তত্ত্বতালাশ
প্রতীককুমার মুখার্জী
শীত বিদায় নেবার মুখে।
বেলা আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে, তাও দিনের আলো ফুটতে ছ’টা বেজে যায়। রাতের হিমে ভেজা
ভেজা জি টি রোডের উপর দিয়ে রুটিনমাফিক দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে ভারী থেকে হালকা
নানান যানবাহন। দুর্গাপুরের মুচিপাড়া বাসস্টপে উল্কাগতিতে ধেয়ে এসে সজোরে ব্রেক
কষে দাঁড়াল শিলিগুড়ি আসানসোল রকেট। কয়েকজন যাত্রীর সাথে বাস থেকে নামল দুটি কিশোর, পুরোপুরি বিধ্বস্ত
অবস্থায়। ক্লান্ত, রাতজাগায়
চোখের তলায় কালি, নোংরা
হয়ে যাওয়া জামাকাপড়। এদের চোখেমুখে লেগে আছে ভয় আর বিপদকে পেছনে ফেলে প্রাণ হাতে
নিয়ে ফিরে আসার বিহ্বলতা। একজন ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। মিনিটকয়েক পরে দূর থেকে
লোকাল মিনিবাস আসতে দেখে শুকনো হাসি বিনিময় করে তারা বাসে উঠল। শেষপর্যন্ত তাহলে
বাড়ি ফিরতে পারছে তারা!
খুব জানতে ইচ্ছে করছে না
তোমাদের, কী হয়েছিল এদের সাথে? চল, দুটো দিন পিছিয়ে যাই আমরা।
তোজো আর জোজো হল যাকে বলে
হরিহর আত্মা। নামেও যেমন মেলে, কাজেও একে অপরের প্রতিচ্ছবি। ছোটোবেলা থেকে পরস্পরের সাথে
প্রতিটি কাজের ভাগীদার এই ‘ঘুড়ি-লাটাই’। পাড়ায় তাদের এই নামেই ডাকে সবাই।
ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না একে অপরকে বাঁচাতে, আবার ঝগড়া করার সময়েও ইঞ্চি ইঞ্চি
জমির হিসাব নেয় দু’জনে। বাড়িতেও কেউ কিছু বলে না। কারণ, এরা ডানপিটে আর
গেছো হলেও মনেপ্রাণে ভালোমানুষ। দু’জনেই সেন্ট পলস-এ ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। পড়াশোনায়
আহামরি না হলেও অনেক লড়াই করে দু’জনেই বছর বছর নতুন ক্লাসে উঠে যায় বুক ফুলিয়ে।
আগের বছর ক্লাস টেন পাস করে তাদের হাবভাবই বদলে গেছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, গাম্ভীর্য, মতামত রাতারাতি গজিয়ে
উঠেছে গালে সদ্য গজানো রেশমি পাতলা দাড়িগোঁফের মতো। তোজো অবশ্য বেশি ওস্তাদ ও
চটপটে। যে দুরূহ কাজগুলো সে পারে, জোজো চেষ্টাই করে না। আবার জোজো গম্ভীর ও রাশভারী। সে হল ওদের জুড়ির মগজ।
জোজোর দিদি তিন্নির বিয়ের
কথাবার্তা চলছে অনেকদিন ধরেই। বেশিরভাগ পাত্রই কাছাকাছি দেখা হয়েছে। কিন্তু এবার
একটা দুর্দান্ত সম্বন্ধ এসেছে হাতে। পাত্র সরকারি ডাক্তার। বাড়ি বীরভূম জেলায়। তার হাসপাতাল হল নবগ্রাম
প্রাইমারি হেলথ সেন্টার। দু’পক্ষের মোটামুটি কথাবার্তা হয়েই গেছে। বাকি শুধু একটু খোঁজখবর আর
তত্ত্বতালাশের। কীভাবে জেনে নেওয়া যায় পাত্রের চালচলন, বন্ধুবান্ধব, বাড়ি, পরিবারের খবরাখবর? সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ, অত দূরের ব্যাপার
কী করে সামলানো যায়? এখনকার
মতো তো আর মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট
ছিল না সেই ১৯৯২-এ! তখন মোটেই হাতের মধ্যে ধরা দেয়নি সারা দুনিয়া। তাহলে উপায়?
তোজোদের দেশের বাড়ি
আসানসোল। মাসে দু’বার করে তার বাবা ও মা বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ আর বাড়িভাড়া আনতে
সেখানে যেতেন। তোজোর বাবা চাকরি করতেন দুর্গাপুর প্রোজেক্টস লিমিটেডে। ওনার শিফট
ডিউটি। উনি শিফট অনুযায়ী কাজ সেরে আসানসোল-দুর্গাপুর করতেন। ছেলে বরাবরের ডানপিটে
বলে কড়া শাসনে রাখতেন তাকে। আর তোজো তার দুষ্টুমিগুলো বাবাকে
লুকিয়েই করত। তাই জোজো যখন একঘর লোকের সামনে গম্ভীরভাবে পাত্রের খবর
আনার দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিল, তোজোর মাথাটা ঘুরে গেল। এবার সে কী করে ম্যানেজ
করবে? না বলার তো কোনও প্রশ্নই
নেই। কারণ,
ঘরভরতি লোকের বাধা সত্ত্বেও জোজোর কথার প্রবল সমর্থন করেছিল সে।
জোজোকে একথা বলতেই সে ফিক
করে হেসে বলল,
“কবে যে তোর
বুদ্ধিটা পাকবে রে মর্কট! কাকু যেদিন আসানসোল থেকে ফিরে নাইট শিফট করে বাড়ি আসবে
তার আগেরদিনই যাব আমরা। যাব, খবর নেব আর চলে আসব। কাকু আসার আগেই ঢুকে যাব বাড়ি। আর
তোকেও বলিহারি যাই। এতো
বড়ো হয়েছিস,
বাড়িতে
সত্যি কথাটা বলে যেতে কী হয় রে তোর?”
তোজো মুখটা হাঁড়ি করে বলল, “সবই তুই বুঝলে তো হয়েই
গেছিল রে গিবন! বাবাকে চিনিস না? কক্ষনও যেতে দেবেই না।”
এ কিছু বললে ও ছেড়ে দেবে
নাকি? যেমন জমকালো ঘুড়ি তেমনি জবড়জং লাটাই।
“তাহলে চল, এইভাবেই চল। কী আর বলব, আমাদের তো কাজটা তুলতেই
হবে। চল,
পরশু বেরিয়ে পড়া যাক। কাজটা করতে যখন আমাদেরই হবে, দেরি করে লাভ কী? প্লাস, কাকুও কাল বিকেলে
ইভনিং শিফট সেরে আসানসোল চলে যাবে তো!”
মুখ চুন করে নিজের ঘরে
ফিরে জরুরি প্রস্তুতিপর্ব সারতে লাগল তোজো। টাকাপয়সা, ছাতা, ওয়াকম্যান, মানিব্যাগ, সুইস নাইফ, ইত্যাদি জড়ো করে ফেলল
খাটের উপর। হাবভাবটা এমন, যেন এভারেস্ট চলল ছেলে! স্বগতোক্তি করল, “কিছু ড্রাই ফুড নিলেই
প্যাকিং কমপ্লিট।”
অতএব তার পরের পরদিন ভোরবেলা
মানিকজোড়কে দেখা গেল মুচিপাড়া স্টপেজে বাসের অপেক্ষায়। ছ’টার শিলিগুড়ি রকেট এলে দু’জনে
গিয়ে এক্কেবারে শেষ সীটে গিয়ে বসে পড়ল। জোজোর কোনও টেনশন নেই। সে তো দিব্বি বাড়িতে বলে যাচ্ছে। তোজো বেচারাই হাতের
নখগুলো খেতে খেতে চলল। অবশ্য মেরেকেটে আধঘণ্টা। তারপরই এই গোপন অভিযান
নিয়ে রোমাঞ্চে ডুব দিল দুই বন্ধু। বিস্কুট আর সেউভাজা খেতে খেতে ইলামবাজারের
রাস্তায় পড়ল বাস। আয়েশি জোজো খেয়েদেয়ে ইতিমধ্যেই নাক ডাকছে। তোজো অগত্যা জানলার বাইরে
মন রাখল। এর মাঝে পেছনের পকেট থেকে পাক্কা বড়োদের মতো মানিব্যাগ বার করে একশো কুড়ি
টাকার টিকিট কেটে নিয়েছে তোজো। দুটো রামপুরহাট স্ট্যান্ড। হঠাৎ
বাসের ভেতরে তাকাতেই চমকে গেল সে। সামনেকার উল্টোদিকের সীট থেকে
ময়লা জামাকাপড় পরা লোকটা কাঁচাপাকা দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে তার দিকে অপলকভাবে
তাকিয়ে! চাউনিটা দেখেই ওর গা শিরশির করে উঠল। ছটফট করে উঠে তড়িঘড়ি জোজোকে ডাকতে
যাওয়ার উপক্রম করতেই লোকটা বিনয়ের অবতার হয়ে গদগদ হয়ে বলে উঠল, “দাদাবাবুর কাছে অনেক
রেজগি আছে দেখলুম। আমারে
একখান বড়ো নোট ভাঙিয়ে দেবেন গো?”
ভীষণ লজ্জায় পড়তে হত জোজো
জাগলে, এই ভাবতে ভাবতে লোকটাকে
টাকাটা ভাঙিয়ে দিল তোজো। নিজেকে নিজেই এত হঠকারী হবার জন্য খুব কথা শোনাল। পথে
কেটে গেল অনেকটা সময়। বাইরে তাকিয়ে, মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে আর খারাপ রাস্তার ঝাঁকুনিতে। রকেট এদিকে
ধুন্ধুমার গতিতে চলতে চলতে শিউড়ির কাছাকাছি। জোজো আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল এতক্ষণে।
“কোথায় এল রে?”
ঠিক দশ মিনিটের ভেতর
তাদের বাস শিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে ঢুকে গেল। ড্রাইভার বাস থেকে নেমে যেতে কন্ডাক্টর
গলা চড়িয়ে জানিয়ে দিলেন যে বাস এখানে পনেরো মিনিট থামবে। কেউ খাওয়াদাওয়া করতে চাইলে সেরে
নিতে পারে। দু’জনে মিলে নেমে দত্ত ক্যাফেতে গরম গরম ছাতুর কচুরি আর হিং দেওয়া ঘন
ডাল খেয়ে নিল পেট ভরে। তারপর গরম গরম জিলিপি নিয়ে বাসে চাপতে কিছুক্ষণ পরেই আবার
যাত্রা শুরু হল। ঠিক সাড়ে এগারোটায় ওরা রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ল।
এরা দুর্গাপুরের স্মার্ট
ছেলে। অনেক
জায়গায় ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস থাকলেও এদিকে কখনোই আসেনি আগে। তাই রামপুরহাটে নেমে
কয়েকজনকে জিগ্যেস করে রিকশা করে কিছুদূর গিয়ে লোকাল বাস ধরল। বাস ধরল মানে বাসের
ছাদে চেপে বসতে বাধ্য হল। সেই বাসে এতটাই ভিড় যে ভেতরে তিলধারণের জায়গা নেই। আর তাদের অবাক করে দিয়ে ছাদে ঝুড়ি, মুরগি, সাইকেল আরও কত কী বোঝাই হতে
থাকল। মানিকজোড় চিন্তিত মুখে ভাবছে এই বাস এই অবস্থায় কী করে এগোবে। ঠিক তখনই জোজোর চুলে হ্যাঁচকা
টান! তোজো সাথে সাথেই মারমুখী, “অদ্ভুত ব্যাপার তো! ছাগল নিয়ে বাসের মাথায় তুলেছে? নেমে আয় জোজো, অন্য বাসে যাব।”
জোজো প্রথমে মাথায় হাত
বুলিয়ে পেছনে তাকিয়েই দেখে এক দাড়িওয়ালা ছাগল ঠিক তার মাথার পেছনেই জাবর কাটছে। সে আর আলাদা করে তার মুখে ওর কিছু
ছেঁড়া চুল আবিষ্কার করতে পারল না। তার মাথা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা। তাই সে মাথা চুলকোতে চুলকোতে
তোজোকে বলল,
“উপায় নেই
পার্টনার। উঠে
এস, এখানে এইসব বাস ছাড়া আর
কিছু চলে না। আর
নবগ্রাম বাসে এখান থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। এভাবেই যেতে হবে। আর আমি তো তোমার মতো কাঠবিড়ালি নই
যে হইহই করে বাসটপ টু রোডটপ করব!”
রাগ থমথমে মুখে তরতর করে
জায়গায় ফিরে এল তোজো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “সে আমি জানি ভাই গজকচ্ছপ। আমি আমার জন্য বলিনি রে
ব্যাটা।”
বাস চলতে শুরু করল। অবিকল
উট যেভাবে চলে,
আর তার পিঠের
সওয়ারদের যেরকম অবস্থা হয়, তার তিরিশগুণ আন্দোলিত হতে হতে তারা এগিয়ে চলল নবগ্রামের
দিকে। নাড়িভুঁড়ি যেন কচুরি, ডাল ও জিলিপির প্যাঁচে পড়ে এই আজবদেশি রোলার কোস্টারে মুচড়ে
মুচড়ে উঠতে লাগল। প্রায় একঘন্টা পরে দুই ধুলোমাখা কুস্তিগির অনেক কসরত করে নামতে
পারল নবগ্রাম প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের গেটে। সময় তখন পৌনে একটা।
ভদ্রস্থ হয়ে অফিসে ঢুকে
ডঃ প্রবীর সেনের নাম জিগ্যেস করতে অফিসের ভদ্রলোক প্রথমে তাচ্ছিল্য, তারপর মনোযোগ, আর শেষমেষ সমবেদনা ও
করুণা সহকারে যা জানালেন, তাতে ওদের প্রায় ডাক ছেড়ে মাটিতে বসে কান্নাকাটি করার
অবস্থা হল। ওই নামে ওই হাসপাতালে কোনওকালে কেউ কখনও কাজ করেনি। এই প্রথম রাশভারী জোজোর
মুখের অবস্থাও যথেষ্ট করুণ দেখাল। হাজার হলেও দিদির বিয়ে বলে কথা!
অফিসের ভদ্রলোক ভারি ভালো। উনি এই দুটি হতোদ্যম ছেলেদুটিকে
রাস্তা অবধি এগিয়ে দিতে এলেন আর দিলেন খানিক আশা, “ভাই, হাল ছেড়ো না তোমরা। হয়তো কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে। এখান থেকে মাইল বিশেক দূরে আরেকটা
নবগ্রাম আছে কিন্তু। সেখানকার হাসপাতালে একবার দেখতে পার। আহা, কত ছোটো ছেলে এরা, দিদির জন্য পাত্র দেখতে
বেরিয়েছে!”
তোজোর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে
গেল। সে তো বরাবরের মরিয়া লোক। হতবাক জোজোর দিকে তাকিয়ে বলল, “কুছ পরোয়া নেই পার্টনার, আমরা শেষ দেখেই ছাড়ব। আমাদের দিদির বিয়ে যখন, এত সহজে হার মানতে রাজি
নই কাকু। আপনি যদি আমাদের বলে দ্যান ওই নবগ্রামে কীভাবে যাব তাহলে আমাদের সত্যি
ভীষণ উপকার হয়।”
ভদ্রলোক কিছু চিন্তা করে
বললেন, “তোমরা একটু অপেক্ষা কর। আমি অফিস থেকে দেখি যদি কাউকে
তোমাদের সাথে পাঠানো যায়।”
ভদ্রলোকের প্রতি সম্মানে
দু’জনের মাথা নুয়ে এল। তোজো বেশি আবেগপ্রবণ। তাই সে বলেই ফেলল, “দুনিয়ায় ভালো মানুষ এখনও
আছে রে ভাই। চল,
এবার দেখা যাক আমাদের দিদির জন্য সেই সেনমশাইয়ের দেখা পাই কি না।”
দশ মিনিট পরেই উনি ফিরে এলেন
পেছনে এক তরুণকে নিয়ে।
“এ হল ভুবন। ওকে সব শেখানো আছে, আর এর বাড়ি ওদিকেই।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড় তোমরা। প্রায় আড়াইটে বাজতে যায়। বেশি দেরি করলে ওখানে গিয়ে কাউকে
পাবে না। অফিস
বন্ধ হয়ে যাবে।”
বিদায় নেবার সময় ওরা
ওনাকে প্রণাম করতে যেতে উনি আবার বললেন, “প্রণাম করার কিছু নেই। আর আমার সাথে তোমাদের অনেকদিনের
আলাপ নয়। হয়তো দেখবে দিনের শেষে মনে হতে পারে, এই লোকটাকে বিশ্বাস করেছিলাম! যাক, যাও। কিন্তু তোমরা তো কিছুই
খেলে না!”
জোজোরা বলল, “না কাকু, আগে কাজটা সেরে ফেলি। এখন তাহলে আসি? চলুন ভুবনদা।”
মানিকজোড়কে নিয়ে বড়ো রাস্তায়
উঠল ভুবনদা। জোজোর কেন জানি না মনে কেমন একটা খটকা লাগছিল পুরো ব্যাপারটায়।
প্রবীরবাবু এত বড়ো মিথ্যা কথা বলবেন? যাক, এখন তো আর কিছু করার নেই। বাস আসতে এবার তারা ভেতরে চাপতে
পারল, আর আরও অচেনা গন্তব্যের
দিকে এগোতে থাকল। কুড়ি মাইল তো, বড়োজোর মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগতে পারে। সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। ক্ষিধে, তেষ্টা, পরিশ্রম, হতাশা আর উৎকণ্ঠা এবার
থাবা বসাতে শুরু করেছে তাদের উপর।
একঘন্টা হয়ে গেল। বাস গদাইলস্করি চালে চলেছে তো
চলেছেই। একাধিকবার ভুবনদা আর কন্ডাক্টরকে জিগ্যেস করে একই উত্তর পাওয়া গেছে, “এই তো, আর দশ মিনিট পরেই নবগ্রাম।”
বাস প্রায় খালি হয়ে এসেছে। গুনে আট-নয়জন লোক আছে বাসে। এই প্রথমবার ওদের ভয় লাগতে শুরু
করল। ঠিক বিকেল চারটে দশে ওরা নবগ্রামে বাস থেকে নামতেই জোজো
কুলকুল করে ঘেমে উঠল। তোজোর জামাটা টেনে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমরা বীরভূম থেকে সোজা
মুর্শিদাবাদে চলে এসেছি রে!”
তোজো ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে
তাকিয়ে সাইনবোর্ড দেখে জোজোর দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। কোথায় এসে পড়ল তারা! আর ঠিক সেইসময়
ভুবনদা এগিয়ে এসে বলল, “ওই
যে ডানদিকে দেখা যাচ্ছে নবগ্রাম হাসপাতাল, চলেন।”
অফিসে ঢুকে ডঃ সেনের কথা
বলতে প্রায় তেড়ে এলেন বয়স্ক ভদ্রলোক, “কি ব্যাপার কী? এই কে আছিস, পুলিশ ডাক তো! যখন তখন যেখান সেখান থেকে উটকো
লোকজন আসে?
বল কোথা
থেকে এসেছিস তোরা? জানি
জানি, সব হয় চোরডাকাত নয়
মেয়েপাচারকারী বা বাংলাদেশের চর। বেরো আমার অফিস থেকে তোরা!”
এই অবধি শুনে শেষে মাথা
গরম হল জোজোর। একে দিদির ভাগ্য নিয়ে এ জাতীয় প্রহসন চলছে, বুঝতে পারছে ওরা ভালোমতো যে এক
পাকা ঠগের পাল্লায় পড়েছে তাদের পরিবার। আরও বুঝতে পারছে আজ বাড়ি ফিরতে পারবে না
কোনওমতেই। অচেনা
জায়গা আর মানুষজন, কোনও
খারাপ লোকের খপ্পরে না পড়ে যায় তারা! ও ভদ্রলোককে শুধু বলতে পারল, “আপনি এভাবে আমাদের সাথে
কথা বলতে পারেন না। আমি আপনার নামে রিপোর্ট করব।”
আগুনে যেন ঘি পড়ল এবার।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে আস্তিন গোটাতে গোটাতে গালাগাল দিতে লাগল আর লোকজন ডাকতে লাগল।
“তোরা জানিস না কার সাথে
কথা বলছিস। জবাই
করে রেখে দেব এখানে, কেউ
টের পাবে না। আমার নামটা শুনে রাখ। আমি নবগ্রামের শেখ ঈদ্রিশ আলি।”
কথা শেষ হবার আগেই জোজোরা
আর একটা সেকেন্ড নষ্ট না করে প্রাণভয়ে পিছু হটতে হটতে একছুটে অফিসের বাইরে। ছোটো
থেকে তাদের ভেতর এইটুকু বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেছে। জানে তারা কখন আক্রমণ আর কখন
পালাতে হয় প্রাণ বাঁচিয়ে। কিন্তু পেছনে কারা যেন তাড়া করেছে ওদের! ভুবনদাকে আর
দেখতে পেল না ওরা কোথাও।
হাঁপাতে হাঁপাতে এমন একটা
রাস্তায় এল ওরা যেখানে কিছু আলো টিমটিম করে জ্বলছে, আর কিছু লোকের ভিড়। গঞ্জের হাট বসেছে। সন্ধে হয়ে আসছে, আর তার সাথে বিপদ ঘনিয়ে।
দূর থেকে একটা আবছা ‘চোর! চোর! পালাল!’ আওয়াজ ওদের কানে ঢুকতেই জোজো দম চেপে বলল
তোজোকে, “গ্রামের চোর ধরতে পারলে
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেপারে খবর বেরোয় গণধোলাইয়ের। আর এখানে আমরা ছাড়া আর
কোনও লোভনীয় টার্গেট নেই রে বাবু!”
তোজো একেই ঘটনাপ্রবাহ
দেখে চুপ করে গেছিল। এবার শুধু দমবন্ধ করে উল্টোদিকে আঙুল তুলে দেখাল। বড়ো কিছু একটা হেডলাইট
জ্বেলে এগিয়ে আসছে রাস্তা দিয়ে। তোজো ইশারা করে বলল, “এটা ধরতেই হবে আমাদের। নইলে হয় গণধোলাই বা জবাই।”
প্রায় খালি একটা হলদেটে
বাস ওটা। সামনে
লেখা ‘রামপুরহাট-কান্দি’। বাছাবাছির ব্যাপার ছিল না। হাটের জায়গাটায় একটু গতি কমাতেই ছিলে
ছেঁড়া ধনুকের ক্ষিপ্রতায় ছিটকে উঠল পেছনের বাম্পারে তোজো। আর জোজোও হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে
ওঠার চেষ্টা করতে করতে তোজোর একটা হাত ওকে টেনে তুলে ফেলল বাম্পারে। ভাগ্যিস বাসটা
লোকাল রুটের বাস ছিল না। নইলে স্টপেজে একবার দাঁড়ালে পেছনের লোকগুলো ওদের সহজে ছাড়ত
না। বাম্পারে চড়তে তোজোর কোনও অসুবিধে ছিল না। জোজো এভাবে বাম্পারে চাপার কথা
ভাবতেই পারে না। সে
বাসের পেছনের শিকগুলো জাপটে ধরে ভয়ে কাঁপছিল। তোজো যখন টের পেল জোজো কাঁদছে, তখন সে নিঃশব্দে তার একটা
হাত দিয়ে বেড় দিয়ে তার প্রাণের বন্ধুকে জড়িয়ে থাকল। ঘড়িতে তখন ঠিক সওয়া পাঁচটা।
দিনের আলো মরে আসছে।
এবার ঠিক আধঘণ্টা লাগল
কান্দি আসতে। নেমে পড়ল ওরা সবার অজান্তেই। বাসওয়ালা জানতেই পারল না সে দুই
কিশোরকে কীভাবে প্রাণে বাঁচাল। কান্দি যে বিশাল বড়ো জায়গা তা
মোটেই না। তবে
তাদের চেহারার কেউ যে সেখানে থাকে না। তা বুঝেই যেন দু-তিনজন তাদের দিকে
এগিয়ে এসে প্রশ্ন করতে শুরু করল, “কে বাপ তুমরা? কোথা বাসা? কুন বাড়ি যাবেক?”
এদের প্রায় ঘিরে ধরল চার-পাঁচজন
মিলে। চোখাচোখি করে নিয়ে তোজো যখন পুরো ঘটনা এদের জানাল, সবাই ওদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে
চাইল। বলল, “আহা, বাপজানদের উপর কতক না ঝড় গেছে!”
হঠাৎ খেয়াল করল জোজো, টানাটানিতে তার হাতঘড়িটা
আর তার হাতে নেই। আর
লোকগুলোর হাবভাব যেন বড়োই অস্বাভাবিক ধরনের ভালো। ভীষণ সন্দেহজনক ব্যাপার। আসলে কী চায় এরা? ও সাথে সাথেই বলল, “আচ্ছা, এখানে রাতে থাকার কোনও
হোটেল নেই?
আমরা রাতে
থেকে কাল সকালে বাড়ি ফিরতাম।”
এই শুনে লোকগুলো নিজেদের
ভেতর গুজগুজ ফিসফাস শুরু করতেই তোজো আবছা শুনতে পেল, “টাউনের মাল বটে। রাস্তা গুলিয়ে এসে পড়েছে। ঘড়িটা টেনেছি, মালকড়ি আছে, ওদের ছাড়া যাবেক নাই।”
ঠান্ডা মাথায় তোজো বলল, “ঠিক আছে, আপনাদের বাসায় আমরা থাকব। কিন্তু এখন একটা বাথরুম বলুন তো
কোথায়?”
এক লুঙি পরা ছোকরা তাদের
নিয়ে গেল গলিতে। অন্যরা
তখন আলোচনারত। সম্ভবত
এদের কী করা হবে সেই নিয়ে। একটা সরু খুপরিতে টিনের দরজা দেখিয়ে দিল ছেলেটা। ওরা দু’জনে ভেতরে ঢুকে এক
সেকেন্ডে প্ল্যান বানিয়েই উল্টোদিকের পাঁচিল টপকাল।
ছুটতে ছুটতে আবার সেই বড়ো
রাস্তা। আর
ভাগ্য ছিল সহায়। কারণ,
কানে তালা ধরানো আওয়াজ করে বিশাল একটা সাদা বাস ঢুকল কান্দি চৌমাথায়। খালাসি বাস
বাজিয়ে হাঁকছে হাকছে, “সাঁইথিয়া
যাবার লাস্ট বাস,
সাঁইথিয়া, সাঁইথিয়া...”
সেই লোকগুলো কোথায় ছিল
জানা নেই। তাই
যতদূর পারা যায় গুঁড়ি মেরে আধা হেঁটে, আধা ছুটে ওরা বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে
দিতে তোজোর মাথার পোকাটা অনেকক্ষণ পরে আবার নড়ে উঠল। জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে
লোকগুলোকে ঠাহর করার চেষ্টা করতেই সে ওদের দলটা দেখতে পেল।
“ও চাচা, আমরা গেলাম। তোমরা বাড়ি গিয়ে আঁটি চোষো এবার।”
লোকগুলো বোঝার আগেই ওদের
পাশ দিয়ে বিশাল এক্সপ্রেস বাসটা ধুলো উড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সীটের মধ্যে গা
এলিয়ে দিয়ে তোজো ফিক করে হেসে বলল, “অবশেষে ব্যাক টু গুড ওল্ড বীরভূম!”
জোজো তার সুরে সুর মেলাল, “একটা সময়ে ভেবেছিলাম ঘরে
বোধহয় আর ফেরা হল না রে বাবু! জোর বেঁচে গেছি রে আজ। কিন্তু বাড়িতে একটা খবর
তো দিতে হত। আজ কীভাবে ফিরব আমরা? তোর ঘড়িতে ক’টা বাজে রে?”
“সওয়া সাতটা বেজে গেছে? বাপ রে! কেন রে ব্যাটা, তোর ঘড়ি কী হল?” এতক্ষণে তোজো লক্ষ করল
জোজোর হাতে ঘড়ি নেই। সব বলতেই তোজোর মুখে কুলুপ আবার।
জোজো অভয় দিল, “ঘাবড়াস না রে, এবার আমরা ঠিক কাল সকালে
বাড়ি চলে যেতে পারব।”
তোজো তার মুখে এক অদ্ভুত
ভঙ্গি করে বলল,
“নাইট শিফট
করে বাবা বাড়ি কখন ঢোকে ভুলিসনি বোধহয়? ভোর সাড়ে ছ’টা! আমার এবার কী হবে?”
কিছুক্ষণ থেমে বলল, “বেশ হয়েছে। যা হবার হবে, যেমন মিথ্যে বলে
বেরিয়েছি।”
লাস্ট বাস দারুণ সার্ভিস
দিল। ঠিক
রাত আটটা পঁচিশে সাঁইথিয়া বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল। বাস থেকে নেমেই ওরা
এসটিডির দোকান খুঁজে বার করল। তোজোর ব্যাগ থেকে একটা ছোট ডায়েরি
পাওয়া গেছে। সেখানে
দুর্গাপুরের বাজারের মুদির দোকানের নম্বর লেখা আছে। আসলে ওদের কারও বাড়িতেই
টেলিফোন না থাকায় দরকারে অদরকারে এই রামকাকার দোকানেই খবরাখবর আদানপ্রদান করা হয়।
বুড়ো রামকাকাকে অত কথা বলাও যেত না, আর উনি বুঝতেনও না। তাই জোজো শুধু বলল, “রামকাকু, আমি মজুমদারবাবুর ছেলে
বলছি শিউড়ি থেকে। একটু
বাড়িতে খবর দিয়ে দেবেন যে আমরা ভালো আছি, সুস্থ আছি আর কাল সকালেই বাড়ি ফিরছি। ওরা যেন চিন্তা না
করে। না না,
আপনাকে এখান
থেকে এর চেয়ে বেশি বলতে পারব না কাকু। কাল সকালে গিয়ে সব বলব। শুধু খবরটা একটু দিয়ে
দেবেন। নইলে
ওরা ভীষণ চিন্তা করবে। ঠিক আছে কাকু? ছাড়ি তাহলে?”
ফোন ছেড়ে টাকা মিটিয়ে
বেরিয়ে এসে জোজো বলল, “একটা
দিকে শান্তি হল। চল, এবার কিছু তো খাওয়া যাক। আর পারছি না রে! খবর পেলাম, রাত
সাড়ে ন’টায় লাস্ট বাস আছে শিউড়ি যাবার। তাই ফোনে সাঁইথিয়া না বলে শিউড়ি বললাম।”
একটা দোকানে পরোটা আলুর
দম খেল দু’জনে মিলে গোগ্রাসে, সেই সকালের পর থেকে। তোজো বলল, “ভালো করে খেয়ে নে। কারণ, আজ রাতে আর কিছু জুটবে কি না
জানা নেই। খেয়ে নিয়ে বাসে চেপে শিউড়ি তো যাই, তারপর দেখা যাবে।”
ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে
নিয়ে তারা একটু হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁটা দিল সাঁইথিয়া বাসস্ট্যান্ডের ভেতর। ঠিক
তখনই ওদের পাগুলো মাটিতে আটকে গেল, আর গা গুলিয়ে উঠল বিস্ময় আর ভয়ে। যাকে আর কখনও দেখতে পাবে
বলে চিন্তাও করেনি সেই লোকটা বিচ্ছিরি একটা হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে!
ভুবন বলল, “বাছাধনেরা যেন জিওলমাছ!
পিছু নিতে নিতে হাড়মাস কালি হয়ে গেল! দাও বাপু, মালকড়ি বার করে হ্যান্ডওভার কর
দেখি। রায়বাবু
বলে দিয়েছে, যা পাবি মুড়িয়ে নিয়ে আসবি। আর দরকার হলে হালকা করে ক্ষুরটা চালাতেও
পারিস। হে হে, আমার
আবার ক্ষুরের হাতটা বড়োই সরেস কিনা!”
আর কিছু করার ছিল না ওদের। শরীরে শক্তি, ইচ্ছে আর পালাবার মনোভাব
কোনোটাই নেই। কোনোমতে বাড়ি ফিরতে চাইছিল দুটি বেহাল আর পরিশ্রান্ত
কিশোর। পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করল তারা। সারাদিন ধরে শুধু মানুষের লোভ, প্রতারণা, লালসা আর খারাপ ব্যবহারে
জর্জরিত তারা। তোজো বলল, “ভুবনদা, তোমায় আমরা দাদা বলেছি। আমরা চোরডাকাত নই গো। দিদির পাত্র দেখতে বাইরে বেরিয়ে
রাস্তা ভুল করেছিলাম, এই আমাদের অপরাধ। তোমার বাড়িতেও আমাদের মতো ছোটোভাই আছে দাদা। কী পাবে আমাদের মেরে, বল? আমাদের কাছে যা আছে নিয়ে
নাও, আমাদের যেতে দাও।”
এই বলে ভুবনকে অবাক করে
দিয়ে তোজো পুরো ব্যাগটাই ওর হাতে ছুঁড়ে দিল। ভুবন জোরে হেসে উঠল। আর হাসির দমকে দমকে বেহাল হয়ে
ব্যাগসুদ্ধু মাটিতে বসেই পড়ল একেবারে। দম আটকে যাচ্ছে তার, “নাও নাও ভাই, মাফ কর আমায়। তোমাদের ব্যাগ তোমরাই সামলাও। আমি একেবারেই নাটক করতে পারি না
যে!”
জোজো আর তোজোর মুখের
অবস্থা হল দেখার মতো। ওরা যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কী হচ্ছে আর কেন হচ্ছে।
জোজো শুধু আমতা আমতা করে চারটে শব্দ উচ্চারণ করতে পারল, “তুমি এখানে কী করে?”
ভুবন উঠে এসে ব্যাগটা
ফেরত দিয়ে দু’জনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “চল, এখানে আর নয়, স্ট্যান্ডে চল। তোমাদের বীরভূমের বাস
একটু পরেই ছাড়বে। এই বাসটা নিশ্চয়ই তোমরা মিস করতে চাইবে না? যেতে যেতে যতটা পারি
বলছি। বাস দিয়ে দিয়েছে স্ট্যান্ডে।
“নবগ্রামের রায়বাবুকে
দেবতার চোখে দেখি। এত ভালো মানুষ দেখা যায় না। ওনার দুই সন্তানই এক মর্মান্তিক
দুর্ঘটনায় ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। সাথে ওনার স্ত্রীও। উনিও বহুদিন হাসপাতালে থেকে
সুস্থ হয়েছেন। সৎ, পরিশ্রমী ও স্পষ্টবক্তা লোকটা অনেক জায়গা থেকে বদলি হয়ে
আমাদের নবগ্রামে এসেছেন। যাক, অত কথা বলার সময় নেই। আজ উনি আমায় হাতে টাকা দিয়ে বলে
দিয়েছিলেন,
ছেলেদুটো
যেন ভালোভাবে বাড়ি ফিরতে পারে সেটা তোর দায়িত্ব। সেই থেকে তোমাদের পেছনে ধাওয়া
করছি। কীভাবে করছি জানতে চেয়ো না, তাতে সকাল হয়ে যাবে। তবে বাসের বাম্পারে ঝুলে অতটা
রাস্তা তোমরা এলে কীভাবে? আমি একটা সবজির টেম্পো ধরে কোনোমতে তোমাদের কান্দিতে এসে
পেলাম। আর শেষের এই জঘন্য নাটকটার জন্য তোমাদের ভুবনদাকে মাফ কর। আসলে তো কখনও
ভিলেন হতে পারব না, তাই
এই অবস্থাতেই একবার ঝালিয়ে নিলাম। এই নাও, এই কাগজটা রাখ। এতে শ্রী পুরন্দর রায়ের বাড়ি ও
অফিসের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর আছে। আর এই টাকাটা রাখ, দাদা দিচ্ছে ভাইদের।”
বাসের জানলায় বসে ক্রমাগত
ছোটো হয়ে যাওয়া ভুবনদার দিকে জলভরা চোখে হাত নাড়াতে নাড়াতে ধরা গলায় চিৎকার করে
উঠল ঘুড়ি-লাটাই,
“দিদির বিয়ে
যেখানেই হোক,
তোমাদের আসা
চাই-ই-ই!”
চোখের সামনে থেকে ভুবনদার
শরীরটা মিলিয়ে যেতে তোজো আর জোজো খোলাখুলি কেঁদে ফেলল একে অপরকে না লুকিয়ে। বাস
ছুটে চলেছে রাতের অন্ধকারে আর দু’জনে নির্বাক হয়ে শুধু সারাদিনের ঘটনাবলি ভেবে
চলেছে। কিছু ঘন্টার ভেতরে তাদের বয়স যেন এক লাফে তরতরিয়ে বেড়ে গেল অনেকটা। রাত দশটা পঞ্চাশে বাস
ঢুকল সেই শিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে। এসব জায়গায় রাত এগারোটা মানে বেশ রাত। চারদিকে
দোকানপাট বন্ধ। এদিক
ওদিক কয়েকটা বাস দাঁড়িয়ে আছে অন্য রুটের। ওরা ছুটে গেল এনকোয়ারিতে। একজন সেখানে মাথায় মাফলার জড়িয়ে
ঘুমোচ্ছিল। অনেক ডাকাডাকিতে উনি ঘুম জড়ানো গলায় জানালেন, “দুর্গাপুরের বাস রাত
আড়াইটায় আসবে। শিলিগুড়ি রকেট।”
বলে আবার পাশ ফিরে শুলেন।
ওরা আর কী করে! ঘুরে ঘুরে খাবার দোকান খুঁজতে লাগল। ভাগ্য খারাপ, সব দোকানই বন্ধ। যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখনি একটা বড়ো দোকান দেখে জোরকদমে
এগোলো তারা।
“আরে, এ যে সেই দত্ত ক্যাফে!
আরে, সকালে তো এখানেই
খেয়েছিলাম! ও দাদা, ভাত
বা রুটি পাওয়া যাবে তো? মাছভাত, ডিমভাত যা হোক দু’জায়গায় দিন তো।” বলে দু’জনে হাত ধোয়ার
জল দেখতে পেছন ফিরতেই পিলে চমকানো ঘড়ঘড় শব্দে দোকানের শাটার নামিয়ে দিল একজন।
“দোকান বন্ধ, খাবার নেই।”
এরা এতটাই শক পেয়েছে
সারাদিন,
যে এই
সামান্য ব্যাপারটা আর আলাদা করে তাদের অবাক করে না। হাতে সময় অনেক। এক ঘুমন্ত কলাওয়ালাকে উঠিয়ে এক ডজন
কলা কিনে নরম,
কালো, মজে যাওয়া কোনোকিছুর
বিচার না করেই গবগবিয়ে খেয়ে ফেলল মানিকজোড়। তারপর দু’তিনটে কুকুরের তাড়া খেয়ে
স্ট্যান্ডের গেটে সিকিউরিটির গোল ছোটো খুপরি ঘরে ঢুকে পড়ল দু’জনে। জোজো তো সটান ওই
ঝুলকালি আর মশার ভেতরেই শুয়ে পড়ল। আর তোজো তার ওয়াকম্যানটা বার করল,
দিনে প্রথমবার।
ঘুমিয়েই পড়েছিল তোজো। কিন্তু রকেট বাসের হৃদকম্প ধরানো
হর্নের আওয়াজে ছিটকে উঠে বসল সে। জোজো নির্বিকার নাক ডাকছে ওই ডাকসাইটে মশার
আক্রমণ অগ্রাহ্য করে। যাক, আর কোনও অনিষ্ট হল না। বাসে চাপল ওরা। আর সেখানেও দেখ ভাগ্য, একটিমাত্র সীট খালি।
জোজোকে সেখানে বসিয়ে নিজে দু’হাতে বাসের রড ধরে অন্ধকার রকেট বাসের দুর্দান্ত গতির
সাথে টাল সামলাতে সামলাতে ঢুলতে লাগল ‘একা কুম্ভ’ হয়ে।
কেউ তার হাত ধরে টেনে ধরে
একটা খালি সীটে বসিয়ে দিতেই ওর সম্বিত ফিরল। বাস পানাগড় ঢুকছে, আর তার ঘড়িতে বাজছে পৌনে
ছ’টা! যদি বাবা ফেরার আগে একবার বাড়ি ঢুকে যেতে পারে ও, কী নিখুঁত অপারেশন যে হবে!
বাস যা ছুটছে তাতে মুচিপাড়া ছ’টার ভেতর ঢুকবেই।
এরপর কী হয়েছিল তা তো
গল্পের শুরুতেই জানা গেছে। যেটা জানা নেই সেগুলো হল, তোজোরা বাড়ি ঢোকার পাঁচ মিনিট
পরেই তার বাবা ফিরে এসেছিলেন। সে দরজা খুলে দিতে উনি বললেন, “ঠিক আছে, তুই যা ঘুমো। আমি বন্ধ করে দিচ্ছি দরজা। ঠিক সাড়ে সাতটায় উঠে পড়তে বসে
যাস।”
লক্ষ্মীছেলের মতো মাথা
নেড়ে ছেলে শুয়ে পড়েছিল। বেচারা বাবা ভদ্রলোক জানতেও পারলেন না তার পুত্র কীভাবে
প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে এসেছে।
আরেকটা কথা। যদিও এই গল্পের অংশ নয়, তাও না বললে অপরাধ হবে।
ঠিক একবছরের মাথায় তিন্নির বিয়ে হয়ে গেছিল ভীষণ ভালো বাড়িতে। এক তরুণ প্রোফেসরের সাথে। বিয়ে
ঠিক হতেই তোজোর বাবাকে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে দেন জোজোর বাবা এবং অদ্ভুত ব্যাপার, উনি কিছুক্ষণ গুম হয়ে
থাকলেন, কিন্তু আর কিছু বলেননি
তোজোকে আজ অবধি ওই ব্যাপারে।
ওদের পুরন্দরকাকু
এসেছিলেন সেই বিয়েতে এবং খুব ভালো করে ওদের ভাইবোনদের আশীর্বাদ করে গেছিলেন।
ভুবনদা আসতে পারেনি। যখন তার না আসার কারণ জেনেছিল কাকুর কাছ থেকে, তোজো আর জোজোর মন বিষাদে
ভরে গেছিল। বলতে গেলে দিদির বিয়ের আনন্দটাই চলে গেছিল। তিনমাস আগে স্কুটার
দুর্ঘটনায় ভুবনদা সবার নাগালের বাইরে চলে গেছে। আর কখনও সে প্রাণ হাতে নিয়ে কাউকে
ফলো করে ঘরে ফেরাবে না।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment