ভৌত সংবাদ:: ভূতের কেত্তন - কৃষ্ণেন্দু বন্দোপাধ্যায়


ভূতের কেত্তন
কৃষ্ণেন্দু বন্দোপাধ্যায়

গল্প উপন্যাস লেখেন, অথচ সারা জীবনে একটাও ভূতের গল্প লেখেননি, এমন লেখক বোধহয় বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে নাঠিক যেমন ছড়াকারদের মধ্যেওযে যেমনই ছড়া লিখুক না কেন, তেনাদের নিয়ে দু-চার লাইন তেনারাই ঠিক লিখিয়ে নেবেনতাই বাংলা সাহিত্যে ভূতের গল্প আর ভূতের ছড়ার ছড়াছড়িতার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলেছে প্রবন্ধ-নিবন্ধ
আর শুধু বাংলা কেন, গোটা পৃথিবী জুড়েই তো তেনাদের রাজত্বতাই গল্প থেকে ছায়াছবি, নাটক থেকে নৃত্যনাট্য, সব জায়গায় তেনারা ছিলেন, তেনারা আছেন আর তেনারা থাকবেন শুধু থাকবেন না, এই জেট-রকেট-নেট-রোবটের যুগেও রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াবেন
       তা নতুন করে যখন তাঁদের নিয়ে খোঁজখবর চলছে, তখন আমিও একটু পাত্তা লাগাই। তেনাদের তো অনেক রকমফের! ভয়ের ভূত, মজার ভূত, রাগী ভূত, দাগী ভূত, চালাক ভূত, বোকা ভূত, একা ভূত, দোকা ভূত, আরও হাজার রকম ভূত তা সেইসব ভূতপ্রেতদের খবরাখবর নেবার জন্যেই এই ‘ভূতের কেত্তন’

আবির্ভাবঃ বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মনে দেবতার পাশাপাশি অপদেবতার ধারণা স্থান পেয়েছেঘটে যাওয়া যেসব ঘটনা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত না, তার মধ্যেই অশরীরী এক আত্মার উপস্থিতি কল্পনা করে নিত মানুষতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল লাগামছাড়া কল্পনা
ফলে সেই যে কুলোর মতো কান আর মুলোর মতো দাঁত নিয়ে তেনারা মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসলেন, সেই থেকে যুগের পর যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মুখে মুখে চলতে লাগল ভূত-পেত্নি, রাক্ষস-খোক্কস আর দৈত্য-দানবের গল্প
তবে বাংলা সাহিত্যে ভূতের প্রথম আবির্ভাব ষোড়শ শতাব্দীতেসেই সময়ে রচিত চৈতন্যচরিতামৃত আর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে প্রথম পাওয়া যায় ভূতের বর্ণনাঅষ্টাদশ শতকের শেষে রচিত বেতাল পঞ্চবিংশতি হয়ে ওঠে তুমুল জনপ্রিয়আর তারপর ভূতকে জাতে তুললেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় আর পরশুরামপাশাপাশি যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও যতীন্দ্রকুমার সেনের হাত ধরে ভূতেরা চিরাচরিত আসন গেড়ে বসল বাংলা সাহিত্যে, যার উত্তরসূরী হিসেবে ঝর্ণাধারার মতো এসে গেল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ভূত, বাংলার প্রায় সমস্ত সাহিত্যিকের হাত ধরেরকমারি ভূতপ্রেত তাদের বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ নিয়ে বাংলা পাঠকদের একইসঙ্গে ভয় ও মজা দিতে শুরু করল, যার অবিরল ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনও - এই একবিংশ শতাব্দীতেও

বাসস্থানঃ ভূতেরা থাকে কোথায়? এ নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনাতবুও মোটামুটি তেনাদের বাসস্থান হলঃ
শ্মশান, গোরস্থান, কবরখানা, পোড়োবাড়ি, পুকুর, দিঘী, খাল, বিল, জলা, জনশূন্য মাঠঘাট, অন্ধকার বনজঙ্গল, বাঁশঝাড়, খানাখন্দ, নিঃঝুম রেলস্টেশন, রেলগাড়ির কামরা, জেটি, বন্দর, জাহাজের কেবিন, এয়ারপোর্ট, এরোপ্লেনের সীট, ফাঁকা অফিসবাড়ি, কোর্ট-কাছারি, হোটেল, সরাইখানা, ইঁটভাটা, ধানজমি, নির্জন রাস্তাঘাট, দোকান, বাজার, এছাড়া কয়েকটি মার্কামারা গাছ, যেমন শ্যাওড়া, বেল, গাব, তেঁতুল, বট, অশ্বত্থ ইত্যাদি ঝাঁকড়া গাছগুলো এবং এই পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য গ্রহ কিংবা মহাকাশেও!

অর্থাৎ আমাদের দেখা চারপাশের দুনিয়ার প্রায় সমস্ত জায়গাতেই ভূত থাকতে পারে বলে কল্পনা করা হয়েছে তবে তেনাদের সবচেয়ে জব্বর বাসস্থান হল ‘সর্ষের মধ্যে’

প্রকারঃ এই ব্যাপারটাই খুব মুস্কিলেরকারণ ভূতপ্রেত যে কত প্রকার আছে, তা বোধহয় তেনারা নিজেরাও জানেন নাতবুও তারই মধ্যে যেগুলো আমাদের বেশি পরিচিত, তার একটা তালিকা বানানো গেল

ক) দেশী ভূতঃ

(১) ব্রহ্মদৈত্য ইনি হলেন আন-অফিসিয়ালি ভূতেদের রাজা। জাতে ব্রাহ্মণ। বিশাল চেহারা। পরনে কাপড়, খালি গায়ে ধবধবে সাদা পৈতে। নিবাস বেলগাছ
(২) পিশাচ প্রাচীন ভূতঅথর্ব বেদে উল্লেখিতএরা কবর থেকে তুলে শব ভক্ষণ করে
(৩) প্রেত বা প্রেতাত্মা আত্মার ভয়ংকর রূপ। সাধারণত ছায়ামূর্তি
(৪) প্রেতিনী বা পেত্নী প্রেতাত্মার স্ত্রী রূপ
(৫) পিশাচী এরা হল পিশাচের স্ত্রী রূপপিশাচের থেকেও ভয়ংকরী
(৬) শাঁকচুন্নি হাতে শাঁখা পরা সধবা মৃতের প্রেতাত্মা। অন্য নাম শাঁখিনী হিন্দীতে চূড়েল। নিবাস শেওড়া গাছ
(৭) ব্রহ্মপিশাচ ব্রাহ্মণ থেকে জন্মানো পিশাচ
(৮) স্কন্ধকাটা বা কবন্ধ এদের মাথা নেই খালি ধড়লম্বা হাত দু’টো সোজা করে হাতড়ে হাতড়ে চলেসেই হাতের মধ্যে পড়লে আর রক্ষা নেইযাদের মাথা কেটে ফেলা হয়, তারাই মরে স্কন্ধকাটা হয় বলে শোনা যায়
(৯) যখ বা যক্ষ ধনরক্ষকব্রাহ্মণ শিশুকে ধন পাহারা দেবার জন্য জীবন্ত বন্দী করে যখে পরিণত করা হয়
(১০) দানো দানব থেকে এসেছে দানো রাক্ষসের আর এক রূপ। কখনও ‘দানা’ও বলা হয়
(১১) রাক্ষস এরা ভয়ংকর হিংস্র ও মানুষখেকো। বিকট দেখতেপ্রাচীন পুরাণে উল্লেখিত
(১২) খোক্কস এরা হল রাক্ষসেরই সঙ্গীকিন্তু সাইজে ছোটোএদের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে
(১৩) রাক্ষসী রাক্ষসেরই স্ত্রীলিঙ্গ এরা কিন্তু রূপ বদল করতে ওস্তাদ
(১৪) ডাকিনী দেবী চন্ডীর অনুচরী
(১৫) যোগিনী মা দূর্গার সখী। সংখ্যায় ৬৪ জন
(১৬) রাকিনী ক্ষুধার্ত হিংস্র নারীরূপী পিশাচ
(১৭) হাঁকিনী হাঁকডাক করে লোককে ঘরছাড়া করে। তারপর তাকে বিপথে চালিত করে
(১৮) শাকিনী দেবী চন্ডীর সহকারিণী। এও এক পিশাচিনী
(১৯) ডাইনী অস্থিচর্মসার বুড়িচুলগুলো শণের নুড়ির মতোগাছ বা ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ায় দেশে-দেশান্তরে শিশু কিংবা তরুণীদের দিকে কুদৃষ্টি দেয়সঙ্গে থাকে কোন পোষা জন্তু
(২০) গেছোভূত গাছেই এদের বাসাসেখানেই থাকে, আর সেখান থেকেই লোককে নানাভাবে ভয় দেখায়
(২১) মেছোভূত এরা শুধু মাছ খেতে ভালবাসেচেয়ে, ভয় দেখিয়ে বা ছিনিয়ে নিয়ে মাছ এদের খাওয়া চাইই
(২২) বাস্তুভূত এরা বাস্তুসাপের মতো বাড়িতে থাকে কারও ক্ষতি করে না
(২৩) গোভূত গৃহপালিত গরুর অকালমৃত্যু হলে তা গো-ভূত হয়এরাও কারও ক্ষতি করে না, শুধু ভয় দেখায়
(২৪) একানড়ে একঠেঙে ভূতএকটা পায়ে নড়বড় করা ভয়ংকর রূপ এদের
(২৫) জটাধারী ভয়ংকর অপদেবতা। প্রাচীন দিঘীর গভীরে বাসকোন কারণে বিরক্ত হলে জটায় পা জড়িয়ে ডুবিয়ে মারেন
(২৬) জটাবুড়ি মহিলা জটাধারী বলা যায়। কাজ একই
(২৭) আলেয়া গভীর রাতে কোন জলা থেকে উঠে এসে আলো দেখিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে নিয়ে যান। তারপর ডুবিয়ে মারেন
(২৮) নিশি বা নিশা ঘুমন্ত মানুষকে ঘর থেকে বাইরে টেনে এনে ঘুরিয়ে মারে
(২৯) দিশা বা ভুলো এই ভূত মানুষের দিক ভুলিয়ে দেয় একই রাস্তায় ঘুরিয়ে মারে বারবার
(৩০) কুনী এক ধরণের পেত্নিঘরের কোণে জঞ্জালস্তূপের মধ্যে থাকতে ভালবাসে
(৩১) বুনী এই পেত্নিদের প্রিয় বাসস্থান হল বাঁশবন। তাই নাম বুনী
(৩২) হুনো এক ধরণের আরবী ভূত। শবমাংস খেতে ভালবাসে
(৩৩) চুন্ড এদের শরীর নেই। শুধু মাথাওলা ভূত
(৩৪) তাল তালগাছের সমান লম্বা ভূত
(৩৫) বেতাল তালের বিপরীত। খর্বকায় শবাধিষ্ঠিত ভূত
(৩৬) নাড়াবুনে গভীর নলবনের অপদেবতা
(৩৭) আচাভুয়া কিম্ভূতকিমাকার দর্শনধারী ভূত
(৩৮) গুয়াসী এরা কাপড় বা বস্তা কিংবা জাল চাপা দিয়ে মানুষ মারে
(৩৯) গলাশী গলায় দড়ি দিয়ে মরা প্রেতাত্মাঅন্যকেও গলায় দড়ি দিতে উসকানি দেয়
(৪০) পেঁচো ছোটো সাইজের অপদেবতাসর্বদা শিশুদের দিকে নজর তাদের ওপর ভর করে
(৪১) এঁশো আঁশ থেকে এঁশোমাছের প্রতি প্রবল ভক্তি। ভূত বা পেত্নি দুইই হয়
(৪২) হাঁড়া ভূত পুকুরে থাকে আর জলের মধ্যে থেকে পা টেনে ধরে
(৪৩) ঝাঁপড়ি ভূত টোকা মাথায় দেওয়া ভূত
(৪৪) জুজু বা জুজুবুড়ি শিশুদের ভয় দেখানো হয় এই ভূতের কথা বলে। নির্দিষ্ট বিবরণ নেই
(৪৫) কানী পিশাচী ছেঁড়া ন্যাকড়া ও ময়লা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এই পেত্নিরাকখনও মাঝরাতে পুকুরঘাটে কাপড় কাচতে দেখা যায় এদের
(৪৬) বর্তুল বা বাঁড়ুল কালবৈশাখীর ঝড়ে বর্তুল আকারে ঘুরতে থাকা হাওয়া
(৪৭) কালু নামেই প্রমাণ। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের ভূত
(৪৮) খাঁটু বেঁটে বা খেটে মাপের ভূত
(৪৯) ব্যন্তর এক ধরণের জৈন ভূত
(৫০) কণ্ব শিশুভুক। রাত্রে পাখী হয়ে উড়ে বেড়ায়
(৫১) ধূম্রনাশ এরাও রাক্ষস জাতীয়কথিত আছে, এদের নাক থেকে ধোঁয়া বের হয়
(৫২) সিংহমুড়া সিংহের মতো মাথাবিশিষ্ট ভূত
(৫৩) পান্তা ভূতের দলে ইনিও আছেন হাড় হিম করা ঠান্ডা এনার স্পর্শ
(৫৪) বোবা অশরীরী অনিষ্টকারী আত্মাএঁর প্রভাবে মানুষ ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে গোঙায়
(৫৫) মধুমতী এরাও এক ধরণের অপদেবতা
(৫৬) দেও দেব কথাটির ফারসী রূপ। ভূত-প্রেত অর্থে ব্যবহৃত হয়
(৫৭) মামদো ইনি হলেন মুসলমান ভূত। গোরস্থান এনার বাসস্থান
(৫৮) জিন প্রথমে দৈত্য, পরে ভূত। আরবের ভূত এরানাম উচ্চারণ করে আহ্বান করলে হাজির হয়ে যায় কারও ক্ষতি করার জন্য

খ) বিদেশী ভূতঃ

(১) গোস্ট (Ghost) এরা শরীরী এবং অশরীরী ভূত। কখনও শব্দ, কখনও স্পর্শ দিয়ে সাড়া দেয়। আবার কখনও শুধুই ছায়ামূর্তি
(২) পল্টারগাইস্ট (Poltergeist) এককথায় বজ্জাত ভূত। উৎপাত আর উপদ্রবে সিদ্ধহস্তবাড়ির ভেতরেই তাদের যা কিছু বজ্জাতি
(৩) উইচ (Witch) এরা রূপকথার ভূত। বাংলার ডাইনীর মতোইসেই শুকনো চেহারা, চোখে সেই ভয়ংকর কুদৃষ্টি। বাহন সেই ঝাঁটা
(৪) ডেভিল (Devil) শয়তানকে বিদেশে ভূত বা অশরীরী রূপেই দেখা হয়কারণ, এরা যেকোন মূল্যে ভালো লোকদের ক্ষতি করেনিজের রূপ বদলে এরা মানুষের চেহারা নিতে পারে। পায়ে আঙুলের বদলে আছে ক্ষুর
(৫) ওয়্যারউল্‌ভ্‌স (Werewolves) মানুষ-নেকড়েদিনের বেলা সাধারণ পুরুষ বা নারী রূপে, রাত্রি হলেই চেহারা বদলে নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়। বিদেশে এরা ভয়াবহ একটা আতঙ্ক
(৬) ভ্যাম্পায়ার (Vampire) রক্তচোষা বাদুড়ের মতোই এরা মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচেসাধারণত এরা কবরের মধ্যে থাকে, রাত্রে উঠে আসে শিকার ধরার জন্য
(৭) জোম্বি (Zombie) কবরের মৃত মানুষরা অন্য মানুষের মন্ত্রবলে জীবন্ত হয়ে উঠলে তাদের বলা হয় জোম্বিকিছু গুণিনের ‘ভুডু’ জাতীয় মন্ত্রের সাহায্যে এরা জীবন্ত হয় এদের কোন স্বাধীন চিন্তাশক্তি নেই, যন্ত্রের মতো এদের চলাফেরাযে একে জাগিয়ে তোলে, শুধু তারই আজ্ঞাবহ ভৃত্য হিসেবে এরা কাজ করে যায়।
(৮) ব্যানশি (Banshee) এরা এক ধরণের পরীস্কটল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডে কোন বাড়িতে দূর থেকে এদের করুণ সুরের আর্তনাদ শুনলে বুঝতে হবে সেই পরিবারে মৃত্যু প্রবেশ করছে।
(৯) রেথ (Wraith) কোন মানুষের মৃত্যুর আগে এরা দেখা দেয় তারই ছায়ামূর্তিরূপে তখনই বোঝা যায় তার মৃত্যু আসন্ন
(১০) গবলিন (Goblin) এরাও অনিষ্টকারী। দেখতে কদাকার

এছাড়াও দেশী ও বিদেশী ভূতের ইতিহাসে আরও কিছু ভূতুড়ে অনুষঙ্গ লক্ষ করা যায়যেমন – ভূতুড়ে জন্তু, ভূতুড়ে গাছ, ভূতুড়ে বাড়ি, ভূতুড়ে আসবাব ইত্যাদিএর প্রত্যেকটা নিয়েই এক বা একাধিক গল্প প্রচলিত আছে বিভিন্ন দেশে

কীর্তিকলাপঃ ভূতপ্রেত তো আছে। কিন্তু তাদের কথা আমরা জানি কী করে? সেটাই তো মজা। তারা নিজেরাই সেটা জানান দেয় তাদের বিচিত্রসব কার্যকলাপ দিয়েসেগুলো কী রকম? সেখানেও আছে নানা বৈচিত্র্য
(১) নির্জন পুকুরে কেউ মাছ ধরছে, গাছ থেকে নেমে এসে তারা মাছ চাইবেই
(২) হাতে মাছ ঝুলিয়ে কেউ বাড়ি ফিরছে, পাশের ঝাঁকড়া গাছ থেকে নেমে এসে তারা কেড়ে নিয়ে যাবে সেই মাছ
(৩) বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তাসেখানে রাস্তার ওপর লম্বালম্বি শুয়ে থাকা বাঁশডিঙিয়ে যেতে গেলেই সেই বাঁশ তুলে নিয়ে যাবে শূন্যে
(৪) ফাঁকা রাস্তায় অন্ধকারে সাদা কাপড় পরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ মায়া দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় ভুলপথে বা একই রাস্তায় ঘুরিয়ে মারে কেউ আলো দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মারে জলায় ডোবায়
(৫) কখনও কোন ভয়ংকর মূর্তি ভয় দেখায়, তো কোথাও শোনা যায় ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নার আওয়াজকখনও হঠাৎ কোন ভয়ংকর শব্দ, আবার কখনও চুপিসাড়ে ফিসফিস আওয়াজ
(৬) পোড়োবাড়ির ভূতেরা আবার এককাঠি ওপরে। সেখানে কখনও তারা অট্টহাসি শোনায়, কখনও খড়ম পরে হাঁটে। কখনও দরজা জানলা দুমদাম করে বন্ধ করে, কখনও চোখের সামনে থেকে কোন জিনিস অদৃশ্য করে দেয়
       সব মিলিয়ে নানারকম অদ্ভুতুড়ে উদ্ভট কান্ডকারখানা দেখিয়েই তেনারা বিখ্যাত হয়েছেন

খাদ্যঃ এবারে আসি তাঁদের খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে তবে এ ব্যাপারে তাঁরা বড়োই সংযমীকয়েকজন শুধু মাছের জন্য পাগল, বাকি বেশিরভাগই মাংশাসীতাদের মধ্যে রাক্ষস-খোক্কস-পিশাচজাতীয় ভূতেরা যেমন আছেন, তেমনই ডাকিনী-যোগিনী-পিশাচিনীজাতীয় ভূতনিরাও কম যান নাকেউ শিশু ভালবাসেন, কেউ গোটা গোটা মানুষবিদেশের ভ্যাম্পায়ার তো আবার শুধু রক্ত চুষে খানতবে তার মধ্যেও কিছু ভালো ভূত অবশ্যই আছেন, যাঁরা শুধুই বায়ুভুক। তাঁরা হাওয়া ছাড়া কিছুই খান না

উৎসবঃ তেনাদের উৎসব? হ্যাঁ, তা আছে বৈকি। এ দেশেও আছে, বিদেশেও আছে
১) এদেশেঃ ভূত-চতুর্দশী – প্রতি বছর কালীপূজার আগের রাতে অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মারা নাকি আবির্ভূত হন তাঁর পূর্বজন্মের ভিটে দেখতে, এটাই এদেশের প্রচলিত মততাই দোষ কাটাবার জন্য চোদ্দ শাক ভক্ষণ ও চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাবার রীতি
২) বিদেশেঃ হ্যালোইন - প্রতি বছর ৩১শে অক্টোবর রাতে বিদেশী মতে, এই বিশেষ রাত্রে সমস্ত প্রেতাত্মা পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসে

গল্পের রকমঃ এবার দেখা যাক ভূতের গল্প কতরকম হয় পৃথিবীর সমস্ত ভূতসংক্রান্ত নথিপত্র, অলৌকিক বা অশরীরী গল্প, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ভূতের কাহিনী তিনপ্রকার
(১) সরাসরি ভূতঃ এখানে ভূতকে সরাসরি দেখা যায়, তাদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করা যায়
(২) অশরীরী ভূতঃ এই ধরণের গল্পে ভূতকে সরাসরি দেখা যায় না, শুধু এক অশরীরী অস্তিত্ব অনুভব করা যায়
(৩) অলৌকিক শক্তিঃ আত্মা নয়, ভূতপ্রেত নয়, এক অসম্ভব অলৌকিক শক্তি নিয়ে এই ধরণের কাহিনীগুলো লেখা হয়, যেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, অথচ বোঝা যায় যে কোন এক অতীন্দ্রীয় শক্তি রয়েছে এই ঘটনার পেছনে 

ভূতবাজঃ হ্যাঁ, ভূতপ্রেত, আত্মা, অশরীরী যেমন আছে তেমনই তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার লোকেরও অভাব নেই সেটা যেমন বাস্তবে, তেমন গল্পেও
বাস্তবে বহু লোক দেখা যায়, যারা চ্যালেঞ্জ করে শ্মশানে বা পোড়োবাড়িতে রাত কাটাতে যান, প্ল্যানচেট বা সিঁয়াসে (Séance)-র মাধ্যমে আত্মা নামাতে চান সাধারণ লোকের পাশাপাশি এ ব্যাপারে বিখ্যাত মানুষরাও জড়িতআমরা তার নিদর্শন পাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে স্বামী অভেদানন্দ পর্যন্ত বহু লোকের স্মৃতিকথায়
বিদেশে কিন্তু এ ব্যাপারে অনেক বেশি উদ্যম দেখা গেছে। সেখানে বহু প্রতিষ্ঠানই আছে ভূতসংক্রান্ত খোঁজখবর বা গবেষণা করার জন্য। বহু মানুষ সেখানে সারাজীবন ভূতপ্রেত নিয়ে গবেষণা করেই জীবন কাটিয়ে দেয়
এদেশে হয়তো এমন কোন সোসাইটি এখনও তৈরী হয়নি, তবে বাংলা সাহিত্য কিন্তু এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেইসেখানে বহু গল্পেই পাওয়া যায় ভূতের সঙ্গে রীতিমতো পাঞ্জা লড়ার মতো লোকের দেখাআর এ ব্যাপারে সবথেকে অগ্রণী হলেন দুই বিখ্যাত চরিত্র, বাংলার দুই অগ্রগণ্য সাহিত্যিকের কলমে
(১) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বরদা’, আর (২) প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মেজোকর্তা’

সবশেষে আবার বলি, তেনারা ছিলেন, আছেন আর থাকবেনওকিন্তু সবসময় এটাই মনে রাখা দরকার

ভূত থাকে কোনখানে? গঞ্জে না শহরে?
ঘরে না বাইরে থাকে, কহো দেখি কহো রে!
যেখানেই থাক ভূত, পাহাড়ে কি বনেতে
আসল ঠিকানা তার মানুষের মনেতে
________
ছবি - ত্রিপর্ণা মাইতি

লেখক পরিচিতিঃ পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অথচ তাঁর আকৈশোর সঙ্গী সাহিত্য সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই তাঁর বেঁচে থাকা তাই একাধারে অসংখ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকা ছড়া, কবিতা গল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক নৃত্যনাট্য রচনা, সুরারোপ সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা বেশ কিছু পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখকের নানা বিষয়ের গ্রন্থরাজির মধ্যেআরশিনগর’, ‘আলাদিন’, ‘ছড়াডুম সাজে’, ‘নির্বাচিত শ্রুতিনাট্য’, ‘ভূতের বৃন্দাবনপ্রভৃতি বইগুলি ইতিমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে

2 comments:

  1. কাহিনি তাঁর জায়গাতে হয়তো আছে । কিন্তু মরনের পর শরীর ধ্বংস হয়ে যায় । সেই শরীর matri jothor chara আবার কি ভাবে হবে? ভুত অনুভবের জিনিষ দেখবার নয় । এই সাথে সেই সত্তা দেহ হারিয়ে শরীরী দুনিয়া তে বড় অসহায় । অঙ্গহীন সেই সত্তা যেমন কারো ক্ষতি করতে পারে না, তেমনি নিজের নামে চলা মিথ্যের প্রতিবাদ করতে পারে na. Sei sujoge আমরা অশরীরী দের নামে মিথ্যে কথা লিখে যাই এইজন্য যে মানুষ ভয় পেতে ভালবাসে । Krishnendu Bandyopadhyay ভুত আছে ভয় নেই সেই টাই সত্যি । এই সত্যি নিয়ে কাহিনী হয় না কেন? মানুষ পড়তে ভালো বাসবে না? আমরা কাহিনী পড়ে সেই চরিত্রের সুখে দুখে হাঁসি কাঁদি না এমন তো নয়। Krishnendu Bandopadhyay

    ReplyDelete