পুরোনতুন গল্প:: বীর শিবাজী - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


বীর শিবাজী
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

ম্যাজিক ল্যাম্পের দুরন্ত অভিযান সংখ্যায় এইবার ছত্রপতি শিবাজীকে নিয়ে কিছু গল্প লিখতে বসলাম, যাঁর গোটা জীবনটাই ছিল যেন একটা অ্যাডভেঞ্চার। তোমরা অনেকেই হয়তো তাঁর কথা পড়েছ এবং পড়তে পড়তে তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছ। আমরা অনেকেই শিবাজীর দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিলক তো শিবাজী উৎসব নামে একটা উৎসবই চালু করে ফেললেন। মারাঠা বীর শিবাজী স্বরাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সম্পূর্ণ বিদেশি শাসন মুক্ত দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তখন বিদেশি শাসন মানে মুঘল শাসন। আর সেই সময় মুঘল শাসন ছিল অত্যাচারী। সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। কারণ, আকবরের মতো মহান সম্রাট সেদিন ছিলেন না, ছিলেন ঔরঙ্গজেব। তাঁর অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতের জাঠ থেকে শুরু করে শিখ, পাতিয়ালা ও আলোয়ারের সৎনামী সম্প্রদায়, রাজস্থানের রাজপুতরা, মধ্য ভারতের বুন্দেলখন্ডের বুন্দেলাগণ প্রত্যেকটা জাতিই বিদ্রোহ করেছিলআর মারাঠায় (আজকের মহারাষ্ট্র) ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলে। শিবাজীও ঔরঙ্গজেবের এই অত্যাচারী শাসনেবিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। শিবাজীকে জীবিত অবস্থায় বাদশাহ আলমগীর কোনদিনই হারাতে পারেননি। বিদ্রূপ করে শিবাজীকে বলতেন পার্বত্য মূষিক।


শিবনের পার্বত্য গিরিদুর্গে তাঁর জন্ম ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দেতাঁর বাবার নাম ছিল শাহজী ভোঁসলে এবং মায়ের নাম জীজাবাঈ। বাবা শাহজী প্রথমে আহম্মদনগর ও পরে বিজাপুরের সুলতানের অধীনে উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন। জীজাবাঈ ছিলেন দেবগিরির যাদববংশীয় জায়গীরদার যাদব রাওয়ের কন্যা। শাহজী থাকতেন বিজাপুরে নিজের দ্বিতীয় পত্নী তুকাবাঈ এবং শিশুপুত্র ব্যাঙ্কোজীকে নিয়ে। তাই বাবার স্নেহ-ভালোবাসা তিনি কোনদিন পাননি। মা জীজাবাঈ তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলে। মাকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। মহান মানুষদের জীবনী ঘাঁটলে জানা যায়, এঁরা প্রত্যেকেই মাকে খুব ভালোবাসতেন। নিজের মাকে ভালো না বাসলে, শ্রদ্ধা না করলে কখনও বড়ো হওয়া যায় না। মা ছোট্ট শিবাজীকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প বলতেন। শিবাজীও এই গল্পগুলো শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতেন সেই রামায়ণ-মহাভারতের যুগে। নিজের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা তিনি এই মহাকাব্যদুটি থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন। সম্ভবত তিনি লিখতে পড়তে জানতেন না। দাদাজী কোণ্ডদেব নামে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁকে শিখিয়েছিলেন অসিচালনা, ঘোড়ায় চড়া, রণকৌশল এবং এক আদর্শ শাসনব্যবস্থা কীভাবে গড়া যায় যেখানে প্রজাদের ভালো রাখা যায়। স্থানীয় পার্বত্য মাওয়ালি উপজাতির সাথে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন বন্ধুত্বের দ্বারা। এই মাওয়ালি উপজাতির মানুষদের নিয়েই তিনি প্রথম নিজের সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এই মানুষগুলো শিবাজীকে খুব ভালোবাসত।
দাদাজী কোণ্ডদেবে মৃত্যুর পর তিনি রাজ্য জয়ে মন দিলেন। ১৬৪৭-এ তিনি তোরণা দুর্গ দখল করেন। তাঁর প্রথম অভিযান ছিল এই তোরণা দুর্গ জয়। এরপর তিনি রায়গড়, বড়ামতি, ইন্দ্রপুর, পুরন্দর, কোন্দন প্রভৃতি দুর্গগুলি জয় করেন। তাঁর নির্দেশে মারাঠা সেনাপতি আবাজী সোন্দর কল্যাণ দুর্গ দখল করে নিলে বিজাপুরের সুলতান ভীষণ ভয় পেয়ে যান। শিবাজীকে আটকাবার জন্য তিনি শিবাজীর পিতা শাহজীকে বন্দি করেন। যে বাবা শৈশবে তাঁকে অবহেলা করেছেন সেই বাবারই মুক্তির জন্য তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসকর্তা মুরাদের কাছে সাহায্য চাইলেন। বিজাপুরের সুলতান শাহজীকে মুক্তি দিলেনউভয়পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। ছ’বছর শিবাজী কোথাও কোন অভিযান চালাবেন না। এই ছিল চুক্তির শর্ত। এই ছ’বছর তিনি শান্তভাবে বসে রইলেন এবং নিজেকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুললেন।


১৬৫৬-তে বিজাপুরের সুলতানের আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর নাবালক পুত্র সিংহাসনে বসলেন। এই সময় দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসনকর্তা ঔরঙ্গজেব বিজাপুরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। শিবাজী এই সুযোগে জাওয়ালি অধিকার করেন। ঔরঙ্গজেব এরপর দিল্লী চলে যান। বিজাপুরের সুলতান শিবাজীর শক্তি খর্ব করার জন্য সেনাপতি আফজল খাঁকে প্রেরণ করেন। আফজল খাঁ এক ভয়ানক লোক। নানাভাবে চেষ্টা করেও তিনি শিবাজীকে সামনাসামনি হারাতে পারলেন না। আফজল খাঁ এবার ছলের আশ্রয় নিলেন। শিবাজীকে নিজের শিবিরে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন। আফজল খাঁ শিবাজীকে জড়িয়ে ধরলেন ভালোবেসে। পোশাকের মধ্যে ছুরি লুকোনো, আস্তে আস্তে সেটা বার করে শিবাজীর বুকে বসাতে যাবেন তার আগেই তিনি লুটিয়ে পড়লেন নিচে। শিবাজীও প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। বাঘনখ পরে এসেছিলেন সেই বাঘনখ দিয়েই আফজল খাঁকে হত্যা করলেন। ( বাঘনখ একরকমের অস্ত্র, হাতের আঙুলে পরা হয়। তোমরা মিউজিয়ামে গেলে দেখতে পাবে) শিবাজী জানতে পেরে গেছিলেন, আফজল খাঁ তাঁর সাথে প্রতারণা করছেন। কৃষ্ণজী ভাস্কর নামে এক মারাঠি ব্রাহ্মণ শিবাজিকে সব জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই কৃষ্ণজী ভাস্করকেই দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আফজল খাঁ। কিন্তু শিবাজীর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে এই মারাঠি ব্রাহ্মণ আফজল খাঁর সমস্ত অভিসন্ধি তাঁকে খুলে বলেন। বিজাপুরের সুলতান তাঁর বশ্যতা মেনে নেন।


শিবাজী ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। দাক্ষিণাত্যে মোগল রাজ্যগুলিতে আক্রমণ চালাতেন। সরদেশমুখী ও চৌথ নামে দুটি কর আদায় করতেন বিজিত রাজ্যগুলি থেকে। সরদেশমুখী ছিল রাজস্বের এক-দশমাংশ এবং চৌথ ছিল রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ। এভাবেই তিনি নিজের সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার মেটাতেন
সম্রাট ঔরঙ্গজেব এবার নিজের মামা শায়েস্তা খাঁকে পাঠালেন শিবাজীকে জব্দ করার জন্য। প্রথমে কিছু যুদ্ধে শিবাজী হেরে গেলেন। শিবাজী বিজাপুরের সাথে আপোস করেন। এক রাত্রিতে শিবাজী আকস্মিকভাবে শায়েস্তা খাঁর শিবির আক্রমণ করেন। শায়েস্তা খাঁ তখন পুণা শিবিরে। রাতে সবাই অসতর্ক ছিল। এই আক্রমণ মোগলবাহিনী সামলাতে পারল না। শায়েস্তা খাঁ কোনরকমে হাতের একটি আঙুল খুইয়ে নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে এলেন।
পরের বছর (১৬৬৪) শিবাজী সুরাট বন্দর লুঠ করে প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। ইংরাজ ও ওলন্দাজ বণিকরা কোনওভাবে পালিয়ে বাঁচলেন।
শায়েস্তা খাঁ পরাজয়ে প্রচণ্ড রেগে গেলেন আলমগীর ঔরঙ্গজেব। তিনি আবার জয়সিংহ ও দিলীর খাঁকে পাঠালেন শিবাজীকে যুদ্ধে হারাবার জন্য। শিবাজীর এই শক্তিবৃদ্ধি তিনি আর বরদাস্ত করতে পারছেন না। এবার কিন্তু শিবাজী পরাজিত হলেন এবং পুরন্দরের সন্ধি (১৬৬৫) করতে বাধ্য হলেন। নিজের ২৩টি দুর্গ মোগলদের হাতে দিয়ে দিলেন, মাত্র ২১টি থাকবে তাঁর। পুত্র শম্ভুজী পাঁচ হাজারি মনসবদার নিযুক্ত হন। শিবাজী জায়গীর লাভ করেন। জয়সিংহের পরামর্শে তিনি শম্ভুজীকে নিয়ে মোগল রাজদরবারে গেলেন। আসলে তাঁর নিজেরও খুব ইচ্ছা ছিল মোগল দরবার স্বচক্ষে দেখার। সম্রাট কিন্তু শিবাজির সাথে ভালো ব্যবহার করলেন না। সম্রাট চেয়েছিলেন শিবাজীকে কান্দাহারে পাঠিয়ে দিতে কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে রাজি হলেন না। ঔরঙ্গজেব তাঁকে একজন মনসবদারের পেছনে দাঁড়াতে বলেন শিবাজী এতে অপমানিত বোধ করেন। তিনি রাজদরবার ত্যাগ করে চলে আসেন। বাদশাহের আদেশে তাঁকে পুত্রসহ বন্দী করা হয়। শিবাজী অসুস্থতার ভান করেন। নিজের সেনাবাহিনীর কিছু অংশ দাক্ষিণাত্যে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। সম্রাটকে বলেন, আমি আজ গুরুতর অসুস্থ। আপনার সব আদেশ আমি মেনে নিলাম কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে জাঁহাপনা
শেষপর্যন্ত আমার কাছে আপনাকে অনুরোধ করতে হল। বলুন কী অনুরোধ আলমগীরের কাছে,” অট্টহাস্য করে উঠলেন আলমগীর।
আমার নাম করে রোজ কিছু ফুল, ফল, মিষ্টি উপহার আগ্রার বিভিন্ন মন্দিরে, দরগায়, সাধু-সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের কাছে পাঠাতে চাইএ ব্যাপারে আপনার অনুমতি দরকার
কেন? দুই ভুরু কপালে তুলে প্রশ্ন করলেন আলমগীর।
আমি মনে করি ঈশ্বরের আর্শীবাদ পেলে আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব। তাই কিছুদিন আমাকে ঈশ্বরের, সাধু-সন্ন্যাসীদের সেবা করার অনুমতি দিন জাঁহাপনা
সম্রাট তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। আর সেটাই ছিল তাঁর চরম ভুল। শিবাজীর কূটবুদ্ধি সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। প্রথম কিছুদিন ফল আর মিষ্টির ঝুড়িই যাতায়াত করতে লাগল। আস্তে আস্তে কড়া পাহারা ক্রমে শিথিল হল। একদিন শিবাজী নিজের পুত্র শম্ভুজীকে ফলের ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়ে বার করে দিলেন এবং নিজে একজন পরিচারকের ছদ্মবেশ ধরলেন। পুরো পরিকল্পনায় শিবাজীকে সাহায্য করেছিলেন জয়সিংহ। শিবাজিকে আমন্ত্রণ করে রাজ দরবারে নিয়ে গিয়ে এভাবে অপমান করাটা জয়সিংহ নিজেও সহ্য করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত আর শিবাজীকে পরাস্ত করা বাদশাহের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
শিবাজীর রাজ্যাভিষেক হয় ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন রায়গড় দুর্গে। তিনি ছত্রপতি উপাধি ধারণ করেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে ‘রাজা’ উপাধি দিলেন এবং বেরারে একটি জায়গীর প্রদান করেন। তাঁর রাজ্যাভিষেক হিন্দু এবং মারাঠাদের মধ্যে বিপুল উন্মাদনার সঞ্চার করে। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন না যদিও মুসলিম শাসন অর্থাৎ মোগল শাসন সেই সময় জনহিতকর ছিল নাকখনও তাঁর সেনাবাহিনী কোনও মসজিদে লুঠতরাজ চালায়নি বা মসজিদ ধ্বংস করেনিতাঁর সেনাবাহিনীতে পাঠান, পর্তুগিজ, ফরাসী, মোগল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের মানুষদের গ্রহণ করেছিলেন।
মৃত্যুর আগে বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন তিনি। শাসনব্যবস্থায় তিনি সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নিরক্ষর হয়েও তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। হিন্দু সন্ন্যাসীদের পাশাপাশি মুসলিম ফকিরদেরও তিনি শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর ব্যয়ে বাবা ইয়াকৎ নামে একজন মুসলমান ফকিরের দরগা নির্মিত হয়েছিলযুদ্ধবিগ্রহের সময় তিনি অযথা অত্যাচার বা হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত করে নিজের চরিত্রকে নষ্ট করেননি। সম্পূর্ণ স্বাধীন রাজা ছিলেন তিনি। ১৬৮০-তে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে আমাদের কাছে তিনি অমর।
তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাই বাকি থেকে গেল। এই স্বল্পপরিসরে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা বেশ শক্ত। কবিগুরুর থেকে দুটো লাইন বলে শিবাজীর গাথা আজ শেষ করলাম।
'মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক কন্ঠে বলো
'জয়তু শিবাজি'
মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো
মহোৎসবে সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব
দক্ষিণে ও বামে
একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব
এক পুণ্য নামে।।'

-----
ছবিঃ আন্তর্জাল

তথ্যসূত্রঃ কিছু কল্পনা, কিছু জনশ্রুতি, আন্তর্জাল এবং ভারতের ইতিহাস ( অতুলচন্দ্র রায় এবং প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়)

No comments:

Post a Comment