গল্পের ম্যাজিক:: দ্বীপের ওপারে - সুস্মিতা কুন্ডু


দ্বীপের ওপারে
সুস্মিতা কুন্ডু

বকখালিতে আজ প্রায় এক সপ্তাহ হল বিমল ঘাঁটি গেড়েছে। পেশায় বিমল স্ট্রাগলিং জার্নালিস্টদেশের বিভিন্ন শহর, গ্রাম, মফস্বল সর্বত্র যেখানেই কোনও অদ্ভুত, কিম্ভুত খবরের সন্ধান পায় ছুটে যায় তার ক্যামেরা আর ল্যাপটপটি বগলদাবা করে। কোনও কোনওবার সত্যিই অস্বাভাবিক অতিপ্রাকৃতিক কোনও ঘটনার সন্ধান পায় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের পকেটের ওজন হাল্কা হওয়া ছাড়া আর কিছু প্রাপ্তি ঘটে নাআর খবর যাও বা জোগাড় হয়, এত কাঠখড় পুড়িয়ে সংবাদপত্রগুলো যে খুব সাগ্রহে সেই খবরটা ছাপে এমনটা কদাচিৎই ঘটে। জেলার পাতার নিচে এককোণে অবহেলায় কয়েক লাইনের ঘেরাটোপে পড়ে থাকে তার বহুকষ্টের এক একটা স্টোরি
এবারেও দক্ষিণবঙ্গের এক স্থানীয় কাগজে কর্মরত এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা খবর শুনে তারই পিছু ধাওয়া করে এখানে আগমন বিমলের। ধর্মতলা থেকে সরকারি বাসে নামখানা হয়ে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে বকখালি। ঘন্টা পাঁচেকের পথ। খরচ বাঁচানোর জন্য কোনও হোটেল ভাড়া না করে এখানকারই এক বাঙালি পরিবারের একটা পায়রার খোপের মতো ঘরে ভাড়া নিয়ে উঠেছে। কিছু উপরি টাকার বদলে রাতের খাবারটাও এরাই বানিয়ে দেয়। আর সারাদিন তো জেলেপাড়া, সমুদ্রের ধারে খবরের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কেটে যায়। এদিক ওদিক কোথাও একটা ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ আর গরম গরম টাটকা সমুদ্রের মাছভাজা খেয়ে নেয়। কোনও কোনওদিন তো শুধু পেটে কিল মেরেই কাটিয়ে দেয়
তা যেহেতু এরকম কৃচ্ছ্রসাধন, সেই মহার্ঘ্য খবরটি আদপে কী ছিল? বেশ কয়েকমাস আগে অনেকগুলি বড়ো কাগজে ছোট্ট করে আর ছোটো কাগজগুলোয় বড়ো করে খবর বেরিয়েছিল যে বকখালিতে জনাদুয়েক মাঝি এবং তার সাথে দু’জন বিজ্ঞানী বকখালি থেকে গোটা দশ কিলোমিটার বঙ্গোপসাগরের ভেতরে জম্বুদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ভুটভুটি চেপে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, কেউ বলে ঝড়ে, কেউ বলে সমুদ্রের দানোর আক্রমণে একজন মাঝি আর একজন বিজ্ঞানীর আর হদিশ মেলেনি। অবশিষ্ট দুইজন ভগ্নপ্রায় ভুটভুটিতে করে কোনওক্রমে ফিরে আসেনএই দুই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছেও কিন্তু কোনও অর্থবহ ব্যাখ্যা মেলেনি। স্থানীয় প্রশাসনও এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি জলঘোলা হতে দেয়নি। কেমন  যেন ঢাক গুড়গুড় করে তদন্তের কাজ সেরে দিয়েছে, পাছে বেশি খবর ছড়ালে পর্যটনশিল্প মাঠে মারা যায়।
সুনন্দ অর্থাৎ বিমলের ওই বন্ধুটি হঠাৎ কিছুদিন আগে বকখালি-ফ্রেজারগঞ্জ-হেনরী আইল্যান্ড গেছিল নিছকই পরিবার নিয়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কিন্তু গিয়ে কানাঘুষোয় শোনে যে সেই দুই বিজ্ঞানীর যিনি ফিরে এসেছিলেন, তিনি নাকি বকখালিতেই একটা পোড়োবাড়িতে বসবাস করেন এবং প্রায়ই তাকে সমুদ্রের তীরে প্রলাপ বকতে বকতে ঘুরতে দেখা যায় তার পিছু পিছু সেই মাঝিটাও ঘুরে বেড়ায়। এটা সুনন্দ নিজের চোখেই দেখেছে বীচে ঘুরতে গিয়ে। বিমল যেহেতু এইধরনের খবর সংগ্রাহক, তাই প্রথমেই ওর কথাই মনে এসেছে সুনন্দর।
তা বিমল এক হপ্তা ধরে গাঁটের কড়ি খসিয়ে এখানে পড়ে থাকলে কী হবে, না সেই বিজ্ঞানী আর না মাঝি কারোরই দেখা মেলেনি। লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু লাভ হয়নি। গরিব মাঝিগুলোর কাছে তো কথা তুললেই ‘দানো, দানো’ করে চোখ কপালে তুলে প্রায় ভিরমি খায়। গোটাকতক হোটেল ম্যানেজার আর একটা বুড়ো কনস্টেবলকে পাকড়াও করেছিল তারা তো উল্টে ওকেই কোন কাগজের লোক, কোথায় বাড়ি এসব জিজ্ঞেস করে-টরে কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল।
কাল সাহস করে ওই পাগলা বিজ্ঞানীর পোড়োবাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল। ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা। সেটাও বহুদিন মানুষের পায়ের ছোঁয়া না পেয়ে ঘাস গজিয়ে লুপ্তপ্রায়। সেই হারিয়ে যাওয়া রাস্তার শেষপ্রান্তে একটা একতলা বাড়িখুব একটা ভাঙাচোরা নয়, তবে বাড়িটাকে চারদিক দিয়ে এত লতাপাতায় আঁকড়ে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে বাড়িটার প্রাণটাই শুষে নিয়ে একটা ভূতুড়েবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। সেই ঝোপঝাড় আগাছার মধ্যে কোথা থেকে একটা আলোর ফলা ছিটকে বেরিয়ে এসে জানান দিচ্ছে, আছে আছে, মানুষ আছে এই বাড়িতে বহু পুরনো জং ধরা গেটটা ঠেলতেই বিকট ক্যাঁঅ্যাঅ্যা...চ শব্দ তুলে খুলে গেল। এখানে সাপখোপ থাকাটাও বিচিত্র নয়। সবে ঢুকে আগাছার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুই পা এগিয়েছে, ওমনি কোত্থকে একটা কুকুর এসে প্রবল চিৎকার শুরু করলবিমল ভয়ে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে ছুটে পালাতে পালাতে লক্ষ করল, কুকুরটার পেছনের একটা পা নেই।
এই অভিজ্ঞতার পর বিমল ধরে নিয়েছিল আর এখানে পড়ে থেকে লাভ নেই। তাই আগামীকাল ফিরে যাবে এই মনস্থির করে শেষবার বীচে একবার এসে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙা দেখছিল। হঠাৎ তার চটক ভাঙল একটা ডাক শুনে।
“হুই কাগুজের বাবু, তুর কাছে বিড়ি হবেক?
ফিরে তাকিয়ে দেখল এক ক্ষয়াটে চেহারার বুড়ো লোক, মাথায় গামছা বাঁধা, পরনে একটা খেটো ধুতি, যেটাকে দেখে ধুতি বলে চেনা খুব কঠিন তার পাশে উবু হয়ে বসে লোকটা হাত বাড়িয়ে রয়েছে। বিমল একটা গোল্ড ফ্লেক বার করে বলল, “বিড়ি তো নেই কত্তাএইটা চলবে?
লোকটা নিরাসক্তভাবে সিগারেটটা হাত বাড়িয়ে নিল। বিমল লাইটারটা জ্বালিয়ে হাতে আড়াল করে এগিয়ে ধরলবুড়ো লম্বা একটা টান দিয়ে যে গল্প শোনাতে শুরু করল, তাইতে গায়ে কাঁটা দিয়ে গেল বিমলের। এখানে আসাটা এই প্রথমবার মনে হচ্ছে বৃথা হয়নি। বুড়ো আর কেউ নয়, সেই বেঁচে ফেরা দুই মাঝির একজন দশরথ মাঝি আর যে মারা গেছিল সে এই দশরথেরই একমাত্র সন্তান গগন। ছেলে হারিয়ে বুড়োর মস্তিষ্কের ভারসাম্য কিছুটা নষ্ট হলেও বুড়োর বর্ণনা শুনে মনে হয় না সেটা নিছক পাগলের প্রলাপ।

সেই অভিশপ্ত দিনে দশরথ আর তার ছেলে গগন তাদের ভুটভুটিতে করে ওই মাস্টারসাহেব আর তার বন্ধুকে জম্বুদ্বীপে নিয়ে গেছিল। যদিও ওই দ্বীপে নামা বারণ, তাও বেশি টাকার লোভে ওরা রাজি হয়েছিল আর ওই বাবুরাও বলেছিলেন যে কীসব গাছপালার পড়াশোনার জন্য ওই দ্বীপ থেকে গাছ আনতে যাবেন শুধুমাত্র। দিনেরবেলায় লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা, তাই রাত্রের অন্ধকারে চারজন রওনা দিয়েছিল। সেই অভিশপ্ত দিনে প্রকৃতিও যেন ওদের বিরুদ্ধে ছিল। বড়ো বড়ো ঢেউ আর ঝড় সমানে চলছিল।
ওরা বাপ-ব্যাটা ভুটভুটি নিয়ে একটু দূরে অপেক্ষা করছিল আর দুই মাস্টারবাবু প্রায় বুকজল সাঁতরে গিয়ে দ্বীপের কিনারায় উঠল। ওদের হাতে শক্ত প্লাস্টিকের বাক্সের মতন কিছু একটা ছিল। তারপর ওরা ধীরে ধীরে ঝোপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন ওরা এল না তখন দশরথের ছেলে গগন জলে নেমে দ্বীপের দিকে গেল। আরও বেশ কিছুটা সময় কাটার পর দশরথ দেখল যে মাস্টারবাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছেন গোটা গায়ে ফালা ফালা চেরা দাগ, হাতে একটা ছুরি আর উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করছেন, “পালাও পালাও, মানুষখেকো !”
দশরথ ঝাঁপ দিয়ে জলে নেমে ওনাকে টেনে বোটে তুলে আবার সাঁতরে গেল দ্বীপের দিকে। ‘গগন, গগন,’ করে ডাকতে ডাকতে আবার সাঁতার দিতে লাগল ডাঙার দিকে। কিন্তু অনেক ডেকে, অনেক খুঁজেও কোত্থাও ছেলের আর মাস্টারবাবুর বন্ধুর চিহ্নমাত্র পেলে না। কোনওমতে ভুটভুটি নিয়ে ফিরে এসে মাস্টারবাবুকে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বৃদ্ধ। জ্ঞান ফেরার পর অনেকবার ওই দ্বীপের চারধারে ভুটভুটি নিয়ে ঘুরেছে, ছেলের নাম ধরে চিৎকার করেছে কিন্তু ছেলের সাড়া পায়নি। দ্বীপে নামার সাহস পায়নি কারণ, তার কিছু হলে মা-মরা নাতিটাকে দেখার কেউ আর থাকবে না। পুলিশে জানিয়েছিল কিন্তু ট্যুরিস্ট খোয়ানোর ভয়ে এই নিয়ে তদন্ত বেশি এগোয়নি। গগনের নামটা পুলিশের খাতায় নিরুদ্দেশের তালিকাতেই থেকে গেছে। দশরথ নিরুপায় হয়ে মাস্টারবাবুর কাছে ছুটেছে যদি তিনি কোনও সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু তিনি হাসপাতাল থেকে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ফিরলেও মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত
এই অবধি বলে হঠাৎ দশরথ খানিকটা দূরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠল, “হুই তো, হুই তো মাস্টরবাবু আসতিছেউকেই জিগাস করলা আমি মিছা কতা কইচি কি লা
বিমল ফিরে চেয়ে দেখল এক ভদ্রলোক, মধ্যপঞ্চাশের কোঠায় বয়স, আলুথালু জামাকাপড়ে বিড়বিড় করে বকতে বকতে হেঁটে আসছেন। ভদ্রলোককে দেখেই বোঝা যায় মানসিক স্থিতিশীলতা আর পাঁচটা লোকের মতো স্বাভাবিক নেই। বিমল তাড়াতাড়ি হেঁটে ওঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, “প্রফেসর অমরেশ মুখার্জ্জী!”
উনি চমকে তাকালেন বিমলের দিকে। বিমল ধীরে ধীরে ওনাকে নিজের পরিচয় দিল, বলল ওর আগমনের হেতু সংক্ষেপে। ওঁর বিভ্রান্ত চোখের দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে আসছিল। বিমল দশরথের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “প্রফেসর মুখার্জ্জী, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি। দশরথের কথা পুলিশ না মানতে পারে কিন্তু আপনার মতো মানুষের কথা তো ওরা অবশ্যই গুরুত্ব দিতআপনি পুলিশের সাহায্য নিয়ে আপনার বন্ধু বিজ্ঞানী ডক্টর প্রিয়তোষ রায়ের খোঁজে গেলেন না কেন?
হোমওয়ার্কটা ভালোই করে এসেছিল বিমল অমরেশবাবুর ঘোলাটে চাউনিটা বিমলের মুখে স্থির হয়ে গেল। উনি বলে উঠলেন, “কেউ জানে না, আর জানলেও কেউ বুঝবে না। যে যন্ত্রণা আমি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি, কেউ বুঝবে না। সবাই আমায় পাগল ভাবে। শয়তানেরা সব চুরি করে নিয়ে যাবে।”
এই বলে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে বালিতেই লুটিয়ে পড়লেন তিনি। বিমল কোনওক্রমে দশরথের সাহায্যে ওনার চোখেমুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল। জ্ঞান ফিরলেও ওঁর অবস্থা দেখে ওরা দু’জন মিলে ওঁর দু’হাত নিজেদের কাঁধে দিয়ে কোনওমতে ওনার সেই পোড়োবাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। গেট দিয়ে ঢুকতে আগের দিনের কুকুরটা আবার ছুটে এলেও প্রফেসরকে দেখে আর দশরথও চেনা মুখ বলে কিছু না বলে সরে দাঁড়াল। কোনওমতে ওনার পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ওনাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সামনে একটা ঘরে, সম্ভবত ওনার বেডরুমে খাটে ওনাকে শুইয়ে দিল। দশরথ তার নাতি ঘরে একলা বলে খানিক পরে চলে গেল। বিমল আর কী করে একজনকে এরকম অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে তো যাওয়া যায় না তাই পাশের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে টেবিলের জিনিসগুলোর দিকে চোখ চলে গেল বিমলের। কতকগুলো মোটা মোটা ডায়েরি, নোটবুক ইত্যাদি। কৌতূহলী হয়ে একটা ডায়েরি তুলে নিয়ে পাতা ওল্টালো ও। তারিখ দিয়ে রোজনামচা লেখা। কয়েকমাস আগে গগন আর ডঃ রায় জম্বুদ্বীপে নিখোঁজ হওয়ারও কয়েকমাস আগের একটা তারিখের পাতাটা তার সামনে খোলা। তার বয়ানটা এইরকম –
তাং ___
আজ স্যাম্পল K. P. 739 আর V. F. 705 অত্যন্ত ভায়োলেন্টলি রি-অ্যাক্ট করেছে। রকিকে যে ওভাবে আক্রমণ করে বসবে, এটা আমি বা অমরেশ কেউই ভাবতে পারিনি। এবার মনে হচ্ছে এগোনোর সাথে সাথে পেছোনোর রাস্তাটাও প্রস্তুত রাখতে হবেপ্রগতি যদি ধ্বংসের অভিমুখে যায় তাহলে তার গতি উল্টোমুখে ফেরানোটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।
- P. R.

বিমল কিচ্ছু মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না শুধু এটুকু ছাড়া যে এই P. R. মানে ডঃ প্রিয়তোষ রায় অন্য একটা ডায়েরি তুলে নিল। এর তারিখগুলো আরও আগের, প্রায় আরও মাস ছয়েক আগের। একটা পাতা খুলে পড়তে শুরু করল
তাং ___
শেষপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের এই শেষপ্রান্তে, এই জম্বুদ্বীপেই মনে হচ্ছে উপযুক্ত পরিবেশ পেলাম। অমরেশের এই বাগানবাড়িতে আর সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।
- P. R.

আরেকটা ডায়েরি তুলে পড়ার জন্য ওল্টাতে গিয়ে কাশির শব্দে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল প্রফেসর মুখার্জ্জী আস্তে আস্তে খাটে উঠে বসেছেন। বিমল তড়িঘড়ি ডায়েরিটা রেখে দিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেল। উনি স্থির চোখে বিমলের দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি সেই সী-বীচের সাংবাদিকটি না! সত্যি জানতে চাও? হুমমম জানতে চাও আমার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুর আর গগনের কী হয়েছে? কিন্তু বাস্তব যে গল্পের থেকেও বিস্ময়কর অনেকসময়।”
ওনাকে আবার উত্তেজিত হতে দেখে বিমল বলল, “প্লীজ, আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি অসুস্থ। দেখুন, সত্যের সন্ধান আমার নেশা এবং পেশা। যদি আপনার কোনও আপত্তি না থাকে বলেই দেখুন না আমাকে সত্যিটা। হয়তো আমি আপনার কোনও সাহায্যেও লাগতে পারি
প্রফেসর মুখার্জ্জী কিছুক্ষণ বিমলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন তারপর ধীরে ধীরে একটু শান্ত হয়ে বলতে শুরু করলেন, “কী নাম যেন বলেছিলে তোমার? ও হ্যাঁ, বিমল। তোমার মতো একজন সাংবাদিককে সত্যিটা জানানো উচিত বলেই হয়তো নিয়তি আমাদের আলাপ ঘটিয়ে দিয়েছে। সবটা তোমায় শুরু থেকেই বলি তাহলে।
“আমি আর আমার বাল্যবন্ধু প্রিয়তোষ একসাথে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করার পর দু’জনের জীবন ভিন্ন খাতে বয়ে যায়আমি আসি শিক্ষকতার পথে আর ও যোগদান করে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। দীর্ঘকাল দেশে বিদেশে জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণার পর প্রিয় কলকাতায় ফিরে আসে এবং আজ থেকে প্রায় বছর দুই আগে হঠাৎই একদিন আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমাকে বলে ওর অত্যাশ্চর্য গবেষণার কথা এবং ওর সাথে শরিক হতে অনুরোধ করে। আমি একবাক্যে রাজি হয়ে যাই এবং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা ছেড়ে বকখালিতে আমার উত্তরাধীকারসূত্রে প্রাপ্ত পুরনো এই জনমনুষ্যবিহীন মামার বাড়িতে দু’জন এসে আস্তানা বানাই। নিছক আস্তানা নয়, একটা ছোটোখাটো ল্যাবরেটরি গড়ে তুলি আমরা। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের জেনেটিক মড্যুলেশন ঘটিয়ে তাদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার গবেষণায় অনেকটাই এগিয়েছিল প্রিয়। আমরা অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করি অনেক ধরনের স্যাম্পলের ওপর। সবচেয়ে লক্ষণীয় সাড়া পাওয়া যায় একটা বিশেষ প্রজাতির গাছের থেকেকার্নিভোরাস প্ল্যান্ট সম্পর্কে ধারণা আছে কিছু?
প্রশ্নটা বিমলের উদ্দেশ্যে। বিমল এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে শুনছিল প্রফেসর মুখার্জ্জীর কথাগুলো। হঠাৎ এই প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠে বলল, “ইয়ে মানে হ্যাঁ, কলসপত্রী, সূর্যশিশির আর, আর...”
প্রফেসর মুখার্জ্জী বলে উঠলেন, “ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ, ওয়াটার হুইল তুমি ঠিকই ধরেছতবে মোটে দুটো বা চারটে নয়, কার্নিভোরাস প্ল্যান্ট বা মাংসাশী উদ্ভিদ প্রায় চারশো থেকে পাঁচশোরকম প্রজাতির আছে। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য এগুলি। পোকামাকড়, মাকড়সা থেকে শুরু করে ছোটো ব্যাঙ মায় ইঁদুর অবধি এরা শিকার করতে সমর্থ। দক্ষিণ আমেরিকা, মাদাগাস্কার, ভারত, শ্রীলঙ্কায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাভূমি অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মাংসাশী উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। এই জাতীয় গাছ স্যাঁতস্যাঁতে আর্দ্র নীচু জলাভূমিতে বেশি জন্মায়। আর এধরনের জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কম যেটা কিনা গাছের বৃদ্ধির জন্য উৎকৃষ্ট সার। সেই  ঘাটতি মেটাতে এই কার্নিভোরাস প্ল্যান্টগুলো এইভাবে প্রাণীদের শিকার করে তাদের দেহরস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে।
এদের শিকারের পদ্ধতিগুলোও ভীষণ ইন্টারেস্টিং। কেউ বিশেষ একধরনের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে পোকামাকড় মাছি এদের আকৃষ্ট করে, কেউ আবার তাদের উজ্জ্বল সুন্দর বর্ণবাহারের মাধ্যমে শিকারকে মোহাবিষ্ট করে টেনে আনে মৃত্যুমুখে। একবার শিকার লোভের ফাঁদে পা দিলে এরা এদের বিশেষ গঠনের সাহায্যে বা আঠার সাহায্যে সেই হতভাগ্য শিকারকে আটকে ফেলে ফাঁদে যতক্ষণ না তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়।”
বলে চলেন প্রফেসর মুখার্জ্জী, “বুঝলে ইয়ংম্যান, প্রিয় ভেবেছিল এই গাছের জেনেটিক কোড বদল করে এবং ওর নিজেরই তৈরি নাইট্রোজেন সাপ্লিমেন্ট ইনজেক্ট করে গাছের বৃদ্ধির হার এবং ফলন অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলবে। সত্যি এই গবেষণায় সফল হলে আমরা আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান বিপুল এই জনসংখ্যার খাদ্যসংকটের সমস্যার চিরতরে সমাধান করতে পারব ভেবেছিলাম। আমাদের রিসার্চ ঠিকপথেই এগোচ্ছিল। আশানুরূপ ফলও পাচ্ছিলাম।
“বছরখানেক আগে হঠাৎ একদিন প্রিয়র মাথায় বুদ্ধি এল যে এই গাছগুলোকে যদি ল্যাবের ঘেরাটোপে, সীমিত সূর্যালোকে কনফাইনড না রেখে ওদের ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাটে মানে আর্দ্র জলাভূমিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে হয়ত আরও ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আমারও প্রস্তাবটা মনে ধরলজম্বুদ্বীপে বর্তমানে মানুষ যাওয়া নিষিদ্ধসেটাই আমাদের জন্য শাপে বর। তাই ওই জায়গাটাকেই আমরা নির্বাচিত করলামগোটা কয়েক স্যাম্পল ল্যাবে রেখে দিয়ে বাকিগুলো নিয়ে আমরা গগনকে অনেকগুলো টাকা দিয়ে রাজি করিয়ে ওর ভুটভুটিতে রওনা দিলাম।”
বিমল বলে উঠল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান! তার মানে গগন আর ডঃ প্রিয়তোষ রায়ের দুর্ঘটনা ঘটার আগেও আপনারা ওই দ্বীপে গেছিলেন?”
প্রফেসর মুখার্জ্জী বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু সেবার কোনওরকম বিপদ ঘটেনি। নির্বিঘ্নে আমরা কলসপত্রী আর ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের পরীক্ষাধীন চারাগুলো দ্বীপের মাটিতে রোপণ করে ফিরে এলাম। তারপর এক-দু’মাস সব ঠিকই চলছিল কিন্তু তারপরই অশনি সংকেত দেখা দেওয়া শুরু হল। যে ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ সাধারণত এক ফুটের থেকে বেশি লম্বা হয় না, আমাদের ল্যাবের সেই গাছের স্যাম্পল চার ফুট ছাড়িয়ে যেতে লাগল। কলসপত্রীর এক একটা ট্র্যাপিং পিচার মানে কলসগুলো আকারে আয়তনে প্রায় স্বাভাবিকের পাঁচগুণ হয়ে গিয়ে বড়ো আকারের মাটির কুঁজোর চেহারা নিল।
“পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমরা টের পেলাম সেদিনই যেদিন আমার পোষা কুকুর রকি ভুল করে ঢুকে পড়ল ল্যাবে। বেচারা না বুঝতে পেরে কৌতূহলবশত গাছগুলোর খুব কাছে চলে গেছিল। ওর আর্তনাদ শুনে আমি আর প্রিয় ছুটে ল্যাবে এসে দেখি রকির শরীরের সিংহভাগই কলসপত্রীর ফাঁদে ঢুকে গেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও রকি বেরিয়ে আসতে পারছে না আর গাছটার ওপর যেন কোনও শয়তান দানো ভর করেছে, গ্রাস করে চলেছে ধীরে ধীরে অসহায় প্রাণীটিকে। আমরা দু’জনে কোনওমতে রকিকে টেনে বার করার চেষ্টা করতে লাগলাম গোটা শরীরটা বার করে আনলেও ওর পেছনের একটা পা গাছটার কবল থেকে বাঁচাতে পারলাম না। একটা কড়া আঠালো তরল পদার্থ যেটা ওই পিচারের ভেতরে ছিল সেটা তীব্র অ্যাসিডের মতো গলিয়ে দিল যেন ওর পা-টাকে। কোনওমতে মৃতপ্রায় অজ্ঞান রকিকে আমরা উদ্ধার করে নিয়ে তো এলাম, কিন্তু আতঙ্কে ক’দিন ল্যাবের ওই গ্রীনরুমের ধারে ঘেঁষতে পারলাম না। শুধু মনে হতে লাগল যেন মাংসাশী ওই গাছগুলো রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছেএবার বুঝি আমাদের পালাএই বুঝি ওদের ভয়াল শাখাপ্রশাখা বাড়িয়ে আমাদের ওই রঙিন মৃত্যুগহ্বরে টেনে নিল।
“রকি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল আর আমি আর প্রিয়তোষ উদয়াস্ত খেটে তৈরি করলাম একটা অ্যান্টিডোট। যেটা ওই গাছগুলোর ঠিক জোঁকের গায়ে নুন পড়ার মতো দশা করে দিয়ে ওদের নিকেশ করবে। কিন্তু কী করে যে ওই গাছগুলোর গায়ে এই অ্যান্টিডোট ইনজেক্ট করব সেটা একটা বড়ো সমস্যাল্যাবে প্রায় গোটা কুড়ি স্যাম্পল ছিলআমরা কয়েকটা ট্র্যাঙ্কুলাইজার গান কিনলাম এবং তার বুলেটগুলোতে অর্থাৎ ডার্টগুলোতে আমাদের অ্যান্টিডোট ভরে দিলাম যাতে করে গাছগুলোর কাছে না গিয়েও ইনজেক্ট করা যায়।”
একটু থেমে ফের দম নিয়ে শুরু করলেন প্রফেসর, “তারপর কোনওক্রমে আমরা ওই রুমে ঢুকে তো থ। এই মাত্র ক’দিনে যেন গোটা রুমটা ছেয়ে গেছে কলসপত্রী আর ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপেএভাবে যে ওদের গ্রোথ হওয়া সম্ভব সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। চারদিকে বর্ণময় মৃত্যুফাঁদ যেন আমাদের গ্রাস করতে আসছে। আতঙ্কে আমরা এলোপাথাড়ি অনভ্যস্ত হাতে ট্র্যাঙ্কুলাইজার গান ফায়ার করতে লাগলাম। অ্যান্টিডোটরূপী তরল মৃত্যু যখন গাছগুলোর শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল তখন ঘরটায় যেন মৃত্যুতান্ডব শুরু হল।
“ধীরে ধীরে সবকটা গাছ অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়ার মতো কালো হয়ে কুঁকড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। এই শয়তানের বীজগুলোকে তো আমরা নিজেদের হাতে করে জম্বুদ্বীপের বুকে ছড়িয়ে এসেছি। সেগুলোকে নিকেশ না করা অবধি তো আমাদের মুক্তি নেই।
“কিছুদিন সময় নিয়ে আমরা আরও অনেকখানি অ্যান্টিডোট প্রস্তুত করে গোটা চারেক ট্র্যাঙ্কুলাইজার গান এবং শ দুয়েক গুলি নিয়ে গগনের ভুটভুটিতে করে রওনা দিলাম। কদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি চলছিল, তাই গগন ওর বাবা দশরথকেও এইবার সাথে নিয়েছিল। ওরা ঘুণাক্ষরেও জানত না আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। টাকার জন্য শুধুমাত্র যেতে রাজি হয়েছিল। রাত্রের অন্ধকারে শেষমেষ দ্বীপে পৌঁছে আমরা দশরথ আর গগনকে অপেক্ষা করতে বলে নেমে সাঁতরে উঠলাম দ্বীপে। গানগুলো লোড করে এগোতে লাগলাম সেই জায়গাটার উদ্দেশ্যে যেখানে গাছগুলো পুঁতে এসেছিলাম। কাছাকাছি পৌঁছে দেখি একটা ছোটোখাটো জঙ্গলমতোআশেপাশে বেশ কিছু পালক আর দ্বীপের কিছু ছোটোখাটো প্রাণীর হাড়গোড় দেহাবশেষ পড়ে রয়েছে। অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলাম না। চারপাশে অস্বাভাবিকরকমের শ্মশানের নীরবতা। আমরা আর সময় নষ্ট না করে অ্যান্টিডোটের ডার্ট ফায়ার করতে শুরু করলাম ঝোপঝাড়গুলোকে লক্ষ্য করে। গোটা ঝোপটায় যেন ঝড় বয়ে যেতে লাগল। প্রবল বেগে দুলতে দুলতে গাছগুলো গুলিবিদ্ধ পিশাচের মতো ছটফট করতে লাগল মৃত্যুযন্ত্রণায়। আমরাও মুহুর্মুহু ফায়ার করতে থাকলাম, কিন্তু উত্তেজনার বশে কখন খেয়াল করিনি প্রিয় অনেকটা এগিয়ে গেছিল। খোলা প্রকৃতিতে বড়ো হওয়া দানবগাছগুলো যে আমাদের ল্যাবের গাছগুলোর থেকে আরও ভয়ংকর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং নতুন নতুন শিকারের পন্থা উদ্ভাবন করেছে সেটা আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। আমি প্রিয়কে সাবধান করার আগেই একটা লিকলিকে আকর্ষ এগিয়ে এসে ওকে ওই মানুষখেকো গাছের জঙ্গলে টেনে নিল। প্রিয়র আর্তচিৎকারে আমি দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে বন্দুক চালাতে লাগলাম কিন্তু অচিরেই অ্যান্টিডোট ভরা গুলি শেষ হয়ে গেল। যেভাবে অজগর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শিকারকে গিলে খায়, সেভাবে চোখের সামনে প্রিয়র শরীরটাকে ওই পিশাচ গাছের গর্ভে তলিয়ে যেতে দেখলাম। এমন সময় আমাদের খুঁজতে খুঁজতে গগন এসে হাজির হল এবং কিছু না বুঝে আমাকে ধরতে গিয়ে গাছের নাগালে চলে আসামাত্র একটা বৃহদাকার ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের লাল পাতার বাইরের শুঁড়ের মতো সিলিয়া থেকে তরল অ্যাসিডের মতো উৎসেচক পিচকিরির জলের মতো ছিটকে এসে গগনের গোটা শরীর ভিজিয়ে দিল। কয়েক ফোঁটা আমার গায়েও ছেটালযেখান দিয়ে ওই আঠালো তরল শরীরে গড়াতে লাগল সেই জায়গাগুলো তরোয়াল দিয়ে ফালাফালা হওয়ার মতো চিরে যেতে থাকল। গগনের সারা শরীর যেন গলে যেতে লাগল। গগন আর প্রিয়কে বাঁচানো যে আর সম্ভব নয় সেটা বুঝতে পারছিলামকতকগুলো রাক্ষুসে আকর্ষ দেখলাম কেঁচোর মতো কিলবিল করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি তখন দ্বীপের তীরের দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম যেখানে দশরথমাঝি ভুটভুটি নিয়ে আছে। তারপর আমার বিশেষ কিছু মনে নেই, শুধু দশরথ আমায় টেনে নৌকায় তুলছে এটুকু ছাড়া
এই অবধি এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন প্রফেসর। বিমল প্রায় দমবন্ধ করে শুনছিল ওনার কথা। উনি থামতে বলে উঠল, “তাহলে কিছু গাছ তো এখনও জীবিত রয়েছে ওই দ্বীপে। সেগুলোর কী হল? আপনি দশরথকেই কী এক্সপ্ল্যানেশন দিলেন আর আপনার বন্ধু এত বড়ো বিজ্ঞানী, তাঁর এই অন্তর্ধানই বা কী করে ব্যাখ্যা করবেন সকলের কাছে? আপনাদের এই গবেষণার তথ্য, এগুলোই বা কী হবে?
প্রফেসর মুখার্জ্জীর চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বললেন, “গগন আর প্রিয়তোষের মৃত্যুর বিভীষিকা আজও আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। ফিরে একটু সুস্থ হওয়ার পর দশরথ আমার কাছে বারবার এসেছে ছেলের খবরের জন্যওকে যতটা সম্ভব রেখেঢেকে বোঝানো সম্ভব আমি বুঝিয়েছি, ওর নাতির সব দায়িত্বও আমি নিয়েছি। কিন্তু বাপের মন। বুড়ো দশরথ ছেলের সন্ধানে দ্বীপের চারধারে আজও ঘোরে। কাউকে কিছু বলতে আমি বারণ করেছিলাম ওকে কিন্তু মদের ঘোরে হয়তো কিছু বলে থাকবে কোথাও। কিছু লোক ক’দিন ধরে আমাকে নজর করছিল। একরাত্রে তো আমাদের ল্যাবে কেউ ঢুকেছে, সেটাও বুঝতে পারি আমি।
“কিছুদিন পর কিছু শয়তান লোক এসে আমার কাছে প্রথমে ফর্মুলা কিনতে চাইলআমি ডাঁহা অস্বীকার করি এরকম কোনও এক্সপেরিমেন্ট আদৌ আমরা করেছিলামওরা তখন আমাকে পয়সার লোভ দেখায়, হুমকি দেয়, ভয়ও দেখায়সর্ষের মধ্যে ভূতের মতো কিছু স্থানীয় পুলিশও পয়সার লোভে ওদের দলে যোগ দিয়েছে তাই পুলিশ বা প্রশাসনের সাহায্য নেওয়াও বুঝতেই পারছ সম্ভব নয়। এইরকম বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল যেন তেন প্রকারেণ বিজ্ঞানীদের থেকে দখল করে চড়া দামে বিদেশে বেচে দেওয়ার মতো দুষ্টচক্রের অভাব তো নেই আমাদের দেশে। আমি অলরেডি আমাদের সমস্ত রিসার্চের রেকর্ড নথিপত্র সব নষ্ট করে দিয়েছি। তার আগে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিডোট আমি বানিয়ে রেখেছি দ্বীপের ওই শেষ ক’টা গাছকে নিকেশ করার জন্য। তবেই আমার শান্তিকালই আমি আবার যাব জম্বুদ্বীপে। দশরথমাঝির সাথে সকালেই দেখা করব আমিওর ভুটভুটিটা প্রয়োজন আমার। এই ছয়মাসে না জানি ওই নরখাদকগুলো কী রূপ ধারণ করেছে!”
এমন সময় দরজার পাশ থেকে দশরথের গলা শোনা গেল, “আমি যাব তুর সাথে, মাস্টারবাবুআমার গগনের বদলা লিব আমি
বুড়োর শীর্ণ চেহারায় চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।
বিমলও বলে উঠল, “প্লীজ, আমাকেও সঙ্গে নিন প্রফেসর মুখার্জ্জী। এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ জীবনে একবারই আসে, বারবার নয়
প্রফেসর মুখার্জ্জী আঁতকে উঠে বললেন, “না না, তা হয় না। জীবনও একটাই হয়। আমাদের ভুলে দুটো তাজা প্রাণ অকালে চলে গেছে, আর নয়। দশরথ, গগনকে কেড়ে নিয়ে তোমার নাতিকে আমি অনাথ করে দিয়েছি। এরপর ওর মাথা থেকে তোমার হাতটাও কেড়ে নিতে আমি পারব না। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো।
“তোমরা কেউ ওই দ্বীপে পা রাখবে না। দশরথ, তুমি শুধু কাল রাত্রে আমায় ওই দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে। পরেরদিন ভোরে দ্বীপের ধারে একঘন্টা অপেক্ষা করবে। যদি বেঁচে থাকি তবে ফিরে আসব তোমার সাথে।”
এই বলে প্রফেসর মুখার্জ্জী বিমল ও দশরথ দু’জনকে ফিরে যেতে বললেন। বিমল ফিরে এলেও কিছুতেই তার সাংবাদিক রহস্যসন্ধানী মন মানতে চাইল না। এরকম একটা রহস্য অভিযান সামনে! এই অবস্থায় হাত পা গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে! কিছুতেই না

পরেরদিন রাত্রে সে ঠিক গিয়ে হাজির হল প্রফেসর মুখার্জ্জীর বাড়ির কাছের বীচে। দেখল দশরথও ভুটভুটি নিয়ে হাজির। দশরথকে দুটো সিগারেট দিয়ে আর ভুজুংভাজুং দিয়ে আগেই ভুটভুটিতে উঠে লুকিয়ে বসে রইলপ্রফেসর মুখার্জ্জী হাতে কতকগুলো ট্র্যাঙ্কুলাইজার গান আর একটা বড়ো বাক্স নিয়ে এসে উঠলেন ভুটভুটিতে। বেশ কিছু বড়ো ছুরিও সঙ্গে নিয়েছেন। দশরথ ভুটভুটি স্টার্ট করল। দ্বীপে প্রায় পৌঁছে বোটটাকে যতটা সম্ভব কাছে নিয়ে গেল দশরথ। জলে নেমে গিয়ে একটা লম্বা কাছি দিয়ে দশরথ বোটটা বাঁধল দ্বীপের একটা গাছে। প্রফেসর বারবার দশরথকে ফিরে যেতে বলে দিয়ে এগিয়ে গেলেন দ্বীপের ভেতরে ও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন জঙ্গলে। বিমলও টুকটুক করে বেরিয়ে এল লুকনো জায়গা থেকে। ওকে দেখে দশরথ জ্বলন্ত আধপোড়া বিড়িটা ছুঁড়ে জলে ফেলে বলল, “বাবু, ইখনও সময় আছেক, তু ফিরে যা
বিমল বলল, “না দশরথ, এতদূর এলাম যখন শেষ দেখেই ফিরব
অতঃপর দু’জন মিলে এগিয়ে চলল যেদিকে প্রফেসর মুখার্জ্জী এগিয়ে গেছেন সেদিকে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর যেন চারদিক বড্ড বেশি নিস্তব্ধ লাগতে শুরু করল। একটা ঝিঁঝিঁপোকার ডাকও শোনা যাচ্ছিল না। আরও খানিকটা এগোনোর পর দেখল এক অপার্থিব দৃশ্য। গোটা পাঁচেক অদ্ভুতদর্শন গাছের গা থেকে বিভিন্ন রঙের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।  দুটো গাছকে দেখে মনে হল যেন ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের ডঃ হাইড ভার্সনবিশাল বিশাল  শুঁড়ওলা লাল পাতাগুলো থেকে ধাতব লাল উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আর গোটা তিনেক গাছ থেকে বড়ো বড়ো পিপের আকারের মরণফাঁদ ঝুলছে। ওগুলো রাক্ষুসে কলসপত্রী বলে চিনতে পারল বিমল। কিছু কিছু দানবীয় আকারের পাতার কলস মাটি অবধি নেমে এসে পাশ বরাবর ওল্টানো। সেগুলোর ভেতরটা যেন নরম মখমলি নীল গালিচায় মোড়া। আর সেই গালিচা চাঁদনির মতন নীলাভ আলোতে উদ্ভাসিত যেন কোনও মায়ানগরীর দ্বার। বিমল মোহাবিষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। হয়তো সেই ছলনাময় মৃত্যুপুরীতে প্রবেশই করে ফেলত যদি না পেছন থেকে দশরথ চিৎকার করে ওর সম্বিত ফেরাততড়িঘড়ি কয়েক লাফে পিছিয়ে এসে দেখল প্রফেসর মুখার্জ্জীকে কতকগুলো সর্পিল শুঙ্গ পেঁচিয়ে মাটি থেকে প্রায় ফুট দশেক ওপরে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে একটা মৃত্যুকলসের মধ্যে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতই ওই গহ্বর ভর্তি বিষাক্ত উৎসেচকে যার সংস্পর্শে আসা মাত্র যে কোনও জীবিত বস্তু মাংসপিন্ডের তালে পরিণত হবে কয়েক মূহুর্তে। এতক্ষণ নিজে সম্মোহিত থাকার জন্য বিমল লক্ষই করেনি। হঠাৎ দশরথ বিমলের পেছন থেকে তীরবেগে ছুটে গিয়ে কোমর থেকে একটা ছোরা খুলে নিয়ে রাক্ষুসে গাছটার কান্ড লক্ষ্য করে পাগলের মতো কোপাতে লাগল আর চিৎকার করতে লাগল, “শয়তানের চর, তু আমার ছেলেটোকে খেইছিস! আমিও তুকে কুচি কুচি কইরে কেইট্যে খাব!”
বিমলও মাটিতে পড়ে থাকা প্রফেসর মুখার্জ্জীর ট্র্যাঙ্কুলাইজার গানটা কুড়িয়ে নিয়ে অ্যান্টিডোট ভরা ডার্ট ফায়ার করতে লাগলগাছ ক’টা যেন মরণযন্ত্রণায় পাগল হয়ে উঠলএই কয়েকমাসে ওরা নিজেদের দ্রুত অভিযোজন ঘটিয়ে শিকার পদ্ধতিও যেমন উন্নত করে তুলেছে তেমনি আগের অ্যান্টিডোটের বিরুদ্ধেও নিজেদের ইম্যুনিটি কয়েকগুণ বড়িয়ে নিয়েছে। অ্যান্টিডোটের বিষে দুর্বল হলেও মরছে না। ইতিমধ্যে দশরথের ছুরির কোপে লম্বা শুঁড়টা কেটে পড়ে গিয়ে প্রফেসর মুক্ত হয়ে গেছেন। উনি শিগগির মাটিতে পড়ে থাকা বাক্স থেকে দুটো ছুরি বিমলের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেও দু’হাতে দুটি ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দশরথের সাথে। বিমলও অনতিবিলম্বে একই পথ অনুসরণ করলআদিম এই বিভীষিকাকে খতম করতে ওরাও আদিম কম্ব্যাটের পথে লড়াইয়ে নামল
কতটা সময় কেটেছে ওরা জানেও না। গাছগুলোর শেষ ডালটা অবধি মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ওরা যখন উঠে দাঁড়াল তখন ওদের আর শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। কীভাবে টলতে টলতে ভুটভুটিতে যে এসে উঠল এবং প্রফেসর মুখার্জ্জীর বাড়িতে এসে পৌঁছাল ঈশ্বরই জানেন
দিনের আলো ফুটতে ধাতস্থ হয়ে ওরা খানিকটা সুস্থ বোধ করল। প্রফেসর মুখার্জ্জী সকলের প্রাথমিক চিকিৎসা করার পর দশরথ কোনওমতে ছুটল নাতির কাছে বাড়িতে। বিমল ও প্রফেসর নিজেদের মধ্যে আগের রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে জুটলেন। প্রফেসর মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, “খোদার ওপর খোদকারি করার ফল বোধহয় এরকমই হয় বিমল
বিমল বলল, “না প্রফেসর মুখার্জ্জী, হয়তো আপনাদের অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি কিন্তু উদ্দেশ্য তো মহৎ ছিল। আর আপনাদের মতো বিজ্ঞানীরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এভাবে গবেষণা চালান বলেই তো মানবসভ্যতার এই অগ্রগতি। নাহলে তো আমরা কোন প্রস্তরযুগেই পড়ে থাকতাম। আমি এসেছিলাম নিছক এক অদ্ভুতুড়ে গল্পের সন্ধানে কিন্তু ফিরে যাচ্ছি এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই গল্প বা সত্য কাগজে ছাপার আমার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই নেই। আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি এই গবেষণাটা আবার শুরু করুন। আরও সুরক্ষিতভাবে, আরও আপনার এবং প্রিয়তোষবাবুর মতো নিবেদিত প্রাণ বিজ্ঞানীদের সাথী করে। সেটাই হয়তো প্রিয়তোষবাবুর স্মৃতির প্রতি সঠিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হবে এবং আপনাদের গবেষণার সাফল্যে যদি দশরথ ও গগনের মতো হাজার হাজার গরিব মানুষের পেট ভরে তাহলে গগনের মৃত্যুও বিফলে যাবে না।”
প্রফেসর মুখার্জ্জীর হাতটা ধরে বিমল বলে উঠল, “কী? করবেন তো?
প্রফেসর মুখার্জ্জী জলে ভেজা চোখে বিমলের দিকে চেয়ে বললেন, “ইয়েস ইয়ংম্যান, ইয়েস
হঠাৎ করে খিলখিল হাসির শব্দে ওরা পেছন ফিরে দেখে দশরথ ওর নাতিকে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দু’জনের মুখেই অনাবিল হাসি। বাচ্চাটা বলে উঠল, “হুই, তুরা মুদেরকেও খেলতে লিবি তো?
এই শুনে ওরা সকলেই হো হো করে হেসে উঠল। অনতিদূরে সমুদ্রতটে লাল সূর্যটাও টুক করে জলের ভেতর থেকে লাফিয়ে আকাশে উঠে ওদের হাসিতে সুর মেলাল
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়

লেখক পরিচিতিঃ সুস্মিতা কুন্ডু আদতে হাওড়াবাসী, বর্তমানে আমেরিকা নিবাসী। ফিজিক্স-এ  পি. এইচ. ডি, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা থেকে। তবে বিগত দেড়বৎসর যাবৎ পূর্ণ মাত্রায় একটি দুই বৎসরের শিশুর জননী। শখ : পাগলের মত গল্পের বই পড়া; বাবার, নিজের ও স্বামীর কর্মসূত্রে আরামবাগ থেকে আমেরিকা ভ্রমণ এবং অবশ্যই লেখালেখি। মূলতঃ গল্প লিখতে ভালোবাসেন বিশেষ করে রূপকথার।

12 comments:

  1. ওঃ কী কলম থুড়ি কী-বোর্ড-আঙুলের জোর আপনার!
    'সেপ্টোপাসের ক্ষিদে' এর পরে বাংলায় এমন গা-শিরিশিরে গল্প আগে খুব বেশি পড়েছি বলে এক্ষুণি তো মাথায় আসছে না. ধন্য আপনার উচ্চ-শিক্ষা! এবং এর সফল প্রয়োগ! এ বৈজ্ঞানিক রূপকথা পরে আমি এখনও চুপ-কথার দেশেই আছি.. কিঞ্চিত ভয়ে ভয়ে.. কে জানে আমার বাড়ির সামনেও কোনোদিন ভুল করে থেকে যাওয়া একটা পাঁচ-ফুটিয়া কলসপত্রী তার নীলাভ আলোর মায়া জাগানো গহ্বর নিয়ে .......

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। জানেন 'সেপ্টোপাসের ক্ষিদে' গল্পটা খুব ছোটোবেলায় পড়েছিলাম। এটা লেখার সময় একদম মনে ছিলনা। ভাগ্যিস! নইলে এটা লেখার সাহস হত না।
    ছোটোদের পড়ার মত গল্প আজকাল খুব কম লেখা হয়। ম্যাজিক ল্যাম্পের কল্যানে কত ভাল ভাল গল্প সবাই পড়তে পারছে। তাই আমিও একটু চেষ্টা করলাম।☺️☺️
    হে হে । আপনার কলসপত্রী গাছটাকে চোখে চোখে রাখবেন কিন্তু ����

    ReplyDelete
  3. সেপ্টোপাশের খিদে পড়ার পরেও আপনার লেখা ভাল লেগেছে, খুব ঝরেঝরে মেদহীন লেখা

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে ☺️☺️

      Delete
  4. মুখবন্ধ
    @ম্যাজিক ল্যাম্প
    প্রথমেই ম্যাজিক ল্যাম্প ওয়েব ম্যাগাজিন কর্ত্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ এই সুন্দর , মনোরম পত্রিকাটির প্রকাশের জন্য। আমি এই পত্রিকার খোঁজই পেতাম না, যদি শ্রী মতি সুস্মিতা কুন্ডু আমাকে গল্পটি পড়ার জন্য লিংক না দিতেন।
    আমি ইচ্ছামতী, জয়ঢাক ইত্যাদি পত্রিকা দেখেছি,বিশেষত ইচ্ছামতী পত্রিকাটি এমনভাবে প্রকাশ করে যে পত্রিকার চরিত্র অনুযায়ী যারা সত্যিকারের পাঠক, অর্থাৎ ছোটরা, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এই প্রচেষ্টা আপনাদেরও রাখতে হবে।
    ফেসবুকে, বিশেষত সাহিত বিষয়ক গ্রুপগুলিতে জয়েন করুন। সব গুলিতে ম্যাজিক ল্যাম্পের খবর জানান। যে বয়সের পাঠকদের এই পত্রিকাতে লেখার বা পড়ার ইচ্ছে হয় তাদের অন্তর্জালে যোগাযোগ করুন। বিশেষত প্রবাসী বাংলাভাষীদের গ্রুপ,অ্যাসোসিয়েশন এদেরকে লিংক পাঠান।নইলে পাঠকের অভাবে আপনারা ও লেখকেরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন।

    @ সুস্মিতা কুন্ডু

    লেখক পরিচিতিতে বলা হয়েছে যে লেখিকা রূপকথার গল্প লেখেন। কিন্তু পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই,আমি কিছুদিন শ্রীমতি কুন্ডুর লেখা পড়ছি। তার প্রতিটি লেখাই স্বতন্ত্র। তিনি শুধু রূপকথার গল্প লেখেন না,এই সময়ের সমস্যা ও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার গল,রম্যরচনা, নিজে বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী তাই তার লেখায় বিজ্ঞান উদ্ভাসিত হবে না,এটা হতেই পারে না। হয়ওনি। তিনি কল্পবিজ্ঞানের ওপর গল্প লিখেছেন। আরও নানাবিধ বিষয়ের মানবিক গল্প লিখেছেন। এককথায় তার কলম বহুমুখী। আমার স্থির বিশ্বাস " দ্বীপের ওপারে" র মত শ্রীমতি কুন্ডুর কোন লেখা আমরা কিশোরদের পত্রিকা আনন্দমেলা,কিশোর ভারতী ইত্যাদিতে অচিরেই প্রকাশিত হবে। সেজন্য আগাম শুভেচ্ছা রইল।

    @দ্বীপের ওপারে
    একজন মাননীয় পাঠক সঠিকভাবেই বলেছেন গল্পটি পড়তে পড়তে " সেপ্টোপাসের ক্ষিধে" মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমাদের কৈশোরে আমরা ফেলুদা,প্রফেসর শংকু পড়ার সুযোগ পাইনি। কিছু ছোটদের পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত, কিন্তু আমাদের বাড়ি আসত শুকতারা। যা কিছু কল্পনার জগত শুকতারা ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। তারপর ক্লাস সেভেন/ এইটে হাতে এল স্বপনকুমারের গোয়েন্দা গল্পের বই। কিশোর গল্পের হাত থেকে মিলল মুক্তি। ধীরে ধীরে বছর তিনেকের মধ্যে শরৎ,বঙ্কিম,বিভুতিভূষন ইত্যাদি শেষ হল। প্রবেশ করলাম বাংলা সাহিত্যের সম্পদের খোঁজে। আজও সেই খোঁজ চলছে।
    বেশ বড় হয়ে, পরিণত বয়েসে সত্যজিত,ফেলুদা,শঙ্কু পড়েছি। পড়তে গিয়ে টের পেয়েছি, সেই কিশোর বয়েসের মনটার মৃত্যু হয়নি। আজও সে অনুসন্ধিৎসু ও রোমাঞ্চের অনুরাগী।
    এত কথা বললাম, সুস্মিতার গল্পের কারনে। গল্পটি পড়তে পড়তে আমার সেই কৈশোরের মনটি ফিরে পেলাম আবার। গল্পটির এমন বাঁধুনি, যে পড়তে পড়তে আবার সেই কিশোর বয়েসে পৌঁছে গেলাম। কল্পবিজ্ঞান যে কেন এখনো জনপ্রিয়, তা শ্রীমতি কুন্ডুর লেখাটি পড়ে আবার মালুম হল। মানুষের মঙ্গলের জন্য যে প্রকল্প দুই বিজ্ঞানী হাতে নিয়েছিল, তা যখন মানুষেরই ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে বিনষ্ট করবার রুদ্ধশ্বাস কাহিনী বয়ন আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে। তার লেখার এমনই যাদু যে পাঠক কিছুতেই গল্পটি শেষ না করে উঠতে পারে না। সাংবাদিক এই গল্পে একজন অনুঘটক মাত্র। তার ন্যারেশনে গল্পটি উন্মোচিত হয়। অভিযানে তার ও মাঝির সংযুক্ত হওয়াটা গল্পে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে মানব সভ্যতা আজ যে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে,বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, ইতস্তত যুদ্ধবিগ্রহ সেই মরণের মোকাবিলায় সাংবাদিক ও মাঝির মত সকলকে এগিয়ে আসতে হবে,হাত লাগাতে হবে সে ইঙ্গিত দিয়ে গেল দ্বীপের ওপারে।
    শ্রীমতি কুন্ডুকে এই রুদ্ধশ্বাস গল্পটির জন্য ধন্যবাদ।শ্রীমতি কুন্ডুর এইরকম লেখা আগামীদিনে আনন্দমেলা,কিশোরভারতীতে প্রকাশিত হবে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

    আইজাক সাহা

    ReplyDelete
    Replies
    1. আইজাক দাদাভাই আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। গল্পটি সকলের এত ভাল লাগবে এ আমি ভাবতে পারিনি।
      দাদাভাই সবরকম গল্প লিখলেও মন বেশি টানে কিশোর সাহিত্যের দিকে। ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথা, সহজ সরল শৈশবের গল্পতেই মনটা আটকে পড়ে আছে।

      Delete
  5. Chomotkar lekha jodio Septopasher Khide ba ei dhoroner carnivorous plant der niye lekha bangla golpo uponyas gulo mone koriye dei, aro lekha porar opekhai roilam :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদমই তাই। এই বিষয়টায় সত্যি অনেক গল্প আছে। আরো লেখার চেষ্টা করছি এবং অবশ্যই লিখবো ☺️☺️☺️

      Delete
  6. টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছ গল্পের শেষ পর্যন্ত। এই বিষয়ে বেশ কিছু গল্প থাকলেও এটা পড়তে খুব ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল, তোমার কলম এগিয়ে চলুক।

    ReplyDelete
  7. টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছ গল্পের শেষ পর্যন্ত। এই বিষয়ে বেশ কিছু গল্প থাকলেও এটা পড়তে খুব ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল, তোমার কলম এগিয়ে চলুক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ তোমায় ধূপছায়া। ☺️☺️

      Delete
  8. চমকপ্রদ বিজ্ঞানভিত্তিক গা শিরশির করা গল্প। সুস্মিতার কলমে জাদু আছে, পাঠককে বুলেট ট্রেনে সওয়ার করে একটা ট্রিমেন্ডাস স্পিডি রাইড দেয়।

    ReplyDelete