গল্প:: বাবুনি - পূর্বা মুখোপাধ্যায়


বাবুনি
পূর্বা মুখোপাধ্যায়

বাবুনি ছিল দাদুভাইয়ের বেড়াল আমার দাদুভাই শ্রীযুক্ত মহীতোষ মিত্র একসময়ের ডাকসাইটে উকিল তালডুবি গ্রামে থাকেন তালডুবি গ্রামে আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশাল বাড়ি বাংলা সিনেমায় জমিদারবাড়ি যেমন পূর্বপুরুষদের কেউ একজন ছিল ওখানের জমিদারের নায়েব প্রচুর পয়সা-টয়সা করেন তার পরে যা হয়, জমিদারি উঠে যাওয়ার পরে সব ব্যাবসা চাকরি-বাকরি করতে শুরু করেন দাদুভাই গ্রামের বাড়িতে থেকে গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা করেন, তারপরে পাস-টাস করে কাছেই শহরের কোর্টে প্র্যাকটিস করেন প্রচুর টাকাপয়সাও করেন কিন্তু গ্রাম আর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি।
বাবা চাকরি করে কলকাতায়, সেখানেই ফ্ল্যাট পিসি দিল্লিতে, বিয়ের পর দু’জনেই ঠাম্মা মারা যাওয়ার পরে এবং আগেও দাদুভাইকে অনেকবার বলেছে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে তাদের কাছে এসে থাকতে কিন্তু দাদুভাই ‘আমি না থাকলে এই এত বড়ো বাড়ি, জমিজমা, বাগান, পুকুর সব পাঁচ ভূতে লুটে খাবে’ বলে কখনোই আসেননি তারপর তো ঠাম্মা মারা গেলেন দাদুভাই একেবারে একা যদিও পুতুলপিসি আর নারানদা, অনেক পুরোনো লোক ওরা, রাতদিন থাকে, বাড়িরই নিচের তলায়, ওদের পরিবার নিয়ে তাও দাদুভাই তালডুবির বাড়ি ছেড়ে আসেন না, বলেন‘এই বাবুনিটাকে ছেড়ে যাই কী করে?
বাবুনি ভারী অদ্ভুত বেড়াল অনেক বেড়ালই ন্যাওটা হয়, আবার বেড়ালদের মধ্যে এক স্বাভাবিক স্বাধীনচিত্ত থাকে আবার বেড়ালকে ঘরে আটকে রাখা যে কী কঠিন তা সবাই জানেন তা, বাবুনিও স্বাধীনচেতা তবে চারিদিক খোলা থাকা সত্ত্বেও বাবুনি কখনও বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়নি সে যেন এই বড়ো বাড়ির রাজকন্যে বাইরের বেড়ালদের সঙ্গে তার সর্বদা দূরত্ব বাবুনি বাইরে বেরোত কেবল দাদুভাইয়ের সঙ্গেই বিশেষ করে বিকেলে দাদুভাই যখন হাঁটতে যেতেন, বাবুনি তাঁর পাশে পাশে যেত দাদুভাই যেখানে যেখানে থামতেন, সে একটু দূরে বসে থাবা চাটত, নয় লেজ আছড়াত মৃদু মৃদু; আবার দাদুভাই সেখান থেকে চলতে শুরু করলেই সেও চলত
তালডুবির বাড়ির একটা বিশাল দক্ষিণের বারান্দা ছিল দাদুভাই সকালে আর সন্ধের পর সেখানে একটা ইজিচেয়ারে বসে অনেকটা সময় কাটাতেন কয়েকটা চেয়ারও ছিল পাতা, আর একটা শ্বেতপাথরের টেবিল সন্ধেবেলা কেউ এলে সেখানেই বসত ইজিচেয়ারের ঠিক পাশেই একটা চেয়ারে বসে থাকত বাবুনি ওই চেয়ারটাতে দাদুভাইয়ের একটা কাচা ধুতি ভাঁজ করে পেতে রাখতে হত বেশ কয়েকদিন একই ধুতি থাকলে বাবুনি ম্যাঁও ম্যাঁও করে জীবন অতিষ্ঠ করে দিত যতক্ষণ না কাচা ধুতি পাতা হচ্ছে দাদুভাই প্রশ্রয়ের হাসি হেসে পুতুলমাসিকে বলতেন‘ওরা খুব পরিচ্ছন্ন প্রাণী, বুঝলে?
আর একটা ব্যাপার ছিল এই যে দাদুভাই, এত বড়ো উকিল, কত পড়াশোনা, কিন্তু তার একটাই বদ অভ্যাস ছিলবিড়ি খাওয়া বলে বলেও ছাড়ানো যায়নি লোকসমাজে খেতেন না কিন্তু বারান্দায় বসে খেতেন আর বাবুনি কীরকম যে চোখ ছোটো করে, মুখ তুলে পরম মৌতাতে বিড়ির গন্ধ নিত! সকালেও দাদুভাই বাথরুমে যাবার আগে বারান্দায় বসে এক কাপ চা শেষ করে বিড়িটা ধরাতেন বাবুনি আবার ঐ মুখ উঁচু আর চোখ বন্ধ করে বিড়ির প্যাসিভ স্মোকার দাদু বিড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে যেতেন, আর বাবুনি ছাদে বা বাগানে সবাই অবাক হত, আর হাসাহাসিও চলত
দাদুভাইকে কোথাও কাজে বেরোতে হলে, যদিও তা কালেভদ্রে, বাবুনি ছাদের পাঁচিলের ওপর বসে থাকত রাস্তার দিকে চেয়ে, যতক্ষণ না দাদুভাই আসেন কাজেই খুব দরকার ছাড়া দাদুভাই বাবুনিকে ছেড়ে কোথাও যেতেন না আমরা ছুটিছাটাতে যেতাম বাবুনি আমাকে ভালোবাসত আর মাকে বাবার বেজায় বেড়াল অ্যালার্জি বাবুনি বাবার ধারেকাছেও ঘেঁষত না মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরত

সে দিন খুব বৃষ্টি সন্ধেবেলাতেই পাড়া নিঃঝুম জলে ডুবে গেছে কলকাতা হঠাৎই আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে বেড়ালের ম্যাঁও ম্যাঁও ডাক মা শুনেছেন প্রথমে ভেবেছেন বাইরের কোনো বেড়াল হয়তো জলে ভিজে আশ্রয় খুঁজছে কিন্তু তারপরেই ঠক্ঠক্ বাবুনি ঠিক এরকম করে কেউ যদি ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবুনির খুব আপত্তি কীভাবে যেন ছিটকিনিতে হাত দিয়ে ঠিক মানুষের মতোনককরেঠক্ঠক্ঠক্‌! ঠিক তিনবার মা দরজা খোলেন, দেখেন বাবুনি বসে আছে মা ভেবেছেন দাদুভাই এসেছেন বুঝি মা আদর করে বাবুনিকে ডাকছেন বাবুনি কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না মায়ের কথা শুনে বাবা বেরিয়ে এসেছেন মা বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন“এই দেখো বাবুনি বসে আছে, বাবা এসেছেন বোধহয়, দেখো তো!” বলেই তাকিয়ে দেখেন বাবুনি কই? একটা পাড়ার বেড়াল সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল
দরজা বন্ধ করতে না করতেই ফোন নারানদা দাদু অসুস্থ, অবস্থা ভালো ঠেকছে না তখনই রওনা হলাম আমরা পৌঁছোলাম ঠিকই, কিন্তু দাদু ততক্ষণে তালডুবির বাড়ি আর আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে যাত্রা করেছেন আর বাবুনিকে ছেড়েও
মাই প্রথম বলল, “পুতুলদি, বাবুনি?” পুতুলদি কাঁদছিল হাউ হাউ করে বলল -বেড়ালকে কেউ মরতে দেখে না বউমা কিন্তু দেখি বাবার পাশে বাবুনিওপেছনে বাগানে নিয়ে গিয়ে রেখেছে নারানদা ওখানেই…”
বাবুনিকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না দাদুভাই, বাবুনিও তাঁকে ছাড়া আমি কেবল ভাবছিলাম, মা যে বেড়ালটাকে দরজা খুলে দেখেছিল, সে কি
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
ম্যাজিক ল্যাম্প 

1 comment:

  1. খুব ভালো লাগলো পড়ে... আমার ঠাকুরদার আমি ছিলাম প্রাণ... যদি ও তিনি কোনো রকম নেশা করতেন না... Chartered Accountant ছিলেন, নিজের ফার্ম এ... উদ্যোগী সৎ পরোপকারী মানুষ ছিলেন... ওঁর যাওয়া টা ও আকস্মিক ছিলো... 2006 এর 18th মার্চ... আর আমার একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো... তারপর ই খবর পেলাম... ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে ❤️💕🥰

    ReplyDelete