গল্পের ম্যাজিক:: উড়নচন্ডী সরোজমামা - সঞ্জয় মিত্র


উড়নচন্ডী সরোজমামা
সঞ্জয় মিত্র

আমাদের বাড়িটা হুল্লোড়ে-টাইপ বরাবর বাবা সরকারি ডাক্তার, আসানসোলে পোস্টেড ছিলেন বহু বছর বাড়িটা শহরের পশ্চিমপ্রান্তে বাবা আর ছোটকাকা মিলে এক লপ্তে জমিটা কিনে পাশাপাশি দুটো বাড়ি করেছিলেন বাড়ি দুটোর নাম দিয়েছিলেন অদ্ভূত - চুলোচুলিআরগলাগলি ছোটকাকা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার শহরজোড়া পসার সকাল থেকে চুলোচুলিবাড়ির দোর থেকে বাইরের রোয়াক পর্যন্ত রুগিদের লাইন লেগে যেত ছোটকাকা ছিলেন দারুণ খিটখিটে কপালে একটা লাল তিলক কেটে থাকতেন সর্বদা সকাল সাতটা থেকে রুগিরা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে তিরিক্ষে হয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিত বেলা এগারোটা নাগাদ ছোটকাকা আসতেন চেম্বারে সব চুপচাপ হয়ে যেত নিমেষে
রবিবার এলে সবকিছু এলোমেলো বোনো পিসেমশাই ভোর ছ’টায় হাজির হয়ে যেতেন বনমালি রায় আমাদের ছোট পিসেমশাই সংক্ষেপে বোনো হাতে প্রকান্ড ঠোঙায় সদর বাজার থেকে কেনা গরম তেলেভাজা আর জিলিপি মোড় থেকে চিৎকারে পাড়া মাতিয়ে গান গাইতে গাইতে ঢুকতেন পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত, ‘আশায় আশায় ভবে আসা, আসা মাত্র হল’ আমি, টুম্পাই, বাবুল, কেষ্ট, মা, বাবা, বুবলি, রাঙাদা, তারপর কাকিমা এই অর্ডারে সব ঘুম ভাঙত সবশেষে উঠত ছোটকাকা উঠেই একটা প্রকান্ড ডাইনোসরের হাই তুলে বলতেন, “এ
এটা শুনে আমাদের কেষ্ট প্রথমদিন চা দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল জানতাম এটা হবে ‘গলাগলি’ থেকে বাবুল আর রাঙাদা গিয়ে চোখে জলের ছিটে দিয়ে বলে, “ব্যস, বুঝে নিলি তো? রোজ হবে ঘাবড়াবি না তো কাল থেকে?
কেষ্ট বলে, “না এজ্ঞে
“ব্যস, এবার সবাইকে চা দিয়ে আয়
চা পর্ব শেষ সঙ্গে তেল চুপচুপে বেগুনি আর ফুলুরি বোনোপিসের ক্লান্তি নেই এক এক করে চলছে ডাক ছেড়ে শ্যামাসঙ্গীত পাক্কা দশটায় তাড়া তাড়া লুচি-বেগুনভাজা আসতে থাকে পিসেমশাই ধবধবে সাদা পাম্প শ্যুয়ে পা গলিয়ে বলবে, “চলি গো, দরজাটা দিয়ে দাও
মায়ের সবিনয় অনুরোধ, “জামাইবাবু, একটু বসে যান আপনার লাল ফুলকোগুলো এবার ভাজা হচ্ছে
বোনোপিসে শুনবে না যাবেই কারণ, ওর বাড়িতে তাসের আড্ডাটা এখনই বসবে এদিকে আমাদের গলাগলিথেকে রাঙাদা চেঁচাচ্ছে, “বুবলি, তোর হল? কখন ঢুকেছিস! বাথরুমটা এবার খালি কর
বাবুল চুলোচুলিতে একতলায় মালির ওপর চেঁচাচ্ছে, “আরে ধুর, অমনি এক গামলা করে খোল মেশাচ্ছ কেন? ডালিয়ার মাটি তৈরি করতে জান না?”
রান্নাঘর থেকে মা আর কাকিমা হুড়ো লাগাচ্ছে, “ওরে মন্টির মা, দুটো ঘর ঝাঁট দিতেই আধঘন্টা লাগিয়ে দিলে! বাটনাটা আর কখন বাটবে?”
ওদিকে বাবা ছুতোরমিস্ত্রি নিয়ে এসেছেন, দড়াম দড়াম করে ঠোকাঠুকি চলেছে দোতলার ঘরে

একদিন আমাদের বাড়িতে সরোজমামা এসে হাজির হল
ছ’ফুট লম্বা মেন দরজা পেরিয়ে ভেতরের দরজাটা বেশ উঁচু সেখানেও ওর মাথা ঠেকে যায় মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি সামনের দাঁত বেশ কয়েকটা পড়ে গেছে মাথার চুল ঘন, উসকোখুসকো সরোজমামা ছোটকাকিমার পিসতুতো ভাই থাকে বেলুড়ে আসানসোলে কোথায় একটা স্কুলে টিচারের চাকরি পেয়েছে এমনিতে বেশ মজার লোক শান্ত এবং আমুদে কোনও ঝামেলা-টামেলা নেই
সরোজমামাকে ওপরের চিলেকোঠার ঘরটা দেওয়া হল তাতেই মহাখুশি কাকিমার কাছে শুনেছি, মানুষটা একটু খামখেয়ালি কোনও জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকতে পারে না সেকেন্ডারি পাশ করে হঠাৎ একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল এর আগেও সরোজমামা কয়েকবার উধাও হয়েছিল একবার হলদিয়া, আর একবার মোগলসরাই
সরোজমামা তখন ক্লাস এইটে পড়ে বড়দা, পঙ্কজমামা আর পাড়ার মাতব্বররা খুঁজে খুঁজে কোথাও না পেয়ে যখন থানা-পুলিশ করতে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ হাজির মুখে একগাল হাসি সঙ্গে কিচ্ছু নেই খালি হাতে যাওয়া, খালি হাতে আসা  জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে না পাড়ার বিশুজ্যাঠা লাঠি উঁচিয়ে বলেছিল, “কোথায় ছিলি বল হতভাগা নইলে দেখেছিস তো, এই লাঠি দিয়ে দু-দু’বার ডাকাত ভাগিয়েছি বলবি কি না?”
সরোজমামা একগাল হেসে বলে, “কেন বলব না! এই তো বলছি, আমি মোগলসরাই গিয়েছিলাম
“কেন, ওখানে কী কত্তে গিছিলি?
“বাহ্‌ রে! আমার ইচ্ছে হল, বেরিয়ে পড়লাম হঠাৎ দেখি মোগলসরাই পৌঁছে গেছি
“ট্রেনভাড়ার পয়সা কোথায় পেলি?
“বললাম, পয়সা নেই যদিও ছিল শ-তিনেক টাকা, মেন্টাল ম্যাথম্যাটিকস কম্পিটিশন থেকে পাওয়া ওরা পুলিশে চালান করল তারপর ছেড়েও দিল হেঃ হেঃ কয়েক ঘা দিয়েওছিল
“কোন থানায় ছিলি?
“কেন, রেলপুলিশ থানায়! ওদের চমৎকার ব্যবস্থা কী চমৎকার রান্না, কী বলব
“ওখানে তো দাগি খুনে ডাকাতরা থাকে শুনেছি রে!”
“হ্যাঁ, ছিল তো ছিলু আহমেদ বলে একটা ওয়াগন ব্রেকারের সঙ্গে একটা ঘরে ছিলাম লোকটার কনুই ভাঙা, ঠোঁটের ওপর থেকে গালের ডানদিকের মাংস পুলিশ মেরে খুবলে নিয়েছে ছিলু লোকটা খুবই ভালো পুলিশটাও খুবই ভালো, খুব অমায়িক
“শুধু কয়েক ঘা? আর কী করল ঠিক করে বল হতভাগা
সরোজমামার মুখে হাট করা হাসি, “না বলার কী আছে? জামাপ্যান্ট খুলে জমা রেখে বলল, আগে টিকিট কেটে নিয়ে আয়, তারপর জামা-টামা ফেরৎ পাবি হেঃ হেঃ
মামার বউ রত্নামামি শিউরে উঠে মুখ চাপা দিয়ে বলে, “ও-ও মা গো
বিশুজ্যাঠা খানিক ইতস্তত করে বলল, “কী করলি তুই?
সরোজমামা বলে, “পুলিশের কথা মানতে হবে না? কাউন্টার থেকে টিকিটটা কেটে নিয়ে এলাম, জামাপ্যান্টও পেয়ে গেলাম অসুবিধে কিছু নেই
“কাউন্টারে লাইন ছিল না?
“ওরে ব্বাবা, সে কী লাইন! পাক খেয়ে চলে গেছে রিক্সো-স্ট্যান্ড পেরিয়ে
“তুই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলি উদোম হয়ে?
“তিন মিনিটও না সে এক মজার কান্ড, জানো তো বিশুজ্যাঠা লাইনে যেই দাঁড়ালাম, সামনের লোকটা আমাকে দেখেই ঝড়ের বেগে পালিয়ে গেল এক পা এগোই আবার সামনের লোক পালায় আবার এগোই চক্ষের নিমেষে কাউন্টারের মুখে

কিন্তু এবার চারদিন গেল, পাঁচদিন গেল কোথায় সরোজমামা! সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে কয়েকদিন পর কী হল সরোজমামার? কোথায় পালাল, কেন পালাল? গাড্ডু মারার ভয়ে ? না না, তা কী করে হয় সরোজমামা ছাত্র হিসেবে মোটেই খারাপ নয় ইংরিজি বাংলায় ততটা ওস্তাদ না হলেও অঙ্কে বরাবর একশোয় একশো দিন সাতেক পর হঠাৎ ভোরবেলা হাজির হাতে আর গলায় পেঁচিয়ে আছে ফুট পাঁচেক একটা সাপ নাক মুখ ল্যাজের দিকটা দিয়ে ঢাকা, চোখদুটো কোনোরকমে খোলা সাপের গা-টা ড্রেন পাইপের মতো মোটা পঙ্কজমামা পুরনো হ্যারিকেনটায় রঙ লাগাচ্ছিলেন দৃশ্যটা দেখে ঘাবড়াবার সময়ও পেলেন না হ্যারিকেন নিয়ে উঠোনের মাঝে সটান মাদাম তুসোর মোমের মূর্তি হয়ে গেলেন বাঁচিয়ে দিল সরোজমামাই সাপের মাথাটাকে একদিকে সরিয়ে বললেন, “এই যে, আমি সরোজ
কী ব্যাপার? ব্যাপার কিছুই নয় সরোজমামা এবার বেশি দূর যায়নি, কাছেই এই হাওড়ায় পাঁচলা বলে একটা গ্রাম আছে তার দক্ষিণপ্রান্তে কিরাতেশ্বর ওঝার আস্তানা কিরাতের বডি দেখা যায় না শয়ে শয়ে সাপ জড়িয়ে থাকে সারা শরীরে বহু লোক তার চেলা ইদানিং সায়েব-মেম ভক্তও জুটেছে অগুন্তি এমনকি চিনেরাও দলে দলে আসছে শিষ্য হতে বাস-স্ট্যান্ড মোড়ের আশেপাশে মেস করে থাকছে দলে দলে দোকানে, বাজারে প্রচুর চিনে দেখা যাচ্ছে থলি হাতে ট্যাংরামাছ পেলে আর রক্ষে নেই ছোঁ মেরে ঝুড়িসুদ্ধু কিনে নেবে যত দামই চাক কিরাত-ওঝার আস্তানাতেই সরোজমামা ছিল এতদিন পঙ্কজমামা অনেক কষ্টে বললেন, “কোনও কথা নয়, আগে তুই বাড়ি থেকে বেরো পারলে সোজা চিড়িয়াখানায় গিয়ে খাঁচায় ঢুকে পড় এখানে শুধু মানুষের বাস
দড়াম করে এক পেল্লায় শব্দে দরজা বন্ধ হল গোটা দশেক কাক সকালের ব্রেকফাস্ট ছেড়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করে পালিয়ে গেল বেশিদিন অবশ্য সরোজমামা বাইরে থাকেনি রেজাল্ট বেরোবার পরদিনই ফিরে এসেছে একেবারে সাফসুফ ভদ্রলোক হয়ে সঙ্গে কিছুই নেই, সাপটাপ তো নয়ই সরোজমামার ভাগ্যে সেকেন্ড ডিভিশন কিন্তু অঙ্কে একশোয় একশো বলল, “কলেজে ভর্তি হতে হবে তো!”

ইতিমধ্যে বারো বছর কেটে গেছে আসানসোলে মাস্টারি করতে আসা সরোজমামা আমাদের বাড়িতেই উঠেছে যা শুনেছিলাম, দেখে তা মনে হল না এত বছরে মানুষের অনেক পরিবর্তন হয় ইতিমধ্যে ওর বিয়েও হয়ে গেছে কিছুদিন ইন্সিওরেন্সের দালালি, জমির দালালি আর অঙ্কের টিউশানি চালাবার পর আবার কোথায় উধাও হয়ে যান শুনেছি ফিরে এসে হোমিওপ্যাথি, তারপর জ্যোতিষচর্চা ইতিমধ্যে পঙ্কজমামা রিটায়ার করেছেন ফ্যামিলিতে রোজগার কমে গেছে পঙ্কজমামা সাফ বলে দিলেন, “সরোজ, আমি আর পারব না সাকুল্যে পাঁচ হাজার টাকা আমার পেনশন এতগুলো লোকের খরচাহু হু করে বেড়ে যাচ্ছে দাম হয় একটা চাকরিবাকরি ধর, না হলে বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেয়
চাকরি কি অতই সস্তা? অমন অঙ্কে একশো পাওয়া ছেলেরা হাজার হাজার ঘুরে বেড়াচ্ছে সরোজমামার লাকটা ভাল পেপার দেখে অ্যাপ্লাই করেছিল আসানসোলের বিরাজময়ী প্রাইমারি স্কুল সেখানেই হঠাৎ চাকরিটা হয়ে গেল অঙ্কের টিচার পনেরো হাজার টাকা মাইনে, একবেলা খাওয়া ফ্রি খারাপ কী? ঠিক হল, সরোজমামা আপাতত একাই গিয়ে জয়েন করবে যতদিন না একটু থিতু হয় আমাদের এখানেই থাকবে চুলোচুলিবাড়ির চিলেকোঠার ঘরে
চিলেকোঠার ঘরে আগে ছোটকাকা থাকতেন ঘরটা সরু একটা গুহার মতো দরজা, জানালা কিছু নেই শীত কি গরম, একটা মাদুর পেতে সারাবছর ওখানেই মেঝেতে শুয়ে থাকতেন ছোটকাকা একবার ভূত-চতুর্দশীর অন্ধকার রাতে ছাদের আলসেতে দেখেন কে একজন বসে আছে ছোটকাকা চেঁচিয়ে ওঠেন, “এই, কে রে?”
দেখলেন বসে আছেন তিনি নিজেই আলসেতে বসে থাকা ছোটকাকাও তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, “এই, কে রে?”
ছোটকাকা কড়া গলায় বললেন, “কে তুই, এখানে কী চাস?
আলসের ছোটকাকা নেমে এসে পাল্টা বলে, “এখানে কী চাস?
পরদিন ছোটকাকার তেড়ে জ্বর চারদিন ধরে জ্বর আর ছাড়ে না পাঁচদিনের দিন সুস্থ হলেন সেই থেকে চিলেকোঠায় আর যাননি সেখানে এখন সরোজমামা দিব্যি আছে, কোনও ঝামেলা নেই ভোর চারটেয় উঠে ভিজানো ছোলা চিবোতে চিবোতে গোটা পাড়াটা চক্কর কাটা সাড়ে ন’টায় ছোটকাকিমার তৈরি রুটি-তরকারি খেয়ে চলে যায় নিজের মনেই খোশমেজাজে থাকে সরোজমামা বিরাজময়ী প্রাইমারি স্কুলটা এখান থেকে অনেকটা দূর বাসে একঘন্টা লাগে


সরোজমামা আমাদের কাছে বেশ মাই ডিয়ারই টুম্পাই একদিন বলে, “সরোজমামা, মাঝে মাঝে উধাও হয়ে কোথায় চলে যেতে শুনেছি কোথায় যেতে বলতে হবে
বুবলি বলে, “হ্যাঁ, আজকে ছাড়ান নেই বলতেই হবে
বাবুল বলে, “প্রথমে কোথায় গেলে?
রাঙাদা একটা ব্লেড দিয়ে পেন্সিল কাটতে কাটতে বলল, “আমি সব জানি
তারপর চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড পরে শিসটায় একটা ফুঁ মেরে বলল, “সবকিছু কি সবাইকে বলা যায়?
সরোজমামা কথাটা এড়িয়ে বলে, “হেডুটা বড়ো বাড়াবাড়ি করছে, বুঝলি সব ক্লাসগুলো আমার ওপর চাপাচ্ছে আবার মহিমকে দিয়ে গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে, আমি কীরকম পড়াই মহিম ওর শালা কী ইংরিজি পড়ায় শোন ছেলেদের পড়াচ্ছে, আই পুটেড দি বুক অন দি টেবল দে আর সাঁতারিং ইন দি ওয়াটার হেডু একদিন করিডর দিয়ে যাচ্ছিল ক্লাসসুদ্ধু ছেলেরা তখন পাল্লা দিয়ে চেঁচাচ্ছে, দে আর সাঁতারিং ইন দি ওয়াটার দে আর শুনে হেডু খানিকটা থতমত ক্লাসে ঢুকে বলল, মহিম তুই আমার ঘরে দেখা কর এক্ষুনি ঘরে ঢুকতেই মহিমের কানটা মুচড়ে বলল, এই জ্ঞান নিয়ে পড়াতে এয়েছিস হতভাগা? ইস্কুলসুদ্ধু সব্বোনাশ করবি আজই বেরো মহিম বলে, আমার কী দোষ! যে লাস্ট বেঞ্চের গুঁপো ছেলেটা, ও হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কেন, সার, ওরা সাঁতার কাটছে, ইংরিজি কী হবে?
“আচ্ছা শোন না কাল রবিবার সবাই মিলে দোমহানির মেলায় যাবি?
আমরা এককথায় রাজি বাবা কাকারা সদা ব্যস্ত কোথাও বড়ো একটা যাওয়া-টাওয়া হয় না দোমহানি এখান থেকে একঘন্টার পথ বাবাকে রাজি করানো গেল কিন্তু ছোটকাকা বেঁকে বসলেন, “না, সরোজটার ওপর ভরসা করে এতদূর যেতে দেওয়া যায় না
শেষে অতগুলো ভাইবোনের জেদের কাছে ছোটকাকার বারণ টিকল না
দোমহানি প্রায় বিহারের বর্ডারে রুক্ষ মাটি রাস্তাও প্রচন্ড খারাপ ছ্যাকড়াগাড়ির মতো একটা বাস তাতেই চেপে বসেছি আমরা ক’জন বাসে বেশ ভিড় প্রথমে ফাঁকাই ছিল একটু পরে কাতারে কাতারে লোক উঠতে লাগল সঙ্গে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বুবলি আর টুম্পাই ছাড়া কেউ বসার জায়গা পাইনি পায়ের ওপরেই হাঁস-মুরগিগুলোকে চাপিয়ে দিল মানুষের ভিড়ের চাপে গা চিঁড়ে-চ্যাপ্টা পা রাখার জায়গা পাচ্ছি না সরোজমামা বসে আছে ড্রাইভারের কোলে একটু বেঁকে গিয়ে ড্রাইভারের চোখের সামনেটা ক্লিয়ার রেখে খোশমেজাজেই বসে আছে চোখাচোখি হতেই বলল, “হে হে, বুঝলি না? আজ হাটবার কিনা...
হঠাৎ সরোজমামার চিৎকার, “আরে ছিলু মিঞা, কা খবর বা জেল সে কব নিকলা? এই ড্রাইভার, গাড়ি রোক না
ড্রাইভার পাত্তা না দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল সরোজমামাও জেদি কম না দু’হাতে ড্রাইভারের চোখদুটো চেপে ধরল ড্রাইভার আর কী করে তৎক্ষণাৎ বাসটা থামাতে বাধ্য হল সে কিছু বোঝার আগেই চোখের পলকে সুড়ুৎ করে সরোজমামা নেমে গিয়ে যে লোকটাকে জড়িয়ে ধরল, তাকে দেখে বাসসুদ্ধু লোকের ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল লোকটার পরনে লাল লুঙ্গি তার কনুই ভাঙা হাতটা ঝুলছে গাছে ফলে থাকা সজনেডাঁটার মতো ডানদিকের গালটা নেই তার জায়গায় এত বড়ো একটা গর্ত ঠোঁটটা ছাড়ানো কাঁঠালের খোলার মতো উল্টোমুখে ঝুলছে ভেতর থেকে শ্বদন্তের মতো মাড়ি ফুঁড়ে বড়ো বড়ো দাঁত বেরিয়ে আছে যেন ভাঙা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা লোহার শিক সরোজমামাকে দেখে ছিলু মিঞা হাসতে লাগল, খ্যাক খ্যাক খ্যাক দু’জনে জড়িয়ে ধরে কী হাসি গল্প আর থামতেই চায় না এদিকে বাস দাঁড়িয়ে গেছে ড্রাইভার হর্ন দিয়ে যাচ্ছে পোঁ পোঁ
কী মুশকিল! প্রায় পাঁচ মিনিট হয়ে গেল গাদাগাদি ভিড়ে মানুষজন মরো মরো মুরগিগুলো কোঁকোর-কোঁ আর ছাগলগুলো ম্ম্ম্‌…ব্যাহ্যাহ্যাহ্যা, ম্ম্ম্‌…ব্যাহ্যাহ্যাহ্যা করতে করতে হদ্দ হয়ে যাচ্ছে ঝুড়ি-ঝোড়া নিয়ে বাজারের মাসিরা চেঁচাচ্ছে, “ছাড় না রে বাপ কী কচ্চিস বল দিনি
সরোজমামার ভ্রূক্ষেপ নেই পরমানন্দে হাত-টাত নেড়ে পুরনো স্যাঙাতের সঙ্গে আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছে
দশ মিনিট পার ড্রাইভার এবার তেড়ে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল যাহ্‌, এবার কী হবে! সরোজমামাকে ফেলে রেখেই বাস চলে যাচ্ছে যে!
“ও সরোজমামা
সরোজমামার কোনও ভাবান্তর নেই বাসটা গতি নেওয়ার অনেকক্ষণ পর হাতটা সামান্য নাড়াল তাতে বোঝায় ঠিক আছে, যা তোরা, কথাই রইল তবেগোছের একটা কিছু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাস চলতে লাগল রুক্ষ মাঠ, দূরে আলুর ক্ষেত, ছড়ানো ছেটানো শালবন ফেলে রেখে বাস দুদ্দাড়িয়ে চলেছে রোদে পুড়ে ইঞ্জিন ফুঁসছে প্রবল আমরা চেঁচাতে লাগলাম পাল্লা দিয়ে কিন্তু কে শোনে ঝরঝরে মান্ধাতার আমলের ইঞ্জিন তার সঙ্গে ‘প্র্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ জাতীয় নাড়িভুঁড়ি ছেঁড়া এক হর্ন আমাদের সব চিৎকারের শব্দ গিলে নিয়ে টর্পেডোর মতো ছুটতে লাগল
একটু দূরে একটু গঞ্জমতো বাস সেখানেই থামল ঝাঁকা বুঁচকি নিয়ে সব হুড়হুড়িয়ে নেমে যাচ্ছে আমরা অজানা আশঙ্কায় বেশ খানিকটা আতঙ্কিত কারও পকেটে একটাও পয়সা নেই দোকানের সাইনবোর্ডে দেখা যাচ্ছে জায়গাটার নাম দোমহানি হাট আমরা চারজন, কিন্তু মনে হচ্ছে অজানা দ্বীপের নতুন আগন্তুক সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন মেলা-টেলা মাথায় উঠেছে এখন একটাই চিন্তা এখান থেকে বাড়ি ফিরব কী করে
বুবলি বলল, “এই টুম্পাইটার জন্যেইকেন তুই সরোজমামার কথায় নাচতে গেলি?”
টুম্পাই বলে, “বাহ্‌ বাবুলই তো আমাকে খোঁচাল মেলায় নাকি সার্কাস হয় নররাক্ষস কচর-মচর কাঁচা মুরগি খেয়ে দেখায় মৌবানিরা গত রবিবার দেখে এসেছে
বাবুল বলে, “এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল বুঝি? সবাই মিলেই তো নাচানাচি করলি, দোমহানি যাব, দোমহানি যাব আমি একা নাকি?”
বেশ একটা ঝগড়ার সিন হয়ে যাচ্ছে পথচলতি লোক চেয়ে চেয়ে দেখছে রাঙাদা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল একটা কথাও বলেনি সামনে একটা ফলওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, মেলাটা কতদূর বলতে পারেন?”
লোকটা বলল, “কেন পারব না? তা কোন মেলাতে যাবেন বাবুরা? দু’জায়গায় সংকেরান্তির মেলা বসে তো একটা সামনে, ফুলতাড়ির মাঠে আর, আর একটা রেললাইনের ওপারে বাবু, ভালো মর্তমান কলা ছিল, পাকা পিয়ারা ছিল নেবেন নাকি?”
“না ফুলতাড়ির মাঠটা কোনদিকে?
ফলওয়ালা বেশ খানিকটা হতাশ বিরক্ত মুখে শুধু হাতটা ডানদিকে তুলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল
রাঙাদার বাড়াবাড়িটা অসহ্য লাগছে এখন আমরা মেলায় যাব নাকি? সেই কখন বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছি খিদেয় পেট টেনে ধরে আছে অনেকক্ষণ রাঙাদা গুনগুনিয়ে গান ধরল, ‘কফি হাউসের সেই  আড্ডাটা আজ আর নেই…’
বললাম, “তুমি গান ধরেছ? আমাদের কী হবে এখন?
“কীসের কী হবে?
“এখান থেকে ফিরবে কী করে সেটা ভেবে ঠিক কর
“বাসভাড়ার পয়সা আছে কারও কাছে?
“নেই তো এতক্ষণ শুনলে কী তবে?”
রাঙাদা আবার ধরেছে, ‘নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে…’
আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, “রাঙাদা, কিছু একটা উপায় কর না
“কী আর উপায় না ফিরতে পারলে এখানেই থেকে যাব কয়েকদিন পারলে আরও কিছুদিন মজাই তো হবে

সে যাত্রা মজাটা আর করতে হয়নি সন্ধে হয় হয় এমন সময় ছোটকাকার স্টুডিবেকার বিকট শব্দ ছাড়তে ছাড়তে হাজির হল আমাদের সামনে বাড়িতে সেদিন আমাদের কী দশা হয়েছিল সেটা আর নাই বা বললাম কিন্তু সরোজমামা কোথায়! সেই থেকে বেপাত্তা চিলেকোঠার ঘরে ওর জিনিসপত্র যেমনকার তেমনি রাখা আছে বিছানা-বালিশ, কয়েকটা অঙ্কের বই, পেন, আর একজন অচেনা মানুষের ছবি ছবির পেছনে লেখা, অপেক্ষা কর, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন তলায় সপ্তাহখানেক আগের একটা ডেট দিয়ে সরোজমামার সই করা ফোটোটা বহুবার নানাভাবে দেখেও ছোটকাকিমা চিনতে পারলেন না জ্ঞাতি-গুষ্টি সবাইকে দেখানো হল কেউই ফোটোর মানুষটাকে চেনে না ওটা এলই বা কোত্থেকে! হঠাৎ একদিন রাঙাদা বলল, “হ্যাঁ, একে খুব ভালো চিনি ছবিটা সরোজমামা নিয়ে গেলেই পারত এটা ওর ভীষণ দরকার
খিল আঁটা খটকা রাঙাদা কেন বলল কথাটা? সেদিন এই রাঙাদাই দোমহানিতে বলছিল, এখানেই থেকে গেলে হয় আগে একদিন বলেছিল উড়নচন্ডী সরোজমামার সব ঘটনা জানে এর কয়েকদিন পর রাঙাদা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় স্বভাবমতোই সরোজমামা কিছুদিন পরে ফিরে এসেছিল কিন্তু রাঙাদার কোনও খবর পাওয়া যায়নি আজও
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জী

লেখক পরিচিতিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এস.সি. স্ট্যাটিস্টিক্স। সরকারি সংস্থার রিটায়ার্ড ডেপুটি ডিরেক্টর। কর্মসূত্রে প্রায় সারা দুনিয়া ঘুরেছেন। এখন লেখালেখি, গানবাজনা, নাট্য রচনা/নির্দেশনা, একটি লাইব্রেরি পরিচালনা ও বিশুদ্ধ আড্ডাবাজিতে মশগুল। দুটি গ্রন্থের লেখক। একটি কাব্যগ্রন্থ ‘যারা কবিতা পড়ে’ ও একটি লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পালের জীবনী ‘সুজন রসিক নাইয়া’দেশ, আনন্দমেলা, সাপ্তাহিক বর্তমান, এই সময়, কিশোর ভারতী, অদ্বিতীয়া, তথ্যকেন্দ্র ও বিভিন্ন বহুল প্রচারিত লিটল ম্যাগে লিখেছেন ও এখনও লেখেন।

2 comments: