গল্পের ম্যাজিক:: বন বন্দুক বাইসন - কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


বন বন্দুক বাইসন
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

“আরে ধুর!” হাত নেড়ে আমার কথাটাকে তোপের মুখে ঝোপের মতো উড়িয়ে দিয়ে কথা বলল ফ্রি-ল্যান্স ফটোগ্রাফার অরিন্দম রয়, “ওরকম কত সরকারিপনা দেখলাম! আসলে এসব হচ্ছে ফরেস্ট বিভাগের সাড়ে সাতাশ বছরের গাফিলতিহয়তো কোনও ঐতিহাসিক সময়ে অতসব জানোয়ার থাকলেও থাকতে পারে, তবে আজ ঐ তালিকার তিরিশটা জন্তুর মধ্যে পাঁচটাকেও গোটা চত্বর খুঁজলে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ!”
অরিন্দমের কথা শেষ হবার আগেই ওপাশ থেকে রিজাইনড্ আর্মি-ম্যান মেজর মনজিৎ কাপুরের প্রতিবাদ ভেসে এল, “নো ব্রাদার। আমি কিন্তু তোমার কথা সমর্থন করতে পারছি না তোমার হয়তো জানা নেই যে, ঐ তিরিশটার মধ্যে দশটাই স্মল অ্যানিমালস্, যেগুলো যে কোনও জঙ্গলেই থাকে কাজেই তোমার ঐ থিওরি অন্য দশটা সরকারি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে খাটলেও এখানে চলবে না
অরিন্দম চুপ মেজর কাপুরের কথার ভিত্তি সর্বদাই অতি সুদৃঢ় উনি যোগ করেন, “আমি নিজে এর অধিকাংশ জন্তু এই দু’বছর আগেও দেখেছিএমনকি ওখানকার যে জন্তুটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সবচেয়ে সন্দেহ, সেই রয়্যাল বেঙ্গলের মুখ থেকে প্রায় ফিরে এসেছি কী, বল না, ক্যাপ্টেন?
পাশে বসা ক্যাপ্টেনের মাথায় সস্নেহে চাপড় মারেন মেজর হাউম-হুম শব্দে ছোট্ট দুটো সম্মতি জানায় অবিবাহিত মেজর কাপুরের সর্বক্ষণের অতি বিশ্বস্ত সঙ্গী ‘ক্যাপ্টেন’, গ্রে-হাউন্ড জাতের একটি নির্মম সারমেয়

রাঁচি থেকে তেত্রিশ মাইল দূরে ‘কুরু মোড়’ থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকে গেছে, সেটা ধরে পালামৌ-এর বিখ্যাত স্যাংচুয়ারি, বেতলা অরণ্যের দিকে আমরা এখন দ্রুত এগিয়ে চলেছি আমি আগে একবারই এসেছিলাম এখানেমেজরের পঞ্চমবারআর অরিন্দমের এই প্রথম এবারে রাঁচিতে আসার সময় ওই আমাকে জোর করে ধরে আনল। আর ধরে আনল বলেই প্রায় তিনবছর পরে অপ্রত্যাশিতভাবে মেজরের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় আমরা যেন হাতে স্বর্গ পেলামজানি, এ ক’দিনের বেড়ানো আর নীরস কাটবে না যতক্ষণ মেজর সঙ্গে আছেন
যে কোনও কৌতূহলকর বিষয়ে রীতিমতো গভীর জ্ঞান মেজর মনজিৎ কাপুরের মতো আর খুব বেশি লোকের মধ্যে আমি দেখিনি। এছাড়া আর একটা বাড়তি সুবিধে পেয়ে গেছি আমরা, বাহন খোঁজার জন্য আমাদের আর কসরৎ করতে হয়নিমেজরের জীপেই এ ক’দিন জোনা আর দশাম ফলস্ দেখেছি। রাজরাপ্পা ঘুরে এসেছি আপাতত আমাদের গন্তব্যস্থল বেতলাওখান থেকে কাল দুপুরে নেতারহাট গিয়ে সেখানকার সূর্যাস্তশোভায় মগ্ন হওয়ার কথা আছে
বেতলা স্যাংচুয়ারিতে ঢোকার মুখেই যে সরকারি আবাস ও ক্যান্টিনটি আছে তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ তুললেই দেয়ালে আটকানো সেই তিরিশটি জন্তুর তালিকাটিতে চোখ পড়ে যাবে যা দেখার জন্যে প্রতিদিন এখানে মানুষের ভিড়কথা হচ্ছিল ঐ তালিকার জন্তু-জানোয়ারগুলো নিয়েই
অরিন্দম কথাটায় সায় দিতে পারছে না, আবার মেজরের অভিজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্যের বিরোধিতাও করতে পারছে নাএই দেখে অনেকটা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এবং কিছুটা দু’জনের বিতর্কের সমাধান করার জন্যও বটে, বললাম, “বেশ তো, তাহলে মেজর, আপনি স্পেশ্যাল চ্যানেলে ওখানকার জন্তুগুলোকে ডিটেলে দেখবার ব্যবস্থা করে দিন না অরিন্দমকে! তাহলেই তো ওর বিশ্বাস হবেবিশেষ করে ওখানকার ফরেস্ট অফিসার মিঃ মালহোত্রা যখন আপনার ক্লাসফ্রেন্ড
মেজর হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, “বহোৎ আচ্ছা ইয়ারএইসঙ্গে তোমারও স্পেশ্যাল এক্সপিরিয়েন্সটা হয়ে যাক, তাই না? সত্যি ব্রাদার, কোনও জটিল বিতর্কের সহজ সমাধানে তোমার কোনও জুড়ি নেই
ক্যাপ্টেন এসব অবান্তর কথায় যেন বিরক্ত হয়েই মাথা ঘুরিয়ে প্রতিবাদ করে — হাউম হাউম

***

বেতলা গিয়ে পৌঁছতেই সন্ধ্যা উতরে গেল। কিন্তু পৌঁছেই যে গা জল করা ঘটনাটা শুনলাম, তাতে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যেতে হল।
আমাদের পৌঁছবার আগেই তিনটে পার্টি তাদের গাড়িতে বেরিয়ে গিয়েছিল জানোয়ার দেখতেকিন্তু মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসেছিল শেষ দুটি গাড়ি এবং প্রথম গাড়ির একটিমাত্র লোক। বীভৎসভাবে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত সেই লোকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে যা জানিয়েছিল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই গমনোন্মুখ অপরাপর গাড়ির আরোহীরাও তৎক্ষণাৎ তাদের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিল। আর দশ মিনিটের মধ্যেই সরকারিভাবে ঘোষণা করা হল যে, অনিবার্য কারণবশত অনির্দিষ্টকালের জন্য স্যাংচুয়ারিতে ট্যুরিস্টদের প্রবেশ নিষিদ্ধ
অবশ্য সেই অনিবার্য কারণটা উপস্থিত কারোরই আর অজানা রইল নাতবুও সরকারি তরফ থেকে তো আর বলা চলে না যে, ফরেস্ট বিভাগের গাফিলতিতে কোনও অজানা কারণবশত একটা বাইসন সহসা সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়ে অগ্রগামী ট্যুরিস্টদের জীপটিকে এক অপার্থিব শক্তিতে ঢুঁ মেরে উল্টে ফেলে ত্রস্ত ভীত পলায়নপর ট্যুরিস্টদের মধ্যে দু’জনকে তার শিং দিয়ে সম্পূর্ণ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে! মাত্র একটি লোক ছাড়া আর কারোর চলৎশক্তি অবশিষ্ট নেই
আমরা যখন গিয়ে এই লোমহর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হলাম, তখন ফরেস্ট বিভাগের ক’জন কর্মচারীর সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মিঃ মালহোত্রা বেরিয়ে গেছেন প্রথম গাড়ির দুর্ভাগ্যগ্রস্ত লোকগুলোকে উদ্ধার তথা সমস্ত ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করতে
প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল তাদের ফিরে আসতেমেজর কাপুরকে দেখে মিঃ মালহোত্রার মুখে যেন অনেকদিন পরে দু’বন্ধুর দেখা হয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাসের চেয়ে ভেসে যাওয়া মানুষের পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার ভাবই বেশি দেখলাম প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে মেজরের দুটো হাত জড়িয়ে ধরে উনি হিন্দিতে যা বললেন, তার থেকে এটুকু উদ্ধার করা গেল যে, ঐ দুর্ঘটনাটি ঘটানোর পর থেকে পাগলা বাইসনটি উধাও
আহত ও নিহতদের তুলে এনে যথাযোগ্য ব্যবস্থা করার পর আবার তাকে খোঁজা হয়েছিল কিন্তু ফরেস্ট বিভাগকে সরকারি কৈফিয়তের মুখে ফেলে দিয়ে সে নিপাত্তা সুতরাং শেষ অবলম্বন হিসেবে অবশেষে একজন সরকারি শিকারিকে ডেকে পাঠানো হয়েছেঅবশ্য তখনও মিঃ মালহোত্রা মেজর কাপুরের উপস্থিতি সংবাদ পাননি
মেজর দু’চারটে কথা জিজ্ঞেস করলেন বেতলার ফরেস্ট বিভাগ প্রসঙ্গেতারপর যখনই বাইসনটির পাগলা হওয়ার প্রসঙ্গ এল, মেজর গম্ভীর মুখে শুধু একটি মন্তব্য করলেন, “সলিটারি বুল
মিঃ মালহোত্রার চোখে আশার ঝিলিক, “ঠিক। আমিও তাই ভেবেছি। সলিটারি বুল। বাইসনটি নিশ্চয়ই সর্দার ছিলএখন দলের একটি উঠতি জোয়ান গায়ের জোরে তাকে দল থেকে বের করে দেওয়ায় ক্ষিপ্ত বাইসনটি সলিটারি বুল হয়ে গেছেতীব্র অভিমানে আর প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায় একটি মানুষ মারার যন্ত্র হয়ে উঠেছেকিন্তু কাপুর, এরপর তো আরও বিপদ হবে। ও বাইসন তো থামবে নাএরপর আরও চতুর, আরও নৃশংস হয়ে উঠবে সেআর আমি কতদিনই বা ট্যুরিস্টদের ঠেকিয়ে রাখব?” মিঃ মালহোত্রার কন্ঠে আকুতি যেন উপচে পড়তে চায়
বরাভয়ের ভঙ্গিতে একটা হাত তুলে মেজর কাপুর বলেন, “আমার জীপে অয়েল ট্যাঙ্ক ভর্তি করার ব্যবস্থা কর মালহোত্রা।”

***

       বেতলা ফরেস্টের তীব্র ঘন অন্ধকার গাছগাছালির মধ্যে অলক্ষ্য জীবজন্তুদের চোখের মতো মানুষের চোখও জ্বলে। সে সঙ্গে জ্বলে মেজর কাপুরের হুডখোলা জীপের হেডলাইটচলেছেন মেজর, মিঃ মালহোত্রা, ওঁর দু’জন দেহরক্ষী, একজন সার্চ-লাইটবাহী স্থানীয় গাইড, ড্রাইভার ও ক্যাপ্টেনসঙ্গে আছি আমি আর অরিন্দম
অরিন্দম শুধু তার জীবিকার জোরে, আর আমি ক্যালকাটা শুটিং ক্লাবে কিছুদিন রাইফেল চালনা শেখার সুবাদে এই ভয়াল বিগ গেমসের সঙ্গী হতে পেরেছি
জীবজন্তু সম্পর্কে যেটুকু জানা আছে তা হল, দলবেঁধে থাকা প্রত্যেক জীবজাতিরই মধ্যে মাঝেমাঝেই এ ধরনের সর্দার হটানো পর্ব চলে এবং বাতিল হওয়া সর্দার এক্ষেত্রে হয়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ জানোয়ারআর এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন জীবের মধ্যে সবচেয়ে শয়তান আর বেপরোয়া হয় আবার শুয়োর আর বাইসনকাজেই আমাদের এ অভিযান এক বিপজ্জনক পথে পা বাড়াবে বুঝেই বোধহয় মনের কোণে এক অবচেতন ভয় নিয়ে নিরস্ত হতে চেয়েছিলামমেজর কাপুরের এক খোঁচায় তা উবে গেল। হাসতে হাসতে উনি শুধু বললেন, “মাই ডিয়ার ব্রাদার, এর থেকেই বুঝে নাও বাঙালি কেন তার গ্রেড আর এক ডিগ্রিও বাড়াতে পারে না
ব্যস, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এই একটা কথার শেকলই যথেষ্ট শক্ত, মেজর জানেনআর যাই হোক, বাঙালির অবমাননা তো সহ্য করা যায় না! তবে মেজর অবশ্যই যাওয়ার আগে বারবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার টিপ কাজ চালাবার মতো যথেষ্ট কিনা, আর আমি আগে কোনও বড়ো রাইফেল চালিয়েছি কিনা
মেজর মানেই একটি পয়েন্ট থ্রি সেভেনটি ফাইভ ম্যাগনাম রাইফেল তাঁর সঙ্গী, যার গুলির ওজন তিনশো গ্রেনকিন্তু বাইসন শিকারে তিনশো গ্রেনের গুলি অ্যালাউড হলেও মেজর কোনও রিস্ক নিতে চাননি আর তাই ওই দুই বন্ধুর মতো আমার হাতেও এখন ঝকঝক করছে একটি ডাবল ব্যারেল পয়েন্ট ফোর ফিফটি ফোর, যার থেকে বেরোনো প্রত্যেকটি জ্বলন্ত গুলির ওজন হবে চারশো গ্রেন। ঠিকমতো লাগলে যেগুলোর একটির আঘাতে হাতিও ভূপতিত হয়
ফরেস্ট অফিসের র‍্যাক থেকে অস্ত্রগুলো বেছে নিতে নিতে মেজর বলছিলেন, “সংখ্যায় রাইফেলের গ্রেড যত বাড়তে থাকে রাইফেল ক্রমশ তত শক্তিশালী হয়আর বাইসন, বাঘ, সিংহের মতো বড়ো বড়ো জন্তু মারতে দরকার মিনিমাম তিনশো গ্রেন ওজনের গুলি,  যেজন্যে দরকার অন্তত আমার রাইফেলটার মতো কোনও ফায়ার আর্মস। সেখানে এমনকি আমাদের পয়েন্ট তিনশো তিন মিলিটারি রাইফেলও কার্যকরী নয়।”
এদিকে আবার এক আশ্চর্য ঘটনামেজরের ম্যাগনাম রাইফেলটি অত্যন্ত বিসদৃশভাবে উঠেছে আমাদের অরিন্দম রয়ের ক্যামেরা ধরা হাতেআনাড়ির হাতে ওই রাইফেল দেখে আমি আতঙ্ক বোধ করায় মেজর অবশ্য জীপে ওঠার আগে গোপনে আমায় বলে দিয়েছেন, অরিন্দমের রাইফেলে গুলি ভরা নেইকথাটা শোনার পর তবে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছি
গাইডের হাতের সার্চ-লাইট ভলকে ভলকে আলো উদ্গিরণ করছে শাল-পিয়াল-সেগুনের অন্ধকার অভ্যন্তরেআমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রতীক্ষা করছি একটা অদৃষ্টপূর্ব অভিজ্ঞতা লাভের জন্য
ইতিমধ্যে আমাদের উন্মুখ চোখে ধরা দিয়ে গেছে তিনখানা হাতি, খানপাঁচেক সম্বর এবং... হ্যাঁ, একদল বাইসনও!
সলিটারি বুল যে দলের প্রাক্তন সর্দার সে দলেরই আশেপাশে ঘুরে অকারণ প্রাণীহত্যা করে নিজের সামর্থ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে তাই ঐ দলের আশেপাশে নিঃশব্দে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ মেজর যখন বললেন যে ‘আমরা কি ঠিক করছি? এর চেয়ে হাঁকডাক করতে থাকলে তো হিংসায় উন্মুখ ঐ বাইসন সহজে বেরিয়ে আসতে পারে!’ তখন আমরা সকলেই সমর্থন করলাম কথাটা এবং তারপর ঐভাবে চক্কর দিতে দিতেই জোরে জোরে কথাবার্তা বলতে লাগলাম
জীপের হর্নে বাইসনের দলটি চঞ্চল হল, তবুও কোনও অঘটন ঘটল না
এবার মিঃ মালহোত্রার পালাউনি প্রস্তাব দিলেন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটার জায়গায় গিয়ে দেখতে মেজর সঙ্গে সঙ্গে মুখরিত, “মাই গড! ইউ আর কারেক্ট মালহোত্রা। কী বাজে ব্যাপার ভাবো তো! আমরা অকারণেই এই একটি দল দেখে ভেবে চলেছি যে, ঐ বাইসনটি এ দলেরই দলপতি ছিল। আরও তো কত বাইসন আছেইস, ছিঃ ছিঃএতদিন পৃথিবীতে এসেও বুদ্ধির তেমন কোনও উন্নতি হল না দেখছি!”
আমরা ঘটনাস্থলে এলাম। যথারীতি জোরে জোরে কথাবার্তা বলতে বলতে ধীরে ধীরে জীপ চালাতে লাগলামমেজর জীপ থেকে নেমে চুরুট ধরিয়ে পাশে পাশে হেঁটে চলছিলেনহঠাৎ অরিন্দমের একটা অবান্তর কথায় এত জোরে হেসে উঠলেন যে, এই রাতেও কোনও গাছ থেকে ডানা ঝটপটিয়ে পাখিরা উড়ে গেলআর ঠিক সেসময় ঘুরন্ত সার্চলাইটের আলোয় আমার চোখে পড়ে গেল সেই শিউরে ওঠা দৃশ্য
এক পলকের জন্য দেখা ক্রুর দুটো চোখের সেই হিমশীতল দৃষ্টি জীবনে কোনওদিন ভোলা যাবে নাআমার হৃৎপিন্ড কেউ যেন ঠান্ডা হাত দিয়ে সজোরে চেপে ধরলআমি এক অজানা ভয়ে প্রায় ককিয়ে উঠলাম, “মেজর!”
ইতিমধ্যে আর একবার সার্চ-লাইটের আলো পড়েছে তার গায়ে। গাইড সেই আলো ঠিক করে ধরতে না ধরতেই বুলেটের গতিতে সেই বাইসনকে আমি ছুটে আসতে দেখলাম
সাচ্চা মিলিটারিম্যান মেজর কাপুরের সে মুহূর্তের অ্যাকশন কোনওদিন ভুলব নাআমার ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সেফটি ক্যাচ খোলা হয়ে গেছেনিষ্কম্প হাতে ডাবল ব্যারেল রাইফেলের দু’খানা বুলেট উনি ফাঁকা করে দিলেন। আর সে মুহূর্তে সবাই দেখতে পেল মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট এক জীবের আশ্চর্য আনুগত্যের নমুনাআমি দেখেছিলাম প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে দু’খানা গুলি খেয়েও মেজরের দিকে সোজা ছুটে আসছে যমদূতটামেজর আর দ্বিতীয়বার গুলি লোড করারও সময় পাবেন না। সে চরম ভয়ের মধ্যেই আমি শুধু অনুভব করলাম আমার পাশ থেকে কেউ যেন উড়ে বেরিয়ে গেল
দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ শিকারি-কুকুর ক্যাপ্টেন, সুদীর্ঘ লাফে গিয়ে বাইসনটির ঘাড়ের ডান পাশ কামড়ে ধরেছেবাইসনটি ছুটতে ছুটতেই ঝাঁকি দিল একবারতারপর এক ঝটকায় ক্যাপ্টেনকে ফেলে দিয়ে সুতীক্ষ্ণ করুণ ডাক ছেড়ে বাঁদিকের জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল
কিন্তু সে ডাক শুনেই মিঃ মালহোত্রার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল কেন? মেজর কাপুর অস্ফুটে ‘বাই জোভ’ বলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন কেন? এ কি শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ?
মেজর জীপে উঠে এসে ক্যাপ্টেনের মাথায় মৃদু চাপড় মারলেন, নিজের মনে মাথা নাড়লেন একবার তারপর ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করলেন বাইসনটি যেদিকে গেছে সেদিকে যাবার জন্য
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মালহোত্রার দিকে তাকাতে উনি কুন্ঠিত মুখে বললেন, “দ্যাট ওয়াজ এ ফিমেল বাইসন।”
তখনই আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারলামআসলে এই বাইসনটি সেই খুনি বাইসন নয়কারণ, মাদী বাইসনরা সর্দার হয় না। বললাম, “তাহলে তো সেই আসল বাইসনটাকে খুঁজে বার করতে হবে
মেজর মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “নো নোতোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ব্রাদারওর চোখ বলছে ওটাই সে শয়তান। গুলিও লেগেছে মোক্ষম জায়গায়আমার এই হাত দুটোকে আমি বড়ো বেশি বিশ্বাস করি ব্রাদার, আর সেজন্যেই তো আরও অবাক হচ্ছি যে কী করে এই গুলি খেয়েও একটা মাদী বাইসন ঐভাবে উধাও হতে পারে! প্রাণের চেয়েও বড়ো কোনও পিছুটান না থাকলে তো সেটা সম্ভব নয়আর সেটাই ওর পাগল হওয়ার কারণ বলে আমার...”
মেজরের কথা শেষ হবার আগেই ক্যাপ্টেন প্রবল জোরে ডেকে উঠতে মেজর গাড়ি থামাতে বললেন।
দু’মিনিটের মধ্যে সেই আহত বাইসনকে নিহতরূপে আমরা আবিষ্কার করলাম একটা ঝোপের আড়ালেওর পা দুটো প্রায় আগলে রেখেছিল যে প্রাণীটাকে সেটা নিশ্চয়ই ওরই বাচ্চা। আর অনেক আগেই বাচ্চাটি নিহত, রাইফেলেরই এক অব্যর্থ গুলিতে
মেজর মাথা নাড়লেন মিঃ মালহোত্রার দিকে চেয়ে মিঃ মালহোত্রাও যেন সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন, “পোচার।”
আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেলকোনও এক পোচার, মানে চোরাশিকারি বনরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে বাইসনের বাচ্চাটাকে গুলি করেছিলকিন্তু ধারে কাছে মা থাকায় আর চুরি করতে পারেনি সেই মা চোখের সামনে তার সন্তানের অপঘাত মৃত্যু দেখে রাগে ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে গিয়ে তছনছ করে দিয়েছিল বেতলা ফরেস্টের সাময়িক শান্তিশৃঙ্খলাআতঙ্ক হয়ে উঠেছিল অপরাজেয় মানুষের কাছেওএখন সে আমাদের চোখের সামনে চিরশান্তিতে নিমগ্না
এ একদিক থেকে ভালোই হলযদিও আমি মেজরের আক্ষেপের কারণ বুঝতে পেরেছি জঙ্গলের আইন কিছুটা জানি বলেই। এসব জীবের অনুভূতির শক্তি তত প্রখর নয় বলেই এরা একদিন থেকে দু’দিনের মধ্যেই ভুলে যায় সন্তানের বিয়োগব্যথা। কাজেই সফট-নোজড বুলেট দিয়ে ওর ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দেবার বদলে একটা ঘুমপাড়ানি বুলেটে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেই সে সব ভুলে যেতঅবশ্য তার বদলে সে এখন চিরঘুমের দেশে গিয়ে মিলিত হতে পেরেছে তার সন্তানের সঙ্গেএ মিলনও বড়ো কম নয়
ওর ঘাড়ের কাছ থেকে রক্তের ধারা বেরিয়ে কীভাবে ওর সাদা পা-কে লাল করে দিয়েছে দেখতে দেখতেই চমকে উঠলামওর চোখের কোলে সার্চ-লাইটের আলোয় ওটা কী চিকচিক করছে? অশ্রু? আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আর সে মুহূর্তেই আমার পায়ের কাছে শুকনো পাতার ওপর টপ করে কী পড়ল দেখেই বুঝলাম, আমিও কাঁদছি
এ কান্না আমার শুধুই শোকপ্রকাশ নয়পৃথিবীর একজন মানুষের ক্ষমাহীন অপরাধের জন্য মানুষের হয়েই এ আমার ঐকান্তিক ক্ষমাপ্রার্থনা
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়

3 comments:

  1. দারুন গল্প।আরো শিকারের গল্প লিখুন।

    ReplyDelete
  2. অনেকদিন পর এতো সুন্দর শিকারের গল্প পড়লাম। মন ভিজে গেলো

    ReplyDelete