সি ভি রমন
অমিতাভ প্রামাণিক
দুই
ব্রিটিশ
ভারতে যে বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজন, এই আন্দোলনের শুরুটা কিন্তু করেছিলেন রাজা
রামমোহন রায়। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশে জন্মেছিলেন আর্যভট-বরাহমিহির-ব্রহ্মগুপ্ত-ভাস্করাচার্যের
মত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, সেই দেশে নেমে এসেছিল প্রায় সহস্রাব্দব্যাপী
অন্ধকার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইংরেজরা কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করে সুপ্রীম কোর্ট,
তার প্রধান বিচারপতি হয়ে ভারতে এসেছিলেন প্রাচ্যবিদ ও বহুভাষাবিদ উইলিয়াম জোন্স।
ভারতের সমস্ত তারামন্ডলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন এমন পন্ডিতের খোঁজ পেলে তিনি
তাঁকে বৃত্তি দেবেন, এই টোপ ফেলে তিনি একজনেরও খোঁজ পান নি, এমন দুর্বিষহ অবস্থা
সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যে ভারত ভেষজ গুণের জ্ঞান অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠা
করেছে আয়ুর্বেদশাস্ত্র, সেই আয়ুর্বেদে উল্লিখিত সমস্ত ভেষজের সন্ধান জানা পন্ডিতের
খোঁজও পাননি তিনি!
সময়টা মনে
আছে তো? অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলার শাসক মুর্শিদকুলি খাঁ, অর্থাৎ নবাবী
শাসন। এর পর আলিবর্দীর সময় বর্গী অত্যাচার চরমে ওঠে, তাদের তাড়া করতে করতেই তার
আয়ু ক্ষয়ে যায়। আলীবর্দীর আদরের নাতি সিরাজকে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে হারিয়ে ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করে। কয়েক বছর পর তারা পেয়ে যায়
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি, অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার। সেই অরাজক অব্যবস্থার
দুর্দিনে অভিশাপের মত বাংলায় নেমে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলার এক-তৃতীয়াংশ
মানুষ খাবার না পেয়ে অনাহারে মারা যায়, গোটা বাংলা হয়ে ওঠে মহাশ্মশান, চাষের জমি
পরিণত হয় জঙ্গলে। সেটা বাংলা ১১৭৬ সাল, ইংরাজি ১৭৭০। ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে এই
দুরবস্থা সামলানোর ভার আসে। হেস্টিংসের নিজেরই নৈতিক চরিত্রের ঠিক ছিল না, তার
বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের উত্তরে তিনি বন্ধু ইংরেজ বিচারকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে
ফাঁসি দিলেন মহারাজা নন্দকুমারের। এর আগে অবশ্য সকল নাটের গুরু ক্লাইভ দেশে ফিরে
গেছেন বিপুল ধনসম্পত্তি জাহাজে ভরে। তার বিরুদ্ধেও অসংখ্য অভিযোগ দায়ের হয়েছে
ইংল্যান্ডের আদালতেই। ঘুষ খাইয়ে অভিযোগকারীদের মুখ বন্ধ
করতে পারলেও নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে না পেরে আফিমে আসক্ত ক্লাইভ
আত্মঘাতী হন।
এই
প্রেক্ষিতে জন্ম রামমোহন রায়ের।
সতীদাহ
প্রথা রদ করার জন্য তিনি সুপরিচিত হলেও সেটাই রামমোহনের একমাত্র পরিচয় নয়। আর পাঁচটা শিশুর মতোই রামমোহনের ছেলেবেলা শুরু হয়। পড়াশুনায়
তার মতি ছিল খুব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে গুরুগৃহ, ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠী আর
মৌলবিদের আরবি-ফার্সি শেখার জায়গা। বাড়িতেই রামমোহন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও কিছু
ফার্সি ভাষা শেখেন। মুখে মুখে শিখতে হত সংস্কৃত শ্লোক, শুভঙ্করী আর্যা আর তালপাতায়
হাতের লেখা মকশো করতে হত। মোগল যুগে ফার্সিই রাজভাষা, সরকারি সব ব্যাপারে ফার্সি
জানতেই হয়। পিতা-পিতামহ এই ভাষা জানতেন, তার কিছু রামমোহনে সঞ্চারিত হয়। পরে আরবি
শেখার জন্য বাবা রামকান্ত তাকে পাটনা পাঠিয়ে দেন। সেখানে আরবি ভাষায় অ্যারিষ্টটল ও
ইউক্লিডের বই পড়ে ফেলেন রামমোহন। সঙ্গে ছিল আরবি ভাষায় কোরান পাঠও। পাটনায় শিখগুরু
গোবিন্দ সিঙের জন্ম হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, এখানেই আছে তখত পাটনা সাহেব
বা হরমন্দির সাহেব গুরদোয়ারা। গুরদোয়ারার মৃদঙ্গ সঙ্গীত তাকে স্পর্শ করেছিল। অল্প বয়সে একাধিক ধর্মের গ্রন্থপাঠ ও তাদের
সংস্কারের অনুভবের মাধ্যমে তার মধ্যে একেশ্বরবাদের ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে। সুফিদের
সহজিয়া দর্শন তাকে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে।
পাটনায় বছর তিনেক কাটানোর পর রামকান্ত রামমোহনকে পাঠিয়ে দেন
কাশীতে পন্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শেখার জন্য। আগে থেকেই ধর্মগ্রন্থ পাঠে মতি ছিল
বলেই খুব অল্প সময়ে রামমোহন বেদ ও বেদান্তে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রাচীন হিন্দু
ব্রহ্মজ্ঞান ও মুসলমানি একেশ্বরবাদের সামঞ্জস্য লক্ষ করে ক্রমে ক্রমে তার মধ্যে
প্রচলিত হিন্দু-সংস্কারের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে থাকে। কাশী থেকে ফিরে এসে এই
নিয়ে রামকান্ত ও রামমোহনের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে যায়।
মাত্র ষোল বছর বয়সে রামমোহন এক পুস্তিকা লিখে ফেলেন –
হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী নাম দিয়ে। ছাপা বই না, হাতে লেখা, তবে তার ছত্রে
ছত্রে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। বাবা রামকান্ত প্রচন্ড ধর্মভীরু, তিনি এসব
অন্যায় আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। বাড়ি থেকে বের করে দিলেন রামমোহনকে।
বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি কিছুকাল তিব্বতে
কাটিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের আচার-ব্যবহার-কথাবার্তা সম্যকরূপে পর্যবেক্ষণ করে
রামমোহন একসময় ফিরে এলেন। তিব্বতে দেখে এলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনযাত্রা।
পরে রামমোহন
কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গেও ওঠাবসা শুরু করলেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বিভিন্ন ধর্মের
মানুষের সংস্পর্শে এসে তিনি এক উদার হিন্দুধর্ম প্রচলন করেন, যার নাম দেওয়া হয়
ব্রাহ্মধর্ম। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা প্রিন্স দ্বারকানাথ, যদিও বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক
ছোট, ছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু।
আধুনিক
লেখাপড়া তখনও দেশে শুরুই হয়নি। মাত্রই কয়েক বছর হল শ্রীরামপুরে তৈরি হয়েছে প্রথম
ছাপাখানা। উইলিয়ম কেরির নেতৃত্বে সেখানে ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন দেশীয় ভাষায় বাইবেল ও
সামান্য কিছু বাংলা বই। রামমোহন নিজেই বাংলায় লিখে ফেললেন বেদান্তের অনুবাদ ও
ভাষ্য। আত্মীয়সভা নামে এক সভা স্থাপন করেন। ইংরাজিতে লিখলেন বাংলা ব্যাকরণ বই,
ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যার বইও।
সেই সঙ্গে
চলল ইংরেজ বড়লাটের কাছে স্কুল-কলেজ খোলার আবেদনও। ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে
হিন্দু কলেজ স্থাপনের পর যখন ইংরেজ সরকার সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন,
রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে চিঠিতে লিখলেন, এসব শিখে আমাদের লাভ কী? এ তো আমরা
জানিই, আমাদের টোল-চতুষ্পাঠীতে এসব শেখানো হয়। আমাদের শেখা দরকার গণিত, দর্শন,
জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের মত বিজ্ঞানের বিষয়াদি। ইওরোপে এসব শিখেই
মানুষ উন্নতি করছে। সংস্কৃত মন্ত্র শিখে আমাদের কাজের কাজ কিছু হবে না, দয়া করে
বিজ্ঞানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির ব্যবস্থা করা হোক।
নিজের কাজ
অসমাপ্ত রেখে রামমোহন মারা গেলেন সুদূর ব্রিস্টলে, ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর।
তার ঠিক ছত্রিশ দিন পরে, ২রা নভেম্বর হাওড়ার পশ্চিমে পাইকপাড়া গ্রামের এক দরিদ্র
পরিবারে জন্ম হল মহেন্দ্রলাল সরকারের। বাল্যেই তিনি মা-বাবাকে হারান, মানুষ হন
কলকাতার নেবুতলায় মামার বাড়িতে। পড়াশুনা প্রথমে পাঠশালায়, পরে ডেভিড হেয়ারের
স্কুলে। ষোল বছরে জুনিয়র বৃত্তি পেয়ে হিন্দু কলেজে, একুশে মেডিক্যাল কলেজে। মেধাবী
ছাত্র মহেন্দ্রলাল পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়ে এল এম এস ডিগ্রি পেলেন।
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় তার বছর দুই আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জগদীশচন্দ্র
বসুর বয়স বছরখানেক। প্রফুল্লচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ এরা জন্মাননি তখনও।
শুভানুধ্যায়ীদের
পরামর্শে মহেন্দ্রলাল এর পর এম ডি পরীক্ষা দিলেন ও ১৮৬৩ সালে প্রথম স্থান অধিকার
করে পাশ করলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি দ্বিতীয় এম ডি, প্রথমজন ডাক্তার
চন্দ্রকুমার দে।
চিকিৎসা
শুরু করতে গিয়ে অবশ্য তিনি এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। সাধারণ মানুষের
মধ্যে শিক্ষার আলো বিন্দুমাত্র নেই, কুসংস্কারে ও যুক্তিহীন বিশ্বাসে চালিত তারা।
অধিকাংশই হতদরিদ্র, চিকিৎসা করবেন যে, ওষুধ কেনার পয়সা নেই রোগীর। তাহলে রোগ সারবে
কী করে?
রাজেন্দ্রলাল
দত্ত ও অন্যান্য কয়েকজনের সংস্পর্শে এসে তিনি এ সময় হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসী হয়ে
ওঠেন। ডাক্তারদের বিশেষ অধিবেশনে তিনি জোর দিয়ে হোমিওপ্যাথির যথার্থতা নিয়ে
বক্তব্য রাখায় ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। তিনি সেসব
পাত্তা না দিয়ে শুরু করেন এক নতুন চিকিৎসার জার্নাল – ক্যালকাটা জার্নাল অফ
মেডিসিন। নিজে লিখে প্রকাশ করতে থাকেন তার নিজস্ব চিকিৎসার অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন
বিচিত্র বিষয়ের ওপর সেই সব লেখা ছাপা হতে থাকে।
এই লেখার
ফাঁকেই তার মনে এই ভাবনার উদয় হয় – ভারতের মানুষদের বিজ্ঞানচর্চায় যদি ইংরেজ সরকার
উৎসুক না হয়, তবে ভারতীয়রা নিজেই নিজেদের চেষ্টায় কেন একটা বিজ্ঞানকেন্দ্র খুলতে
পারে না? দেশীয় রাজাদের হাতে পয়সা কম নেই। তারা বাবুগিরি করে টাকা ওড়ায়। চেষ্টা
করলে কি তাদের এ ব্যাপারে রাজি করানো যায় না?
১৮৬৯ সালের
অগাস্টে ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিনে ছাপা হল মহেন্দ্রলালের প্রতিবেদন – অন দ্য
ডিজায়ারেবিলিটি অফ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেজ বাই দ্য নেটিভস অফ ইন্ডিয়া। বেরোনোর
সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রতিবেদন সাড়া ফেলল কলকাতার সমাজে। দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দ্য
ইংলিশম্যান প্রভৃতি পত্রিকায় এই লেখার ওপর মন্তব্য ছাপা হল। মহেন্দ্রলাল উৎসাহিত
হয়ে এগিয়ে গেলেন আরও এক ধাপ। নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ছাপিয়ে দিলেন এক অনুষ্ঠান পত্র,
ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা শুরু করার অভিপ্রায় জানিয়ে। তাতে তিনি ব্যাখ্যা করলেন
বিজ্ঞান কী, আগে ভারতে কেমন বিজ্ঞানচর্চা হত, সেসব অবলুপ্তির পথে চলে গেছে জানিয়ে
নতুন করে ভারতীয়দের দ্বারা বিজ্ঞানচর্চা শুরু করার জন্য এক বিজ্ঞানকেন্দ্র খোলা
হবে, সেকথা জানিয়ে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থদানের অনুরোধ করলেন। মহেন্দ্রলাল লিখলেন,
সকলেই অগ্রসর হউন। যিনি এক দিনে লক্ষ মুদ্রা দান করেন, তিনি কেন পশ্চাতে পড়েন?
পুত্রকন্যার বিবাহে যারা লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করেন, তাঁরা কেন নিশ্চিন্তে বসিয়া
থাকেন? একবার মুক্ত হস্তে দান করিয়া সমাজ স্থাপন করিয়া স্বীয় ভ্রম দূর করুন।
বঙ্গীয় যুবকগণের অবস্থার উন্নতিসাধন করুন। বঙ্গের শিল্পবিদ্যার
পুনরুদ্ধার করুন।
এই খবরও
ছাপা হল বিভিন্ন দেশি সংবাদপত্রে। অধিকাংশ খবরের কাগজই ইংরাজি। বঙ্কিমচন্দ্র তখন
সদ্য চালু করেছেন তাঁর নতুন সাহিত্যপত্রিকা বঙ্গদর্শন। সেই পত্রিকার প্রথম বর্ষের
পঞ্চম সংখ্যায় তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে শুধু মহেন্দ্রলালের অনুষ্ঠান পত্রটিই নয়,
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় চর্চার উপযোগিতা নিয়ে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে বঙ্গদর্শনের
পাঠকদের এই মহান কার্যকলাপে অংশগ্রহণের আবেদন জানালেন। লিখলেন, উদ্দেশ্য অতি মহৎ,
তাহাতে আর সন্দেহ কী! বিজ্ঞান সাধনায় উৎসাহিত করতে গঙ্গাধর চ্যাটার্জী নামে একজন
পরজ রাগিনীতে লিখে দিলেন একটা গানও।
সেন্ট
জেভিয়ার্স কলেজে তখন বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা পড়াতেন ফাদার লাফোঁ নামে এক পাদ্রি।
তিনি মহেন্দ্রলালের সঙ্গে লেগে পড়লেন এই ব্যাপারে। ধর্মপ্রচারে ব্যস্ত বঙ্গীয়
ক্যাথলিক সমাজ তাদের অনুমোদন প্রদান করল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট, পায়োনিয়র, দ্য
বেঙ্গলী, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান স্পেকটেটর, দ্য স্টেটসম্যান, বিহার হেরাল্ড,
দ্য ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি পত্র পত্রিকায় লেখালিখি চলতেই থাকল। ফাদার লাফোঁ এশিয়াটিক
সোসাইটিতে আহ্বান জানালেন এই মহান ব্রতে সামিল হওয়ার জন্যে।
চাঁদার বই
নিয়ে মহেন্দ্রলাল ঘুরতে লাগলেন রাস্তায় রাস্তায়। প্রথম চাঁদা দিলেন বাবু জয়কিষেণ
মুখার্জি, এক হাজার টাকা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দান করলেন এক হাজার টাকা।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দ্বিজেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর দিলেন এক হাজার টাকা
করে। হাইকোর্টের জজ রমেশচন্দ্র মিত্র দিলেন দু’হাজার টাকা। কাশিমবাজারের মহারানি
স্বর্ণময়ী দিলেন আট হাজার টাকা। বঙ্কিমচন্দ্র দিলেন পাঁচশো টাকা। মহেন্দ্রলাল নিজে
দিলেন এক হাজার টাকা। সাত বছর ধরে আবেদন নিবেদন চালিয়ে সংগ্রহে এল পঁচানব্বই হাজার
সাতশো ছেচল্লিশ টাকা।
১৮৭৬ সালে
বাংলার তদানীন্তন সরকার মহেন্দ্রলালের আবেদনে সাড়া দিয়ে ২১০ বৌবাজার স্ট্রিটে একটা
বাড়ি এই শর্তে হস্তান্তর করে যে সংগৃহীত টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা সরকারি খাতে
ব্যয় করতে হবে ও প্রতি মাসে জার্নাল থেকে ১০০ টাকা করে আয় দেখাতে হবে। ঐ বছরেরই
জুলাই মাসে অ্যাসোসিয়েশনের কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। চার বছর বাদে অ্যাসোসিয়েশন জমিসহ
বাড়িটি তিরিশ হাজার টাকায় কিনে নেয়।
কিছু কিছু
উল্লেখযোগ্য দান আসতে থাকে। কালীকৃষ্ণ ঠাকুর গবেষণাগার বানানোর জন্যে দান করেন
পঁচিশ হাজার টাকা। তা দিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়। তিরিশ হাজার টাকা ব্যয় করে
তৈরি করা হয় একটা লেকচার হল, আধুনিক পদ্ধতিতে লেকচারের সুব্যবস্থা করতে।
অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা সেই টাকা নিজেরাই তুলে দেন; দ্বারভাঙার মহারাজ দান করেন
পাঁচ হাজার টাকা। লেকচার থিয়েটারের উদ্বোধন করতে আসেন ভাইসরয় লর্ড রিপন।
অবশ্য
বাড়িটার অবস্থা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। ১৮৮৯ সালে সেটাকে ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা
হয়, তার জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেন ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা। তার নামানুসারে
ল্যাবোরেটরির নাম করা হয়।
প্রথম দিকে কেবলমাত্র
বিজ্ঞানের কোনও বিষয়ের ওপর বক্তৃতাই ছিল এর একমাত্র কাজ। বক্তৃতা দিতেন
মহেন্দ্রলাল নিজে, ফাদার লাফোঁ ও তারাপ্রসন্ন রায়। অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গতি ছিল না
বক্তাদের বেতন দেওয়ার। নামমাত্র চাঁদার বিনিময়ে যে কেউ এসে এইসব বক্তৃতা শুনতে
পারত। অন্যান্য কলেজের ছাত্ররাও এই বক্তৃতা শুনতে আসত। তাদের মধ্যে আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্রও ছিলেন।
১৮৮০ সালে
কুমার কান্তিচন্দ্র সিং বাহাদুর বিজ্ঞানসভাকে একটা দূরবিন দান করেন, সেটা তৈরি
করেছিল জার্মানির বিখ্যাত দূরবিন-নির্মাতা মেৎর্জ। দরকারি সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য
করেছিল ইংল্যান্ডের ব্রাউনিং। ঋতু পরিবর্তন দেখানোর যন্ত্রপাতি, সূর্য ঘড়ি, সূর্য
ও চন্দ্রগ্রহণ, গ্রহ পরিক্রমা ইত্যাদি হাতে-কলমে দেখানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
কেনা হয়েছিল। জগদীশ্চন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখার্জি, মহেন্দ্রনাথ রায়, শ্যামাদাস
মুখার্জি, রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতিরা পদার্থবিদ্যায় বক্তৃতা করতেন।
রসায়নের ক্লাস নিতেন কানাইলাল দে, তারাপ্রসন্ন রায়, রামচন্দ্র দত্ত, রজনীকান্ত
সেন, চুনিলাল বসু প্রমুখ।
এসব
সত্ত্বেও মহেন্দ্রলালের মনের গভীরে যে সুপ্ত বাসনা ছিল, যে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা
নিজেদের গবেষণা দিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানকে পরিপুষ্ট করবে, আবিষ্কার করবে নতুন তত্ত্ব,
নতুন প্রযুক্তি বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে, তা আর হয়ে উঠল না।
অ্যাসোসিয়েশনের কাজ কেবলমাত্র বক্তৃতাতেই থেমে রইল তাঁর জীবদ্দশায়। এক এক বছর যেতে
লাগল, আর তিনি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলেন। যেখানে ভেবেছিলেন উদার হস্তে
রাজা-রাজড়ারা চাঁদা দেবে, দু একজন বাদে কেউ উপুড়-হস্তই হতে চায় না। এমনকি একজন
অধ্যাপককেও মাইনে দিয়ে পাকাপাকি চাকরি করে দেওয়ার অবস্থায় পৌঁছাতে পারল না
অ্যাসোসিয়েশন।
বিদেশ থেকে
খবর আসে ইংল্যান্ডের অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ ফল কাজে লাগিয়ে অমুক
কোম্পানি বিশাল কারখানা খুলেছে, সেখানে চাকরি করছে কয়েক হাজার মানুষ।
মহেন্দ্রলালের ক্ষোভ বেড়ে যায়। আরে এ তো আমাদের দেশেও সম্ভব ছিল, সম্ভব ছিল এই অ্যাসোসিয়েশনেই।
কিন্তু হচ্ছে কই!
মড়ার ওপর
খাঁড়ার ঘায়ের মত খবর এল, জাপান থেকে শিকাগো যাওয়ার পথে জাহাজে স্বামী বিবেকানন্দের
সঙ্গে মোলাকাৎ হয়েছে ব্যবসায়ী জামশেদজি টাটার। স্বামীজী তাকে ভারতে বিজ্ঞানকেন্দ্র
চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন। টাটা সেই পরামর্শ গ্রহণ করে দক্ষিণ ভারতে অনেক
অর্থব্যয়ে বিজ্ঞানকেন্দ্র চালু করতে চলেছে। মহেন্দ্রলালের এই অ্যাসোসিয়েশন এতদিন
ধরে শুধু অন্যের আবিষ্কারের কাহিনিই পড়িয়ে এল, নিজে কিছু করতে পারল না, আর এরা
তাঁকে ফেলে এগিয়ে যাবে!
দীর্ঘ আঠাশ
বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে, লোকের দরজায় দরজায় টাকার জন্যে ঘুরে, বিভিন্ন জায়গায়
বিজ্ঞানের উপকারিতার ওপর বক্তৃতা করে, নিজের পেশায় অর্থ-উপার্জনে অবহেলা করে এবং
নিজের উপার্জিত অর্থের সর্বস্ব পণ করে মহেন্দ্রলাল যে স্বপ্ন বুনেছিলেন, তা তাঁর
অধরাই থেকে গেল। অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হিসাবে তিনি প্রতি বছর বার্ষিক
অধিবেশনে বক্তৃতা করতেন। জীবনের শেষদিকে তাঁর সেই বক্তৃতায় নেমে এল করুণাঘন বিষাদ।
বলেই ফেললেন, আমার এই কাজ শুরু করাই ভুল হয়েছিল। এর চেয়ে নিজের কাজটা মন দিয়ে করলে
আমি আজ লাখপতি হতে পারতাম, হয়ত দেশকে সেভাবেই বেশি সেবা করতে পারতাম। অন্যান্য
দেশে এরা কতদূর এগিয়ে গেল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। সভাস্থ সকলের উদ্দেশে তিনি
বললেন, আমার বয়স হয়েছে, আমার শরীরে আর শক্তি নেই। আমার যতটুকু সামর্থ্য আমি তার
সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালিয়েছি। Now my
weary lips I close, Leave me, leave me to repose.
১৯০৪ সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি মহেন্দ্রলালের জীবনদীপ
নির্বাপিত হয়ে যায়।
* * * *
স্কটস লেনের
বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে রমনের চোখে পড়ে এক ভবনের, তার গেটের ফলকে ইংরাজিতে
লেখা – ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। অদ্ভুত নাম তো –
বিজ্ঞানের চাষের জন্য ভারতীয় সংস্থা! মনে চিন্তা খেলে গেল – কী হয় এখানে? কেমন
বিজ্ঞানের চাষ? হাতে-কলমে বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাসনা তার রক্তে, কিন্তু এম
এ পাশের পর আর তার সুযোগ হ’ল কোথায়? এখানে কি যন্ত্রপাতি আছে? বিজ্ঞানের বই বা ম্যাগাজিন
পড়ার মত লাইব্রেরি আছে?
প্রশ্ন
মাথায় নিয়ে শুধু ঘুরে বেড়ানো রমনের স্বভাবে নেই। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সেই
ভবনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। সামনেই সেক্রেটারির অফিস, সেখানে বসে একটা
বই পড়ছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। তাকেই ইংরাজিতে বললেন তিনি, ও মশাই, শুনছেন, আমার
নাম রমন। আমি ম্যাড্রাস থেকে এসেছি, এখানে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করি।
কিন্তু আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আমার পদার্থবিজ্ঞানে খুব উৎসাহ। আমি কি আমার অবসর সময়ে
এখানে কাজ করতে পারি? এখানে কি ল্যাবরেটরি আছে? যন্ত্রপাতি আছে? লাইব্রেরি, বইপত্র
– এসব আছে? বিজ্ঞানের জার্নাল রাখা হয় এখানে?
সেক্রেটারি
ভদ্রলোক রমনের মুখের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে পড়ে গেল
মহেন্দ্রলাল সরকারের শেষ জীবনের বক্তৃতাগুলো। যে হাহাকার নিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে
চলে গেছেন তিন বছর আগে, তার ধ্বনি কি এতদিনে পৌঁছে গেছে বৃহৎ কারও কানে? তাই বুঝি
তিনি পাঠিয়েছেন এই কৃষ্ণকায় পাগড়ি-পরা দেবদূতকে?
চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বইটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে বললেন, নমস্কার, আমার নাম অমৃতলাল
সরকার। আমার বাবা মহেন্দ্রলাল এই ভবনের প্রতিষ্ঠাতা। আপনার সমস্ত প্রশ্নগুলোর
উত্তরই – হ্যাঁ। বস্তুত বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেই এই অ্যাসোসিয়েশন তিনি
তৈরি করেছেন তিরিশ বছর আগে। যন্ত্রপাতিও আছে কিছু কিছু, কিন্তু তাদের ব্যবহার হয়
খুবই কম। আপনার মত অনিসন্ধিৎসু মানুষের জন্যেই তিনি এসব করে গেছিলেন, অথচ তাঁর
জীবদ্দশায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মানুষ তিনি দেখে যেতে পারেননি। আপনার যখন যেমন
খুশি আপনি এই বিজ্ঞানাগার ব্যবহার করতে পারেন।
করমর্দনের
জন্যে রমনের বাড়িয়ে দেওয়া হাত নিজের হাতে ধরার বদলে তিনি রমনকে বুকে জড়িয়ে
ধরলেন।
(ক্রমশ)
Beautiful. Admire the skills of the authour, the way it is described connecting several incidents involving many characters in a very relevant manner.
ReplyDeleteAll the very best to Amitava...
Sukumar Roy