গল্পের ম্যাজিক:: কী কাণ্ড! - রাজীবকুমার সাহা


কী কাণ্ড!
রাজীবকুমার সাহা

নিজের চেয়ারে বসিয়া কলম বাগাইয়া অভ্যাসবশত আগেরদিনের অসমাপ্ত ফাইলখানা খুলিতেই চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল বিভাসের সে কিয়ৎক্ষণ ঝিম মারিয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে পার্শ্ববর্তী বড়বাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া চাপা স্বরে কী একটা ইশারা করিল। বড়বাবু দুইদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি ফেলিয়া অপেক্ষাতর নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কী! আজকেও নাকি? কই দেখি, ফাইলটা।”
বড়বাবু হাত পাতিতেই বিভাস ফাইলখানা ঝটিকায় চালান করিয়া দিয়া যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। বেশিদিন হয় নাই, মাত্র বছর দেড়েক হইল বিভাস চাকুরিতে বহাল হইয়াছে। মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের চাকুরি, কাজের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত। সকালে আসিয়া টেবিলে ঘাড় গুঁজিলে তুলিতে তুলিতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনাইয়া যায়তদুপরি কাজের অগ্রগতি লইয়া উর্দ্ধতনের সহিত খিটিমিটি লাগিয়াই থাকে। এমতাবস্থায় একই কাজ যদি পাঁচদিন ধরিয়া বারংবার করিতে হয় তাহা হইলে কাহার মাথাই বা ঠিক থাকে! বিভাসেরও রহিল না। দ্বিপ্রহরে ক্যান্টিনে খাইতে বসিয়া সে অন্যত্র চাকুরির তল্লাশ করিতেছে বলিয়া গোপনে বড়বাবুকে জানাইয়া দিল
বড়বাবু দুই চোখ কপালে তুলিয়া কহিলেন, “সে কি! এরকম একটা চাকরি... এই আকালের বাজারে... না না, বিভাস, এ কোনও কাজের কথা নয় ভাই, সে তুমি যাই বল
বিভাসের চোখেমুখে হতাশার আকুতি স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বলিল, “আর পারছি না সুকুমারদা, বিশ্বাস করুন! এভাবে কাজ করা যায়, আপনিই বলুন? একেকটা ফাইল কয়েকবার করে চেক করে কমপ্লিট করে রাখছি, স্যারের ঘরে গিয়ে দেখছি অসংখ্য ভুল। প্রথম প্রথম হালকা সুরে বকাঝকা, তারপর ওয়ার্নিং, আর এখন তো আমায় দেখলেই অগ্নিশর্মা হয়ে যাচ্ছেন উনিআমি চাকরিটা ছেড়েই দেব ঠিক করেছি। ব্যাটাছেলে, কাজ একটা জুটিয়ে নেব ঠিক।”
বড়বাবু অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। চোখেমুখে অসংখ্য চিন্তার ভাঁজ প্রকট করিয়া বলিলেন, “কাজটা কার হতে পারে তাই ভাবছি হেদু’দিনও হয়নি জয়েন করেছ... এখনই এ ধরনের শত্রুতা... তোমার কাউকে সন্দেহ হয় নাকি বিভাস?”
ব্যাজার মুখ করিয়া বিভাস চুপচাপ রুটিতে তড়কা মাখাইয়া মুখে পুরিতে ছিল। বড়বাবুর শেষের কথাটি কেমন একটা চাপা ইঙ্গিতরূপে কানে আসিয়া ঠেকিল। উত্তর না দিয়া আনত মুখেই দুইদিকে মাথা নাড়িল। চতুর্দিকে তস্করের ন্যায় দৃষ্টি ফেলিয়া বড়বাবু অকস্মাৎ ঘন হইয়া বসিয়া বিভাসের কানের নিকটে মুখ রাখিয়া নাকিসুরে বলিলেন, “ওই তিন নম্বর টেবিলের শালাবাবু এই পোস্টটির জোর দাবীদার ছিল কিন্তু ভায়া বেশ তোড়জোড় চালিয়েছিল তিন নম্বর টেবিল। শেষে তোমার কাছে হেরে যেতে হলঅবিশ্যি নিজের যোগ্যতাবলেই পেয়েছ তুমি।”
কথাখানি বলিয়া বড়বাবু চোখ টিপিয়া চেহারায় এমন একখানা অভিব্যক্তি ফুটাইয়া তুলিলেন যেন এই অতি গূঢ় সত্যটি তিনি বিস্তর পূর্বেই অবগত ছিলেন বিভাসের প্রতি স্নেহপরবশ হেতু এতদিন লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। শুনিয়া বিভাসের প্রথমে কোনও বাঙনিষ্পত্তি হইল না। আশ্চর্যের ধাক্কা খাইয়া চোখদুইটি আপনা হইতেই বিস্ফারিত হইয়া আসিল আর মুখ ফুটিয়া অজ্ঞাতসারেই বাহির হইয়া গেল, “কিরণদা!”
খানিক থতমত খাইয়া দাঁত খিঁচাইয়া বড়বাবু তাড়াতাড়ি বলিলেন, “আস্তে আস্তে। না, সে ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত কিছু বলতে পারছি নাতবে কথাটা তুমি ভেবে দেখতে পারো। এখন দুইয়ে দুইয়ে চার হয় কি না তাই দেখার।”

চাকুরিতে যোগ দিয়া অবধি ট্যাক্স সেকশনেই কাজ করিতেছিল বিভাস। মাস দেড়েক হইল অ্যাকাউন্ট সেকশনে বসিতেছে। এই সেকশনের দুই নম্বর টেবিলের প্রাণেশ তরফদারের মাস দুই পূর্বে অকালমৃত্যু ঘটিলে বিভাসকে উঠিয়া আসিয়া এই শূন্যস্থান পূরণ করিতে হইয়াছে। নিজে অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র বলিয়া এই সেকশনে কাজ করিতে পাইয়া মনে মনে খুশিই হইয়াছে। যদিও কাজের পরিমাণ বাড়িয়াছে দ্বিগুণ। কারচুপির রাস্তা প্রশস্ত হইয়াছে চতুর্গুণ। কিন্তু বিভাসের সেইদিকে নজর নাই। সে চায় সোজা পথে কলম পেষিয়া একের পর এক উন্নতির ধাপ পার হইতে। কিন্তু এই পোড়া দেশে কতজন নিজের বিবেক বিসর্জন না দিয়া আশাতীত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছিয়াছে? দাবা খেলিতে বসিয়া ঘোড়ার চাল এড়াইয়া গেলে মাত ঠেকাইয়া রাখা যায় না। চিরন্তন এই সত্যখানি বিলক্ষণ অবগত থাকিয়াও তথাপি হিসাব মিলাইতে গিয়া গণ্ডগোল ধরা পড়িলেই অবিমৃষ্যকারীর ন্যায় বিভাস কাটাকুটি করিয়া তাহা সঠিক করিয়া রাখে। প্রায় প্রতিটা ফাইলেই এ হেন গণ্ডগোলের পরিমাণ প্রচুর। ইহা লইয়া নিজের সেকশনেরই দুই চারিজন সহকর্মীর সহিত প্রথমে অসন্তোষ, শেষে বাকবিতণ্ডা পর্যন্ত গড়াইয়াছে। তাহাদের মধ্যে তিন নম্বর টেবিলের কিরণশঙ্কর নন্দীও রহিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, দুর্নীতি-বৃক্ষের এই সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া শিকড়-বাকড় হইতে বড়বাবুর পৌরহিত্যে ডাল-পাতা পর্যন্ত প্রবহমান বলিয়া এই কয়েকদিনে বিভাসের ধারণা হইয়া গিয়াছে
চেয়ারপার্সন এখন বিভাসকে দেখিতে পাইলেই চোখমুখ বিকৃত করিয়া মুখ ফিরাইয়া বসেন। আর ফাইলে সাদা কালি লেপা জায়গায় নতুন হিসাব দেখিলে ত দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দেন। বিভাস বুঝিল চেয়ারপার্সন লোকটি অত্যন্ত ঘোড়েল। জল স্পর্শ না করিয়া মাছ ধরিবার পক্ষে অবস্থান করেন তাই বিভাসকে চোটপাট করিয়া বলেন, “বছর খানেক ধরেই দেখছি গরমিলের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। হিসাবপত্রে একটু আধটু ভুলভ্রান্তি... তা কাজ করতে গেলে ওসব হয়ই। শুধরে নিতে হয়। আপনি ওই টেবিলে আসার পর তো দেখছি তা পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিভাসবাবু, অ্যাঁ! অ্যাকাউন্টেনসির ছাত্র হিসেবে লজ্জা করে না আপনার? কই, প্রাণেশবাবু থাকতে তো তেমন...”

বিভাস পড়িয়াছে এক নতুন বিপদে। কে বা কাহারা যেন নিত্য তাহার ফাইল খুলিয়া অত্যন্ত চুপিসাড়ে গতদিনের পরিশ্রম আর সততায় জল ঢালিয়া দিয়া যায়। সংশোধিত হিসাবপত্র আবার পূর্ববৎ করিয়া লিখিয়া রাখিয়া যায়। প্রথম প্রথম সে নিজেরই ভুল মনে করিয়া পুনরায় নতুন করিয়া লিখিতে বসিত। কিন্তু বারংবার একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটিতে শুরু করিলে সন্দেহ ক্রমে ঘোরতর হইতে লাগিল। এই দুর্বৃত্তকে চতুর্দিকে খুঁজিতে গিয়া টিফিনের সময় ফাঁকা অফিসে লুকাইয়া নজর রাখিতেও কসুর করিল না বিভাসকিন্তু অপরাধীকে ধরা ত দূর তাহার টিকির নাগালও পাইল না। শেষে টেবিল ছাড়িয়া উঠিবার প্রাক্কালেই ফাইলপত্র নিজস্ব আলমারির ভিতর পুরিয়া তালাবন্ধ করিয়া যাইতে লাগিলকিন্তু ঘটনা তথৈবচ। কোন এক মন্ত্রবলে তাহার তালাবন্ধ আলমারির অভ্যন্তরেও হিসাবপত্র নয়ছয় হইতে লাগিল। কিছুদিন পর হাল ছাড়িয়া দিয়া অজানা এক আশঙ্কায় ভীত হইয়া বিভাস বড়বাবুকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানাইতে বাধ্য হইলকিন্তু বড়বাবুও কোনওরূপ কূলকিনারা করিতে পারিলেন না। চেয়ারপার্সনের সামনে ফাইল খুলিতেই হিসাবে একের পর এক অনিবার্য গরমিল আত্মপ্রকাশ করিতে লাগিল।

ভাদ্রমাসের অমাবস্যায় প্রতিবছরই অতনুর বাড়িতে কালীপূজার নিমন্ত্রণ থাকে বিভাসের। অতনু বিভাস বাল্যকালের বন্ধু। এইবার নিশি লাগিতে লাগিতে মধ্যরাত্রি পার হইয়া যাইবার কারণে ফিরিতে বেশ দেরিই হইয়া গেল। রওনা হইবার মুখে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আরম্ভ হইয়া গেলে অতনু বাধা দিয়া বন্ধুকে রাত্রিটি তাহার বাড়িতেই কাটাইয়া যাইতে অনুরোধ করিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু বিভাস সেই কথা কানে তুলিল না। তাহার মা বাড়িতে একলা রহিয়াছেনসুতরাং রাত্রি যতই হউক বিভাসকে ফিরিতেই হইবেবন্ধু নাছোড়বান্দা বুঝিয়া অতনু একটি ছাতি হাতে ধরাইয়া দিয়া বন্ধুকে বিদায় জানাইল। রাস্তা ততটা দূর নহে। তবে পথিমধ্যে একটা ঝাঁকড়া বৃদ্ধ তেঁতুলগাছ পড়ে। দিনমানেও এই গাছটা চারিপাশ এত নিঝুম অন্ধকার করিয়া রাখে যে চলাফেরা করিতে কয়েক মুহূর্তের জন্য হইলেও গা ভার হইয়া উঠে
ছাতি মেলিয়া জোর কদমে কাছাকাছি আসিতেই তেঁতুলগাছটির কথা মনে পড়িল বিভাসের। ছোটবেলা হইতেই গাছটা দেখিলে অস্বস্তি হয় তাহার। অতনুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়া বৃষ্টির ছাঁট আর দমকা বাতাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিলে বিভাস এত জোরে হাঁটা লাগাইয়াছিল যে গাছটির কথা এতক্ষণ তাহার স্মরণে ছিল না একেবারেইএখন কাছাকাছি আসিয়া পা দুইটি অকস্মাৎ যেন ভারী হইয়া আসিল। ব্যগ্র মনে সাহস সঞ্চয় করিতে করিতে হাঁটার গতি যতটুকু বাড়াইয়া লওয়া যায় তাহাই করিতেছিল সেকাপড়চোপড় ভিজিয়া শরীরের সহিত লেপটাইয়া গিয়া দামাল বাতাস আর হাঁটার ছন্দ মিলিয়া কেমন এক পতপত শব্দ করিতেছিলদেখিতে দেখিতে তেঁতুলগাছটাও বিদ্যুতের এক অভ্রভেদী ঝলকানিতে নিকটে আসিয়া পড়িল। শ্বাস বন্ধ করিয়া জায়গাটা একদৌড়ে পার হইয়া যাইবে কি না ভাবিতে না ভাবিতেই কে যেন পেছন হইতে মারিল এক ধাক্কাবিভাস তিনহাত দূরে জলকাদায় মাখামাখি ঘাসের উপর প্রায় উড়িয়া গিয়া পড়িল। এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও তাহার চোখেমুখে একরাশ তারাবাজির আলোর বিচ্ছুরণ ফুটিয়া উঠিলহাতের ছাতিটি কোথায় উলটাইয়া পড়িয়াছে খুঁজিতে গিয়া মনে হইল একটা টর্চ সঙ্গে থাকা জরুরি ছিল।
ছাতিখানা বেশিক্ষণ খুঁজিতে হইল না। বৃষ্টির শব্দ আর মেঘের গর্জন ছাপাইয়া খোনা অথচ তীব্র এক কণ্ঠস্বর অচিরেই তাহার রক্ত হিম করিয়া দিল। নিজের নামখানি কানে আসিতেই বিভাস বুঝিতে পারিল যে শব্দ গাছের উপর হইতেই আসিতেছে। খোনা গলা আবার ডাকিল, “বিভাস, কাদায় লেপটে আছ কেন ভাই? ওঠে দাঁড়িয়ে দ্যাখো কোথাও লাগল-টাগল কি না। কী কাণ্ড! মানুষ এভাবে চোখের মাথা খেয়ে দৌড়োয়? পড়ে থাকা অতবড় গাছের ডালটাও দেখতে পাওনি? ওঠো ভাই, ভয় পেয়ো না।”
বিভাসের শরীরের সমস্ত রক্ত সহসা যেন জল হইয়া গিয়া আবার উত্তপ্ত লাভার ন্যায় ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল। গ্রীবার রোমকূপ খাড়া হইয়া গিয়া কানদুইটা অত্যধিক গরম হইয়া উঠিল। অসাড় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভর করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার নিষ্ফল উপক্রম করিয়া আবার শিথিল হইয়া পড়িল। হৃৎপিণ্ডখানি লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া গলায় আটকাইয়া গিয়া শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইয়াছেএমতাবস্থায় কাহার নাম যে স্মরণ করিতে হয় তাহা সে হাজারবার চিন্তা করিয়াও মনে করিতে পারিল না। অগত্যা জলকাদার মধ্যিখানেই কাহিল হইয়া বসিয়া রহিল। বিভাস জীবনে এমতাবস্থায় কখনই পড়ে নাই।
খোনা কণ্ঠস্বর আবার কহিল, “কী কাণ্ড! বৃষস্কন্ধঃ শালপ্রাংশুর্মহাভুজঃ লোকের ওরম ভীতুর ডিমের মতো লেটকে পড়লে চলে নাকি? অ্যা? ওঠো ওঠো, ভয় নেই। আমি তোমাদের প্রাণেশদা গো! প্রাণেশ তরফদার।”
বিভাসের এইবার সত্যই মরণের যোগাড় হইল। প্রাণেশ মরিয়াছেন একবছর পার হইয়াছে। আজ হঠাৎ তাহার প্রেতাত্মা বিভাসের স্কন্ধে ভর করিল কী হেতু? থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকা শরীরটাকে কিছুতেই বশে আনা যাইতেছে না। মাথার দুইপাশের রগদুইটা যেন দপদপ করিতে করিতে ফাটিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে। অতিকষ্টে খানিকটা বল সংগ্রহ করিয়া বিভাস চিঁ চিঁ করিয়া উঠিল, “আ-আপনি? আপনি তো সেই বছর খানেক আগে...”
“হ্যাঁ, কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা প্রাণেশ এখন চন্দ্রবিন্দু হয়েছে। হা হা হা... মানে অফিসে একসময় কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম কিনা। তুমি তো সবই জানকী কাণ্ড!”
বিভাস ইতিমধ্যে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করিয়া লইয়াছিল। মাথা তুলিয়া সত্রাস দৃষ্টিপাত করিয়া চতুর্দিকে তাকাইল। তবে কষ্টিপাথরের চাইতেও কালো জমাট অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করিতে পারিল না। ঘোর অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র আঁধারের গায়ে তড়িদবিকাশের মতই তাহার অন্তঃকরণও সহসা চমকাইয়া উঠিল। বাতাস আর বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই। মিনমিন করিয়া বলিল, “আপনি কোথায় আছেন প-প্রাণেশদা? অন্ধকারে তো ঠিক...
প্রাণেশের গলাটা এইবার খানিক ভারী শোনাইল। বায়ুমণ্ডলে একখানা দীর্ঘশ্বাস বিলীন করিয়া দিয়া বলিলেন, “আমি তোমার আশেপাশেই আছি বিভাস। দেখতে চেয়ো না, সহ্য হবে না। চন্দ্রবিন্দুদের চেহারাটা আর আগের মতো থাকে নাকিছু কথা আছে তোমার সাথে। মন দিয়ে শোনো।”
দুই হাতে ভর দিয়া বিভাস কোনওমতে উঠিয়া বসিয়াছে। বৃষ্টির ছাঁট আর শীতল বাতাসে পূর্ব হইতেই তাহার ঠাণ্ডা লাগিতেছিল। আকস্মিক ঘোর কাটাইয়া উঠিতে ধীরে ধীরে শরীরে তীব্র শীত অনুভূত হইতে বুঝিল ইন্দ্রিয়গুলি পূর্বাবস্থায় ফিরিতেছে। কর্ণগোচর হইতেছে না বটে, কিন্তু ধীর গম্ভীর পদের একটা পায়চারির শব্দ বিভাস নিশ্চিতরূপে অন্তরে অনুভব করিতেছিল। ঘাড় না ফিরাইয়া অন্ধের মতো অন্তহীন দৃষ্টি মেলিয়া বলিল, “কী কথা বলুন। তবে আপনি কি সত্যিই প্রাণেশদা? না অন্য কেউ অযথা আমায় ভয় দেখাতে...” গলাটা শেষদিকে কাঁপিয়া যাওয়ায় ঢোঁক গিলিয়া চুপ করিয়া গেল।
প্রাণেশ এইবার খেপিয়া গিয়া বলিলেন, “তোমার কি বুদ্ধিসুদ্ধি সব বানের জলে ভেসে গেল নাকি, বিভাস? কী কাণ্ড! কথাবার্তার ধরন-ধারন খেয়াল করলেই তো...”
“এবার চিনেছি প্রাণেশদা। আপনার কথায় কথায় সংস্কৃত উচ্চারণ আর ‘কী কাণ্ড, কী কাণ্ড’ করাটা মনে ছিল না একদম। সরি, আপনি বলুন।” বিভাসের গলাটা খানিকটা স্বাভাবিক শোনাইল এইবার।
প্রাণেশ নাসিকায় ফোঁস করিয়া একটা শব্দ করিয়া শান্ত হইয়া বলিলেন, “অফিসে আবার একটা ষড়যন্ত্র চলছে হে, জান তো! এক ষড়যন্ত্রে আমাকে সরিয়ে দিয়েছিল ওরা। এবার তোমার পালা।”
সারা শরীরে বরফের মতন জমিয়া থাকা ভয়-ডরগুলি ধীরে ধীরে গলিয়া গলিয়া সরিয়া যাইতে লাগিল বিভাসের। প্রেতাত্মা প্রাণেশের সহিত কথায় কথায় সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করা অফিসের সদা হাস্যময় প্রাণেশ তরফদারের পার্থক্যটা একটু একটু করিয়া ঘুচিয়া যাইতে লাগিল। বিভাসের শ্বাসপ্রশ্বাস প্রায় স্বাভাবিক হইয়া আসিল। ভয়-ডর মুছিয়া গিয়া এইবার একরাশি উৎকণ্ঠা আসিয়া চাপিয়া বসিল। বিভাস চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করিল, “এসব কী বলছেন প্রাণেশদা? আমি তো ঠিক...”
“হা হা হা... ঠিক বুঝতে পারছ না। তাই তো? কী কাণ্ড! পারবে পারবে, তবে ঠিক করে বোঝার আগেই তোমাকে যে সরে পড়তে হবে ভায়া
বিভাস হতবিহ্বল হইয়া চুপ করিয়া রহিল। প্রাণেশের কোনও কথারই মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাইতেছে না। প্রাণেশ এত হেঁয়ালি করিতেছেন কেন? সরিয়া পড়িতে হইবে কথার অর্থ কি প্রাণেশ যেই পথে গিয়াছেন তাহাকেও সেই পথেই যাইতে হইবে? সারা শরীর হঠাৎ কাঁটা দিয়া ঝাঁকুনি মারিয়া উঠিল তাহার
বিভাসকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখিয়া প্রাণেশ পুনরায় বলিলেন, “অফিসের ওই ঘুঘুর বাসার ঘুঘুটা কে চেন তো? সুকুমার মিত্র। তোমাদের বড়বাবু গো, কী কাণ্ড! এই বাসায় চেয়ারপার্সন থেকে শুরু করে পিওনটা অবধি নাম লিখিয়ে রেখেছে। প্রত্যেকের পাওনা-গণ্ডার হিসেব আলাদা। বড়বাবুর আলমারির গোপন কুঠুরিতে বখরার হিসেবের খাতা আছে একখানা।”
বিভাস অত্যধিক আশ্চর্য হইয়া বলিল, “কী বলছেন প্রাণেশদা! খাতা করে অ্যাকাউন্ট মেনটেন!”
“তবে আর বলছি কী! রীতিমত সপ্তাহে একবার করে হিসেব আপডেট করা হয়। বারকয়েক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমায়। দলে টানতে না পেরে প্রথমে পেছনে লাগত। ছোটখাটো ভুলভ্রান্তিগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে খুব চোটপাট চালাতচেয়ারপার্সনকে দিয়ে চাপ দিত। কিছুতেই যখন কিছু হল না তখন একটা পুকুরচুরি মাথায় চাপিয়ে দিলেতিনদিনের মাথায় আত্মঘাতী হলুম। তারপর তোমায় উঠিয়ে এনে আমার ফাঁকা টেবিলে বসানো হল। ভেবেছিল ছেলেমানুষ, ছলে বলে তোমায় পকেটে পুরে ফেলবে। কিন্তু তুমিও পা ফেললে সেই আমার রাস্তাতেই। এখন তোমাকে নিয়ে ওরা পড়েছে মহাবিপদেএকদিকে হিসেবে কারচুপি করে কোনও লাভ হচ্ছে না। তুমি শুধরে ঠিক করে রাখছ। আবার সরাসরি তোমায় ফাঁসাতেও পারছে না। কারণ, একই কাজ করার ফল হিসেবে আমার আত্মহত্যাটা এখনও কাঁচা রয়ে গেছে।”
“সব্বোনাশ! তাহলে এখন?” বিভাস ভড়কাইয়া গেল।
“এখন ষড়যন্ত্র চলছে কীভাবে তোমাকে আবার ট্যাক্স সেকশনে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। ওই পুনর্মূষিক ভব আর কি। কারণ, সেকশনটা তেমন সুবিধের নয়। হাতে আসা পাওনা-গণ্ডার পরিমাণটা নগণ্যই বলা চলে। আমার টেবিলে এখনও নিজেদের পেয়ারের লোক হাতে আসছে না বলে টিকে আছ। তুমি কিন্তু প্রস্তাব এলেই রাজি হয়ে যাবে। বুঝলে? নইলে কিন্তু...”
ব্যগ্র হইয়া বিভাস বলিল, “কিন্তু আমার তো এই অ্যাকাউন্টের কাজ করতেই বেশী ভালো লাগে প্রাণেশদা
এইবার প্রাণেশের উত্তর নিমেষের মধ্যেই বিভাসের কানে আসিয়া ঠেকিল না। পরিবর্তে খোনা গলাটা যেন অনেক দূরে শুনাইলদ্রুত ছুটিয়া পলাইতে পলাইতে মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলিলে যেমন হয় ঠিক তেমনই আসিয়া ঠেকিল বিভাসের কানে, “নইলে বিপদে পড়বে হে... সাবধান কিন্তু বিভাস...! যা যা বললাম...” কথাগুলি আকাশে বাতাসে মিশিয়া গিয়া অস্পষ্ট হইয়া গেল কে যেন চুম্বক দিয়া কথাগুলি তাহার কাছ হইতে টানিয়া লইয়া গেল।
কিছুক্ষণ কান পাতিয়া থাকিয়াও বিভাস আর কিছু শুনিতে পাইল না। ঝড়জলের গতি অনেকখানি মন্দীভূত হইয়াছে। পূর্বদিকে অন্ধকার হটাইয়া একটা হালকা রূপালি আলো উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে আরও খানিকক্ষণ থম মারিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া প্রত্যূষে সারা শরীরে এক দুর্বহ ক্লান্তি লইয়া টলিতে টলিতে বাড়ি ফিরিয়া বিছানা লইল বিভাস। ধুম জ্বরের সহিত আমাশয়ের উপসর্গ আসিয়া জুটিয়াছে।

দিন পাঁচেক পর বিভাস অফিসে গিয়া দেখিল একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। কী এক ব্যাপার লইয়া বচসা চলিয়াছে আর ফাঁক পাইলেই প্রত্যেকে নিজের ফাইলপত্র খুঁটিয়া দেখিতেছে। বিভাসের প্রশ্নের উত্তরে বড়বাবু যাহা বলিলেন তাহার মর্মার্থ এই দাঁড়ায় যে, কে বা কাহারা প্রত্যেকের ফাইলে নোটের জায়গায় কীসব হিজিবিজি লিখিয়া যাইতেছে গোপনে। বড়বাবুর মতে ভাষাটা সংস্কৃত এবং যে লিখিয়া রাখিতেছে সে এই ভাষায় রীতিমত পারদর্শী। বড়বাবুর যে খানিকটা সংস্কৃতজ্ঞান রহিয়াছে তাহা অফিসের প্রায় সকলেই অবগত আছেনসেই কারণে ভাষাটা সংস্কৃত কি পালি কি হিব্রু তাহা লইয়া নতুন করিয়া আর বাকবিতণ্ডা হইল না। কিন্তু যাহা লইয়া ধুন্ধুমার চলিতেছিল তাহা বিভাসের উপস্থিতিতে অকস্মাৎ বন্ধ হইয়া গেল। শেষে বড়বাবুর হাবভাব আর পিওনের দুই চারখানা বেফাঁস মন্তব্যের কারণে ইহা যে সেই গোপন খাতাসংক্রান্ত খণ্ডযুদ্ধ তাহা অনুমান করিতে বিভাসের বিশেষ বেগ পাইতে হইল না।
দিন তিনেক পর ধীরে ধীরে প্রকাশ পাইল যে গোপন খাতার হিসাবের সহিত কাহারোই পাওনা-গণ্ডা মিলিতেছে না। যেমন, ফাইলে যেখানে হিসাব রহিয়াছে দুইহাজার টাকার সেখানে বাঁটোয়ারা হইয়াছে মাত্র বারশত টাকার। বাকি আটশত টাকার কোনও হিসাব লিখিত হয় নাই। ফাইল এই যাবত বড়বাবুই সামলাইয়া আসিতেছেন এবং কতদিন ধরিয়া এই চোরের উপর বাটপাড়ি করিয়া আসিতেছেন তাহা কেবল খোদায় মালুম। সবাই এখন আগাগোড়া হিসাব চাহিতেছে আর চুরির টাকা বড়বাবু এই পর্যন্ত কতখানি ডাকাতি করিয়াছেন তাহা পরিমাপ করিতেছে।
কিন্তু আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হইতেছে একেকটা ফাইলে সংস্কৃত ভাষায় নোট আসিল কী করিয়া! লিখিল কে? সীমিত জ্ঞান সম্বল করিয়া পাঠোদ্ধার করিতে গিয়া বড়বাবুর বিষম খাইয়া নাভিশ্বাস উঠিবার যোগাড় হইয়াছিল। অনেক চাপাচাপির পর বড়বাবু মুখ খুলিয়াছিলেন এই বলিতে যে, সংস্কৃত নোটগুলি কোনওক্রমে সরকার বাহাদুর বা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হাতে পড়িলে সব কয়টির কোমরেই যে দড়ি পড়িবে তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহেরও অবকাশ নাই। এই যাবত সমস্ত দুর্নীতির ইতিহাস লিখিত রহিয়াছে তাহাতে। আর তাহাতে বড়বাবুর হইয়াছে মরণদশা। চুরির খাতায় হিসাব গরমিলের পর সংস্কৃত জানা বড়বাবুকেই এই ব্যাপারে সন্দেহ করিতেছে সবাই। কারণ, একমাত্র বড়বাবুর কোনও ফাইলেই সংস্কৃতের ‘স’ও লিখিত নাই। কোণঠাসা বড়বাবুর চেহারাখানা দেখিবার মত হইয়াছে। পই পই করিয়া বুঝাইয়া চলিয়াছেন যে তিনি হিসাব পাই পয়সা অবধি ঠিক রাখিয়াছেন। সংস্কৃতে নোটগুলিও তাহার কর্ম নয়। এই অবস্থা কী করিয়া হইল কিছুতেই তাহার মাথায় ঢুকিতেছে না। বিভাস মুচকি হাসিয়া নিজের কাজে মন দিল।
অন্যদিকে চেয়ারপার্সনের হইয়াছে আরেক জ্বালাকিছুতেই নিজের সহি মিলাইতে পারিতেছেন না। দশটা দস্তখত দশরকম হইয়া যাইতেছে। কলম বাগাইয়া ধরিয়া প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও একরকম রাখিতে পারিতেছেন না। ইহাতে অফিসের কাজে যেমন বিঘ্ন ঘটিতেছে তেমনই ট্রেজারির কাজে সমস্যা হইতেছে সবচাইতে বেশীতাহার কোনও চেকই ট্রেজারি পাশ করিতেছে না। উপরন্তু চেক লইয়া যে-ই উপস্থিত হইতেছে সে-ই ট্রেজারিবাবুর নিকট সহি জাল করিবার হুমকি খাইয়া আসিতেছে। মোট কথা অফিসময় এক অরাজক অবস্থা চলিতেছে।

এমনি গোলযোগের মধ্যে মনস্থির করিয়া বিভাস একদিন প্রাণেশের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। অফিস হইতে ঠিকানা যোগাড় করিয়া খুঁজিয়া পাতিয়া প্রাণেশ তরফদারের বসতবাটির সন্ধান পাইতে তাহাকে বেশ গলদঘর্ম হইতে হইয়াছিল। যাহাই হউক, প্রাণেশের বিধবা মা বিভাসের পরিচয় জানিয়া আহ্লাদে আটখানা হইলেন। পুত্রের অফিসের সহকর্মীকে পুত্রবৎই স্নেহ করিলেন। বাটিভর্তি চিঁড়াভাজার উপর দুই চারিটি কড়াপাকের নারিকেল-নাড়ু ফেলিয়া বিভাসের হাতে ধরাইয়া দিয়া সাদা থানের খুঁটে চোখ মুছিয়া সামনে আসিয়া বসিলেন। বিভাস জিজ্ঞাসা করিল, “এমন কী হয়েছিল যে প্রাণেশদা এভাবে...”
বৃদ্ধার অন্তর নিংড়াইয়া চাপা একটা দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। বলিলেন, “কী জানি বাবা, আমার পানু এমন তো ছিল না কখনও। হেসেখেলে বেড়াত সবসময়। কুড়ি বছর বয়সে বাপ মারা যাওয়ার পর সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে বয়েই গেল শেষদিন পর্যন্ত। একদিনের জন্যেও মুখের হাসি মরেনি। অনেক বোঝালাম, ঝগড়াঝাঁটি করলাম, শেষে তিনদিন উপোস করে রইলাম। কিন্তু ছেলেকে সংসারী করাতে পারলাম না। এই পানু কিনা শেষপর্যন্ত গলায় দড়ি... ভাবলেই আমার...
“টাকাকড়ি সব...’’
“সে কথা আর বলো না বাবা। সিকিভাগও হাতে পাইনি এখনও। বেশ কয়েকদিন ছুটোছুটি করেছি। কিছু মনে করো না বাবা, তোমাদের ওই চেয়ারপার্সন আর বড়বাবু লোক ভালো নয়। রাম বলে রহিম জানে, রহিম বলে রাম। একটা না একটা অজুহাত মুখস্থই থাকে।”
শেষদিকে একরাশি ক্রন্দনের বাষ্প উথলাইয়া উঠিয়া বৃদ্ধার গলা চাপিয়া ধরিল। মুখে আঁচল চাপা দিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিলেন। বিভাস চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সবটা না জানিলেও প্রাণেশের টাকাকড়ি লইয়া তাহার অফিস যে গড়িমসি করিতেছে তাহা বিভাস নিজেও টের পাইয়াছিল। বৃদ্ধার ক্রন্দনের বেগ খানিক প্রশমিত হইলে এইবার জিজ্ঞাসা করিল, “জেঠিমা, প্রাণেশদার শ্রাদ্ধশান্তি...”
বৃদ্ধা সহসা চমকাইয়া উঠিয়া যথাশীঘ্র বলিলেন, “হ্যাঁ, না, মানে...কেন বাবা? তুমি কিছু শুনেটুনে...”
বিভাস বিস্ময় চাপিয়া রাখিতে পারিল না। গলাটা যথাসম্ভব মুলায়েম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী শুনে জেঠিমা? শ্রাদ্ধশান্তি ঠিকঠাক হয়েছিল তো?”
শিথিল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বৃদ্ধা বলিলেন, “না বাবা, ও মরার পর আজ অবধি পানুর অফিসের কেউ আসেনি। তুমি এসেছ, তোমায় লুকোব না। পানুর শ্রাদ্ধটা বিধিমতে করা যায়নিশেষদিকে পুরুতমশাই পালিয়ে গিয়েছিলেন” বৃদ্ধার গলার স্বর আবার অবরুদ্ধ হইয়া আসিল।
নিজের অস্পষ্ট অনুমান বাস্তবরূপ ধারণ করিতেই বিভাসের চোখদুইটা বর্তুলাকার ধারণ করিল। বলিল, “সে কি! প্রাণেশদার শ্রাদ্ধ ঠিকমতো হয়নি? পুরুত পালিয়ে গেল? কেন কেন?”
“সে এক আজব ব্যাপার বাবা। মিনিট তিনেক মন্ত্র পড়েই পুরুতমশাইর গলা বসে যেতে লাগল। ঘনঘন জল চেয়ে খাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর থেকে আবার মন্ত্র পড়ছিলেন ঠিকই তবে বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। চোখমুখ শুকিয়ে এমন চেহারা হয়ে গেল যেন খুব ভয় পেয়েছেন কিছুতে। শেষদিকে কোশাকুশি ছেড়ে ওঠে পালিয়েই গেলেন। দশদিন ধুম জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে আবোলতাবোল বকছিলেন। এমন ধারা তো জন্মেও দেখিনি কখনও। সবই আমার কপালের দোষ বাবা। নইলে এই জোয়ান ছেলেটা আমার আগে যায়?”
বিভাস এতটা আশঙ্কা করে নাই।

দিন পনের পরে গুরুজির আশ্রমে যাইতেছে বলিয়া তিনদিনের ছুটি লইয়া কালকা মেলে চড়িয়া বসিল বিভাস। আগেরদিন প্রাণেশের মায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিল। গয়ায় নামিয়া স্টেশন রোডের এক হোটেলে জিনিসপত্র রাখিয়া ফল্গু নদীর পাড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। পুরুষানুক্রমে বহাল পাণ্ডার খোঁজ পাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না। আগায় ফুলবাঁধা সুপুষ্ট টিকি দুলাইয়া, নাকের চশমা পুনঃপুন স্বস্থানে স্থাপন করিয়া আর যজমানের অভ্যন্তরে শাঁস কী পরিমাণে রহিয়াছে তাহা তির্যক চাহনি দ্বারা পরিমাপ করিয়া পরেরদিন সকাল নয়টার মধ্যে পিণ্ডদান সম্পন্ন করা চাই বলিয়া পাণ্ডা বিধান দিলেন ফর্দ অনুসারে পিণ্ডদানের জিনিসপত্র খরিদ করিয়া পাণ্ডার নিকট গচ্ছিত রাখিয়া বিভাস হোটেলে ফিরিয়া আসিল।
ট্রেনের ধকল, তারপর পৌঁছিয়াই প্রাণেশের পিণ্ডদানের যোগাড়যন্ত্র করিয়া বিভাস এতটাই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল যে সন্ধ্যা নাগাদ নাকেমুখে সামান্য কিছু গুঁজিয়া দিয়া বিছানায় পড়িবামাত্র নিদ্রার গভীরে তলাইয়া গেল। ঘুম ভাঙ্গিল দরজার অপর পৃষ্ঠে মুহুর্মুহু ধাক্কায়। বাতি জ্বালাইয়া দেওয়ালের ঘড়িতে চাহিয়া দেখিল ভোর চারটা বাজিয়াছে মাত্র। এই কাকভোরে কে ডাকিতেছে? দরজা খুলিতেই আকুলিবিকুলি করিয়া বেয়ারার পাশ কাটাইয়া পাণ্ডা মহারাজ ঝড়ের বেগে বিভাসের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চোখেমুখে তীব্র এক উৎকণ্ঠা বিরাজ করিতেছে। বলিলেন, “জলদি কিজিয়ে যজমান, নাহা ধো কে আইয়ে। হমে যানা হ্যায় অভি প্রেতশিলা পেপিণ্ডদান ঠিক পাঁচ বজে নও মিনিট অউর তেরহ সেকেন্ড সে শুরু হোনা চাহিয়েজলদি তৈয়ার হো কে চলে আইয়ে। বয়ঠে হ্যায় হম নীচে।”
হতভম্বভাবটা কাটাইয়া উঠিতে বিভাস খানিকটা সময় নিল। আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ কিন্তু পিণ্ডদান তো সেই নয়টায় বললেন। এখন হঠাৎ করে বলছেন... আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কি, হয়েছে কী?”
চকিতে দরজা ভেজাইয়া মৈথিলী ব্রাহ্মণ কাঁদোকাঁদো মুখে যাহা বলিল শুনিয়া বিভাস স্তম্ভিত হইয়া গেল। রাত্রিবেলা আহারাদির পর শৌচক্রিয়াদি সারিবার উদ্দেশ্যে মাঠের রাস্তা ধরিতেই কোথা হইতে এক ভয়ানক দর্শন মূর্তি আসিয়া পথ আগলাইয়া বেতালের মতন গাছের ডালে ঝুলিতে লাগিল। প্রাণেশ তরফদার নামে নিজের পরিচয় দিয়া এবং বিভাসের উল্লেখ করিয়া পিণ্ডদানের নির্ঘণ্ট লইয়া শাসাইতে লাগিল। আর ওই বীভৎসরূপী প্রেতমূর্তি চাক্ষুষ করিয়া পাণ্ডার অবাধ্য শৌচবেগ সিগন্যাল না মানিয়া তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া গিয়া কেলেঙ্কারি বাধাইল।
কথার ফাঁকে পাণ্ডাটি বিভাসের নিকট স্বীকার করিলেন যে নিজ সুবিধার্থে পিণ্ডদানের সময়টি তিনি স্বয়ং নির্ণয় করিয়াছিলেন। তাহার এই কৃতকর্মের জন্য মার্জনাও প্রার্থনা করিলেন।
হোটেলের বাহিরে রাস্তায় আসিয়া পাণ্ডা মহারাজ বলিলেন, “ওহ, অউর এক বাত যজমান, মৃতক অউর আপ কা গোত্র এক হি হ্যায় না?”
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বিভাস জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? আবার গোত্র নিয়ে কী ঝামেলা হল?”
“নহি, অগর এক হি হ্যায় তো কোই বাত নহি। অউর অগর দুসরা হ্যায় তো হম নহি কর সকেঙ্গে ইয়ে কাম। কোই দুসরা পূজারী ঢুন্ড না পড়েগা।”
বিভাস মনে মনে প্রমাদ গুনিল। তাড়াহুড়ায় প্রাণেশের গোত্র সম্পর্কে সে কলিকাতা হইতে কিছুই জানিয়া আসে নাই। প্রাণেশের মাও কিছু বলিয়া দেন নাই। মৃতের গোত্র না জানিলে শ্রাদ্ধ হইবে কী করিয়া! ব্রাহ্মণ তখনও তাহার মুখের পানে তাকাইয়া উত্তরের অপেক্ষা করিতেছেন দেখিয়া উপায়ান্তর না পাইয়া বিভাস নিজে আর প্রাণেশ সমগোত্রীয় বলিয়া দৃষ্টি লুকাইলঅতঃপর অশান্ত হৃদয়ে অতিশয় এক দুর্ভাবনা লইয়া সে প্রেতশিলার দিকে অগ্রসর হইল। সিঁড়ি বাহিয়া পাহাড়ে চড়িতে বিভাসের পা দুইটি যেন ভাঙিয়া যাইতে লাগিল।
কিন্তু দুর্ভাবনার ফলটা চাক্ষুষ করিল শ্রাদ্ধ করিতে বসিয়া। প্রাণেশের মা যেমনটি বর্ণনা করিয়াছিলেন ঠিক তেমনটিই নিজের চোখের সামনে অভিনীত হইতে দেখিতে পাইয়া বিভ্রান্ত হইয়া পড়িল। শ্রাদ্ধে বসিয়া পাণ্ডা মহারাজের আকুল-ব্যাকুল দৃষ্টি, বারংবার জলপান, আর তাহার পর পাগলের মতন পরের কাজ আগে আগের কাজ পরে – সবকিছুই কলিকাতায় প্রাণেশের শ্রাদ্ধের মতনই ঘটিতে লাগিল। বিভাস একবার শুধু জিজ্ঞাসা করিবার সুযোগ পাইয়াছিল যে পাণ্ডা মহারাজের কি কোনও অসুবিধা হইতেছে কি না। প্রত্যুত্তরে পাণ্ডা হাতজোড় করিয়া হাউমাউ করিয়া বলিলেন, “হমে ছোড় দিজিয়ে যজমান, হম সে নহি হোগা ইয়ে শ্রাদ্ধ। অ্যায়সা প্রতীত হো রহা হ্যায় কে, কোই হমারে মুহ সে অপনা বোলি বুলবা রহা হ্যায়। ইতনা শুদ্ধ সংস্কৃত তোহ হম ক্যায়া হমারা বাপ ভি নহি বোলে কভি।”
কোনওমতে মুখের কথা শেষ করিতে করিতে নিজের জিনিসপত্র গুছাইয়া পড়িমরি করিয়া ছুটিয়া নিমেষেই দৃষ্টির আড়াল হইয়া গেলেন পাণ্ডা মহারাজ। এইবার বিভাসের মনেও আতঙ্ক ঢুকিয়া গেল। ঘটনা অথবা দুর্ঘটনা দুইটা যে নেহাৎ কাকতালীয় নহে সে তাহা অচিরেই টের পাইয়া গেল। বৈকালে কলিকাতা ফিরিবার টিকিট কাটা ছিল পূর্বেই ততক্ষণ হোটেলে ফিরিয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া একলা থাকিতে সাহস যুগাইতে পারিল না অনেক চেষ্টা করিয়াওকোনওক্রমে সারাটা দিন এইদিক ওইদিক করিয়া কাটাইয়া বৈকাল না হইতেই স্টেশনে গিয়া আস্তানা গাড়িয়া যথাসময়ে গাড়িতে চাপিয়া বসিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।
ট্রেন তখনও বাংলার মাটি স্পর্শ করে নাই। গাড়িতে বিভাস বিন্দুমাত্রও ঘুমাইবে না সঙ্কল্প করিয়াও শেষপর্যন্ত চোখদুইটাকে শাসনে রাখিতে পারিল না। শেষরাত্রে হঠাৎ টান টান করিয়া বাঁধা সিতারের তারে টঙ্কারধ্বনির মতন ঘুমের চটকটা ভাঙ্গিয়া খান খান হইয়া গেল। জাগিয়া শুধু দুইটি কথাই মনে পড়িল তাহার – ‘এত সহজে মুক্ত আমি হব না বিভাস। তাছাড়া অফিসের হিসেবটা মিটিয়ে নিতে বাকি রইল যে, কী কাণ্ড!’

গয়া হইতে সময়মত ফিরিয়াও আরও দুইদিনের ছুটি বাড়াইয়া লইয়াছিল বিভাস। মাঝে রবিবার থাকার কারণে সোজা সোমবারে অফিসে আসিয়া উপস্থিত হইয়াই পড়িল একেবারে বাঘের মুখে। অফিস তোলপাড় করিয়া অডিট চলিতেছে। সব সেকশন মিলাইয়া বড়, মেজ, ছোট যতরকম বাবুরা রহিয়াছেন সকলে মূষিক-মার্জারের লুকোচুরি খেলায় মাতিয়া উঠিয়া শুধু এই কক্ষে ঢুকিতেছেন আর ওই কক্ষে বাহির হইতেছেন। বগলে, হাতে, মাথাতে আর ঘাড়ে শুধুই ফাইলের রাশি। ঘাঁটিতেছেন আর অডিট কক্ষে গিয়া জমা করিয়া আসিতেছেন। একদিকে বড়বাবু সুকুমার সেন আর চেয়ারপার্সন নিজ নিজ স্থান হইতে বিতাড়িত হইয়া চুন খাওয়া মুখ করিয়া বসিয়া আছেন। চেহারার অভিব্যক্তি স্পষ্টই ইঙ্গিত করিতেছে যে শনির দশা নিকটাসন্ন। শুধু বিভাস যখন নিজের জায়গায় গিয়া দেখিল যে তাহার ফাইলে সব কিরণবাবুর হস্তাক্ষর রহিয়াছে আর সে নিজে ট্যাক্স সেকশনে পুনর্বহাল হইয়াছে তখন অজ্ঞাতেই মুখ দিয়া অস্ফুট স্বরে বাহির হইয়া গেল, “কী কাণ্ড!”
_____
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি

লেখক পরিচিতি - ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরে জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং স্থিতি গোমতী জেলার কাকড়াবনে। পেশায় একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। নেশা, বই পড়া, সিনেমা দেখা আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই লেখালেখি করছেন।

14 comments:

  1. কী চমৎকার যে লাগল বলে বোঝাতে পারব না।

    ReplyDelete
  2. ভয়ংকর ভাল

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লাগল। কি কাণ্ড!

    ReplyDelete
  4. কি কান্ড!! এই গল্পটা এতো পরে পড়লাম!! ঝরঝরে ভাষায় অনায়াস গতিতে এগিয়েছে। সাধুভাষার এই পরীক্ষামূলক আঙ্গিকটা গল্পের চলনের সঙ্গে দিব্ব্যি মানিয়ে গেছে। আরো এমন লেখা পড়তে চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ রইল!

      Delete
  5. এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম ।

    ReplyDelete
  6. Bhison bhalo laglo.Sadhubhasai lekha pore mon bhore gelo.Aro erom lekha chai

    ReplyDelete
  7. বেশ ভালো লাগলো পড়তে

    ReplyDelete