সৌগত সেনগুপ্ত
ছোটা আম্বানা জায়গাটা বাংলা ঝাড়খন্ড সীমান্তে, ধানবাদ থেকে
পনেরো কিমি আগে। আর আসানসোল থেকে জায়গাটার দূরত্ব তেতাল্লিশ কিমি।
খুব ছোটো একটা জায়গা। তার থেকেও ছোটো একটা রেলস্টেশন।
সারাদিনে আট-দশ জোড়া ট্রেন থামে। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল বলে উঁচুনিচু পাহাড়ি
এলাকা। দু’একটা টিলা ট্রেন থেকেই দেখা যায়।
আমার বন্ধু প্রসূন তখন ধানবাদের মাইনিং
স্কুলে এম.টেক করছে। সপ্তাহে সপ্তাহে কলকাতা-ধানবাদ যাওয়া আসা করে।
আমি তখনও এখনকার মতোই কলকাতায় চাকরি করি। আমাদের মাঝেমধ্যে দেখা হয়।
প্রসূনের ফটোগ্রাফির শখ, ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় অবসর সময়ে।
একদিন প্রসূন আমাকে বলল, “সৌগতদা, ছোটা আম্বানা যাবে?”
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।
জায়গাটা কোথায় রে বাবা! ওর থেকেই শুনলাম ছোটা আম্বানা খুঁজে পাওয়ার গল্প।
ওখানে ট্রেন লাইনের ধারে স্টেশন থেকে কিছুটা আগে একটা টিলা আছে।
বললাম, “সে আর নতুন কী? ওরকম টিলা তো আরও অনেক জায়গায় আছে!”
আরো জানলাম, শুধু টিলা নয়, টিলার উপরে একটা
সিগন্যাল ঘর আর একটা সেমাফোর সিগন্যালও আছে। যদিও সেটা এখন এই
অটোমেটিক সিগন্যালের যুগে অকেজো। শুধু তাই নয়, ওখানে রেল লাইনটা ইংরেজি ‘এস’
অক্ষরের মতো বেঁকে গেছে। প্রথমে ট্রেন থেকে দেখে আর পরে গুগল স্যাটেলাইট
ইমেজ দেখে প্রসূনের মনে হয়েছে জায়গাটা এক্সপ্লোর করে দেখা দরকার।
ওখান থেকে ট্রেনের দারুণ ভিউ পাওয়া যাবে। আর আশেপাশের প্রাকৃতিক
পরিবেশও খুব সুন্দর। কাজেই একদিন ছোটা আম্বানা অভিযানে যেতেই হবে।
আমি তো এককথায় রাজি হয়ে গেলাম।
তখন কি জানতাম, সেই বেড়ানো সত্যি সত্যি অভিযানে পরিণত হবে!
শুরুয়াত
যদিও প্রসূনের মার্চ মাসে যাওয়া ইচ্ছে ছিল,
কিন্তু সবদিক সামাল দিয়ে আমাদের যেতে যেতে সেপ্টেম্বর মাস হয়ে গেল।
অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি প্রসূন আমাকে জানাল ছোটা আম্বানা যাবার প্ল্যান
ফাইনাল হচ্ছে। আমাদের আর একজন সঙ্গী হল সিদ্ধার্থ। আমরা ঠিক করলাম,
২০-২১শে সেপ্টেম্বর যাচ্ছি। ২০ তারিখে রাত্রে আসানসোল, ওখানেই রাত্রিবাস।
পরেরদিন সকালে লোকাল ট্রেন ধরে ছোটা আম্বানা। টিলা বিজয় এবং
বেলাবেলি আসানসোলে ফিরে এসে ট্রেন পাল্টিয়ে কলকাতা ফেরা।
টিউশন ক্লাসকে অফিস ট্যুরের গল্প শুনিয়ে,
আর অফিসে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে যাবার জোগাড় করা হল। নিয়ে যাবার জন্যে প্রয়োজনীয়
ব্যাগ না থাকায় আগেরদিন সেটা কিনতে হল। ২০ তারিখ সকালে একপ্রস্থ টিউশন সেরে প্রায়
ছুটে ছুটে অফিস, পরেরদিন না আসার অজুহাত শুনিয়ে শেষমেশ প্রসূন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ
জানাল ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আমার অফিস থেকে হাওড়া স্টেশন খুব কাছে হলেও
রাস্তায় জ্যামের কথা সবাই জান।
প্রথমে ঠিক ছিল আমরা অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে
যাব আর সাড়ে ন’টা পৌনে দশটার মধ্যে আসানসোল পৌছে যাব, আসানসোলের রিটায়ারিং রুম খুব
ভালো ইত্যাদি। কিন্তু সিদ্ধার্থ আসবে শিবপুর থেকে। ওখানে পি.এইচ.ডি.
করছে। শিবপুর থেকে হাওড়া আসা খুব সহজ, কিন্তু সিদ্ধার্থ প্রথমে
শিবপুর থেকে গড়িয়াতে ওর বাড়ি গিয়ে হাওড়া আসবে। যাই হোক, আমারও
সুবিধা হল বিভূতি এক্সপ্রেসে টিকিট কাটার জন্য। ট্রেন যখন রাত আটটায় তখন তাড়াহুড়ো করারও কিছু নেই।
পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে লঞ্চে করে নদী পার হয়ে পৌনে সাতটাতেই পৌঁছে গেলাম।
হাওড়া স্টেশন
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনও?
রাতের আকাশের তারা যেমন গোনা যায় না তেমনি হাওড়া স্টেশনের মানুষের সংখ্যাও।
পরিসংখ্যানবিদেরা টিকিট বিক্রি দিয়ে একটা পরিমাপ করেন ঠিকই, কিন্তু একটা সংখ্যা
দিয়ে বর্ণময় হাওড়ার যাত্রীদেরকে মাপা যায় কি? দুটো টিকিট পকেটে নিয়ে স্টেশন চত্বরে
ঢুকে প্রথম কাজ ছিল ট্রেন সংখ্যা ১২৩৩৩ আপ হাওড়া এলাহাবাদ সিটি বিভূতি এক্সপ্রেস
কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে খোঁজ করা। তা সে ছাড়বে ১০ নম্বর থেকে। এরপর আমার দুই
নম্বর কাজ আসানসোল স্টেশনের রিটায়ারিং রুম বুকিং করা। কিন্তু
কাউন্টারের লোক বলল সেটা নাকি আসানসোল গিয়েই করতে হবে। প্রসূন জানিয়েছে মেট্রোতে
এসপ্ল্যানেড আসবে, তারপর বাস, ও তখন কালিঘাটে। সিদ্ধার্থ তখন
বাড়ি থেকেই বেরোয়নি। ছেলেটা মনে হয় ঝোলাবে!
আমার তিন নম্বর ও শেষ দায়িত্ব রাতের খাবার
কেনা, ফুড প্লাজা থেকে। আমি খুব ফুডি নই। তাই খাবার বাছতে গিয়ে
হিমশিম। হিমশীতল খাবার নাকি উষ্ণ, তার জন্য প্রসূন আসা অবধি
অপেক্ষা করতেই হল। শেষে তিন প্যাকেট বিরিয়ানি প্যাক করে নেওয়া হল রাতের জন্যে। আমি
নিজে ভেবেছিলাম রাতের খাবার বোধহয় আসানসোল স্টেশনে করতে হবে। এই প্যাকিংয়ের
বিষয়টা মাথায় আসেনি। এই লিডারশিপ কোয়ালিটির জন্যে না প্রসূন নতুন জায়গা আবিষ্কার
করেছে!
প্রসূন আর সিদ্ধার্থর বার্থ ছিল ২০ আর ২৩,
আর আমার ৪। সবগুলোই এস ৯–এ। ট্রেন দিয়ে দিয়েছে
প্ল্যাটফর্মে, এদিকে সিদ্ধার্থর দেখা নেই। প্রসূন বলল, সিদ্ধার্থ নাকি এরকম দেরি
হামেশাই করে। যাই হোক, ফোন
করাতে এক চান্সে উত্তর, স্টেশনে ঢুকছি। আমরা ২৩, ২৪ বার্থে গুছিয়ে বসলাম।
সিদ্ধার্থও এল, আর এসেই ইঞ্জিন দেখতে গেল। আমরা ২৩ নম্বরের লোকটাকে ৪ নম্বরে
পাঠিয়ে দিলাম। আমার ধারণা ছিল না, এত লোক এত রাত্রে আসানসোল যাচ্ছে তাও
আবার রিজার্ভেশন করে! দু’একজন আবার রাজারহাটের প্রতিবেশী। গলায় ট্যাগ
ঝুলিয়ে ফ্রাইডে ইভনিং উইক-এন্ড কাটাতে বাড়ি ফিরছে। ই-টিকিটের
প্রিন্ট আউট নিয়ে সোজা আপার বাঙ্কে।
ট্রেন ছাড়ার ঝাঁকুনি পেলাম, ওদিকে
সিদ্ধার্থ ইঞ্জিন দেখতে গিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। এদিকে প্রসূন
নির্বিকার। সিদ্ধার্থ নাকি এরকমই, ওর সঙ্গে স্কুল থেকে পড়েছে।
ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়ার আগেই সিদ্ধার্থ এল। সে নাকি ট্রেন ছাড়ছে দেখে
এস ১-এ উঠে ভেতর দিয়ে আসছে।
রাতের ট্রেনের সঙ্গী
সন্ধের ট্রেনে যাত্রা মানেই মনে হয়
সারারাতের পাড়ি। কিন্তু এবারে সেটা নয়। গভীর রাতে নেমে
যেতে হবে। ঢিমেতালে হেলেদুলে হাওড়া থেকে ছেড়ে যথারীতি কর্ড লাইনে ঢুকল। প্রসূনের
ট্রেনের গতি মাপার যন্ত্র রেডি, কিন্তু মোবাইলে সিগন্যালই নেই। আমি বসেছি ট্রেনের
অভিমুখের বিপরীত দিকে। আমার উল্টোদিকে প্রসূন। সিদ্ধার্থ
বসেছে কিউবের একেবারে বাইরের দিকে। ডানকুনির আগে পর্যন্ত কিছু হকার দেখা গেলেও তারপরে
সব হাওয়া হয়ে গেল। পুলিশের উর্দি
পরা কে বা কারা এসে ব্যাগ সাবধানে রাখার উপদেশও দিয়ে গেল। তবে ভিডিও
রেকর্ডিং করতে দেখলাম না। যথাসময়ে ট্রেনে টিকিট পরীক্ষককে দেখা গেল।
তবে মুখে উপস্থিত বলাতেই কাজ হল, কাগজ, এস.এম.এস.
কিছুই লাগল না। এরপর ট্রেন বারুইপাড়ায় থামল। কামারকুন্ডু,
জৌগ্রাম আর একটা কোন স্টেশনে থামতে থামতে বর্ধমানে পৌঁছতে দেরি করিয়ে দিল বেশ
কিছুক্ষণ। সেই দেরি আর ফিরে পাওয়া গেল না, অন্তত আসানসোল পর্যন্ত।
বর্ধমানে ডাউন তুফান এক্সপ্রেসের সঙ্গে
মোলাকাত হল যেটা এত লেট যে নাম-মাহাত্ম্য ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
কখন হাওড়া পৌঁছাবে কে জানে! বর্ধমানের পরে বিরিয়ানি খেয়ে নেওয়া হল। সিদ্ধার্থ খুব স্বাস্থ্য সচেতন।
তাই ডিম খেতে কিন্তু কিন্তু করছিল। কারণ, সেদিন সকালে একটা ডিম অলরেডি খাওয়া হয়ে গেছে।
আমি আর প্রসূন জোর করে খাওয়ালাম। দুর্গাপুর আসতে প্রসূনের পুরনো স্মৃতি ফিরে এল। তা
বলে প্রসূন স্কিৎজোফ্রেনিয়াক নয় কিন্তু! ও আগে দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত।
কালিপাহাড়িতে অনেকক্ষণ দাঁড়াল। আমার ঘোড়া সাহেবের কুঠির (কার লেখা বল তো? মনে
পড়লে কমেন্ট করে দিও) কথা মনে হল। আর ট্রেনটা আরও লেট করে আসানসোল পোঁছাতে রাত প্রায়
১১টা হয়ে গেল।
রাতের আসানসোল স্টেশন
রাতের অতিথি
ঠিক ১১টার সময় ২নং প্ল্যাটফর্ম থেকে ধানবাদ
যাবার শেষ মেমু লোকাল ছেড়ে গেল। কাল সকালে আমরা ওইখান থেকে ওইরকম একটা ট্রেনে ছোটা
আম্বানা যাব। কিন্তু সে তো অনেক দেরি। আগে রাতের জন্য
মাথা গোঁজবার একটা আস্তানা পাওয়া যাবে কি? আমরা র্যাম্প দিয়ে ৪নং থেকে ২নং
প্ল্যাটফর্মে এসে এনকোয়ারিতে খোঁজ নিলাম থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কি না? প্রশ্নের
উত্তরে জানা গেল, রুম নেই তবে ডরমিটরি খালি আছে। সেটার জন্যে আবার ভেতরে আসতে হল।
লেখালেখির ফাঁকে এনকোয়ারির টারমিনালে ট্রেন আসা যাওয়ার সফটওয়্যারটা দেখলাম। তখন দু’দিকেই
ঘন ঘন ট্রেন আসার সংকেত। টাকা আর টিকিটের সঙ্গে আই.ডি.
কার্ড দেখাতে হল। প্রসূনের আই.এস.এম-এর আই.ডি (যেটা ডেট এক্সপায়ার করে গেছে),
আমার পুরনো ঠিকানার ভোটের আই.ডি (যেখানে আমার রবীন্দ্র জাদেজার মতো গোঁফ)।
তারপর সেই এনকোয়ারির লোকের পিছু পিছু
ডরমিটরিতে উঠলাম। বাঁদিকে দুটো এসি রুম আর ডানদিকে এসি ডরমিটরি। মাঝে একটা করিডোর
যার একদম শেষে একটা ছাদ থেকে স্টেশন চত্বরটা দেখা যাচ্ছে। আকাশে বেশ মেঘ,
চাঁদ তারা সব উধাও। ডরমিটরিতে ঢুকে আমরা একদম শেষের তিনটে কিউব দখল করলাম।
ডবল রুমের থেকে আরও ভালো। স্প্লিট এসিটাকে চিলড করে চালিয়ে ফ্রেশ হতে গেলাম ছাদের
পাশে কমন টয়লেটে। হঠাৎ ঘরের আর বারান্দার আলো নিভে গেল আর ছাদের উপর একটা মুখ! কে
উঁকি মারছে ওখানে? ছাদের পাঁচিলের পাশে ওখানে কে দাঁড়িয়ে? প্রসূন বা সিদ্ধার্থকে
ডাকার মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে না গলা থেকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আলো এসে গেল।
আসানসোল স্টেশনের ডরমিটরি
তারপর যা দেখলাম তাতে গলা দিয়ে আওয়াজ সত্যি
বন্ধ হয়ে গেল! ছাদের ওপাশে একটা বিশাল বড়ো হোর্ডিং যেখান থেকে মুখ দেখাচ্ছেন
তৎকালীন ক্রিকেট অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টিবিভ্রম আর
নিজের বোকামি বুঝতে পেরে ঘটনাটা পুরো চেপে গেলাম বাকিদের কাছে। হালকা
ঠাণ্ডায় রাত্রে ঘুমটা ভালোই হল।
সকাল, ২১শে সেপ্টেম্বর
আসানসোল থেকে ছোটা আম্বানা যাওয়ার মেমু
ট্রেন সকাল ৫.১০-এ, তাই সাড়ে চারটের মধ্যে উঠে তৈরি হয়ে নিতে হল। সকালবেলার কাজগুলো
সেরে, মহিলার কাছে কম্বল ফেরত দিয়ে টিকিট কাউন্টারে লাইন দিলাম। আসানসোল থেকে ছোটা
আম্বানার রিটার্ন টিকিট নিল ২০ টাকা করে একেকজনের। এর
মধ্যে অগ্নিবীণা আর হলদিয়া যাবার ট্রেনের ঘোষণাও করেছে। সিদ্ধার্থ আর প্রসূন কিছু
খাবার কিনতে গেল। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে যেতেই ট্রেন ঢুকে গেল। ১
নম্বর থেকে হলদিয়া এক্সপ্রেস, ৫ নম্বর থেকে অগ্নিবীণা আর ৬ নম্বর থেকে বর্ধমান
যাবার মেমু ছাড়ার জন্যে রেডি। শনিবার হলেও অত ভোরে আসানসোল স্টেশনে অনেক লোক।
কেউ কলকাতা যাবে, কেউ আবার যাবে আদরা।
অন্ধকারে আসানসোল স্টেশনের বোর্ড
জ্বলজ্বল করছে
অন্ধকারে ট্রেন চলেছে। বাঁদিকে আদ্রা যাওয়ার লাইন বেঁকে গেছে
আকাশে মেঘ ভরা, রাত্রে বৃষ্টিও হয়েছে। বারো
বগির মেমু ঠিক সময়েই ছাড়ল। বাঁদিকে লোকো শেড পার করে আদরা যাবার সিঙ্গল লাইন বেঁকে
গেল। বরাচক, সীতারামপুর, কুলটি পার করার
পর বাইরে একটু একটু আলো দেখা গেল। আমরা ততক্ষণে তিনটে জানালার ধার বেছে ক্যামেরা
নিয়ে বসে পড়েছি। বৃষ্টি নেই, তাই রক্ষে। যদিও সকাল থেকেই কুয়াশা ভরা মেঘলা
আবহাওয়া, যেটা ছবি তোলার একেবারে বিপরীত। বরাকর নদী পার করে বাংলা থেকে ঝাড়খণ্ডে
ঢুকলাম। মোবাইলে এসএমএস এল, বিহারের নেটওয়ার্ক আপনাকে স্বাগত
জানায়। কুমারডুবিও পেরোনোর পরে খেয়াল করলাম ট্রেনে লোক উঠতে শুরু করেছে।
ধানবাদে সকালে অনেকেই কাজে যাচ্ছে। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদেরও দেখলাম। বলতে ভুলে গেছি,
মুগমার পরে গ্রেডিয়েন্ট শুরু হল। কুমারডুবি (MSL
১৩৮) থাপরনগর (MSL ১৪৪), কালুবাথান (MSL ২৩৬)
পার হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে পাশের লাইনটা দূরে সরে যাচ্ছে, জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে
যাচ্ছে, আবার পাশে এসে যাচ্ছে কিছুদুর গিয়ে। ট্রেন থেকে প্রসূন টিলাটা দেখাল। আর
একটু পরেই ট্রেন এসে থামল ছোটা আম্বানাতে (MSL ১৯৪)।
ভোরের বর্ষাভেজা কুলটি স্টেশন
জঙ্গলের মধ্যে মেমু লোকাল
শিখর অভিযান
স্টেশনে নেমে দেখি, ঘাস তখনও ভিজে। স্লীপার
ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম শিখরের দিকে। এর মধ্যে আবার হু হু করে হাওড়ামুখী ডাউন
কোলফিল্ড এক্সপ্রেস এসে আমাদের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। ক্যামেরার EXIF বলছে
সময়টা ৬.২৭। লাইন থেকে নেমে দাঁড়ালাম। প্রথমে স্লীপার, তারপরে লাইনের পাশে পায়ে
চলা রাস্তা দিয়ে এগোতে হল। এরপরে আর রাস্তা নেই। আগাছা আর
চোরকাঁটা ভরা অসমতল ঢালু জমি। সেসব ভেদ করে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম।
হাওড়াগামী ডাউন কোলফিল্ড এক্সপ্রেস
হিলটপে পৌঁছে প্রাথমিক কাজের মধ্যে ছিল
ইনসেক্টিসাইড স্প্রে করা। পোকার উপদ্রবের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রসূন ওটা
কলকাতা থেকেই নিয়ে গিয়েছিল। একদিকে দূরে ছোটা আম্বানা স্টেশন দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে লাইনজোড়া বাঁক নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে আগের স্টেশন কালুবাথানের দিকে।
আশেপাশে ছোটো বড়ো টিলা, দূরে দূরে দু’একটা গ্রামও দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজনের
কোনও চিহ্ন নেই। একটা লম্বা সিগন্যাল
পোস্ট আর পাশে একটা ছোটো ইটের তৈরি ঘর আছে। ঘরের ভেতরে ধুলো ভর্তি, বহুদিনের
অব্যবহারের প্রমাণ।
সিগন্যাল পোস্ট আর পাশে একটা ছোটো ইটের
তৈরি ঘর (ছবি – প্রমিত মিত্র)
ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার করে প্রসূনেরই আনা
শতরঞ্জি পেতে ব্যাগগুলো রাখা হল। তখনও আকাশে মেঘ। যে কোনও সময়
বৃষ্টি আসবে। নিচের রেললাইন দিয়ে দু’দিকেই ঘন ঘন মালগাড়ি যাচ্ছে। কয়লাখনি এলাকা
বলে তার বেশিরভাগ কয়লার ওয়াগন। সঙ্গে শিয়ালদা রাজধানী, আসানসোল বারাণসী
প্যাসেঞ্জার, হাওড়াগামী মুম্বাই কলকাতা মেলের মতো যাত্রীবাহী ট্রেনও যাচ্ছে একের
পর এক।
আকাশে অল্প আলো ফুটেছে।
একটা নীল রঙের পাখিকে দেখে সিদ্ধার্থ আর প্রসূন ডি এসেলারের লেনসবন্দী করতে শুরু
করল। আমি আমার পয়েন্ট অ্যান্ড শুট কোডাক ক্যামেরাতে চোখ লাগিয়ে
দেখলাম, ও মা, গাছপালা সবই দেখা যাচ্ছে, পাখির চোখ ছাড়া! ওটা আমার ক্যামেরার
নাগালের বাইরে। সিদ্ধার্থ বেশ কয়েকটা ছবি তুলে এলসিডিতে দেখাল, নীলকণ্ঠ পাখি।
ততক্ষণে রোদটা ভালোই উঠেছে। প্রায় ৯টা বাজতে চলল। এই সময় কলকাতায়
সকালবেলাতে অফিস যাবার জন্যে ট্রেন আর মেট্রোতে ঠেলাঠেলি করি। এখানে নিজেরা
ছাড়া একটা লোকও নেই। বিষয়টা
অবাক লাগাতে প্রসূনকে বললাম। প্রসূন পাত্তাই দিল না। লোকজন আসলে
নাকি, কে, কী, কেন, কোথা থেকে এসেছি, হাজারটা প্রশ্ন করবে আর
আমাদের ছবি তোলা পণ্ড হবে।
শিয়ালদাগামী ডাউন রাজধানী এক্সপ্রেস
কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে
নীলকন্ঠ পাখি (ছবি – সিদ্ধার্থ
মুখোপাধ্যায়)
এরপর আপে ডাউনে পরপর অনেকগুলো ট্রেন গেল এল। যাদের
মধ্যে বৈদ্যনাথধাম-রাঁচি এক্সপ্রেস, ধানবাদ–পাটনা এক্সপ্রেস
এই দুটো ট্রেনের বোর্ড দেখে বুঝলাম। এদের পরে আসানসোলগামী মেমু এল।
এটাও কামরার রঙ দেখে চিনলাম। আর দুটো ট্রেন দেখার পরিকল্পনা ছিল, শতাব্দী
এক্সপ্রেস আর দুরন্ত এক্সপ্রেস। এগুলো চলে যাবার পরে আমরা নিচে নামতে থাকব, আর ছোটা
আম্বানা স্টেশনে গিয়ে আসানসোলগামী ট্রেন ধরব। সওয়া ন’টা নাগাদ আপ লাইনে শতাব্দী
আসবে। প্রসূন একটা কাশফুলের ঝোপের পাশে ক্যামেরা বসিয়েছে। সিদ্ধার্থ অবশ্য পাহাড়ের
উপর থেকেই রেডি। শতাব্দী এল ঠিক ৯.১৮-তে। ছবি তোলা শেষ হলে সেগুলো
একপ্রস্থ ফিরে দেখছি, আর মাঝে মাঝে কুট কুট চপর চপর করে ট্রেল মিক্স খাচ্ছি।
মেঘলা আকাশের নিচে ধানবাদ আসানসোল মেমু
লোকাল
রাঁচিগামী আপ শতাব্দী এক্সপ্রেস (এখন আর ট্রেনটাকে এরকম দেখতে নেই)
এবার শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আসবেন দুরন্ত
এক্সপ্রেস। আর মিনিট কয়েকের অপেক্ষা, ব্যস, আমাদের ছোটা আম্বানা অভিযান
শেষ। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। সিদ্ধার্থ
বা প্রসূন কেউ আমাকে থামতে বলল। চারদিকে একটাও শব্দ নেই। সারা পৃথিবী
যেন এখানে এসে বোবা হয়ে গেছে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা ক্ষীণ
আওয়াজ, গোঁ গোঁ গোঁ গোঁ... জেনারেটর কারের আওয়াজ আর ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের হর্ন।
ট্রেন আসছে, দুরন্ত আসছে। কিন্তু কোথায়? ছোটা আম্বানা স্টেশন পার করে প্রথম
এস কার্ভ পার করে সে তখন আমাদের ক্যামেরার নাগালে। সামনে সাদা
ইঞ্জিন, পেছনে সবুজ গাড়ি। পরে ক্যামেরার EXIF এ
দেখছি ৬টা ছবি সবক’টা ৯.৩৩-এ। হু হু করতে করতে আমাদের দশ মিটার সামনে দিয়ে বাঁক
নিয়ে সে গাড়ি আসানসোল-দুর্গাপুর-বর্ধমান হয়ে সোজা শিয়ালদার দিকে এগিয়ে গেল। প্রসূন
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “মিশন সাকসেসফুল।”
এবার শিখর থেকে নেমে আসার পালা।
শিয়ালদাগামী ডাউন দুরন্ত এক্সপ্রেস
অভিশপ্ত টিলার ভূতুড়ে কিসসা
ফেরার পথে সাইকেল নিয়ে চলা দুটো ছেলের
সঙ্গে দেখা হল। তার মধ্যে একজন আবার ধানবাদের একটা পলিটেকনিকের জ্যাকেট
গায়ে। সেখানে আবার প্রসূনের বন্ধু ফ্যাকাল্টি। আমাদের বাংলাতে
কথা বলা শুনে ছেলেগুলো বাংলাতেই জিগ্যেস করল, আমরা কোথা থেকে এসেছি আর কোথায়
গেছিলাম। কলকাতা থেকে ওই টিলা দেখতে এসেছিলাম শুনে এমনভাবে তাকাল
যেন এলিয়েন দেখছে! তারপর ঠেঠ দেহাতি ভাষায় কীসব বিড়বিড় করতে করতে সাইকেল নিয়ে এমনভাবে
গ্রামের দিকে দৌড় দিল যেন বাঘে তাড়া করেছে। পায়ে পায়ে প্ল্যাটফর্মে
এলাম।
আমাদের রিটার্ন টিকিট কাটাই ছিল। স্টেশনে
এসে চায়ের দোকানে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে চা পাওয়া যাবে কি না জিগ্যেস করতে প্রৌঢ় চা-দোকানি
সেই এক কথা রিপিট করল, আমরা কারা, কোথা থেকে কেন এসেছি। ওই টিলার কথা
শুনে তিনি এক আশ্চর্য কাহিনি শোনালেন। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ইলেক্ট্রনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করার আগে
গ্র্যান্ড কর্ড সেকশনে ওই সেমাফোর সিগন্যাল চালু ছিল। ভারতীয় রেলের
বিভিন্ন জায়গায় আজও চালু আছে। খুব রহস্যজনকভাবে অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে দু-দু’জন
সিগন্যালম্যান রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে গেছে ওই ঘর থেকে। তাদের আর কোনও
খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর ওই
সিগন্যাল পোস্ট তুলে দিয়ে ছোটা আম্বানা আর কালুবাথান স্টেশনের মধ্যে অন্যত্র
একাধিক সিগন্যাল পোস্ট বসিয়ে ট্রেন চলাচল চালু রাখা হয়। এখন তো ইলেক্ট্রনিক
সিগন্যাল ব্যবস্থা এসে গেছে। কিন্তু সেই যুগের সাক্ষী হয়ে সেই সিগন্যাল পোস্ট
আর সঙ্গে ঘরটা এখনও টিঁকে আছে।
দোকানিবুড়ো আরও জানালেন, ওই জায়গাটা নিয়ে
ওদের এতই ভয় যে ওখানে চাষ-আবাদ, এমনকি গরু ছাগল চরাতেও কেউ যায় না।
কেউ ভুল করে চলে গেলে তাদের নাকি কিছু না কিছু ক্ষতি হয়! বুঝলাম সেই ছেলেদুটোর
চমকানোর কারণ। বার কয়েক রাম
নাম উচ্চারণ করে আমাদের সাবধানে থাকতে বললেন। আমরা আশ্বাস
দিয়ে বললাম, আমরা যখন টিলায় উঠে আবার নেমেও আসতে পেরেছি তখন আর কিছু হবে না।
উল্টে ওদের সাহস দিয়ে বললাম এই যে চোরকাঁটা আমরা জিনসে বেঁধে নিয়ে এসেছি এতে সব
অপদেবতা-টেবতা পালিয়ে গেছে।
আসানসোল যাবার মেমু লোকাল আসার কথা ১০.১৩-এ
আর সেটা আসানসোল পৌঁছানোর কথা ১১.৩০–এ। সেইমতো আমরা প্ল্যান করে রেখেছি আসানসোলে অনেক সময়
থাকবে, ঝাড়া হাত পায়ে চিন্তা করব কী কী করব। দোকানদার বলেছিল মেমু লোকাল লেট করে কারণ, সেটা নাকি গয়া
থেকে আসে। সেটা যে এত লেট করবে কী করেই বা বুঝব! সিদ্ধার্থের আনা
বারবন বিস্কুট খেতে খেতে কিছু ছবি তোলা হল। কিছু না কিছু দেখলেই দু’জনেই ছবি তুলতে
থাকছে আর আমি চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে বসে ওদের লক্ষ করছি।
একটা মালগাড়ি এসে ঠিক আমাদের সামনেই
দাঁড়িয়ে গেল। ছবি তোলার সুবিধার জন্য সিদ্ধার্থ সেটার ওপাশে চলে গেছিল।
এদিকে ডাউনে জম্মু-তাওয়াই-কলকাতা-শিয়ালদা এক্সপ্রেস ঢুকে গেল আর সেটা আবার মাঝের
লাইনে। ট্রেনটা দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু সিদ্ধার্থকে ডেকে আনতে আনতে
ট্রেনটা আবার ছেড়ে দিল। এদিকে মেমুরও কোনও হদিস নেই। সামনে দিয়ে ট্রেন চলে
যাওয়াতে আমাদের তো মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। সিদ্ধার্থ দিব্যি
অম্লানবদনে বলল, “আমাদের তো লোকাল ট্রেনের টিকিট। ওটা এক্সপ্রেস
ছিল, চেকার ধরত।”
এর পরে আর কথা হয় না। অগত্যা মনোযোগ দিয়ে জিনস থেকে চোরকাঁটা ছাড়াতে শুরু
করলাম।
মেমু এল ১১.৩০ নাগাদ। তখনও জল্পনা
করছি, আসানসোলে নেমে রিটায়ারিং রুমে গিয়ে ভালো করে স্নান করতে হবে।
আমাদের তো ২৪ ঘন্টার জন্য ৩টে বেড নেওয়া আছে! জন আহারে লাঞ্চ করে ট্রেন ধরব। তখন কি জানতাম উপরওয়ালা আমাদের চিন্তাভাবনা দেখে
মুচকি হেসেছিলেন! মেমু বরাকর পর্যন্ত ভালো এলেও ওখানে দাঁড়িয়ে রইল।
আমরা প্লাটফর্মে বসে গল্পগুজব করতে শুরু করলাম। বরাকর ছেড়ে
কুলটিতে এসে আরও অনেকক্ষণ। এবারে সত্যিই মনে হচ্ছিল টিলার অভিশাপ আমাদের উপরে
পড়েছে। শেষে সীতারামপুরে
আসতে ঘোষণা হল, আপ শিয়ালদা মুজফফরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে।
ট্রানজিট যাত্রীরা দৌড়ালেন ওটা ধরতে। আমরা তখন বসার জায়গা পেলাম।
যদিও সেই ট্রেন চলে যাওয়ার পরেও আমাদের ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল। সেই সময় মনে
হচ্ছিল ট্রেনটা আদৌ কি চলবে কখনও? আশেপাশের নির্বিকার যাত্রীদের দেখে একসঙ্গে রাগ
আর করুণা দুইই হচ্ছিল। কথা বলে জানলাম, এটাই এ তল্লাটের রেওয়াজ।
আসানসোলে প্লাটফর্ম খালি না থাকার জন্য ট্রেনটা যতটা সম্ভব দেরি করে যাতে যতটা কম
সময় প্লাটফর্ম দখলে থাকে।
শেষমেশ ট্রেন আসানসোলে ঢুকল। ঘড়ি দেখার
ইচ্ছে হয়নি। এখন EXIF দেখে লিখছি। কুমারডুবি থেকে ট্রেন
বরাকরে ঢুকেছে ১২.১০-এ, আর আসানসোলে এ ঢুকলাম ১.৪০-এ।
আকাশ ভরা মেঘের মাঝে বরাকর নদীর ব্রিজ
পেরোচ্ছে মেমু লোকাল
ফেরার কথা
ভাগ্য ভালো ট্রেনটা দু’নম্বর প্লাটফর্মে দিয়েছিল। আর
ওভারব্রিজ পার হতে হল না। ধানবাদ আর গয়া যাওয়ার জন্য একঝাঁক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন
ট্রেনে ওঠার জন্য। কোনওরকমে ব্যাগ সামলে নেমে এনকোয়ারিতে গিয়ে খোঁজ নিলাম
হাওড়া যাওয়ার কী ট্রেন আছে। লাক
খারাপ থাকার তখনও বাকি ছিল! জম্মু-তাওয়াই-কলকাতা এক্সপ্রেস আমাদের সামনে দিয়ে চলে
গেছে। এরপরে তুফান
এক্সপ্রেসের আগে কোনও ট্রেন নেই। সেই ট্রেনেরও আশু কোনও সম্ভাবনা নেই।
হয়তো পাঁচটা নাগাদ ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস আগে আসবে। পূর্বা এক্সপ্রেস ঠিক সময়ে আসছে, কিন্তু সেই
ট্রেনের আসানসোল থেকে হাওড়া টিকিট দেওয়া হয় না! ওঁরাই বুদ্ধি দিলেন বর্ধমান যাওয়ার
মেমু লোকাল ধরে নিতে। তাহলে বর্ধমান থেকে কানেক্টিং হাওড়া লোকাল পাওয়া
যাবে। কিন্তু সেই ট্রেনটা দুপুর ২.০৫-এ ছেড়ে যাবে আর এতক্ষণে প্লাটফর্মে ঢুকেও
গেছে। পরের ট্রেন কখন? ভয়লা! সেই ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস! কিন্তু কেন? ৪.১০ আর ৪.৪৫-এ দুটো লোকাল থাকলেও সেদিন ডাউন লাইনে
কালিপাহাড়ি আর রানিগঞ্জের মধ্যে ট্রাফিক আর পাওয়ার ব্লকের জন্য বাতিল থাকবে। যদি
তুফান আগে এসে যায়, দাঁড়িয়ে থাকবে।
আমরা খুব তাড়াতাড়ি শিয়ালদা যাবার ৩টে লোকাল
ট্রেনের টিকিট কেটে নিলাম। স্নান তো ডকে উঠল, এখন কিছু খেতে হবে। জন আহারে বোর্ড
দেখলাম। আহ! চিকেন থালি মাত্র ৬৫ টাকা। আগে কুপন নিয়ে তারপর খাবার
পাওয়া যাবে, সেলফ সার্ভিস। কাউন্টারে আমাদের ঠিক আগে যারা ছিলেন তারাও চিকেন থালি
নিলেন, আমাদের টার্ন যখন এল মুরগি শেষ! সিদ্ধার্থ বলেই ফেলল, “এটাও টিলার অভিশাপ!”
শেষে ভেজ থালির ট্যালট্যালে ডাল আর লাউয়ের
সবজি খেয়ে মুরগি হয়ে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামলাম। ততক্ষণে মেমুর সব সিট ভর্তি হয়ে
গেছে। এদিক ওদিক করে একটা ভেস্টিবিউল আর দরজার মাঝে (মেল এক্সপ্রেস ট্রেনে ওই
জায়গায় টয়লেট থাকে) শতরঞ্জি পেতে বসলাম। আবার একচোট আলোচনা শুরু হল। আমরা অন্ডালে
নেমে হুল এক্সপ্রেস ধরব কি না? শেষে ওই প্ল্যানটাও কাজে লাগল না।
কারণ, আমাদের মনে টিলার অভিশাপ নিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে একটা ভয় কাজ করছে।
যদি হুল এক্সপ্রেসে ভিড় থাকে? অথবা লেট থাকে? অথবা বাতিল থাকে? তখন মাথায় আসেনি
মোবাইলে একবার ট্রেনের রানিং স্ট্যাটাসটা দেখে নিই! কিছু সমাপতন আর অন্ধবিশ্বাস
মনের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলে এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রচুর লোক অন্ডালে নেমে গেল।
কিন্তু আমরা সিট পেলাম না। কারণ, যত লোক নামল আবার তত লোকই প্রায় উঠল।
আমাদের দেখাদেখি কি না জানি না, নাকি তারা ওইভাবেই যাতায়াত করেন, কাগজ বা
প্লাস্টিক পেতে অনেকেই মেঝেতে বসে যাচ্ছেন। মাথার কাছে জানলা দিয়ে হালকা হাওয়া
আসছে। সিদ্ধার্থ আর প্রসূন পুরো সময়টা ঘুমিয়ে কাটাল।
আমি তিনটে ব্যাগ কোলের কাছে চেপে ধরে ঠায় জেগে রইলাম। খানার কাছে ডাউন হুল
এক্সপ্রস ওভারটেক করল যেটায় ঠাসাঠাসি ভিড়। ভাগ্য ভালো যে অন্ডালে নেমে যাইনি। বর্ধমানে ঢোকার আগে আমাদের লোকাল ট্রেনটা এতক্ষণ
দাঁড়িয়ে রইল যে আমিও একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে ওরা দু’জন উঠে পড়েছে। ৪ নম্বর
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়াবার পর ওরা আমাকে ডেকে ওঠাল। পাশেই
মেন লাইন হাওড়া লোকাল ছিল। কিন্তু
তাতে মেমুর মতো সিঁড়ি নেই। ফলে মেমু থেকে নেমে পাশের ট্রেনে উঠতে বেশ কষ্ট করতে হল। আমার
হাতে চোট লাগল, সিদ্ধার্থর চশমা খুলে গেল। কর্ড লাইনের লোকালের খোঁজ করতে জানা গেল
সেটা একটু আগে ছেড়ে গেছে, কারণ আমাদের ট্রেন লেট করেছে। তখনও মেন লাইনের লোকাল
ছাড়েনি, উঠে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম।
এরপর বাকি ট্রেন-জার্নিতে আর কিছু বলার মতো
ঘটনা ঘটেনি। শুধু দুটো ঘটনা না বললে এই ভ্রমণ অভিযান শেষ হয় না। সে
দুটোও কাকতালীয় কি না কী বলব! আমি আর প্রসূন বালি স্টেশনে নেমে এয়ারপোর্ট যাবার
জন্য বাস ধরেছিলাম। অন্যদিকে সিদ্ধার্থ হাওড়া হয়ে গড়িয়া যাওয়ার বাস ধরবে। আমরা
বালি থেকে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস হয়ে সোজা এয়ারপোর্ট যাওয়ার একাধিক বাস থাকতেও যে
বাসে উঠেছিলাম সেটা ডানলপ-চিড়িয়া মোড়-নাগেরবাজার হয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে যায়। অন্যদিকে
সিদ্ধার্থও হাওড়া থেকে গড়িয়া যাওয়ার এসি ৫-এর বদলে ভুল করে এসি ৫২-তে উঠে পড়েছিল
যেটা নাকি সম্পূর্ণ অন্যদিকে যায়! মাঝপথে বাস থেকে নেমে অনেক ঝক্কি সামলিয়ে বাড়ি
পৌঁছেছিল ও। প্রায় কাছাকাছি সময়ে তিনজনের কেন একইরকমের ভুল হবে অনেক ভেবেও মাথায়
আসেনি। সারাদিনের ক্লান্তি নাকি ভূতুড়ে টিলার অভিশাপ কে জানে!
ওই টিলাটা সত্যিই ভূতুড়ে আর অভিশপ্ত কি না
সেটা যাচাই করতে আর একবার ছোটা আম্বানা যেতেই হবে। তোমরা কেউ সঙ্গে যেতে চাও নাকি?
_____
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। খুব ভাল লাগল লেখা আর ততোধিক ভাল ছবিগুলো।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, দুটো ছবি আমার দুই বন্ধুর তোলা, বাকিগুলো আমার|
Deletebah darun
ReplyDeleteলেখা ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো, অনেক ধন্যবাদ|
DeleteDurdanto abhijan..Anek samayi erokom choto choto ghora gulo smaraniya hoye Jay..Darun laglo..Ami porer bar Tomar sange jabo
ReplyDeleteThank you Sudeep, অবশ্যই যাব
DeleteKhub sundar likhechis Saugata. Valo laglo pore.
ReplyDeleteThank you
Deleteযেমন ভালো লেখা, তেমন ভালো ছবি।
ReplyDeleteথ্যাঙ্ক ইউ কুন্তলাদি, আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো|
Deleteঘোড়া সাহেবের কুঠী মনে হচ্ছে যেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা।
ReplyDelete