এফোঁড় ওফোঁড়
নির্মাল্য সেনগুপ্ত
(১)
শরতকালের দুপুর। এ সময় সবার মনই একটু উড়ু উড়ু হয়ে থাকে। পরীক্ষার পাট বেশ
কয়েকদিনের জন্য চুকে গেছে। স্কুল ছুটি। মা দুর্গা আসব আসব করছেন। গুচ্ছের মজা।
এইসব কিছুর মধ্যে একটা জিনিসই বেমানান হয়ে আছে। সেটা আমি। আমার মনখারাপ।
কথা হচ্ছে আমার এক জেঠু
থাকেন দিল্লীতে। রুন্টুজেঠু। তিনি আমার গত পরীক্ষার রেজাল্ট অপ্রত্যাশিত ভালো
হওয়ার সুবাদে আমাকে একটি শার্টের পিস উপহার দিয়েছিলেন। আকাশি রঙের চেক ডিজাইনের।
ভারি সুন্দর দেখতে। এমনিতে আমার জামাকাপড়ের
প্রতি তেমন আকর্ষণ নেই, তবে যেহেতু জিনিসটি দিল্লীর তাই আমার মনে হয়েছে ওটি একটি
অমূল্য জিনিস, এর জুড়ি মেলা ভার। তাই নাচতে নাচতে দর্জির কাছে গেলাম মাপ দিতে। তৈরি হয়ে এল।
মা-বাবার ঘরের বড়ো আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটিকে যেই
গায়ে চড়িয়েছি ওমনি মাথায় বাজ পড়ল। একি! আমার প্রিয় শার্টটার দুটো হাতা কনুই পার
করে কবজি থেকে মাত্র ইঞ্চি তিনেক আগে
থেমেছে। তার ফলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে সেটা
না হয়েছে ফুল হাতা না হাফ হাতা। দুটোর মাঝামাঝি গিয়ে আটকে গেছে।
আয়নায় স্পষ্ট দেখলাম আমার
হাসি মুখটা কেমন ধীরে ধীরে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। এটা কী? থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট
শুনেছিলাম। শার্ট তো কষ্মিনকালেও শুনিনি বা দেখিনি। দু’দিন বাদে পুজো, কত আশা করলাম এটা পরে সপ্তমীর দিন প্যান্ডেলে যাব আর
বন্ধুদের হাসি হাসি ইর্ষান্বিত মুখগুলোকে দেখে মনে মনে বলব, হুঁ হুঁ, এ বাবা দিল্লী কা মাল, তোমাদের তো আর আমার মতো জেঠুভাগ্য নেই, থাকে তো সব কদমগাছি, তেঁতুলতলা, শেওড়াফুলি, নিদেনপক্ষে মালদা। কপাল করে এমন জেঠু পেতে হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত জেঠুভাগ্য থাকলেও যে আমার
দর্জি-ভাগ্য অতিশয় করুণ এবং এই জামা পরে পুজোয় বেরোলে আমার
জেঠু দিল্লীর বদলে মঙ্গলগ্রহে থাকে তাইই বেশি প্রমাণ হবে, এই ভেবেই আমার চোখে জল এসে গেল। মনে মনে দর্জিকে সপরিবারে শাপশাপান্ত করতে করতে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গেলাম।
“এই দ্যাখো, এটা কী হয়েছে!”
আমার মনের অবস্থার একফোঁটা
তোয়াক্কা না করে মা তারস্বরে হাসতে থাকলেন। আমি বোকার মতো রাগী রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাসি থামলে মা বললেন, “যা, এক্ষুনি দোকানে যা। বল গিয়ে ঠিক
করে দিতে।”
যদিও ওই কালান্তক
দর্জির ওপর আমার মোটেও ভরসা ছিল না, তবুও উপায় নেই দেখে তাও গেলাম। কিন্তু
হায়। অত অভিশাপের বদলা নিল ব্যাটা। দোকান বন্ধ। কাল রবিবার। খুলবে
পরশু। এদিকে বুধবার সপ্তমী।
কাঁচুমাচু মুখে মায়ের কাছে
ফিরে গেলাম। মা শার্টটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা, দাঁড়া দেখি। আমি পারি কি না।”
মায়ের এই
দর্জিপনায় আমি যারপরনাই ভীত হলাম। মা গত বছর একটা সেলাই মেশিন
কিনেছেন। কিন্তু লাভের খুব একটা কিছু হয়নি। বাবার একটা শার্টের পকেট উলটো লাগিয়েছেন,
আমার খেলার জার্সি ছিঁড়ে গেছিল, এমন সেলাই করেছেন
যে সেটা এখন গায়েই ঢোকে না। এখন শুধু নিজের শাড়ির ফলস পিকো করেন, তাও মাঝেমাঝেই শুনি ‘এই যাহ!’ তারপরে সেটা আবার দোকানে নিয়ে
যেতে হয় ঠিক করার জন্য।
এ হেন পরিস্থিতিতে আমার যে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু
উপায়ও নেই। এক তো শেষ আশা, তার উপরে কার বুকের পাটা আছে মাকে আমার ভয়ের কথা
জানাবে!
মা একটা আধ ফুটের কাঁচি
নিয়ে এলেন। আমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর হাতার একটা দিক আমাকে ধরতে দিয়ে অন্যদিক
থেকে কুচ কুচ করে সেটা ইঞ্চি তিনেক কেটে
ফেললেন কোনও মাপ ছাড়াই। পরের হাতারও একই দশা
হল। কাঁচিপর্ব শেষ হলে মা সেটা দু’হাতে
মেলে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর খুশি খুশি মুখ করে নিয়ে
গেলেন মেশিনের দিকে।
ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট। মেশিন
চলছে। আমার নিভন্ত মনে একটু আশার আলো জাগবে
জাগবে করছিল, এমন সময়...
“এই যাহ!”
এই কথাটার তাৎপর্য জানতে
আমার বাকি নেই। প্রায় লাফিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল, কী হল?”
মা একরাশ বিরক্তির সাথে
বললেন, “সূঁচটা ভেঙে গেল। শেষ সূঁচ ছিল। আবার ধর্মতলা যেতে হবে কিনতে। জ্বালা এক!”
আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস
করলাম, “আমার জামা?”
মা আমার জামা, এখন অবশ্য
জামার ভগ্নাবশেষই বলা চলে সেটাকে, এক হাত দিয়ে তুললেন। একদিকের হাতা পুরো
এবড়োখেবড়ো করে কাটা, অন্যদিকে কিছুটা সেলাই করা, ডগায় কয়েকটা সুতো ঝুলছে।
আর আশা নেই। আমি
ছেড়ে দিলাম। দিল্লীর লাড্ডু হোক কি চেকশার্ট, আফশোস ছাড়া
আর কিছুই করার থাকে না সেটা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
আমার অবস্থা দেখে মায়ের
বোধহয় করুণা হল। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “ব্যস,
হয়ে গেছে।”
এখনও আশা আছে কি? আমি
চোখটা উপরের দিকে তুললাম। মা
বললেন, “যা, এক্ষুনি দাদুর বাড়িতে যা। তোর
ঠাম্মার কাছেই তো সেলাই মেশিন আছে। মাকে সেদিনই মেশিনে তেল দিতে দেখছিলাম। ঠাম্মা
ঠিক করে দেবে।”
আমার চোখ চিকচিক করে উঠল।
ঠিক তো। ঠাম্মার উপর আমার অগাধ ভরসা। অসাধারণ রাঁধেন, ঘরদোর তকতকে পরিষ্কার,
গোছানো। যদিও তার সেলাই মহিমার কথা আজ অবধি শুনিনি, তবুও কিছু একটা যে দাঁড়াবে বুঝতেই পারছি। আমি তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালাম। আর তখনই মনে
পড়ল আসল কথাটা।
ঠাম্মা অবধি
পৌঁছাবার আগে আমাকে একটা হার্ডল ক্রস করতে হবে। সেটা হল আমার
দাদু।
(২)
আমার দাদু, আদপে যিনি আমার
ঠাকুরদা, মিস্টার রঞ্জন সেনগুপ্ত, বিদেশে যাকে সবাই রন্টজেন নামে চেনে, যিনি এক
ছক্কায় ইংল্যান্ডের স্যাটেলাইট জমিনচ্যুত করেছিলেন তার বাড়িতেই এখন যাচ্ছি আমার
শার্ট সেলাই করাতে। দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখি বসার ঘরে তিনি বসে আছেন। ডাক পড়ল।
“কী ব্যাপার? এই অসময়ে?”
আমি শার্টটা দেখিয়ে বললাম, “ঠাম্মার কাছে এসেছি সেলাই করাতে। ঠাম্মা কোথায়?”
পরের প্রশ্নবাণের জন্য তৈরি হয়েছিলাম, কিন্তু দাদু কেমন চুপ করে গেলেন। ইশারা করে বললেন, “বস।”
কিছুক্ষণ পরে বললেন,
“ঠাম্মা স্নানে গেছে। তুমি আলমারি থেকে আমার খয়েরি ব্যাগটা নিয়ে এস তো।”
আমি নিয়ে এলাম। দাদু সেটা
খুলে কিছু একটা দেখলেন। আমার বেশ কৌতূহল
হচ্ছিল, কিন্তু সাহস করতে না পেরে চেপে
গেলাম। ব্যাগটা পাশে রেখে দাদু জিজ্ঞেস
করলেন, “তোমায় কে বলল ঠাম্মা সেলাই করতে
পারে? তুমি জানতে ঠাম্মার সেলাই মেশিন আছে?”
আমি বললাম, “না। মা আমাকে বলল।”
“যাও, সেটা দেখে এস। শোবার ঘরের দরজার পাশে আছে।”
আমি দেখতে গেলাম। এর আগে
এটা খেয়াল করিনি। একটা পুরনো শাড়ি দিয়ে ঢাকা। তুলে দেখলাম রুপোলি পাত দিয়ে মোড়া একটা সেলাই মেশিন।
দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরনো মডেল।
ফিরে এসে বললাম, “হ্যাঁ, দেখেছি।”
দাদু কিছুক্ষণ চুপ থেকে
বললেন, “এর পেছনে একটা গল্প আছে। শুনবে?”
যদিও শার্টের দুঃখে তখনও
বেশ কাতর ছিলাম, কিন্তু গল্পের লোভ কাটাতে পারলাম না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। দাদু একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন।
সেবার আমি ইংল্যান্ডের
ইউনিভার্সিটি অফ লিডসে গেছি মেটালার্জির
একটা স্পেশাল সেমিনার নিতে। খুব খাটনির কাজ। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেকচার
দিতে হয়। গলা-টলা পুরো ভেঙে গেছিল। তিনদিনের সেমিনার শেষ হয়ে
গেলে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কোমরে একটু অ্যালার্জিমতো হয়েছিল। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ওখানকার পুরনো বান্ধবী লিন্ডার সাথে দেখা হয়ে
গেল। লিন্ডা আমায় বলল, “রনি চল, আজ একটা অকশনে আমায় ইনভাইট করেছে। তুমিও আমার সাথে ঘুরে আসবে।”
এদিকে সেদিনই আমার সন্ধে
সাতটায় ফ্লাইট। তখন দুপুর একটা প্রায়। যদিও ঘন্টা ছয়েক আছে হাতে, তবুও একটু উসখুস করছিল
মনটা। কিন্তু লিন্ডা কোনও কথাই শুনল না। টানতে
টানতে আমায় নিয়ে গেল নিলামে।
বিশাল কুইন্স হোটেলের অকশন
হলে নিলাম চলছে। অ্যান্টিক জিনিসের। সবাই বিড করতে ব্যস্ত। আমার পুরনো জিনিসের
প্রতি খুব একটা ভালোবাসা নেই। কিন্তু
একটা তিন চাকার সাইকেল বিক্রি হয়ে যাওয়ার
পর যে জিনিসটার পালা এল সেটা দেখে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।
অকশনার বললেন, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, এবার যে জিনিসটা আপনারা দেখছেন সেটার ঐতিহাসিক মূল্য যে কত তা আপনাদের ধারণার বাইরে। বিশ্বের প্রথম সেলাই মেশিন,
আবিষ্কার করেন মিস্টার থমাস সেইন্ট, আজ থেকে দুশো বছর আগে,
সতেরশো নব্বই সালে। এটি তার নিজের হাতে তৈরি তৃতীয়
মেশিন যা আপনাদের কারও হাতে আজ চলে আসবে। নিলাম শুরু
মাত্র চল্লিশ ডলার দিয়ে।”
সত্যি বলছি, জিনিসটার ঐতিহাসিক মূল্য নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। আসল কথা
হচ্ছে এই, তোমার ঠাম্মা অনেকদিন ধরে আবদার
করে চলেছিল একটা সেলাই মেশিনের জন্য। একটা সেলাই মেশিন পেলে সে আমার গোটা প্যান্ট
সেলাই করে দিতে পারে এমনও বলেছিল। আর এটা ঠিক নতুন মেশিনের প্রতি আমার খুব একটা ভরসা
ছিল না। পুরনো জিনিস বেশ টেকসই হয়
জানি। এছাড়া নিয়ে
গেলে বেশ সারপ্রাইজডও হবেন তিনি। তাই নিলাম
ডাকতে শুরু করলাম।
ছেচল্লিশ ডলারে যখন প্রায় জিনিসটাকে পেড়ে ফেলেছি, কাউন্টিং শেষ হতে চলেছে ঠিক
সেই সময় একটা কালো কোটপ্যান্ট আর হ্যাট পরা সাহেব হলের অন্য কোণা থেকে নিলাম ডাকল, “পঞ্চাশ ডলার।”
আমি ছাড়ব কেন? এমনিতেই
লোকটাকে কেমন সন্দেহজনক দেখতে, আর আমার জিনিস নিয়ে যাবে! কভি নহি। আমি ডাকলাম পঞ্চান্ন। ডাকাডাকি চলতে থাকল। নিলাম যেই আশিতে
পৌঁছেছে কেন জানি না আমি অসহিষ্ণু হয়ে পড়লাম। কিছুতেই হার মানব না সাহেবটার কাছে। আমি ডাক দিলাম দেড়শো ডলার।
সারা হল চমকে উঠল। এক লাফে দেড়শো! সেই সাহেবটাও
কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এর মধ্যে কাউন্টিং শেষ হল। অকশনার ঘোষণা করলেন, “দ্য সেউইং মেশিন ইস সোল্ড টু মিস্টার রন্টজেন স্যাঙ্গুপ্টা।”
লিন্ডা আমার পিঠ চাপড়ে দিল। যদিও গাটা একটু কড়কড় করছিল, তবুও যখন জিনিসটা হাতে পেলাম বুকটা গর্বে ফুলে উঠল। পৃথিবীর তিন নম্বর সেলাই
মেশিন এখন আমার হাতে। আমাকে একটা চাবি দেওয়া হল। এইটা
ছাড়া মেশিনের ডালা খুলবে না। আমি
সেটা চোরাপকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।
বিকেল চারটে। এবার
এয়ারপোর্টের দিকে যেতে হবে। এদিকে তোমার ঠাম্মাকে ফোন করে যেই সারপ্রাইজের কথা
বলেছি সে এমন নাছোড়বান্দা হয়ে উঠল যে সত্যিটা বলেই দিতে হল। এমনিতেই সেলাই মেশিন,
তার উপরে এমন তার ইতিহাস, তোমার ঠাম্মা আনন্দে আটখানা। ফোনেই বোঝা যাচ্ছিল। আমার
মন থেকে টাকার কষ্ট পুরোপুরি উবে গেল।
ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে
ছিলাম। প্রায় মিনিট পনেরো পরে একটা ট্যাক্সি পেলাম। লিন্ডা
বিদায় জানাল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কোনও দরকার হলেই যেন ফোন করি। আমি বসলাম ব্যাক-সীটে। পাশে সেলাই মেশিন। জানালা খোলা। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। হঠাৎ আমার
মনে হল এই রাস্তাটা আমার চেনা নয়। ড্রাইভারও এখনও অবধি কোনও কথা বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ড্রাইভারসাব, আর কতক্ষণ?”
উত্তর এল না। আবার
জিজ্ঞেস করলাম। একটা হিসহিসে গলায় এবার উত্তর এল, “চুপচাপ বসে থাক। একটা টুঁ শব্দও করবে না।”
ভয়ে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।
এবার ট্যাক্সির মিররে দেখতে পেলাম ড্রাইভারের মুখটা। কুইন্স হোটেলের নিলামের সেই
সাহেব। দরদর করে ঘামছি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে প্রাণটা হারাতে হবে নাকি? একটা বহু পুরনো ফ্যাক্টরিতে এসে ট্যাক্সিটা
থামল। বোঝাই যায় এখানে লোকের আনাগোনা নেই।
কালো কোট আমায় নামার ইশারা
করল। নামার সময় যেই সেলাই মেশিনটার দিকে হাত বাড়িয়েছি, একটা গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি
কালো কোট আমার দিকে তার টি-শার্টটা
একটু তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। দেখি তার কোমর থেকে উঁকি মারছে একটা চকচকে
পিস্তলের বাঁট।
ফ্যাক্টরির তিনতলায় আমায়
নিয়ে যাওয়া হল। ভাঙাচোরা বিক্ষিপ্ত একটা ঘর। কয়েকটা
কাঁচকাটার ভাঙা যন্ত্র। তার একপাশে একটা প্রায়
সাত ফুট লম্বা ধবধবে ফরসা সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে দু’তিনটে গুন্ডাধরনের কালো সাহেব বা নিগ্রো। আমি আসতেই
লম্বাটা দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “আসুন আসুন, মিস্টার রন্টজেন। বেশ ঝামেলায় ফেলে
দিয়েছিলেন আপনি। গ্যারিই শেষরক্ষাটা করল।”
কালো কোট যার নাম জানলাম
গ্যারি, বলে উঠল, “একদিক থেকে ভালোই হল। পঁচিশ ডলারের তেল পুড়ল ঠিকই, কিন্তু দেড়শো ডলার বেঁচে গেল। কী বল, মাইকেল?”
দু’জনে হেসে উঠল। আমার গা-পিত্তি
জ্বলে গেল। আর হাতে মাত্র দু’ঘন্টা।
তারপরেই আমাকে ফেলে রেখে উড়ে যাবে ইন্ডিয়ার এরোপ্লেন। এমন সময় একজন নিগ্রো মাইকেলের কানে কানে এসে কিছু বলল। মাইকেল আমার দিকে
এগিয়ে এল।
“চাবিটা দাও রন্টজেন।”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
“কীসের চাবি?”
মাইকেল চেঁচিয়ে উঠল, “নাটক করো না রন। মেশিনের চাবিটা দাও, নইলে
এই মুহুর্তে মারা পড়বে তুমি।”
আমার তখনই মনে পড়ে গেল।
মেশিনের চাবি। যেটা ছাড়া মেশিনের ডালাই খুলবে না। যেটা আছে আমার চোরাই পকেটে। আমি বুঝলাম
এখান থেকে বেঁচে ফেরার এই সুযোগ। চাবি দিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে আমি শেষ। বুদ্ধিটা
তখনই এসে গেল। আমি নিরীহের মতো মুখ করে
বললাম, “সেটা তো আমার স্ত্রীর কাছে।
বিশ্বাস না হয় সার্চ করে নাও।”
একজন গুন্ডা এসে আমায় চাপড়ে
চাপড়ে সার্চ করল। পায়ের জুতোমোজা খুলে দেখল। পেল না।
মাইকেল দাঁতে দাঁত চিপে
বলল, “কোথায় তোমার স্ত্রী? নাম কী তার?”
আমি মনে মনে সহস্রবার জিভ
কেটে বললাম, “লিন্ডা। কুইন্স হোটেলের ওদিকে
পার্ক রো-এর কাছে থাকে।”
গ্যারি বলল, “হ্যাঁ, ওর সাথে
নিলামে একটি মেয়েকে দেখেছি আমি।”
মাইকেল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “ওকে। ফোন কর তাকে। বল, তোমাকে
চাবিটা দিয়ে যেতে এক্ষুনি।”
আমি শান্তভাবে জিজ্ঞেস
করলাম, “কোথায় আসতে বলব?”
মাইকেল বলল, “হাইগেন পার্কের পাশের গ্লাস ফ্যাক্টরির সামনে। এক্ষুনি যেন আসে।”
আমি ফোনে ডায়াল করলাম। রিং
হচ্ছে। লিন্ডা ধরেছে।
“হ্যালো!”
মাইকেল আমার কানের কাছে
এসে বলল, “কোনওরকম চালাকি করলে দু’জনের কেউ
বাঁচবে না।”
আমি ফোনে বললাম, “লিন্ডা, আমার মেশিনের চাবিটা দিয়ে যাও।”
লিন্ডা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস
করল, “চাবি! সে তো তোমারই কাছে থাকার
কথা। আমি পাব কোথায়?”
মাইকেল পাশে দাঁড়িয়ে কথা
শোনার চেষ্টা করছে। আমার আশা শেষ হয়ে আসছে। আমি ধরা গলায় বললাম, “বলেছিলে না, বিপদে পড়লে আমায় সবসময় সাহায্য
করবে। আমার চাবিটা খুব দরকার। দিয়ে যাও।”
লিন্ডা কিছুক্ষণ চুপ করে
থেকে বলল, “কোথায় আসব? ঠিকানা বল।”
আমি বললাম। লিন্ডা কি বুঝল
কিছু?
কেটে গেল পনেরো মিনিট। হঠাৎ গ্যারি বলে উঠল, “মাইকেল, ওই যে এসেছে।”
আমি পাশের ভাঙা জানালাটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিচে লিন্ডা একা দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন। আমার ফোনটা বেজে উঠল। লিন্ডা।
মাইকেল আমার হাত থেকে
ফোনটা কেড়ে নিল। গ্যারি দুটো গুন্ডা নিয়ে নিচে নেমে গেল। সব শেষ। লিন্ডা আমার ইশারা বোঝেনি। একাই এসেছে সে। মাইকেল আমার দিকে বন্দুক তাক করে হাসছে। আমি হঠাৎ ভাবলাম, এ কী করলাম আমি! নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে লিন্ডাকে বিপদে ফেলে দিলাম! এত স্বার্থপর আমি? এখন আমরা দু’জনেই মারা পড়ব আর এই বদমাইশগুলো
যা চাইছে তাই পেয়ে যাবে। না, তা হতে
দেব না।
আমি চোরাপকেট থেকে চাবিটা
বের করলাম। হাতে তুলে ধরে বললাম, “মাইকেল, চাবি আমার কাছে। একটা শর্তেই আমি তোমাকে এটা দেব। যদি লিন্ডাকে এখান থেকে
চলে যেতে দাও। নইলে এটা এক্ষুনি ছুঁড়ে ফেলে
দেব।”
মাইকেল হো হো করে হেসে উঠে
বলল, “ওরে মূর্খ, এখানে এসে কেউ বাঁচে না।
চাবিটা দে। নইলে এক্ষুনি শেষ করে দেব।”
আমি জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। কেউ নেই নিচে। লিন্ডা ধরা পড়েছে। আমার একটা
ভুলের জন্য এত কিছু হল। মাইকেল আমার দিকে বন্দুক
তাক করে আছে। আমি দাঁতে দাঁত চিপলাম, তারপর চাবিটা ছুঁড়ে দিলাম ভাঙা জানালাটার দিকে।
গুড়ুম করে একটা শব্দ। বারুদের গন্ধ নাকে এল। আমার চোখ বন্ধ। কিন্তু ব্যথা অনুভব
করছি না কেন? তবে কি সেই অবকাশটুকুও
পাইনি? কাদের গলার আওয়াজ পাচ্ছি যেন? নরকের শয়তান, না স্বর্গের দেবদূত?
চোখ খুলে অবাক হয়ে গেলাম।
সারা ঘর জুড়ে প্রায় জনা তিরিশেক বৃটিশ পুলিশ বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। নিগ্রো গুন্ডাগুলো হাত তোলা আর মাইকেল মেঝেতে পড়ে
কাতরাচ্ছে।
একজন উর্দিধারী আমার দিকে
এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, “হাই, আমি ডিটেকটিভ স্মিথ। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ তো?”
আমি মাথা নাড়ালাম। পেছনে একটা চেনা আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখি লিন্ডা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এগিয়ে গেলাম।
“তোমার এই ঋণ কীভাবে শোধ করব, লিন্ডা? তোমায় আমি নিজের
স্বার্থে বিপদে ফেলছিলাম। আমাকে তুমি ক্ষমা কর।”
লিন্ডা হেসে বলল, “ধুর, আমি নিলামের সময়তেই বুঝেছিলাম যে
কিছু একটা গন্ডগোল আছে যখন একটা সেলাই মেশিন নিয়ে এত ঝামেলা চলছে। তাই তুমি ফোন
করতেই আমার বন্ধু স্মিথকে ফোন করেছিলাম।”
আমি ঘুরে স্মিথকে জিজ্ঞেস
করলাম, “ব্যাপার কী ডিটেকটিভ? একটা সেলাই মেশিন নিয়ে এত হাঙ্গামা কেন?”
স্মিথ ইশারায় ভূপতিত মাইকেলকে দেখিয়ে বলল, “এর আসল
পরিচয় কী জানেন?”
আমি মাথা নাড়লাম। স্মিথ
বলল, “এ হল থমাস সেইন্টের পৌত্র
মাইকেল সেইন্ট।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত বড়ো একজন আবিষ্কারকের পৌত্র গুন্ডা! স্মিথ বলল, “মাইকেল একজন ব্যবসায়ী। সম্প্রতি লোকসানের ফলে বাড়ির সমস্ত কিছু নিলামে
তুলে দেয়। তারপর পিতামহের ডায়েরি থেকে জানতে পারে এক বিশাল বড়ো তথ্য এই
মেশিনটার সম্পর্কে। তখনই এটা ফিরে পাওয়ার জন্য...”
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “কী তথ্য? এর মধ্যে কি মিস্টার
সেইন্ট কোনও গুপ্তধন লুকিয়ে গেছিলেন?”
স্মিথ শান্তমুখে হেসে
বললেন, “না। তার থেকেও বড়ো কিছু। আসুন দেখবেন।”
আমি এগিয়ে গেলাম। মেশিনটা
একপাশে রাখা ছিল। একজন পুলিশ আমার ছুঁড়ে ফেলা
চাবিটা উদ্ধার করে এনেছিল। ডালাটা খোলা হল।
রুপোলি পাতে মোড়া সেলাই মেশিন। আমি কোনও বৈচিত্র
খুঁজে না পেয়ে স্মিথের দিকে তাকালাম। স্মিথ আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “এবার মেশিনের সূঁচটা লক্ষ
করুন।”
আমি দেখলাম। সাধারণ সূঁচের মতোই দেখতে। আলাদা কিছু বুঝলাম না। আমি জিজ্ঞাসু চোখে স্মিথের দিকে তাকাতে স্মিথ বলল, “ধরতে পারলেন না তো? তবে শুনুন। সেই সময়ে যে মেশিন বানানো হত
তাতে সূঁচ বদলানো যেত না। তবে সেগুলো এতোই পোক্ত হত যে সহজে
ভাঙতও না। মেশিন-সূঁচ আর হাত-সূঁচের মধ্যে তফাৎ কী জানেন? হাত-সূঁচের সুতো ভরার ফুটো বা ‘আই’টা
থাকে গোড়ায় যা মেশিন-সূঁচে থাকে ঠিক উলটো। আগায়। এটাই
ছিল সবথেকে বড়ো আবিষ্কার। কিন্তু
ভুলবশত সেইন্ট মহাশয় তার তৃতীয় মেশিনটি বানিয়ে
ফেললেন হাত-সূঁচ দিয়ে। যার ফলে এই মেশিনটিকে কোনওদিন
ব্যবহার করা যায়নি। কিন্তু যার জন্য আজ এর ঐতিহাসিক মূল্য লক্ষ ডলার হয়ে গেছে। মাইকেল এটাই জানতে পেরেছিল। কিন্তু আপনার জন্য সেই
চেষ্টা বৃথা হল। এটি এখন আপনার।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “দেখুন মশাই, আমার লক্ষ ডলার চাই না। তবে দেড়শো ডলার খরচা করে আমি একটা অকেজো মেশিন আমার
মিসেসের জন্যই নিয়ে যেতে পারব না।”
আমি বললাম “তারপর?”
দাদু বললেন, “তারপর আর কী। আমি
লিন্ডাকে দেড়শো ডলারে মেশিনটা বিক্রি করে ইন্ডিয়া
ফিরে এলাম।”
দাদুর এই মূর্খামিতে আমার বেশ রাগ হচ্ছিল। তারপর
ভাবলাম, লিন্ডার জন্যই দাদুর প্রাণ
বেঁচেছে তাই রাগটা গিলে নিলাম।
একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল।
দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা, মাইকেলরা যখন তোমায় সার্চ করল
তখন ওরা চাবিটা পেল না কেন?”
দাদু মাথা নেড়ে বললেন, “ওই তো। আমার কোমরে অ্যালার্জির কারণই ছিল ওই চোরাপকেট। তাই আমি দর্জিকে দিয়ে
সেলাই করে চোরাপকেটটা কোমরের জায়গায় হাঁটুর নিচে করে নিয়েছিলাম।”
আমি বললাম, “আর মেশিন না পেয়ে ঠাম্মা কী বলল?”
দাদু বললেন, “বলে দিয়েছি মেশিনের কথা। আনতে তো হবেই। তাই উষার একটা মেশিন কিনে আনলাম
ধর্মতলা থেকে আর কী।”
আমি বললাম, “শেষ প্রশ্ন। মেশিন পেয়ে ঠাম্মা তোমায় কী কী বানিয়ে দিল?”
দাদু বললেন, “তোমার ঠাম্মা আমাকে দুটো জিনিস বানিয়ে দিয়েছে। দেখবে?”
এরপর দাদু তার সেই খয়েরি
ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন দুটো আধময়লা রুমাল। যাদের এককোণায় বাচ্চাদের হাতের লেখার
মতো অ্যাঁকাব্যাঁকাভাবে ইংরেজী R লেখা রয়েছে।
আমার শেষ আশাটুকুও নষ্ট
হয়ে গেল।
_____
অলঙ্করণঃ সম্বুদ্ধ বিশী
No comments:
Post a Comment