একলা পথে
প্রদীপ্ত ভক্ত
আমার মাথার মধ্যে একটা
পোকা আছে যেটা কিনা প্রায়ই নড়ে ওঠে। খাচ্ছি, অফিস যাচ্ছি, আড্ডা মারছি, বই পড়ছি - সব ওই দিনকতক
কোথাও না বেড়াতে গেলেই কীরকম অস্থির অস্থির লাগে। আমার পক্ষীরাজ মানে আমার
পালসারটাও আস্তাবল মানে গ্যারাজে বন্দি থাকলে ক্ষেপে যায়। আর কেউ টের না পাক, আমি পাই। তাই কোনও এক
শনিবার না রবিবার দুম করে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মানে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে
সিদ্ধান্ত ঘুরতে যাব। তো চালাও পানসি বেলঘরিয়া। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অবধি ঠিক
ছিল গাদিয়াড়া যাব। কিন্তু হঠাৎ করেই মত বদলে টাকি। টাকিতে লোকে পিকনিক করতে যায় বা
ভাসান দেখতে। আমার কিন্তু টাকি যাওয়ার এক এবং একমাত্র কারণ ছিল ইছামতী। এমন সুন্দর
নামের একটা নদী, তাকে না দেখে থাকা কি
ঠিক! নদীর বুঝি অভিমান হয় না!
বাইকে তেল ভরা নেই। ধুর, দেখা যাবে। রাস্তায় কি আর
কিছু পাব না! এহ্ হে, ক্যামেরাটাও
তো আমার কাছে নেই! তাতে কী, চোখের লেন্সটা তো আছে রে বাবা! উফ্, বয়স্ক লোকেদের মতো করিস
না তো! চল তো,
যা হবে দেখা
যাবে। কিছু খেয়ে বেরোতে বলেছিলেন বটে বাবা, কিন্তু আমি এমনিতেই যথেষ্ট দেরি
করে ফেলেছি। এরপর দেরি করলে রোদ উঠে যাবে।
এয়ারপোর্টের জ্যাম কাটিয়ে
মধ্যমগ্রাম পৌঁছলাম। স্পীড ষাট-পঁয়ষট্টির বেশি ওঠেনি তেমন। মধ্যমগ্রাম থেকে
ডানদিকের বাদু যাবার রাস্তা ধরে এগোলাম বারাসাত দিয়ে না গিয়ে। রাস্তা মোটামুটি
যেমন খারাপ হয় তেমনই। ভালো হবে এমন আশাও ছিল না। রাস্তা চিনি না। এদিক সেদিক
জিজ্ঞেস করে এগোচ্ছিলাম। তা হঠাৎ একটা রাস্তা বেশ ভালো লেগে গেল। চারদিকে প্রচুর
গাছপালা রাস্তাটার, আর
বেশ মসৃণও বটে। কিন্তু ইনটুইশন বলছে এ রাস্তা ভুল। তবুও ওই রাস্তা ধরেই এগোলাম।
কিছুদূর গিয়ে আমার অনুভূতি সত্যি করে রাস্তাটা ভুল প্রমাণিত হল। আমায় ঠিক প্রমাণ
করল, মানে মারাত্মকভাবে ঠিক
প্রমাণ করল। রাস্তা বলে আর কিছু নেই। একধারে ভেড়ি আর অন্যপাশে ইঁটের পাঁজা। আর
আমার চমত্কার মসৃণ রাস্তা একটা মাটির রাস্তায় পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত অসমান। প্রচুর
ধুলো উড়ছে। ভেড়ি দেখে আমায় থামতেই হল। জল দেখলেই আমি আর স্থির থাকতে পারি না। একজন
লোক মাছ ধরছে।
“ও কাকা, কী মাছ ধরছ?” বেশ একটা ‘কুবের হে, মাছ কিবা’ স্টাইল নিয়ে জিজ্ঞেস
করলাম। লোকটা আমায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উদাসীন হয়ে মাছ ধরতে লাগল। কয়েকটা ছেড়ে
দিল। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ নেই, এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আমি নিজের মনে ভেড়ির জল, মাছেদের লাফালাফি, পাখিদের ওড়া-উড়ি, পোড়া ইঁটের গন্ধ নাকে
নিয়ে দেখতে লাগলাম। আহা, বড্ড ভালো লাগছে। টাকি অবধি যাওয়ার কি খুব দরকার আছে? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি না
কেন! হঠাৎ লোকটার মনে হয় আমায়
ন্যালাখ্যাপার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া হল। আমার সাথে খানিক কথাবার্তা বলল।
কোথা থেকে আসছি,
কোথায় যাব।
মানে সেই চিরন্তন বেসিক প্রশ্ন। আমি অবশ্য দার্শনিক জবাব দেওয়ার রিস্ক নিইনি। এ
চত্বরে মেরে পুঁতে দিলে কেউ খবর পাবে না। যাই হোক, সে চিংড়িমাছ ধরছে সে খবর শোনার পর
আমার চটকাটা ভেঙে গেছিল। আবার বাইক স্টার্ট করলাম। এহ্ হে, বেজায় ধুলো। রাস্তা অতি
খারাপ। আজ ফিরে পালসিকে চান করাতে হবে। এই সময় পুরো দুনিয়ার উপর রাগ হয়ে যায়। বড্ড
রোমান্টিসিজমের ভূত চেপেছিল না তোমার! নাও, বোঝো এখন।
সাড়ে বারোটা পৌনে একটা
নাগাদ পৌঁছলাম শেষমেশ। আমার পালসিকে একধারে দাঁড় করিয়ে রেখে চক্কর কাটা শুরু
করেছি। হঠাৎ একটা ডাবওয়ালা কাম ভ্যানওয়ালা এসে আমায় খুব উত্সাহের সাথে জিগ্যেস করল, “কোথা থেকে আসছ? বর্ডার দেখতে যাবে? বাইক তো যাবে না। তা কোনও
ব্যাপার না। ক’জন আছ তোমরা?”
“আমি একা।”
“একা তো ভাই একটু বেশি
ভাড়া পড়বে। তা তোমার থেকে বেশি নেব না। তুমি আমায় দুশো টাকা দিও।”
ধুস, কোথায় ভাবলাম একাবোকা
দেখে সাহায্য করতে এল! বুঝলে হে, সবই give and take। তাকে কাটিয়ে আমি এগোলাম খানিক।
এদিক সেদিক জেনে বুঝলাম, বাইক যায় বর্ডার কিংবা মিনি সুন্দরবন অবধি। তবে আই কার্ড
লাগে। তা আমার তো ড্রাইভিং লাইসেন্স আছেই। মিনি সুন্দরবন আর কিছুই না, কৃত্রিমভাবে খানিকটা
জায়গায় সুন্দরবন অঞ্চলের গাছপালা লাগানো হয়েছে। টাকির আসল রাজবাড়ি ভেঙে গেছে।
আরেকটা আছে,
তবে তা
দেখতে আমি খুব একটা উত্সাহী না। বস, বর্ডার, মিনি সুন্দরবন সব হবে। আমি আগে একটু ইছামতী দেখতে
চাই। যার জন্যে আসা। গেলাম নদীর ধারটায়। ঘাটে কেউ নেই। বসলাম। স্বপ্নের ইছামতীর
সাথে স্বাভাবিকভাবেই মিলল না। না মিলুক। এই ইছামতী আলাদা থাকবে আর
স্বপ্নেরটাও থাকবে।
এক বুড়ো মাঝি দাঁড় বেয়ে
চলেছে। খানিক আগেই শুনেছি হাতে টানা নৌকো বন্ধ। চড়তে হলে ভটভটি চড়তে হবে। তাই দাঁড় টানা নৌকো দেখে খুব
উত্সাহ নিয়ে ডাকলাম, “ও চাচাআআআ... নেবে একটু? একা আছি, কোনও ঝামেলা করব না।”
কিন্তু আবার সেই উদাসীনতা। আমাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বুড়ো
মাঝি তার নৌকো নিয়ে চলে গেল। একটু নিলে কি এমন ক্ষতি হত? দূর দূর। উঠে পড়লাম। যাই,
একটু মিনি সুন্দরবনই দেখে আসি। তার আগে এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না।
আমার মুখের মধ্যে মনে হয়
একটা অজ্ঞানতার ছাপ আছে। তাই আমায় বেশিরভাগ লোকেই জ্ঞান দিয়ে ওই অজ্ঞানতাটা মুছে
দিতে চায়। এখানেও তার বিরূপ ঘটল না।
চা-দোকানি ভদ্রলোক বললেন, “কলকাতা থেকে একা আসছ! এই বয়েসে বাইক চালাচ্ছ! না
না, খুব রিস্কি একা একা এতদূর আসা বাইক নিয়ে।”
মনে মনে বললাম, ‘যতটা ছোটো
ভাবছেন অতটাও না। মেঘে
মেঘে বেলা মন্দ হয়নি।’
মুখে বললাম, “হ্যাঁ কাকু,
এই তো চলে তো এলাম।”
“কীসে পড়?”
এটাও বাঁধা প্রশ্ন। ওই যে
অজ্ঞানতার ছাপ, তার ফল মনে হয়। একবার একজনকে মরিয়া হয়ে বলেছিলাম, “পড়ি না। ক্লাস সেভেন পাস করে এদিক সেদিক
হাতের কাজ করি।”
চাকরি করি বললে উল্টোদিকের
লোকজন হয় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো করতে থাকে বা দর্জি হয়ে যায়। জুলুজুলু করে মাপতে থাকে। তাই আমি আজকাল আর বলি না আমি কোনও
এক বাতানুকূল অফিসের শ্রমিক। লোকে গালভরা নাম যাই দিয়ে থাক না
কেন। বরং বলে দিই কিছু একটা যখন যেমন মনে আসে।
বললাম, “ফার্স্ট ইয়ারে
পড়ি।”
মানুষটা খারাপ না। আমায় বললেন, “দেখ এদিক সেদিক ঘুরে।
বর্ডার, মিনি সুন্দরবন, ভটভটিতে চড়বে তো চড়। বন্ধুদের সাথে এলে আরও
ভালো করতে।”
একা এসেও যে আমি খারাপ
করিনি সে কথা তাঁকে না বলে আমার পক্ষীরাজকে বললাম, “চল, তোকে মিনি সুন্দরবন ঘুরিয়ে
আনি। সুন্দরবন তো মনে হয় না যাওয়া হবে তোকে নিয়ে।”
মিনি সুন্দরবন জায়গাটা
ভালো। কৃত্রিমভাবে তৈরি হলেও ভারি চমত্কার জায়গা। সুন্দরীগাছ, মাঝে মাঝে পাখিরা উড়ছে, ডাকাডাকি করছে। একটা
জায়গায় ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম খানিক। হাঁটাহাঁটি করতেও দিব্যি লাগছিল।
স্থানীয় কিছু মহিলারা খেজুরগুড়, রস আর কী কী যেন সব বিক্রি করছিল। অনেকবার ধরে ডাকাডাকি
করার পর দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, “না গো দিদি, আমি খেজুর-রস খাই না।”
‘আর এখন এই চড়া রোদের
মধ্যে দাঁড়িয়ে খেজুরগুড় খাওয়ার ইচ্ছাও নেই’ (এটা অবশ্য মনে মনে বলেছি)।
“নিয়ে যাও খেজুরগুড়,
বাড়ির জন্য।”
তাতেও আমি ঘাড় নেড়ে উদাস
গলায় বললাম, “নাহ্।”
কী জানি কেন, আমি কিছু না
নিলেও তার আমাকে বেশ পছন্দ হয়েছিল। হতে পারে আমি তার গুড়ের খাঁটিত্ব
নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলিনি বলে কিংবা আমায় দেখে তার যাদবপুর পড়তে যাওয়া ভাইয়ের কথা
মনে পড়ে গেছিল, সেই জন্যে।
“গুড় তুমি বানিয়েছ দিদি?”
“নাহ্, তোমার জামাইবাবু। ও এইসব বানায়, আমি খালি বিক্রি
করি।”
“কখনও বাংলাদেশ গেছ?”
“নাহ্, আমাদের কেউ তো
ওখানে নেই। খামোখা যাব কেন?”
তার সাথে আরও খানিক গল্প
হল। তার ভাই যাদবপুরে পড়ে। সবসময় তো লোক আসে না। এইবার গরম পড়ে গেছে। আর রসও হবে না, লোকও হবে
না। আমায় বলল, “মুখটা তো শুকিয়ে গেছে একেবারে। খাওয়াদাওয়া করেছ কিছু?”
চট করে মিথ্যে আমি বলতে
পারি না। বিশেষ
করে এমন মায়া নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে আদৌ বলা যায় কি না আমি জানি না। তাই সত্যিটাই বললাম, “এখানে তো খাওয়ার দোকান
তেমন নেই। ফেরার
পথে খেয়ে নেব কিছু।”
বলল, “চল, আমাদের বাড়ি
কাছেই। ওখানে
যা হোক দুটো মুখে দেবে।”
সামান্য একটা জিনিসও
কিনিনি আমি তার থেকে। তবুও কে ভাবতে পেরেছিল এমন অচেনা একজন মানুষ তার মায়ার
আঁচল বিছিয়ে দেবে! আমি আমার জীবনে এরকম কত মানুষের কাছে যে ঋণী আমি জানি না। একবার
কলেজে পড়ি তখন। প্রচন্ড এক গরমের দুপুরে কলেজের ক্লাস না করে মাঠে মাঠে ঘুরতে
বেরিয়েছিলাম। রাস্তা ভুল করে তেষ্টায় যখন ধুঁকছি, আমাদের হোস্টেলে কাজ করত
এমন একজন আমায় ডেকে তার বাড়ি নিয়ে নিয়ে ঝকঝকে ঘটি ভরে ঠান্ডা জল দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে খেতে নিষেধ
করেছিল এবং জলের সঙ্গে খানকতক বাতাসা দিয়েছিল। শুধু জল খেতে নেই। আমি এদের ভালোবাসা
কক্ষণও ফিরিয়ে দিতে যাইনি। কারণ, আমার সে ক্ষমতা কোথায়! খালি বুকের মধ্যে যখন অনেকটা ফাঁক হয়ে যায়, বেরিয়ে পড়ি আমি। জানি পথে ঘাটে সে ফাঁক
বুজিয়ে দেওয়ার লোক আছে।
আবার একটা মিথ্যে
প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে এলাম। নদীর ঘাটে গিয়ে দেখি তখনও লোক হয়নি, তাই এখন ভটভটি
ছাড়বে না। নদীর ধারে ঘাটে একা বসে রইলাম। আমার তাড়া নেই। একজন দু’জন করে লোক
হচ্ছিল। সব চার থেকে ছ’জনের দল। আমি একা। তাই ভরসা আছে কোথাও না কোথাও
ঢুকে যাব। এক দলের এক মাঝবয়েসী লোক, বেশ একটা নেতা নেতা ভাব আছে, দেখি মাঝির সাথে দরাদরি করতে শুরু
করল।
নৌকো এগিয়ে চলেছে। ওদিকটা
বাংলাদেশ, এদিকটা ভারত। আমার বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কোনও টান বা নস্টালজিয়া নেই। তবুও অদ্ভুত একটা মনের ভাব হল।
খানিক দূরে তিন নদীর মোহনা। জলঢাকা, ইছামতী আর একটার কী নাম ছিল ভুলে গেছি। খানিক নদীর উপর
ঘুরে ফেরা। চা খেতে সেই চায়ের দোকানেই আবার। খিদে পাচ্ছিল, কিন্তু কোনও খাবারই মনঃপূত হচ্ছিল
না। আরও খানিকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছে। ওদিকে মেঘ করেছে খুব। থাকি আর একটু? বৃষ্টি হলে ভিজব না হয়।
এই করে আরও খানিকক্ষণ কাটিয়ে বাইক স্টার্ট করার পরপরই তিনি এলেন। আকাশভাঙা না হলেও
বেশ ঝমঝমিয়ে। তিরের ফলার মতো বিঁধছে গায়ে। তবু দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। রাস্তায় লোক
কমে গেছে। গাছগুলো মাথা নেড়ে নেড়ে এনজয় করছে দিব্বি। ব্যাটা থাক তোরা এক জায়গায়
দাঁড়িয়ে। হুঁ হুঁ,
মানুষ হওয়ার মজা মন্দ নাকি! দেখ দেখ, কেমন সাঁই সাঁই করে চলেছি আর বিভিন্ন জায়গার
বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। কিঞ্চিত পরেই অবিশ্যি এ সুখ আর ছিল না। বৃষ্টির দাপট বাড়ল। আমার পক্ষীরাজ থামল। গাড়ি থামিয়ে
আপাদমস্তক ভেজা অবস্থায় এক চায়ের দোকানে চা চাইলাম। লোকটা কীরকম সন্দেহজনক
দৃষ্টিতে দেখছিল। যেন
এরকম ভিজে কেউ যায় না। যত্তসব! উহ্, বেজায় ঠান্ডা রে বাবা! কাঁপতে কাঁপতে রওনা দিলাম।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment