হিরণগাঁওয়ের স্মৃতি
সুদীপ চ্যাটার্জী
আমি কোনওদিন কোনও ভৌতিক
ঘটনার সাক্ষী হইনি। আজগুবি কোনওকিছুই দেখা হয়নি জীবনে। কিন্তু তাও কয়েকটা ঘটনা
ঘটেছে যা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তখন ২০০৯ সাল। জানুয়ারি মাস। লখনউ শহরে
হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। লোকেরা বলাবলি করছে, এমন শীত গত কুড়ি বছরে পড়েনি। বিকেল
নামলেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাঠখড় জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়। কাজকর্ম তো আর বন্ধ
থাকতে পারে না শীত পড়েছে বলে। তাই যেসব মানুষদের রাস্তায় থাকতে হয়, তারা মাঝে মাঝে এসে এই
‘আলাও’গুলোয় হাত-পা গরম করে নেয়। কখনও কখনও রাস্তার গরু কুকুরও এসে দাঁড়ায় আগুনের
কাছে। কেউ তাড়িয়ে দেয় না। শীতের হিমেল হাওয়ায় মানুষ আর পশুদের মধ্যে একটা সম্পর্ক
গড়ে উঠেছে।
এর মাঝে হঠাৎ করে আমি ঠিক
করলাম, আগ্রা যাব। এত কাছে
থেকেও এতদিনে তাজমহল দেখা হল না, এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা। কিছুদিন আগেই পরীক্ষা শেষ
হয়েছে কলেজে। আমার কথা শুনে অভিষেক (মাস্টার), প্রশান্ত (ভোলে) আর অঙ্কিত
(নেডু)ও যেতে রাজি হয়ে গেল। রাত সাড়ে এগারোটার সময় ট্রেন। তখন আটটা বেজে গেছে।
রিজার্ভেশনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। হুড়মুড় করে দুটো জামা ব্যাগে গুঁজে দেওয়া হল। কয়েকটা রুটি চিবিয়েই
বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের উদ্দেশে। আমি তখন মাঝে মাঝেই হুটহাট ঘুরতে
বেরিয়ে যাই এরকমভাবে। জেনারেল বগিতে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়লেই হল, বসার জায়গা না পেলেও
কিছু আসে যায় না। একসময় তো ট্রেনটা গন্তব্যে পৌছবে। তখন সব কষ্ট সার্থক মনে
হয়। চারবাগ স্টেশনে এসে জানা গেল ট্রেন লেট আছে। প্লাটফর্মে ঘোরাঘুরি করে আর চায়ের
পর চা খেয়ে বেশ কেটে গেল সময়। এদিকে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করা লোকেদের ভিড় বেড়েই
চলেছে। গাড়িতে চড়তে পারলে হয়। একসময় টুন্ডলা-আগ্রা-যোধপুর এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াল
প্লাটফর্মে। কী ভিড়! মানুষ উপচে পড়ছে। জেনারেল বগিটাকে দেখে মনে হচ্ছে রেফিউজিদের
আস্ত একটা শহর। আমরা যে কী করে ট্রেনের ভেতরে পৌঁছলাম সেই রহস্যের সমাধান না করতে
যাওয়াই ভালো। মিনিট পনেরো পর আবিষ্কার করলাম, আমি আপার সীটের কোনায় ঝুলছি। পেছনের
কোনও স্থানবিশেষের এক ইঞ্চি হাড়ের ভরে আমার পুরো শরীরটা টিকে আছে। সেই আপার সীটে
আস্তানা গেড়েছে আরও একগ্রাম মানুষ। তারই মধ্যে বিশাল বপু নিয়ে শুয়ে আছে এক
সাধুবাবা। চারদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি একাক্কার কান্ড। ট্রেনের সাইডবার্থ, আপার আর লোয়ার বার্থে
চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে আছে কমপক্ষে দু’শোজন। লোয়ার বার্থের নিচেও মাথা গোঁজার ঠাঁই
নিয়েছে বেশ কিছুজন। এত লোক যে ঐটুকু জায়গাতে ঢুকল কী করে সে যুক্তি দিয়ে বোঝা কারও
কম্ম নয়। আমাদের দলের বাকি তিনজন তারই মাঝে কেতরে আছে। প্রথম চিন্তায় আমার মাথায়
এল, ‘হায় রে, স্বাধীন ভারত।
তোমার এই দশা!’ বেশিরভাগ লোকে জানেই না ইন্ডিয়ান রেলের এই দশা। তারা তিনমাস আগে
এসি অথবা নিদেনপক্ষে স্লীপারে রিজার্ভেশন করে যায়। কিন্তু গরিবদের সেই সাধ্য নেই। তারা
এমনি করেই ট্রেনে চড়তে বাধ্য। দু’তিনদিন ধরে জার্নি করতে হলেও কিছু করার নেই। সামান্য
বসা, শোয়া, খাওয়ার জল, বাথরুমের ব্যবস্থাও নেই
এই বগিগুলোতে। অনেকসময় দু’দিন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয় লোকেদের। যাই হোক, আমার পেছনের হাড় তখন
বিদ্রোহ করছে। আর একটু হলেই আমি সোজা নিচে পড়ে যাব লোকেদের ঘাড়ের ওপর। কিন্তু ঠিক
করে বসার জায়গাও নেই। আমি একটু এদিক ওদিক হয়ে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করতেই সবাই চেঁচিয়ে
উঠল। ওদের
দোষ নেই। আসলে এক সেন্টিমিটার জায়গাও নেই ওখানে। সবার অবস্থাই আমার মতো। আমি
রেগেমেগে সাধুবাবাকে এক ধমক দিলাম। এত বড়ো বপু নিয়ে শুতে হলে এসিতে যাও না বাপু!
সেই শুনে সাধুর কোনও প্রতিক্রিয়াই হল না। বোঝা গেল, বাবাজি গাঁজা খেয়ে স্বর্গরাজ্যে
ভ্রমণ করছেন। ওকে কিছুই বলে লাভ নেই। যদি আমিও একটু বাবার প্রসাদ পেতাম এখন, কষ্ট থেকে রেহাই হত। ততক্ষণে
আমার সারা শরীরে ব্যথা ছড়িয়ে গেছে। এমনি করে বসে থাকা অসম্ভব। আগ্রা এখান থেকে
সাত-আট ঘন্টা। এখন খালি আধঘন্টা কেটেছে। আশায় আশায় রইলাম, বারেলি এলে কিছুটা ফাঁকা হবে। সাড়ে
তিনঘন্টা পর বারেলি এল। এই সময়টা আমি নানারকমভাবে নিজেকে মানসিক সান্ত্বনা দিয়ে
কাটিয়েছি। মনে করেছি বিপ্লবীদের কথা, অভিযাত্রীদের কথা। মাঝে মাঝে ওপরের পাখা ধরে ঝুলে দু’তিন
সেকেন্ডের জন্যে আরাম দিয়েছি আমার স্থানবিশেষের হাড়টাকে। বারেলি আসছে, আর আধঘন্টা, আর পনেরো মিনিট, আর পাঁচ মিনিট। বারেলি
আসতেই আমি চোখ বুজলাম। কিছু লোক নামবে নিশ্চয়ই। দু’তিন মিনিট গেল। কিছু টের পাচ্ছি
না তো লোকেদের নেমে যাওয়া। চোখ খুলতেই দেখি, ভিড় একটুও হালকা হয়নি। উল্টে আরও অনেক লোক ঢুকে
গেছে তার মধ্যে। এ কী রে বাবা? এখানে আরও লোক ঢুকল কোত্থেকে? এক আঙুল জায়গা নেই। আমি আতঙ্কে
ঘেমে উঠলাম। এইভাবে আরও পাঁচ-ছয় ঘন্টা। মরে যাব যে! আগেও বেশ কয়েকবার জেনারেলে
গেছি, কিন্তু এরকম অবস্থা হয়নি
কোনওদিন। আসলে আমি দুর্ভাগ্যবশত ভুল জায়গায় আটকে গেছি। নিচের কোনও জায়গায় থাকলে
অন্তত পড়ে যাওয়ার ভয়টা থাকত না। এইভাবে থাকা অসম্ভব! শহীদ হওয়ার আর বেশিক্ষণ বাকি
নেই।
পরের চার-পাঁচ ঘন্টা যে
আমার মনে আর শরীরে কত কিছু হল সে নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়। কিন্তু আপাতত সেই গল্প
থাক। সাড়ে চারটের কাছাকাছি শুনলাম, লোকেরা বলাবলি করছে, এবার টুন্ডলা আসছে। শুনে বেশ আরাম
হল। টুন্ডলা
বেশ বড়ো জায়গা। ওখানে প্রচুর লোকে নেমে যায়। আর আগ্রা ওখান থেকে একঘন্টা। আশায়
আশায় রইলাম। ধীরে ধীরে পাঁচটা বেজে গেল, টুন্ডলা আসেনি এখনও। ট্রেনটা লেট করছে। আমি পেছনের
হাড়কে বললাম, “রোসো বাবা, আর কিছুক্ষণ। টুন্ডলা এল
বলে।”
সাড়ে পাঁচটা। লোকেরা এখনও
বলছে টুন্ডলা প্রায় এসে গেছে। আমি আশাবাদী। পৌনে ছ’টা। আমার হাড় ভেঙে যাবে মনে হল। আর কতক্ষণ? ছ’টা। টুন্ডলা এখনও
আসেনি। আমি আর পারছি না। সওয়া ছ’টা। আমার মনে হল আমি টুন্ডলা আর জীবিত অবস্থায়
দেখতে পারব না। দেখি অভিষেক কোনওক্রমে উঠে দরজার কাছে গেছে। সাড়ে ছ’টা। আমি মনস্থির
করে ফেলেছি ততক্ষণে। আমি অভিষেককে বললাম, “আমি পরের স্টেশনে নামছি। তোরা ইচ্ছে হলে নাম, নাহলে বসে থাক। আগ্রায়
দেখা হবে।”
শুনে অভিষেক বলল, “যা বলেছিস। আমিও নামছি।
আর পারছি না।”
ভোলে আর নেড়ু তখন ঘুমিয়ে
পড়েছে কোনও এক জায়গায় গুটিসুটি মেরে। ওরা নাকি ট্রেনেই যাবে। মরুক গে যাক। প্রচুর
হট্টগোল পাকিয়ে আমি নেমে এলাম দরজার কাছে। নামতে পারলে বাঁচি। যে কোনও জায়গায়
নামলেই হল। এই
লাইনের কাছাকাছি জি টি রোড গেছে। ওখানে গিয়ে বাস ধরে নিলেই হল। আমরা তৈরি হয়ে আছি নামব
বলে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। কিন্তু একী? ট্রেন যে থামেই না! এতক্ষণ লেট করছিল, এবার কোনও জায়গাতেই
থামছে না। এমনকি ফিরোজাবাদেও থামল না। এখানে ট্রেনের থামার কথা। ব্রেক ফেল হয়ে গেল
নাকি! আমরা তো অবাক। সিকোহাবাদে নামব বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, সিকহাবাদেও ট্রেন দাঁড়াল
না। আমার মাথায় খুন চেপে গেল। নামবই নামব। কিন্তু ট্রেন দাঁড়ায়
না। সামনে একটা ছোটো স্টেশন আসছে, ট্রেন মাঝারি স্পীডে চলে যাচ্ছে। দাঁড়াবে না বোঝাই যাচ্ছে।
আমি মনস্থির করে ফেললাম। ট্রেনটা স্টেশন চত্বরে ঢুকে গেছে। সামনে একটা বালি
সিমেন্টের ঢিবি। হয়েই যাক। এসপার, নয় ওসপার। আমি ব্যাগটা কাঁধে গলিয়ে চলন্ত ট্রেন
থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পাশের লোকগুলো চিৎকার করে উঠল। বালির ওপরেই পড়েছি। উঠে দেখলাম
হাত পা সব ঠিকই আছে। খালি কনুইটা ছড়ে গেছে একটু। অভিষেকও লাফিয়ে পড়েছে। ওরও কিছু
হয়নি। আমরা উঠে একগাল হেসে ট্রেনটাকে টা টা করে দিলাম হাত নেড়ে।
ধীরে ধীরে স্টেশনের বাইরে
বেরিয়ে এলাম। এটা একটা গ্রাম বলেই মনে হচ্ছে। হলুদের ওপর কালোতে লেখা আছে, ‘হিরণগাঁও’। তখনও ভালো করে সকাল হয়নি। ট্রেনে
কিছু বোঝা যায়নি, বাইরে
এসে শীত টের পাওয়া যাচ্ছে। সামনেই একটা হ্যান্ডপাম্প। ঘাড়ে মুখে ভালো করে জল
দিলাম। কী ঠান্ডা জল! কিন্তু এখন যেন আরামে মনটা জুড়িয়ে গেল। সামনেই একটা চায়ের
দোকান। চারদিকে দেখা যাচ্ছে গম আর ছোলার ক্ষেত। সকালবেলার শিশিরে ভেজা কাঁচা পাকা
আলপথ। পাখি ডাকছে। এ তো স্বর্গ! দোকানির কাছ থেকে এক ভাঁড় চা নিয়ে চুমুক দিলাম সামনের
বেঞ্চিতে বসে। কানে এল কোকিলের ডাক। জনাকয়েক লোকে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে
দোকানটায়। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হল। হিরণগাঁওতে এখনও বিজলি বাতি
আসেনি। বেশি লোকজন থাকে না এখানে। হিরণগাঁও নামটা কী করে হল বলতে তারা জানাল, আগে
এই অঞ্চলে প্রচুর হরিণ ছিল। এরা একসময় হরিণ পুষত। এখনও নাকি এখানে হরিণ
দেখতে পাওয়া যায় কখনও কখনও। কিন্তু নামটা ঠিক কে দিয়েছে জানে না সঠিকভাবে কেউ।
জিজ্ঞেস করে জানলাম, এখান থেকে জি টি রোড প্রায় ছয় কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা আছে
ক্ষেতের ওপর দিয়ে। রাস্তায় কেউ না কেউ ঠিক পৌঁছে দেবে। আমরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে
হাঁটা শুরু করলাম আলপথের মাঝবরাবর। যতদূর চোখ যায় সবুজ ক্ষেত ছড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে
দূরে দেখা যাচ্ছে ছুক-ছুক করতে করতে চলে যাওয়া ট্রেন। ছোলার ক্ষেত পেরিয়ে
কড়াইশুঁটি ক্ষেতে নেমে পড়লাম। কচিকচি কড়াইশুঁটি চিবোনোর মজাই
আলাদা। কী মিষ্টি মটরদানাগুলো যেন! সবুজ মুক্তোগুলোকে যেন কেউ চিনির রসে ফেলেছে। মাঝে
মাঝে দেখা গেল বেগুন, কপি, আখের ফসলও হয়েছে। দূরে
দেখা যাচ্ছে হলুদ হয়ে থাকা সর্ষের ফুল। অভিষেক গুন গুন করে গান ধরেছে হাঁটতে
হাঁটতে। চারদিকে কী শান্তি! কয়েকটা ছোটো কাঁচা বাড়ি, গরুর গলায় বাঁধা ঘন্টির টুং টাং, আমরা
ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পথ হাঁটছি। কী হবে আগ্রা গিয়ে? তাজমহল কি এখানের চেয়ে বেশি
সুন্দর হবে?
সেখানে কি
এই শান্তি পাব? এখানেই থেকে গেলে হয় না? কে বলবে একঘন্টা আগে আমি
ট্রেনে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলাম? সেই জন্যেই কি এই স্বর্গের দেখা পাওয়া গেল? আমরা সব ভুলে অনেকক্ষণ
বসে রইলাম একটা ছায়াঘন গাছের নিচে। বেশ খানিকক্ষণ পর কয়েকটি ছেলে এসে বলল, “আপ লোগ জিটি রোড
জায়েঙ্গে না! চলিয়ে,
হম ছোড় আতে হ্যায়।”
তাদের দু’জনের সাইকেলের
পেছনে বসে পড়লাম। সাইকেল
চলল আলপথের ওপর দিয়ে। শিশিরাবৃত সবুজের মেলা জুড়ে শীতের আমেজ, পাখিদের ডাক, হাতে কচি মটরশুঁটির দানা, আর এঁকে বেঁকে চলা
সাইকেলের ট্রিং ট্রিং শব্দ। আমি কি এখানে কোনওদিন ফিরে আসতে
পারব না? এটা কোনও ট্যুরিস্ট
প্লেস নয়, কিন্তু তাতে কী হয়েছে! এখানে
আমি ফিরবই।
এর পরে আমরা আগ্রা
গেছিলাম। সেখান থেকে ভরতপুর, জয়পুর। কিন্তু এই কাহিনি সে নিয়ে
নয়। আমার মনে রয়ে গেছে হিরণগাঁওয়ের শান্ত ভোরের সেই ছবি। তারপরে আমি বহুবার সেই
একই লাইনে যাতাযাত করেছি। প্রত্যেকবার দেখতে দেখতে গেছি বাইরে যদি হিরণগাঁও চোখে
পড়ে। যদি সেখানে ভুল করে ট্রেনটা থামে। কিন্তু সেই জায়গাটা কিছুতেই চিনে উঠতে
পারিনি। লখনউ থেকে এলে প্রতিবার ফিরোজাবাদের পর থেকে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, যদি দেখতে পাই
হিরণগাঁওয়ের সাইনবোর্ড, চেন টেনে নেমে পড়ব। কিন্তু কোনওদিন সেই ছোটো গ্রাম আর
দেখতে পাইনি। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সাথে আমি ধীরে ধীরে ভুলে যাই সেই কথা। কলেজের
পাট শেষ হলে দিল্লিতে চলে যেতে হয় বেশ কিছুদিনের জন্যে।
সাল ২০১২। পুজোর সময় বাড়ি
ফিরব। কোনও ট্রেনেই জায়গা নেই। কোনওরকমে স্লীপারের একটা ওয়েটিং টিকিট কেটে বসেছি
সীটের এককোণে। গাড়ির
নামটা মনে নেই। রাত দুটোর সময় ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ল। একঘন্টা
হয়ে হয়ে গেল কোনও নড়চড় নেই। চেঁচামেচিতে
জানা গেল কী একটা ব্রেকের প্রবলেম। না সারানো অবধি যাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করেই
যাচ্ছি। অনেকক্ষণ হয়ে গেল। ভেতরে বেশ গরম লাগছে তখন। ভাবলাম, বাইরে বেরিয়ে আসি। বাইরে
এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। চারদিকে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। বেশ ফুরফুরে হাওয়া
দিচ্ছে। একটা পাথরের ওপর বসলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। চোখ মেলে দেখি ভোরের
আলো ফুটছে। ট্রেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি হওয়ার কোনও আশা করা বৃথা। ট্রেনের
কাজকারবার আমি ভালোই জানি। সামনে দেখি একটা ছোট্ট জটলা। গিয়ে দেখি, একটা চায়ের দোকান। এককাপ
চা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এই জায়গাটার নাম কী?”
চাওয়ালা উত্তর দিল, “হিরণগাঁও।”
চকিতে মুখ তুলে তাকালাম।
হিরণগাঁও! এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলাম দূরের সাইনবোর্ডটা। হলুদের ওপর কালো দিয়ে
লেখা, হিরণগাঁও। এক মুহুর্তের মধ্যে সব
মনে পড়ে গেল। সেই আলপথ, ভোরের শিশির, মটরশুঁটি, সাইকেল, পাখির ডাক…
একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম
থ হয়ে। এতদিন পর এভাবে দেখা দিল! কোথায় লুকিয়ে ছিল এই জায়গাটা? ধীরে
ধীরে আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনস্থির করে নিয়েছি। ব্যাগ হাতে হাঁটতে শুরু করলাম
রেললাইনের ওপর দিয়ে। তুমি আমায় ডাকনি, কিন্তু আমি এসেছি। আমি বলেছিলাম না, আমি ফিরব? আমি
আজ ফিরে এসেছি। হঠাৎ
একটা অজানা অভিমানে আমার বুক ভারী হয়ে এল।
_____
No comments:
Post a Comment