেইসময়েই বদ্যিবুড়িকে ঘিরে আসর বসে। পরিদের আসর।
পরিদের দেখতে ঠিক আট-ন বছরের মেয়েদের মতন। সেরকমই ছোটোখাটো আর হালকা
তাদের চেহারা। দেখতে তো সুন্দর বটেই - আরও সুন্দর তাদের কাঁধে নরম ভেলভেটের মতন ডানাজোড়া। ছোটো মেয়েদের মতন তারা
গল্প শুনতে ভালোবাসে। বদ্যিবুড়ি তাদের মানুষের গল্প শোনায়।
একদল বনমানুষ কেমন করে একদিন পেছনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সামনের দুটো পা হয়ে গেল তার হাত আর সেই হাতদুটো দিয়ে সে নানান রকম কাজ করতে শিখল।
তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কাজ আগুন জ্বালতে শেখা। তারপর কেমন করে সেই আদিম মানুষ চাকা
বানাল, নৌকা বানাল আর গুহার দেয়ালে অপূর্ব সব ছবি আঁকল, এই সব গল্প পরিদের শোনায় বদ্যিবুড়ি।
পরিরা বলে সবই তো ঠিক ছিল, বুড়িমা। কিন্তু মানুষ বল্লম আর
তীরধনুকটা বানাল কেন বলো তো। আর বানালই যদি, নিজের ভাইবোনের
বুকে সে সব দিয়ে আঘাত করতে শিখল কেমন করে? কই, একজন পরি তো আরেকজন পরিকে কখনও
আক্রমণ করে না।
এই প্রশ্নের উত্তর বদ্যিবুড়ির কাছে নেই। তাই সে দুঃখী-দুঃখী মুখ
করে বসে থাকে। তার পর একসময় পরিরা বলে যাই গো ঠাকুমা। আমাদের তো সারারাত অনেক কাজ
করতে হয় তুমি জানো। সে সব কাজ সারি গে। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। তোমাকেও তো সূর্যের আগে
উঠতে হবে।
সত্যিই তাই। একেক পরির একেক রকমের দায়িত্ব। জলপরিকে বনের ভেতরে যত ঝরনা
আর বিল আর দিঘি সেগুলোর দেখাশোনা করতে হয়। তাদের ঢেউ ছোটো হবে না বড়ো হবে, কখন
কোথায় শালুক ফুটবে আর কোথায় পদ্ম, কোন পুকুরে জন্ম নিলে বোয়ালমাছের হা থেকে
পুঁটিমাছের ছা-গুলো বেঁচে যাবে এইসব তাকেই ঠিক করতে হয়।
ফুলপরিকে দেখতে হয় যত ফুলন্ত লতা আর বৃক্ষের ভালোমন্দ। সবাই যাতে
একইভাবে সূর্যের আলো পায়, একইভাবে বেড়ে ওঠে। সবার ফুলগুলি যেন মৌমাছিদের নাগালের
মধ্যে থাকে। হালকা রঙের ফুলগুলি যেন রাতের বেলায় গন্ধ ছড়ায় আর গাঢ় রঙের ফুলগুলো
যেন দিনের বেলায় বন আলো করে থাকে – এসব ফুলপরির চিন্তা।
মেঘপরি রোদের সময় বনের মাথায় ছায়ার মেঘ ডেকে আনে, খরার সময় বৃষ্টির
মেঘ। তাছাড়া যখন খুব উঁচু গাছের মাথায় একটা মাত্র রুদ্রপলাশ মনখারাপ করে ফুটে
থাকে, ভাবে আমাকে তো কেউ দেখতেই পাচ্ছে না, তখন মেঘপরি সেই ফুলের ঠিক পেছনটাতে
একটুকরো কালোমেঘ এঁকে দেয়। কালো মেঘের পটভূমিকায় তখন সেই লালফুলকে বিশ-ক্রোশ দূর
থেকেও কী সুন্দর দেখতে পাওয়া যায়। রুদ্রপলাশের আহ্লাদ তখন আর ধরে না।
তবে সমস্ত পরি মিলে লালটিলার বনকে যত না দেখে, যত না বনের ভালোমন্দ
নিয়ে ভাবে, বদ্যিবুড়ি একাই তার চেয়ে বেশি দেখে, তার চেয়ে বেশি ভাবে। পরিদের কাজ
যেখানে ফুরোয়, সেখানেই শুরু হয় বদ্যিবুড়ির কাজ।
যখন গরমের দিনে প্রায় শুকিয়ে-ওঠা পুকুরের কাদায় শুয়ে মাছগুলো খাবি খায়,
তখন বদ্যিবুড়ি তার হাত-কোদালিটা নিয়ে ঝরনার বুক থেকে নালা কেটে জল এনে সেই পুকুরে
ফেলে। নতুন জল পেয়ে মাছগুলো বেঁচে যায়।
যখন ঝড়ে টুনটুনি পাখির বাসার সেলাই ছিঁড়ে যায়, কুশি কুশি বাচ্চাগুলো
ছেঁড়া-বাসার ভেতরে বসে বৃষ্টিতে ভেজে আর হি-হি করে কাঁপে, তখন বদ্যিবুড়ি তার
সেলাইয়ের বাক্স নিয়ে গুটি গুটি সেই বাসার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে যত্ন করে
সেলাই করে দেয় টুনটুনির ছেঁড়া বাসা। ছোট্ট টুনটুনি তখন বদ্যিবুড়ির সাদা চুলের ভেতর
ঠোঁট ঢুকিয়ে কত্ত আদর করে দেয় তাকে। কত বাজপাখির নখে ঘায়েল খরগোশ, চিতায় কামড়ানো
হরিণ বদ্যিবুড়ির ঘরে তার ওষুধে সেরে উঠে বনে ফিরে গেছে তার গোনাগুনতি নেই।
শীতের রাতে বদ্যিবুড়িই তো আলেয়া-পরিদের ডেকে বলে, শিগগির মশাল জ্বাল
বাছারা। ওই দ্যাখ, বোকা তিব্বতি হাঁসগুলো অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে বিল পেরিয়ে
কোনদিকে চলে গেল।
সেইজন্যে সারা বনের ছোটো থেকে বড়ো সমস্ত প্রাণী, সবচেয়ে ছোটো কলমি ফুল
থেকে সবচেয়ে বড়ো সেগুন গাছ – সবাই বদ্যিবুড়িকে ভীষণ ভালোবাসে।
কিন্তু মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী। তার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।
* * *
কেন এমন কথা বলছি শোনো।
রাজা জটিলেশ্বর দুই দেশের সীমানায় বেড়া তোলার কয়েকদিন পরের ঘটনা এটা।
লালটিলার জঙ্গলে মেহেদি ঝোপের বাসা থেকে একটা বুলবুলির ছানা অতি উৎসাহে সময়ের একটু
আগেই লাফ মেরে বেরিয়ে এল। তখনও তার ডানায় ভালো করে পালক গজায়নি আর তাই সে একটানা
পাঁচ হাতের বেশি উড়তেও পারে না। তাই দেখে বদ্যিবুড়ির তো মাথায় হাত। এই রে, ছানাটা
তো এক্ষুনি কাগের পেটে যাবে। ধর ধর ধর।
বদ্যিবুড়ি ছুটল বুলবুল-ছানার পেছন-পেছন। কিন্তু ছানাটাও তেমনি বিচ্ছু।
সে ওই কচি-ডানাতেই ফর ফর করে এই ঝোপের মাথা থেকে ওই গাছের ডাল, ওই গাছের ডাল থেকে
সেই পাথরের ছাদ – এইভাবে ক্রমশই বুড়ির নাগাল এড়িয়ে পালাতে লাগল। সে যেন এক
চোর-পুলিশ খেলা পেয়েছে। কিন্তু বদ্যিবুড়িও তো ছাড়ার পাত্রী নয়। সে গাছকোমর করে
শাড়ির আঁচল জড়িয়ে, ঝোপঝাড় পাথর-টাথর ঠেলে, ছানার পেছনে পেছনে দৌড়তে-দৌড়তে হঠাৎ
শুনল, কারা যেন প্রচন্ড জোর চিৎকার করে বলছে, এইও! আর এক পাও এগোবে না। তাহলে
তোমাকে গ্রেপ্তার করব।
বদ্যিবুড়ি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ধমক দিয়ে কথাগুলো বলছিল রাজা জটিলেশ্বরের সীমান্ত-প্রহরীরা। তারা
পাহাড়ের উত্তর-ঢালে কুচকাওয়াজ করতে করতে পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ পড়শি-রাজ্য
মুচকুন্দপুর থেকে এক বুড়িকে সীমান্ত পার হয়ে এদিকে ছুটে আসতে দেখে তারা বল্লম
উঁচিয়ে আবার হুঙ্কার ছাড়ল – খবর্দার বিদেশি। আর এক পাও এগিয়েছ কি মরেছ।
বদ্যিবুড়ি ওখানে, ওই সীমান্তে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই দেখল, বুলবুলির ছানাটা
মনের আনন্দে ফুড়ুত করে বনের আড়াল ছেড়ে বিকটধামের ন্যাড়া মাঠে পাখা মেলল, আর
সঙ্গে-সঙ্গেই একটা কাক কোথা থেকে যেন উড়ে এসে সেটাকে মুখে পুরে নিয়ে পালাল।
বদ্যিবুড়ির চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। সে পেছন ফিরে খুব ধীর পায়ে ফিরে চলল নিজের কুঁড়েঘরের
দিকে।
সেই যে কুঁড়েঘরের দাওয়ায় গালে হাত দিয়ে বসল বদ্যিবুড়ি, আর সে নড়েও না,
চড়েও না।
যে হরিণগুলো প্রতিদিন বদ্যিবুড়ির হাত থেকে আমলকি খেতে আসত, তারা সেদিন
দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ফিরে গেল। যে মা-মরা বাঁদরছানাটা রোজ একবার করে এসে বদ্যিবুড়ির
পিঠের ঘামাচি মেরে দিয়ে উপহার হিসেবে একটা কলা নিয়ে যেত, সে-ও এসে বদ্যিবুড়ির উদাস
মুখ দেখে পালাল।
বিকেল শেষ হব-হব সময়ে প্রতিদিনের মতন পরিরা এল গল্প শুনতে। তারা তো
বদ্যিবুড়ির মুখের অবস্থা দেখে হতবাক। তারা তো ঠাকুমাকে কখনও এমন বিমর্ষমুখে বসে
থাকতে দেখেনি। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো যে হিমপরি, যার কাজ ভোরবেলায় মাকড়শার জালের
মধ্যে হিমের ফোঁটা গেঁথে হার বানানো, সে ভয়ে ভয়ে বদ্যিবুড়ির পিঠে হাত রেখে শুধোল –
কী হয়েছে ঠাকুমা? তোমার মনখারাপ কেন?
এইবার বদ্যিবুড়ি কেঁদে ফেলল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, কেমন করে বিকটধামের
সৈন্যরা তাকে ওদিকে যেতে দেয়নি। কেমন করে তাকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে বুলবুল
ছানার মৃত্যু।
তোমাদের তো আগেই বলেছি, পরিরা এমনিতে খুব ভালো। কিন্তু তারা রাগলে ভীষণ
রেগে যায়। সতেরো জন পরিই তাদের প্রিয় বদ্যিবুড়ির অপমানের কথা শুনে এমন রেগে গেল
যে, তক্ষুনি আকাশ থেকে বনের মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে উল্কা খসে পড়ল। তারা বলল, দাঁড়াও
বুড়িমা। ওই বিকটধামের রাজাকে মজা দেখাচ্ছি। তোমাকে যদি সীমান্ত পেরোতে না দেয়,
তাহলে এই বনের কেউই সীমান্ত পেরিয়ে ওদিকে যাবে না। এবার রাজা জটিলেশ্বর বুঝবে
কাঁটাতারের মজা।
* * *
আগেই বলে রাখি, রাজাকে খাজনা দেওয়ার চাপে বিকটধামের চাষীরা কেউই বাগান
কিম্বা গাছপালা রাখতে পারত না। সব গাছ কেটে ফেলে শুধু ধান, গম, ডাল এইসবের জমি বার
করতে হয়েছিল তাদের। সেই ফসল বিক্রি করে রাজার খাজনা মেটাত তারা।
গাছ ছিল না বলে বিকটধামে প্রজাপতি ছিল না, মৌমাছি ছিল না। কাক চিল ছাড়া
অন্য কোনও পাখিও ছিল না। কিন্তু তোমরা তো জানো, মৌমাছি, প্রজাপতি আর পাখি ছাড়া কোনও
গাছেরই ফুলের পরাগমিলন হয় না। তারা এক ফুলের পরাগ শরীরে মেখে অন্য ফুলের
গর্ভমুন্ডে গিয়ে বসে। তবেই তো পরাগে রেনুতে মিলন হয় আর ফুল থেকে শস্য জন্ম নেয়। ধান,
গম, ডালও এই নিয়মের বাইরে নয়। বিকটধামের চাষের ক্ষেতে সেই পরাগমিলনের কাজটা করে
দিত লালটিলার পতঙ্গ আর পাখিরা। তারা কাজ করত মক্ষীপরি আর পক্ষীপরির কথায়।
মক্ষীপরি আর পক্ষীপরি সমস্ত পতঙ্গ আর পাখিদের ডেকে বলে দিল – আজ থেকে
তোরা কাঁটাতারের ওদিকে যাবি না। বিকটধামের কোনও ধানের শিষে পা রাখবি না।
পতঙ্গ আর পাখিরা বলল, আচ্ছা।
তোমরা তো এ কথাও নিশ্চয় জানো যে, বৃষ্টির মেঘকে বনভূমিই ডেকে নিয়ে আসে।
এতদিন অবধি দক্ষিণের সমুদ্র থেকে জলভরা মেঘেরা লালটিলার বনের ডাকে পাহাড়ের মাথায়
এসে জড়ো হত। তারপর মুচকুন্দপুর আর বিকটধাম দুই দেশেরই মাঠে বৃষ্টি ঝরাত। মেঘপরি
মেঘেদের বলে দিল, ব্যস, এবার থেকে এই মুচকুন্দপুর অবধিই। কাঁটাতারের ওদিকে যাবে না
তোমরা।
মেঘ বলল, আচ্ছা।
বিকটধামের যত উনুনের ধোঁয়া, কামারশালার ধোঁয়া, যজ্ঞস্থল আর পাতা
পোড়ানোর ধোঁয়া সমস্তই উড়ে আসত লালটিলার বনের দিকে। বনের গাছেরা সেই সব ধোঁয়া শুষে
নিয়ে, নির্মল বাতাস ফিরিয়ে দিত বিকটধামের দিকে। বনপরি গাছপালাকে বলল, আজ থেকে আর
ওদিকের ধোঁয়াদের এদিকে আসতে দিবি না। ঠিক যেভাবে বুড়িমাকে ওদের প্রহরীরা বলেছিল,
খবরদার, বেড়া ডিঙোবে না, সেইভাবেই তোরাও ধোঁয়াদের বলবি, খবরদার।
গাছেরা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আচ্ছা।
ঠিক একমাসের মাথায় বিকটধাম রাজ্যে হাহাকার পড়ে গেল। খেতের পর খেতে
শস্যের মঞ্জরী এল। কিন্তু একছড়া শস্য ফলল না কোথাও। বিকটধামে সেবার বর্ষায় একফোঁটা
বৃষ্টি হল না। নদীনালা, খালবিল সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আর হাওয়ায় জমে রইল ধোঁয়ার
ভারী চাদর। ছেলে-মেয়ে-বুড়োবুড়ি, কাশতে কাশতে সবার প্রাণ বেরিয়ে যায় আর কি!
রাজামশাই, তার পরিবার আর সাঙ্গোপাঙ্গোরাও তার বাইরে নয়।
শুধু কি কাশি? একদিন স্বয়ং রাজামশাইয়ের ভাঁড়ারেও চাল ডাল ফুরোল। তার হাতি ঘোড়া গোরুদের
ঘাস-জল ফুরোল। সহজকথায়, বিকটধামে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল।
প্রজারা রাজবাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলল, রাজামশাই! অনেক হয়েছে।
এবার আপনি বাইরে বেরিয়ে আসুন। খোঁজ নিন কোন পাপে রাজ্যের এই অবস্থা।
রাজা জটিলেশ্বর বুঝলেন অবস্থা বেগতিক। প্রাজাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে
গেছে। তাদের পেটে খাবার নেই। অসুখে প্রাণ যাচ্ছে। এখন এরা মরিয়া। হয়তো আর একদিনের
মধ্যে কোনও উপায় না বার হলে রাজবাড়িই জ্বালিয়ে দেবে ওরা।
রাজামশাই বাইরে বেরিয়ে এলেন।
প্রজাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ মাধব সর্দার এগিয়ে এসে বলল,
ওইদিকে দেখুন মহারাজ। দেখতে পাচ্ছেন, ওই লালটিলার মাথায় মেঘ জমে আছে? মেঘ থেকে
বৃষ্টি ঝরছে। শুনতে পাচ্ছেন পাখির ডাক? তাহলে কাঁটাতারের এদিকে কী হল? আপনি এখনই
যান। কথা বলুন রাজা সরলকুমারের সঙ্গে।
রাজা জটিলেশ্বর একাই রথে চড়ে সরলকুমারের রাজপ্রাসাদে পৌঁছলেন। সঙ্গে
তার না আছে সেপাই-সান্ত্রী, না আছে তুরি-ভেরী। কোত্থেকে থাকবে? না খেতে পেয়ে সকলেই
তো শয্যা নিয়েছে। রাজা জটিলেশ্বর কুন্ঠিত হাতে সিংদরোজার কড়া নাড়লেন। তাকে দেখতে
পেয়ে সরলকুমার নিজেই দৌড়তে দৌড়তে এসে তাকে আদর করে নিয়ে গেলেন রাজসভায়। নিজের
পাশের আসনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বন্ধু?
রাজ্যের অবস্থা খুলে বললেন জটিলেশ্বর। বললেন, লালটিলার দিক থেকে পাখি,
পতঙ্গ, মেঘ, হাওয়া কেউই আর বিকটধামের দিকে যাচ্ছে না। আমরা মরতে বসেছি ভাই। তুমি
কিছু করো।
তখন সরলকুমার আর জটিলেশ্বর দুজনে ছদ্মবেশে পৌঁছলেন বদ্যিবুড়ির কুটিরে।
বদ্যিবুড়ি থমথমে গলায় বলল তার সেদিনের অপমানের কথা। বলার পরে প্রশ্ন
করল, মহারাজ জটিলেশ্বর! কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আপনি বাঁধবেন কাকে? মানুষের মন যে ওই
পাখির মতন। সে মন সীমানা মানে না। মানুষের বিদ্যেবুদ্ধি মেঘের মতন। সে চায় এদেশ
থেকে ওদেশে উড়ে যেতে। একদেশের জ্ঞানের বীজ অন্য দেশে গিয়ে ডালপালা মেলে। আপনি
জানেন না সে কথা? আর মানুষের ভালোবাসা যেন নির্মল হাওয়া। তারও তো দেশকালের ভাগ হয়
না। আপনার বিকটধামের মানুষজন কি মুচকুন্দপুরের মানুষের ভালোবাসা চায় না? জিজ্ঞেস
করে দেখুন তো আপনার প্রজাদের।
বদ্যিবুড়ি বলল, মহারাজ। কাঁটাতারের বেড়া খুলে দিন। বরং এমনভাবেই রাজ্য
চালান যাতে আপনার প্রজারা স্বপ্নেও না দেশত্যাগের কথা ভাবতে পারে। যতক্ষণ ওই
কাঁটাতারের বেড়া থাকবে, ততক্ষণ আমার বন্ধুরা কিছুতেই ওদিকে যাবে না। পাখিরা যাবে
না, প্রজাপতিরা যাবে না। মেঘ বৃষ্টি, বাতাস কেউ যাবে না বিকটধামে।
জটিলেশ্বর মাথা নিচু করে বললেন, আমার চোখ খুলে গেছে বুড়িমা। আমি নিজের
ভুল বুঝতে পেরেছি। আজই আমি সমস্ত বেড়া খুলে দিচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমার
রাজ্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে তুমি দেখবে বেড়া ভাঙার কাজ।
বদ্যিবুড়ির দুই হাত ধরে দুই রাজা যেই না পাহাড়ের চুড়ো টপকে উত্তরে
বিকটধামের মাটিতে পা রাখলেন অমনি তাদের মাথার ওপর দিয়ে জলভরা কালো মেঘ উড়ে গেল
বিকটধামের দিকে। অনেকদিন বাদে ঝমঝম বৃষ্টি নামল বিকটধামে। সেই বৃষ্টি থেমে যখন
আকাশে রামধনু ফুটল তখন পাখি আর প্রজাপতিরা ভিড় জমাল বিকটধামের ফসলের খেতে। হাওয়ায়
তখন আর এক কুচি বিষধোঁয়াও অবশিষ্ট ছিল না।
বদ্যিবুড়ি মুগ্ধ চোখে সেই দৃশ্য দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ তার কানের কাছে
অদৃশ্য হিমপরি ফিসফিস করে বলল, ও ঠাকুমা। বিকেল হয়ে গেল তো। গল্প শোনাবে
না?
বদ্যিবুড়ি চমকে উঠে বলল, তাই তো নাতনি। ভুলেই গেছিলাম। তোরা দাওয়ায়
গিয়ে বোস, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
তারপর দুই মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বদ্যিবুড়ি ঘন-বনে ঢাকা শুঁড়িপথ
বেয়ে তার কুঁড়েঘরের দিকে ফিরে চলল।
_____
ছবিঃ অরিজিত ঘোষ
সৈকত মুখোপাধ্যায়ের লেখায় বরাবর মুগ্ধ হই। কত গভীর সত্যগুলো কত অনায়াস রূপকথার ছলে বলে যান তিনি।
ReplyDeleteগভীর অর্থবহ এক গল্প, সতেজ,সবুজ।
ReplyDeleteKi sundor golpo !Mugdho hotel porlam
ReplyDeleteঅসাধারণ। সহজ কথায়, রূপকথার মোড়কে কত বড় কথা বলে দিলেন ।
ReplyDeleteমুগ্ধ।
ReplyDelete