বিজ্ঞান:: সত্যি ভূতের গপ্পো - সৌম্যকান্তি জানা

সত্যি ভূতের গপ্পো
সৌম্যকান্তি জানা

‘ভূত’ নামটা শুনলেই গা ছমছম করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার, আবার তা যদি হয় রাতের বেলা তবে তো কথাই নেই তোমরা গল্প-গাথায় যে সমস্ত ভূতেদের ‘দেখা’ পাও তারা প্রায় সবাই মানুষ-ভূত। আসলে ভূত-সাম্রাজ্যে যেন মানুষের মৌরসিপাট্টা। সেখানে পশু-পাখিদের ঠাঁই নেই। মানুষ মরে যদি ভূত হতে পারে, পশু-পাখিরা হবে না কেন? এ নিয়ে পশু-পাখিদের যদি অভিমান-অনুযোগ থাকে তবে তা সঙ্গত। আর তাই দুটো ভূতুড়ে পশু-পাখি নিয়ে আমরা চর্চা করব।
ভূতপ্রেমীরা বলেন, ভূত সবসময় দেখা যায় না, সবাইকে দেখাও দেয় না। রাতের বেলা কেউ কেউ দেখতে পায়, আবার কেউ কেউ তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। এরকম বেশ কয়েকটি পশুপাখি নিয়ে কিন্তু ভূতুড়ে কাহিনি আছে। তাতে অতিরঞ্জন থাকতে পারে কিংবা রহস্য থাকতে পারে তবে একেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তোমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’ অনেকেই পড়েছ। সেখানে কাকাবাবু ‘ইয়েতি’ নামে এক রহস্যময় প্রাণীকে নিয়ে রহস্যের জাল বুনেছিলেন। কিছুদিন আগে এই ইয়েতিকে নিয়ে আবার খবর হয় সংবাদ মাধ্যমে। কিন্তু আজও ইয়েতির কোনও ফটো কেউ তুলতে পারেনি বা মৃতদেহ সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ইয়েতি আছে কি নেই তা নিয়ে আজও ঘোর রহস্য রয়ে গেছে। হিমালয়ের ইয়েতির মতো স্কটল্যান্ডের লচ নেস মন্সটার, উত্তর আমেরিকার স্যাসকোয়াচ আর দক্ষিণ আমেরিকার চুপাক্যাবরা-কে নিয়েও সমান অমীমাংসিত রহস্য রয়ে গেছে। এদের নিয়ে যে সব কাহিনি আছে তা গা-ছমছমে ভূতুড়ে গল্পের থেকে কোনও অংশে কম নয়। এই সব রহস্যময় প্রাণীদের বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ক্রিপটিড (Cryptid)এমনই দুটো ভুতুড়ে ক্রিপটিডের কথা আজ তোমাদের জানাব।

উলামাঃ


শ্রীলঙ্কায় একটা লোককাহিনি খুব প্রচলিত আছে। অনেকদিন আগে শ্রীলঙ্কায় স্বামী-স্ত্রী ও তাদের এক ছেলে নিয়ে একটা পরিবার  ছিল। হঠাৎই একদিন স্বামীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধল যে সে তাদের ছেলের প্রকৃত বাবা নয়। তার স্ত্রীর ব্যাভিচারের ফলে ঐ সন্তানের জন্ম হয়েছে। এই নিছক সন্দেহের বশে সে তার ছেলেকে স্ত্রীর অজান্তে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে রান্না করল। তারপর সেই মাংসের ঝোল ভর্তি বাটি তার স্ত্রীকে খেতে দিল। মহিলাটি খেতে গিয়ে বাটিতে একটা ছোট্টো আঙুল দেখে বুঝতে পারল যে এটা তার সন্তানের আঙুল। সন্তান হারানোর তীব্র বেদনায় ও আতঙ্কে মহিলাটি খাবার ফেলে দৌড় লাগাল জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলে গিয়ে সে আত্মহত্যা করল। তারপর থেকে সেই সন্তানহারা মায়ের অশরীরি আত্মা শয়তান পাখি (Devil Bird) বা স্থানীয় ভাষায় ‘উলামা’ (Ulama)-র রূপ ধরে রাতের বেলা সমস্ত জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর সুতীব্র বেদনায় চীৎকার করে কাঁদে। সেই কান্নার শব্দ শোনা যায় বহুদূর থেকে। এই কান্নার শব্দ হল মরণের-ডাক। যে এই শব্দ শোনে তার মৃত্যুর ডাক আসে। ফলে নির্জন রাত্রে সেই গগনবিদারী শব্দ যে-ই শোনে মৃত্যুভয়ে সে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
কাহিনি সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, জঙ্গল থেকে রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে যে হাড় হিম করা শব্দ ভেসে আসে তা কিন্তু মিথ্যা নয়। আর সবচেয়ে বড়ো রহস্যময় ব্যাপার হল এই শয়তান পাখি বা উলামা-কে স্বচক্ষে জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেখেছে কিংবা ছবি তুলেছে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে শ্রীলঙ্কায় উলামার ভতুড়ে গল্প মানুষের মনে দানা বেঁধে ছিল। তবে পশ্চিমি বিজ্ঞানের জগতের লোকেরা একে শ্রীলঙ্কার মানুষের কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিল।
স্থানীয় কিছু মানুষের দাবি ছিল তারা ওই উলামাকে দেখেছে, তবে ক্ষণিকের জন্য। যদিও তারা দেখার সাথে সাথে চীৎকার একসাথে শোনেনি। ফলে ধন্দের নিরসন হওয়া সম্ভব ছিল না। যাইহোক, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে পাখিটা নাকি বিশালাকার, অন্ধকারে দুটো ছোখ জ্বলে, আর তার দুটো শিং আছে। অনুসন্ধান আর বিশ্লেষণ চলতেই থাকল। ড. আর. এল. স্পিটেল তাঁর ‘The Far off Things’ গ্রন্থে জানালেন যে উলামা প্রকৃতপক্ষে পেটে ছিট দাগযুক্ত ঈগল-পেঁচা (Spot bellied eagle owl, বিজ্ঞানসম্মত নাম Bubo nipalensis) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে চেঞ্জেবল হক-ঈগল (Changeable Hawk-Eagle) বা ওরিয়েন্টাল হানি বাজার্ড (Oriental Honey Buzzard)-ও হতে পারে।
২০০১ সালে কাকের তাড়া খেয়ে দলছুট হয়ে যাওয়া একটা অপরিণত পেটে ছিট দাগযুক্ত ঈগল-পেঁচাকে কিছু গ্রামবাসী উদ্ধার করে। সেই সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রচার করা হয় যে ওটাই হল বহু আলোচিত উলামা। সংবাদমাধ্যমও এই মত সমর্থন করে। কারণ এই পাখিটা যা দেখতে তা অধিকাংশ স্থানীয় মানুষ যারা উলামা দেখেছে বলে দাবি করেছিল তাদের বর্ণনার সাথে মিলে যায়। তবে সব মানুষ কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারেনি। কিছু মানুষের দাবি তারা যে পাখিটিকে ‘ক্রন্দনরত’ অবস্থায় দেখেছে তা চেঞ্জেবল হক-ঈগলের সাথেই বেশি মেলে। আর তাই বিতর্কের শেষ এখনও হয়নি।

বন্ডেগেঝৌঃ


পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া নিউগিনি এলাকায় ‘মনি’ নামে একপ্রকার উপজাতির বাস। দীর্ঘদিন ধরে একটা বিশ্বাস তাদের মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে যে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা রাতের আঁধারে গভীর জঙ্গলে মানুষের রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। তারা রাত্রিবেলায় দেখেওছে তাদের সেই পূর্বপুরুষ ভূতেদের। ওই ‘ভূতেরা’ উচ্চতায় তিন ফুটের থেকে একটু খাটো, আর সারা গায়ে সাদা-কালো ঘন লোমে ঢাকা। তারা গাছে উঠতে পারে, আবার মাটিতে দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতেও পারে। মনি উপজাতির লোকেরা তাদের বেশির ভাগ সময়ই মাটিতে হাঁটতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের মধ্যে তাদের দেখলে মনে হবে ছোটোখাটো মানুষ। তাদের দিকে এগিয়ে গেলে তারা নাকি উঠে দাঁড়ায়, মুখে একটা শিসধ্বনি দেয় আর অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিমায় হাত তোলে। মনি উপজাতির মানুষেরা তাদের ওই পূর্বপুরুষ ‘ভূতেদের’, খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখে। আর তাই তাদের কোনও ক্ষতি তারা করতে দেয় না। তাদের ভাষায় ওই পূর্বপুরুষ ভূতেরা হল ‘বন্ডেগেঝৌ’ (Bondegezou)এই নামের অর্থ হল ‘জঙ্গলের মানুষ’ (Man of the forest) অবশ্য স্থানীয় মানুষরা আরও একটা নামে ওদের ডাকে – ডিঙ্গিসো (Dingiso)
মনি উপজাতির মানুষেরা বন্ডেগেঝৌকে যতই তাদের পূর্বপুরুষ ভূত বলে বিশ্বাস করুক, বিজ্ঞানীরা তো আর তা মানবেন না। ফলে খোঁজখবর শুরু হয় বন্ডেগেঝৌদের নিয়ে। তবে যে কোনও কারণেই হোক এদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের উৎসাহ একটু কম ছিল, নইলে বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির যুগেও কেন প্রথম স্পষ্ট ছবি তুলতে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল? বন্ডেগেঝৌ-এর প্রথম পরিষ্কার ছবি তোলেন অস্ট্রেলিয়ার একজন বিজ্ঞানী। তবে তার পরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে আসল নমুনা সংগ্রহের জন্য। ড. টিম ফ্ল্যানারি ১৯৯৪ সালে প্রথম সংগ্রহ করেন একটা মৃত বন্ডেগেঝৌ-এর চামড়া ও হাড়। আর তারপরই বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন যে মনি উপজাতির লোকেদের ‘ভূত’ পূর্বপুরুষরা হল একটা নতুন প্রজাতির আশ্চর্য প্রাণী। এরা আসলে ক্যাঙারুদের এক জাতভাই – গেছো ক্যাঙারু। বন্ডেগেঝৌ আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এ ধরণের কোনও গেছো ক্যাঙারুর কথা বিজ্ঞানীমহলে জানা ছিল না। এরা গেছো হলেও বেশিরভাগ সময় মাটিতেই থাকে, আর ঠিক মানুষের মতো পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দূরের জিনিস দেখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দু’পায়ে দাঁড়ানো, শিসধ্বনি অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিমা আসলে ওদের সতর্কীকরণ ভঙ্গিমা। এদের লেজটা সাধারণ ক্যাঙারুর তুলনায় অনেক ছোটো। আর তাই এদের দূর থেকে ছোটখাটো লোমশ মানুষ বলে মনে করা অস্বাভাবিক নয়। নতুন এই প্রাণীটির বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হল Dendrolagus  mbaiso প্রজাতির নাম ‘mbaiso দেওয়ার কারণ এই শব্দটি মনি উপজাতির মানুষের থেকে নেওয়া শব্দ, যার অর্থ ‘নিষিদ্ধ প্রাণী’IUCN-এর লাল তালিকাভুক্ত (Red List) প্রাণীদের তালিকায় বন্ডেগেঝৌকে বিপন্ন (Endangered) প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এদের সংরক্ষণ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয় না পরিবেশবিদ বা সরকারকে কারণ মনি উপজাতির লোকেরা তাদের ওই পূর্বপুরূষ ‘ভূতেদের’ চিরাচরিত প্রথা অনুসারেই সুরক্ষা দেয়।
_______

No comments:

Post a Comment