পোর্ট ট্যালবটের ভূতুড়ে ক্যাসলে
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
প্রথমেই জানাই, ভূতের গল্প
যারা লেখেন, তাদের কাছে ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া একদমই ঠিক কথা নয়। এ যেন
গয়লার কাছে দুধে জল আছে কিনা জানতে চাওয়া। তাও তোমাদের পত্রিকার সদস্য সংখ্যার কথা
মাথায় রেখে লিখছি, এটা ভেবে যে একথা পাঁচকান হবে না।
আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। ভূত
কেন, ওই নামের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। আমার কাছে ভূতো বলে একজন ড্রাইভার
এসেছিল, তাকে কাজে রাখিনি। ‘অদ্ভুত’ আমার খুব প্রিয় শব্দের তালিকায় পড়ে। মাঝে
মধ্যেই বলি অদ্ভুত সুন্দর, অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এক ধরণের ভূত বিরোধিতাই বলতে পারো।
তা এবার আসল কথায় আসা যাক। একরকম
অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তাকে ভৌতিক বলব নাকি বলব না, সে
বিচার তোমাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
সাধারণত লেখার সময় একটা ভৌতিক
পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করি। পর্দা অকারণে নড়ে, ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি
করে, টেবিলের নিচ থেকে হঠাৎ করে কারুর হাত বেরিয়ে আসে। সব মিলিয়ে পাঠকরা বলে পড়ার
সময় গা ছমছম করছিল।
এক্ষেত্রে সেটা ইচ্ছে করেই
করব না। ঠিক যেরকম হয়েছিল, কমা, ফুলস্টপ বাদ দিয়ে ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করছি।
এটা বেশ কয়েকমাস আগের কথা।
শীতের শেষ দিক। ঠাণ্ডা তখন বেশ ভালোই। ওয়েলসে মারগাম ন্যাশনাল পার্কে এক পুরনো
ক্যাসলে গিয়েছিলাম। ক্যাসল বলতে আমরা যা ভাবি এটা ঠিক সেরকম নয়, বলা যায় ওই আদলে
তৈরি ১৮০০ সালের একটা বিশাল প্যালেস। যিনি তৈরি করেছিলেন
সেই ট্যালবট-এর নামেই পরে শহরের নাম হয় পোর্ট ট্যালবট।
ব্রিটেনের স্টিল ইন্ডাস্ট্রির
কেন্দ্রে ওয়েলেসের এই শহর। আর তাই টাটা গ্রুপ টাটা স্টিল বিক্রি করে দেওয়ার
সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আশংকা করা হচ্ছে যে এই শহরের ৯৯ শতাংশ লোক কাজ হারাবে। তাদের
জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই স্টিল ইন্ডাস্ট্রির উপরেই নির্ভর করে। আর
তাই এ নিয়ে রোজ এ শহরের নাম ইংল্যান্ডের কাগজে উঠে আসছে।
ক্যাসলটা শহরের খানিকটা
বাইরে। একটা হাজার একরের বন জঙ্গল ঘেরা জায়গার মধ্যে এই বিশাল প্যালেস। আমি
যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন কেন জানি না লোকের ভিড় একেবারেই ছিল না।
সকাল দশটা নাগাদ বিশাল গোথিক
আর্কিটেকচারের ওই ক্যাসলের মধ্যে যখন ঢুকলাম, তখন আমি ছাড়া ওখানে আর কেউ ছিল না। কাঠের
বিশাল দরজা পেরিয়ে মূল বিল্ডিং-এর মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কিছুটা এগোতে দেখলাম একটা
চওড়া মার্বেলের সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। তাতে লাল কার্পেট পাতা। কিন্তু কার জন্য এ
কার্পেট পাতা কে জানে? কারণ সিঁড়ির মুখে দড়ি দিয়ে পথ বন্ধ করে লেখা আছে – ‘নো
পাবলিক অ্যাকসেস’। অর্থাৎ উপরে যাওয়া সাধারণের জন্য
বারণ।
তা যাই হোক, নিচ থেকে বাড়ির
স্থাপত্য দেখলে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। মাথার উপরে টিউডর স্টাইলের আর্চ। বিশাল
মারবেল পাথরের ফায়ারপ্লেস। পায়ের নিচে মেঝে সাদা কালো মার্বেলের। উপরের দিকে বিশাল
ওরিয়াল উইনডো। নিচের তলায় বেশ কয়েকটা সুন্দর পাথরের মূর্তি, ছবি।
তা নিচে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি আর
ভাবছি, এ বাড়ি নিয়ে ভূতের গল্প লিখলে খারাপ হত না। বাড়ির মধ্যে আলো ছায়াতে মেশানো
বেশ একটা ভূতুড়ে পরিবেশ, যেটা খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। ভূত
বলে যদি কোন কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে তো এখানেই থাকবে। এ বাড়ি নিয়ে বেশ একটা ভয় -
শিহরণের অনুভূতি সহজেই তৈরি করা যায়।
শারদীয়াতে বেশ কয়েকটা পত্রিকায়
ভূতের গল্প লিখব কথা দিয়েছি। কিন্তু
মাথায় প্রায় কিছুই আসেনি। একদিন রাতে কবরখানা গিয়ে খানিকক্ষণ কাটিয়ে এসেছি। সেদিন
টিপটিপ করে বৃষ্টিও হচ্ছিল। ভূতুড়ে কোন অভিজ্ঞতাই হয়নি। ঠাণ্ডা যাতে না লাগে, তাই
মাথায় টুপি টেনে কবরখানার নিচু দেওয়াল পেরিয়ে বেরোচ্ছি, হঠাৎ কোত্থেকে একটা লোক মুখোমুখি
এসে পড়ল। সৌজন্যমূলক ভাবে ‘হ্যালো’ বলতেই লোকটা
দেখি হাউমাউ করে শুনশান রাস্তা ধরে ছুটে পালাল। যেটুকু প্লটের দেখা মিলেছিল,
মুহূর্তে উধাও।
তা এরকম আরও কয়েকটা জায়গায়
গেছি। কিন্তু ভূতের দেখা বা প্লটের দেখা পাইনি।
তা সেদিন ওই বাড়ির একটা অন্ধকার
কোণে দাঁড়িয়ে একটা ভূতের গল্পের প্লটের কথা ভাবছি, হঠাৎ দেখি আমার পাশে আরেকটা লোক
দাঁড়িয়ে আছে। বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। বয়স হয়েছে। সত্তর
কি আশি হবে।
ওয়েলেস অ্যাকসেন্টে বলে উঠল -
ভারতীয়?
- হ্যাঁ,
বলতে লোকটা আমার পরিচয় জানতে চাইল।
কথায় কথায় জানলাম লোকটার নাম রবার্ট। ভারতীয়দের বিশেষ করে ওর খুব পছন্দ। তার কারণ ভারতের
মতো শান্তির দেশ নাকি আর হয় না। ওর এখানেই জন্ম, এখানেই সারাজীবন কাটিয়েছে। ওর নাতিরাও
সবাই পোর্ট ট্যালবটের স্টিল প্লান্টে কাজ করে।
আমি আমার পরিচয় দিলাম।
আমার পরিচয় পেয়ে লোকটা বলে
উঠল - শুধু আমার ছেলে নয়, এখানে আমি যাদেরকে চিনি, সবার ভবিষ্যৎ - এখন তোমাদেরই
হাতে। অনুরোধ করছি, দেখো যাতে এই প্ল্যান্ট বন্ধ না হয়।
জানালাম – সে চেষ্টাই করছি। তবে
যে ভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, তাতে কোনও সংস্থাই এ ধরণের ব্যবসায় থাকতে
চাইবে না।
লোকটা জানি না কেন – হঠাৎ
আমাকে জিজ্ঞেস করে উঠল - এ বাড়ির উপরতলায় যেতে চাও?
- হ্যাঁ,
যেতে তো চাই, কিন্তু উপরে ওঠা তো বারণ।
লোকটা হেসে উঠে জামায় লাগানো একটা
ব্যাজ দেখিয়ে বলে উঠল - আমি ‘ফ্রেনডস অফ মারগাম পার্ক’-এর সদস্য। আমরা স্বেচ্ছায়,
কোনও ধরণের পারিশ্রমিক ছাড়াই এই বাড়ি তোমাদের মতো টুরিস্টদের দেখাই আর এখানকার
ইতিহাস শোনাই। আমার কাছে এ বাড়ির সব বন্ধ নিষিদ্ধ
ঘরগুলোর চাবি আছে।
- তা এ ঘরে যাওয়া নিষিদ্ধ কেন?
- সে কি! আসার আগে খবর নাওনি?
এই ক্যাসলকে ব্রিটেনের সব থেকে বিপজ্জনক ভূতুড়ে বাড়ি বলা হয়। সারা পৃথিবী থেকে
ঘোস্ট হান্টাররা এখানে আসে। ‘মোস্ট হণ্টেড হাউস’-এর উপরে যে ক’টা অনুষ্ঠান হয়, তার
সবেতেই একদম উপরের দিকে এর স্থান। নানান ধরণের প্যারানরমাল আকটিভিটি এখানে হয়।
- তা আপনার কী মনে হয়? আপনি ভূতে
বিশ্বাস করেন?
- ধুর, আমি ও সবে বিশ্বাস করি
না।
- তাহলে উপরে ওঠা নিষিদ্ধ কেন
তাহলে?
- এমনিতে ওর বাইরে আরেকটা
কারণও আছে। এ সব ঘরগুলোতে অনেক বিরল প্রজাতির বাদুড় আছে। লোকজনের চলাচল হলে ওদের থাকার
অসুবিধে হবে, সেইজন্য এরকম ব্যবস্থা। তা চল,
তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।
লোকটা এবারে সিঁড়ির পথে আটকানো
দড়ি সরিয়ে আমাকে উপরে নিয়ে এল। তালা খুলে একটা ঘরে ঢুকলাম। ঘরগুলো
যে খুব অন্ধকার তা নয়। ধার দিয়ে কাঁচের আয়তাকার ওরিয়াল স্টাইলের জানলা। নীল রঙের
দেওয়াল। তাতে কাঠের ফ্রেমে কিছু বিশাল বিশাল ছবি টাঙ্গানো। ঘরের কিছু জায়গায় পাইন
কাঠের ফ্লোরিং। কয়েকটা ঘরে ঝাড় লন্ঠন আছে। আসবাব নেই বললেই চলে। গা ছমছমে পরিবেশ।
একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যাচ্ছে। মাঝে আর্চ শেপের দরজা। ঘরের কোনও
কোনও জায়গা বেশ অন্ধকার।
একটা ঘরের মধ্যে এসে লোকটা
বলে উঠল – এই ঘরটাতে অনেকবার বাচ্চাদের কান্নার গলা শুনতে পাওয়া গেছে। দিনেরাতে
হঠাৎ করে বাচ্চাদের ছোটাছুটির আওয়াজ পাওয়া যায়। কয়েকমাস আগে একটা পাঁচ বছরের
বাচ্চা লুকিয়ে উপরে উঠে এসেছিল। পরে নেমে বলেছিল যে সে নাকি আরেকটা বাচ্চার সঙ্গে
উপরে খেলছিল।
- তাই?
বাচ্চারা তো আর মিথ্যে কথা বলে না। তা আপনি নিজে কখনও শুনেছেন?
লোকটার ঠোঁটের কোণে শুধু হাসি
ফুটে উঠল। বলে উঠল - বয়স হলে অনেক কিছু শোনা যায়। কোনটা কার বোঝা যায় না। তবে ওই
বাচ্চার ভূতের থেকে অনেক বেশি দুর্নাম রবার্ট স্কটের ভূতের।
- সে কে?
- দেড়শ বছর আগে ট্যালবটরা যখন
এখানে থাকত, তখন রবার্ট স্কট এখানকার গেমকীপার ছিল। অর্থাৎ স্কটের দায়িত্ব ছিল
আশেপাশের জঙ্গল ও তার পশুপাখির খেয়াল রাখা যাতে অন্য কেউ অন্যায় ভাবে ঢুকে পশুপাখি
শিকার না করে। একবার এক চোরা পাচারকারীকে সে ধরে
ফেলে। কিন্তু ওই পাচারকারীর গুলিতেই স্কট মারা যায়। সেই থেকেই স্কটের অতৃপ্ত আত্মা
এখানে থাকে। অনেক সময় তাকে দেখা গেছে। সে নাকি খুব রেগে থাকে। তেড়ে তেড়ে আসে। পাথর
ছোঁড়ে। তবে গত দশ বছরে সব ধরণের সতর্কতা নেওয়ার পরে আর সেরকম ঘটনা বেশি ঘটেনি। উপরে
তো আর কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। তবে তা সত্ত্বেও অনেক সময় দোতলার ভেতরের বারান্দায় ছায়ার
মধ্যে কাউকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
আমি লোকটার কথা শুনছিলাম আর ঘুরে
ঘুরে ঘরের চারদিক দেখছিলাম। ঘরের অন্ধকার কোণগুলো ভালো করে না দেখা গেলেও ঘরের ছাদের
কিছু কোণে যে বাঁদুড়ের দল আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল।
সব ঘর দেখানোর পর লোকটা বলে
উঠল - তুমি খুব ভাগ্যবান। যে ঘরগুলো দেখলে তা দেখার জন্য বহু লোক বহু বছর ধরে
অপেক্ষা করে থাকে। তোমার উপরে আমার এই শহর, আমার বংশধরেরা আজ নির্ভর করে আছে। তাই
দেখালাম। আজকে এই বাড়ির যে অবস্থা, কালকে আমাদের এই শহরের সে অবস্থা হতে চলেছে
স্টিল প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গেলে। ঘোস্ট
টাউন। তুমি দেখো যদি কিছু করা যায়।
- অবশ্যই।
সবরকম চেষ্টা করছি। দেখা যাক কী হয়! আচ্ছা, আপনার সঙ্গে একটা ছবি নিতে পারি?
বলে ফোন বার করলাম।
লোকটা বলে উঠল - না, না, আমার
ছবি তোলা উচিত হবে না। এসব জায়গা আমার দেখানোর কথা নয়। একেবারে নিষিদ্ধ। ছবি তোলার
রিস্ক আমি নিতে চাই না।
কী আর করা যাবে! লোকটার সঙ্গে
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম।
নিচে তখনও কেউ নেই।
ধন্যবাদ জানিয়ে বেরনোর আগে
ফের বলে উঠলাম - এর দায়িত্বে থেকেও আপনি যে বলতে পারেন, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন
না, তা বলার জন্য সত্যিই অনেক সাহস লাগে।
লোকটা হেসে বলে উঠল - মানুষ
দু’ধরনের হয় জানো তো? হয় সে ভূতে বিশ্বাস করে, না হলে সে নিজেই ভূত হয়। আসি।
- মানে?
লোকটা উত্তর না দিয়ে ঘুরে
দাঁড়াল। তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
আমি আর দাঁড়ালাম না। কখন আবার
মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে দেখে কে জানে! ঘরগুলো ভালো করে দেখতে গিয়ে লোকটার মুখের দিকে
খেয়াল করে তাকানোই হয়নি।
দ্রুতপায়ে ক্যাসেল থেকে
বেরিয়ে এলাম। লোকটার নাম যেন কী বলেছিল? রবার্ট? পুরোটা কি তাহলে রবার্ট স্কট?
_______
Margam Castle is one of the most haunted mansions in Wales and is also one of the scariest. The most frequently encountered spirit is thought to be Robert Scott, a gamekeeper at the house for many years. Robert’s wraith is one full of anger and rage because of his unjust murder by a poacher. He has often been seen purposefully ascending the Gothic staircase leading the castle and is allegedly accountable for some of the most amazing poltergeist activity. http://www.frightnights.co.uk/index.php/haunted-locations/margam-castle/
ReplyDeletesuper story
ReplyDelete
ReplyDeleteএমন মুনশিয়ানার সঙ্গে শুরু, চলন আর হঠাৎ করে শেষ একমাত্র অভিজ্ঞানই পারে। আমার পড়া সেরা কয়েকটা গল্পের মধ্যে থাকবে তোমার এই গল্প । অনবদ্য... অসাধারণ... কোনও বিশেষণ প্রয়োগ করেই আমার ভালোলাগার অনুভব আমি বোঝাতে পারব না অভিজ্ঞান!