আমার ম্যাজিক অভিযান:: টো টো কাহিনি (তৃতীয় পর্ব) - তাপস মৌলিক

আগের পর্বগুলি – প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব

টো টো কাহিনি
(তৃতীয় পর্ব)
তাপস মৌলিক

তিরিশ বছর আগের কথা। কলেজে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। পড়াশুনো তো ঘন্টা করি! খালি আড্ডা, সিনেমা আর দু’দিন ছুটি পেলেই ক’জন বন্ধু মিলে যেখানেসেখানে বেরিয়ে পড়া, ঘুরতে। কিন্তু ঘুরব যে, পকেট তো ঢুঢু! প্রধান ভরসা তাই এগারো নম্বর, শোওয়ার জন্য হট্টমন্দির খুঁজি, খাওয়ার জন্য ‘যত্রতত্র’ নামের কোনও হোটেল। সদ্য লায়েক হয়েছি, দুনিয়ার কাউক্কে পরোয়া করি না, যদি কেউ উলটো গায় তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দি। তখন ভাবতাম হুজুগ, নেশা। এখন বুঝি, নিজেদের অজান্তেই কখন যেন কলেজ ছাড়িয়ে আদি ও অকৃত্রিম এই পৃথিবীর পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেছিলাম...

‘মোদের কিছু নাই রে নাই’

যেতে পারি, কিন্তু কোথায় যাব?

কলেজফেরত হোস্টেলের ক্যান্টিনে টিফিন খাচ্ছি। কাল-পরশু দু’দিন ছুটি। কী করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা। এত সময় কাটাই কী করে! পরীক্ষার এখনও তিনমাস দেরি, পড়াশুনোর প্রশ্নই নেই। নতুন সিনেমাও দেখার কিছু বাকি নেই আর। হোস্টেলে থাকলে তো খালি ঘুমোব আর দিনরাত আড্ডা মারব। তারচে কোথাও বেড়িয়ে এলে হয়। সমস্যা হল, পয়সাকড়ি নেই বেশি হাতে।
       শঙ্কর বলল, “চল দেখি, কত আছে ঝেড়েঝুড়ে।”
       তিনজনের পকেট ঝেড়ে মোট বেরোল এক’শ পঁয়ত্রিশ টাকা।
       ভাস্কর বলল, “চলবে, যাওয়া যায়। যদ্দূর অবধি পয়সা থাকবে তদ্দূর যাব।”
       বললাম, “তারপর ফিরব কী করে?”
       “ফিরতে তো হবেই, সে পয়সা থাক আর নাই থাক। ও নিয়ে এখন ভেবে কী লাভ?”
       ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় যাব? আমি বললাম বনে, শঙ্কর বলল পাহাড়ে, ভাস্কর বলল সমুদ্রে। শঙ্কর পাহাড় নিয়ে কী একটা বই পড়েছে, তারপর থেকে হিমালয়ের তুষাররাজ্য নাকি ওকে হাতছানি দিচ্ছে। ভাস্কর বলল কোনারকের সমুদ্রের ঢেউ পুরীর চেয়ে ঢের বড়ো বড়ো। আমি বললাম, “ছোটোবেলা থেকে শুনছি – বন্যেরা বনে সুন্দর, অথচ এখনও অবধি নিজেদের সৌন্দর্যটা কিনা নিজেরাই দেখলাম না!”
       তুষাররাজ্য কিম্বা কোনারকে দু’দিনে ঘুরে আসাটা একটু টাফ। তাও আবার সঙ্গে এক’শ পঁয়ত্রিশ টাকা! বিনা টিকিটে যদি প্লেনে চড়া যেত তাহলে একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু ব্যাপারটাতে আমাদের কারুরই খুব একটা কনফিডেন্স নেই। শেষকালে এমন তর্ক বেধে গেল যে সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি নেমে খাবার সময় হয়ে গেল, তাও কোথায় যাব ঠিক হল নাসবচেয়ে বড়ো সমস্যা যেটা, তিনজন তিনজায়গায় যেতে চাইলে একসঙ্গে যাই কী করে! অগত্যা ঠিক হল, কোথায় যাব সেটা না হয় যেতে যেতেই ঠিক করা যাবে।
       পরদিন ভোরে উঠে রওনা। জিনিসপত্র গোছগাছ নিয়ে ফের একপ্রস্থ ঝামেলা। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, ভালোই শীত যেখানে যাব সেখানে হয়তো আরও ঠান্ডা পেলাম। তাই তিনজন তিনটে কম্বল নিয়ে নিলাম। আর বাকি টুকটাক জিনিস, গরম জামাকাপড় তো গায়েই আছে সব। একটা বড়ো ব্যাগেই এঁটে যেত, কিন্তু সেটা বইবে কে? তাই তিনটে ব্যাগ হল। বেরোনোর সময় ক্যান্টিনের ক্ষুদিরামদা বলে, “যান কই সব?” বললাম, “ফিরে এসে বলব’খন
       হাওড়া স্টেশনে এসে সোজা একটা লোকাল ট্রেনে উঠে বসলাম। কোথায় যাব তারই যখন ঠিক নেই তখন ট্রেন নিয়ে খামোখা বাছবিচার করে কী লাভ? টিকিটের ঝামেলাও নেই, পয়সা বাঁচাতে হবে কিনা! আধঘন্টা চলার পর বোঝা গেল ট্রেনটা বর্ধমান লোকাল। ভাস্কর নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “যাক!”
       ভাস্করের বাড়ি বর্ধমান। এ লাইনে বিনা টিকিটে যাওয়াআসায় ও ডক্টরেট করেছে। একবার কলেজে বাইরের ছেলেরা গোলমাল করায় কলেজ কিছুদিন বন্ধ ছিল, হোস্টেল ফাঁকা করে আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছিল। খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল। কাগজের সেই কাটিংটা সর্বদা ভাস্করের পার্সে থাকত, তাতে ডেট-ফেট কিচ্ছু লেখা নেই। চেকার টিকিট চাইলেই কাটিংটা দেখিয়ে সে বলত, “কী করব বলুন! দেখুন ইমিডিয়েটলি হোস্টেল ফাঁকা করে দিতে বলেছে। টিকিট কাটব কি, দাড়িটা কামিয়ে আসারও সময় পাইনি!”
পার্স থেকে বার করে ভাস্কর কাটিংটা একবার দেখে নিল।
সাড়ে ন’টা নাগাদ আড্ডা মারতে মারতে বর্ধমান পৌঁছে গেলাম। অতঃ কিম্? দেখি একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন বোলপুর যাচ্ছে। চড়ে বসলাম তাতে। শান্তিনিকেতন আমি দেখিনি, শঙ্কর একবার এসেছে, ভাস্কর বেশ কয়েকবার। বলল, “জায়গা মন্দ নয়, যাওয়া যায়।” বোলপুর নেমে রেললাইন টপকে একটা ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক গলে রাস্তায় নামলাম। ভাস্কর ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিল টিটিই-কে একবার টাটা করে আসবে, শঙ্কর বলল, “ছেড়ে দে, অনেক চান্স পাবি।”

আমোদের শান্তিনিকেতন

বোলপুর স্টেশনের বাইরের রাস্তা, দু’ধারে খাবার হোটেল। হোটেলের লোকজন হাঁকাহাঁকি করছে, “গরম ভাত, মাছ, মুরগি, পাঁঠা সব পাবেন। চলে আসুন দাদা।”
একে তো বেলা হয়েছে, তার ওপর এরকম ডাকাডাকিতে প্রবল খিদে পেয়ে গেল। ঢুকলাম একটা হোটেলে। শঙ্কর বলল, “পয়সা থাকতে ভালোমন্দ খেয়ে নি। ফুরিয়ে গেলে কী খাব তার তো ঠিক নেই!” ভাস্কর বলল, “ঠিক কথা, লাগাও মুরগির ঝোল।”
আমি এতক্ষণে বুঝলাম আমাকে ক্যাশিয়ার করার পেছনে কী গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। পকেটে এক’শ পঁয়ত্রিশ টাকা, ওদিকে বলে কিনা মুরগির ঝোল! বললাম, “হবে না, তোদের প্ল্যানটা কী? খাওয়াদাওয়া সেরে আবার ফেরার ট্রেনে উঠব?”
ভাস্কর বলল, “ঠিক আছে, তোকে খেতে হবে না, তুই নিরামিষ খা। দাদা, আলুসেদ্ধ হবে? একটা আলুসেদ্ধ-ভাত আর দুটো মুরগির ঝোল-ভাত দিন।”
আমি বললাম, “আমার আলুসেদ্ধও লাগবে না। দাদা আপনি দু’টো মুরগির ঝোলকে তিনটে করে দিন।”
শঙ্কর বলল, “আমারটাতে ভাগাভাগি চলবে না। দাদা, আপনি একটা আস্ত প্লেট দেবেন, আর একটা ভাগাভাগি করে ওদের দিয়ে দিন। আমি নয় ওই টেবিলে গিয়ে বসছি।”
হোটেলদাদা এতক্ষণ হাঁ করে ব্যাপার বুঝছিল। এবার ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “দু’টোকে তিনটে করা যায়, একটাকে দুটো করব কী করে?”
“কেন?”
“এক প্লেটে তো তিন পিস থাকে!”
ভাস্কর আমায় বলল, “কেন কিপটেমি করছিস? এখন অবধি তো একপয়সা গলাসনি। বউনিটা মুরগি দিয়ে করলে দেখবি পুরো ট্যুরটা ভালো ভালো খাব। না হলেই বরং না খেয়ে থাকতে হবে।”
অগত্যা দাদাকে নিশ্চিন্ত করে তিন প্লেটেরই অর্ডার দেওয়া হল। ভাস্কর বলল রাত্রে খাওয়ার ভার ওর। তাতে বুঝলাম এবেলাই যা খাওয়ার খেয়ে নিতে হবে।
গরম ভাত আর মুরগির ঝোল। কখন যে এল আর কখন সাবাড় হয়ে গেল কিছু হদিশ করা গেল না। যেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। এক’শ পঁয়ত্রিশ টাকার মধ্যে ষাট টাকা মুরগির ঝোলেই বেরিয়ে গেল।
ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে রাস্তায় নামলাম। সামনেই রিকশাস্ট্যান্ড। এগোতেই চার-পাঁচজন রিকশাওয়ালা ‘কোথায় যাবেন দাদা’ ‘চলে আসুন’ করতে করতে আমাদের দিকে ধেয়ে এল। আর তাইতে আমাদের বেদম হাসি পেয়ে গেল। হাঁটার পয়সা নেই, বলে কিনা রিকশা চড়তে! শঙ্কর তো হাসতে হাসতে ‘ওরে বাবারে, হালুম রে, হুলুম রে, গেলুম রে’ বলতে বলতে রাস্তার ওপরই ল্যাটা দিয়ে বসে পড়ল। রিকশাওয়ালারা বেজায় অবাক। এত হাসির কী আছে? কারও কারও মুখ দেখে মনে হল বেশ চটেও গেছে, ভেবেছে আমরা বুঝি ওদের নিয়েই মশকরা করছি। ওদের বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থা তখন নেই আমাদের। ভরপেট খাওয়ার পর অট্টহাসি হেসে পেট ব্যথা হয়ে গেছে। কোনওরকমে রুমাল দিয়ে হাসি-টাসি মুছে সামনে এগোলাম।

শান্তিনিকেতন। সুন্দর রাস্তা। দু’পাশে গাছ। ছায়া। পাখি ডাকছে। মেয়েরা সাইকেল চালাচ্ছে। প্রচুর লোকজন বেড়াতে এসেছে। দু’তিনটে ট্যুরিস্ট বাস রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ট্যুরিস্টদের এক একটা দল নিয়ে গাইডরা খুব বোঝাচ্ছে। একটা মাঠ দেখিয়ে একজন গাইড শুনি তেড়ে বক্তৃতা করছেন, “এই যে সবুজ মাঠ দেখছেন, এখানেই গুরুদেব ছোটোবেলায় ফুটবল খেলতেন। কচি কচি ঘাসের আগায় এখনও হয়তো তাঁর পায়ের ধুলো লেগে আছে।”
আমাদের গাইড আজ ভাস্কর। কারণ ওর দেশের বাড়ি বীরভূম। এখানেও বারকতক এসেছে। রামকিঙ্করের গড়া মূর্তি-টুর্তি দেখিয়ে আমাদের সে নিয়ে গেল আম্রকুঞ্জে।
দিব্যি জায়গা। ভাতঘুমের পক্ষে আদর্শ। পা ছড়িয়ে বসা গেল। জায়গাটা ফাঁকা, আজ নাকি স্কুল ছুটি। শুধু এক ভদ্রলোক এক গাছের তলায় চুপচাপ বসে ছিলেন। ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, বছর পঞ্চাশ বয়েস, শিক্ষক শিক্ষক ভাব। ভাব কেন, শিক্ষকই হবেন। কেননা আমাদের বেশ স্নেহমিশ্রিত সুরে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, “কোত্থেকে আসচ বাবারা? ঘুরে দেকেচ সব?”
কথাবার্তা ভালোই চলছিল। এর মধ্যে শঙ্কর হঠাৎ ভারী ভালোমানুষের মতো মুখ করে বেমক্কা জিগ্যেস করে বসল, “আচ্ছা, এই যে আপনারা গাছের তলায় ক্লাস নেন, ধরুন গরমকালে কোনও ছাত্রের মাথায় আম পড়ল, কিম্বা ধরুন হঠাৎ একটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে আপনাকে কামড়ে দিল, তখন কী হয়? ক্লাস চলবে?”
ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর কেটে কেটে বললেন, “চলবে। যতদিন শান্তিনিকেতন থাকবে, চলবে।”
তাল কেটে গেল। আমরাও কেটে পড়লাম।

বিকেলে একটা ঝুপড়ি দোকানে চা খেতে খেতে শঙ্কর বলল, “দুপুরের খাওয়াটা তো ভালোই হল। রাত্তিরে থাকবি কোথায়?”
ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে বলে, “কেন? হট্টমন্দিরে? ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে! দাদা, এখানকার হট্টমন্দিরটা কোথায়?” বলে চায়ের দোকানের মালিকটির দিকে তাকাল।
শঙ্কর বলল, “ফাজলামি রাখ। ফান্ডে আছে কত?”
বললাম, “তিয়াত্তর টাকা পঞ্চাশ পয়সা।”
ভাস্কর বলল, “এই পয়সায় তুই কি হোটেলে থাকার মতলব করছিস নাকি? তোর মামার হোটেল আছে বুঝি এখানে? আমি তো বললাম, রাত্রে খাওয়াদাওয়ার ভার আমার, থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। চল শ্রীনিকেতন যাই। সেখানে একটা হোস্টেল আছে। বর্ধমানের প্রচুর ছেলে থাকে।”
“তুই চিনিস তাদের?”
“চিনি না মানে? বর্ধমানের ছেলে, আর আমি চিনব না? আর আমি না চিনলেও আমাকে সবাই চেনে।”
হাঁটা দিলাম শ্রীনিকেতনের দিকে। বেশ অনেকটা রাস্তা। জিগ্যেস করে করে যখন হোস্টেলটা খুঁজে বার করলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। নিচের কমনরুমে চারটে ছেলে ক্যারম খেলছিল। ভাস্কর গিয়ে তাদের জিগ্যেস করল, “দেবাশিস আছে?”
“কোন দেবাশিস? দেবাশিস কী?”
“আরে বর্ধমানের দেবাশিস, টাইটেলটা মনে পড়ছে না।”
“বর্ধমানের দেবাশিস? বর্ধমানের... বর্ধমানের...”
“আচ্ছা অমিতাভ আছে? অথবা কৌশিক?”
“অমিতাভদা? অমিতাভদা তো বর্ধমানের নয়, ওর বাড়ি তো মেমারি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অমিতাভ, মেমারির অমিতাভ, বর্ধমানেই তো পড়ত। কোন রুমে থাকে?” ভাস্কর বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল।
“অমিতাভদা তো কাল বাড়ি গেছে। আজ পৌষ সংক্রান্তির ছুটি, কাল রোববার। পরশু সকালে আসবে।”
“সে কী? বাড়ি চলে গেল? এদিকে আমাদের আসতে বলে দিয়েছে! বলেছিল, এই দু’দিন ছুটি আছে, চলে আয়, শান্তিনিকেতন ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।”
“তোমরা কোথা থেকে আসছ?”
“কলকাতা।”
“ঠিক আছে, দাঁড়াও, অমিতাভদার রুমমেট উজ্জ্বল আছে, ওকে ডাকি।”
দুটো ছেলে উজ্জ্বলকে ডাকতে গেল, তাদের জায়গায় আমাদের দু’জন ক্যারম খেলতে লেগে পড়লাম। মিনিট দশেক পর উজ্জ্বল এল। তার সঙ্গে দোতলায় অমিতাভর ঘরে গেলাম। একটা রুমে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা। উজ্জ্বল ছাড়া বাকি দু’জন আজ নেই। উজ্জ্বল বলল, “আরেকজনের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। অনেকেই বাড়ি গেছে আজ, হোস্টেল ফাঁকা।”
ভাস্কর বলল, “তোমাদের হোস্টেলে ক্যান্টিন আছে তো? আমাদের ডিনারটা বলে দিও, পয়সা আমরাই দিয়ে দেব।”
“না না, সে কী! পয়সা দেবে কেন? অমিতাভদা শুনলে আমায় মেরে ফেলবে। ডিনার আমি বলে দিচ্ছি। তোমরা রেস্ট নাও। আমি একটু বেরোচ্ছি, সাড়ে ন’টার সময় একসঙ্গে খেতে যাব। আর অমিতাভদা হয়তো কাল সকালেই ফিরে আসবে।”
উজ্জ্বল বেরিয়ে গেল। ভাস্কর ব্যাগটা একটা খাটে ছুঁড়ে ফেলে ধপাস করে বসে পড়ে শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়েছে? ভোজনং অ্যান্ড শয়নং? বলেছি যখন খাওয়াব তখন আলবাত খাওয়াব।”
শঙ্কর এতক্ষণ খুব চুপচাপ ছিল। হঠাৎ গম্ভীরভাবে বলল, “আমি খাব না।”
ভাস্কর অবাক, “খাবি না কেন? মুরগি হজম হয়নি এখনও?”
“অমিতাভকে তুই চিনিস?”
“নোঃ! শুধু অমিতাভ কেন, অমিতাভ দেবাশিস কৌশিক কাউকে চিনি না। ওইটাই তো বুদ্ধি। এখানে বর্ধমানের কিছু ছেলে থাকবে সেটা স্বাভাবিক। আর দেবাশিস, অমিতাভ, কৌশিক এগুলো খুব কমন নাম। প্রতিটা হোস্টেলে তিন-চারটে করে থাকবেই। তাদের কেউ যদি বর্ধমানের হয়, তাহলেই ব্যস, গোল!! প্রবাবিলিটির অঙ্ক।”
“অমিতাভ পরশু ফিরে এসে যখন আমাদের কথা শুনবে তখন কী হবে?”
“কী আর হবে? চিনবে না। ভাববে, ঈশ, আমার এত ক্লোজ ফ্রেন্ডদের নাম আমি মনেই করতে পারছি না? ছি ছি! আমাদের আর পাবে কোথায় তখন? আমরা তো কালই ভোকাট্টা।”
“আর যদি কাল সকালেই চলে আসে?”
“এলে আসবে, সে আমি ম্যানেজ করে দেব। তাছাড়া আমরা তো ভোরবেলাই বেরিয়ে যাব।”
শঙ্কর বলল, “আমি এর মধ্যে নেই। তুই বর্ধমানের ছেলে, তুই থাক। আমি কোপাই নদীর ধারে থাকব।”
দু’জনের প্রবল তর্কাতর্কি শুরু হল। ভাস্কর যত মিষ্টি করে ‘মধ্যবিত্ত’, ‘ভেতো বাঙালি’, ‘ভীতুর ডিম’ ইত্যাদি বলে গাল দেয়, শঙ্কর তত বেঁকে বসে – “এরকম ধাপ্পাবাজি ফ্রডগিরিতে আমি নেই। দরকার হলে উপোস করে থাকব, কোপাই নদীর জল খেয়ে থাকব।”
শেষে দু’জনেই আমার দিকে ফিরল, “তুই কী বলিস?”
বললাম, “কাল রাতে আমরা হোস্টেলে ছিলাম। আজও সেই হোস্টেলেই আছি। তাহলে বেড়ানোটা আর হল কোথায়? তারচে কোপাই নদীর ধারটা ইন্টারেস্টিং শোনাচ্ছে।”
ব্যাগ উঠিয়ে ফের বেরিয়ে পড়লাম। নিচে ছেলে চারটে তখনও ক্যারম খেলছিল। শঙ্কর তাদের ডিনারটা ক্যানসেল করে দিতে বললআর বলল, উজ্জ্বল ফিরলে যেন বলে দেয়, আমরা আমাদের এক আত্মীয়র বাড়ি চলে যাচ্ছি, রাতে সেখানেই থাকব।”

রাত ন’টা। টিমটিমে কুপির আলোয় শ্রীনিকেতনের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছি। এক গ্লাস গরম চা’য়ে পাউরুটির লোফ ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাস্কর গজগজ করে চলেছে, “ধুর ধুর!! সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়।”
বললাম, “এরপর কোথায়?”
ভাস্কর বলল, “কেন? কোপাইয়ের ধারে যাবি না?”
শঙ্কর বলল, “হ্যাঁ চল, যাব না কেন? চাঁদের আলোয় কোপাই যা লাগবে না!”
ভাস্কর বলল, “ঠান্ডায় চাঁদের আলো বেরিয়ে যাবে, চল না! ঘ্যামা ব্যবস্থা করে দিলাম, সেটা তোদের পছন্দ হল না।”
চায়ের দোকানের মালিকের কাছে ডিরেকশন জেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চাঁদ এখনও ওঠেনি, চারদিক নিঝুম অন্ধকার। এই সাড়ে ন’টাতেই বোধহয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠান্ডাও পড়েছে ভালোই। মাফলার, টুপি ইত্যাদি যার যা সম্পত্তি আছে ব্যাগ থেকে বার করে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। বাড়িঘর শেষ হয়ে গিয়ে রাস্তাটা কীরকম একটা জঙ্গল জঙ্গল জায়গা দিয়ে এগোচ্ছে। শঙ্কর আর আমি হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম, ‘মোদের কিছু নাই রে নাই, আমরা ঘরে বাইরে গাই, তাই রে নাই রে নাই রে না, না না না।’ ভাস্কর তাতে যোগ না দেওয়ায় বুঝলাম ও এখনও রাগে গজগজ করছে।
গান গাইলে ঠান্ডা একটু কম লাগে। কিন্তু একটু পরেই রাস্তাটা এমন একটা থমথমে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল যে আমাদের গান থেমে গেল। চাপ চাপ অন্ধকার যেন চারপাশ থেকে আমাদের গিলে খেতে চাইছে। এখানে আমাদের উপস্থিতি জানান দেওয়াটাই কীরকম অস্বস্তিকর লাগছিল। গ্রামের লোকজন যদি কেউ কিছু সন্দেহ করে বেরিয়ে আসে! অবশ্য এই জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম-ট্রাম আছে কিনা তাই বা কে জানে! গান থামিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলাম। শঙ্করকে জিগ্যেস করলাম, “কোথায় তোর কোপাই নদী?”
ভাস্কর মাঝেমধ্যেই খুকখুক করে কাশছিল আর গলা খাঁকারি দিচ্ছিল। ব্যাগ থেকে ওর কম্বলটা বার করে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে হঠাৎ বলল, “গলাটা কেমন খুসখুস করছে, একটু গার্গল করলে হয়।”
হাসি পেয়ে গেল। “এই জঙ্গলের মধ্যে তোর হঠাৎ গার্গল পেয়ে গেল? আর সময় পেলি না? ঠান্ডা জলে কি আর গার্গল হয়?”
ভাস্কর বলল, “ঠান্ডা জলে কেন? গরম জলেই করব। ওই দ্যাখ, ওই দিকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোনও বাড়ি আছে ওখানে। চল গিয়ে দেখি।”
গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটু দূরে একটা লন্ঠন বা কিছুর আলো দেখা যাচ্ছিল সত্যিই। খানিক পরে দেখা গেল একটা পায়ে চলা পথ সেদিকে গেছে। ভাস্কর সে রাস্তায় নেমে পড়ে বলল, “দাঁড়া, একটু গার্গল করে আসি।”
শঙ্কর বলল, “তুই কি মার খাওয়াবি আমাদের? এই রাত্তিরবেলা কার না কার বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিস!”
ভাস্কর অবিচল, “তোরা এখানে দাঁড়া না। তোদের কে যেতে বলেছে? আমি যাব আর একটু গার্গল করেই চলে আসব।”
এ খ্যাপাকে আটকানো মুশকিল, আবার একা ছাড়াও যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও চললাম ভাস্করের পেছন পেছন।
আলোটা একটা বাড়ির থেকেই আসছে বটে। একতলা একটা মাটির বাড়ি, সামনে একটা উঁচু বারান্দা, তাতে বাঁশের খুঁটিতে ঠেকনা দেওয়া খড়ের চাল। বারান্দার সামনে একটা ছোটো নিকোনো উঠোন। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বারান্দায় একটা হ্যারিকেন রাখা। সেই আলোয় উঠোনের একপ্রান্তে একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে একটা ঘটি থেকে জল ঢেলে ঢেলে হাত-মুখ ধুচ্ছে, মনে হয় এইমাত্র রাতের খাওয়া খেয়ে উঠল। ভাস্কর সোজা এগিয়ে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, একটু গরম জল পাওয়া যাবে? একটু গার্গল করতাম।”
মেয়েটা আমাদের লক্ষই করেনি। হঠাৎ আগাপাশতলা কম্বল মুড়ি দেওয়া ভাস্করকে আর তার পেছনে আমাদের দেখে ‘ওরে বাবা গো, মা গো, ভূত’ বলে ঠং করে ঘটিটা মাটিতে ফেলে পড়ি কি মরি ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে খিল দিয়ে দিল। ভেতর থেকে তার পরিত্রাহি চিৎকার আর কান্না শোনা যেতে লাগল। আর, একটি পুরুষ আর একটি মহিলা কণ্ঠ শুনলাম মেয়েটিকে বলছে, “আরে হলটা কী? কী দেখেছিস তুই? ভূত আবার কী? বাইরে কেউ ছিল নাকি? ঠিক করে বল না কান্না থামিয়ে।”
ভাস্কর একটু এগিয়ে গিয়ে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা ভূত নই, বর্তমান। একটু গরম জল পাওয়া যাবে? গার্গল করতে এসেছি।”


এরপর আগামী সংখ্যায়
_____
ছবিঃ লেখক

8 comments:

  1. অল্প কিছুদিন আগেই কোপাইয়ের তীর থেকে ঘুরে এলাম। কিন্তু আপনার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আমাকে আবার নতুন করে ঘুরে আসবার জন্য উদ্দীপিত করল। অসাধারণ লিখেছেন। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ বাবিন। পরের পর্বে কোপাইয়ের ধারে পৌঁছব। :-)

      Delete
  2. আমি শান্তিনিকেতনের সব কিছু দুদিন ধরে দেখেছি, কিন্তু কোপাই নদী বা জঙ্গলে যাইনি বলে আপশোষ হচ্ছে। পরের বার ওসব জায়গায় যাব। এই লেখাটা খুব উপভোগ করলাম। আমার কলেজ জীবনকে মনে করিয়ে দিল। তখন পরপর কয়েকদিন ছুটি পেলেই বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে পড়তাম।

    ReplyDelete
  3. aahaaa..darun darun..anabadyo..notun sonkhya elei sabcheye age toto kahini porte jhapiye pori..

    ReplyDelete
  4. Darun laglo Tapas da.Kintu porer part ta kobe pabo?

    ReplyDelete