গল্পের ম্যাজিক:: ফুলচুরির সাতকাহন - অঙ্কিতা সিংহরায়


ফুলচুরির সাতকাহন
অঙ্কিতা সিংহরায়

“আমাদের ছোটবেলায় সরস্বতীপুজোর সে এক আলাদা আমেজ ছিল। এখনকার ছেলেছোকরারা আর তার কতটাই বা পায়?” বলে মেজদাদু যেই একটু গল্প গল্প আভাস দিলেন তখন বাড়ির কুঁচো-কাঁচা যতগুলো এপাশ ওপাশে ঘুরঘুর করছিল, সেগুলো মেজদাদুর চারপাশে উৎসুক মুখ করে গা ঘেঁষে এল। ভাবখানা এই, তারা মেজদাদুর ছোটবেলার গল্প শুনতে বিশেষ আগ্রহী। কুঁচো-কাঁচাদের মধ্যে বাবলু, টুবাই, ফড়িং এদের নেহাত কুঁচো বললে তারা একটু অপমান বোধ করে। কেননা, আজকাল ওরা ‘কোন ক্লাস’ জিজ্ঞাসা করলে বলে, “এই তো সামনের বছর ক্লাস নাইন হবে
অর্থাৎ নিজেদের একটু বড়ো করে জাহির করার প্রয়াস চোখে পড়ে। তবে বিন্তি, পুঁটু নেহাতই ছোট। নার্সারি, প্রি-স্কুলে তাদের সবে যাতায়াত শুরু হয়েছে। আর ঘোতন ক্লাস ফাইভে উঠে এই দুইয়ের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক। তবে বয়স যার যাই হোক না কেন মেজদাদুর গল্প বলার ধরনই একরকম, ছোটবড়ো সবার কাছে একইরকম জনপ্রিয়। আর সবে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাই এখন মামাবাড়িতে সবার আস্তানা হয়েছে, আর দেদার মজা, হুটোপাটি তো চলছেই তবে মেজদাদুর গল্প ছাড়া তা যেন অসম্পূর্ণ।
এখানে বলে রাখা ভালো, মেজদাদু মানুষটি ছোটদের কাছে যতটাই প্রিয়, আদতে তিনি ততটাই রাশভারী গুণী মানুষপ্রথম জীবনে মিলিটারিতে জয়েন করে কয়েকবছর দেশে বিদেশে পোস্টিং ও অনেকটা সময় সীমান্তেও কাটিয়েছেন। পরবর্তীকালে সেই চাকরি ছেড়ে তিনি আবার পড়াশোনায় ফিরে আসেন এবং বাকি জীবন অধ্যাপনা করে কাটান। তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁর জীবনের সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর সর্বোপরি তাঁর অদ্ভুত গল্প বলার ধরন সবাইকে আকৃষ্ট করে। তা সে কথা থাক, এখন আপাতত মেজদাদু হালকা শীতের সন্ধ্যেবেলায় গায়ে চাদর জড়িয়ে দক্ষিণ দিকের বৈঠকখানায় তক্তপোশেই আমেজ করে বসলেন আর গল্প শোনার লোভে ছোটরা সবাই তাকে ঘিরে বসল। এমন সময় মা এসে ধোঁয়া ওঠা গরম দার্জিলিং চায়ের কাপ দিয়ে গেল দাদুর জলচৌকির ওপর। মেজদাদু একটা লম্বা শ্বাসে সেই সুঘ্রাণ টেনে নিয়ে শুরু করলেন।
“সে অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন তোমাদের বয়সের কি আরেকটু বড়োআমাদের তখন ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা ছিল এখনকার মাধ্যমিক বা সি.বি.এস.. বোর্ড পরীক্ষার মতোতা সেবার আমি ম্যাট্রিকুলেশান দিয়েছি। আমাদের তখন ডিসেম্বরে পরীক্ষা হত। তারপর নতুন বছরের শুরুতে আমরা বাগদেবীর পুজো করে নতুন ক্লাসে পড়াশোনায় মন দিতাম। তবে আমাদের সময়ে আমরা পুজোয় অনেক বেশি কাজ করতাম। যেমন পুজোর চাঁদা তোলা, ঠাকুর আনা, প্যান্ডেল করা, সাজসজ্জা সবেতেই হাত লাগাতাম। যদিও চাঁদা তোলাতে বাড়িতে ঘোর আপত্তি করতেন বাবা, তাই ওটা বাদ দিয়ে বাকি কাজেই আমি বেশি যোগ দিতাম। আর একটা অন্যতম কাজ ছিল পুজোর আগেরদিন রাতে ফুল চুরি করতে যাওয়া। সেটা ছিল অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের মতোবলাই বাহুল্য, বাড়ির বড়োদের চোখ এড়িয়ে যেতে হত। তা সে যাই হোক, সেবার আমার এমন এক অভিজ্ঞতা হল যে আমি আর কোনওদিন সাহস করে আর ও-কাজে যাইনি।
“সেবারে ঠিক হল আমরা জনাপাঁচেক ভোররাতে বের হব ফুলের খোঁজে। আমাদের গন্তব্য মোটামুটি স্থির ছিল। আমাদের গ্রামের শেষপ্রান্তে ছিল ঘোষালদের ফুলের চাষ। সেখানে হরেক রকমারি গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, সূর্যমুখী আরও কতরকমের মরশুমি ফুলের চাষ হত। প্রায় দু-তিন বিঘা জমিতে ছিল গাঁদাফুলের চাষ। মালিরাই সেসব ফুল পাহারা দিত, আর তার সঙ্গে ছিল মানুষ সমান উঁচু কাঁটাতারের বেড়া – দুটি সারিতে। আমাদের অনেকদিনের লক্ষ্য ছিল ওই ঘোষালদের বাগান। তো সেবার আমরা ওখানেই অভিযান করব মনস্থির করলাম। যথারীতি রাত দুটোর দিকে আমার অন্য সঙ্গীরা এসে আমায় ডাক দিল। আমি মাকে বলে আগেরদিন রাতে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। খিড়কির দরজাটায় বুড়ান এসে টুকটুক করে শব্দ করতেই আমি সাড়া দিলাম আর খুট করে দরজার ছিটকিনি খুলে পা টিপে টিপে বাবার তিন ব্যাটারি দেওয়া লম্বা টর্চটা বগলদাবা করে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে আমার বাকি সঙ্গীরা সবাই অপেক্ষা করছে
“আগামীকাল শুক্লা পঞ্চমী, আজ আকাশে চতুর্থীর একফালি চাঁদ। তার ক্ষীণ আলোয় অন্ধকার আরও যেন ঘনীভূত। শীতের আমেজও শেষরাতে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আমরা চারজন ঘোষালদের বাগানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। প্রায় এক-দেড় মাইল রাস্তা পার হয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম বাগানের পেছনের দিকের বেড়ার কাছে। রাত তখন আন্দাজ আড়াইটে তিনটে হবে। মালিদের ঘরগুলো অপর প্রান্তে। যতটা তাদের থেকে দূরে থাকা যায় ততটাই নিরাপদ। আমার অপর দুই বন্ধু বিল্টু আর শ্যামা কাঁটাতারের বেড়া টেনে ধরে এক মানুষ গলার মতো ব্যবস্থা করল আর তার মধ্যে দিয়ে আমি আর ন্যাপা চটপট ঢুকে পড়লাম বাগানে। পরে আমাদের সাহায্যে ওরাও ঢুকে এল ভেতরে। তারপর মুহূর্তের মধ্যে আমরা দু’হাতে ফুল তুলে ব্যাগ বোঝাই করতে লাগলাম। আর সদ্য ফোটা টাটকা গাঁদাফুলের বোঁটা ছেঁড়ার চটাপট চটাপট শব্দ হতে লাগল। এরকমভাবে কতক্ষণ হয়েছিল খেয়াল পড়ে না হঠাৎ আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম একটা শব্দে। আরে সর্বনাশ! মালিরা ফুল ছেঁড়ার শব্দে জেগে উঠেছে বা কেউ হয়তো জেগেই ছিল পাহারা দেওয়ার জন্যে বিশেষত পুজোর আগের রাত বলেই হয়তো বা।
“আরে, কৌন হ্যায় রে?”
“আরি বাপ!” বলে জনাতিনেক জাঁদরেল উড়ে মালি দরজা খুলে, “আরে লাঠি লে আও, তুম উধর যাও!” করতে করতে বার হয়ে ছুটে এল।
“আর এদিকে ততক্ষণে আমি কিছু বোঝার আগেই বুড়ান, বিল্টু আর শ্যামা তারের ফাঁক গলে ওধারে পড়ে পালানোর উপক্রম করে ফেলেছে। আমি পড়ে গেলাম বিপদেআমি অনেকটা ভেতরে চলে এসেছিলাম তাই পালানোর কোনও রাস্তা দেখলাম না। তার ওপর ওই কাঁটাতার একা পার হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু হতাশ হলে চলবে না। এদের হাতে ধরা পড়লে একটা হাড়ও আস্ত রাখবে না। তারপর থানা-পুলিশ পর্যন্ত যেতে পারে। তাহলে বাবা জানতে পারবে আর তখন কী হবে সেটা ভেবে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার। কিন্তু সে যা কপালে আছে হবে, এখন আপাতত বাঁচার শেষ চেষ্টা করি; এই ভেবে আমি গুঁড়ি দিয়ে একটা প্রকান্ড গাঁদাফুলের ঝোপের আড়ালে প্রায় দমবন্ধ করে বসে রইলাম। এই জায়গাটা বেশ এক মানুষ সমান উঁচু গাছের সারি এবং ঘন ঝোপ মতন হয়ে আছে। তাই কপাল গুণে বেঁচে গেলেও যেতে পারি। ইতিমধ্যে একজন মালি আমার খুব কাছে এসে পড়ল আর জোরালো টর্চের আলো ফেলে চারদিক দেখতে লাগল। এমন সময় অপর দু’জন দূর থেকে চিৎকার করে তৃতীয় জনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, “আরে সীতারাম, ইধর আও। ও লোগ ভাগ রাহা হ্যায়! আরে সারে কে সারে ফুল চুরা লিয়া হ্যায়! আরি বাপ!”
“সেই শুনে সীতারাম উল্টোদিকে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিল। আমি মনে মনে ইষ্টনাম জপ করতে লাগলাম। আরও কিছুক্ষণ ওরা এদিক ওদিক ইতস্তত ঘুরে-ফিরে শেষে ডেরায় ফিরে গেল। তবে বাকি রাত ওদের ঘরে আলো জ্বলতে লাগল। এদিকে আমি অনেকক্ষণ অন্ধকারে নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় একটু সাহস করে হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে একটু মুখ বাড়িয়ে চারদিকটা ভালো করে দেখে নিলাম। মালিদের ঘরটা আমার জায়গা থেকে বেশ দূরে কাউকে দেখতে পেলাম না। তারপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আরও একটু সাহস সঞ্চয় করে গুঁড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম কাঁটাতারের বেড়ার দিকে। তারপর তার ফাঁক করে কোনওপ্রকারে নিজেকে বার করে বাগানের পাশের নালাটায় পড়লাম। কাদার মধ্যে পা গেঁথে গেল সে থাক, পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে তখন বাড়ি ফিরতে পারলেই আমি খুশি যাই হোক, নালাটা পেরিয়ে ওপারে যখন উঠলাম তখন খেয়াল হল টর্চটা কোথায় ফেলে এসেছি সে মরুক গে যাক এখন কোনওপ্রকারে মালিদের চোখ এড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে পাকা রাস্তায় উঠতে পারলে তারপর এক লম্বা দৌড় মেরে বাড়ি পৌঁছতে পারলে এ যাত্রা বাঁচি


“রাত তখন আন্দাজ সাড়ে তিনটে- চারটে হবে আমি বড়ো রাস্তার ধারে এসে পৌঁছলাম কিন্তু কী মুশকিল, এত অন্ধকার যে আমি দিক ঠাহর করতে পারলাম না রাস্তার দু’ধারে প্রায় শতবর্ষ পুরোনো বিশালদেহী বট-অশ্বত্থগাছেদের সারিতাতে অন্ধকার যেন আরও জমাট বেঁধে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে কোনদিকে যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না এবার বেশ গা ছমছম করতে লাগল এই জায়গায় আগে কখনও একা আসিনি, আর রাতে তো নয়ই আমার বাকি সঙ্গীরাই বা কোথায় গেল? উড়ে মালিগুলো ওদের তাড়া করে ধরল কি না কে জানে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটা দিলাম সিধে রাস্তা ধরে এইভাবে কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না আন্দাজ আধঘন্টা হবেহঠাৎ দূর রাস্তার পারে দেখলাম একটা আলো জ্বলছে আমি চমকে গেলাম অনেকগুলো চিন্তা আর দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল কিছুক্ষণ আরও হেঁটে এগিয়ে গেলাম সেদিকে বলাই বাহুল্য, সেই ধূ ধূ জনমানবহীন প্রান্তরে আমি একা, আর হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা আগুনের আলোএকটা অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করল আমি একবার ভাবলাম পেছন ফিরে ছুটে পালাই পরক্ষণেই মনে হল পালাবই বা কোথায়? তাই যা থাকে কপালে বলে সাহস করে আরও কয়েক পা এগিয়ে যেতেই প্রথম লক্ষ করলাম একটা সাইকেল-রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে আর ওই আলোটা রিক্সার লম্ফটার আগুন। রিক্সাটার চালকের আসনে কে যেন একটা বসে আছে। এরপর আমার একটু স্বস্তি হল, যাক, কাউকে একটা পাওয়া গেল। কিন্তু মুহূর্তেই সেই স্বস্তিটা অস্বস্তিতে পরিণত হল। মনে সন্দেহ এল, এ কে? এত রাতে রাস্তার মাঝে এরকম অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়েই বা আছে কেন লোকটা? এইসব ভাবতে ভাবতে আমি মাত্র হাত দুয়েক দূরত্বে চলে এলাম। এবার লম্ফর আলোয় ভালো করেই দেখলাম, একটা মাঝবয়সী শুকনো চেহারার লোক স্থির হয়ে বিস্ফারিত চোখে বসে আছে একদম স্থির, যেন বেঁচে নেই! পাথরের মতো অবিচল। যেন ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে লোকটা কিছুতে। আমার উপস্থিতিও তার নজরে আসেনি।
“আমি থাকতে না পেরে লোকটাকে ডাকলাম, “দাদা, ও দাদা, শুনছেন?”
“কোনও সাড়া নেই। তখন আমি লোকটাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিলাম। লোকটা যেন ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে তুমি? এত রাতে কী করছ এখানে?”
“লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে একটা আঙুল দিয়ে রিক্সার যাত্রী আসনের দিকে ইঙ্গিত করল। তারপর যা দেখলাম সেরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি আমার জীবনে আর কখনও দেখিনি।
“দেখলাম রিক্সায় একটা কাটা নরমুন্ড পড়ে আছে! অর্ধদগ্ধ, পচাগলা, এককথায় বীভৎস। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। তারপর আচমকা সম্বিত ফিরে পেলাম। রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এমনটা কী করে হল?”
“সে তখন ভয়ে আধমরা হয়ে বলল, “আমি কিছু জানি না বাবু। আমি এই ভোররাতের ট্রেনের জন্যে একজন বাবুকে নিতে তার বাড়ি যাচ্ছিলামযাওয়ার আর মাইলটাক রাস্তা বাকি ছিল। পথে হঠাৎ একটা জোরে শব্দ পেলাম যেন ভারী কিছু একটা ধপ করে পড়ল ঠিক আমার পেছনে। আমি তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে চেয়ে দেখি এই কান্ড! তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। আমি কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছি তাও জানি না। বাবু আপনি না এলে হয়তো আমি ভয়েই এখানে মরে পড়ে থাকতাম।”
“আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু এটা এল কোথা থেকে?” বলে আমি ওপরের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তা আরও ভয়াবহ। একট বুড়ো অশ্বত্থগাছের নীচে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম, সেই গাছের ডালে আরও গোটা কতক নরমুন্ড এখানে ওখানে আটকে রয়েছে। বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গেলরিক্সাওয়ালা ‘ও মাগো!’ বলে সজোরে আর্তনাদ করে উঠল সে দৃশ্য দেখে। ভয়ে রামনাম জপতে শুরু করল।
“এতক্ষণে হঠাৎ আমার বুদ্ধি খুলে গেল, “আরে আমরা বোধহয় তেলিখানার শ্মশানের কাছে এসে পড়েছি!”
“আমি শুনেছিলাম এদিকেই কোথায় একটা আছে সেই শ্মশান আর খুব সম্ভবত এগুলো শকুনের কাজ। অনেকদিনই এমন হত যে ভালো করে শবদাহ করার আগেই শ্মশানযাত্রীরা শ্মশান ত্যাগ করত বা বৃষ্টিতে শবদাহ পন্ড হয়ে যেত। তখন সেই সব অর্ধদগ্ধ শবদেহ থেকে মুন্ড বিচ্ছিন্ন করে শকুনের দল গাছের ওপরে নিয়ে এসে জড়ো করত। এবং তারই একটা আজ এই বেচারা রিক্সাওয়ালার কপালে জুটে এই মহাবিভ্রাট ঘটিয়ে বসেছে। ভাগ্য ভালো যে আমি এসে পড়েছিলাম। না হলে ব্যাটা নির্ঘাত বেঘোরে মারা পড়ত।”
এতক্ষণ এক নিঃশ্বাসে বলে মেজদাদু যখন থামলেন তখন সবার অবস্থা দেখার মতো হল। ভয়ে চোখ গোল গোল করে লেপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটা মাথা। বিন্তি আর পুঁটি ভয়ে অনেকক্ষণ আগেই পালিয়ে গিয়ে মায়েদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এতক্ষণে বাবলু জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
মেজদাদু ভীতু মুখগুলোকে দেখে খুব একটু হা হা করে হাসলেন। তারপর বললেন, “তারপর আর কী? আমি লকড়ি জোগাড় করে সেই মুন্ডটা রিক্সা থেকে ফেলে দিলাম, আর সেই রিক্সাওয়ালাই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল। তখন ভোর হয়ে গেছে। এদিকে বুড়ান, শ্যামা ওরা বাড়িতে আমার ধরা পড়ার খবর দিয়ে গেছে। বাবা সব জানতে পেরে গেছেন। হুলুস্থুলু কান্ড। এমন সময় আমি বাড়িতে এসে হাজির। তা সে যাত্রা অল্পের ওপর দিয়েই গেল বটে, কিন্তু আমার যা শিক্ষা হল তাতে আমি ও পথ আর কখনও মাড়াইনি!”
_____
অলঙ্করণঃ অঙ্কিতা সিংহরায়

লেখক পরিচিতিঃ অঙ্কিতা সিংহরায় বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ সায়েন্সেস করছেন। কলকাতায় আর জি কর মেডিকেল কলেজ থেকে এম বি বি এস করে ২০১১ সালে ইউ এস এ আসেন তিনি সম্প্রতি উনি ক্লিনিকাল রিসার্চ এবং এপিডেমিওলজি নিয়ে কাজ করছেন। পড়াশোনার বাইরে পেইন্টিং, বই পড়া  আর গল্প লেখা ওনার হবি

1 comment: