কাঞ্চনগড়ের রহস্য
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
আমাদের চারবন্ধুর ঘুরতে
যাওয়াটা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। বছরে চারবার তো
বেরুবই। তবে সাধারণ লোকেরা যেমন ঘুরতে যায় আমরা তেমনটা যাই না। বেশিরভাগ লোকেই
বিখ্যাত বিখ্যাত সব জায়গায় ঘুরতে যায়। আমরা অর্থাৎ, আমি রিমি, মধুমিতা, রেমি আর মনীষা একটু অন্যরকম জায়গা পছন্দ করি। হয়তো সেই
জায়গাটার পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তেমন নামডাক নেই। প্রকৃতি কোনওবারই আমাদের নিরাশ করেনি। ফিরে
এসেছি নানানরকম অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে।
আমার তিনবন্ধু এখন বেজায়
ব্যস্ত। মনীষা একটা প্রাইভেট ফার্মে আছে। ছুটি
পাওয়া খুব মুশকিল। রেমি আর মধুমিতার স্কুল। প্রচুর ছুটি পায় ওরা। আমি এম.এ. -তে ভর্তি হয়েছি। সবে আমরা গ্র্যাজুয়েশন
কমপ্লিট করেছি। মাঝেমাঝে ম্যাগাজিনে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখি। ছবি আঁকতেও খুব
ভালোবাসি।
গতবছর মার্চে আমরা বেড়াতে
গেছিলাম কাঞ্চনগড়। প্রথম প্রথম আমাদের এই বেরিয়ে পড়া
নিয়ে বাড়িতে বাবা-মায়েরা খুব অশান্তি করতেন। কিন্তু এখন মেনে নিয়েছেন। অ্যাডভেঞ্চার করতে
আমরা ভালোবাসি, এ ব্যাপারে কোনও কম্প্রোমাইজ নয়। তবে এখনও যে কথা শুনতে হয় না তা নয়।
কাঞ্চনগড় বিহার আর ঝাড়খণ্ডের মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত। ছোট ছোট টিলা, অসংখ্য ছোট
ছোট ঝোরা আর জঙ্গলে ঘেরা এই কাঞ্চনগড়। আমাদের
বাংলোটা একটা টিলার ওপর। লালরঙের বাংলো। সামনে একটা শিমুলগাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। এখানে সাধারণত কেউ
থাকতে আসে না। মধুমিতার এক জেঠু এই বাংলোর মালিক। একসময় খুব ভালো জব করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। আমেরিকায় নিজের ছেলের কাছে গেছেন
জেঠু-জেঠিমা। অবশ্য কলকাতাতেই বেশিরভাগ সময় থাকেন। বাংলোবাড়িটা খানিকটা বড়োলোকের খেয়াল বলা যায়। বাংলো খালিই পড়ে ছিল। জেঠুই একদিন ফোন করেন আমেরিকা থেকে। মধুকে বলেন, “তুই তো শুনেছি বন্ধুদের সাথে খুব ঘুরে বেড়াস। তা আমাদের কাঞ্চনগড় থেকে ঘুরে
আয়। কেয়ারটেকার মিশিরজি আছেন, তোদের
কোনও অসুবিধা হবে না।”
মধুরা আগেও অনেকবার এখানে
এসেছে। তাই সবকিছুই মোটামুটি চেনে। আর এটাও জানিয়েছে যে কাঞ্চনগড়ে কোনও কেল্লা-টেল্লা নেই। গড় বললেই আমাদের কেল্লা বা দুর্গের কথাই আগে মনে পড়ে। কেয়ারটেকার
মিশিরজি আমাদের বাজার করে দিতে রাজি হলেন, কিন্তু
রান্না করতে রাজি হলেন না। রেমি বলল, “এমন
চমৎকার কিচেন থাকতে মিশিরজিকে আর কষ্ট দেওয়ার দরকার কী?”
প্রথম যেদিন এলাম, সেদিন অবশ্য আর রান্নার ঝকমারিতে যাইনি। হাই-রোডের ধারে একটা ধাবায় বসে লাঞ্চ সেরেছিলাম। ধাবার মালিক একসঙ্গে এতগুলো কেতাদুরস্ত পোশাক পরা মেয়েদের দেখে বেশ অবাক হয়ে
তাকিয়েছিল। হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমরা
এখানে কোথায় যাচ্ছি। মনীষা হেসে বলেছিল, “কেন তাতে আপনার কী দরকার?” ধাবা-মালিককে একদম সাউথ ইন্ডিয়ান
সিনেমার নায়কদের মতো দেখতে।
“না মানে, এদিকে আপনাদের মতো শহুরে
লোক তো তেমন আসে না। তারপর চারজনই মেয়ে।”
মনীষা বলেছিল,
“আমার বাবা কলকাতার লালবাজারের পুলিশ অফিসার। আমরা যেখানে
খুশি যেতে পারি।”
এই ঢপটাই ও দিয়ে থাকে সবসময়। তারপর রেমিকে দেখিয়ে বলল, “এর বাবা তো পার্লামেন্টে আছে।”
রেমি জল খাচ্ছিল। জোর বিষম খেল। ধাবা-মালিক হিন্দিতেই বলেছিল, “তবুও সবাই সাবধানে থাকবেন।”
ধাবা-মালিক এবার বাকি লোকগুলোর
সাথে আড্ডায় যোগ দিল। সবাই খেতে এসেছিল। এদের আলোচনায় কান দিয়ে যা শুনলাম তা হল, কাঞ্চনগড়ের একটা পুরোনো
বাড়িতে ভূতের উৎপাত শুরু হয়েছে। আরও একটা খবর শুনলাম। মাঝেমাঝে কিছু বাচ্চা উধাও
হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগই গরিব আদিবাসীদের বাচ্চা।
অনেকের ধারণা, ভূতের দল এসব অপকর্ম করছে।
বাচ্চাগুলোর রক্ত চুষে খেয়ে নিচ্ছে। আমাদের রুটি আর চিকেন তড়কা খাওয়া হয়ে গেছিল। এসব গালগল্প প্রায় প্রত্যেক পুরোনো বাড়িকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। এসব আর ভালো লাগে না। আমরা অটোতে উঠে বসলাম। কাঞ্চনগড়ের স্টেশনে নেমে আমরা একটা অটো
ভাড়া করেছিলাম। আমি আবার ভূতের গল্প খুব ভালোবাসি। অটোচালক দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “শুনছি এখানে একটা হানাবাড়ি আছে?”
“কেউ
একবার ভেতরে গেলে আর সে জ্যান্ত বের হতে পারে না। কবরস্থানের উল্টোদিকের বাড়িটায়
ভূতেরা আস্তানা গেড়েছে। কেউ সন্ধের পর আর ওদিক দিয়ে যায় না। ইংরাজ আমলে বাড়িটা
একজন সাহেব করেছিল শখ করে। তার মৃত্যুর পর বাড়ির সবাই
বিদেশে চলে যায়। বহুদিন কেউ থাকে না।” অটোচালকদাদা
আমাদের অনেক তথ্য জানিয়ে দিল।
মধুমিতার জেঠুর বাংলো
দারুণ পছন্দ হয়ে গেল আমাদের। পেছনে ঘন জঙ্গল। মাঝেমাঝে ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে।
মিশিরজি আমাদের ঘর খুলে দিলেন। উনি বাংলোর পেছনদিকে গেস্ট-হাউসে থাকেন পরিবার নিয়ে। মিশিরজির স্ত্রী আমাদের সাথে আলাপ করতে এলেন না।
দূর থেকে তাঁকে দেখেছি। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী। বাড়িটার সামনে বেশ বাগান আছে। তবে
লাল শিমুলগাছটা ভারি সুন্দর। আম গাছে বোল এসেছে। আমরা দোতলায় উঠে গেলাম। রেমি
বাইনোকুলার নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মধুমিতা আর মনীষা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক, হোয়াটস-অ্যাপ করছে। একটু পরেই ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। আমি পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসলাম।
বেশ গরম এখানে। পেছনে শালগাছের ঘন জঙ্গল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কতরকম
পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে যার বেশিরভাগই আমার অচেনা। ময়ূরের ডাক শুনে মাঝেমাঝে চমকে
যাচ্ছি। সেই কবরস্থানটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ওখানেই নাকি একটা
ভূতুড়ে বাড়ি আছে। রেমি বাইনোকুলার হাতে পেছনের বারান্দায় চলে এল। রেমি একসময় চেঁচিয়ে উঠল, “ওই দ্যাখ, ভূতের বাড়ি!”
রেমির হাত থেকে বাইনোকুলার
কেড়ে আমিও চোখ লাগালাম। সত্যি তো ভূতের বাড়ি! ভাঙাচোরা একটা বাড়ির কঙ্কাল। কার্নিশ বেয়ে বটের চারা উঠেছে। আর ছাদের ওপর একটা
বাচ্চা মেয়ে। উত্তেজিত হয়ে রেমিকে বললাম, “রেমি
ছাদের ওপর একটা বাচ্চা মেয়ে!”
রেমি আমার হাত থেকে কেড়ে
নিল দূরবীন। চোখে লাগিয়ে দেখল। তারপর বলল, “কীসব
বলছিস! কোথায় বাচ্চা মেয়ে? ঘুমিয়ে
পড়। তোর রেস্ট দরকার।”
আমি ওর হাত থেকে আবার
দূরবীন ছিনিয়ে নিলাম। কিন্তু এবার আর কোনও বাচ্চা
দেখতে পেলাম না। স্পষ্ট দেখেছিলাম একটা বাচ্চা মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল, মুহুর্তের
মধ্যে কী করে ভ্যানিশ হয়ে গেল! নিশ্চয়ই চোখের ভুল। সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগছিল। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
বিকেলের দিকে আমরা হাঁটতে
বেরুলাম। মধুমিতা আমাদের গাইডের ভূমিকায়। একটা ঝোরার সামনে আমরা কিছুক্ষণ বসলাম। রেমি বলল, “এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। এখানে আমরা পিকনিক
করব কাল।”
তিনজনে নানান গল্পে মেতে
উঠল। আমি একটা বড়ো গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। সূর্যদেব অস্ত যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে লালরঙ ছড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে। আমার চোখ বুজে এল। আর
চোখ বুজতেই একটা ঝটকা খেলাম। একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। সেই হানাবাড়ির ছাদে সে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে গোলাপিরঙের ফ্রক। চোখ খুলে দেখি সবকিছু স্বাভাবিক। আমার তিনবন্ধু বসে
বসে গল্প করছে। কখনও সেলফি তুলছে। আমি উঠে পড়লাম। বললাম, “আমি একটু ঘুরে আসছি। সোজা বাড়ি
চলে যাব।”
আমি সেই কবরখানার দিকে
হাঁটতে শুরু করলাম। একসময় পৌঁছেও গেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখার লোভ সামলালাম। কাল
দুপুরে আসা যাবে। এখন অন্ধকার হয়ে আসছে, না
যাওয়াই ভালো। সেই হানাবাড়ির দিকেও দৃষ্টি গেল।
একদম অন্ধকারে ঢাকা। তবে একসময় যে এই বাড়ির বেশ
জৌলুস ছিল সেটা বোঝা যায়। একদিন এর ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে।
কয়েকটা ফটো তুললাম বাড়িটার। তারপর বাড়ি ফিরে এলাম। আমি আসার একটু পরেই ওরাও ফিরে
এল। আমি কফি করলাম। কফির কাপ নিয়ে আবার তুমুল আড্ডা শুরু হল। কিন্তু
আমার আড্ডায় আর মন নেই। আমার চাই একটু নির্জনতা। তাই অন্য একটা ঘরে গিয়ে নিজের
লেখার খাতা বের করলাম। লিখতে বসে বারবার সেই বাচ্চা
মেয়েটির কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। নিজের
অজান্তে কখন তার ছবি আঁকতে বসে গেছি। সম্বিৎ ফেরে রেমির ডাকে। ‘ডিনার রেডি ম্যাডাম’। দেখলাম, সেই
বাচ্চাটির ছবি আমি এঁকেছি নিজের লেখার খাতায়। ভারি মিষ্টি মেয়ে।
গোলাপিরঙের ফ্রক পরা। মাথায় দুটো বিনুনি। বয়স পাঁচ থেকে সাত।
ডিনার মানে নুডলস। চটজলদি
আর কীই বা করার আছে। এসে থেকেই তো খালি
গল্প করছি সবাই। আর আমাদের হালিশহর থেকে মিষ্টি এনেছিলাম। কালকের প্রোগ্রামের
প্ল্যান ঠিক করল মধু।
“কাল খুব
সকাল সকাল আমরা ব্রেকফাস্ট নিয়ে বেরুব। একটা খুব পুরোনো কালীমন্দির আছে, দেখতে
যাব। তোদের খুব ভালো লাগবে। অতএব আর আড্ডা না দিয়ে
সবাই শুয়ে পড়, না হলে সকালে উঠতে পারবি না।”
রাত্তিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে
পড়লাম। সবাই একটা ঘরেই শুয়েছি। একটা বড়ো ঘরেই
আমাদের শোবার ব্যবস্থা। দুটো মাঝারি
সাইজের খাটে দিব্যি দু’জন করে শুয়ে পড়লাম। বেশ ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। কেন জানি না, মাঝরাতে
ঘুম ভেঙে গেল। শুয়ে শুয়ে বোর হচ্ছিলাম।
ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা। বিছানা থেকে
উঠে বারান্দায় চলে এলাম। বাংলোর পেছনের বারান্দা। আকাশে
একফালি চাঁদ। লেবুফুলের মিষ্টি গন্ধ। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। আমি ভালো করে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিলাম। শালবনের মধ্যে থেকে কোনও এক নাম না জানা
প্রাণী ডেকে উঠল। আমি থর থর করে কেঁপে উঠলাম। ডাকটা মনে হয় হায়নার। নিশাচর পাখিদের
কর্কশ আওয়াজ। রাত্তিরে সবাই ঘুমায় না। রাত্তির হলে এদের জীবন শুরু হয়। কী মনে হতে
রেমির দূরবীনটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। চোখে লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম সেই
ভূতের বাড়ি। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। দূরবীনটা প্রায় আমার হাত থেকে খসে পড়েই যাছিল।
দেখলাম ওই হানাবাড়িতে আলো জ্বলছে। এত রাত্তিরে কে ওখানে আলো জ্বালবে? আবার দেখলাম।
নাহ্, আমার দেখায় কোনও ভুল নেই। একটা
আলো জ্বলছে। টিউবলাইটের আলো। বাড়ির সামনে দু’তিনটে লোক জটলা করছিল। কিন্তু ওদের কথা কিছু শুনতে পেলাম না। এতদূর থেকে
সেটা সম্ভবও নয়। লোকগুলো একসময় বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমি আর কিছু দেখতে পেলাম না।
আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
রেমির ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। দেখি
ওরা সবাই তৈরি হয়ে কফি খাচ্ছে। মনীষা বলল, “কফি তৈরি আছে। চটপট বাথরুমের কাজ সেরে ফেল।”
আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে
নিলাম। কফি খেয়েই বেরিয়ে পড়া গেল। এখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। এই সময়টা ভারি সুন্দর।
পাখিরা সব ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। সূর্যদেব উঠছেন। বেশ
কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা সেই মন্দিরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। খুব পুরোনো মন্দির। ভেতরে বাদুড় ভর্তি।
মায়ের নিমকাঠের মূর্তি। রোজ এখানে পুজো হয়। এখন একজন বয়স্ক ঠাকুরমশাই পুজো করছেন।
আমরা কোথা থেকে এসেছি জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন, “কবরখানার দিকে একদম যেও না। খুব বাজে জায়গা।”
মধু বলল, “কেন? ভূত আছে বলছেন!”
“তোমরা
একেলে ছেলেমেয়েরা কিছু মানো না।
কিন্তু ভগবান থাকলে ভূতও থাকবেই।”
কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে
মায়ের প্রসাদী ফুল আর প্রসাদ দিলেন। পুরোহিতমশাইয়ের সবই ভালো কিন্তু মাঝেমাঝে ‘জয় মা, জয় মা’ করে বিকট শব্দ করেন। তেল-সিঁদুর মাখানো একটা হাড়িকাঠও নজরে এল। স্থানীয় আদিবাসীরা মাকে খুব ভক্তি করে।
সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট্ট নদী। আমরা জিনস গুটিয়ে নিলাম। পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে ওপারে যাব। ওপারে গিয়ে ব্রেকফাস্ট
করব।
নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছে
আমরা নিজেদের পছন্দমতো একটা করে
জায়গা বেছে নিলাম। মধু আর মনীষা
ব্রেকফাস্ট বার করতে শুরু করল। ব্রেড অ্যান্ড বাটার আর ডিমসেদ্ধ। রেমি বলল, “কেউ এখানে কিছু ফেলবি না। সব
আবর্জনা আবার কৌটো করে বাড়ি অবধি নিয়ে যাবি, তারপর
ডাস্টবিনে ফেলবি।”
আমি দেখছিলাম কালীমন্দিরে
দুটো লোক এল গাড়ি চেপে। ওদের দেখালাম।
মধুমিতা বলল, “মন্দিরে কি কেউ গাড়ি চেপে আসতে
পারে না?”
রেমি দূরবীন লাগিয়ে দেখল। বলল, “আরে, এ তো সেই ধাবা-মালিক! আমরা কাল খেলাম যেখানে। আরেকটা
লোককে চিনি না।”
রেমির হাত থেকে দূরবীনটা
নিয়ে আমরা একে একে সবাই দেখলাম। সত্যিই তো ধাবা-মালিক। এখানে কী করছে!
মনীষা বলল, “আরে, পুজো দিতে এসেছে! ও কি পুজো দিতে আসতে পারে না?”
রেমি বলল, “কিন্তু এত দামি গাড়ি চেপে! আর লোকটার জামাকাপড়ও বেশ দামি মনে হচ্ছে।”
“আরে, ধাবা-মালিকদের অনেক টাকা। তুই জানিস না।”
আমাদের আলোচনার মাঝেই ওরা
আবার গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল।
নদীর ধারে বসে অনেক ছবি-টবি তুলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ঠিক করলাম, একদিন মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে আসব। জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর।
দুপুরের রান্না আজ
মনীষা আর আমি করলাম। ভাত আর ডিমের কষা। দুপুরে ফ্যান-ট্যান চালিয়ে গায়ে চাদর টেনে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমার ঘুম আসছিল না। চিন্তা
করছিলাম সেই ভূতের বাড়ি নিয়ে। ভাবলাম, একবার
সামনে থেকে বাড়িটা দেখে আসি। মিশিরজিকে বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। মিশিরজি আমার
বেরুনোর পর বড়ো গেটে তালা লাগিয়ে দিলেন। আমি
বাড়ির সদর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে এসেছিলাম। মিশিরজিকে বলেছিলাম, “ওরা ডাকলে সদরটা খুলে দেবেন।”
বেশ গরম লাগছে এখন। হাঁটতে
হাঁটতে আমি শুনশান কবরখানার সামনে চলে এলাম। কবরখানার ভেতর ঢুকে পড়লাম। আহ্, কী শান্তি! চারদিকে বড়ো বড়ো গাছে ঘেরা। কিছু সমাধির ফলকগুলো
একদম ভেঙেচুরে গেছে, নামগুলো একদম পড়া যাচ্ছে
না। পুরোনো সমাধির পাশাপাশি কিছু নতুন
সমাধিও আছে। খ্রিস্টানদের কবরখানা এটা। উলটোদিকের হানাবাড়িটা একদম পরিষ্কার দেখা
যাচ্ছে। ক’টা ছবি তুললাম বাড়িটার। ছবি তুলতে
তুলতে বাড়িটার একদম সামনে চলে গেছিলাম। আর ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। দোতলার জানালা থেকে কী যেন একটা উড়ে এসে আমার গায়ে পড়ল।
আমি দেখলাম একটা ইটের টুকরো। আমার মাথায় লাগলে হয়ে যেত! চেঁচিয়ে উঠলাম,
“কে? জানালায় কে?”
এইবার জানালায় একটা বাচ্চা ছেলের মুখ দেখা গেল। অসহায় চোখদুটো। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা
করলাম, “তুমি এখানে কী করছ? জানো না এটা ভূতের বাড়ি?”
“আমাকে
এখানে ধরে রেখেছে দিদি। আমাকে বাঁচাও,” ছেলেটি
কাঁদতে কাঁদতে বলে।
আমি অবাক হয়ে যাই, এও কি ভূতের মায়া! আমি সাহস করে ওপরে গেলাম। সারাবাড়িতে মানুষের বসবাসের
চিহ্ন। সেগুলো দেখেই বোঝা যায় যারা এখানে
থাকে তারা মোটেই ভালো মানুষ নয়। খুঁজে খুঁজে সেই ঘরটায় গেলাম।
বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকানো। তালা দেওয়া নেই। আমি টেনে খুলে ফেললাম। ভেতর থেকে
বাচ্চা ছেলেটা এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। ছেলেটির মধ্যে একটুও শহুরে ছাপ নেই। স্থানীয়
আদিবাসীদের ছেলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী নাম
তোমার? এখানে কেমন করে এলে?”
“সে খবরে
তোর কী দরকার?” পেছনে তাকিয়ে দেখি দুটো খুব বাজে রকমের লোক এসে দাঁড়িয়েছে। বিচ্ছিরিভাবে
হাসছে। বাচ্চা ছেলেটি এদের দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটা লোককে আমি চিনি। ধাবা-মালিক। একজনের হাতে আবার পিস্তল। আমাকে ধাক্কা মারতে মারতে ওরা ঘরের ভেতরে
ঢুকিয়ে দিল। ধাবা-মালিক একটা চেয়ারের সাথে আমায়
বাঁধতে বাঁধতে বলল, “এই বাড়িতে একবার কেউ ঢুকলে সে আর
বেরুতে পারে না। চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই, তবুও মুখটা বেঁধে রাখলাম। এখানে কেউ আসে না। সবাই এটাকে ভূতের বাড়ি বলে মনে করে।”
আমি ছটফট করতে লাগলাম।
আমার মোবাইলটা সেই ধাবা-মালিক কেড়ে নিয়েছে প্রথমেই। আরেকজন
লোক ছেলেটিকে নিষ্ঠুরভাবে মারতে লাগল। সঙ্গের লোকটিকেও আমার খুব চেনা মনে হল।
সকালে দেখা সেই পুরোহিতের সাথে আশ্চর্যজনক মিল। তবে পুরোহিত বয়স্ক আর এ মাঝবয়সী।
লোকটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘জয় মা’ বলে বিকট চিৎকার করল। তখনই বুঝে গেলাম, এ সেই ঠাকুরমশাই।
তারপর বাচ্চাটিকে টানতে টানতে
অন্য কোথাও নিয়ে গেল। ধাবা-মালিক
আমাকে বলল, “জানিস আমরা কারা? ছেলেধরা।” বলেই হা হা করে বিশ্রীভাবে হেসে
উঠল। “মাঝেমাঝে এক একটা বাচ্চা উঠিয়ে
নিয়ে যাই, তারপর তাদের বিক্রি করে দিই চড়া
দামে। ব্যস, দিনকতক একেবারে নিশ্চিন্ত। এর
সাথে স্মাগলিংও করি। মরার আগে সব জেনে নে।”
এদের হাতেই তাহলে আমায়
মরতে হবে! খুব ভুল করেছি একা একা এভাবে চলে
এসে। বাইরে আঁধার নেমে এসেছে। আমার চোখ
থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। আর তখনই ঘটে গেল সেই অদ্ভুত ঘটনা যার কোনও ব্যাখ্যা আমি পাইনি।
আমি দেখলাম, সেই গোলাপিরঙের ফ্রক পরা মেয়েটি
ধাবা-মালিকের একদম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ধাবা-মালিকের
শরীরের ভেতর দিয়ে ক্রস করল। বাতাসে ভেসে ভেসে আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
চোখদুটো জ্বলছে। সেই ভয়ানক মূর্তি আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করল। তারপর আমি জ্ঞান
হারালাম।
যখন জ্ঞান হল, দেখলাম, আমি বাংলোর একটা ঘরে শুয়ে আছি।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। আমার সামনে মধু, রেমি, মনীষা, মিশিরজি, মিশিরজির স্ত্রী
প্রত্যেকে উদ্বিগ্ন মুখে। আমি উঠে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “সেই
বাচ্চা ছেলেটি কোথায়?”
রেমি বলল, “রিল্যাক্স। বাচ্চা-চোর সব ধরা পড়েছে। ছেলেটি ওর মায়ের কাছে। সব তোর জন্য হয়েছে। আমরা যখন
পুলিশ নিয়ে ওখানে পৌঁছাই তখন তুই রীতিমতো মা
দুর্গার মতো লড়াই করছিস ধাবার সেই লোকটার সাথে। আর ওদের দলে ছিল মন্দিরের
পূজারি। বয়স্ক সেজে থাকত, আসলে ইয়াং ছেলে। তুই তাকেও খুব মেরেছিস। তুই ক্যারাটে কবে শিখলি? আমাদের
তো বলিসনি!”
রেমি কী বলছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, “তোরা কী করে জানলি যে আমি এখানে?”
মধু বলল, “নিজেই তো ফোন করলি। তোর ফোনে সব তথ্যপ্রমাণ আছে। বদমাইশ লোকগুলো আর ছাড়া
পাবে না। পুলিশ অফিসার সব রেকর্ডিং, ছবি
নিজের ফোনে সেভ করে নিয়েছেন।”
মনীষা বলল, “বাবা, কীরকম বদমাশ দেখ! এদিকে ধাবা চালায় আর ভেতরে ভেতরে কেমন শয়তানি বুদ্ধি। ইচ্ছা করে বাড়িটাকে ভূতুড়ে বানিয়ে রেখেছিল।”
“তার ওপর পুরোহিতটা সবাইকে বোঝাত, ওদিকে ভূত আছে যেও না। বাচ্চা চুরি ওই করত। ওর সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি,” মধু বলল।
আমি খুব অবাক হয়ে
যাচ্ছিলাম এসব দেখে। কারণ, আমি তো
কোনওরকম মারপিট করিনি। জিজ্ঞাসা
করলাম, “আর একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল গোলাপিরঙের জামা পরা। তার কী হল?”
“আর কোনও
বাচ্চা তো ছিল না!”
“আমায়
খাতা পেন্সিল দে, এক্ষুনি ওর স্কেচ করছি।”
মিশিরজি আমার জন্য খাতা
পেন্সিল নিয়ে এলেন। আমি যাকে দেখি তার মুখ স্কেচ করতে পারি। খাতা তুলে নিলাম কোলের
ওপর। পেন্সিল দিয়ে একটু একটু করে ফুটিয়ে তুললাম সেই বাচ্চা মেয়েটির অবয়ব। মিশিরজিকে দিলাম খাতাটা। মিশিরজি চশমা খুলে ফেললেন। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মিশিরজির স্ত্রী ছবিটা বুকে জড়িয়ে
কাঁদতে লাগলেন। মিশিরজি বললেন, “আমার মেয়ে পিঙ্কি। মায়ের সাথে পুজো দিতে গিয়ে আর ফেরেনি। পাঁচবছর আগের
ঘটনা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পাইনি। হারিয়ে যাওয়ার সময় পিঙ্কি গোলাপিরঙের জামাই পরেছিল। মনে হয় শয়তানগুলো ওকে মেরে ফেলেছে।”
পিঙ্কির খবর পরে আমরা
পেয়েছিলাম। সেই বদমাইশ পুরোহিত পিঙ্কিকে বেশি করে ক্লোরোফর্ম দিয়ে ফেলেছিল। পিঙ্কি
তাতেই মারা গেছিল। ওরা পিঙ্কির শরীরটাকে ওই কবরখানায় পুঁতে দিয়েছিল। জেরার চোটে
ওরা সব স্বীকার করেছিল।
সাহসিকতার জন্য আমাকে
সরকার থেকে একলক্ষ টাকা দিয়েছিল। আমি সেই টাকা পিঙ্কির মাকে দিয়েছিলাম। কারণ, আমি জানতাম এই টাকার আসল হকদার আমি নই। আমি নিমিত্ত মাত্র। হয়তো দুষ্টের দমন করার জন্য কোনও মানুষের শরীর ওর
দরকার ছিল। তবে এতদিন অপেক্ষা করল কেন? আরও আগেই তো এই কাজ করতে পারত! আমার এত সব প্রশ্নের জবাব এখনও পাইনি। আর পাবও না।
আজ বসে বসে একবছর আগের কথা
লিখে ফেললাম। আজ আমি খুব খুশি। খুব ভালো একটা খবর পেলাম। মিশিরজি ফোন করেছিলেন একটু আগে। ওনাদের একটা মেয়ে হয়েছে
ঠিক পিঙ্কির মতোই দেখতে। এভাবেও ফিরে আসা যায়!
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
বাহ
ReplyDeleteBah sundor
ReplyDeleteonek dhonyobad babin ebong jaya !
ReplyDeleteBesh ekta Gogol Gogol effect esche golpotai
ReplyDeletelekhar somoy ami gandalur kotha vebecchi...nalini dash er gandalu :)
Deleteভাল লাগল বেশ।
ReplyDelete