বায়োস্কোপ:: কানকাটা হইচির গল্প - সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়


কানকাটা হইচির গল্প
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়

জাপানকে আমরা ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’ বলে থাকি মধ্যযুগে মানে প্রায় দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ সেখানে একটা বিরাট বড়ো যুদ্ধ হয়েছিল এই ঘটনা ইতিহাসে ‘গেনপেই যুদ্ধ’ (১১৮০-১১৮৫) নামে কুখ্যাত। সে সময় দেশটা ছোট বড়ো অনেক রাজা বা সামন্ত প্রভুদের দখলে ছিল। ক্ষমতার প্রদর্শন, এলাকা দখল এসব নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়শই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকততবে ওই শতাব্দীর শেষের দিকে বোঝাই যাচ্ছিল যে হেইকি আর গেনজি বা মিনামোতো এই দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে যে জিততে পারবে সেই পুরো জাপানকে শাসন করবে। তারপর এল সেই দুর্দিন। ২৫শে এপ্রিল ১১৮৫ নাগাদ জাপানের হোন্‌সু দ্বীপের দক্ষিণে সিমোনোসেকি নামে যে সরু প্রণালী তারই দান-নো-উরা বলে এক জায়গায় এক দুর্দান্ত নৌযুদ্ধ শুরু হয়। দু'পক্ষের ছোট বড়ো অনেক যুদ্ধ জাহাজ আর দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা এতে যোগ দেয়। জাপানী কিংবদন্তী অনুযায়ী দু'পক্ষের অসংখ্য মানুষের মৃত্যুতে নাকি দান-নো-উরা’র জল লাল হয়ে গেছিল। এই প্রবল যুদ্ধের শেষের দিকে সবাই বুঝতে পারল হেইকিদের পরাজয় নিশ্চিতখন হেইকিদের শিশু সম্রাট আনতোকুকে বুকে নিয়ে তাঁর ধাই মা ওই রক্তে রাঙা সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জাপানী উপকথা অনুযায়ী হেইকি সম্রাট এখনও জলের নীচে তাঁর নতুন সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে যাচ্ছেন। হেইকি নামের আশ্চর্য কাঁকড়াই নাকি এর সাক্ষী যার খোলে হেইকি সামুরাইদের শিরস্ত্রাণের মতো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়

হেইকি কাঁকড়া

এতো গেল ইতিহাসের কথা। কিন্তু এই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে অনেক কিংবদন্তী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জাপানের লোকশ্রুতি আর সাহিত্যে। তেমনি একটা অনবদ্য আখ্যান হল কানকাটা হইচির গল্প। হইচি ছিল এক অনাথ ছেলে যে আবার চোখেও দেখতে পেত না। এটুকু শুনেই তোমরা ঘাবড়ে যেও না, এই গল্পটা সত্যিই কানকাটা হইচির; অন্ধ হইচির না। সে মানুষ হয় এক বৌদ্ধ মঠে সেখানকার সন্ন্যাসীদেরই তত্ত্বাবধানে। একটু বড়ো হতে না হতেই তার গানের গলার খুবই সুনাম হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় সংগীতই নয়, জাপানের পুরান ও প্রাচীন ইতিহাসের ওপর লেখা নানা কাব্যকে সুর দিয়ে সে চমৎকার গাইতে পারতএর মধ্যে দান-নো-উরা’র নৌযুদ্ধকে নিয়ে একটা কবিতাও ছিল। সত্যি বলতে কি একসময় এই দান-নো-উরা’র গানের জন্যই হইচির সবচেয়ে খ্যাতি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি কয়েক দিন ধরে সে এই গান গাইতো আসরে। বিরাট বড়ো এই কাব্যগীতি শুনতে শুনতে অনেকেরই চোখে জল চলে আসত যখন হতভাগ্য শিশু সম্রাট আনতোকুর শেষ পরিণতি খুব দরদ দিয়ে গেয়ে উঠতো হইচি। সাথে থাকতো প্রাচীন জাপানী বাদ্যযন্ত্র বিওয়া। যেটা সে সমান দক্ষতায় বাজাতে পারত

জাপানের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বিওয়া
আসল গল্পটা শুরু হয় এক রাতের দিকে যখন ওই মঠে হইচি একা বসে তার গানের রেওয়াজ করছিল। সে সময় এক সামুরাই এসে হইচিকে তার সঙ্গে যেতে বলে। সে আরও জানায় যে তার প্রভু হইচির গানের অনেক নামডাক শুনে তার নিজের প্রাসাদে তাকে নিয়ে যেতে বলেছেনকিন্তু তার সাথে ওই সামুরাই রক্ষী এও বলে সতর্ক করে দেয় যে এই কথা যেন সে কাউকে না জানায়, তাহলে বিপদ আছে। যা হোক, গাইতে সে খুবই ভালবাসত। তাই কোনও সন্দেহ না করে হইচি ওই সামুরাই-এর সাথে তার প্রভুর প্রাসাদে পৌঁছায়। চোখে দেখতে না পেলেও অনুভূতি দিয়ে বোঝে যে সে এক বিরাট প্রাসাদে এসে পড়েছে যেখানে অনেক সভাসদ তার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। অবশেষে তার ওপর আদেশ হয় দান-নো-উরা’র যুদ্ধ নিয়ে লেখা বিখ্যাত কাব্যগীতি গেয়ে শোনাবার জন্য। এইজন্যই অপেক্ষা করছিল হইচি। সে তার গলার সব আবেগ দিয়ে দান-নো-উরার যুদ্ধের কাহিনী গেয়ে শোনাতে থাকে। তার গানে যেন পুরোনো সময়টাই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সে রাতে। সুরের মধ্যেই পুরো ডুবে গেছিল সে, কোন হুঁশ ছিল নাশেষে ভোর হওয়াতে পাখির ডাকে সম্বিত ভাঙে হইচির। কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে তখন নিজেই সে ওই সামন্ত প্রভুকে অভিবাদন জানিয়ে ফিরে আসে তার মঠে। পরের দিন আবার তার ডাক আসে ঠিক রাতের বেলা। সামুরাই রক্ষীর সাথে একইভাবে সে গিয়ে পৌঁছায় আগের রাতের সেই প্রাসাদে। যথাসময়ে তার গানের ডাক এলে অনায়াসে সেই যুদ্ধের কাহিনী সে বয়ান করতে থাকে সুরে সুরে। এইভাবে পরপর অনেক রাত ধরে হইচি বারবার ওই রাজসভায় গিয়ে সেই কাব্যগীতি গেয়ে শোনায়গাইতে গাইতে মাঝে মাঝে গভীর রাতের দিকে তার গানের অনেক ভূয়সী প্রশংসাও কানে আসে হইচিরকিন্তু ধীরে ধীরে মঠের অন্য সন্ন্যাসীরা কিছু একটা আঁচ করতে থাকে তাকে দেখে। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে হইচি তখন রুগ্নতার সারা দেহে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তারপর এক বাঁধভাঙা ঝড়ের রাতে বেপাত্তা হইচিকে খুঁজতে খুঁজতে ওই মঠের কিছু কর্মীরা তাকে পেয়ে যায় এক প্রাচীন সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে। তখন চারিদিকে প্রবল ঝড় বৃষ্টি কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ওই সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে কোন বৃষ্টি নেই বরং হইচিকে ঘিরে কিছু অদ্ভু আলো তখন প্রায় শূন্য থেকে দুলছে। দূরে দূরে আরও ছোট বড়ো নানা আলোকবিন্দুর নৃত্য চলছে তখন। যেন অনেক দূর থেকে জাহাজের পাল এগিয়ে আসছে কাছে। আর তাদেরই আলোর সে কি নাচ!! প্রবল ভয়ে প্রায় টানতে টানতে ওই মঠের লোকেরা নাছোড় হইচিকে ফিরিয়ে আনে সে রাতে সমস্ত ঘটনা শুনে মঠের মূল সন্ন্যাসী বুঝতে পারেন যে দান-নো-উরা’র যুদ্ধের পর হতভাগ্য হেইকি সামুরাইদের আত্মারাই হইচিকে নিয়ে যায় গান শোনানোর জন্য। রাতের পর রাত তাদের দুর্ভাগ্যের গাথাই হইচি শোনায় তার গলার দরদ দিয়ে। এমনকি হইচি যাকে প্রাসাদ ভেবেছিল সেটা আসলে হেইকিদেরই সুপ্রাচীন সমাধিক্ষেত্র। এরপর মঠের সন্ন্যাসীরা হইচিকে ওই অশুভ আত্মাদের থেকে বাঁচাবার জন্য তার সারা শরীরে প্রভু অমিদা বা অমিতাভর (প্রাচীন জাপানী ভাষায় বুদ্ধদেবের নাম) প্রণাম মন্ত্র লিখে রাখে এমনকি তার অন্ধ চোখের ভ্রুর মধ্যেও এই মন্ত্র লেখা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, এইভাবে শরীরে মন্ত্র লেখা থাকলে সেই শরীর আত্মাদের দৃষ্টিগোচর হবে না। হইচিকে বারবার সাবধান করা হয় যে ওই সামুরাই রক্ষী ডাকলেও সে যেন কিছুতেই সাড়া না দেয়। অবশেষে আবারও আসে রাত্রিবেলা, হেইকি সামুরাইয়ের আত্মা সেদিনও হইচি’র নাম ধরে ডাকতে থাকে কিন্তু তাকে কোথাও দেখা যায় না এমনকি তার গলাও শুনতে পাওয়া যায় না। চারিদিকে অনেক খুঁজে শেষে একটা হলঘরে হইচির দুটো কান শুধু দেখতে পাওয়া যায়। আসলে ওই সন্ন্যাসীরা হইচির কানে মন্ত্র লিখতে ভুলে গেছিল। তখন হইচিকে না পেয়ে প্রবল রাগে তার কান কেটে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে সেই আত্মা অসহ্য যন্ত্রণাতেও মুখ বুজে থাকে হইচি কিছুক্ষণ পরে রেগেমেগে সেখান থেকে চলে যায় হেইকি সামুরাইয়ের সেই অশুভ আত্মা। পরদিন রক্তাক্ত হইচিকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই মঠের এক বড়ো হলঘরে প্রভু অমিদার মূর্তির সামনে। তার চারিদিকে তখন ছোপ ছোপ গাঢ় লাল দাগ। সন্ন্যাসীদের সেবায় সে যাত্রা ধীরে ধীরে সেরে উঠলেও আর কোনদিন স্বাভাবিকভাবে শুনতে পায়নি হইচিতবে জনশ্রুতি অনুযায়ী এর পরেও তার গানের চর্চায় কোন ঘাটতি হয়নি। বরং গায়ক হিসেবে আরও ছড়িয়ে পড়ে তার নাম আর সেই সঙ্গে এই মঠের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।

১৯৬৪ সাল নাগাদ ‘কাইদান’ বলে একটা বিখ্যাত ছায়াছবি তৈরী হয়েছিল জাপানে । সেই ছবিতে চারটে ভূতের গল্প ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এই কানকাটা হইচির গল্প। এই প্রাচীন লোক কাহিনী অনবদ্যভাবে উঠে এসেছিল সেই ছবিতে। কাহিনী বলার আদল, ফটোগ্রাফি, সংগীত সব কিছুতেই এতো উৎকর্ষের জায়গা পেয়েছিল এই ছবি যে ১৯৬৫ সালে বিখ্যাত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একে ‘বিশেষ জুরী পুরস্কার’ দিয়ে সম্মানিত করা হয় সে বছর শ্রেষ্ঠ বিদেশী ছবি হিসেবে অস্কারের মনোনয়নের তালিকাতেও এই ছবির নাম ছিল।

কাইদান ছায়াছবির দৃশ্য - বিওয়া বাদনরত হইচি

কাইদান ছায়াছবির দৃশ্য - হইচির শরীরে মন্ত্র লিখছেন সন্ন্যাসী

এর মধ্যে তোমাদের আর একটা কথা বলে রাখি। আমরা ছেলেবেলায় প্রথম এই গল্প পড়েছিলাম মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য অনুবাদে। সম্পর্কে আবার যিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় অবন ঠাকুরের জামাই। পরে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনুবাদেও আরেকবার পড়েছিলাম এই গল্পটা। গপ্পোটা পড়ে আমার গায়ে বেশ কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। অনেক পরে যখন ছবিটা দেখি তখন ছেলেবেলার স্মৃতি আর সেই ভয় পাওয়ার অনুভূতি আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছিল, এমনই ভালো ছিল ছবিটা। সত্যি কথা বলতে কি বাপু আমরা ভূতে তো কেউই বিশ্বাস করি না, তবে সে তো দিনের বেলা!!
_______
শীর্ষচিত্রঃ কাইদান ছায়াছবির দৃশ্য – দান-নো-উরার নৌযুদ্ধ

লেখক পরিচিতি - সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্য, মার্গ সংগীত আর সারা পৃথিবীর সিনেমার একনিষ্ঠ ভক্ত। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন অণুপত্রিকায় লেখা-লেখিতে হাত পাকানো। মূলতঃ গদ্যসাহিত্যেই বেশি স্বচ্ছন্দ। প্রথাগত শিক্ষা প্রযুক্তিবিদ্যায় (স্নাতকোত্তর) আর বর্তমানে সেই বিষয়েরই শিক্ষকতায় যুক্ত। লেখক মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীর সংকটে এক কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে সৎ-সাহিত্য।

7 comments:

  1. দারুণ আকর্ষণীয় রিভিউ। রিভিউ পড়ে ছবিটা দেখার ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। লেখকের কলম থেকে এরকম আরো অনেক অসাধারণ অজানা ছবির রিভিউ ভবিষ্যতেও পাব এই আশা রাখি।

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত রিভিউ !এরকম রিভিউ আরো চাই 😃

    ReplyDelete
  3. darun review... hoyto monilal gongopadhyay-er lekha ta ar pabo na market-e.. tobe cinema ta obossoi dekhbo... erkom ojana sundor cinemar khoj jeno aro pai..

    ReplyDelete
  4. আপনাদের মতামতই আগামী লেখার অণুঘটক। অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে।

    ReplyDelete
  5. খুব ভাল লাগলো তোমার রিভিউ পড়ে। ছবিটা জাপানের সেরা supernatural movie গুলোর মধ্যে অন্যতম।

    ReplyDelete
  6. লেখাটা বেশ ভালো লাগল। তথ্য আছে অনেক, বর্ণনাও প্রচুর, কিন্তু পড়তে গিয়ে কোথাও তা মনকে ভারী করে না। অভিনন্দন, এবং আপনার আরও লেখা পড়ার আশা রইল।

    ReplyDelete
  7. khub valo hoechhe lekhata. amio Hemendra kumar Roy-er Kaan kata hochi porechhi. apni aro likhben.

    ReplyDelete