গল্প:: মৃত্যুর রং - অনন্যা দাশ


মৃত্যুর রং
অনন্যা দাশ

(১)

ফোনটা যখন এল তখন রিয়া ল্যাবে কী একটা কাজ করছিল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল পেগির ফোন, তাই তুলল এখানে আসার পর প্রথম কিছুদিন যখন খুব মন খারাপ করত মা-বাবা আর কলকাতার সবার জন্যে তখন মন ভালো করার জন্যে পেগির কাছে কিছুদিন আঁকা শিখেছিল জল রং এখন সময়ও হয় না আর মন খারাপ ভাবটাও অনেক কমেছে
হ্যালো পেগি, কী খবর? অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, রিয়া ফোন ধরে বলল
পেগি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর দেখা! এই পোড়া ভাইরাসের জন্যে কারও সঙ্গে দেখাই করতে পারছি না ক্লাসও নিই না এখন তেমন ওই জুমে অনলাইন ক্লাস নিতে আমার ভালো লাগে না তা শোনো, তোমার কী একটু সময় হবে তোমার সঙ্গে দেখা করা বিশেষ দরকার আমার একটা কথা বলার ছিল আমার বাড়িতে একবার আসতে পারবে? ফোনে ঠিক বলতে চাই না
রিয়া শুনে বলল, “ হ্যাঁ, বাড়িতে যেতেই পারি তবে আজ তো বৃহস্পতিবার, আজ বা কাল হবে না আজ কাজের পর পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড নিয়ে বসতে হবে, কাল একটা প্রেজেন্টেশান আছে পরশু মানে শনিবার গেলে চলবে?”
হ্যাঁ, শনিবার এলেই হবে আসলে ব্যাপারটা একটু চিন্তার, মানে আমার একটু ভয় লাগছে তাই বেশি দেরি করতে চাই না তোমাদের ভ্যাকসিন হয়ে গেছে তো?
আচ্ছা, না ঠিক আছে শনিবার দিন দেখা হবে হ্যাঁ, ভ্যাকসিন হয়ে গেছে বুস্টারও হয়ে গেছে, তাই নিয়ে চিন্তা নেই
আচ্ছা, বেশ আর শোনো, তুমি যখন আসবে তখন আমার কিছু আঁকার বই, মানে জল রং টেকনিক নিয়ে আঁকার বইগুলো, তোমাকে দিয়ে দেব অয়েলগুলো স্যালির জন্যে থাকবে ওর আবার জল রঙে তেমন আগ্রহ নেই তাই
রিয়া থ্যাঙ্ক ইউ বলতে পেগি খুশি হয়ে ফোন রেখে দিল স্যালিটা কে যদিও সে জানে না
কিম পাশেই ছিল, জিজ্ঞেস করল, “কার ফোন ছিল?”
আমার আঁকার টিচার পেগির কয়েকদিন আঁকা শিখেছিলাম ওঁর কাছে
পেগি কার্টিস?”
হ্যাঁ
ও, পেগির কাছে আমিও ছোটোবেলায় আঁকা শিখেছি, কিন্তু আমার আঁকার হাত একেবারেই বাজে, তাই বেশিদিন আর চলেনি ক্লাস তা কী বলছিলেন?”
ওঁর বাড়ি যেতে বলছিলেন কিছু একটা ব্যাপারে ভয় পেয়েছেন বলছিলেন তুমি যাবে? শনিবার দিন যাব বলেছি
কিম এক কথায় রাজি রহস্যের গন্ধ পেয়ে, বলল, “হ্যাঁ, শনিবার দিন ব্রেকফাস্টের পর যাওয়া যেতেই পারে আমি তোমাকে তুলে নেব
শুক্রবার দিন রাত ন’টায় হঠাৎ দরজায় বেল শুনে রিয়া একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল ম্যাজিক আই দিয়ে দেখল বাইরে কিম দাঁড়িয়ে!
আরে তুমি এত রাতে, কী ব্যাপার?” দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল রিয়া
তোমার ডিনার হয়েছে?”
হ্যাঁ, কেন বল তো?”
আজ আমাদের ডিনারের পর আমরা সবাই ফ্যামিলি রুমে বসেছিলাম কিছুক্ষণের জন্যে ওটা প্রতি শুক্রবার করি আমরা সবাই সপ্তা কেমন কাটল সেই নিয়ে একটু আলোচনা, তারপর যে যার মতন টিভির অনুষ্ঠান দেখে বা ঘরে যায়, যা খুশি তা আজকে বাবা হঠাৎ বললেন, ‘কিম মনে আছে ছোটোবেলায় তুমি একজনের কাছে আঁকা শিখতে?
“আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন পেগি কার্টিস!
- ‘ঠিক, ওই পেগি কার্টিস আজকে মারা গেলেন
“আমি আঁতকে উঠে বললাম, “সেকি খুন হলেন নাকি?”
“বাবা বললেন, ‘নাহ, খুন হবেন কেন? বয়স তো হয়েছিল অনেক, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মারা গেছেন বলে তো শুনলাম
“তা আমি আর বাবাকে ওই ফোন নিয়ে কিছু বললাম না, কিন্তু তোমাকে খবরটা দিতে এখানে চলে এলাম,” এতটা বলে কিম থামল
রিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলেছেন তোমার বাবা?” কিমের বাবা ওদের ছোটো টাউন নিউ চেরিভেলের পুলিশ প্রধান সেই সূত্রে অন্য কিছু জানতেও পারেন
কিম বলল, “না, আসলে বাবা তো যাননি অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল তবে আমরা যেন কিছুই জানি না এমন ভান করে কাল সকালে গিয়ে হাজির হব, কেমন?”
রিয়া বলল, “আমিও ঠিক ওই কথাই ভাবছিলাম কাল সকালে দেখা হবে তাহলে

()

পরদিন সকালে উঠে রিয়ার কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না কিম মনে হয় সেটা বুঝেই ওর জন্যে একটা ব্লুবেরি মাফিন নিয়ে এসেছিল মাফিন খেতে খেতে গাড়িতে বসল রিয়া মাফিন খাওয়া শেষ হতে না হতেই পেগির বাড়ি এসে গেল ছোটো কিন্তু বেশ সুন্দর পেগির বাড়িটা এক ফালি বাগান পেরিয়ে ওরা বাড়ির দরজায় গিয়ে বেল দিল একজন গোলগাল মহিলা দরজা খুললেন বয়স চল্লিশ মতন হবে
রিয়া পরিচয় দিয়ে কেন এসেছে বলতে উনি বললেন, “ হে, তোমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে পেগি আন্টি তো গতকাল বিকেলে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন
হো! আমরা তো জানতাম না তা আপনার পরিচয়টা?”
আমি রুথ পেগি আমার মাসি হতেন বছর পাঁচেক হল আমি এখানকার রান্নাবান্নার দিকটা সামলাচ্ছি পেগি আন্টির সব করার সময় হত না আর বয়স হয়েছিল বলে বাইরের খাবারও খেতে চাইতেন না আমি বিয়ে-টিয়ে করিনি তাই আমিই এসে এখানে থেকে বাড়ির কাজ সব করতাম
এমন সময় আরেক মাঝবয়সি মহিলা, “কে এসেছে?” বলে ঘরে ঢুকলেন
তাঁকে দেখেই রুথের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল
রিয়া বলল, “আমরা পেগির কাছে আঁকা শিখতাম আজকে দেখা করতে আসার কথা ছিল কয়েকটা জল রঙের বইও দেবেন বলেছিলেন পেগি, কিন্তু এখন দুঃসংবাদটা শুনলাম
!” বলে মহিলা ওদের এক ঝলক দেখে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন
উনি কে?” রিয়া জিজ্ঞেস করল
রুথ নাক সিঁটকে বললেন, “ওই হল স্যালি আমার মাসির মাথাটা খারাপ হয়েছিল তাই ওই স্যালি মহিলাকে নিজের সঙ্গে থাকতে দিয়েছিলেন! এই ক’টা বছর আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকেছি!”
কেন? স্যালি কী করেন?”
কী আবার, কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আঁকা আঁকে সারাদিন বসে পেগি আন্টি জুমে বা অনলাইনে ক্লাস নিতে পছন্দ করতেন না তাই বেশির ভাগ ক্লাস স্যালিই নিত ইদানীং
আচ্ছা, এই স্যালির কথাই পেগি বলছিলেন জল রঙে তেমন আগ্রহ নেই
হ্যাঁ, স্যালি নাকি অয়েল পছন্দ করে তাই পেগি আন্টিও ইদানীং অয়েল নিয়ে মেতেছিলেন অবশ্য শরীর খারাপ ছিল বলে পুরোটা আঁকতেও পারতেন না স্যালিই আঁকাগুলোকে শেষ করত
তারপর গলা নামিয়ে বললেন, “ওর সঙ্গে একা থাকতে আমার ভারি ভয় করে নাকি একজনকে খুন করে জেলে গিয়েছিল! পেগি আন্টি কেন যে ওকে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে কে জানে!”
আরও কিছুক্ষণ থেকে কিছু জানা গেল না, তাই রিয়া আর কিম ফিরে গেল
রবিবার সকালে কিম ফোন করে রিয়াকে বলল, “খবর আছে অটপ্সিতে পেগির শরীরে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে সেই জন্যেই তাঁর মৃত্যু হয় স্যালির ঘরে লুকোনো কিছু ঘুমের ওষুধও পাওয়া গেছে সেই ভিত্তিতে পুলিশ স্যালিকে জেলে নিয়ে গেছে
কিন্তু কেন? ঘুমের ওষুধ তো যে কেউ ওর ঘরে রেখে দিতে পারে! সেটা তো যথেষ্ট প্রমাণ নয়!”
কিম বলল, “পেগির উইলে স্যালিই ওর সব সম্পত্তির মালিক, সেটাই পুলিশের কাছে সব চেয়ে বড়ো প্রমাণ রুথ বলেছে স্যালির সঙ্গে নাকি পেগির ঝগড়া হয়েছিল এবং পেগি নিজের উইল বদলাবার চিন্তা করছিলেন কিন্তু করে উঠতে পারেননি তবে আমি একটা কাজ করেছি পেগির ল-ইয়ারের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি দেখি তিনি কী বলেন

()

পরদিন লাঞ্চের সময় ওরা দু’জন ল্যাব থেকে বেরিয়ে শার্লি, ডিটি অ্যান্ড ডিটি উকিলদের অফিসে গিয়ে হাজির হল অফিসের সামনে পার্কিং নেই বলে একটা পার্কিং লটে গাড়িটাকে পার্ক করতে হল কিমকে দিনের বেলাতেও পার্কিং লটের ভিতরটা অন্ধকার মতন কেমন একটা গা ছমছম ভাব
পেগির ল-ইয়ার পিটার ডিটি ওদের নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন ভদ্রলোকের বয়স সত্তর মতন হবে কিন্তু দিব্যি ফিট বললেন, “পেগি তো আমাকে উইল বদলের কথা কিছু বলেনি তবে এটাও ঠিক আমি ছুটিতে ছিলাম তাই ফোন করলেও আমাকে পেত না আর পেগি আমাকে ছাড়া এখানকার অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইত না
রিয়া বলল, “আচ্ছা তা স্যালির নামের উইলটা আপনিই করেছিলেন তো?”
হ্যাঁ, ওটা আমারই করা ওতে কোনো ভেজাল নেই বছর পাঁচেক আগে পেগি ওটা আমাকে করতে বলে আমার মনে একটু খুঁতখুঁত যে ছিল না তা বলতে পারি না স্যালির রেকর্ড তো খুব একটা ভালো নয় সে জেলেও গিয়েছিল একবার আমি আমার মনের কথা পেগিকে বলতে সে বলে, ‘স্যালি আমার ছাত্রী ছিল অনেক বছর ধরে ওকে আমি খুব ভালো করে চিনি আমার সেরা ছাত্রীদের মধ্যে একজন গত এক বছর ধরে আমার সঙ্গে রয়েছে এবং কাজ শিখছে আমি চাই আমি মরে গেলে আমার বাড়ি আর আঁকার স্কুল ওই চালাক আর ওর জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র সারা রাত ধরে জেগে কাজ করে তারপর ওর গাড়ি নিয়ে বেরোনোই উচিত হয়নি গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে আর অন্য একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে সেই গাড়ির চালক মারা যায় স্যালির আর্থিক অবস্থাও তখন ভালো ছিল না তাই ভালো উকিলও করতে পারেনি, তাই তিন বছর জেলে কাটাতে হয়েছে এখন সমাজ এমন যে কেউ একবার জেলে গেলে তো তার জীবন মোটামুটি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু আমি স্যালিকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই ওর মতন প্রতিভাবান শিল্পীর জীবন এইভাবে শেষ হয়ে যাক আমি চাই না অন্তত কিছু লোককে আঁকা শেখালেও নিজের খরচ তুলে নিতে পারবে, শুধু একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই হবে সেই জন্যেই বাড়িটা ওকে দিতে চাই’”
আর রুথ? রুথের কথা কিছু হয়নি?”
নাহ, রুথ আর ওর ভাই তখনও ওখানে আসেনি পরে আর পেগির সঙ্গে উইল নিয়ে তো কথা হয়নি এমনিতেও পেগি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকত দরকার না হলে তো ফোন করত না
ও, রুথের ভাইও থাকে নাকি ওখানে?”
হ্যাঁ, রুডি সে ব্যাটা কিছুই করে না রুথ তো তাও রান্নাবান্না আর কিছু ঘরের কাজ করে দিত পেগির ভাইটা তো একেবারে অকাল কুষ্মাণ্ড! বলত তো কোন একটা দোকানে কাজ করত, কিন্তু আমার তো মনে হয় না কোনো কাজই করত অথচ পেগি আমাকে একবার বলেছিল রুথ আর রুডি দুজনেরই নাকি আঁকার হাত ভালো ছিল, কিন্তু কোনো চর্চা নেই, চেষ্টা নেই, বেশ অলস
স্যালির গ্রেফতারের ব্যাপারে সব বৃত্তান্ত শুনে পিটার বললেন, “স্যালি বোকা নয় ঘুমের ওষুধের শিশি নিজের ঘরে কেন রাখবে জানি না আর এত বছর পরে কেনই বা তবে জানি না, মানুষের মন বলে কথা কার মাথায় কখন কী ঘোরে তো বলা যায় না
পেগির কেন ভয় করছিল সে বিষয়ে কিছু জানেন? উনি আমাকে ফোন করেছিলেন কিন্তু দেখা হওয়ার আগেই উনি মারা যান
পিটার মাথা নাড়লেন, “নাহ, বলতে পারব না আসলে আমি তো মাস খানেকের জন্যে ছুটি নিয়ে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমার সঙ্গে বছরের শুরুর দিকে ট্যাক্স সংক্রান্ত ব্যাপারে শেষ কথা হয়েছিল পেগির
পিটারের সঙ্গে কথা শেষ করে ওরা পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিতে গিয়ে দেখল কিমের গাড়িটাকে কে যেন বিশ্রীভাবে লাল আর কালো রং দিয়ে ছোপ দিয়ে দিয়েছে সারা গায়ে! সারা গাড়ি জুড়ে লেখামাইন্ড ইয়োর ওন বিজনেস’, অর্থাৎ নিজের চরকায় তেল দাও!
কিম তাই দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “বাবা আমাকে মেরে ফেলবেন! এটা ঠিক করতে প্রচুর দাম দিতে হবে!”
রিয়া বলল, “যে করেছে তার কাছ থেকেই দামটা আদায় করতে হবে
কিম শুনে বলল, “এই রং থেকে কেমন জানি রুডি রুডি গন্ধ পাচ্ছি!”
রিয়া বলল, “সে আর বলতে!”

()

এরপর দু’দিন আর কিছু হল না কিমের গাড়িকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে তিন হাজার ডলার লাগবে গ্যারেজ থেকে বলল, তাও সেটা কিমের বাবার জন্যে স্পেশাল রেট তাই শুনে কিমের মুড অফ স্যালি আপাতত জামিনে বেরিয়েছে, পেগির ফিউনারালে গিয়েছিল, কিন্তু খুব শিগগির ট্রায়াল হবে আর এখানকার নিয়ম অনুযায়ী যে খুন করেছে সে কিছুতেই সম্পত্তি পেতে পারে না, তাই পেগির বাড়ি খুব সম্ভব রুথ আর রুডিই পাবে
শুক্রবার দিন সন্ধেবেলা হঠাৎ রিয়া একটা ফোন পেল কার গলা, ছেলে না মেয়ে বোঝা যাচ্ছিল না গলার স্বর গোপন রেখে একজন বলল, “আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই খুব জরুরি দরকার পেগি কার্টিসের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু কথা ছিল তবে এখন বলতে পারব না আজ রাত আটটার সময় লেকভিউ পার্কে আসতে পারবেন? লেকের ধারে যে বোটহাউসটা আছে তার পাশে একাই আসতে হবে কিন্তু পুলিশকে সঙ্গে আনলে আমি দেখা দেব না
লেকভিউ পার্কটা ল্যাব থেকে খুব একটা দূরে নয়, হেঁটেই যাওয়া যাবে সেই ভেবেই রিয়াহ্যাঁবলে দিল ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে বা ফাঁদ হতে পারে সেই সব জেনেও হ্যাঁ বলতেই হল কিমকেও কিছু বলল না তাকে বললেই সে নিজের বাবাকে বলে দেবে আর তখনই এক গাদা পুলিশ এসে হাজির হবে
ল্যাব থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিল রিয়া সারাদিন মাস্ক পরে থেকে বড্ড কষ্ট হয় এখন মাস্ক খুলে তাজা হাওয়া মুখে লাগাতে খুব ভালো লাগছিল পনেরো মিনিট হাঁটার পরই লেকভিউ পার্কে পৌঁছে গেল অন্ধকার হয়ে এসেছে নভেম্বর মাসের শীতের রাত, তাই অন্য কোনো লোকজন নেই পার্কে এমনিতেও এখানে সব পার্কের সময় হল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, এখন তাই পার্ক বন্ধ
ধীর পায়ে হেঁটে বোটহাউসটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রিয়া আগেও এসেছে এখানে অনেকবার, তাই কোনো অসুবিধা হল না
আমার কথা বিশ্বাস করে আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ!” কাঁপা গলায় একজন বলল
রিয়া তাকিয়ে দেখল কোট টুপি পরা একজন বয়স্কা মহিলা
মহিলা কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “আমি লিলিয়ান শিলার পেগির বন্ধু এইভাবে এখানে ডাকার জন্যে দুঃখিত, আমি কিছুদিনের জন্যে ক্রুজে গিয়েছিলাম তাই আগে যোগাযোগ করতে পারিনি এসে পেগির মৃত্যুর ঘটনাটা শুনলাম তুমি হয়তো বলবে এত লুকোচুরি কেন, তাই তো? শুধু রুডির জন্যে সে আমাকে শাসিয়েছে যে আমি যদি পুলিশ বা অন্য কাউকে কিছু বলি তাহলে আমাকে শেষ করে দেবে আমার বাড়ির ওপর নজর রাখছে সে, তাই বাড়িতে কাউকে ডাকছি না তোমাকে কে ফোন করেছিল সেটা যদি তুমি ভুলেও পুলিশকে বলে দাও তাই বাইরে থেকে ফোন করেছি আর নামও বলিনি আমি জানি তোমার বন্ধুর বাবা পুলিশে কাজ করেন আমি শুধু এইটুকুই বলব যে পেগি রুথ আর রুডিকে নিয়ে খুশি ছিল না আমাকে এই খামটা দিয়েছিল আমি ক্রুজে যাওয়ার আগে বলেছিল ওর কিছু হলে এই কাগজটা তোমাকে দিতে, তুমি নাকি বুঝতে পারবে, আর কিছুই বলেনি পেগি তো বাড়ি থেকে বেশি বের হত না তাই আমিই গিয়েছিলাম ক্রুজে বেরোবার আগের দিন ওর সঙ্গে দেখা করতে, তখন লুকিয়ে এটা দিয়েছিল ওই রুথটা সর্বক্ষণ আমাদের সঙ্গে আঠার মতন লেগেছিল, তাই কিছু বলতে পারছিল না খামের ওপরেই তোমার নাম আর ফোন নম্বর লেখা ছিল তাই আমার অসুবিধা হয়নি এতে কী আছে আমি জানি না, কিন্তু পেগির শেষ ইচ্ছে পূরণ করব না তা তো হতে পারে না রুডি মনে হয় আমার পিছু নিয়ে থাকতে পারে, তাই তুমি এখুনি বেরিও না আমি বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে বেরিও যাতে দেখতে না পায় তোমাকে সাবধানে থেকো
আপনিও সাবধানে থাকবেন এর মধ্যে কী আছে আমি পরে আপনাকে ফোন করে জানাব, কেমন?”
হ্যাঁ, খামের ওপরে আমার নম্বর লিখে দিয়েছি,” বলে মহিলা হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন
রিয়া দশ মিনিট বসে থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিল
বাড়ি পৌঁছেই খামটা খুলে দেখল খামে কয়েক টুকরো কাগজ ভালো করে দেখতে বুঝল কাগজগুলো আসলে পেগির ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট কত ডলার জমা পড়েছে, কত তোলা হয়েছে সেই সবের হিসেব শেষের পাতায় যে সব চেক জমা পড়েছে সেই সবের ফটোকপি খুচ খুচ করে সেলফ চেক করে প্রায় দশ হাজার মতন ডলার তুলেছেন পেগি তা তুলতেই পারেন সংসারের খরচ
পরদিন ব্যাঙ্কে গেল রিয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেও ওরা কোনো কিছু বলতে রাজি হল না ক্লায়েন্টের অ্যাকাউন্ট নিয়ে নাকি ওরা কিছু বলতে পারে না
শেষে বিরক্ত হয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করল, “পেগি তো বাড়ি থেকে বেরোতেন না তেমন, তাহলে এতগুলো সেলফ চেক কে নিয়ে আসত?”
ব্যাঙ্কের ম্যানেজার গোমড়া মুখ করে বললেন, “সব সঠিক সাইন করা থাকত তাই আমরা দিয়ে দিতাম রুথ বা রুডি কেউ একজন আসত মিসেস কার্টিস ফোন করে বলেছিলেন উনি আসতে পারবেন না, একে শরীর খারাপ তার ওপর কোভিড, তাই রুথ বা রুডি কেউ সেলফ চেক নিয়ে এলে যেন আমরা তাদের দিয়ে দিই ওঁর ছাত্রী স্যালিও এসেছে কয়েকবার
এরপর রিয়া ল্যাবে গিয়ে কপিয়ারে কাগজটাকে ফেলে চেকগুলোকে এনলার্জ করে করে স্ক্যান করল তার পরেই কিমকে ফোন করে সোজা পুলিশ স্টেশন
পুলিশকে রিয়া বলল, “রুথ আর রুডি ছিল পেগির দিদির ছেলেমেয়ে পেগির নিকটতম আত্মীয় ওরা ধরেই নিয়েছিল পেগি নিজের সব সম্পত্তি ওদের দিয়ে যাবে, কিন্তু বছর ছয়েক আগে স্যালি উদয় হয় পেগি নিজের উইলে সব কিছু তার নামে করে দেন সেই খবর পেয়ে রুথ আর রুডি পেগির বাড়িতে এসে হাজির হয় পেগি নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদির দিকে খুব একটা খেয়াল রাখতেন না যা আছে তা আছে টাইপের মনোভাব, বা রুথ আর রুডি হয়তো তাঁর ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট লুকিয়েও ফেলত যাই হোক, কোনোভাবে একটা ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পেগির হাতে এসে পড়ে তখন তিনি দেখেন যে অ্যাকাউন্ট থেকে অনেক বেশি ডলার বেরিয়ে গেছে অতগুলো সেলফ চেক তো তিনি লেখেননি! তখন উনি বুঝতে পারেন কেউ তাদের আঁকার প্রতিভা কোনো কাজে লাগাচ্ছে! পেগির সই নকল করাতে! উনি ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে ফোন করেন পেগি বুঝতে পারছিলেন না কাজটা কে করেছে, রুথ, রুডি না স্যালি তিনজনই ভালো আঁকে আমি সইগুলো এনলার্জ করে দেখেছি প্রথম একটা চেকের সই একটু আলাদা, বাকিগুলো সব এক সেটা বোঝার জন্যে হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টও লাগছে না বড়ো করলেই বোঝা যাচ্ছে এবার আপনাদের কাজ ব্যাঙ্কে গিয়ে সিসি টিভি দেখে বোঝা ওই দিনগুলোতে সেলফ চেক নিয়ে কে গিয়েছিল আমার ধারণা রুডির কাজ ওগুলো, রুথ তাকে সাহায্য করেছে ওদের জেরা করলে হয়তো এটাও বেরিয়ে পড়বে যে খুনি সম্পত্তি পায় না ভেবেই ওরা স্যালিকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করে তাহলে বাড়ি আর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ওদেরই হয়ে যাবে নিকট আত্মীয় হিসেবে

()

ব্যাঙ্কের সিসি টিভি ক্যামেরাতে ধরা পড়েছিল রুডি আর রুথই গিয়েছিল ওই সব ভুয়ো চেক নিয়ে রুডিই বেশি তারই নাকি ঘন ঘন অর্থের দরকার হয়ে পড়ত দু’জনকেই পেগি পকেটমানি দিতেন মোটা রকমের তাও জুয়া খেলার নেশা হয়ে গেলে যা হয় পুলিশের জেরার মুখে রুথ ভেঙে পড়ে সব দোষ কবুল করে নেয় কীভাবে ঘুমের ওষুধ দিয়ে পেগিকে খুন করে ওরা, তারপর বাকি ওষুধসহ কৌটোটা স্যালির ঘরে লুকিয়ে ফেলে

*                   *                   *

রিয়া আর কিমকে পেগির বাড়িতে ডিনারে ডেকেছিলেন স্যালি অনেক রান্না করে ওদের খাইয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “আমার একটা ভুলভাল অতীত আছে, তাই আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না সবাই মনে করে আমিই দোষী, একমাত্র পেগি আমাকে বিশ্বাস করে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল আমি কী করে সেই বিশ্বাসের বদলে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি? আমি বুঝতে পারছিলাম কী হচ্ছে, কিন্তু পেগি ব্যাঙ্কে কত অর্থ রয়েছে কত তোলা হচ্ছে সে নিয়ে মাথা ঘামানো পছন্দ করত না আর ওরা তো ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পেগির হাতে পড়তেই দিচ্ছিল না আমি তাই একটা ডুপ্লিকেট বার করিয়ে পেগিকে দিয়েছিলাম পোস্টে এসেছে বলে আশা করেছিলাম সে খুলে দেখবে তবে আমি ভাবতে পারিনি ওরা এইভাবে পেগিকে খুন করে ফেলবে পেগিকে আমি খুব মিস করি যাই হোক, আমি ঠিক করেছি যে এই বাড়িটা বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে অন্য কোথাও একটা বাড়ি কিনে আঁকার স্কুল খুলব এখানে আমাকে অনেকে জেনে গেছে ছোটো জায়গা তো, তাই সন্দেহের কিছু দানা আমার নামের সঙ্গে লেগে থেকেই যাবে সারা জীবন
রিয়া আর কিম জানাল, সেটা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে
ওরা চলে আসার আগে স্যালি একটা বাক্স এনে রিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, “ওয়াটার কালারের বইগুলো পেগি আমাকে বলেছিল তোমাকে এগুলো দিতে, জিনিসপত্র গোছাচ্ছি এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে তাই এগুলো দিয়ে দিতে চাই সুযোগ পেলে আঁকাটা চালিয়ে যেও পেগির আত্মা শান্তি পাবে
----------
ম্যাজিক ল্যাম্প 

2 comments:

  1. খুব সুন্দর নিটোল, ছিমছাম একটা রহস্য গল্প। বেশ ভালো লাগল।

    ReplyDelete