গল্পের ম্যাজিক:: জুনিয়া ও তুষারগুহার প্রহরী - অদিতি সরকার


জুনিয়া ও তুষারগুহার প্রহরী
অদিতি সরকার

।। ।।

গাঢ় সিসেরং আকাশ থেকে কণা কণা শীত ঝরে পড়ছিল অবিশ্রাম। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা তুষারের আস্তরণ। রিশিনের গোটানো ডানার ধারে ধারে ঠান্ডার নীলচে দাগ, কেশরে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ। মাথা নিচু করে একটার পর একটা পা ফেলে ফেলে চলছিল রিশিন। নরম বরফে প্রতিবার হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়া পা জোর করে টেনে তুলতে হচ্ছিল তাকে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল তার। সেই গরম শ্বাসের বাষ্প মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে তার মুখের সামনে সাদা কুন্ডলী পাকাচ্ছিল। নাকের ফুটো ঘিরে জমে যাচ্ছিল বরফের দানা হয়ে। তবু সে চলছিল একরোখা, জেদি। সে জানে, এইখানে থেমে গেলে সে থামাই হবে তাদের শেষ থামা।
রিশিনের পিঠে বসা জুনিয়ার চামড়া ভেদ করে তীক্ষ্ণ শীতের ফলা ঢুকে যাচ্ছিল হাড় পর্যন্ত। রোদগরম দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া এমন শীত কখনও দেখেনি। জমে যেতে যেতে সে বুঝতে পারছিল, এক্ষুনি একটা আশ্রয় না পেলে তারা দু’জন এই তুষারপ্রান্তরেই শেষ হয়ে যাবে। ঠান্ডায় আড়ষ্ট হাতে রিশিনের ঘাড়ে আলতো চাপড় দেয় জুনিয়া। শক্ত হয়ে যাওয়া ঠোঁট জোর করে খোলে।
“আর একটু, রিশিন, আর একটু। ওই সামনে ধোঁয়ার রেখা দেখা যায় যেন, আবছা সুতোর মতো। ধোঁয়া মানেই আগুন, আর আগুন মানেই মানুষ। গ্রাম আছে নিশ্চয়ই ওখানে। আশ্রয় পাব ঠিক। আর ক’টা পা।”
রিশিনের ছুঁচলো কানজোড়া আগুপিছু হয়। ধোঁয়ার রেখা তারও চোখে পড়েছে। নাকে এসেছে গন্ধ। জুনিয়া না বললেও সে ওই পথেই এগোত।
আরও কতক্ষণ এইভাবে চলেছিল তারা হিসেব নেই জুনিয়ার। কাঠ হয়ে আসা শরীরকে সে কোনওরকমে বসিয়ে রেখেছিল রিশিনের পিঠে লাগাম জড়িয়ে নিয়েছিল অসাড় আঙুলে। যতক্ষণে গ্রামের সীমানায় এসে দাঁড়াল তারা, ততক্ষণে তার শুধু রক্তটুকুই আর জমে যেতে বাকি।
গ্রাম দেখে কিন্তু হতাশই হতে হল। গোল একটা ফাঁকা জায়গা ঘিরে অনেকগুলো ছোটো ছোটো পাথরের একতলা বাড়ি তাদের মাথায় স্লেটপাথরের টালির চাল। সে চালেও প্রচুর ফাঁকফোকর। বাড়িগুলোর মনমরা রঙের দেওয়ালে কতদিন কলি ফেরানো হয়নি কে জানে। জানালা দরজা সব এঁটেসেটে বন্ধ। কোথাও কারও সাড়াশব্দ নেই।
জুনিয়া চোখ সরু করে ধোঁয়ার রেখাটাকে খুঁজছিল। এখান থেকেই তো উঠছিল সেটা। এতদূর থেকে এতক্ষণ ধরে তাকেই তো লক্ষ্য করে এসেছে তারা দু’জন। একেবারে পেছনের বাড়িটার মাথায় ওটা কী? লাগামে টান দেওয়ার আগেই রিশিন চলতে শুরু করেছে। সেও দেখেছে। ধোঁয়া। সবথেকে ফুটিফাটা বাড়িটার ভাঙাচোরা ছাদ ভেদ করে ধোঁয়া উঠছে আকাশে। হালকা, সরু প্রায় দেখা যায় না এমনই পাতলা সাদাটে ধোঁয়া।
“কে আছেন ভেতরে, দয়া করে দরজা খুলুন। আমরা আশ্রয়প্রার্থী।”
কোনও জবাব আসে না ভেতর থেকে। কেউ আছে কি না ভেতরে তাও বোঝা যায় না। চরাচরব্যাপী নিস্তব্ধতার মধ্যে জুনিয়া গলার আওয়াজ তার নিজের কানেই খুব জোরালো শোনায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জুনিয়াতারপর আবার ডাক দেয়।
“কেউ কি আছেন? আমরা ক্লান্ত, শীতার্ত। রাতের জন্য একটু উষ্ণ আশ্রয় চাই। গৃহস্থের কোনও ক্ষতির বাসনা আমাদের নেই।”
একটা ভীরু, কচি স্বর ভেসে আসে এবার বন্ধ দরজার ওপার থেকে।
“তোমরা কারা? এখানে কী চাও?
জুনিয়া সামান্য অবাক হয়এই বাড়িতে কি বড়োরা কেউ নেই? এই প্রচন্ড তুষারপাতের সময়েও? গ্রাম ছেড়ে সকলেই কি তার মানে কোথাও কাজে গিয়েছে?
“আমি দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। আমার সঙ্গে রয়েছে আমার পক্ষীরাজ, রিশিন। পথ হারিয়ে ফেলেছি দক্ষিণদ্বীপে ফেরার। আমাদের রাত কাটাবার একটু জায়গা চাই। তোমার মা কিংবা বাবাকে জিজ্ঞেস কর, আমাদের আজ রাতটুকু তাঁরা থাকতে দেবেন কি না।”
দরজাটা হঠাৎই খুলে যায়। জুনিয়ার পায়ের পাশে একঝোপ লাল চুলের ফাঁক দিয়ে দুটো বাদামি চোখ চকচক করে ওঠে।
“পক্ষীরাজ? সত্যি সত্যি পক্ষীরাজ?
একটা ছোট্ট হাত রিশিনের কেশরের দিকে এগিয়েও আবার পিছিয়ে যায়। চকচকে চোখদুটো জুনিয়ার দিকে ঘোরে এবার। সে চোখের ভাষা পড়তে পারবে না এমন পাষাণ জুনিয়া নয়
“হাত দাও, কিছু বলবে না।”
হাতটা এবার নির্ভয়ে রিশিনের কেশর ছোঁয়। যত্ন করে কেশর থেকে জমা বরফের গুঁড়ি ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলতে থাকে।
“তোমার বাবা কোথায়? কিংবা মা? যিনিই থাকুন বাড়িতে তাঁকে ডাক একবার।”
জুনিয়ার কথায় রিশিনের কেশরের মধ্যে ঘুরতে থাকা নরম হাতখানা হঠাৎই থেমে যায়। ছোট্ট শরীরটা নিজেকে আরও ছোট্ট করে গুটিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে।
“মা নেই। কেউ নেই। শুধু আমি আছি।”
“মানে?
উত্তর নেই। লালচুলো মাথাটা শুধু আরও নিচু হয়। কাঁধটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। জুনিয়া আর অপেক্ষা করে নারিশিনের পিঠ থেকে নেমে পড়ে সে।
“রাস্তা দেখাও, ভেতরে যাব। রিশিনও যাবে।”
“আ-আমাদের আস্তাবল আছে। ঘো-ঘোড়া নেই।”
“বেশ তো। সেখানেই নিয়ে চল তাহলে আগে।” লালচুলোর গলার কাঁপনটুকু অগ্রাহ্য করে জুনিয়া।
আস্তাবলটা বাড়ির পেছনদিকের দেওয়ালের লাগোয়া। সেখানে ঢুকে জুনিয়ার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। অজস্র প্রশ্ন জমা হচ্ছিল তার মনে। লালচুলোর দিকে একবার আড়চোখে তাকায় সে। গাল বেয়ে নামা জলের ধারা তখনও শুকোয়নি ছোট্ট মানুষটার। জুনিয়া মুখ বুজে রিশিনের দিকে মন দেয়। দেওয়ালে ঝোলানো কম্বল দিয়ে আচ্ছা করে দলাইমলাই করে দেয় সে রিশিনকে। সব বরফ, সব কাদা ঘষে ঘষে সাফ করে। তারপর যবের বস্তা থেকে কিছুটা যব নিয়ে রিশিনের সামনে পাত্রে ঢেলে দেয় সে। আজ রাতের মতো রিশিনকে নিয়ে আর চিন্তা নেই। “এবার ঘরে চল
ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ে জুনিয়া। ঘরের ভেতরটাও কনকনে ঠান্ডা। বড়ো চুল্লিতে মোটে আঁচ নেই, শুধু কয়েকটা পাতলা শুকনো কাঠিকাঠি ডালপালা জ্বলছে ঘরের এককোণে। জ্বলছে বললে ভুল হবে, প্রায় নিভেই এসেছে। ছাই থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে খালি। বিছানাপাতি টানটান করে পাতা, দেখে মনে হয় কোনওদিন কেউ তাতে শোয়ইনি যেন। তাকে বাসনকোসন ধোয়ামোছা, গোছানো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জুনিয়া। তারপর পেছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে ফেরে। “তোমার নামটা বললে না তো?
“শা-শানারাআইলানকন্যা শানারা। মায়ের নাম তাসি।”
“বাহ্‌, ভারি সুন্দর নাম সব্বারতা শানারা, খাওয়াদাওয়া কি সেরে ফেলেছ, না বাকি আছে?
উত্তর নেই। হালকা একটু নাকটানার আওয়াজ হয় শুধু। জুনিয়া শুনেও শোনে না। “বলছি কি, আমার থলিতে খানিকটা ভেড়ার মাংস আছে, কাল শিকার করেছিলাম। খাও যদি তো বার করি। বড়ো করে আগুন জ্বেলে সেঁকে নিলেই হবে। দু’জনে মিলে খেয়েদেয়ে বেশ জমিয়ে ঘুম দেওয়া যাবে না হয়।”
নাকটানার শব্দ আরও জোরালো হয়। “আ-আস্তাবলে কাঠ আছে, কাটা। বাবা কেটে রেখেছিলেন, শীতের আগেই। অত ভারী কাঠ আমি ঘর পর্যন্ত বয়ে আনতে পা-পারি না। তাই কাঠি কুড়িয়ে আ-আগুন জ্বেলেছি।”
“আচ্ছা বেশ, সে নয় আমিই নিয়ে আসছি। কিন্তু শানারা, তুমি এখানে একা একা কী করছ বল দেখি। তোমায় ফেলে সবাই গেলই বা কোথায়?
“তু-তুষারগুহায়
“তুষারগুহা? সে আবার কী? আচ্ছা দাঁড়াও। আগে কাঠ আনি, আগুন জ্বালি বড়ো করেখেয়েদেয়ে গরম হয়ে তারপর শুনব তোমার কথা।”

।। ।।

“কতদিন পরে মাংস খেলাম। দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়াদিদি, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” শানারার হেঁচকি থেমেছে। গরম আগুনতাতে তার মুখচোখের ফ্যাকাশে শীর্ণভাবের জায়গায় এখন লালচে আভা। জুনিয়ার খুব কাছে ঘেঁষে বসেছিল সে।
“এতদিন কী খাচ্ছিলে?” জুনিয়া খুব আস্তে প্রশ্ন করে।
“যখন ওরা সবাইকে নিয়ে গেল, তখন বাড়িতে খাবার ছিল তো, শুকনো। তাই খেয়ে চলছিল। সেগুলো যখন শেষ হয়ে গেল তখন বনের ফলটল, যা পেতাম। এই দু’দিন শুধু, মানে এত বরফে সব ঢেকে গেল যে। ফাঁদও পেতেছিলাম, জান।  কিন্তু কিচ্ছু পড়েনি ফাঁদে। আসলে এখনও ঠিকমতো শিখিনি তো। ভালো করে শেখার আগেই তো বাবাকে নিয়ে গেল।”
“কে নিয়ে গেল তোমার বাবাকে শানারা? কেন নিয়ে গেল?
শানারা সোজা হয়ে বসে এবার। জ্বলজ্বলে চোখদুটো বড়ো বড়ো করে তাকায় জুনিয়ার দিকে। চকচকে বাদামি মণিতে উজ্জ্বল কমলা আগুনের প্রতিচ্ছবি কেঁপে কেঁপে ওঠে। “তুমি জাব্রেকের নাম শুনেছ?
“না তো। কে সে? তোমার বন্ধু?
“না না না। তুমি কিচ্ছু জান না। জাব্রেক কারও বন্ধু নয়। জাব্রেক ভয়ংকর, ভয়ানক।”
শানারার অমন শিউরে ওঠা দেখে চমক লাগে জুনিয়ার। দু’হাত বাড়িয়ে সে আরও কাছে টেনে নেয় ছোট্ট নরম শরীরটাকে। “বেশ, বল তুমি জাব্রেকের কথাআমি শুনি।”
জুনিয়ার কোলের মধ্যে মাথাটা নিশ্চিন্তে নামিয়ে দেয় শানারা। তারপর বলতে থাকে। জুনিয়া অবাক হয়ে শোনে।
“এই যে আমাদের গ্রাম দেখছ, চেন্নান গ্রাম, তার একেবারে উত্তর মাথায় আছে আলমাহি পাহাড়। সে যে কী বিশাল উঁচু পাহাড় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সারাবছর তার মাথা বরফে ঢাকা। আজ পর্যন্ত কেউ তার চুড়োয় উঠতে পারেনি। শুনেছি, সেই পাহাড়ের ভেতরে আছে এক তুষারগুহা। আর তুষারগুহার অতলে আছে রত্নের খনি। সেখানে জাব্রেকের রাজ্য। ভয়ংকর, ভয়ানক জাব্রেক। আশপাশের সব গ্রাম জাব্রেকের ভয়ে কাঁপে। কেন জান?
“কেন?
“রত্নখনিতে কাজ করার জন্য লোক লাগে তো। সবাই তো জাব্রেক নয়। মাটির ওপরের মানুষ তুষারগুহার হিম সহ্য করতে পারে না বেশিদিন। আস্তে আস্তে ওখানেই জমে বরফ হয়ে যায়। চারদিকের বরফের মধ্যে আরও একটা বরফের স্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তুষারগুহায়। এমনি করে কমতে কমতে যখন আর কেউ থাকে না কাজ করার মতো, তখন জাব্রেক আবার ওপরে আসে দাস খুঁজতে। তার সঙ্গে আসে তুষারগুহার প্রহরীরা। তাদের দেখতে ঠিক মানুষের মতোই হলে কী হবে, শুনেছি তারা নাকি মানুষ নয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জমাট ঠান্ডা দিয়ে তৈরি তারাজাব্রেক ছাড়া তারা কাউকে জানে না, কাউকে মানে না। তাদের দিকে তাকালে শরীরের রক্ত জমে বরফ হয়ে যায়, যেখানে ছোঁয়া লাগে সেই জায়গাটা জমে অবশ হয়ে যায়।
“জাব্রেক আর তার ওই সাংঘাতিক প্রহরীরা মিলে এক একটা গ্রামের ছেলেমেয়ে, বুড়ো-বাচ্চা সবাইকে হিমের সুতো দিয়ে বোনা জালে বেঁধে নিয়ে যায় তুষারগুহায়। পশুপাখি কাউকে ছাড়ে না জাব্রেকযেখান দিয়ে সে চলে যায়, সেখানে তারপর আর কোনওদিনও রোদ ওঠে না। শুধু বরফের ঝড় বইতে থাকে শনশন। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ।”
“তোমাদের গ্রামেও বুঝি সে এসেছিল?
জুনিয়ার কোলের ভেতরে শানারার মাথা নড়ে, “এসেছিল।”
“সবাইকে নিয়ে গেল?
“গেল তো। আমার টগবগকেও ছাড়ল না।”
জুনিয়া এবার বোঝে, আস্তাবলে বস্তাভরা যব, কম্বল, বুরুশ কার সম্পত্তি ছিল। বুদ্ধিমতীর মতো এই প্রসঙ্গ নিয়ে সে একটি মন্তব্যও করে না। “তোমাকে নিল না যে বড়ো?
“আমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামের বাইরে পশ্চিমের নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। যখন ফিরলাম, তখন আর গ্রামে কেউ নেই। শুধু হাওয়া বইছে কনকনে। আস্তে আস্তে সাদা হয়ে যাচ্ছে মাঠঘাট, জমে যাচ্ছে সব কুয়ো, সব পুকুর। বুঝলাম, জাব্রেক এসেছিল। আমি এদিকে ভাবতে ভাবতে আসছি, মাকে না বলে অতদূরে গেছি, কত না বকুনি খাব। আমি কি জানি বল জুনিয়াদিদি, মার সঙ্গে আর আমার দেখাই হবে না?
আবার একটা ভেজা ভেজা হেঁচকি তোলে শানারা। জুনিয়া আস্তে আস্তে চুলভরা মাথাটায় বিলি কেটে দেয়। তার মনে একটা কিছু চিন্তা ঘুরছে।
“আচ্ছা শানারা, আমায় একটা কথা বলবে?
“কী কথা?
“এই জাব্রেককে কেউ কখনও আটকানোর চেষ্টা করেনি?
“ও বাবা, কী করে করবে? তার সঙ্গে যে সবসময় থাকে হিমসুতোয় বোনা জাল! তোমার ওপর একটিবার ফেলে দিলেই হয়ে গেল। তুমি না পারবে নড়তে না পারবে চড়তে। তখন জাব্রেক যা বলবে তোমায় তাই করতে হবে। আর ওই প্রহরীরা? ওরে বাবা।”
“জাল কাটা যায় না?
“যায়। কিন্তু তার জন্য লাগে আগুননদীর জল দিয়ে তৈরি তলোয়ার।”
“জলের তলোয়ার?
“হ্যাঁ গো। শুনেছি, শুধু তার কোপেই কাটা যায় জাব্রেকের হিমরশির জাল।”
“তবে, এতদিন কেউ তা করেনি কেন?
“আগুননদীর পথ যে ভীষণ কঠিনআর জল আনতে গেলেই তো হল না। আগুননদীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে একচোখো বোগামতাকে না হারিয়ে কেউ একফোঁটা জলও নিতে পারবে না। আমার দাদু, আহিরানই তো শুনেছি চেষ্টা করেছিলেন কম বয়েসে। পারেননি।”
জুনিয়া চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। তার কপাল কোঁচকানো, ঠোঁট চাপা।
“তুমি চেন আগুননদীর পথ?
শানারা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। জড়ানো গলায় সাড়া দেয় সে। “যাইনি কখনও, তবে জানি। দাদুর কাছে শুনে শুনে মুখস্থ।”
“আমাকে বলবে, কী করে যেতে হয়?
শানারা ধড়মড় করে উঠে বসে এবার। ঘুম পালিয়েছে তার “তুমি যাবে সেখানে জুনিয়াদিদি? সে যে ভীষণ কঠিন রাস্তা! কেউ পারে না।”
“না গেলে কী করে হবে বলএভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। এক কাজ কর শানারা। আজ বরং ঘুমিয়ে পড়কাল সকালে তুমি আমি আর রিশিন মিলে একটা উপায় বার করব ঠিক।”

।। ।।

রাত পেরিয়ে সকালটাও ঠিক আগেরদিনের মতোই ঘোলাটে ধূসর হয়ে এল। সূর্য যে কোথায় লুকিয়েছে সেই জানে। একঘেয়ে বরফ ঝরার কোনও বিরাম নেই। তবুও এরই মধ্যে তারা যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছিল। গরম ঘরের ভেতরে ঘুমিয়ে জুনিয়ার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। বেরোবার আগে সামান্য খাওয়াদাওয়াও করে নিয়েছে সে আর শানারা। বেঁচে যাওয়া সেঁকা মাংস কিছুটা খেয়ে আর বাকিটা থলিতে নিয়ে নিয়েছিল জুনিয়া। ওদিকে রিশিনও সারারাত বিশ্রাম পেয়ে চটপটে তাজা। তার পিঠে এখন দেড়জন সওয়ার। শানারাকে নিজের সামনে বসিয়ে নিয়েছিল জুনিয়া।
“আবার একবার বল আমায় শানারা, কী করে পৌঁছব আগুননদীর পাড়ে।”
“বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাইনবনকে ডানহাতে রেখে চলতে হবে যতক্ষণ না গ্রাম শেষ হয়। সেখানে দেখতে পাবে ভাঙা মন্দিরের চূড়া। মন্দির পেরোতে গেলে বাধা দেবে সোনালি ঈগলের দল। তাদের হারাতে পারলেই সামনে খুলে যাবে পাতালসিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নামলে পাবে পথভোলানির মাঠ। সেই মাঠের শেষে আছে একচোখো বোগামের কামারশালা। তার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে আগুননদী।” শানারা গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেতে থাকে। বোঝাই যায়, এ পথের নির্দেশ সে অনেকবার শুনেছে
“বেশ, তাহলে সেদিকেই যাওয়া যাক।” রিশিনের পেটে হালকা রেকাবের চাপ দেয় জুনিয়া। শিক্ষিত রিশিনকে বেশি বলতে হয় না। অল্প ইঙ্গিতই তার জন্য যথেষ্ট।
জুনিয়া আর শানারাকে পিঠে নিয়ে বিশাল ডানাজোড়া মেলে দেয় রিশিন। আজ তার ডানায় এখনও বরফ জমেনি। কিছুটা দূরত্ব অন্তত সে উড়ে যেতে পারবেই। তার গোটানো পায়ের নিচে তুষারমোড়া পৃথিবীটা সাদা সমুদ্রের মতো দেখাচ্ছে এখন। ডানদিকে পাইনের বনও বরফে সাদা। লম্বা লম্বা বরফঢাকা হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি দিয়ে।
বেশি উঁচুতে ওঠে না রিশিন। পাইনবনের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়তে থাকে। তার চোখ বাঁদিকে ভাঙা মন্দিরের চুড়ো খুঁজছে। ছায়া ছায়া বিরাট কী যেন একটা দূরে উঁচু হয়ে আছে। হয়তো ওটাই সেই চুড়ো। ডানার ঝাপট বাড়ায় রিশিন। ওড়ে ওই ছায়া লক্ষ্য করে।
“মন্দিরের সামনে কি নামতে হবে শানারা?” জুনিয়া জানতে চায়।
“বাহ্‌ রে, তা তো হবেই। নইলে সিঁড়ি পাবে কী করে?” জুনিয়ার বোকামিতে ভারি অবাক হয় শানারা
“ও হ্যাঁ, তাও তো ঠিক।” জুনিয়া হাত দিয়ে অনুভব করে দেখে নেয় তার কোমরের তলোয়ার, পিঠের ধনুক, তূণীর সব ঠিকঠাক আছে কি না।
সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল জুনিয়া। পায়ের তলা থেকে কখন বরফঢাকা চেন্নান গ্রাম পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করেনি সে। রিশিনের তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনিতে চমক ভাঙেমুখ তুলতেই তীব্র রোদের জ্যোতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই চারদিক থেকে অনেকগুলো ধারালো নখ আর ঠোঁট ঘিরে ফেলে তাকে। কাদের যেন শক্ত ডানার ঝাপটে প্রায় পড়ো পড়ো অবস্থা হয় তাদের দু’জনেরই।
“ঈগল, ঈগল! ভাঙা মন্দিরের সোনালি ঈগল। যেতে দেবে না আমাদের।” চিৎকার করে ওঠে শানারা। প্রাণপণে রিশিনের কেশর মুঠোতে আঁকড়ে রেখেছে সে।
রিশিন ডাইনে বাঁক নেয়, বাঁক নেয় বাঁয়ে। নাছোড় পাখিগুলো তার সঙ্গ ছাড়ে না। ক্রমাগত ঠোক্কর দিতে থাকে গায়ে, মুখে। চোখ খুবলে নেওয়ার চেষ্টা করে সমানে। এত ঝটাপটির মধ্যে নিজেকে রিশিনের পিঠে বসিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছিল জুনিয়ার, তলোয়ার বার করবে কী। কোনওরকমে নিজেকে বাঁচাচ্ছিল সে।
হঠাৎই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। “শানারা, শানারা, শিগ্গির, শিগ্গির। আমার থলি, আমার থলিটা তোমার কাঁধেই ঝোলানো তো।”
শানারা রিশিনের ঘাড়ে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল সেখান থেকেই কোনওমতে ঘাড় ঘুরিয়ে চায়। “থলিতে কী?
“থলিতে সেঁকা মাংসের টুকরো আছে না? সাবধানে বার করতে পারবে?
“পারব। তারপর? এখন তুমি মাংস খাবে নাকি?” শানারা বিস্ময় চাপতে পারে না।
“আমি খাব না। মাংসের টুকরোগুলো ছুঁড়ে দাও নিচে। যত পার, যত দূরে পার
শানারার চোখ বড়ো হয় একবার। তারপর মাথা নাড়ে সে। বুঝেছে শানারা জুনিয়া কী করতে চায়।
ঈগলগুলোর দলবাঁধা আক্রমণ হঠাৎই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমে একজন, তারপরে আরও একজন, তারপর গোটা দলটাই গোঁৎ খেয়ে নিচের দিকে ঝাঁপ দিল। প্রত্যেকের লক্ষ্য আকাশ থেকে ঝরে পড়তে থাকা বড়ো বড়ো মাংসের টুকরো। অন্য কোনওদিকে মন দেওয়ার তাদের এখন আর ইচ্ছে নেই।
ভাঙা মন্দিরের সামনের ফাঁকা চাতালে সাবধানে রিশিনকে নামিয়ে আনে জুনিয়া। ঠিক তাদের সামনেই হাঁ হাঁ করছে এক বিশাল গহ্বর। তার তল দেখা যায় না। সে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে নেমে গেছে বিশাল চওড়া পাথরের সিঁড়ি। জুনিয়ার হাতশক্ত করে আঁকড়ে ধরে শানারা। “নামবে, জুনিয়াদিদি?
“অবশ্যই।”
একহাতে শানারার হাত আর অন্য হাতে রিশিনের লাগাম ধরে সিঁড়িতে পা রাখে জুনিয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ভেতর থেকে তাদের দিকে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত নীলচে আলোর ফুলকি। যেখানেই ছোঁয়া লাগে চিড়বিড় করে ওঠে। রিশিন পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায় তাদের এড়াতে, কিন্তু তারা সংখ্যায় বাড়তেই থাকে। শানারা ছটফট করতে থাকে জুনিয়ার পাশে। জুনিয়ার নিজেরও সমস্ত শরীর আগুনের মতো জ্বলছিল।
“জুনিয়াদিদি, দেখ, দেখওইদিকে।” শানারা হঠাৎ ফিসফিস করে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করছে সিঁড়ির বাঁদিকে। জুনিয়া ভালো করে দেখে। সত্যিই তো। তারা যেদিক দিয়ে নামছে সেদিকে আলোকণা থিকথিক করছেকিন্তু শানারার দেখানো দিকটায় কোনও ফুলকিই নেই। একটু ভাঙাচোরা বেশি ওদিকের সিঁড়িটা, তা ঠিক। দু’দিকের মাঝখানে একটা মস্ত বড়ো ফাঁকও আছে। তবুও, একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখাই যায়। এদিকে তো আলোর কণাগুলো দাঁড়াতেই দিচ্ছে না।
“লাফাতে হবে কিন্তু। পারবে তো?
“পারব,” শানারার গলায় ভরপুর আত্মবিশ্বাস। জুনিয়ার হাত ছাড়িয়ে নেয় সে।
প্রথমে শানারা, তারপর জুনিয়া, সবশেষে রিশিন লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায় ফাঁকটা কী আশ্চর্য, আলোর কণাগুলো আর তাদের তাড়া করে আসে না! গায়ের জ্বালা কোথায় মিলিয়ে যায়। এমনকি যতটা অন্ধকার মনে হয়েছিল ততটা অন্ধকারও আর লাগে না সুড়ঙ্গটা। হালকা একটা আভা মনে হয় যেন পুরো সুড়ঙ্গটা জুড়ে ছড়িয়ে আছেতারই মধ্যে সাবধানে নামতে থাকে তারা তিনজন। কত ধাপ যে নামে তার হিসেব নেই কোনও। অনাদি অনন্তকাল ধরে যেন তারা তিনজন নেমেই চলেছে। একেবারে পৃথিবীর গভীরতম কেন্দ্রে গিয়েই বুঝি থামবে সেই নামা।
“দিদি
হঠাৎ শানারার চাপা গলার ডাক শুনে এগিয়ে যায় জুনিয়া। “কী হল?
“এটা কী, দেখ তো।” শানারার পায়ের ঠিক সামনে পড়ে আছে একটা গোল বলের মতো কী যেন। গোলাপি আলো বেরোচ্ছে সেটা থেকে। জুনিয়া হাঁটু মুড়ে নিচু হয়। আর তক্ষুনি বলটা লাফিয়ে উঠে আসে তার হাতে।
জুনিয়া চমকে প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল জিনিসটা। কোনওমতে দু’হাতে বলটাকে সামলে ধরে সে। কী যেন নড়াচড়া করছে বলটার ভেতর। গুনগুন আওয়াজও আসছে একটা। আলতো করে বলটা কানের কাছে ধরে জুনিয়া। স্পষ্ট গলায় কে যেন কথা বলছে বলের ভেতর থেকে। শাঁখের মতো গম্ভীর কিন্তু মিষ্টি গলা। জুনিয়া আলো ছড়ানো গোলকটাকে আরও ভালো করে কানে চেপে ধরে।
 “দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া, অভিনন্দন! অত্যাচারী জাব্রেকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম ধাপ পার করেছ তুমি। কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি। সে পথে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া, হয়তো তোমার কাজে লাগতে পারি আমি।”
“আপনি, আপনি কে?
“আমি কে সেটা না হয় এখন অজানাই থাক। ধরে নাও আমিও ওই ছোট্ট শানারার মতোই জাব্রেকের অত্যাচারের শিকার। আমিও চাই তার বিনাশ।” শাঁখের মতো গলাটা গমগম করে বাজে।
“বেশ, তবে তাই হোক।” জুনিয়া বলটাকে থলিতে ঢোকাতে যায়।
“না জুনিয়া, না। থলির ভেতরে বন্দী করে নয়, তোমার হাতে ধরে রাখ আমাকে। না হলে ঠিকঠাক পথ দেখাব কী করে?
গোলক হাতে উঠে দাঁড়ায় জুনিয়া। অবাক হয়ে দেখে, তাদের ঠিক সামনেই শেষ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। ফুরিয়ে গেছে সিঁড়ির ধাপ।
সুড়ঙ্গের বাইরে যতদূর চোখ যায় ধু ধু করছে সবুজ মাঠ এক। কোথায় তার শুরু, কোথায় শেষ, কিছুই বোঝা যায় না। একইরকম গাছে ভরা ক্রোশের পর ক্রোশ। না আছে ঢোকার পথ, না বেরোনোর রাস্তা।
হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলে জুনিয়া। কী করে পেরোবে তারা এই পথভোলানির মাঠ? অথচ মাঠ না পেরোলে আগুননদী যে অধরাই থেকে যাবে। জেদ করে শানারাকে এত দূর নিয়ে এসে শেষটায় হেরে যেতে হবে?
গোলাপি আলোর গোলক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিল জুনিয়া। শানারাও চুপ করে দাঁড়িয়েছিল তার পাশে। মুখে কথা নেই। সেও হয়তো মনে মনে একই কথা নিয়ে চিন্তা করছিল।
হাতের পাতাটা গরম গরম ঠেকছিল কিছুক্ষণ ধরেই। সেটা খুব বেড়ে ওঠাতে হাতের দিকে তাকাতে বাধ্য হল জুনিয়া। অবাক হয়ে দেখল গোলাটা এখন পুরোপুরি আলোতে পালটে গেছে। উজ্জ্বল, তীব্র গোলাপি আলো। গমগমে শাঁখের আওয়াজ আবার ভেসে এল ওই আলোর গোলা থেকে। “আমার রশ্মিকে অনুসরণ করে চল দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। শুধু আমার আলোর রেখায় পা ফেলে চলবে তোমরা তিনজনেই। পা যেন রশ্মিরেখার এতটুকু বাইরে না পড়ে। তাহলে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না তোমাদের। এগোও জুনিয়া। তোমাকে অনুসরণ করে আসুক ওরা।”
“আর আমরা সবাই যদি একসঙ্গেই চলি? রিশিনের পিঠে?
“বেশ। তাই চল
সরু একটা গোলাপি আগুনের রেখা সেই মুহূর্তে সোজা এগিয়ে গেল মাঠের দিকে। জুনিয়া অবাক হয়ে দেখল গাঢ় সবুজের দেওয়াল অনায়াসে ভেদ করে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা পথ। বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে রিশিনকে ওই গোলাপি আলোর পথের দিকে চালিয়ে দেয় জুনিয়া।
খুব মন দিয়ে আলতো করে আলোর দাগে দাগে পা ফেলছিল রিশিন। আলো-পথের দু’পাশে জমাট সবুজ অন্ধকার। সেখান থেকে কীসব যেন ছায়াটে আঙুল বাড়াচ্ছিল। টেনে নিতে চাইছিল তাকে আলোকরেখার বাইরে। সবই টের পাচ্ছিল রিশিন। গা কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার। তবু সে মুহূর্তের জন্যও ভোলে না তার দায়িত্ব, লহমার জন্যও দিকভ্রান্ত হয় না।
রিশিনের পিঠে প্রায় দমবন্ধ করে বসেছিল জুনিয়া আর শানারা। ডানহাতটা বাড়িয়ে রাখতে রাখতে কাঁধ টনটন করছিল জুনিয়ার। তবু সে বসেছিল স্থির, অচঞ্চলযেন হাত না নড়ে, যেন রেখা বেঁকে না যায়।
কে জানে সে কতক্ষণ পরে যেন মনে হল সবুজ অন্ধকার কেটে আলো দেখা দিয়েছে তাদের সামনে। হাতের পাতায় গোলাপি রেখার তেজও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। তবে কি সত্যি তারা পেরিয়ে এল পথভোলানির মাঠ?
“ওই সামনে একচোখো বোগামের কামারশালা, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া।” শাঁখ-স্বর আবার বাজে, তবে এবার অনেক নরম।
“তার সঙ্গে কি যুদ্ধ করতে হবে আমাকে? তাকে হারাতে পারলে তবেই পৌঁছব আগুননদীতে?” ক্লান্ত জুনিয়া প্রশ্ন করে।
“না। যা রটে তার সবটাই ঘটে না। বোগাম এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে তার কামারশালায় আগুননদীর জলের তলোয়ার গড়বে বলে। আজ পর্যন্ত কেউ এসেই পোঁছয়নি যে তার কাছে। শুধু গুজব রটেছে তার নামে। বোগাম হিংস্র, বোগাম দানব, আরও কত কী। সত্যিটা যে কেউ জানেই না। চল জুনিয়া, সময় নষ্ট কোরো না।”
“কিন্তু আমার দাদু যে বলেছিলেন...” শানারার কথা শেষ হয় না। গোলক আবার দপ করে জ্বলে ওঠে।
“তোমার দাদু এই পর্যন্ত এসে পৌঁছননি, আইরানকন্যা শানারা। পাতালসিঁড়ি থেকেই তিনি ফিরে যান। বাকি যা, সব তাঁর শোনা কথা। দেখেননি কিছু নিজে। চোখ কান দুটো নিয়েই চলতে হয় আইরানকন্যা, কেবল একটার ওপর ভরসা করে চললে ঠকার সম্ভাবনা।”
কেউ একজন এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে। লম্বাচওড়া মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তার বলশালী দেহ, চওড়া কাঁধ। একটি চোখের ওপর কালো কাপড়ের ফেটি বাঁধা। জুনিয়া সতর্ক হয়ে তলোয়ারের বাঁটে হাত রাখে।
“অভিবাদন! পথভোলানির মাঠ নির্বিঘ্নে পেরিয়ে এসেছ, কে তোমরা?” রিশিনের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করে ব্যক্তিটি।
“আগে বলুন, আমরা কার সঙ্গে কথা বলছি
“আমি একচক্ষু বোগাম। অস্ত্র নির্মাণ করি। ওই অদূরেই আমার কামারশালা।”
জুনিয়া নিজের ও সঙ্গীদের পরিচয় দেয়। শুধু আলোক-গোলকের পরিচয়টুকুই সে দিতে পারে না, কারণ সে পরিচয় তার নিজেরই জানা নেই। তাকে অবাক করে গোলক অকস্মাৎ নিজেই কথা বলে ওঠে।
“কেমন আছ হে, বোগাম? আমার গলা ভুলে যাওনি আশা করি।”
বোগামের একটিমাত্র চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। অতবড় শরীরটা নিয়ে সে দ্রুত নতজানু হয়ে বসে। “আপনি?
“আমি। আমিই। এদের সাহায্য কর বোগাম। তাহলেই মুক্তি।”
“যে আজ্ঞা, প্রভু।”
এই অদ্ভুত কথাবার্তার অর্থ জুনিয়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে শুধু একবার নিজের হাতে ধরা গোলকের দিকে আর একবার বোগামের দিকে চাইতে থাকে। বোগাম ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে আবার। জুনিয়াকে ইঙ্গিত করে সে, অনুসরণ করার জন্য।
“সঙ্গীদের নিয়ে আমার পেছনে পেছনে এস, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। আগুননদীর জল সংগ্রহ করতে হবে।”
“আগে কিছু খেলে হত না? বড্ড খিদে পেয়েছে যে! মাংসগুলোও জুনিয়াদিদি ঈগলদের খাইয়ে দিল।” শানারা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।
বোগামের কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফের ফাঁকে হালকা হাসি খেলে যায়। “বেশ, তবে আগে আমার কামারশালা, তারপরে আগুননদী।”

।। ।।

অনেকক্ষণ ধরেই একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসছিল জুনিয়ার। কাছেই কোথাও যেন খুব জোরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তারা যেখানে বসে আছে, সেই বোগামের কামারশালার সামনে কিন্তু ঝড়-টড় কিছুই নেই। গাছের পাতায় স্বাভাবিক হাওয়ার দোল। অথচ আওয়াজ হয়ে চলেছে একনাগাড়ে। শানারা ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে। রিশিন ঘাস খাচ্ছে সামনের মাঠে। কারোরই কোনও বিকার নেই। কিন্তু সেই তখন থেকে হাওয়ার একটানা ফোঁসানিতে জুনিয়ার কানে তালা লাগার উপক্রম। আর না পেরে বোগামকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলে সে। “একটা আওয়াজ হচ্ছে না? ও কীসের আওয়াজ অমন একটানা?
“শুনতে পাচ্ছ বুঝি? দেখবে? তবে চল” উঠে দাঁড়ায় বোগাম। দেওয়ালের কুলুঙ্গি থেকে কী যেন নিয়ে ঝোলায় পোরে।
“ও কী নিলেন, বোগাম?
“ওটা? সিসের বোতল। আগুননদীর জলকে তো সাধারণ বোতলে ভরা যায় না জুনিয়া। সিসের বোতল ছাড়া সে জলকে ধরে রাখাও যায় না।”
কথা বলতে বলতে তারা হাঁটছিল। আওয়াজও বাড়ছিল ক্রমশই। একটা মোড় ঘুরতেই আওয়াজটা ফেটে পড়ল যেন। জুনিয়াও দাঁড়িয়ে পড়ল ওখানেই। বিস্ময়ে ও কিছুটা আতঙ্কে তার বুক ধকধক করছিল।
আগুন। দাউদাউ করে আগুন বয়ে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। কী সাংঘাতিক স্রোত তার, কী জোর শিস! এই আগুন তাকে ভরে নিতে হবে বোতলে? এ তো অসম্ভব কাজ।
“কী হল, ভয় পেলে নাকি?” বোগামের গলায় চাপা হাসি। জুনিয়ার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। ওই ভয়ংকর আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথা কাজ করছিল না।
“আচ্ছা, একটা কথা বল তো। এই যে এত এত আগুন, তুমি তো তার পাশটিতেই দাঁড়িয়ে আছ। আঁচ লাগছে কি? গরম-টরম?
জুনিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করে সত্যি সে আগুনের কোনওরকম তাপই টের পাচ্ছে না। আরও গুলিয়ে যায় তার। এ রহস্য বোঝার আশায় সে বোগামের দিকে তাকায়।
“এ আগুনে তাপ নেই জুনিয়া। এ জাদু-আগুন। সত্যের, ন্যায়ের আগুন। এই আগুনের একটা ফুলকিতে সব অন্যায়, সব মিথ্যেকে পুড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সৎকে, ন্যায়ের পথে চলা মানুষকে এ আগুন এতটুকু পোড়ায় না। হাত দিয়ে দেখ না নিজেই।”
বলে কী লোকটা! পাগল নাকি! জুনিয়া দু’পা পিছিয়ে যায় নিজের অজান্তেই।
“ভয় পেলে হবে না, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। ও আগুনকে বোতলবন্দী তোমাকেই করতে হবে। তুমি কথা দিয়েছ শানারাকে। অত্যাচারীকে হারাতে হলে ও আগুনে হাত তোমায় ডোবাতেই হবে জুনিয়া। ও কাজ আমার নয়। আমি শুধু তরবারি গড়ে দিতে পারি।”
জুনিয়ার মুখচোখ দেখে বোধহয় বোগামের মায়া হয় এবার। সে গলা নরম করে পরের কথাগুলো বলে। “ভয় নেই জুনিয়া। তুমি সত্যের পথে না চললে, সাহসী না হলে এতদূর এসে পৌঁছতেই পারতে না। কতজন তো চেষ্টা করেছে তোমার আগেও, কই, পারেনি তো। তুমি পারবে জুনিয়া, বলছি আমি। নাও, হাত বাড়াও। এই বোতলে ভরে নাও দেখি আগুননদীর জল।”
নিরুপায় জুনিয়াকে হাত পেতে বোতল নিতেই হয়ধীরে ধীরে এগোয় সে নদীর কাছে, আরও কাছে। অনেকখানি ঝুঁকে বোতলটা নিয়ে যায় সে আগুনস্রোতের ঘূর্ণির কাছে। অবাক হয়ে দেখে জুনিয়া, কীভাবে নীল-কমলা আগুনের ধারা নিজে থেকেই ঢুকে যাচ্ছে তার হাতে ধরা বোতলের ভেতর। তার হাতে গরম তো লাগেই না, বরং সারাটা শরীর এক অসম্ভব শক্তিতে চনমন করে ওঠে। সিসের বোতলের গলা পর্যন্ত আগুন ভরে সে উঠে দাঁড়ায়, ফিরে তাকায় বোগামের দিকে।
বোগাম তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। হাসিমুখে ছিপিটা বাড়িয়ে দেয় সে। “এই নাও। এঁটে ফেল মুখটা। এবার বাকি কাজ আমার আজ রাতে ভালো করে বিশ্রাম নাও জুনিয়া। কাল তোমার অনেক পরিশ্রমের দিন।”
“একটা কথা।”
“বলো।”
“ওই গোলাপি আলোর গোলা, ও কী আপনি জানেন তাই না?
“জানি, কিন্তু বলার অধিকার নেই। সময় হলে তুমিও জানবে। এখন চল

গভীর ঘুম থেকে জেগে হকচকিয়ে যায় জুনিয়া। কোথায় আগুননদী, কোথায়ই বা বোগামের কামারশালা। এ তো কঠিন বরফে মোড়া এক পাহাড়ের চূড়ায় এক তাঁবু। এখানে কী করে এল সে? নিজের দিকে তাকিয়ে তার বিস্ময় আরও বেড়ে যায়। এমন পুরু সারা গা ঢাকা লোমের পোশাক, এমন হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চামড়ার জুতো, এসব কোথা থেকে এল তার গায়ে? এদিক ওদিক তাকায় জুনিয়া। অবাক হয়ে দেখে তার পাশটিতে ঘুমন্ত শানারার পরনেও একইরকমের জামাকাপড়।
“অবাক হচ্ছ? হওয়ারই কথা।”
তাঁবুর ভেতরটা হঠাৎ গোলাপি আলোয় ভরে যায়। শাঁখস্বর বেজে ওঠে নরম, গম্ভীর। জুনিয়া তাকিয়ে দেখে তার ডানহাতের তালুতে জ্বলজ্বল করছে আলোর বলখানা
“ওদিকে দেখ
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঘোরায় জুনিয়া। বিদ্যুতের মতো উজ্জ্বল একটা ঝলকানি এক লহমার জন্য তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তারপরেই সে বোঝে ওটা বিদ্যুৎ নয়, ওটা আগুনধারার তলোয়ার।
“ভাবছ তো, ওখান থেকে এখানে এলাম কী করে? সহজ উত্তর জুনিয়া। আগুননদীর জলের তলোয়ার পেয়েছ যে তুমি। তোমার ইচ্ছেয় ও তলোয়ার কাজ করবে না জুনিয়া, তোমাকেই ওর আদেশ মেনে চলতে হবে। ও জানে ওর প্রয়োজন কোথায়, তাই তোমাকে ও নিয়ে এসেছে আলমাহি পাহাড়ের শিখরে। ঠিকঠাক পোশাকআশাক পরিয়ে। জাব্রেকের তুষারগুহা যে এই আলমাহি পাহাড়েই। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও জুনিয়া।”
জুনিয়ার বুকের ভেতর একটুখানি কেঁপে ওঠে। সে পারবে তো? তারপরেই সব অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে দেয় সে মুঠো করে ধরে আগুননদীর জলের তলোয়ারের বাঁটখানা।
“আমি প্রস্তুত

।। ।।


শানারাকে কিছুতেই তাঁবুতে রেখে আসা গেল না। অগত্যা তাকে সঙ্গে নিয়েই তুষারগুহার পথে চলে জুনিয়া। পাহাড়ের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তারা। প্যাঁচালো জটিল হিমশীতল বরফের সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে তারা এগোচ্ছিল জাব্রেকের তুষারগুহার দিকে। পায়ের নিচে বরফ, মাথার ওপরে বরফ, বরফ দু’পাশের চেপে আসা দেওয়ালে। রিশিনের ডানা এখানে কাজে লাগবে না। সে সাবধানে মসৃণ বরফের ওপর পা ফেলে ফেলে আসছিল জুনিয়ার পেছন পেছন। জুনিয়ার হাতে আগুনজলের তলোয়ার, গলায় মালা করে ঝোলানো আলোর গোলা।
“সামনে বিপদ জুনিয়া। বুদ্ধি খাটাতে হবে।” শাঁখস্বর ফিসফিস করে।
জুনিয়া থামে। তার ঠিক সামনেই এপার ওপার দেখা যায় না এমন এক অতলকালো হ্রদ। “পার হব কেমন করে?
“আমার আলোর দিকে তাকিয়ে দেখ গোলাপি আলো জোরালো হয়। জুনিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বচ্ছ গোলাপি আলোয় তৈরি এক পুল। “ওর ওপরে পা দিয়ে দিয়ে যাও জুনিয়া। সাবধান, টাল খেলে কিন্তু আর উঠতে পারবে না।”
“শানারা? পারবে?
উত্তর দেয় না শানারা। মুখ শক্ত করে পা রাখে আলোর পুলে। টলমলিয়ে ওঠে পুল, দুলে ওঠে এ মাথা থেকে ও মাথা। জুনিয়ার বুকের ভেতর হৃৎপিন্ড একটা ডিগবাজি খেয়ে আবার চলতে শুরু করে। মাঝপথে পৌঁছে একবার থামে শানারা। পেছনে তাকাতে চেষ্টা করে।
“থেমো না, থেমো না। পেছনে চেয়ো না। পেরিয়ে যাও শানারা, পুল পেরিয়ে যাও” জুনিয়ার চিৎকার শানারার কানে পৌঁছয় কি না সেই জানে। আবার হাঁটতে শুরু করে সে। পায়ে পায়ে পেরিয়ে যায় বাকি পথটুকু।
“এবার তুমি, জুনিয়া। রিশিনের পিঠে বোসো।”
রিশিনের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। দু’বার পুলের দিকে এগিয়েও পিছিয়ে আসে সে। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে তার, গায়ে ঘাম। জুনিয়া নিজের ভয় চেপে রিশিনের পিঠে হাত বোলায়। “ভয় কী রিশিন? আমি আছি তো।”
রিশিন এবার খুব সন্তর্পণে পা দেয় আলোর পুলে। জুনিয়ার শক্ত হাত তার লাগামেএকটিবার শুধু পেছনে চেয়েছিল জুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সে। আলোর রেখায় গড়া পুল শুধু তার সামনেই। রিশিনের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাচ্ছে পেছনে পুলের আলো পেরিয়ে আসা পথকে ঢেকে ফেলছে অন্ধকার।
হ্রদ পেরিয়েও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। দম নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। জুনিয়ার হাতে টান দেয় তলোয়ার, যেন বলে, চল চল, সময় নষ্ট করার সময় নেই।
রিশিনের ডানা এতক্ষণ মুড়ে রেখে রেখে টনটন করছিল। সে ডানা সামান্য ঝাড়া দেবে বলে কাঁধ উঁচু করতেই গুহার দু’পাশের দেওয়ালে তার ডানার আগাদুটি ঘষা খায় এবং কেউ কিছু বোঝার আগেই ছাদ থেকে ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়তে থাকে অজস্র ধারালো তুষারশলাকা। যার যে কোনও একটি তাদের গায়ে ঠেকলেই মৃত্যু অনিবার্য।
জুনিয়া নিছক আত্মরক্ষার তাগিদেই ডানহাতটি উঁচু করে তোলে। তার খেয়ালও ছিল না যে ওই হাতেই ধরা রয়েছে আগুননদীর তলোয়ার। সে অবাক হয়ে দেখে কীভাবে তলোয়ারে সঙ্গে ঠেকতেই ছ্যাঁৎ শব্দে বাষ্প হয়ে যেতে থাকে শলাকাগুলি। জুনিয়া প্রাণপণে চক্রের মতো ঘোরাতে থাকে তার তলোয়ার। একে একে জল হয়ে, বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায় সমস্ত শলাকা।
হঠাৎই এক প্রবল হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে সুড়ঙ্গ। “কে প্রবেশ করেছে তুষারগুহায়? কার এত বড়ো সাহস যে জাব্রেকের রত্নভান্ডারে ঢুকতে চায়? কে নিমন্ত্রণ দিয়েছে নিজের মৃত্যুকে?
“আমি জাব্রেকআমি। এই রত্নভান্ডারের আসল অধিপতি। মিহারুম। যাকে অন্যায় জাদুবলে পরাজিত করে তুমি নিজেকে আজ এই অতুল ঐশ্বর্যের মালিক মনে করছ।”
জুনিয়া হতবাক হয়ে দেখে তার হাতে ধরা গোলা এখন গনগনে লাল। গোলা থেকে বেরোনো স্বর এখন মেঘগর্জন হয়ে ফেটে পড়ছে।
“মিহারুম? হা হা হা... এখনও শিক্ষা হয়নি? শরীর নেই, রাজ্য নেই, তবুও ঔদ্ধত্য যায়নি তোমার, রাজা মিহারুম? স্ফটিকগোলকে বন্দী রাজা এসেছ শক্তিমান জাব্রেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে? হা হা হা... বেশ, তবে দেখি কত ক্ষমতা তোমার। হা হা হা হা...”
ব্যঙ্গের হাসিটা গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। শানারা নিজেকে গুটিয়ে কুন্ডলী করে ফেলে রিশিনের আড়ালে। কাদের যেন ভারী পায়ের শব্দ শোনা যায়। শব্দটা অদ্ভুত। যেন প্রতিবার পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কাচ ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে ঝনঝন করে। জুনিয়া সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করে।
ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে কী একটা। মানুষের মতো, কিন্তু মানুষ নয়। মানুষের আকৃতি, কিন্তু স্বচ্ছ বরফ দিয়ে গড়া যেন। আরও, আরও আসে ওই যে। দলে দলে হিমজমাট, ওরা কারা?
“তুষারগুহার প্রহরী। ছুঁয়ে দিলেই শেষ।” শানারার গলা কাঁপছে
জুনিয়া কীরকম স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শানারার কথায় তার চেতনা ফেরে। তার হাতের মধ্যে তলোয়ার ছটফট করছে। প্রায় লাফিয়েই তার শিখা স্পর্শ করে প্রথম প্রহরীকে। হুশশ করে একটা শব্দ। জুনিয়া অবাক হয়ে দেখে বস্তুটা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পেছনের সারির প্রহরীরা তবুও এগিয়ে আসছিল। ওদের বোধ নেই, বুদ্ধি নেই, চিন্তা করার মতো মস্তিষ্কও নেই। ওরা শুধু জানে জাব্রেক আর তার আদেশ। সেই আদেশ পালন করতেই এগোচ্ছিল ওরা।
জুনিয়ার হাতের তলোয়ারখানা যেন জীবন্ত। একটা চক্রের মতো ঘুরছিল সেটা। সেই সঙ্গে ঘুরছিল মিহারুমের শরীর থেকে বেরোনো আলোর রেখা। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে ছিল হিমশীতল মৃত্যুদূতের সারি, সেখানে এখন শুধু কিছু জলের ধারা। গলে, পুড়ে উবে গেছে ওরা সবাই।
“কে তোমার সঙ্গে, মিহারুম? কাকে নিয়ে এসেছ? এত শক্তি তো তোমার নেই।” জাব্রেকের গলায় ক্রুদ্ধ গর্জন।
“আমার সঙ্গে আছে সত্য, জাব্রেক, আমার সঙ্গে আছে ন্যায়। আমার সঙ্গে আছে আগুননদীর জলের তলোয়ার।”
“না। কক্ষনও না। এ হতে পারে না। এ অসম্ভব।”
“সাবধান!” হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে শানারা।
কথা বলতে বলতেই আড়াল থেকে একখানা মস্ত জাল ছুঁড়ে দিয়েছে জাব্রেকহিমহিম, ধোঁয়া-ধোঁয়া সে জাল আর একটু হলেই তাদের সবাইকে ঢেকে দিত। ভাগ্যিস শানারার চিৎকারে চমকে উঠে তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেছিল জুনিয়া, জাল এসে ঠেকেছে তারই ডগায়। টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ছিল জাব্রেকের হিমজাল, কালো কালো ছাইয়ের গুঁড়ো হয়ে
জাব্রেকের আর্তনাদ গুহা ফাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তারই সঙ্গে যোগ হচ্ছিল আরও নতুন কিছু শব্দ। যেন অসংখ্য মানুষের কন্ঠস্বর।
“ও কীসের শব্দ জান, জুনিয়া?” জুনিয়া প্রচন্ড চমকে দেখল তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ। চমক সামলে ক্ষিপ্র হাতে তলোয়ার চালায় সে ধারালো ডগা ঠেকায় পুরুষের গলার নিচে।
“তুমি, তুমিই জাব্রেক?
“শান্ত হও, শান্ত হও জুনিয়া। তলোয়ার সরাও।” হাসে পুরুষটি।
এ তো সেই শঙ্খস্বর! জুনিয়া নিজের গলার দিকে তাকায়। মালায় ঝুলন্ত সেই আলোর গোলকটি কোথায় গেল?
“হিমজাল কাটার সঙ্গে সঙ্গেই জাব্রেকের জাদু শেষ হয়ে গেছে জুনিয়া। ওই শোন তার রত্নগুহার দাসদের স্বর। এতদিন যারা বরফ হয়ে জমে ছিল এই গুহার কোণায় কোণায়, আজ সবাই তারা আবার জেগে উঠেছে। ওই দেখ শানারাকে।”
জুনিয়া ভুলেই গিয়েছিল শানারার কথা। ওই তো এক যুবা শানারাকে কোলে তুলে নিয়েছে তাদের দু’জনকেই জড়িয়ে রয়েছে এক তরুণী। সকলেরই চোখে জল, মুখে হাসি।
“আমি মিহারুম, জুনিয়া। এই রত্নখনি, এই রাজ্য আমারই ছিল। আমার রত্নেরও প্রয়োজন ছিল না, দাসেরও না। তাই এই পাহাড়, এই খনিকে আমি ফেলে রেখেছিলাম অবহেলায় কখনও প্রহরাও দিইনি। সেই সুযোগ নিয়েছিল ওই জাব্রেকদুরন্ত লোভ তাকে এই খনির মালিকানা পেতে প্ররোচিত করেছিলযুদ্ধে আমাকে সে পরাজিত করতে পারবে না জানত তাই অন্যায় উপায়ে, জাদুবিদ্যার সাহায্যে আমাকে হারিয়েছিল সে। আমার আত্মাকে ভরে রেখেছিল এই স্ফটিক গোলকের মধ্যে। যা আজ চূর্ণ হয়ে গেছে ওই হিমজাল কাটার সঙ্গে সঙ্গেই।”
“আর জাব্রেক? তার কী হল?
“সেও শেষ। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তৈরি হয়েছিল ওই জাল। জাল শেষ, জাব্রেকও। ধন্যবাদ তোমাকে, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া।” মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করেন মিহারুম।
“ধন্যবাদ। আমাদের শানারাকে আমাদের কোলে আবার ফিরে পেয়েছি তোমারই জন্য, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। আমরা তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।”
জুনিয়ার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসেছে আইলান আর তাসি। লালচুলো শানারা দাঁড়িয়ে আছে একমুখ হাসি নিয়ে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে কান নাড়ছে ছটফটে বাদামি এক ঘোড়া। ভারি অপ্রতিভ হয়ে পড়ে জুনিয়া, বড্ড লজ্জা করে তার।
সে তো শুধু দক্ষিণদ্বীপের পথ খুঁজে চলেছে। পেলেই ফিরে যাবে নিজের দেশে
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল

2 comments:

  1. বেশ ভালো লাগল। ছোটোদের মনে-মনে যাওয়ার মতো দুরন্ত অভিযানই বটে। জুনিয়ার পরবর্তী ঘটনাবহুল কাহিনির অপেক্ষায় থাকলাম।

    ReplyDelete
  2. দারুন লাগলো।রূপকথা আর অভিযানের মিশেল।আরো দীর্ঘ হলে ভালো হত।

    ReplyDelete