ম্যাজিক ল্যাম্প:: এপ্রিল ২০১৭

দ্বিতীয় বর্ষ।। তৃতীয় সংখ্যা।। এপ্রিল ২০১৭
দুরন্ত অভিযান সংখ্যা


প্রচ্ছদঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
_____

সম্পাদকীয়:: এপ্রিল ২০১৭


ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখি দুরন্ত অভিযানের গভীর অরণ্য, অশান্ত সমুদ্র, পিরামিড, মরুভূমি, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল থেকে মঙ্গল, নেপচুন, প্লুটো - চোখের সামনে ভেসে ওঠে কতই না দূর-দূরান্তের ছবি
কতদিন ইচ্ছে হয়েছে বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট কেটে নেমে পড়ি কোনও অজানা জায়গায় সেখানকার বিচিত্র মানুষদের সঙ্গে আলাপ করি তাদের একজন হয়ে কাটিয়ে যাই কিছু সময় আবার চুপচাপ কাউকে না জানিয়ে সব ছেড়ে পাড়ি দিই নিরুদ্দেশে ঠিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদর মতো
ম্যাজিক ল্যাম্পের এই সংখ্যায় থাকছে দুরন্ত অভিযানের গল্প। তাই বন্ধুদের বলছি, সিটবেল্ট বেঁধে নাও, টিকিট কেটে নাও, পাল তুলে দাও এসে গেছে আমাদের দুরন্ত অভিযান সংখ্যা

এই সংখ্যায় থাকছে মনমাতানো গল্প, অভিযানের ছড়া, প্রবন্ধ, আর একটি বিশেষ বিভাগ – ‘আমার ম্যাজিক অভিযান’ নামে, যেখানে আছে সত্যিকারের অভিযানের অভিজ্ঞতা তাপস মৌলিকের কলমে অনবদ্য ‘টো টো কাহিনি’, পাঁচটি দুর্দান্ত কমিকস - তাপস মৌলিক, সুমিত রায়, সায়ন পাল, সপ্তর্ষি দে সম্বিতা দত্তের কলমে তুলিতে ‘আমার ছোটোবেলা’ বিভাগে ছোটোবেলার অভিজ্ঞতা লিখেছেন শ্রী চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় থাকছে অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ এবং অবশ্যই ছোটোদের নিজস্ব আঁকিবুঁকির বিভাগ ‘ম্যাজিক পেন্সিল’ এবারের বিষয় ছিল ‘প্রিয় অভিযাত্রী চরিত্র’। সেখানে ছোটোরা এতো সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে পাঠিয়েছে যে বলার নয়
বাংলা নববর্ষে একগুচ্ছ রঙিন উপহারের ডালি সাজিয়ে তোমাদের সামনে উপস্থিত তোমাদের ভালোবাসার বন্ধু ম্যাজিক ল্যাম্প গরমের ছুটিটা হুল্লোড়ে কাটুক, মজায় কাটুক শুভ নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা নিও খুব খুব ভালো থেকো বন্ধুরা।

ইতি জিনি
_____
ছবিঃ চিরঞ্জিত সামন্ত

গল্পের ম্যাজিক:: তাতুনের কলকাতা সফর - প্রকল্প ভট্টাচার্য


তাতুনের কলকাতা সফর
প্রকল্প ভট্টাচার্য

ইস্কুল ছুটি হলে সক্কলের আনন্দ হয়, শুধু তাতুনের খুব মনখারাপ হয়ে যায়। সবাই কেমন দৌড়ে বাড়ি ফেরে, ও ফেরে আস্তে আস্তে, পায়ে পায়ে হেঁটে। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে জানলার ধারে বসে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মা শরবত নিয়ে আসে, কেক নিয়ে আসে, শশা কেটে আনে। তাতুন খায়, কিন্তু সে না খাওয়ার মতোই। মা বলে, তাতুন, টিভি দেখবি? তাতুন, সাইকেল চালাতে যাবি? তাতুন, তোর বন্ধুরা খেলতে ডাকছে, যাবি? তাতুন হ্যাঁ-ও বলে না, না-ও বলে না। চুপ করে বসে থাকে।
তখন ওর খুব মন কেমন করে ওর নিজের বাড়ির জন্যে। হ্যাঁ, সত্যিকারের বাড়ি। এটা তো কোয়ার্টার্স। বাড়ি তার কলকাতায়। সেখানে এখন কত্তো মজা হচ্ছে! গলিতে কালো, ভোঁদা, বাবুসোনারা ক্রিকেট খেলতে নেমে গেছে, তার মাঝখান দিয়ে বাপিনদা সাইকেল চালাচ্ছে আর ইচ্ছে করে ধাক্কা দিচ্ছে একে ওকে, জয়দা ক্যারাম বোর্ড পেতে একা একা প্র্যাক্টিশ করছে, শ্যামলকাকুরা ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে...
সবাই কেমন মজা করছে, আর তাতুন এই এত্ত দূরে তামিলনাড়ুর কোন অজগ্রামে পড়ে আছে। কোনও মানে হয়!
খুব মনখারাপ হলে তাতুন বাবার কাছে চলে আসে। বাবা ছোট্ট স্টেশনটার স্টেশনমাস্টার। স্টেশন মাস্টারশুনে তাতুনের হাসি পেত খুব। স্টেশনের আবার মাস্টার কী! না আছে ছাত্র, না কিছু, একজন রোগা পয়েন্টকাকু পতাকা নাড়ায়, আর একজন সিগন্যাল ঠিক করে, এই তো। এর আবার মাস্টার! বাবার কাজ বলতে সারাক্ষণ একটা টেলিফোন তুলে ‘হ্যালো হ্যালো’, আর কীসব চাবি টেপাটেপি। টিকিটঘরে দুটো কাকু আসে, তাদের সঙ্গে আড্ডা। বিশেষ কেউ ট্রেনে চড়েও না, টিকিটও কাটে না। ঝুড়ি ভর্তি সবজি নিয়ে বিক্রেতারা নামে, অনেকে সাইকেল নিয়েও নামে। কেউ বোধহয় টিকিট কাটে না। স্টেশনে এলে তবুও তাতুনের একটু সময় কাটে, ভালো লাগে। মনে করে রাখে সব গল্পগুলো, ফিরে গিয়ে গাবুলদাদা, সুজিতদাদাদের বলতে হবে তো! কিন্তু, কবে যে যেতে পারবে!
এই স্টেশন দিয়েই হুশ হুশ করে এক্সপ্রেস গাড়ি যায়, মালগাড়ি যায়। মালগাড়ি গেলে তার বগিগুলো গোনে তাতুন। মাঝে মাঝে দু’একটা তেলের গাড়ি যায়। আর লোকাল ট্রেন তো আসেই ফি ঘন্টায়। পয়েন্টকাকু বলে ইউনিট হি হি, ট্রেনের কি ইউনিট, টেন্স, হান্ড্রেডস প্লেস হয়? বাবা শিখিয়েছে, ওটা শুধু ইউনিট নয়, ইএমিউ। ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিট। এক্সপ্রেস গাড়িগুলো এত তাড়াতাড়ি যায়, তাদের নাম পড়তে পারে না তাতুন। বাবা বলে দেয়, কোথায় কোথায় যায় গাড়িগুলো, আপ আর ডাউন, যাওয়া আর ফেরা, সব গাড়িরই। এমনভাবেই তাতুনরাও তো একদিন এসেছিল এইখানে কিন্তু ফিরতে পারছে না কেন!

আজ ইস্কুল ছুটি। সকালে দুধ-পাঁউরুটি খেয়েই মাকে বলে তাতুন পায়ে পায়ে স্টেশনে চলে এল। বাবা জোরে জোরে ফোন করছে, ব্যস্ত বোধহয়। লম্বা প্ল্যাটফর্মটা একেবারে ফাঁকা। চারটে বেঞ্চি পাতা। পেছনে ব্যুগনভিলিয়াগাছ। হাল্কা হাওয়া দিচ্ছে, বাতাসে অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ। তাতুন দূরের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। দূর থেকে একটা ট্রেন আসবার শব্দ... এটাই তো কলকাতা যাওয়ার গাড়ি! কিন্তু গাড়িটা এত আস্তে আস্তে আসছে কেন? এ কী, থামবে নাকি! হ্যাঁ ঠিক! তাতুনের সামনে এসে থেমেই গেল গাড়িটা! এগিয়ে দেখতে গেল তাতুন। দরজার কাছে একজন টিটিই দাঁড়িয়ে।
আঙ্কল, এই ট্রেনটা কি কলকাতা যাচ্ছে?”
হ্যাঁ যাচ্ছে উঠবে তো চটপট উঠে পড়ো, এখুনি ছেড়ে দেবে! এই বলে টিটিই-আঙ্কল তাতুনের হাতটা ধরে টানতেই তাতুন ট্রেনে উঠে পড়ল, আর ট্রেনটাও ছেড়ে দিল। জানলার ধারের একটা সীট খালি পেয়ে তাতুন বসল সেখানে। একমুহুর্তের জন্য তার মনে হল যে বাবাকে জানিয়ে এলে হত কিন্তু সত্যিই সে কলকাতা যাচ্ছে, এই আনন্দে আর জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া পেয়ে সে সব ভুলে গেল। মনটা খুশিতে ভরে উঠল অনেকদিন পর
সোনালি রোদ্দুরে চারপাশ ঝলমল করছে। বালি, মাটি আর পাথুরে রাস্তার পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। চাকাটায় আওয়াজ হচ্ছে তালে তালে ঠিক মনে হচ্ছে যেন বলছে ‘যাচ্ছেতাতুন কলকাতাতেযাচ্ছেতাতুন কলকাতাতে’
তামিলনাড়ু ছাড়িয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ চলে এসেছে কখন তাতুন টের পায়নি বাবা শিখিয়েছিল, এটা দাক্ষিণাত্যের মালভূমি লাল বালি মাটি আর কী ধুলো! লাইনের পাশের গাছগুলোর পাতা দেখে মায়া হয়, কতদিন জল পায়নি, আর ধুলোয় চাপা পড়ে ধুঁকছে মাঝে মাঝে শহরতলি বা বড়ো শহর স্টেশনের নামগুলো পড়া যাচ্ছে না, তবুও গুডুর, নেল্লোর, সব অদ্ভুত কয়েকটা নাম দেখা গেল। রাস্তায় সাইকেল, বাস, লরি ছেলেমেয়েরা স্কুল যাচ্ছে, নাকি ফিরছে? বাড়িগুলো বেশিরভাগ একতলা আর খুব রঙচঙেদোতলা হলে সিঁড়িটা বাইরের দিকে। বৃষ্টি হলে দোতলায় উঠবে কী করে? বড়ো বড়ো আমবাগান, কলাবাগান, নারকেলগাছের সারি ধানক্ষেতও আছে, তবে শুকনো মনে হল। একটা নদীর ওপর দিয়ে ঘড়ঘড় করে ট্রেন গেল তাতুন দেখল তাতে জল প্রায় নেই বললেই চলে, শুধু বালি। ওর মনে পড়ল, জিওগ্রাফি মিস বলেছিলেন, রেইনফেড রিভারস আর স্নোফেড রিভারস, ইরিগেশনের ধরণধারণ ওই যে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো খাঁজকাটা, ওটাই তো স্টেপ কাল্টিভেশন, তাই না? আরে! ঐ যে ডোঙ্গা সিস্টেমে জল তুলছে দুটো লোক ওই জল তাদের ক্ষেতে যাবে সত্যি, সেই রিট্রিটিং মনসুন না আসা পর্যন্ত বৃষ্টি হবে না তার ওপর এত গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে, ঝড়ে পড়ে যাচ্ছে আহা রে, ভাবতে ভাবতে তাতুনের জলতেষ্টা পেয়ে গেল। এই রে, ওয়াটার বটল তো নেই সঙ্গে! কী করবে এখন! তাতুন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। উলটোদিকের সীটে বসা আঙ্কলটা একটা বই পড়ছিলেন ঠিক বুঝতে পেরে বললেন, “জল খাবে? এই নাও।বলে নিজের জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিলেন।
অনিচ্ছেসত্ত্বেও তাতুন ওঁর বোতলটা নিয়ে জল খেয়ে ফেরত দিল।
থ্যাঙ্কস, আঙ্কল!
নো মেনশন। কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
কলকাতা
বাহ্‌, আমিও কলকাতা যাচ্ছি। তুমি কি একা যাচ্ছ?”
মনে পড়ল, মা শিখিয়ে দিয়েছিল একা থাকলেও কক্ষনও সেটা কারোকে না জানাতে। তাই তাতুন বলল, “না না, আমার বাবা-মা পাশের বগিতে আছেন।
ওহো, আচ্ছা,আর কিছু না বলে আঙ্কল আবার বই পড়তে লাগলেন। তাতুনও জানলার দিকে মুখ ফেরাল।
একভাবে চলতে চলতে কই ট্রেনটা তো ক্লান্ত হচ্ছে না! মাঠ, শহর, পাহাড়, নদী পেরিয়ে ছুটেই চলেছে সমান তালে। কখনও কখনও গতি কমে এলেও থামছে না বললেই চলে। পাশ দিয়ে আর একটা এক্সপ্রেস গেল, কী জোরে! না না, তাতুনের মনে পড়ে, উল্টোদিকে যাচ্ছিল তো, তাই রিলেটিভ ভেলোসিটির জন্যে অমন মনে হলআসলে অতো জোরে যাচ্ছিল না ট্রেনটা। ঠিক যেমন, একটু আগে একই দিকে পাশাপাশি একটা মালগাড়ি যাচ্ছিল সেটা যেন মনে হচ্ছিল চলছেই না!
একটুখানি থামল একটা স্টেশনে। নাম টুনি। হি হি, মজার নাম তো! যাঁরা লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছিলেন তাঁদের খাবার এল। সামনের আঙ্কল বললেন, “তুমি খাবে না?”
না, খিদে পায়নি আমার,” তাতুন বলল বটে, কিন্তু বেশ টের পাচ্ছিল পেট চুঁই-চুঁই করছে।
আমার কাছে একস্ট্রা পরোটা আছে, তরকারিও আছে। এই নাও।
না না করেও তাতুন হাত বাড়িয়ে নিল, আর তিনটে পরোটা খেয়েও নিল চেটেপুটে। আঙ্কল অবশ্য আর বাবা-মায়ের কথা জানতে চাননি, ভাগ্যিস!
ভরপেটে বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি মতন এসেছিল তাতুনের। হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় আওয়াজে চমকে উঠে দেখল বিরাট একটা ব্রিজ।
কৃষ্ণা নদী,সামনের আঙ্কল বললেন, বিজয়ওয়াড়া স্টেশন আসছে এরপর।
এত লম্বা ব্রিজ!তাতুন অবাক।
হাসলেন আঙ্কল, আরও একটা লম্বা ব্রিজ পেরোবো আমরা। গোদাবরী নদীর। আর দুই ঘন্টা পরেই।
ব্রিজ শেষ হল। কী বিরাট একটা শিবলিঙ্গ দেখা গেল! বড়ো বড়ো বাড়ি, অফিস ট্রেন ধীরে ধীরে বিজয়ওয়াড়াতে ঢুকল।
দক্ষিণ ভারতের সব বড়ো স্টেশনেরই প্রায় একরকম, একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। লাইনের পাশে জমা জল বা আবর্জনায় ছিটোনো ফিনাইল, ফেলে দেওয়া তরকারি, নষ্ট হয়ে যাওয়া নারকেল চাটনি, গরম ভাজা ধোসা, সব মিলিয়ে একটা কেমন টকচে গন্ধ। শব্দও থাকে একরকম। একবার বুঝতে না পারা ভাষায়, একবার হিন্দিতে আর একবার ইংরিজিতে ট্রেনের ঘোষণা, টি-কাফি, ব্রিয়ানি-ব্রিয়ানি, গরম্পুরি-গরম্পুরি। কই, বাবার স্টেশনে তো এরকম থাকে না! হঠাৎ বাবা-মায়ের জন্যে একটু মন কেমন করে উঠল তাতুনের। নাহ্‌, বাবাকে জানিয়ে এলেই হত। মাও চিন্তা করবে। বাবা দুপুরে বাড়ি ফিরে শুনবে তাতুন স্টেশনে গেছে, কিন্তু ফেরেনি। এতক্ষণে হয়তো খোঁজাখুঁজি করছে সবাই। যাক গে, ওদের ভরসায় থাকলে কলকাতা আসা হত না। আর তো কয়েক ঘন্টারই ব্যাপার, তারপরেই পৌঁছে যাবে। বাড়ি পৌঁছে শিশিজেঠুকে বলবে একটা ফোন করে বাবাকে জানিয়ে দিতে।
হঠাৎ দেখল, ওর বয়সেরই একটা ছেলে নোংরা ছেঁড়া জামাপ্যান্ট পরে কামরার ভেতরে ঝাঁট দিতে এল। ঢোকামাত্রই সক্কলে, এই, ভাগ! যাঃ, বেরো!করে তাকে তাড়ালতারপর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, “এগুলো পাকা চোর। আগেরবার আমার কাকার নতুন জুতো এই স্টেশনেই তো চুরি হল!
এসবের মধ্যেই আবার গাড়ি ছাড়লযারা জল আনতে স্টেশনে নেমেছিল, হৈ হৈ করে দৌড়ে উঠে এলএক যাত্রীর সঙ্গে কুলির ঝগড়া বেধেছিল যে যার মাতৃভাষায় কীসব বলছিল যা অন্যজন বুঝতে পারছিল না। গাড়ি চলতে শুরু করায় সেই ঝগড়াও গেল থেমে। ধীরে ধীরে রাজকীয় ভঙ্গিতে স্টেশন পেরিয়ে আবার স্পিড গেল বেড়ে। ঠা ঠা রোদ্দুর, তার মধ্যে পাথুরে জমির থেকে বেরনো গরম হলকা... কামরার অনেকেই জানালার লোহার পাল্লা নামিয়ে ঘুমোচ্ছেন কিন্তু তাতুন বসে রইল গোদাবরী নদী দেখবে বলে। স্টেশনের নামগুলো ভারি মজাদার। এলুরু, টাডেপল্লিগুডেম, নিডাডাবোলু... হি হি হি হি! এসবের মধ্যেই চলে এল গোদাবরী নদী আহা, সাধে কি বলে দাক্ষিণাত্যের গঙ্গা! মাঝখানে বালির চর, তবুও কতো জল! লোকজন পয়সা ফেলছে জলে, ওতে নাকি মানত পূরণ হয়। ব্রিজটা বোধহয় এক কিলোমিটার লম্বা, আর দোতলা! ওপর দিয়ে বাস-লরির রাস্তা, আর নীচ দিয়ে ট্রেন-লাইন। ওরেব্বাস, কী দারুণ ব্যাপার! তাক লেগে যায় তাতুনের। তারপর ব্রিজ শেষ হয়ে আসে রাজমুণ্ড্রি স্টেশন।
এতক্ষণ জেগে থেকে ক্লান্ত তাতুনের চোখ ঢুলে আসতে থাকে ক্রমেআবার যখন চোখ খোলে তখন বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে। বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে কিছু আলো। স্টেশন এলে কিছুটা জায়গা আলোকিত। সব চিরে ট্রেন ছুটেই চলেছে। তাতুনের একটু বোর লাগে। এতক্ষণ ধরে একভাবে বসে থাকা যায়! একবার উঠে টয়লেটে ঘুরে আসে। এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়ার জায়গাটা দেখে ভয় করে, কী জোরে নড়ছে পাটাতনদুটো! বাবা বলেছে, ওই যাতায়াতের জায়গার নাম ভেস্টিবিউল। নাকি পাটাতনদুটোর নাম! ভালো করে জেনে নিতে হবে। বাবা এখন কী করছে! কালই ফোন করবে বাবাকে, চিন্তা না করতে বলবে। বলবে, সে কলকাতায় একটু থেকেই ফিরে আসবে আবার।
এসব ভাবতে ভাবতে তাতুন সীটে এসে বসতেই সামনের সীটের আঙ্কল ওকে আবার পরোটা আর আচার খেতে দিলেন, নিজেও খেলেন। ধন্যবাদ দিয়ে তাতুন খেয়ে নিল। বেশ খিদেও পেয়েছিল তার। তারপর জল খেয়ে গুছিয়ে বসল।
আঙ্কল বললেন, “ভাইজাগ আসছে। তারপর ট্রেনটা উলটোদিকে চলবে। জানো তো?”
তাই!
হ্যাঁ। কিন্তু ভেবো না আমরা ফিরে যাচ্ছি! আসলে বন্দর তো, লাইনটা একমুখী।
বন্দর... তাহলে কি ভাইজাগ থেকে বিশাখাপত্তনম কাছেই!
হা হা করে হেসে ওঠেন আঙ্কল, বাহ্‌, তোমার জেনারেল নলেজ বেশ ভালো তো! হ্যাঁ, ভাইজাগ আর বিশাপত্তনম একই। ওই নামটাকেই ছোটো করে ভাইজাগ বলে। আগে নাম ছিল ওয়ালটেয়ার।
বাইরে কিছু পাহাড়ের গায়ে আলো দিয়ে রাস্তা সাজানো দেখা যায় ওগুলোর ওপরে নাকি মন্দির এই অন্ধ্রপ্রদেশটা এত বড়ো, সারাদিন ছুটেও পেরোনো গেল না তারপর উড়িষ্যা, তারপর বাংলা... উফফফ, কতক্ষণে কলকাতা আসবে গো!
তাতুন জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি, চিন্তা নীচের বার্থে পা ছড়িয়ে শুইয়ে দেয় কেউ ট্রেনের দোলানিতে কেমন যেন নেশার ছন্দ ‘কালসকালে কলকাতাতে, কালসকালে কলকাতাতে’ বলতে বলতে ভাইজাগ, ভুবনেশ্বর সব পেরিয়ে যায়
ঘুম ভাঙে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে, ‘ভাঁড়ে চা, চপ-শিঙাড়া’ শুনে। চটপট উঠে বসে তাতুন দেখে আঙ্কল আগেই উঠে বসে আছেন পায়ের কাছে। তাকে দেখে বলেন, “গুড মর্ণিং! মুখ ধুয়ে এস, খড়্গপুর আসছে। পুরি-তরকারি খাব।
খড়গপুর!
হ্যাঁ, তারপর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই হাওড়া!
তাতুনের বুকে পুজোর ঢাক বাজতে থাকে। তাড়াতাড়ি মুখে চোখে জল দিয়ে আসে। স্টেশনের বাংলায় নাম লেখা, ‘দাঁতন’, বাড়ির দেওয়ালে বাংলাতে ‘ভোট দিন’, আহা, চোখ যেন জুড়িয়ে গেল! খড়গপুরে আসতেই আঙ্কল নেমে দুজনের পুরি-আলুচচ্চড়ি কিনে আনলেন। ঝোল ঝোল চচ্চড়ি দিয়ে পাঁপড়ের মতো লুচি, সেও যেন অমৃত মনে হয়।
বাকি রাস্তাটা খুব আনন্দে কাটে। ঝলমলে সকাল, চেনা চেনা স্টেশনের নাম, রূপনারায়ণ নদীর ব্রিজ, তারপর আন্দুল থেকে ট্রেন ধীরে চলতে থাকে। পাশ কাটিয়ে ভিড় লোকাল ট্রেন এগিয়ে যায়, কয়েকজন হাত নাড়ে, তাতুনও নাড়ে। মাঠে ছেলেরা খেলা করতে করতেও হাত নাড়ে দেখাদেখি রামরাজাতলা, দাশনগর, টিকিয়াপাড়া পেরিয়ে হাওড়ায় ঢুকে পড়ে ট্রেনটা ধীরে ধীরে। ব্যাগ গুছিয়ে সবাই নামতে থাকে। তাতুন একটু চিন্তায় পড়ে। এখন হাওড়া থেকে কীভাবে বাড়ি যাবে! এতক্ষণ তো সেটা মনে পড়েনি তার! কিছু চিন্তা করে সে একজন টিটিইকেই জিগ্যেস করে। আচ্ছা আঙ্কল, এখান থেকে সূর্য যেন স্ট্রীট কী করে যাব?”
টিটিই আঙ্কল একটু অবাক হন, কোথা থেকে আসছ তুমি?”
এই তো এই ট্রেনে এলাম
তুমি কি একা এসেছ? কোথা থেকে? টিকিট কই তোমার?”
টিকিট তো নেই আমার বাবা তো স্টেশন মাস্টার
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন টিটিই আঙ্কল ঘিরে ধরেন তাকে। পরপর প্রশ্ন করতে থাকেন, “স্টেশন মাস্টার? কী নাম? কোথাকার? তোমার নাম কী? সঙ্গে কে আছেন? বাড়ি কোথায়? ঠিকানা? ফোন নম্বর?”
একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে তাতুন ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “ও বাবা!
হঠাৎ দেখে সামনে বাবা দাঁড়িয়ে। লাফিয়ে বাবার কোলে উঠে পড়ে তাতুন। উফফ, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত।
কী রে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি? চল, বাড়ি চল!
বাড়ি! হ্যাঁ, তাই তো তাতুন ঘুমিয়েই পড়েছিল বাবার স্টেশনের বেঞ্চিটায় বসে বসে এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল সে! লজ্জায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাতুন বলে, “বাবা, আমরা কবে কলকাতা যাব?”
আগামী সপ্তাতেই যাব। আমি ছুটি পেয়ে গেছি, আজই ঠিক হলচল, বাড়ি চল, মাকে বলি গোছগাছ শুরু করতে!
তাতুন প্রায় নাচতে নাচতে বাবার হাত ধরে বাড়ি চললতাহলে আগামী সপ্তাতেই সত্যি সত্যি তার কলকাতা সফর শুরু হতে চলেছে!
------
অলঙ্করণঃ সুজাতা চ্যাটার্জী