শিবুস্যারের
বাঘ শিকার
বাবিন
“হুঃ!
একে কি বন্দুক চালানো বলে?”
শিবুস্যার গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে তক্তপোশে উঠে বসতে বসতে বলে উঠলেন।
“তার
মানে?” পিন্টু
একটু রাগত সুরে বলে ওঠে,
“আমি যে দশটায় দশটা বেলুন ফাটালাম, সেটা বুঝি কিছু নয়?”
ব্যাপারটা হল, সরস্বতীপুজো উপলক্ষ্যে রাজরাজেশ্বরীতলার মাঠে একটা ছোটোখাটো
মেলা বসেছে। সেখানে আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম টিপ পরীক্ষা করতে। এন্তার বেলুন
ফাটিয়ে এসে আলোচনা করছিলাম কার টিপ কীরকম। সেটা শুনেই শিবুস্যার মন্তব্যটা করলেন।
“ওই
যে বললুম,” স্যার
নির্বিকারভাবে বললেন,
“জ্যান্ত বাঘের —
ওই তোমাদের চিড়িয়াখানার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কি সার্কাসের ম্যাদামারা আফিম খাওয়া
বাঘ নয় হে, জঙ্গলের
মধ্যে খাঁটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সামনে কুড়ি ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে গুলি করা যে
কী জিনিস সে আর তোমরা কী বুঝবে?”
গল্পের আভাস পেয়ে আমরা সবাই নিজেদের আলোচনা থামিয়ে স্যারের দিকে
ঘনিয়ে এলাম। ডাকু বলল,
“আপনি শিকারও করেছেন বুঝি?”
“আরে
ছোঁড়া, আমি
যে কী কী করেছি সেসব বলতে শুরু করলে বুড়ো হয়ে গিয়ে অক্কা পেয়ে যাব, তবুও গল্প
শেষ হবে না,” স্যার
আমার দিকে চেয়ে বললেন,
“বাবিন, দ্যাখ
তো, চা-টা
হল কি না।”
বুঝলাম,
একপ্রস্থ চা না খেয়ে স্যার গল্প শুরু করবেন না। শিবুস্যার হলেন আমাদের কোন্নগর
হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই। আমাদের বলতে আমি, ডাকু, পিন্টু, রাজা আর
পিলু — কাউরই
আত্মীয় নন উনি। নগেনজেঠুর বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া থাকেন। বিয়ে থা করেননি। ইস্কুল আর
বাড়ি, এই
ওঁর জীবন। ফাঁকা সময়টুকু কাটান লাইব্রেরি থেকে আনা গল্পের বই পড়ে। হপ্তায় তিনদিন
সন্ধেয় আমাদের অঙ্ক কষান। ভুল করলেই পাওনা স্যারের বিখ্যাত একটি গাঁট্টা। শুধু
গাঁট্টা নয়, রামগাঁট্টা!
যে না খেয়েছে সে কী বুঝবে তার মর্ম!
শিবুস্যার চমৎকার গল্প বলতে পারেন। প্রতিটি গল্পই নাকি তাঁর
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। হেন জায়গা নেই যে উনি যাননি। হেন কাজ নেই উনি করেননি।
এখন সব ছেড়েছুড়ে এই কোন্নগরে এসে থিতু হয়েছেন। ফি রোববার বেলা দশটার দিকে আমরা
হানা দিই স্যারের বাড়ি। স্যার তাঁর চৌকির ওপর বাবু হয়ে বসে একটি জমজমাট গল্প বলেন
আর আমরা মেঝেতে শতরঞ্জির ওপর হাঁ করে বসে গিলতে থাকি। যদিও আজ রোববার নয়, তবুও ছুটির
দিন বলে আমরা গল্পের আশায় স্যারের বাড়ি গিয়েছি।
চা-টা শেষ করে স্যার বলতে শুরু করলেন, “তখন আমার
সবে একুশ কি বাইশ বছর বয়স। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ভাবছি এম.এ.-টা করব কি না, এমনি সময়
জামাইবাবুর মুখেই খবরটা শুনলুম। রাজচন্দ্রপুরের মহারাজা মুরারিমোহন রায় একজন
শিকারি খুঁজছেন। পাকা চাকরি। মাইনেও যথেষ্ট ভালো। আর বন্দুক-টন্দুক ওদের বিস্তর
আছে, তাই
সেসব নিয়েও চিন্তার দরকার নেই। খবরটা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।”
ডাকু ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বলে উঠল, “ইয়ে, বাঘ-টাঘ
মেরেছেন?”
শিবুস্যার ওঁর রুপোর পানের ডিবে থেকে এক খিলি পান মুখে ফেলে ভ্রূ
কুঁচকে ভারি বিরক্ত গলায় বললেন, “ইয়েস মাই বয়। সেই গল্পই বলতে চলেছি। তোদের সবুর হলে তো!”
আমি ভয় পেয়ে গেলাম, এই বুঝি শিবুস্যার রেগেমেগে কাহিনি
এখানেই বন্ধ করে দেন। তাই হাঁ হাঁ করে উঠলাম, “ডাকু তুই চুপ দে তো একটু। স্যার, আপনি আপনার
মতো করে বলতে থাকুন,
আমরা কেউ ডিস্টার্ব করব না।”
স্যার ডাকুর দিকে একটি কটাক্ষপাত করে আবার বলতে শুরু করলেন, “স্কুল
লাইফেই এন.সি.সি.-তে রাইফেল চালানো শিখেছিলুম। ফোর্ট উইলিয়াম শুটিং রেঞ্জে .২২ আর
.৩০৩ রাইফেলে প্র্যাকটিস করে বেশ কয়েকটা প্রাইজও ছিল পকেটে। তার ওপর আমার
জামাইবাবু ছিলেন সারান্ডা জঙ্গলের রেঞ্জার। ওখানে গিয়ে কত যে বুনো শুয়োর, বাইসন
মেরেছিলুম তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তখনকার নামকরা শিকারি শ্যামলাল মুন্ডার সাথে ওঁর
চ্যালা হয়ে ঘুরতুম। বাইশটি বাঘ শিকারের তকমা ওঁর ঝুলিতে। অবিশ্যি আমি যখন শিকারে
হাত পাকাচ্ছি, সরকার
বাহাদুর তখন বাঘ শিকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তখনও পর্যন্ত নিজের হাতে বাঘ না
মারলেও শ্যামলালের সঙ্গে থাকার ফলে বাঘের চরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা হয়ে
গিয়েছিল। যাই হোক, জায়গাটা
চমত্কার আর জঙ্গলের মধ্যে এমন রোমাঞ্চকর এক চাকরির সুযোগ সারাজীবনে যে আর পাওয়া
যাবে না সেটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার নেই। তাই কপাল ঠুকে নিজের সম্পর্কে
সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে দিলুম একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে। আশা ছিল না, তবুও কী
আশ্চর্য্যি, দিন
দশেক পরই রাজাসায়েবের চিঠি এল। পত্রপাঠ তল্পিতল্পা গুটিয়ে এস্টেটে হাজির হবার
অনুরোধ। কীভাবে পৌঁছাব সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন চিঠিতে। সঙ্গে লেখা ছিল যে, চিঠিতে
উল্লেখিত দিনে পৌঁছালে স্টেশন থেকে এস্টেটের গাড়িও মিলতে পারে।
“এককালে
রাজচন্দ্রপুরটা ছিল টেরাইয়ের কোলে নেপালের খুব কাছে পাহাড়ের নিচে আদিম জঙ্গলের
মধ্যে এক নেটিভ এস্টেট। মূলত নেপালি থারু, রাজবংশীদের বসবাস। যদিও তখন ইংরেজরা
চলে গেছে, রাজপাট
আর নেই, তবুও
সেখানে তখনও থানা-পুলিশ বলতে কিছুই ছিল না। রাজাসায়েবের কথাই ছিল শেষ কথা। সেসময়
ওঁদের ইজারা নিয়ে শাল,
সেগুন, মেহগনি
ইত্যাদি গাছ কেটে চালান করার ব্যবসা। বিপুল লাভ। জঙ্গলের মধ্যে থাকলেই সুবিধে বলে
সেই জঙ্গল কেটেই ওঁদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। জঙ্গল বলতে যে কী বোঝায়, যে না
গিয়েছে সে আন্দাজও করতে পারবে না। গগনভেদী আদিম সব বৃক্ষের দঙ্গল। সূর্যের আলোও
ঠিকঠাক ঢোকে না ভেতরে। শুধু মাঝেমাঝে সে অরণ্যের বুক চিরে বয়ে গেছে দু’একটা নাম না
জানা পাহাড়ি নদী। একলা ঢুকে পড়লে সে গাছের গোলকধাঁধা থেকে বেরুবার পথ খুঁজে পাওয়া
মুশকিল। সে গভীর অরণ্যে বাঘ, হাতি, হায়না, হরিণ, বুনো শুয়োর, সজারু, সাপ কিছুরই অভাব ছিল না। আজকাল আর
তেমনটি সহজে দেখা যায় না। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে আমাদের মতো শিকারি মানুষরাই
জন্তুজানোয়ারদের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। আমি যখন গিয়েছিলুম তখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ
আইন চালু হয়ে গেছিল। কিন্তু ওই যে বললুম, রাজাসায়েবের এলাকায় ওঁর আইনই চলত। কে
না জানে জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গলের নিয়মই চলে।
“যাক, পরদিনই চেপে
বসলুম ট্রেনে। বিহারের রক্সৌল জায়গাটা হল নেপাল বর্ডারে সিরসিয়া নদীর তীরে।
নেপালের বীরগঞ্জের ঠিক উল্টোদিকে। খুব ভোর ভোর এখানে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের
বাইরে আসতেই রাজাসায়েবের পাঠানো গাড়িটা পেয়ে গেলুম। অবিশ্যি গাড়ি যে শুধু আমাকেই
নিতে এসেছিল তা নয়। জানা গেল, সপ্তাহে দু’দিন করে এই জীপ রক্সৌল আসে এস্টেটের
কাঁচা-আনাজের বাজার নিয়ে যেতে। যাঁরা বাইরে থেকে আসেন তাঁরা জানেন ব্যাপারটা। গাড়ি
স্টেশনের বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখে ম্যানেজার প্রভাত গাড়ি বোঝাই করে নানান সবজি, মাছ-মাংস
তুলে নেয় এখান থেকে। অতিথিদের নিয়ে গাড়ি আবার রওনা দেয়। আমিও সেই গাড়িতে চেপে
বসলুম।
“কিছুক্ষণের
মধ্যেই বুঝতে পারলুম,
এই গাড়িটা না পেলে আমার পক্ষে সত্যিই মুশকিল হত রাজচন্দ্রপুর যাওয়া। কারণ, যে রাস্তা
ধরে আমরা যাচ্ছিলুম কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা জনবিরল হয়ে গেল। রাস্তার দু’দিকে শুধুই
উঁচু উঁচু গাছের সারি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল সবুজ পাইনে ঢাকা
পর্বতশৃঙ্গ। আমাদের যাত্রাপথে মাঝেমাঝে আসছিল ছোটোখাটো পাহাড়ি নদী। কোথাও তার ওপর
দিয়ে সেতু আছে, কোথাও
আবার খুবই অল্প জল। আমাদের জীপ সে জলের ওপর দিয়েই নদী পেরিয়ে চলে গেল। মাঝে এক
জায়গায় স্নানরত সপরিবার ঐরাবতও নজরে পড়ল। হ্যাঁ, হাতি না বলে আমি ঐরাবতই বলব। কারণ, ওরকম বিশাল
সাইজের দাঁতাল হাতি বইয়ের ছবিতে ছাড়া আর কোথাও কক্ষনও দেখিনি আমি!
“ড্রাইভার
দেখলুম নির্বিকারভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে। প্রভাতবাবুও হাতের ফর্দ নিয়ে কীসব হিসেব
কষছেন। বুঝলুম, এসব
দেখে দেখে ওদের গা সওয়া হয়ে গেছে। যাই হোক, পৌনে ঘন্টাটাক যাবার পর জঙ্গলে ঘেরা
এক প্রাসাদে এসে আমাদের যাত্রা শেষ হল। রাজবাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। কারণ, প্রায় বিশ
ফিট উঁচু পাঁচিলে ঘেরা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বিঘা জমির ওপর সেই বিশাল বাড়িটিকে
প্রাসাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ঢোকার মুখে গেটের, ইয়ে, গেট না বলে
সিংহদরজা বললেই বেশি মানানসই হয়, তা সেই দরজার সুমুখে একজন বন্দুকধারী সান্ত্রীকে দেখে
বুঝলুম এ যে শুধু নামেই রাজা তা তো নয়। রাজপাট চলে গেলেও রাজপরিবারের আদবকায়দা
এখনও বজায় রেখেছেন। তবে পরে বুঝেছিলুম বন্দুকধারী সান্ত্রী শুধুই ঠাটবাটের জন্যই
নয়, জংলি-জানোয়ার
থেকে নিরাপত্তার জন্যও বটে।
“আর্দালি
এসে আমার বেডিং-ব্যাগ কেড়ে নিয়ে আমাকে বৈঠকখানায় বসাল। মেঝেতে পা রাখতেই নরম
কার্পেটে ডুবে যেতে লাগলুম। হাঁ করে ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য দেখতে দেখতে অতি
সংকুচিতভাবে দুধসাদা সোফার নরম গদিতে বসলুম। মাথার ওপর যে ঝাড়বাতিটা ঝুলছে সেটা
নির্ঘাৎ বেলজিয়াম থেকে আমদানি করা। রাজবংশের এক-সে-এক কীর্তি দেয়ালে টাঙানো। স্টাফ
করা মাথাসুদ্ধু রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া, হরিণের শিংসুদ্ধু মাথা, গন্ডারের
শিং, বিপুল
সাইজের তৈলচিত্র, শিকারের
ফটোগ্রাফ ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে শিকারের পোশাক পরিহিত এক
ব্যক্তি তিন-তিনটে মৃত প্রমাণ সাইজের বাঘের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে
ভাবছিলুম, এমন
বিক্রমশালী শিকারি বংশ হওয়া সত্ত্বেও বাঘ মারার জন্য আমার মতো চুনোপুঁটির দরকার
পড়ল কেন?
“একটু
পরেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বাড়ির পেছনদিকের বাগানে। এদিকটায় পাঁচিলের বদলে লোহার
মজবুত রেলিং দেওয়া, যাতে
প্রাতরাশ করার সময় রাজাসায়েবের অরণ্যদর্শনে ব্যাঘাত না ঘটে। বিশাল বড়ো সেই
চত্বরটার একদিকে শুটিং প্র্যাকটিস করার জন্য চাঁদমারি রয়েছে দেখলুম।”
“ইয়ে, স্যার,” পিন্টু
আমাদের সকলের মনের প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে উঠল, “চাঁদমারি মানে?”
“চাঁদমারি
জানিস না আর বন্দুক ছুঁড়তে গেছিলিস?” শিবুস্যার সামান্য বিরক্ত সুরে বললেন, “চাঁদমারি হল
ওই যাকে তোরা বলিস টার্গেট। মেলায় গিয়ে একটা গোল বোর্ডে লাগানো বেলুন ফাটাস যে
সেটাও একরকম চাঁদমারি বলা যেতে পারে। সাধারণত একটা চৌকো বোর্ডে সাদা-কালো মিলিয়ে
মিশিয়ে গোলগোল অনেকগুলো বৃত্তাকার রেখা টানা থাকে। টার্গেট প্র্যাকটিস করার সময়
লক্ষ্য থাকবে বৃত্তের কেন্দ্রে গুলি করা। কেন্দ্রের যে যত কাছাকাছি গুলি করতে
পারবে সে তত ভালো বন্দুকবাজ। বুঝলি?”
“হ্যাঁ,” আমরা সকলেই
প্রায় একসঙ্গে নানানরকম সুরে বলে উঠলাম।
শিবুস্যার আবার গল্পে ফিরে গেলেন, “একটা টেবিলে বেশ কয়েকটি ভয়ালদর্শন
রাইফেল রাখা। একটি লোক উবু হয়ে বসে সেগুলো সাফসুতরো করছে। তা দিয়ে নির্ঘাৎ পাখি
শিকার করা হয় না। তার মধ্যে কয়েকটিকে চিনতে পারলুম। ৪.৫ সিঙ্গল ব্যারেল আন্ডার
লিভার উইনচেষ্টার রাইফেল,
ম্যানলিকার শুনার রাইফেল, আঠাশ ইঞ্চি ব্যারেলের ম্যানটন কোম্পানির দোনলা বন্দুক, রিপিটার
ইত্যাদি খাসা সব শিকারের অস্ত্রশস্ত্র! জামাইবাবুর কাছে একটা বিদেশি পত্রিকায়
দেখেছিলুম নানানরকম বন্দুকের ছবি। এই প্রথম সাক্ষাৎ দর্শন। চক্ষু যেন সার্থক হয়ে গেল।
এসবের মধ্যে একটা পাখিমারা ছররা এয়ারগানও ছিল। ছোট্ট পিস্তলের মতো ওয়েপনটা দেখে
ভারি ভালো লাগল। ব্যারেলের ব্যাস দেখেই আন্দাজ করলুম এটা এয়ারগান না হয়ে যায় না।
সচরাচর যেসব এয়ারগান পাওয়া যায় সেগুলো বেশ লম্বা হয়, রাইফেলের মতোই। এমন জিনিস আগে কখনও
দেখিনি। মস্ত এক ছাতার তলায় বেতের সোফায় বসে যে টকটকে ফর্সা, হাতির
দাঁতের লাঠি হাতে অশীতিপর বৃদ্ধ, বুঝলুম তিনিই রাজাসায়েব। ভদ্রলোক যে এককালে রীতিমতো সুপুরুষ
ছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু পরে মুখ খুলতেই ওঁর গলার বজ্রগম্ভীর স্বর
শুনে সেটার আরও একবার প্রমাণ পেলুম। আমি করজোড়ে নমস্কার করতে উনি আশীর্বাদের
ভঙ্গিতে ডানহাতটা সামান্য তুলে ভ্রূ কুঁচকে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বাঙালি
তো?’
“সেসময়
আমার খেলোয়াড়সুলভ পেটানো লম্বা চেহারা, ফর্সা রং, আর খাড়া নাক
দেখে অনেকেই পাঞ্জাবি বলে ভুল করত। তার ওপর জিম করবেটকে আমি গুরু মানতুম; তাঁর মতো
একটা মোটাসোটা গোঁফও রেখেছিলুম। বিনীত কন্ঠে বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি বাঙালিই।’
‘মনে
হচ্ছে আপনাকে দিয়ে হবে,’
রাজাসায়েব সন্তুষ্ট কন্ঠে বললেন, ‘আপনি প্রথমে নিজের ঘরটি দেখে নিন।
লম্বা ট্রেনযাত্রা করে এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে এইখানেই চলে আসুন। কথা হবে।’
“আমি
একটু উত্কন্ঠিত হয়ে উঠলুম। কী এমন কাজ, যা আমাকে দিয়ে হবে কি না তা নিয়ে উনি
ধন্দে ছিলেন?
“যাই
হোক, আমি
আর্দালির সঙ্গে বাড়ির ভেতরদিকে একটি ঘরে পৌঁছলুম। চমত্কার ঘরটি। সেগুনকাঠের খাট।
তাতে নরম বিছানা পাতা। ছত্রীর সঙ্গে মশারি টাঙিয়ে গুটিয়ে রাখা। বোঝা গেল, এখানে মশার
উত্পাত আছে। পড়া-লেখার জন্য একটি টেবিল। অ্যাটাচ বাথ। আমার বেডিং আর ব্যাগ
ইতিমধ্যেই এ রুমের মধ্যে চলে এসেছে। আর্দালি হরি সিং জানিয়ে গেল, স্নান করার
জন্য গরমজল হুকুম করলেই পাওয়া যাবে।
“উষ্ণ
জলে স্নান করে ট্রেনযাত্রার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে বাগানে রাজাসায়েবের সামনে
হাজির হলুম। বেতের সুদৃশ্য টেবিলের ওপর টি-পটে লিকার রয়েছে। গরম দুধ রয়েছে আর একটি
পটে। এছাড়া বিভিন্ন পাত্রে কফি, কোকো, কর্নফ্লেক্স রাখা। সঙ্গে রুটি, মাখন, স্যান্ডুইচ, ডিমসেদ্ধ, কলা, লেবু, পীচ, আঙুর
ইত্যাদি নানান খাদ্যসামগ্রী সাজানো। একজন বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করে করে প্লেট সাজিয়ে
দিল।
“আমার
ভারি সংকোচ হতে লাগল। যতই হোক, চাকরিটা যদি হয়ে যায় তাহলে আমি তো ওঁর বেতনভুক কর্মচারী
ছাড়া আর কিছুই নই। অথচ খাতির দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন রাজ-অতিথি!
“খেতে
খেতেই রাজাসায়েবের সঙ্গে কথা হতে লাগল।
‘আপনার
কাজটা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের বংশের ইতিহাসটা ছোটো করে বলে দিলে সুবিধে হবে।
আমার বাবা নিকুঞ্জমোহন ছিলেন একাধারে মস্ত গুণী শিল্পী — গাইয়ে, আবার
অন্যদিকে অসমসাহসী শিকারি। সচরাচর এমন কম্বিনেশন দেখা যায় না। আপনি তো অনেক
শিকার-টিকার করেছেন চিঠিতে পড়লুম।’
‘আমাকে
আপনি না বলে তুমি বললে খুশি হব,’ আমি কুন্ঠিতভাবে বললুম, ‘হ্যাঁ, সারান্ডার জঙ্গল চষে বেড়িয়েছি, ছত্রিশটা
বুনো শুয়োর, বাইশটা
বাইসন, চুয়াল্লিশটা
শজারু...”
‘ব্যস
ব্যস, ওতেই
হবে,’ রাজাসায়েব
চায়ে মৃদু চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আসলে ফরেস্ট থেকে ওদের নিজস্ব একজন পাকা বাঘ শিকারিকে ডাকা
হয়েছে। তিনি নৈনিতাল থেকে দিন কয়েকের মধ্যেই এসে পড়বেন। কিন্তু আমার ভয় বড়োকুমারকে
নিয়ে। একটু খুলে বলি। আমার একটিই সন্তান ছিল — সৌমিত্রমোহন। বাঘ শিকারে গিয়ে তার
মৃত্যু হয় মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তার দুই পুত্রসন্তান — কৃষ্ণমোহন
আর রাধামোহন। বড়োকুমারকে নিয়েই আমার ভয়। বড়োই দুর্দান্ত সে। সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার
প্রিয়। আর ছোটোটি এক্কেবারে উল্টো। শান্ত, নির্বিরোধী। গানবাজনা, লেখালিখি
এসব নিয়ে আছে। কলকাতার পত্রিকায় কিছু লেখাও বেরিয়েছে। দু’জনেরই এখনও
বিয়ে হয়নি। সামনের আশ্বিনে গৃহদেবতার বার্ষিক অনুষ্ঠান হবে। সে সময়ই আমাদের বংশের
রীতি অনুযায়ী বড়োকুমারের রাজ্যাভিষেক হবে। তারপরই দু’জনকে
একসঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দেব। ব্যস, আমার দায়িত্ব শেষ।’
“অনেকক্ষণ
ধরেই হালকা একটা রেওয়াজের শব্দ ভেসে আসছিল কানে। এবার বুঝলুম সেটা ছোটোকুমারের।
“ঠিক
এ সময়ই হন্তদন্ত হয়ে ধবধবে সাদা সিল্কের কুর্তা-পাজামা পরা বছর ত্রিশের এক সুপুরুষ
যুবা আমাদের কাছে এসে হাজির হলেন। টানটান মেদহীন শরীর। টকটকে ফর্সা রং। গালে লাল
আভা। সবকিছুকে তুচ্ছ করে দেবার প্রবণতা তাঁর উঁচু নাক আর বাঁকানো ভ্রূতে পরিষ্কার।
রাজপরিবারের রক্ত যে তাঁর শিরায় শিরায় বইছে সেটা কারও বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
আমাকে একঝলক দেখে নিয়ে আমার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই রাজাসায়েবকে বললেন, ‘প্রভাতকে
তুমি কী বলেছ? সে
আমাকে টাকা দিতে চাইছে না। এখুনি আমার কিছু টাকার প্রয়োজন, তোমার
ম্যানেজারকে বলে দাও।’
“ভদ্রলোক
মুখ খুলতেই তীব্র হুইস্কির গন্ধে টের পেলুম, সক্কাল সক্কাল উনি নেশা করে এসেছেন।
রাজাসায়েব ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ তোমার বড়োই বেয়াদপি! গত সপ্তাহে
তোমাকে পুরো মাসের হাতখরচ দেওয়া হয়েছিল। আজ আবার হাত পাততে তোমার লজ্জা করল না?’
‘সে
হিসেব সময়ে দিয়ে দেব দাদু,
বাইরের লোকের সামনে...”
চোখমুখ লাল করে চাপা সুরে কথাটি বলে যুবক গটগট করে ফিরে যেতে যেতে দাঁতে দাঁত
চেপে বলে গেলেন, ‘দুপুরের
মধ্যে আমার টাকা চাই।’
“রাজাসায়েব
একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় বললেন, ‘এই হল কৃষ্ণমোহন। এই একটি নাতিকে নিয়ে হয়েছে আমার যত
জ্বালা!’ রাজাসায়েব
হাতের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্দালিকে হুকুম করলেন
প্রভাতবাবুকে ডেকে পাঠাবার জন্য। তারপর আবার আমার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, ‘তা যা
বলছিলুম, রামানুজ
বলে একটি ছেলে দীর্ঘদিন আমাদের শিকারি হিসেবে কাজ করছিল। বোঝই তো, জঙ্গলের
মধ্যে বাস করি, জন্তুজানোয়ারের
উপদ্রব ভালোরকমই। আমার বয়স হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্দুকে হাত রাখিনি। তার ওপর
বড়োকুমারের যখন তখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাওয়া আমায় চিন্তায় ফেলে দেয়। তাই সাবধান
থাকার জন্য ওকে রাখা। বড়োকুমারের সঙ্গে থাকত তার ওপর নজর রাখার জন্য। হঠাৎ কোনও
বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। বেশ ভালোই ছিল, কিন্তু আচমকা সে কাউকে কিছু না বলে
কয়ে গায়েব হয়ে গেছে। এদিকে দিনকয়েক হল একটা মানুষখেকো বাঘের খবর শোনা যাচ্ছে।
জঙ্গলের আশেপাশের গ্রাম থেকে গরু-মোষ দিয়ে শুরু করেছিল, এখন একেবারে
মানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আর জানোই তো, বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে
আর অন্যকিছু খেতে চায় না। তাই আমার নতুন একজন শিকারির দরকার হয়ে পড়ল। কাজটা এমন
কিছু কঠিন নয়, শুধু
বড়োকুমারকে চোখে চোখে রাখা। ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকা। সে জঙ্গলে ঢুকতে চাইলে আটকাতে তো
পারবে না, শুধু
তার নিরাপত্তার দিকে নজর রাখা...’
“আমি
আশ্বস্ত হয়ে বলে উঠলুম,
‘এ আর এমন কী। আমি স্বচ্ছন্দে পারব।’
“এমনি
সময় প্রভাতবাবু হাজির হলেন। রাজাসায়েব তাঁকে নির্দেশ দিলেন বড়োকুমারকে কিছু টাকা
দেবার জন্য। তিনি চলে যাবার পর আমার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ধীরে ধীরে গম্ভীর
গলায় বললেন রাজাসায়েব,
‘আমার কথাটা পুরো শেষ হয়নি।’
“ওঁর
গলার মধ্যে এমন একটা সুর ছিল যে আমি থমকে গেলুম। মনে পড়ল, জঙ্গলের
নিয়ম কান পেতে শোনা,
কিছু বলা নয়। রাজা মুরারিমোহন রায় লাঠিতে ভর করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
তারপর লোহার রেলিংয়ের ওপারের আদিম অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন, ‘আমাদের
বংশের একটা অভিশাপ আছে। আমার দাদু একবার এক নাগকে সপরিবারে হত্যা করেছিলেন
বন্দুকের গুলিতে — অকারণে, শুধুই
বন্ধুদের সঙ্গে নিছক আনন্দ করতে করতে। যদিও ওই নাগ আমার দাদু বা তাঁর বন্ধুদের
কোনও ক্ষতিই করেনি। একমাসের মধ্যে দাদুর মতো পাকা শিকারি সামান্য বাইসনের গুঁতো
খেয়ে মারা যান। তারপর থেকে আমাদের বংশের প্রত্যেক প্রথম সন্তান জঙ্গলের কোনও না
কোনও জন্তুর হাতে মারা গিয়েছে। আমার বাবা মারা গেছেন পাগলা হাতির মুখোমুখি পড়ে।
অন্ধকারে ফিরছিলেন পাখি শিকার করে। হাতিটা চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল পথের পাশে ঝোপের
আড়ালে। শুঁড়ে করে তুলে আছড়ে মেরে ফেলে। আমার বড়ো নাতি কৃষ্ণমোহন, একটু আগে
দেখলেন, ওকে
নিয়েও আমার বড্ড ভয়। একটু উচ্ছৃঙ্খল। পয়সা নিয়ে ওড়াতে শিখে গেছে। কিছু উল্টোপাল্টা
বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নেশাভাঙ করে। তবে আমার কড়া নির্দেশ আছে সে যেন জঙ্গলে একা একা না
যায়। নেশার ঘোরে ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে..... তবে আমার কর্মচারীরা সঙ্গে
থাকে। কিন্তু সে বড়োই দামাল। ওদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না। তাই আমি চাই তুমি ওর
সঙ্গে সঙ্গে থাকো আমার খাস লোক হিসেবে। বিপদ বুঝলে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরবে — না না, আমার নাতির
ওপর নয়, জন্তুজানোয়ারদের
ওপর। আর আমার একটা অফার আছে। আমার কাছে খবর আছে যে বড়োকুমার চায় ফরেস্টের শিকারি
আসার আগেই ওই মানুষখেকোটাকে নিজে হাতে গুলি করে মারতে। মানছি ওর বন্দুকের হাত ভালো, কিন্তু কেন
জানি আমার ভয় হচ্ছে,
আবার কোনও বিপদ না ডেকে আনে এই বংশে। তাই বড়োকুমার কিছু করার আগেই তুমি যদি ওই
বাঘটাকে মারতে পার তবে দশ হাজার টাকার চেক আমি নিজে হাতে তোমাকে তুলে দেব। আর সেটা
করতে হবে আজকালের মধ্যেই।’
“আগেই
বলেছি যে গভর্নমেন্ট তখন বাঘ মারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তবে মানুষখেকোর
ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম হতে বাধা নেই। জঙ্গলে যেতে গেলে বন্দুক চালাবার বিদ্যের
চেয়ে যেটা বেশি দরকার হয় সেটা হল সাহস। সেটার কোনও অভাব আমার ছিল না। তবে আমার
বন্দুকটা রাজাসায়েবের ওসব বিদেশি বন্দুকের কাছে যাকে বলে নস্যি। তাই সেদিকে
চেয়েছিলুম। রাজাসায়েব বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। উনি বললেন, ‘তোমার এই
কসরত করা চেহারাটা দেখে আমার মনে হয়েছে তুমি পারবে। ইচ্ছে হলে আমার কালেকশন থেকে
নিজের পছন্দমতো বন্দুক নিয়ে যেতে পার। কী, ঠিক আছে তো?’
“রাজাসায়েব
বেয়ারাকে দিয়ে একটা চেকবই আনিয়ে তাতে আমার নাম আর দশ হাজার কথাটা লিখে বললেন, ‘এটা
আগেভাগেই লিখে আমার কাছেই রাখলুম। আমার বিশ্বাস শিগগিরই চেকটা তোমার হয়ে যাবে।’
“ব্যস, এর ওপর কি
আর কথা চলে! অনেকক্ষণ ধরেই আমার মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছিল। কিন্তু সংকোচবশত সেটা
আর তখন জিজ্ঞেস করা হল না।
“রাজাসায়েবের
কালেকশন থেকে একটা রাইফেল হাতে তুলে একবার পরখ করে দেখে নিলুম। এ রাইফেল তোদের
দেখা পুলিশের ব্যবহার করা আদ্যিকালের রাইফেল নয়। এ হল বাঘ মারা .৪২৩ ক্যালিবারের
ম্যাগাজিন রাইফেল। একটা ম্যাগাজিনে পাঁচটি করে গুলি থাকত। যেমন ভারী সে রাইফেল
তেমনি তার রাজকীয় চেহারা। আমি হাত পাকিয়েছিলুম থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলে। সারান্ডায়
শিকারে গিয়ে যেসব বন্দুক ব্যবহার করেছিলুম সেগুলোও এমন হেভি নয়। শ্যামলালের
বাঘমারা বন্দুকেও হাত রেখেছি। রাইফেল শুটিং কম্পিটিশনে যে বেশ কয়েকটা প্রাইজ
পেয়েছিলুম সেটা তো আগেই বলেছি, কিন্তু এমন ভারী বন্দুক হাতে নিয়ে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়ে গেলুম। রাজাসায়েবের অনুমতি নিয়ে চাঁদমারিতে তাক করে প্রথম গুলিটা চালাতেই
রি-কয়েলের ধাক্কায় প্রায় কুপোকাত হবার জোগাড়!”
“রি-কয়েল?” পিন্টু বলে
উঠল, “সে
আবার কী?”
“বন্দুক-পিস্তল
থেকে গুলি চালালে নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী সেটাও পেছনদিকে একটা মারাত্মক ধাক্কা
দেয়। সেটাকেই বলে রি-কয়েল,”
শিবুস্যার বললেন,
“সেই জন্যই বন্দুক ছোঁড়ার সময় সাবধানে দাঁড়াতে হয়। বাঁ পা-টা সামনে বাড়িয়ে, ডান পা-টাকে
পেছনে রেখে টার্গেটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে হয়, যাতে
ধাক্কাটা এলে সামলে নেওয়া যায়।
“যাক, কিছুক্ষণ
প্র্যাকটিস করার পর রাইফেলটার সঙ্গে বেশ সড়গড় হয়ে গেলুম। রাজাসায়েব ম্যানেজারকে
ডেকে হুকুম করে দিলেন আমাকে যেন সবরকম সহযোগিতা করা হয়।
“বেলা
এগারোটা নাগাদ খবর এল বাঘমশাই খানিক দূরে জঙ্গলের ধারে গুরকি নামের একটি গ্রামের
কাছাকাছি রয়েছেন। এক গ্রামবাসীর গোয়াল থেকে একটা বাছুর তুলে নিয়ে গেছে। তত্ক্ষনাৎ
জীপে করে রওনা দিলুম। জায়গাটা গ্রামের কাছাকাছি হলেও গভীর জঙ্গল। উঁচু গাছের সঙ্গে
সঙ্গে জংলিগাছের ঝোপঝাড়ও প্রচুর। একটা পাহাড়ি ঝর্নার নালা রয়েছে কাছেই। পায়ের ছাপ
দেখে বুঝতে পারলুম বাঘটা ওইদিকেই চলে গেছে। বাছুরটাকে পুরো খায়নি। পেটের কাছটা
খানিকটা খেয়ে রেখে গেছে। মাটি নরম হবার জন্য বেশ গভীরভাবে পায়ের ছাপ গেঁথে বসে আছে
মাটিতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেই সামনের ডানদিকের থাবায় একটা গর্তের চিহ্ন নজরে
পড়ল। বাঁশ জাতীয় জিনিসের ওপর বেকায়দায় পা পড়ে গেলে এমনটি হতে পারে। তার মানে আঘাত
লাগার জন্যই বাঘটা দৌড়ঝাঁপ করে শিকার করতে পারে না। সেইজন্যই সে সহজ শিকারের দিকে
নজর দিয়েছে — মানুষ।
আর একবার বাঘ যদি মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে যায়, তখন আর অন্য কিছু তার মুখে রোচে না।
তবে রোজই তো আর মানুষ জোটে না। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই বাছুরটা তুলে নিয়ে গেছে।
শ্যামলালের মুখেই শুনেছিলুম, বাঘ কিন্তু মানুষকে সচরাচর এড়িয়েই চলে। শুধুমাত্র এরকম আহত
হয়ে কিংবা বয়স হয়ে শিকার করার শক্তি হারিয়ে ফেললেই তার মানুষখেকো হবার সম্ভাবনা
বৃদ্ধি পায়।
“আন্দাজ
করলুম, অন্ধকার
নামলেই বাঘটা আবার ফিরে আসবে আধখাওয়া বাছুরটা খাবার জন্য। ঠিক করলুম, সন্ধের
মুখে-মুখেই মড়ির কাছাকাছি একটা গাছের ওপর ওৎ পেতে বসব।”
“মড়ি
মানে?” ডাকু
জিজ্ঞেস করে উঠল।
“মড়ি
হল বাঘের ফেলে যাওয়া আধখাওয়া জন্তুজানোয়ারের দেহটা,” স্যার একটু এলিয়ে বসে বললেন, “উফ্, অনেক বকেছি, আর পারছি
না। বাবিন, দেখ
তো আর একটু চা হয় কি না।”
আবার শিবুস্যারের জন্য আদা দেওয়া চা এল আর আমাদের জন্য নাড়ু।
কিন্তু গল্পের এমন একটা জায়গায় স্যার থেমে গেছেন যে আমাদের মন খাওয়ার দিকে ছিল না।
অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন স্যারের চা শেষ হয়। আমাদের জুলজুল দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে
শিবুস্যার রয়ে সয়ে তারিয়ে তারিয়ে সেটা খেয়ে ফের শুরু করলেন।
“রাজকীয়
ভোজের পর দুপুরে ভালো করে ঘুমিয়ে নিলুম। এক তো ট্রেনযাত্রার ধকল ছিলই, তার সঙ্গে
রাত জাগবার জন্য শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিলুম। শুভস্য শীঘ্রম।
“বিকেলে
রাজাসায়েব আমার সঙ্গে ছোটোকুমারের আলাপ করিয়ে দিলেন। রাধামোহন রায়কে একঝলক দেখে
প্রথমে থমকে গেসলুম! অবিকল যেন কৃষ্ণমোহনই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন তানপুরার
সামনে। বুঝলুম, এরা
যমজ। রাজাসায়েব বললেন,
ইনি নাকি মিনিট পাঁচেকের ছোটো। ভদ্রলোকের গানের গলা সত্যিই ভালো। বেশ মিশুকেও
বটে। আমি ওঁদের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে যত্ন করে কথা বললেন। কলকাতার
গাইয়েদের সম্পর্কে কিছু আলাপ আলোচনা হল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর দু’জনের একটা
তফাত বুঝতে পারলুম, ছোটোর
ভ্রূর ওপরে একটা বেশ পুরনো কাটা দাগ আছে যেটা বড়োর দেখিনি। তবে আমার ভুল কি না
বলতে পারব না, রাজাসায়েব
একবার বড়োকুমারের ব্যাপারে নিজের দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করতে ছোটোকুমারের ঠোঁটের
কোণে কেমন যেন একপেশে একটা ক্রূর হাসি খেলে গেল।
“গ্রামবাসীদের বলে এসেছিলুম মড়িটার
সামনের জামরুল গাছটার ওপর একটা মাচা বানিয়ে রাখতে। সন্ধের মুখে এসে বসব। সেইমতো
বিকেল পাঁচটা নাগাদ জীপে চড়ে বেরিয়ে পড়লুম। ড্রাইভারকে বলে দিলুম আমাকে জায়গাটার
কাছাকাছি ছেড়ে দিয়ে ও যেন ফিরে যায়; সকালে আবার আসবে আমাকে নিতে। কারণ, বাঘের একবার
যদি সন্দেহ হয়ে যায় যে এখানে কোনও মানুষজন আছে তাহলে সে কোনওমতেই আর ফিরে আসবে না
মড়ি খেতে।
“কেন
জনসনের .৪২৩ ক্যালিবারের ম্যাগাজিন রাইফেলটা নিয়েছি। দরকারে এটি পাঁচ-পাঁচটি গুলি
চালাতে পারে পরপর। এছাড়া রাতের জন্য কিছু শুকনো খাবার আর জলের বোতল। রয়েছে টর্চ আর
মশা তাড়াবার মলম। দিনটা আবার অমাবস্যার কাছাকাছি ছিল। তিথিটা মনে নেই। তখনও হালকা
আলো থাকলেও অন্ধকার যে ঘনিয়ে আসবে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলুম। সাবধানে মাচায়
উঠতে যাব এমনি সময় আবার একটা গাড়ির শব্দ পেয়ে থমকে গেলুম। এখন আবার কে এল? ফরেস্টের
শিকারি কি আজই এসে গেল?
“একটু
পরেই শুকনো পাতার ওপর দিয়ে খচমচ করতে করতে যিনি এলেন তাঁকে দেখেই আমার চোখ কপালে
উঠে গেল। বড়োকুমার! তাঁর হাতে একটি আমেরিকান রেমিংটন এক্সপ্রেস রিপিটার। ব্যারেলের
ওপরে আবার একটি টর্চ লাগানো, অন্ধকারে টার্গেটকে দেখার জন্য। এই রাইফেলটির বিশেষত্ব হল, লিভার
টানলেই ফুরোনো কার্টিজ আপনা আপনি বেরিয়ে গিয়ে নতুন কার্টিজ ঢুকে যেত। এটা দিয়ে
আরামসে হাতি-গন্ডার অবধি শিকার করা চলে। আমার দিকে চেয়ে অট্টহাস্য করে বললেন, ‘কী ভেবেছিলে
শিবু? আমাকে
লুকিয়ে নিজে একা এসে বাঘটাকে শিকার করে এলেম দেখাবে? ওটি তো হচ্ছে না! এই এলাকায় জঙ্গলের
মধ্যে শিকার করার এক্তিয়ার শুধু আমাদের। হরিণ, শুয়োর মারো কোই বাত নহি, কিন্তু
বাইরের কেউ এসে এখানে বাঘ মারবে এটা তো আমি বরদাস্ত করব না!’
“কুমারের
টলমল হাঁটা দেখে বুঝতে পারলুম নেশা জবরদস্ত হয়েছে। বিনীত ভঙ্গিতে বললুম, ‘রাজাসায়েবের
হুকুম আছে আপনাকে চোখে চোখে রাখতে।’
“খুব
বিশ্রীভাবে চিত্কার করে উঠে বড়োকুমার বললেন, ‘তুমি এসেছ ঠিক আছে, কিন্তু
বাঘটা মরবে আমার গুলিতেই। বুঝলে?’
“আমি
আর কিছু না বলে মাচা থেকে ঝুলন্ত দড়ির মইটা কুমারকে দেখিয়ে ওপরে উঠে যেতে অনুরোধ
করলুম। কুমার বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে উঠলেন, ‘ওসব মাচায়-ফাচায় বসে শিকার করবে
তোমাদের মতো ডরপোক লোকেরা। আমি এই ঝোপের মধ্যেই বসব। একেবারে ফেস-টু -ফেস গুলি
চালাব। দেখি কে আসলি শের!’
এই বলে মড়িটার থেকে পঁচিশ-তিরিশ ফুট দূরের একটা জংলি ঝোপের মধ্যে থেবড়ে বসে
পড়লেন বড়োকুমার।
“আমি
প্রমাদ গুনলুম! মানুষ মেরে মেরে বাঘটা মারাত্মক সাহসী হয়ে উঠেছে। আমাদের নাগালের
মধ্যে পেলে যে কী হতে পারে সেটা আন্দাজ করে আমার চিন্তা বেড়ে গেল। একবার ভাবলুম
কুমারকে ছেড়ে মাচায় উঠে যাই, আমার তো একটাই প্রাণ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল এই নেশায়
বিভোর মানুষটাকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। যতই হোক আজই ওঁর দাদুর নুন খেয়েছি
যে! তাই ওঁর পাশেই আমার ব্যাগ-বন্দুক রেখে বসে পড়লুম।
“জঙ্গলে
অন্ধকার নেমে এসেছে। সে যে কী অন্ধকার তোরা আন্দাজও করতে পারবি না। তার সঙ্গে
মিশেছে হালকা কুয়াশা। তবে কিছুক্ষণ পর অন্ধকারটা সয়ে গেল আর আকাশে তারার আলোতেও কিছুটা
সুবিধা হচ্ছিল। আমাদের স্থির নজর ছিল মড়িটার দিকে। মাঝে মাঝেই ছোটোখাটো জানোয়ার
যেমন শজারু, শম্বর,
হরিণ, শেয়ালগোছের
কয়েকটা প্রাণী আশপাশ দিয়ে যাতায়াত করছিল। সময়টা শীতকাল বলে সাপের ভয় নেই। তবে
চিন্তা হচ্ছিল হাতির কথা ভেবে। একটা হায়নাগোছের জন্তু এসে বাছুরটার গায়ে কামড়
বসাতে গেল একবার। পায়ের কাছ থেকে একটা ঢিল তুলে ছুঁড়ে মারতেই সেটা পালিয়ে গেল।
“কুমার
একটা বেঁটে ছোটো বোতল থেকে মদ্যপান করতে করতে নিচু স্বরে বকবক করে চললেন। কোথায়
কোথায় কবে কী কী শিকার করেছেন তার ইতিবৃত্ত আওড়াতে লাগলেন। আমার ভয় হতে লাগল বাঘটা
যদি এদিকে এসে পড়ে তাহলে কুমারের আওয়াজ শুনে পালিয়ে না যায়। ওঁকে একবার সাবধান করে
দিলুম, কিন্তু
উনি সেটা গ্রাহ্যই করলেন না। হঠাৎ রামানুজ নামটা শুনে কান খাড়া করলুম। কুমার
বলছিলেন, ‘রামানুজটার
কপাল মন্দ ছিল। সেদিনই রাইফেলটা বিট্রে করল। নইলে বাঘটা ওর কিস্যু...’
“বড়োকুমার
কথা বলা থামিয়ে কান উঁচু করে কী যেন শোনার চেষ্টা করে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটা শব্দ
পেলে?’
“আমিও
কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করতে লাগলুম। জঙ্গলে নিস্তব্ধতা এতই ভয়ংকর যে কোথাও
একটা পাতা খসলেও যেন টের পাওয়া যায়। কুমারের বকবকানির ফাঁকে আমারও মনে হচ্ছিল যেন
বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা ক্রমশ যেন দূরে চলে
গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও আমরা আর বিশেষ কোনও শব্দ পেলুম না। খানিক
অপেক্ষা করে কুমার আবার বলতে লাগলেন, ‘সেদিনটা আমি কক্ষনও ভুলতে পারব না।’
“আমি
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলুম,
‘কী হয়েছিল সেদিন?’
‘আরে
এই বাঘটা মাসখানেক আগেই আমাদের হাতে মারা পড়ত। জঙ্গলের ভেতরে যেখানে এই ঝরনাটা
পাহাড় থেকে পড়ছে, সেখানেই
একটা কাঠ কুড়োতে আসা মেয়েকে বাঘটা মেরে ফেলেছিল। আমি আর রামানুজ দু’জনে
গিয়েছিলুম বাঘটার সন্ধানে। দুপুর থেকেই আমরা ওৎ পেতে বসেছিলুম। বিকেলের দিকে, তখনও আকাশে
অনেকটাই আলো ছিল, অনেকক্ষণ
ধরে অপেক্ষা করতে করতে আমার প্রচন্ড হিসু পেয়ে গেছিল। দু’জনেই
বন্দুকগুলো হাত থেকে নামিয়ে রেখে সবে একটা গাছের পেছনে গিয়েছি কি যাইনি, ঠিক সেই
মুহুর্তেই বাঘটা চলে আসে মড়ি খেতে। আমার ফিরে আসার অপেক্ষা না করেই রামানুজ
তাড়াহুড়োতে আমার বন্দুকটাই তুলে বাঘটার মুখোমুখি পনেরো-বিশ ফিটের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে
সটান চালিয়ে দেয়। উফ! কপাল বলতে হবে, গুলি বেরলো না!’
‘কী
বলছেন?’ আমি
হতবাক হয়ে বলি।
‘তবে
আর বলছি কী মশাই! আমার বন্দুক থেকে গুলি বেরলো না। শুধু খট করে একটা শব্দই হল।
বাঘটা ওকে দ্বিতীয়বার আর গুলি চালাবার সুযোগ দেয়নি। লম্বা একটা লাফ মেরে প্রায় দশ
ফিট লম্বা বাঘটা রামানুজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে তুলে নিয়ে গেল আমার চোখের
সামনে দিয়ে আর বন্দুকটা পড়ে রইল মাটিতে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর হুঁশ ফিরতে বন্দুকটা তুলে দেখি ওতে গুলি
ভরতেই ভুলে গেসলুম। অথচ এমন ভুল আমার হবার কথা নয়। এর ম্যাগাজিনে পাঁচটা করে গুলি
থাকার কথা, অথচ
একটাও ছিল না! কী করে যে এমন ভুল হয়ে গেল বুঝতে পারলুম না। আমার বন্দুকটা নেওয়াই
কাল হল বেচারির। যাই হোক,
রামানুজের বন্দুকটা তুলে বাঘটার খোঁজে গেলুম। হই হই করে চিত্কার করতে করতে
কিছুদূর যেতেই পেয়ে গেলুম ওর লাশটা। কিছুটা খেয়ে ফেলে চলে গেছে বাঘটা!’
‘কিন্তু
রাজাসায়েব যে বললেন,
রামানুজ কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে...’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘ওসব
অনেক কথাই বাইরে প্রকাশ করতে নেই মশাই,’ কুমার তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলে
আবার খানিকটা মদ্যপান করে বললেন, ‘এরপর থেকে আমি আরও সাবধান হয়ে গেছি। বেরোবার আগে চেক করে
নিয়েছিলুম। দাঁড়াও দাঁড়াও,
আর একবার দেখে নিই।’
“এই বলে
বড়োকুমার ম্যাগাজিনটা পরখ করে দেখার জন্য যেই না নিজের বন্দুকটা হাতে তুলেছেন, ঠিক সেই
মুহুর্তে জঙ্গলের মধ্যে যেন একটা আলোড়ন উঠল। গাছে গাছে পাখি কিচকিচ করে উঠল।
দু-চারটে বাঁদর লাফালাফি শুরু করে দিল। কাছাকাছি কোথাও ফেউ ডেকে উঠল। বোঝা গেল, জঙ্গলের
রাজা কাছাকাছি এসে গেছেন। শ্যামলালের মুখেই শুনেছিলুম, বাঘের ঘ্রাণ
শক্তি তেমন প্রবল নয়,
কিন্তু ওদের শ্রবণ শক্তি মারাত্মক। কাছাকাছি যদি একটা পাতাও নড়ে, সেটাও ওদের
কান এড়ায় না। বড়োকুমার দেখলুম এবার একদম টানটান হয়ে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরেছেন। আমিও
নিজের বন্দুকটা চেপে ধরেছি। অনেকটা খাঁটি বাসমতি চালের মতো ভুরভুরে একটা গন্ধ
বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।”
ডাকু বলে উঠল, “বাসমতি চালের গন্ধ? বাঘের গন্ধ তো চিড়িয়াখানায়...”
শিবুস্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, অনেকটা বাসমতি চাল রান্না করলে যেমন
গন্ধ পাওয়া যায় ঠিক সেইটিই হল বাঘের গায়ের গন্ধ। চিড়িয়াখানায় যে বোঁটকা গন্ধটা পাস
সেটা আসলে বাসি পচা মাংস আর বাঘের মলমূত্রের গন্ধ মিলেমিশে অমন হয়ে যায়। খাঁচা
ঠিকঠাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না করার ফল। বুঝলি?”
ডাকু বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়িয়ে চুপ করে গেল।
“অন্ধকারে
আন্দাজ করতে পারছিলুম না যে বাঘটা এখন ঠিক কোন জায়গাটায়। তবে খুবই কাছাকাছি যে আছে
তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আশেপাশে প্রচুর শুকনো পাতা পড়ে থাকায় আর তার ওপর বাঘটার পা
ফেলে চলার শব্দ থেকে আন্দাজ করলুম, বাঘটা মড়িটাকে কেন্দ্র করে প্রায়
সত্তর-আশি ফুট ব্যাসের বৃত্তাকারে গোল হয়ে পাক খেয়ে যাচ্ছে। ওকে বিরক্ত করার মতো
কেউ যে এখানে নেই সে বিষয়ে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে যাবার জন্য প্রায় গোটা দশেক পাক
খাবার পর সরাসরি এগিয়ে গেল মড়িটার দিকে। অন্ধকারেও তার রাজকীয় চেহারা দেখে যেন ঘোর
লেগে গেল। যেমন লম্বা তেমনি তার হাঁটার চাল। আমার মতো অকুতোভয় মানুষেরও হৃদপিন্ডটা
যেন ছলকে উঠল। খুব সাবধানে হেয়ার ট্রিগার আনলক করে রাইফেলটা তুলতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু
বড়োকুমার আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন।”
ডাকুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার
আগেই স্যার বলে উঠলেন,
“রাইফেল থেকে যাতে অসাবধানে গুলি না বেরিয়ে যায় তাই একধরনের লক থাকে, যাকে বলে
হেয়ার ট্রিগার। যেমন অনেক পিস্তল-বন্দুকে থাকে সেফটি ক্যাচ। দুটোর মধ্যে সামান্য
তফাৎ থাকলেও কাজটা একই।”
ডাকুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। শিবুস্যার আবার ফিরে গেলেন গল্পে, “রাইফেলের
কুঁদোটা কাঁধের উপর রেখে ডানহাতের তর্জনী ট্রিগারে দিয়ে মাছিতে চোখ রেখে বড়োকুমার
খুব সাবধানে ঝোপের থেকে মাথা তুলে খাড়া হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন। গুলিটা করতে হবে
দুই চোখের মাঝখানে। বাঘটা এখন আমাদের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে। বড়োকুমার খুব
সাবধানে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলেন বাঘের দিকে। পায়ের
তলায় পড়ে থাকা পাতায় মচমচ শব্দ হতেই বাঘটা আঁচ করল কেউ কাছাকাছি এসে গেছে। যেই
বাছুর থেকে মুখটা ঘুরিয়েছে অমনি বড়োকুমার রাইফেলের ডগায় থাকা টর্চটা ঝট করে
জ্বালিয়েই ট্রিগার টিপলেন। বাঘটা দশ-পনেরো ফুটের মধ্যেই ছিল। এক গুলিতে তার মাথাটা
ছাতু ছাতু হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হল না! শুধু খট করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল
রাইফেল থেকে! দারুণ অবাক হয়ে কুমার আবার টিপলেন, কিন্তু গুলি মোটেই বেরলো না! পাগলের
মতো খট খট করে কুমার বারবার ট্রিগার টিপতে লাগলেন। কিস্যু হল না। হবেই বা কী করে, রাইফেল যে
ফাঁকা! তাতে বিলকুল গুলি নেই!
“বড়োকুমার
অসহায়ভাবে আমার দিকে চাইলেন। কী হতে চলেছে বুঝতে পেরে আতঙ্কে আমি নিজের রাইফেলটা
তুলে বাঘটার দিকে তাক করে গুলি চালাতে যাব কিন্তু তার আগেই আমার ঘাড়ে খুব ঠান্ডা
একটা নল এসে ঠেকল! চমকে পিছন ফিরে দেখি, কম্ফর্টারে মুখ ঢাকা অন্ধকার একটা
মূর্তি! ডান ভ্রূর ওপরের কাটা দাগটা দেখে চিনতে পারলুম — ছোটোকুমার!
এত বড়ো চমকটা আশাই করতে পারিনি। ইনি এলেন কোত্থেকে? তার মানে খানিক আগে যে গাড়ির শব্দটা
শুনতে পেয়েছিলুম বলে সন্দেহ হয়েছিল সেটা ভুল নয়।
“আর
বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেলুম না। পিস্তল নাচিয়ে চাপা হিসহিসে সুরে রাধামোহন বলে
উঠলেন, ‘গুলি
চালাবার চেষ্টা করলে তোমার খুলিটা উড়িয়ে দেব।’ অবাক হয়ে চেয়ে দেখি শান্তশিষ্ট, সঙ্গীতপ্রেমী, সাহিত্যমনস্ক
ছোটোকুমারের চোখে যেন খুন জ্বলছে! হাতে উদ্যত কোল্ট পিস্তল। হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘রামানুজের
ভুলে আগেরবার সব গুবলেট হয়ে গেছিল। এবার আর সেটা হতে দেব না।’
‘তার
মানে?’ আমরা
প্রায় চিত্কার করে উঠলাম,
‘আগেরবার ছোটোকুমারই রাইফেল থেকে গুলি বের করে নিয়েছিলেন?’
“হুম!
রাজপরিবারগুলোর ইতিহাস পড়লেই দেখবি ভাইয়ে ভাইয়ে খুনোখুনি-রেষারেষির এমন ঘটনা আকছার
ঘটেছে,” শিবুস্যার
নির্বিকারভাবে বলতে থাকলেন,
“বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পলকে বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল বড়োকুমারের ওপর।
হুইস্কির নেশায় এমনিতেই বড়োকুমার টলমল ছিলেনই, আত্মরক্ষার কোনও সুযোগই পেলেন না।
উল্টে পড়ে যেতেই থাবার এক আঘাতে ঘাড়টা মটকে মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল।
ছোটোকুমার পিস্তলের নল দিয়ে ঠেলে এবার আমাকে ইশারা করে বললেন, ‘চালাও গোলি।’
“পরদিন
সকালে ফিরে যাবার আগে একবার রাজাসায়েবের সঙ্গে দেখা করে খচখচ করতে থাকা প্রশ্নটা
করেই ফেললুম, ‘আপনিও
কি আপনার পিতার কনিষ্ঠপুত্র ছিলেন?’
“আরাম
কেদারায় অসহায়ের মতো বসেছিলেন উনি। বারান্দার দিকে উদাসীনভাবে চেয়ে কাঁপা কাঁপা
গলায় বললেন, ‘আপনি
বুদ্ধিমান।’ তারপর
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল।’
‘আর
বড়ো রাজাসায়েব কি বাঘের হাতেই...’
“নিরুত্তরে
পাশের ছোটো কারুকার্য করা টেবিলের ওপরে রাখা আমার নামাঙ্কিত দশ হাজার টাকার চেকটা
বাড়িয়ে দিলেন এক হতভাগ্য পিতামহ।
“আমাকে
স্টেশনে ছাড়তে ছোটোকুমার নিজে গিয়েছিলেন। কেন জনসনের .৪২৩ ক্যালিবারের ম্যাগাজিন
রাইফেলটা — যেটা
দিয়ে এত বড়ো মানুষখেকোটা মেরেছিলুম ছোটোকুমার সেটা আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন, আমি নিইনি।
একচ্যুয়ালি নিতে পারিনি। শিকারের ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গেছিল। তবে দশ হাজার টাকার
চেকটা নিয়েছিলুম। বড়োকুমারকে বাঁচাতে না পারলেও রাজচন্দ্রপুরের ত্রাস ওই
মানুষখেকোটাকে শেষমেষ খতম করার ইনাম। বাঘটার ছালসুদ্ধু মাথাটা এখনও রাজবাড়ির
দেয়ালে হয়তো টাঙানো আছে।”
গল্প শেষ হতে শিবুস্যার তার তোরঙ্গ খুলে বার করলেন একটা পিস্তল।
ঝকঝক করছে আলো পড়ে। আমরা হামলে পড়লাম, “স্যার, এটা কী?”
“এটাই
সেই পিস্তলের মতো দেখতে এয়ারগানটা। ছোটোকুমার কিছু একটা নেবার জন্য অনুরোধ উপরোধ
করতে কখনও-সখনও দুষ্টু কাক তাড়াতে কাজে লাগবে ভেবে এটাই তুলে নিয়েছিলুম,” শিবুস্যার
মুচকি হেসে বললেন।
ডাকু বরাবরের মতো সন্দেহজনক সুরে বলে উঠল, “সবই ঠিক আছে, তবে এমন ছোটোখাটো
পকেটে ভরার মতো এয়ারগান কি তখনকার দিনে তৈরি হয়েছিল?”
শিবুস্যার ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই হয়েছে তোদের নিয়ে মুশকিল।
সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখিস। চল বাপু, আমার নাইবার সময় হল। যত্ত সব!”
_____
অলঙ্করণঃ
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
লেখক পরিচিতিঃ রবীন্দ্রভারতী
থেকে স্নাতক। জন্মস্থান কোন্নগর আর বেড়ে ওঠা বর্ধমানে। সন্দেশ, প্রতিদিন, রাজপথ, কিশোর
জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ বেশ কয়েকটি কিশোর পত্রিকাতে লেখালিখি। বর্তমানে একটি সর্বভারতীয়
প্রথম শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। ভালোবাসেন বই পড়তে আর
ঘুরে বেড়াতে। নেশা সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং।
জন্তু জানোয়ার ভালবাসি বলে শিকারের গল্প আমি পড়িনা। এই গল্পের প্রথম কয়েকটা লাইন পড়ে মনে হয়েছিল যে ঘণাদার গল্পের মতো হবে। তারপর যেন নেশার ঘোরে ছিলাম - যেন একটা সিনেমা দেখলাম। অপূর্ব - সত্যিই অপূর্ব গল্প হয়েছে। আর কিছু বলার নেই, বাবিন। আপনার গল্পের হাত খুব ভাল। লিখে যান। ~ ক্যাল।
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ| খুব আনন্দ পেলাম|
Deleteদারুণ এক কথায়
ReplyDeleteধন্যবাদ| ভালো থাকবেন|
Deletevalo laglo
ReplyDeleteআপ্লুত হলাম। ভাল থাকবেন
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগলো।প্রথম দিকে কিছুটা তারিনীখুড়োর ছায়া পাওয়া যায়।শেষটা কিন্তু একদমই আলাদা।গল্পের শেষটা গল্পটাকে একটা বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ বন্ধু|
Delete