ফাঁদ
ঋজু
গাঙ্গুলী
বড়োগাছের
জটলায় ঝুপসি হয়ে থাকা জায়গাটা থেকে কান্নার আওয়াজটা আবার ভেসে আসছে। বিরক্ত এবং
কিছুটা চিন্তিত হয়ে জলার গা ঘেঁষে গজানো নরম ঘাসের ঝোপটা থেকে মুখ তুলে সেদিকে
তাকাল লগ। ওর মনে পড়ল, ক’দিন আগেই এমন কান্না শুনতে হয়েছিল ওখান থেকেই। ওই ঝুপসি
জায়গায় যে বিশালকায় কিন্তু নিরীহ জন্তুগুলোর আস্তানা, তাদের সঙ্গে ওর কোনও অসদ্ভাব
নেই। অবশ্য পুরনো অনেক লড়াইয়ের ক্ষত বয়ে বেড়ানো একটা স্টেগোসরাসের সঙ্গে জলার
চারপাশে, এমনকি জলার ভেতরে থাকা প্রাণীদের অসদ্ভাব থাকবেই বা কেন?
কিন্তু
তবুও, এতদিন পাশাপাশি ঝগড়া আর মরণপণ যুদ্ধ এড়িয়ে চলার বাইরে যাদের নিয়ে ওকে মাথা
ঘামাতে হয়নি, আজ তাদের আস্তানার দিকে নিজের ভারী এবং বেশ কিছু প্রাচীন ব্যথাবাহক
শরীরটা টেনে নিয়ে চলল লগ। কোনও মায়ের কান্নাই ও চুপচাপ সহ্য করতে পারে না।
নিজের
ছোটো কিন্তু সাংঘাতিকরকম মজবুত পায়ে ভর দিয়ে ওজনদার শরীরটাকে সাবধানে জল-কাদা থেকে
ওপরে তুলে ঝুপসি জায়গার কাছে নিয়ে গেল লগ। কাঁটাওয়ালা মুগুরের মতো বিশাল লেজটা
দিয়ে শরীরের ভারসাম্য রেখে পাকদণ্ডি বেয়ে উঠতে উঠতেই ও খেয়াল করেছিল, জলের স্তর
থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে মোটামুটি সুরক্ষিত জায়গাতেই ইগুয়ানোডনগুলো বাসা বেঁধেছে। কিন্তু
কান্নার আওয়াজ বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই অবস্থান সত্ত্বেও এবং বড়ো প্রাণীরা জায়গাটায় ওঠার
মুখটা আটকে রাখলেও মৃত্যু হাত বাড়িয়েছে এই আস্তানায়। অবশ্য মৃত্যু তো এই জলার
সর্বত্র ওত পেতেই আছে। যেভাবে উড়ুক্কুগুলো জলের একটু কাছে আসা মাছ তুলে নেয়
নিজেদের ধারালো ঠোঁটের ফাঁকে, সেভাবেই মৃত্যু অপেক্ষা করে এখানকার প্রতিটি প্রাণীর
মুহূর্তের অসতর্কতার জন্য, তাদের নিজের ঠোঁটের ফাঁকে ধরে ফেলবে বলে।
তবে
সন্তানহারা মায়ের কান্নাকে ছাপিয়ে একটা অন্যরকম শব্দ উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। পেছনে
তাকিয়ে দেখল লগ, ফেলে আসা সরু পথটা ধরে উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ভারী পা। মাথাটা তুলে
পায়ের মালিকদের দেখে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লগ। মৃত্যুকে কীভাবে
একটা ক্লান্তিকর আবেগবর্জিত জিনিসে পরিণত করা যায়, তা দেখিয়ে দেখিয়ে রীতিমতো
সম্ভ্রম ও ভয়ের পাত্র হয়ে ওঠা চক, মানে ট্রাইসেরাটপসদের দলপতি নিজেই এই মিছিলের
নেতৃত্ব দিচ্ছে।
জলা,
তার ধারের কাদাজমি, ছোটো টিলার ওপরে বড়ো বড়ো গাছে দিনেদুপুরেই অন্ধকার হয়ে থাকা
একটা বড়ো ঝোপ, ক্রমশ উঁচু হতে থাকা পাহাড়ি পথের একেবারে শেষে আগুন-পাহাড়, মানে গরম
বাতাস আর ধোঁয়া উগরানো একটা উপত্যকা, তার পেছনে একটা মস্ত বড়ো হ্রদ - এই নিয়ে গড়ে
উঠেছে লগের পৃথিবী। এর বাইরেও জগৎ আছে, একথা ও জানে। পাহাড়গুলো যেখানে শেষ, তার
পাশেই তো রয়েছে এক ভয়ংকর শুকনো মরুভূমি। আর জলার ওপাশেই রয়েছে একটা বিশাল জঙ্গল।
তার ওপাশে হয়তো রয়েছে আরও অনেককিছু। তবে লগের
দুনিয়া জলা আর তার চারপাশের এই জায়গাটুকু নিয়েই। ক্যালেন্ডার বা ঘড়ির আবিষ্কার না
হলেও এটুকু বোঝার ক্ষমতা আর স্মৃতি আছে লগের, যে এই জলার ধারে ও রয়েছে অনেকদিন
ধরে।
আর
প্রায় ততদিন ধরেই ও দেখে আসছে মৃত্যু কারও গায়ে হাত বুলিয়ে তার জ্বালাযন্ত্রণা শেষ
করে দিলেই সেখানে উদয় হয় চক আর তার দলবল এবং তারপর শুরু হয় সেই সময়ের সবচেয়ে বড়ো
দুশমনের নামে চিৎকৃত বিষোদ্গার। প্রথম প্রথম আর পাঁচজন তৃণভোজীর মতো লগও চকের
বক্তৃতা শুনে ভাবত, এই উপত্যকায় বা জলায় হওয়া প্রতিটি মৃত্যুর জন্য দায়ী দানব বা
তারই মতো কোনও মাংসাশী। তবে তারপর একটু একটু করে ও বুঝেছে, অনেকক্ষেত্রে
তৃণভোজীদের লোভ বা অতিভোজনও তাদের বিপদ ডেকে আনে। আর তখন থেকেই ওর কাছে চকের এই
চেঁচামেচি আর আস্ফালন নিরর্থক হয়ে পড়েছে।
আজকেও
তাই হচ্ছিল। চকের তর্জন-গর্জন ইগুয়ানোডনের দলটাকে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত আর মজা
দেখতে ভিড় জমানো আরও একগাদা জলাবাসীকে আমোদিত করতেই কাজে লাগছিল। বিরক্ত হয়ে লগ
টিলা থেকে নেমে জলায় ফিরে যাওয়ার কথাই ভাবছিল। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজটা ওকে
এবং সব্বাইকে দস্তুরমতো চমকে দিল।
“সব
বাজে কথা!” বলে উঠল গলাটা।
গলার
তীক্ষ্ণতা আর ভঙ্গি শুনেই লগের একটা কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু
সেটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে ধারণাটাকে ও পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন, মানে গলা আর
মাথাটাকে ওপরদিকে তুলে একটা বিশাল গাছের মগডালে দৃষ্টিপাত করতেই লগের ছোটো
চোখগুলোও যথাসম্ভব বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
“সব
বাজে কথা!” কথাটা সজোরে আরেকবার বলে উঠল একটা উড়ুক্কু, মানে টেরোড্যাকটাইল।
তৃণভোজীদের
একটা জমায়েতে, সেও আবার সদ্য মারা যাওয়া কোনও প্রাণীর আস্তানায় একটি উড়ুক্কুর আসা
মানে প্রায় অভাবনীয় ব্যাপার দুটো কারণে। প্রথমত, উড়ুক্কুরা মাংসাশী, তাই
তৃণভোজীদের মধ্যে তাদের কারও উপস্থিতি প্রত্যাশিত নয়। দ্বিতীয়ত,
অন্যান্য মাংসাশী জন্তুদের মতো মাটিতে দাঁড়িয়ে সামনাসামনি লড়ে না তারা।
তাই তাদের বিশেষ কেউই পছন্দ করে না এই জলায়।
লগের
মনে পড়ল, উড়ুক্কুরা তো দলবেঁধে যাতায়াত করে। তাহলে আগুন-পাহাড়ের ভেতরে নিজেদের
আস্তানা ও দল থেকে এতদূরে এই উড়ুক্কু কী করছে?
হঠাৎ
বাধা পেয়ে, তাও আবার একটা উড়ুক্কুর কাছ থেকে কথা শুনতে হচ্ছে বলে চক এতটাই চমকে
গেছিল যে ও রাগ না করে স্রেফ অবাক হয়ে উড়ুক্কুটাকে দেখছিল। এবার ও চিবিয়ে চিবিয়ে
বলে উঠল, “তাহলে একটা উড়ুক্কুর কাছে আমাদের শুনতে হবে, কীভাবে এই জলার ধার থেকে
গায়েব হয়েছে আমাদের এক ছোট্ট ভাই?”
“আলবাত
শুনতে হবে,” তীক্ষ্ণ গলায় উত্তর ভেসে আসে গাছের ওপর থেকে। তারপর চাঁদের বুকে হঠাৎ
ভেসে যাওয়া একটা মেঘের মতো প্রকাণ্ড ছায়ার মতো করে মাটিতে নেমে আসে উড়ুক্কুটা।
“একটাও
কাজের কথা না বলে বরং বোকার মতো নিজের আর নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের পায়ের চাপে
ঘটনাস্থলের সব সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপ করে চলেছ তুমি এতক্ষণ ধরে। অবশ্য যাদের এই নিয়ে
সত্যিটা জানার দরকার ছিল তাদেরই তো দেখছি এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই।”
এবার
লগের খেয়াল হল, চকের দলের বাকিরা একটু অপরাধী অপরাধী মুখ করে সরে দাঁড়াচ্ছে। আর
ইগুয়ানোডনদের দলপতি ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে। পরের কথাগুলো থেমে থেমে সেই বলল।
“আমাদের
দলের সবচেয়ে ছোটো সদস্যদের এই নিয়ে তিনবার হারালাম আমরা, তাও গত দিন সাতেকের
মধ্যে। ছোটো হলেও তাদের এভাবে গায়েব করে দেওয়ার ক্ষমতা এই জলায় আর কার আছে বলতে
পার? সেই শোকে সন্তপ্ত হয়ে আছি আমরা, আর তুমি আমাদেরই গালমন্দ করছ।”
লগ
বুঝতে পারল, উড়ুক্কু কী বলতে চাইছে সেটা না শুনে বরং তার আপাত অভদ্র কথাবার্তা নিয়েই
এবার কাঁটাছেঁড়া হতে চলেছে। আর ঠিক
তাই-ই হল। চক এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তারস্বরে বলে উঠল, “এক মাংসাশীর কাছ থেকে
আমরা আর কীরকমের ব্যবহার পেতে পারি? বন্ধুরা, এস সবাই মিলে এই ‘গাঁয়ে মানে না, আপনি
মোড়ল’ উড়ুক্কুকে শিক্ষা দিই।”
উড়ুক্কু
দুয়েকবার ডানা ঝাপটে কথা বলতে চাইলেও সবাইকে দুপদুপিয়ে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে আর
দ্বিধা করল না। আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ
তুলে।
লগও
পেছনের হট্টগোল আর কান্নাকাটি ফেলে জলার দিকে পা বাড়াল।
রোদ্দুরটা
যখন মাথার একদম ওপরে উঠেছে, তখন অনেকদূর থেকে দানবের গর্জন ভেসে এল জলার ওপরের
স্থির হয়ে থাকা বাতাসে। চটকা ভেঙে চারপাশে দেখল লগ। দানব এখনও অনেকদূরে।
কিন্তু কোনও শিকারের সঙ্গে সম্ভবত মোলাকাত হয়েছে ওর।
মাথার
ভেতরে জমাট বাঁধা ঝোপঝাড়গুলোকে সাফ করতে চেষ্টা করল লগ। ওর মুখে কেউ হাসি দেখতে
পায় না ঠিকই, তবে বহু পুরনো একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ায় ওর মুখেও একচিলতে হাসি ফুটে
উঠল তখন।
দানব
তখন আরও জোয়ান ছিল। কিন্তু ওকে ঠেকিয়ে রাখাই শুধু নয়, উচিত শিক্ষা
দিতে পেরেছিল লগ সেদিন। তবে আজকের প্রায় বৃদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত লগের সাধ্য হবে কি
দানবের সামনে দাঁড়ানোর? তখনই উড়ুক্কুর শেষ কথাগুলো মনে পড়ে গেল লগের। ‘দানব এই
কাজগুলো করেনি। আমি জানি।’ কীভাবে কথাটা এত নিশ্চিতভাবে বলতে
পারল ও?
নিজের
ওপর বেশ বিরক্তই হল লগ। প্রথমে যে বিষয়ে ওর জড়িত থাকা উচিত নয় তাতে যোগ দেওয়া,
তারপর এখন এক উড়ুক্কুর কথা নিয়ে ভাবা। কেন?
কিন্তু
অনেক চেষ্টা করেও কথাগুলো মাথা থেকে তাড়াতে পারল না লগ। অবশেষে নিজেকে মনে মনে
প্রচুর গালাগাল দিয়ে প্রায় অচিন্তনীয়ভাবে ইগুয়ানোডনদের আস্তানাটাকে একপাশে রেখে
পাকদণ্ডি বেয়ে আগুন-পাহাড়ের দিকে রওনা হল লগ।
গন্ধকের
ঝাঁঝালো গন্ধ আর গরম বাতাসের বাষ্প যখন লগের নাকে ধাক্কা মারল তখন মাথার ওপরের
গোলাটা হলুদ থেকে কমলা হয়ে পাহাড়ের পেছনে ঢলে পড়ার জোগাড় করছে। ঠিক তখনই একটা
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে হ্রদের চারপাশে বিকট দুর্গন্ধময় গুহা আর পাথরের ফাঁকফোকর থেকে
আকাশে উড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ুক্কু।
জীবনে
প্রথমবার উড়ুক্কুদের আড্ডায় এলেও বহুযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে ‘পালাও অথবা লড়ো’
সংকেতের সঙ্গে লগের পরিচয় অতি নিবিড়। তাই ওকে
দেখেই যে এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা লগ বুঝতে পারল। বুদ্ধিমান সৈনিকের মতো ও
যেখানে ছিল সেখানেই থেমে গেল।
মাথার
ওপরের আকাশটাকে প্রায় ঢেকে দিয়ে তীব্র চিৎকার করতে করতে ঘুরপাক খাচ্ছিল
উড়ুক্কুগুলো। তাদেরই মধ্য থেকে একজন, যে আকারে-প্রকারে এতটাই বিশিষ্ট যে তাকে
দলপতি হিসেবে চিনতে ভুল হয় না, লগের থেকে কিছুটা দূরে একটা পাথরের ওপর এসে বসল। এই
ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয় তা লগের জানা ছিল। ও কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলে উঠল,
“আমি তোমাদের একজনকে খুঁজছি।”
ছোট্ট
সূর্যের মতোই অসহনীয় দ্যুতিতে জ্বলতে থাকা দু’চোখ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লগকে দেখল
দলপতি। লগের ধৈর্যের অভাব নেই। তবে আজ ও
একটু চিন্তিত হচ্ছিল অন্ধকার নামছে বলে। কিন্তু ও জানত, সেই মনোভাবটা প্রকাশ করে
ফেললে ও যাকে খুঁজছে তাকে পেতে আরও সময় লাগবে। তাই ও নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রইল।
“আমাদের
একজনের সঙ্গে আপনার কী দরকার?” অবশেষে মুখ খুলল দলপতি।
মনে
মনে মুচকি হাসল লগ। জলা থেকে এতটা দূরে সম্পূর্ণ একা উঠে আসাটা হঠকারিতা ছিল ঠিকই,
তবে সেটা যে ওকে কিছুটা অতিরিক্ত সম্ভ্রম আদায় করে দিয়েছে সেটা ভেবে ওর ভালো লাগল।
“আজ
তোমাদের একজন নিচে একটা জমায়েতে ছিল। তার সেখানে কিছু বলার ছিল, কিন্তু নানা কারণে
সে কথাগুলো বলতে পারেনি। আমি কথাগুলো শুনতে চাই।”
পাহাড়ের
লম্বা ছায়ার আড়ালেও এই কথাটা শুনে দলপতির তখনও শক্ত হয়ে থাকা চেহারাটা যে কিছুটা
নরম হল সেটা লগ বুঝতে পারল। মাথাটা এদিক ওদিকে ঝাঁকিয়ে বলল দলপতি, “আপনি কিঁ-র কথা
বলছেন?”
“কিঁ!”
সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে লগ। তারপরেই ওর মাথায় আসে, উড়ুক্কুদের নামকরণ সম্বন্ধে ও কীই
বা বুঝবে? তবে দলপতি যে বেশ সহজ হয়েছে সেটা তার আলাপি গলা শুনেই বোঝা গেল, “হ্যাঁ,
চাঁছাছোলা কথার বাইরে ওর যাবতীয় মন্তব্য শুধু প্রশ্নবাচক। তাই আমরা ওকে ওই নামেই
ডাকি। সঙ্গে আনুনাসিক ব্যাপারটা আমাদের আওয়াজের, মানে...”
লগ
সহজভাবেই এবার বলে, “তার সঙ্গে কি এখন দেখা হওয়া সম্ভব? তাহলে কথাগুলো বলে নিতাম।”
দলপতি
ডানা ঝাপটিয়ে বলে, “আপনি নিচে নেমে যান। আমাদের দলের ছোটোরা, এমনকি অনেক বড়োও
আমাদের ডেরার এত কাছে আপনাকে দেখে বড্ড অস্থির হয়ে রয়েছে। আমি কিঁ-কে খুঁজে বের
করে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি।”
কথা
না বাড়িয়ে পেছন ফেরে লগ। তারপর ওর খেয়াল হয়, পাকদণ্ডি বেয়ে ও নিচে নেমে গেলে কিঁ
ওকে কীভাবে খুঁজে পাবে সেটা তো বলে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ততক্ষণে ভারী শরীরটা নিয়ে ও
দুদ্দাড় করে এতটাই নেমে এসেছে যে আর ওপরে চড়াই ভেঙে ওঠার ইচ্ছে ওর ছিল না।
তবে
নিচে নেমে জলার দিকে যাওয়ার আগেই মাথার ওপরে হুশ করে কিছুটা বাতাস সরে যাওয়ার শব্দ
পেল লগ। আধো-অন্ধকারেও কিঁর জ্বলন্ত চোখজোড়া ওর নজরে পড়ল। তবে ও কিছু বলল না। কমবয়সীরা
যে নিজেদের কথা অন্যকে শোনাতেই ভালোবাসে সেটা ও বিলক্ষণ জানে।
কিছুক্ষণ
চুপ করে থাকার পর নিজের স্বভাবসুলভ রুক্ষ আর তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল কিঁ, “তোমার ভাই-বেরাদররা
আমাকে তখন মারতে পারেনি বলে তুমিই আমাকে কষ্ট করে নিচে নামিয়ে আনলে বুঝি?”
কোনও
উত্তর না দিয়ে নরম ঘাসের একটা চাবড়া মুখে পোরে লগ। অস্থির হয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়
কিঁ, আর ডানা ঝটপটিয়ে বলে ওঠে, “তোমার নাকি আমার কাছে কী একটা প্রশ্ন আছে?”
এবার
মুখ তোলে লগ, আর একদম সোজাসুজি কিঁ-র চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, “এই নিখোঁজ হয়ে
যাওয়ার ব্যাপারগুলোর পেছনে দানব নেই, এ ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?”
তারার
আবছা আলোয় জলা আর পাহাড়ের মাঝের এই খাঁজের মতো কিন্তু অনেকটা উঁচু জায়গায় আসা
আদ্যন্ত বিপজ্জনক জেনেও লগ সেখানটায় এসে দাঁড়াল। ওর মাথার ওপর একটা চক্কর কেটে
একটু দূরে মাটির ওপর বসল কিঁ। তারপর
জ্ঞান দেওয়ার মতো করে ওর কথা শুরু করল।
“কে
কী করেছে সেই নিয়ে মনগড়া কিছু বানালে সত্যির সন্ধান কখনওই পাওয়া যায় না। তাই আগে
নিজের মন থেকে সব পুরনো ধারণা বাদ দাও। তারপর ভাবো, যারা নিখোঁজ হয়েছে তাদের
চলাফেরার পথ কী ছিল। চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাবে টিলার পাশের রাস্তা ধরে নিচে
নেমে এসে নরম গাছ আর বাঁশের ঝাড়, আর জলা থেকে জল খেয়ে দিনের বেলাটা এদিক ওদিক ঘুরে
আর ঘুমিয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে যাওয়া ছাড়া ওদের রোজকার চলাফেরায় আর কিচ্ছু ছিল না।
এবার তাহলে ভাব, কী এমন হতে পারে যাতে দলের ছোটোরা স্বেচ্ছায় এই নিরাপদ অথচ একঘেয়ে
ছকের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।”
“তুমি
কি তাহলে বলতে চাইছ...” প্রশ্নটা করেই ফেলে লগ, “যে নিখোঁজ হওয়া বাচ্চাগুলো
স্বেচ্ছায় কোথাও চলে গেছে? কোথায় গেছে তারা?”
গলার
তীক্ষ্ণতাকে খাদে নামিয়ে উত্তর দেয় কিঁ, “আমি বলতে চাইছি ওরা স্বেচ্ছায় নিজের দল
ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে। ওদের দলের বাকিরা তখন নিজেদের আস্তানায়
ফিরতেই ব্যস্ত। তাছাড়া সামনে কাছে দানব বা অন্য কোনও মাংসাশীর অস্তিত্ব ওরা
আবিষ্কার করেনি। তাই ওরা দলবেঁধে নিজের মতো করে রোজ যেমন ফেরে, তেমন করেই ফিরেছিল।
ওরা বুঝতেও পারেনি, দলের সবথেকে ছোটোটি তখন অন্যদিকে এগিয়ে গেছে।”
“অন্যদিকে
মানে?” সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে লগ।
উত্তর
না দিয়ে সামনের দিকে ইঙ্গিত করে কিঁ। তরল অন্ধকারের মধ্যেও লগ দেখতে পায় সামনের
প্রায় মসৃণ পথটার ধারে পড়ে রয়েছে প্রচুর নীল রঙের ফল, যা ওই জন্তুরা খেতে
ভালোবাসে, কিন্তু যা এদিকে কাছেপিঠে পাওয়াই যায় না।
প্রথমেই
ফলগুলো দেখে লগের মাথা থেকে সত্যসন্ধানের তাগিদ বেরিয়ে গিয়ে খিদেটা মাথাচাড়া
দিয়েছিল। তবে সেটাকে পেছনে ঠেলে ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোঝার
চেষ্টা করল ঠিক কী ঘটেছে এখানে গত কয়েক রাতে।
ওকে
রাস্তাটা ধরে নিচের দিকে নামতে দেখে কিঁ বলে ওঠে, “সাবধানে। নইলে ওদের যা হয়েছে
তোমারও তাই হবে।”
কথাটা
হেঁয়ালির মতো শোনাচ্ছে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে কিঁ-র দিকে তাকাতে গেছিল লগ, আর তখনই ওর
একটা পা পিছলে গেল। সহজাত অভ্যাসের বশে কিছু না ভেবেই নিজের লেজটা অন্যদিকে এনে
নিজেকে পথের ওপরেই রাখে লগ। সতর্কতাসূচক একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে কিঁ। কিন্তু
ততক্ষণে অন্ধকার ভেদ করে লগের নজর পড়েছে অনেক নিচে নদীর তীরের কাছে পড়ে থাকা বেশ
কয়েকটা বড়োসড় ঢিপির দিকে। সাবধানে নিজের ভারসাম্য অটুট রেখে কিঁ-র দিকে তাকায় লগ।
নিঃশব্দে
মাথা নাড়ায় কিঁ। লগ বুঝতে পারে নিচে পড়ে থাকা ওই শরীরগুলো মৃত ইগুয়ানোডনদের
দেহাবশেষ মাত্র।
আবার
মুখ খোলে কিঁ। হয়তো চারপাশে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেছে বলেই অনেক নিচু স্বরে ও বলে,
“ভেবে দেখ, যদি দানবের সঙ্গে মোলাকাত হত ওদের তাহলে কি দলের বাকিরা জানতে পারত না?
দানব নিঃশব্দে আক্রমণ করায় বিশ্বাস করে না। ও যখন হামলা করে তখন গোটা জলা-জঙ্গল
জানতে পারে সে বিষয়ে। কিন্তু এই রাতগুলোয় কী হয়েছে?
“বাচ্চাগুলোকে
তাদের পছন্দসই ফল দিয়ে টেনে আনা হয়েছে এক নির্জন বিপজ্জনক পথে। তারপর হয় তারা
নিজেরাই পা পিছলে পড়েছে নিচে, নয়তো তাদের বাধ্য করা হয়েছে আতঙ্কে জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে।
নিচের ধারালো পাথর আর ছুঁচোলো বাঁশবনের ওপর পড়ে ওরা বেশিক্ষণ বাঁচেনি। তারপর শুরু
হয়েছে মহাভোজ।”
“কিন্তু,”
নিচে নামতে নামতেই বলে লগ, “কেউ কিচ্ছু জানতে পারেনি কেন?”
“কারণ,”
আবার আকাশে ওড়ে কিঁ, “ওদের যারা ফাঁদে ফেলেছিল তারা আওয়াজ করে শিকার ধরায় বিশ্বাস
করে না।”
পাহাড়ের
নিচে নেমে এসে বুঝতে পারে লগ, কেন এই আপাত বিরাট চেহারাগুলোর গন্ধও জলার কাছে
পৌঁছয়নি। এখান থেকে আগুন-পাহাড়ের লাগোয়া হ্রদ খুব বেশি দূরে নয়।
নদীর একটা বদ্ধ আর নানা পচা জিনিসে ভরা শাখাও কাছেই। ফলে হাওয়া দিলেও তাতে পচা
মাংসের একটা গন্ধ এমনিতেই রয়েছে। তাছাড়া মাঝে পাহাড়টা পড়ে গেছে বলে হাওয়া ওদিকে
পৌঁছতেও পারে না।
কিন্তু
এমন নিপুণভাবে ফাঁদ পেতে এদের মারল কে?
তখনই
তীব্র চিৎকার করে আকাশে ওড়ে কিঁ। চিৎকারটার
অর্থ বুঝতে লগের একটুও সময় লাগেনি - সাবধান! অনেকদিনের অনভ্যাসের জড়তা কাটিয়ে নিজেকে মরণপণ
লড়াইয়ের জন্য তৈরি করতে সর্বাঙ্গে একটা ঝাঁকুনি দেয় লগ। অন্ধকারে যতদূর চোখ যায়
তার মধ্যে ও খুঁজে দেখতে চায় ওর শত্রুকে এবং স্তম্ভিত হয়!
ওর
সামনে নয়, নিঃশব্দে ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা ছোটোখাটো প্রাণী। মাথার গড়ন, দাঁড়াবার ভঙ্গি, ছোটো ছোটো হাতের নখ
এবং হালকা হিসহিসিয়ে ওঠা মুখের ফাঁকে উপস্থিতি জানান দেওয়া ধারালো তেকোনা দাঁতের
সারি ওকে বুঝিয়ে দেয় সামনে দাঁড়ানো দুশমন মাংসাশী। কিন্তু দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সে লগের তুলনায় অনেকটাই
ছোটো।
এ
ধরনের অবস্থায় লগ অকারণ লড়াই থেকে দূরে সরে যেতে চায়, বিশেষত শত্রু যখন ওর তুলনায়
কমজোর। কিন্তু ছোটোবেলার একটা স্মৃতি ওর মরচে পড়া মগজে হঠাৎই ঝলসে উঠল। ও শুনেছিল,
দানবের চেয়ে ছোটো কিন্তু অনেক বেশি ক্রূর আর দক্ষ এক ঘাতকের কথা। যে দলবেঁধে শিকার করে!
র্যাপটর!
প্রায়
অন্ধের মতো, কিছুটা হাওয়ার বাঁক-বদল থেকে আর কিছুটা আন্দাজে নিজেকে ঘুরিয়ে নদীর
দিকে নেওয়ার পাশাপাশি নিজের লেজটা সজোরে বাঁদিকে আছড়ায় লগ। একটা ভারী শরীর আর্তনাদ
তুলে ছিটকে যায় অন্ধকারে। ঝাঁকুনি লেগে থরথরিয়ে ওঠে লগের শরীর।
আবার
তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে মাথার ওপর চক্কর কাটে কিঁ। লড়ো, অথবা পালাও! লড়ো, অথবা পালাও! লগের মাথায় ক্রমাগত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে
এই কথাটা। ও বুঝতে পারে, নদীর ধারের জঙ্গল থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে আরও অনেক
ছায়া। যারা ওকে
ঘিরে ফেলতে চাইছে।
লগ
বুঝতে পারে, ওর পিঠের ওপর উঠে থাকা কাঁটাগুলো দেখে এগোতে সাহস পাচ্ছে না
জন্তুগুলো। মনে মনে আরও একবার সেই অজানা প্রাণীকে ধন্যবাদ জানায় লগ, যে ওর
চেহারাটা বানিয়েছিল। একমাত্র লগই জানে যে ওই কাঁটাগুলো শরীরের
ভারসাম্য রাখা ছাড়া আর কোনও কাজে আসে না।
কিন্তু
তবুও, সংখ্যায় শত্রুরা অনেক। তাহলে
পালাতে হবে। কিন্তু কোনদিকে?
আবার
অন্ধের মতো, কিছু না ভেবেই, হয়তো বহুদিন আগের অজস্র লড়াইয়ের স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া
কোনও অনুভূতির বশে নিজের বাঁ-দিকে সরে গিয়ে লেজটা ডানদিকে চালিয়ে দেয় লগ। দু’পাশে
দুটো শরীর ছিটকে গেল এটা বুঝেও লগ নিজের কোণঠাসা অবস্থাটা উপলব্ধি করে। আর বুঝতে পারে, যে ও ফাঁদে পড়েছে। পাহাড়ি পথে ওঠার রাস্তা বন্ধ। জঙ্গলের দিকটা এই
প্রাণীগুলো আটকে দিয়েছে। যাওয়ার জায়গা বলতে শুধু নদী। তাহলে সেদিকেই যাওয়া যাক।
একটা
পাহাড় ভেঙে নেমে আসার মতো করে নদীর দিকে ছোটে লগ। তার মধ্যেও ও বুঝতে পারে, ওর ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ছে একের পর এক শরীর যারা ওকে কামড়ে, ওর রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে, ওর পা অকেজো
করে ওকে স্থবির করে দিতে চাইছে। লগ
থামে না। লেজ আর মাথাটা নিচু করে ভারী শরীরটাকেও অস্ত্র হিসেবে নির্মমভাবে ব্যবহার
করে এগোতে থাকে ও। দমে ঘাটতি হচ্ছে, চোখের সামনে আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘন হচ্ছে।
এসব বুঝেও ও নদীর কাছে এসে পড়ে।
ওর
গলার ওপর প্রায় লাফিয়ে পড়া একটা প্রাণীকে নিরস্ত করে কিঁ।
অব্যর্থ লক্ষ্যে চালানো ওর ঠোঁট প্রাণীটির চোখ থেকে গলগলিয়ে রক্ত ছোটায়। লগ বোঝে,
এই অসম লড়াইয়ে কিঁ নিজের অতি সীমিত শক্তি নিয়েও জান লড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নদীর
ধারের নরম কাদায় যদি ওর শরীর আটকে যায় তাহলে জোয়ার না আসা অবধি ও নিতান্ত অসহায়। আর
সেজন্যই ওকে ফাঁদে ফেলে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে এই প্রাণীগুলো।
নিজেকে
বড্ড দুর্বল মনে হয় লগের। একসময়ের এত লড়াই, এত কিছু দেখাশোনার পর শেষে নদীর ধারের
কাদায় আটকেই প্রাণটা খোয়াতে হবে ওকে? আর
ওই না একসময় দানবের সঙ্গে লড়াই করেছিল!
আর
কিছু ভাবার সময় পায় না লগ। কিঁ-র চিৎকার শুনে ও বুঝতে পারে ওকে একটা বিশেষ দিকে
যেতে বলছে কিঁ। সেদিকে ছুটতে গিয়ে লগ দেখতে পায়, নদীর বুক থেকেই মাথা তুলেছে একটা
পাহাড়।
পাহাড়? এখানে তো কোনও পাহাড় ছিল না! ভয় আর বিস্ময়ের ধাক্কায় দাঁড়িয়ে পড়ে লগ।
সামনে,
নদীর জল দিয়ে নিজের পেট ভরানো শেষ করে মাথা তোলে দানব। আর তারপরেই তার হিংস্র গর্জন নদী থেকে জলা, জঙ্গল
থেকে মরুভূমি এই সবটুকু জায়গায় আকাশ-বাতাস ফালাফালা করে দেয়।
ক্লান্ত,
ক্ষতবিক্ষত, দমের ঘাটতিতে অবসন্ন এক বুড়ো স্টেগোসরাস তৈরি হয় তার অতি অতি পুরনো
শত্রু, এই অঞ্চলের একচ্ছত্র সম্রাট টিরানোসরাস রেক্স-এর সঙ্গে শেষ লড়াইয়ের
অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের জন্য।
কিন্তু
এ কী? দানব ওর বদলে
ওর পেছনদিকে তাকিয়ে আছে কেন? পুরনো
বন্ধু কী ভাবছে সেটা অনেক সময় আগে থাকতেই বুঝে ফেলা যায়। পুরনো শত্রুর ক্ষেত্রেও
কি তাই হয়?
লগ
প্রায় ছিটকে একদিকে সরে গেল। হিংস্র
গর্জনে চরাচর কাঁপিয়ে দানব আক্রমণ করল ওই প্রাণীগুলোকে। ক্লান্তি, উত্তেজনার প্রবল দাপট কেটে যাওয়ার পর
আসা অনিবার্য শৈথিল্য আর মৃত্যুভয়ের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা - এই তিনের ধাক্কায় লগ
বুঝতে পারল, সামনে নদীর চড়ায় এক অভূতপূর্ব লড়াই চলতে থাকার মধ্যেই ওর চোখ বুজে
আসছে।
তারপর
অন্ধকার...।
রোদের
চড়া তাপ আর শুকনো বালিতে আধবসা হয়ে থাকার ফলে সর্বাঙ্গে হওয়া চিড়বিড়ানির ঠেলায়
জ্ঞান ফিরল লগের। চোখ মিটমিটিয়ে খুলেই ও সেটা বন্ধ করে ফেলল।
কারণ, অতি পরিচিত জলার বদলে ওর চারপাশে তখনও ছিল সেই নদী, বালি, পাহাড় আর একরাশ
ছিন্নভিন্ন শরীর।
কষ্ট
করে উঠে দাঁড়ায় লগ। তখনই
পাশের একটা বাজ পড়ে ঝলসানো গাছের ডাল থেকে কিঁ-র নিজস্ব, কিছুটা ব্যঙ্গ মেশানো
গলায় প্রশ্নটা উড়ে এল, “ঘুম ভাঙল তাহলে?”
উত্তর
না দিয়ে লগ আগে নদী থেকে জল খেল যতটা সম্ভব। মাথাটা
পরিষ্কার হতে থাকায় একে একে ওর গতরাতের ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। আর তারপরেই ওর মনে হল কাল রাতের
ঘটনাগুলো, কেমন যেন সাজানো গোছের। কিঁ-র
দিকে কড়া চোখে তাকাল লগ। তারপর পাহাড়ি পথের দিকে রওনা দিল।
গোটা
পথটায় কিঁ কিচ্ছু বলেনি। লগ সোজা ইগুয়ানোডনদের আস্তানায় গিয়ে জানায় কী হয়েছিল। চক
না থাকলেও সেখানে আরও যারা ছিল তারা ঘটনাটা শুনে প্রথমে যথারীতি বিশ্বাস করেনি।
তবে সারাদিন ধরে দফায় দফায় অনেকে পাহাড়ের ওপারে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে।
রাত
নামার আগেই নায়কোচিত সম্বর্ধনা পায় লগ। যেহেতু কিঁ-র বিশ্লেষণ মেনেই এই সত্য
উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছিল, তাই নিমরাজি হয়েও তাকে সম্বর্ধনা দেয় অন্যান্য তৃণভোজীরা।
তবে লগ যে কিছু একটা ভাবছে অথচ সেটা কিঁ-কে জানানো হচ্ছে না, এটা বুঝে কিঁ-র অস্বস্তিটাই
পুরো সময় জুড়ে প্রকট ছিল।
অনুষ্ঠানের
পর লগ যখন চুপচাপ জলার ধারে একটা ডোবায় গা চুবিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন
পাশের গাছের ওপর ও একটা ঝটপট শব্দ শুনতে পেল। অভিজ্ঞতা থেকে লগ জানত এই অবস্থায়
কিছু জিজ্ঞেস না করলেই বরং বেশি কথা জানা যাবে। তাই হল।
নানারকম
উঁচু আর নিচু সুরে কিঁ জানাল, কীভাবে ও পুরো উপত্যকাটার ওপর নজরদারি করতে গিয়ে
জঙ্গলের ওপার থেকে র্যাপটরদের এই দলটাকে আসতে দেখেছিল। তারপর প্রথমে না বুঝলেও
ইগুয়ানোডনদের একাধিক বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ায় ও বুঝতে পারে এই ঘটনাগুলোর জন্য কারা
দায়ী। র্যাপটররা দলবদ্ধভাবে ওই বাচ্চাগুলোকে তাড়া করত আর টাল সামলাতে না পেরে তারা
পড়ে যেত নিচে, যেখানে পাথর, বাঁশ আর নদীর কাদা মিলে তাদের জন্য তৈরি করেই রেখেছিল
প্রাকৃতিক মরণ ফাঁদ।
লগ
তারপরেও কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কিঁ খুব আস্তে, প্রায় শোনা যায় না
এমন করে বলল, “তাই কাল রাতে আমাদের একটা এসপার-ওসপার করতেই হল।”
“আমাদের?”
এবার গলায় যথাসাধ্য ব্যঙ্গ ফুটিয়ে বলে লগ।
“আমাদের”
গলায় জোর ফুটিয়ে বলে কিঁ, “আমার একার পক্ষে জলার অন্যান্য প্রাণীদের এই
ব্যাপারগুলো বোঝানো সম্ভব হত না। তোমাকে ওরা বিশ্বাস করে।
তাই তোমাকে ব্যাপারটা দেখাতে আর বোঝাতেই গেছিলাম আমি...”
“আর?”
কিঁ-র কথার শেষের অসমাপ্ত টানটা ধরতে পেরেছিল লগ, “তারপরের অংশটুকু?”
“যোদ্ধা
হিসেবে তোমার খ্যাতি আমার কানেও এসেছে,” শান্ত এবং কিছুটা মুগ্ধ গলায় বলে কিঁ,
“তবে এই বয়সে এবং অনভ্যাস সত্ত্বেও কাল রাতে তোমাকে যেভাবে লড়তে দেখলাম আমি তা
অবিশ্বাস্য।”
“কিন্তু
তাতেও তো শেষরক্ষা হত না,” ক্লান্ত গলায় বলে লগ, “আমার পক্ষে তো সম্ভব ছিল না ওদের
সবার মহড়া নেওয়া। খেলা তো শেষ হয়েই গেছিল তখন।”
“নাহ্,”
খুশিয়াল গলায় বলে কিঁ, “দানবের যাতায়াত কখন কোথায় হয় তা আমার ঠোঁটস্থ।
তাই ও কাল রাতে কোথায় থাকতে পারে তা আমি জানতাম। তোমার হাতে মার খাওয়ার স্মৃতিটা ও যে একেবারে
ভুলতে পারেনি সেটাও আমি আন্দাজ করতে পারি জলা থেকে ওর দূরে থাকা থেকে। তাই তোমাকে
ওর কাছে নিয়ে যেতে পারলে ও তোমাকে আক্রমণ করবে না, এমনটাই আমি ভেবেছিলাম।
“সঙ্গে এই ভাবনাও ছিল যে নিজের এলাকায় অন্য একঝাঁক
শিকারিকে দেখে দানব রাগ আর ঈর্ষার বশে তাদেরই আক্রমণ করবে। ঠিক সেটাই হল।
“এই সাংঘাতিক বিপদের হাত থেকে জলাকে বাঁচাতে গেলে
আর কোনও উপায় ছিল না। অনেক সময় গায়ে শক্ত কিছু ঢুকে গেলে সেটাকেও তো শক্ত আর
ধারালো কিছু দিয়েই বের করতে হয়। তাই না?”
ঘুম
ঘুম চোখে লগ বলে, “তার মানে কাল তুমিও ওদের জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলে, যাতে কাদা
ছিলাম আমি...”
কিঁ
বলে, “হুঁ, আর ধারালো পাথর ছিল তোমার পুরনো বন্ধু, থুড়ি শত্রু।”
ঠিক
রাগ করতে পারে না লগ। ওর মনে পড়ে, চোখ খোলার সময়ে কিঁ-র প্রশ্নটায় ওর স্বভাবসুলভ
ব্যঙ্গ ছিল ঠিকই। সঙ্গে অনেকটা নিখাদ উদ্বেগও ছিল।
ওপরের
ডালটার দিকে একবার তাকায় লগ। ও দেখতে পায়, ওর নতুন বন্ধু ডানায় ঠোঁট গুঁজে ঘুমোনোর
তাল করছে।
লগ
ভাবে, গায়ের ব্যথা আর কাটাছেঁড়াগুলো বাদ দিলে ব্যাপারটা বেশ ভালোই ছিল।
_____
অলঙ্করণঃ
সুমিত রায়
লেখক
পরিচিতিঃ জঁর ফিকশনের অনুরাগী পাঠক এবং শিশু-কিশোরসাহিত্যের ভক্ত এই মানুষটি মনে
করেন মগজাস্ত্র আর রসিকতা দিয়ে সব পাহাড়-পর্বত পার হওয়া সম্ভব। বই আর সিনেমার
বাইরে ভালোবাসেন আড্ডা, রাবড়ি আর গরম শিঙাড়া।
অন্যরকম ভালো। আরও হোক।
ReplyDeleteথ্যাংকু
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteওহ, অনেকদিন বাদে ঋজু গাঙ্গুলির কাছ থেকে একটা sixer পেলাম, বাহ।
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগলো
ReplyDeleteদারুণ লাগল ঋজুদা... দারুণ!
ReplyDelete