একটা লম্বা সফরের কাহিনি
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
পর্ব এক
১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর
প্লাইমাউথ বন্দরের জেটিতে এক ক্যাপ্টেন বেজায় রেগেমেগে পায়চারি করছিলেন। জাহাজ
রওনা দেবার জন্য তৈরি, পূবালি বাতাস বইছে ঝিরঝির করে, কিন্তু জাহাজ রওনা হতে পারছে
না। পারবে কী করে? আগের দিন ক্রিসমাস গেছে। জাহাজের তিয়াত্তরজন কর্মচারী সে উল্লাসে
মেতেছিল সারারাত। অতএব সকালে তাদের টিকির দেখা নেই। যে ক’জন এসে পৌঁছেছে তারা নাক
ডেকে ঘুম দিচ্ছে বা ঢুলছে বসে বসে।
সেদিনটা তো নষ্ট হল। লোকজন
ডেকেডুকে এনে তৈরি হয়ে জাহাজ ছাড়ল পরদিন সকালে। আবহাওয়া চমৎকার। জাহাজটা আধুনিক। তার
বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অভিযানের জন্য নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো। জল কেটে চলেছে পাল
উঁচিয়ে যেন এক বিরাট রাজহাঁস।
তবে সবার ভাগ্য সমান যায় না। জাহাজের
এক ছোকরা তখন দুলুনিতে গা গুলিয়ে বমিটমি করে একাকার করে ভাগ্যকে দুষছে, কেন মরতে
সমুদ্রে এলাম। ছোকরার নাম চার্লস। চার্লস ডারউইন। বিগ্ল্ জাহাজে এই তার প্রথম
সমুদ্রযাত্রা। হামবোল্টের লেখা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের রোমাঞ্চকর বর্ণনা শুনে তার
ইচ্ছে হয়েছিল সে জায়গাটা একবার দেখে আসবার। শুনে তার চেনা একজন পাদ্রি, কেমব্রিজের
রেভারেন্ড হেনসলো খবর দিলেন, বিগ্ল্ নামে একটা জাহাজ সমীক্ষার কাজ নিয়ে রওনা
হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। সেখানে একইসাথে একটা বিশেষ কাজে সে একেবারে মহাদেশের
দক্ষিণতম প্রান্তে তিয়েরা দেল ফুয়েগো অবধি যাবে সে। সেই শুনে বাবার কাছ থেকে খানিক
টাকা নিয়ে তড়িঘড়ি মোটা ভাড়া গুনে জাহাজে চড়ে বসেছিল সে। সমুদ্রপীড়ায় কাতরাতে
কাতরাতে এখন সেই ইচ্ছেকে অভিসম্পাত দিচ্ছিল ছোকরা। এমন হবে জানলে কে আসত!
১৮৩২ এর ৪ জানুয়ারি বিগ্ল্
পৌঁছুল মেদিরা দ্বীপে। বন্দরের সামনে এসেও ভিড়তে পারল না ঝড়ের ধাক্কায়। তবে
ডারউইনের তখন সেসব দেখার অবস্থা নেই। সমুদ্রপীড়া থেকে তখনও তার মুক্তির লক্ষণ নেই
কোনও। জাহাজে প্রায় চারশো বৈজ্ঞানিক বইপত্রের একটা দারুণ লাইব্রেরি আছে। সেই
লাইব্রেরি কেবিনেই ঠাঁই হয়েছে তার। ক্যাপ্টেন তাকে ওর থেকে “লিল”-এর একটা ভূতত্বের
বই পড়তে দিয়েছিলেন। কেবিনে বসে তাই পড়ে আর ক্যালেন্ডার গোনে সে, কখন জাহাজ এর পর
টেনেরিফিক দ্বীপে পৌঁছুবে। ওখানে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবার কথা।
কিন্তু কপাল খারাপ।
টেনেরিফিকের সান্তাক্রুজ বন্দরে পৌঁছুতে সেখানকার স্বাস্থ্যদপ্তরের লোকজন জাহাজে
উঠে এসে জানাল, জাহাজের লোকজনের দ্বীপে নামা মানা। খবর এসেছে ইংল্যান্ডে কলেরা
লেগেছে। অতএব সেখান থেকে আসা জাহাজের লোকজনকে দ্বীপে নামবার আগে ক’দিন জাহাজেই
আটকে থাকতে হবে, তাদের কেউ কলেরা নিয়ে এসেছে কিনা বোঝবার জন্যে।
শুনে রেগেমেগে ক্যাপ্টেন ফিট্জ্রয়
হুকুম দিলেন, তোলো নোঙর। সটান পরের স্টেশন কেপ ভার্দে চলে যাব এই বাজে জায়গাটা
ছেড়ে। শুনে, বেচারা ডারউইনের মনখারাপ দেখে কে! কতদিন ভেবেছে এইখানে এসে বন্ধুর
সাথে আড্ডা মারবে, আর সেইটেই এমনভাবে ফাঁকি পড়ে গেল। তায় আবার শরীর খারাপ। ভালো
লাগে?
১৬ তারিখ কেপ ভার্দেতে নোঙর
করল জাহাজ। পায়ের তলায় মাটি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ডারউইন। জাহাজ তার কাজকর্ম করে,
আর ছোকরা চার্লস একা একা ঘুরে বেড়ায় দ্বীপ জুড়ে। আর সেই ঘুরতে ঘুরতেই জোয়ারের জল
জমে থাকা গর্তগুলোর মধ্যে এক আজব মাছের দেখা পেল সে। তার নাম কাট্ল্ ফিশ। সে মাছ
ইচ্ছেমত নিজের রঙ বদলে ফেলে। ভয় পেলে একরকম, তেড়ে এলে আরেকরকম এমনি শতেক রঙ আছে
তার ঝোলায়। দেখে তো সে বেজায় উত্তেজিত। মোটেও জানত না বিজ্ঞানীরা সে খবর রাখেন।
উত্তেজিত হয়ে সে সেই মাছের চালচলন খুঁটিয়ে দেখে তাই নিয়ে এক লম্বা চিঠি লিখে বসল
দেশে, রেভারেন্ড হেনসলোর কাছে।
সে দ্বীপে যা দেখে তাই আজব
লাগে তার চোখে। বন্দরের কাছে, সমুদ্র থেকে প্রায় আট মানুষ উঁচুতে সে দেখে পাহাড়ের
গায়ে একটা সাদা লম্বা দাগ এঁকেবেঁকে গেছে। জিনিসটা চুনের দাগ। তার মানে ওখানে অনেক
শামুকঝিনুকের খোলা ছিল কখনো। কিন্তু কথা হল, সে তো থাকে সমুদ্রের তলার মাটিতে। জল
থেকে আট মানুষ উঁচুতে তা গেল কেমন করে? সমুদ্রের জল তো এতটা নীচে নেমে যাবার কথা
নয় লক্ষ বছরেও? তাহলে? এইবারে বেজায় কৌতূহল হল ডারউইনের ব্যাপারটাকে বোঝবার।
ততদিনে, জাহাজের লাইব্রেরিতে
ক্রমাগত পড়াশোনায় মনের মধ্যে তখনও লুকিয়ে থাকা তুখোড় এক বৈজ্ঞানিকের ঘুম ভাঙছিল
তাঁর। সে বৈজ্ঞানিক অনুমান করল, নিশ্চয় তাহলে এখানকার মাটি আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে
উঠে সমুদ্রের তলা ছাড়িয়ে উঠে গিয়েছে আকাশের দিকে। মহাদেশীয় উত্থানপতনের বৈপ্লবিক
তত্ত্বের এক অব্যর্থ প্রমাণ হয়ে তাঁর চোখে ধরা দিল পাহাড়ের গায়ের একটা সামান্য
দাগ।
অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাহাজ
পৌঁছোল ব্রাজিল। অবশেষে স্বপ্নের জমিতে পা দিল চার্ল্স্। সেখানকার ক্রান্তীয়
বর্ষণবনে ঘুরে বেড়ায় সে একা একা। দু চোখ ভরে দেখে নেয় প্রকৃতির অসীম বৈচিত্র্য।
ডায়েরিতে লেখে, এই স্বর্গীয় দৃশ্যের প্রতি
সুবিচার করতে পারেননি হামবোল্ট।
এদিকে জাহাজে তখন আরেক গোল
বেধেছে। দাসপ্রথার সমর্থক ক্যাপ্টেনের সাথে বেজায় ঝগড়া বেধেছে চার্লসের, এ অঞ্চলের
দাসপ্রথার নৃশংসতা নিজের চোখে দেখে। আরও একা হয়ে গেছে সে তাই। আরও নিবিড় করে তাকে
ঘিরে ধরেছে তার লাইব্রেরির বইরা। তাদের মধ্যে জমানো জ্ঞানের পাঠ, আর খোলা আকাশের
নিচে প্রকৃতির পাঠশালায় ঘুরে ঘুরে সে জ্ঞানকে যাচাই করে নেবার মধ্যে দিয়েই প্রকৃতি
তখন এক সাধারণ তরুণের মস্তিষ্কে অচেতন থাকা বিজ্ঞানীর ঘুম ভাঙাবার কাজ করে চলেছেন।
তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে তাঁর প্রকৃতির সমীক্ষা। অ্যাব্রলের অগভীর সমুদ্রে বিগল-এর গভীরতা
মাপবার সমীক্ষা চলবার সময় তাঁর নজর আটকে থেকেছে বাদামী রঙের সমুদ্রটার দিকে। সে
জলের নমুনা তুলে পরীক্ষা করে খুঁজে পেয়েছেন একজাতের আণুবীক্ষণিক নলের মত দেখতে
প্রাণীকে। তাদের গায়ের রঙ সমুদ্রকে অমন রঙে রাঙিয়ে রাখে।
১৮৩২-এর এপ্রিলের শুরুতে রিও
ডি জেনেইরো পৌঁছে দেখা গেল ইংল্যান্ড থেকে জাহাজিদের নামে চিঠিপত্র এসে পড়ে আছে
সেখানে। নিজের নামে আসা চিঠিটা খুলে ফের একটা নতুন দুঃখ পেল চার্ল্স্। তার প্রিয়
বান্ধবী ফ্যানির বিয়ে হয়ে গেছে দেশে। একদিকে ক্যাপ্টেনের সাথে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া,
তার ওপর দেশের সাথে এই অন্যতম নাড়ির টানটাও এমন করে ঘা খাওয়া তখন সে কিশোরের
মনোযোগ পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির গভীর বৈচিত্র্যের দিকে। প্রকৃতিই তখন তাঁর
নতুন সঙ্গী হয়ে উঠেছে। আর, একজন ভালো বন্ধুর মতই, সে ভারী আদর করে, আনন্দ দিয়ে
দিয়ে জাগিয়ে তুলছিল চার্লসের সেরা গুণটাকে। কৌতুহলী এক ট্যুরিস্টকে বদলে দিচ্ছিল
একজন হবু বৈজ্ঞানিকে।
জাহাজ তখন সে এলাকাতেই থাকবে
ক’দিন। কাজেই সঙ্গী জুটিয়ে ডারউইন রওনা হলেন সে এলাকার গভীর অরণ্যের দিকে। প্রায়
একশ মাইল পথ ঘুরে তেইশে এপ্রিল ফের যখন ফেরত এলেন বন্দরে তখন তাঁর সংগ্রহে জমে
উঠেছে অবিশ্বাস্য সব পোকামাকড় আর লতাগুল্মের একটা বিরাট সংগ্রহ।
ফিরে এসে শোনা গেল বিগ্ল্
গিয়েছে অ্যাব্রলের দিকে। আরও কিছু সমীক্ষার কাজ সারবে সে সেখানে। সময়টা খুব কাজে
লেগে গেল ডারউইনের। সংগ্রহ করে আনা নমুনাগুলোকে নিয়ে এ সময়টা চলল গভীর অধ্যয়ন।
তাদের নানান বিশিষ্টতা আর সেই নিয়ে অজস্র প্রশ্ন আর ব্যাখ্যায় ভরে উঠতে লাগল তরুণ
বিজ্ঞানীর রোজনামচার খাতা।
৬ জুন তারিখে বিগ্ল্ ফিরে
এল। আর তার পরেই ফের ঝামেলা হয়ে গেল একটা। জাহাজের ডাক্তার ছিল রবার্ট ম্যাক্কর্মিক।
সে সময়ের কানুন মোতাবেক, জাহাজ কোথাও গেলে সেখানকার জীবজগতের নমুনা জোগাড় করবার
দায়িত্ব তার ডাক্তারের হাতে থাকত। ফিরে এসে সে দেখে চার্ল্স্ নামের সেই অকালপক্ক
ছোকরা জঙ্গল ঢুঁড়ে সেসব জুটিয়ে এনে তাই নিয়ে বেজায় পড়শোনা জুড়েছে। দেখেই রবার্টের
মাথায় রক্ত উঠে গেল। বলে, আমার কাজ তো আমারই করবার কথা হে! সে কাজ এ ছোকরা যখন আগ
বাড়িয়ে করতে লেগেছে তখন আমি আর এ জাহাজে নেই। এই বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মহা রাগে
গজগজ করতে করতে সে গিয়ে উঠল বিলেতগামী এক যুদ্ধজাহাজে।
ব্যাপারটা খানিক তিতো হলেও
তাতে লাভও হল একটা। জাহাজে নতুন ডাক্তার এল, কিন্তু নমুনা সংগ্রাহকের কাজটা
পাকাপাকিভাবে ডারউইনের কাঁধেই চাপল এসে এবার।
জুলাইয়ের শুরুতে এবার যখন
জাহাজ রিও ছেড়ে মন্টভিডিওর দিকে রওনা দিল, তখন জাহাজের সঙ্গ নিল পরপয়েজের একটা
বিরাট ঝাঁক। আর দিনের পর দিন তাদের আচারআচরণ জাহাজের ডেক-এ বসে লক্ষ করতে লাগলেন
চার্ল্স্ ডারউইন।
সেপ্টেম্বরে জাহাজ যখন
আর্জেন্টিনা পৌঁছেছে তদ্দিনে ডারউইন পুরোদস্তুর জাহাজের প্রকৃতিবিদ। সঙ্গে নোটবুক,
পেনসিল, আর বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে চললেন সেখানকার দুর্গে। তাতে
এক উটকো ঝামেলা জুটল। অচেনা সব যন্ত্রপাতি নিয়ে এক ছোকরাকে ঢুকতে দেখে দুর্গের
লোকজন জিজ্ঞেস করল, এ ছোকরা জাহাজের কী কাজ করে? জাহাজিরা জবাব দিল, ও হল আমাদের
প্রকৃতিবিদ।
একে তো দুর্গের মুখ্যুসুখ্যু
সেপাই লোকজন অমন সব যন্ত্র কখনও দেখেনি, তায় আবার “প্রকৃতিবিদ” বস্তুটা যে কী তাও তাদের
বুদ্ধির বাইরে। অতএব দুর্গের ক্যাপ্টেন ধরে নিলেন এ নিশ্চয় গুপ্তচর। নইলে কাজের
এমন অদ্ভূতুড়ে নামই বা কেন হবে, আর সঙ্গে এমন অদ্ভূতুড়ে যন্ত্রপাতিই বা থাকবে কেন?
অতএব তাঁর পেছনে দুর্গের চর লেগে গেল। তবে তারা ডারউইনের সাথে ঘুরেফিরে যে রিপোর্ট
দিয়েছিল, তাতে ক্যাপ্টেন বোধহয় ছোকরাকে বদ্ধ উন্মাদ ঠাউরে থাকবেন। কারণ সে তখন তার
যন্ত্রপাতি নিয়ে পাটাগোনিয়া মালভূমির বুকে পুন্টা আল্টা টিলায় গিয়ে খুঁজে বের করছে
অতিকায় সব জীবাশ্মের হাড়।
এবারে ফের একটু গণ্ডগোল বাধল।
রাক্ষুসে সব দাঁত আর অন্যান্য নানান জাতের হাড়গোড়ের জীবাশ্ম ঘাড়ে করে এনে জাহাজে
তুলতে ক্যাপ্টেন ফিট্জরয় বেজায় ক্ষেপে গিয়ে ডারউইনকে বলেন, “ওসব জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে জাহাজে
এনে তুলছ যে বড়ো, তা বলি ওতে কার কোন উপকার হবে হে?”
চার্ল্স্ জবাব দেননি। প্রত্নজীববিদ্যায়
তাঁর দৌড় নেই বললেই হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীসুলভ ষষ্ঠেন্দ্রিয়ই হয়ত তাঁকে বলে দিচ্ছিল,
নিজের অজান্তেই প্রকৃতির যে ধাঁধার উত্তর তিনি খুঁজতে শুরু করেছেন, এ ফসিলের
টুকরোরা সে রহস্যের কোনও হারানো সমাধানের অংশ হলেও হতে পারে।
ফিট্জরয় যতই মাথা নাড়ান,
ডারউইন কিন্তু একগুঁয়ের মত ফসিল খোঁজার কাজ চালিয়েই যাচ্ছিলেন। পরের বন্দর বাহিয়া
বিয়াংকা। সেখানে পাজ আর লিয়েবের নামে আরও দুটো জাহাজ যোগ দিল বিগল-এর সাথে, সে
এলাকায় তার সমীক্ষার কাজে। এই বাহিয়া এলাকায় তিন জাহাজের রসদ ভরবার কাজকর্মের
ফাঁকেই সে এলাকা থেকে আরও কিছু বিচিত্র জীবাশ্ম তুলে আনলেন ডারউইন। সেইসঙ্গে চলছিল
সুযোগ পেলেই হেনসলোর কাছে সংগৃহীত নমুনা আর তাঁর নোট্স্ এর কপি ডাকে পাঠাবার
কাজ। তদ্দিনে ডারউইনের বিগ্ল্ ডায়েরি
আড়াইশো পাতা ছাড়িয়ে গেছে।
ডিসেম্বরের চার তারিখে সে
এলাকার কাজ শেষ করে সঙ্গী জাহাজদের বিদায় দিয়ে বিগ্ল্ চলল আরও দক্ষিণে টিয়েরা
দেল ফুয়েগোর দিকে। সেখানকার এক দ্বীপ থেকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া তিন আদিবাসীকে
বিগ্ল্ বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে বয়ে আনছিল তাদের নিজের এলাকায়। সেটা হল, বন্দিদের
যে দ্বীপ থেকে ধরা হয়েছিল সেখানে একটা গির্জা বসানো। সেজন্য এক পাদ্রিও এসেছেন
জাহাজে চেপে।
সে কাজ সারতে গিয়ে সেখানকার
অন্য এক দ্বীপে আশ্চর্য এক জনজাতির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ডারউইনের। বেঁটেখাটো, মুখে
রঙ করা লোকগুলো একবর্ণ ইংরিজি জানে না, অথচ এমন তাদের স্মৃতিশক্তি যে একেকবার
শুনেই গোটা একটা ইংরিজি বাক্যই হুবহু আউড়ে দিতে পারে একটুও না আটকে।
ক্রিসমাস আর ’৩৩এর জানুয়ারির শুরুর
দিকটা ভালো যায়নি বিগ্ল্-এর। ঝড়ে ঝঞ্ঝায় ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল সে সমুদ্রের বুকে। গির্জা
বসাবার জন্য তার গন্তব্য দ্বীপটা রয়েছে বিগ্ল্ চ্যানেল নামে এক বিপজ্জনক খাড়ি
পেরিয়ে। সেখানে ঝড়ের সমুদ্রে জাহাজ ঢোকাতে গেলে মহাবিপদ হতে পারে।
খাড়ির বাইরে খোলা সমুদ্রে
ঝড়ঝাপটার ভেতর ক’দিন অপেক্ষা করবার পর অবশেষে নাছোড় ক্যাপ্টেন করলেন কি, তিনটে বড়ো
নৌকায় গির্জা বসাবার মালপত্র, পাদ্রি, বন্দি আর জাহাজের বেশ কিছু লোকজন চাপিয়ে তাই
নিয়ে পাড়ি দিলেন ঝড়ের সমুদ্র বেয়ে। বলাবাহুল্য কৌতুহলী ডারউইনও চললেন তাঁর সাথে।
জানুয়ারির শেষাশেষি পাদ্রি
ম্যাথিউস আর বন্দি করে নিয়ে গিয়ে খৃস্টান বানিয়ে ফিরিয়ে আনা তিন আদিবাসী মিলে চালু
হল দ্বীপের গির্জা। নৌকোতিনটের মধ্যে দুটো এবার বিগ্ল্ খাড়ির মধ্যে দিয়ে আরও
এগিয়ে গেল জায়গাটা ভালো করে সমীক্ষা করে নেবার জন্য। অন্যটা জাহাজে ফিরে গেল।
সমীক্ষা চলবার সময় একদিন
ডারউইন দেখালেন, এক বছরের মধ্যে কতটা বদলে গেছেন তিনি। একদিন রাতে তাঁরা যখন পাড়ে
তাঁবু খাটিয়েছেন তখন সমুদ্র হঠাৎ ফুলে উঠে ভাসিয়ে নেবার তাল করেছিল সব্বাইকে।
ডারউইন তখন সেই জলে লাফ দিয়ে পড়ে বেজায় সাহস দেখিয়ে সব্বাইকে বাঁচান। তাতে খুশি
হয়ে ফিটজ্রয় জায়গাটার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়াটার নামই রেখে ফেললেন ডারউইন।
ফেরার পথে দেখা গেল ততদিনে
এলাকার লোকজন মিশন লুট করে যত কাপড়টাপড় পেয়েছে সব কেড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে পরে
চলে গেছে। পাদ্রিবেচারা ফিটজরয়কে দেখেই একলাফে এসে নৌকোয় উঠে বসে বলে, “আর যাচ্ছি নে
বাবা। আমি জাহাজে চললাম।”
ফিটজরয় তখন আর কী করেন? তিন খ্রিস্টান
বানানো আদিবাসীকে গির্জায় ফেলে রেখে পাদ্রি নিয়ে ফিরে গেলেন জাহাজে।
মার্চের শুরুতে জাহাজ পৌঁছুল
ফকল্যান্ডে। সবে তখন সাহেবরা সে দ্বীপ কেড়ে নিয়েছে। কাজেই বিগ্ল্ এসে লেগে গেল
দ্বীপের পাহারাদারিতে, যদ্দিন না ইংল্যান্ড থেকে আরও সেপাই এসে পৌঁছয়। আর ডারউইনও
সুযোগ পেয়ে চললেন দ্বীপের ফসিলদের নমুনা খুঁজতে।
সে কাজে নেমে চমকে উঠেছিলেন
ডারউইন। দক্ষিণ আমেরিকায় যেসব ফলিস তিনি পেয়েছেন, এ দ্বীপের পুরোনো জীবদের ফসিলের
গড়ন তার থেকে একেবারে আলাদা! কেমন করে এমনটা হল? প্রকৃতির কোন রহস্য এক জায়গার
ফসিলকে আরেকজায়গার ফসিল থেকে একেবারে অন্যভাবে গড়ে উঠতে মদত দিয়েছে?
এর উত্তর ছিল না তখন
বিজ্ঞানের কাছে। ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে বসলেন ডারউইন। তারপর ঠাণ্ডা মাথায়
শুরু করলেন একটা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজ। অবচেতনায় তাঁর প্রকৃতিই হয়ত আসল পথটা
দেখাতে শুরু করেছিল তখন। শুরু হল এতদিন ধরে নানা এলাকা থেকে জোগাড় করা জীবাশ্মদের
পাশাপাশি রেখে তাদের তুলনামূলক অধ্যয়নের কাজ। পরবর্তীকালে পৃথিবীজোড়া উদ্ভিদ ও
প্রাণীদের বিস্তার আর বিভিন্ন পরিবেশে একই জাতের জীবের বিভিন্নভাবে অভিযোজিত হয়ে
ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেবার যে তত্ত্ব তিনি তৈরি করেছিলেন, তার বীজ হয়ত বোনা হয়েছিল
ফকল্যান্ডের বুকে সেই জীবাশ্মের তুলনামূলক অধ্যয়ন থেকেই।
ফকল্যান্ড থেকে কিছু ফরাসিকে
নিয়ে বিগ্ল্ এরপর উত্তরমুখে মন্টেভিডিওয় ফিরে গেল এপ্রিলের শেষাশেষি। ফেরার
আরেকটা কারণ ছিল। ইতিমধ্যে, সমীক্ষার কাজে লাগাবার জন্য অ্যাডভেঞ্চার নামে আরও
একটা জাহাজকে সস্তায় কিনে নিয়ে তাকে সারাইসুরাই করবার জন্য মন্টেভিডিওর কাছে
মালদোনাদোয় পাঠিয়েছিলেন ফিট্জ্রয়। তাকে সঙ্গে নেবার জন্যও ফিরে আসাটা দরকার ছিল
তাঁর।
ডারউইন সুযোগটা কাজে লাগালেন।
সংগ্রহের নমুনার বোঝা তখন বেজায় বেড়ে উঠেছে। বাড়িতে বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন খানিক
পয়সার জন্য, যাতে সব সামলাবার জন্য একটা চাকর রাখবার পয়সা দেন তিনি। মন্টেভিডিওতে
এসে বাবার চিঠিতে টাকাপয়সার সমস্যা মিটতে জাহাজের বেহালাওয়ালা ছোকরাকে চাকর রেখে
তাকে বেশ শিখিয়েপড়িয়েও নিয়েছেন তদ্দিনে।
তাকে সঙ্গে করে আর কিছু লোক
জুটিয়ে ডারউইন এবারে ফের একবার পাটাগোনিয়ার বিস্তীর্ণ মালভূমি অঞ্চলে ফিরে গেলেন
জীবাশ্মের সন্ধানে। সেখানকার গচো উপজাতির ফূর্তিবাজ মানুষজনের সঙ্গে খোলা আকাশের
নীচে ক্যাম্প করে, বোলাস ছোঁড়া শিখতে গিয়ে পাথরবাঁধা দড়ির প্যাঁচে নিজের ঘোড়াকেই
শিকার করে হাসির খোরাক হয়ে, হেসে, গেয়ে ফূর্তি করে কাটিয়ে দিলেন বেশ কিছু দিন। আর
তারপর, একেবারে হঠাৎ করেই, প্রকৃতি একটা নতুন রহস্যের দরজা খুলে ধরল তাঁর সামনে।
জিনিসটা পাওয়া গিয়েছিল সেই
পুন্টা অলটাতেই। এবারে সমুদ্রের ধারে। একটা অতিকায় অজানা স্তন্যপায়ীর জীবাশ্ম।
একধরণের ভূমিবাসী স্লথ সেটা। আগের বছর সান্টিয়াগোতে পাহাড়ের গায়ে জলের আট মানুষ
ওপরে যে সাদা শামুকঝিনুকের খোলার স্তর দেখেছিলেন তিনি, এখানেও তেমনই একটা স্তরের
নিচে পলিপাথরের স্তরের মধ্যে জমাট বেঁধে ছিল জিনিসটা।
ততদিনে প্রকৃত বিজ্ঞানসাধকের
প্রথম ধাপটা নিজে নিজেই শিখে ফেলেছেন ডারউইন। সেটা হল, অজানা ধাঁধাকে ধরবার শুরুতে
সঠিক প্রশ্নগুলো করা। জিনিসটা দেখে তিনি এই প্রশ্নগুলো করলেন নিজেকেঃ
ক। এ ফসিলের সঙ্গে সামান্যতম
মিল আছে এমন কোনও প্রাণী কেন দক্ষিণ আমেরিকায় নেই?
খ। এদের নির্মূল হবার কারণ কী
পরিবেশের বদল?
গ। যদি তাই হয় তবে সে বদল কেন
ঘটেছিল?
ঘ। কবে মারা গিয়েছিল জীবটা? “লিল”-এর
বইয়ে পাওয়া তত্ত্ব বলছে মহাদেশীয় ভূমিদের সামান্য উত্থানপতন ঘটতেও বহুকাল সময় লাগে। তাহলে
ভূস্তর থেকে এতটা উঁচুতে পাওয়া এ জীবাশ্মের প্রাণীটা যখন জ্যান্ত ছিল সে সময় তো
লক্ষ লক্ষ বছর আগে হবার কথা?
প্রশ্নগুলো অতিষ্ঠ করে তুলছিল
ডারউইনকে। এর উত্তর পেতে আরও অনেক দেখতে হবে তাঁকে। ইতিমধ্যে বিগ্ল্ চলেছে আরও
উত্তরে সমীক্ষার কাজে। ডারউইনের তখন আর সেদিকে মন নেই। ফিটজরয়ের কাছে অনুমতি চাইলেন,
সাগরের তীর ধরে ধরে বুয়েনস্ এয়ার্স অবধি খুঁজে দেখবেন তিনি, আরও কিছু সূত্র যদি
পান তাঁর প্রশ্নের উত্তরের!
সেই দীর্ঘ পথে তিনি খুঁজে
পেয়েছিলেন দানবিক মেগাথেরিয়ামের অতিকায় মাথা, পেয়েছিলেন, অতিকায় পিপীলিকাভূকের
খোলস, দানবিক এক টক্সোডন জাতের প্রাণীর জীবাশ্মও।
আস্তে আস্তে একটা
যুক্তিশৃঙ্খল গড়ে উঠছিল তাঁর মাথায়। তিনি ভাবছিলেন, বর্তমানের প্রাণীদের তুলনায় এ
এলাকার অতীতের বাসিন্দাদের চেহারা বহুগুণে বড়ো ছিল। এ অঞ্চলে প্রকৃতি ঊষর। গাছপালা
কম। কিন্তু প্রাণীদের অত বড়ো চেহারার অর্থ হল তাদের যুগে এ অঞ্চল অনেক বেশি
খাবারের জন্ম দিত, তার মানে সেই লক্ষলক্ষ বছর আগে এ অঞ্চল ঘন সবুজে ছাওয়া এলাকা না
হয়ে যায় না।
পরের প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই
জাগল তাঁর মনে — কেন হঠাৎ পালটে গেল জলবায়ু?
আরেকটা বিচিত্র বিষয় তাঁকে
খোঁচাচ্ছিলঃ আফ্রিকার বহু ঊষর জায়গাতেই তো অনেক বড়ো চেহারার প্রাণী টিঁকে আছে। এককালে
সেসব জায়গাও সবুজ ছিল বলে প্রমাণ আছে। তাহলে এখানে এরা বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন? কী
সেই রহস্যের জবাব?
এরপর বেশ কিছুদিন ধরে বিগ্লের
জন্য অপেক্ষায় থেকে সে এলাকার নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতেই গোটা বিষয়টা নিয়ে মনের
ভেতর নাড়াচাড়া করছিলেন ডারউইন। সেই করতে গিয়েই হঠাৎ খেয়াল হল, ইউরোপের শীতল
দুনিয়ায় পাওয়া বহু প্রাণীর সাথে প্রায় একরকম চেহারার এত প্রাণী দক্ষিণ আমেরিকার এই
গরম, ভেজা এলাকাগুলোয় থাকে কেমন করে?
প্রশ্নটা এখনকার দিনে বিশেষ
সিরিয়াস কিছু নয়। কিন্তু ডারউইনের যুগে এ প্রশ্ন বেজায় বিপজ্জনক ছিল। কারণ সে সময়
খৃস্টানরা চার্চের কথা খুব মানত। তাদের চার্চ আর বাইবেল তাদের শেখাত, ভগবান নাকি
প্রত্যেকটা প্রাণীকে একেবারে তার পরিবেশের সঙ্গে উপযুক্ত করে গড়েন। ডারউইনের মনে
প্রশ্ন জাগছিল, তাই যদি হবে তাহলে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশে
একই গড়ণের প্রাণী থাকা উচিত নয়। কোন প্রাণীর প্রজাতিরই নির্মূল হবারও কথা নয়। অথচ
দুটোরই প্রমাণ তিনি পেয়েছেন এই দেশের বুকে। তাহলে কি বাইবেল মিথ্যে কথা বলে? ভুল
শেখায় মানুষকে? ভগবানকে নিয়ে গল্প বানিয়ে প্রকৃতির রহস্যকে জানবার পথে বাধা দেয়
মানুষকে?
কেউ শুনতে পায়নি, কিন্তু
আটলান্টিকের পাড়ে সেই আধা মরু এলাকায় গচো উপজাতির জোয়ানদের সাথে ঘুরে বেড়ানো এক
প্রকৃতিবিদ আধপাগলা ছোকরা লাখো বছরের পুরোনো কিছু হাড়গোড় পিঠে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে
তখন হাতে একটা অদৃশ্য যুদ্ধের শঙ্খ তুলে নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই সেই শঙ্খের
ধ্বনি সাক্ষাত ভগবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সে যুদ্ধ একদিন বিজ্ঞানের
চেতনার বিস্ফোরণে মিথ্যে করে দেবে বাইবেলে বলা রাস্তায় ঈশ্বরের জীবজগত সৃষ্টির
কুসংস্কারাচ্ছন্ন গল্পটাকে। ধ্বংস হবে ধর্মের শেকলে বিজ্ঞানকে বেঁধে রাখবার কারাগার।
বিগ্ল্-এর রুট ম্যাপ (এ লেখায় যে অংশটা আছে তা পার্পল রঙে দেখানো) |
এরপর আগামী সংখ্যায়
কি লিখেছো দেবজ্যোতিদা ...অসম্ভব ভালো লেখা।এইটার জন্যে প্রতিবার মুখিয়ে থাকবো।আমি লেখাটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম জাহাজের যাওয়ার একটা ম্যাপ থাকলে লেখাটা অন্য মাত্রা পাবে।তা নীচে দেখলাম সেটাও মৌজুদ।এই লেখাটা আমি বুকমার্ক করলাম।
ReplyDeleteAri sabas, ki chomotkar lekha!
ReplyDelete