বইঃ
ভূতভূতুনির গল্প
সম্পাদনাঃ
জয়দীপ চক্রবর্তী
আলোচনাঃ ঋজু
গাঙ্গুলী
শহর-গ্রাম থেকে ঝোপঝাড়,
গাছপালা, পোড়োবাড়ি, পরিত্যক্ত ভিটে, মায় অন্ধকার যতই গায়েব হয়ে যাক না কেন, ভূতের
গল্প পড়তে যে আমরা ভীষণ রকম ভালোবাসি, তার পরিচয় যেকোন বইয়ের দোকান বা ম্যাগাজিনের
স্টলে গেলেই পাওয়া যায়। প্রায় প্রত্যেক পত্রিকা নিয়ম করে ভূতের আর রহস্য-গোয়েন্দা
গল্পের বিশেষ সংখ্যা বের করে চলে, বিশেষত এই মাসে, যখন আকাশের মুখ হয় অন্ধকার,
ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় ঘরের জানলাটা, আর খিচুড়ি বা তেলেভাজা
হাতে আমরা জুলুজুলু চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবি, এবার একটা জম্পেশ করে ভূতের গল্প
হয়ে যাক!
ম্যাজিক ল্যাম্পের এই
সংখ্যাতেও সলিড কিছু ভূতের আর ভয়ের গল্প শোনানোর জন্যে কলম তথা কি-বোর্ড ধরেছেন এক
ঝাঁক সাহিত্যিক। আর আমি এসেছি সেই ব্যবস্থা করতে, যাতে আরেকটু ভয় পেতে চাইলেই পাঠক
ভিজে সন্ধে বা ফাঁকা দুপুরটা কাটানোর মতো একটা চমৎকার বই খুঁজে পান।
·
বইয়ের নামঃ ভূতভূতুনির গল্প
·
সম্পাদনাঃ জয়দীপ চক্রবর্তী
·
প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৬
·
প্রকাশকঃ কবিতা পাক্ষিক
·
হার্ডকভার, ১৪৪ পৃষ্ঠা, প্রকাশ-কালীন
মূল্যঃ ১০০/- টাকা
·
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ দেবাশীষ দেব
মন-মাতানো গল্প লেখায়
সিদ্ধহস্ত লেখক জয়দীপ চক্রবর্তীর সম্পাদনায়, এবং দেবাশীষ দেব-এর অদ্বিতীয় ছবিতে
সমৃদ্ধ শক্তপোক্ত বইটা হাতে নিয়েই একটা চেয়ার বা সোফা খুঁজে সেট হয়ে যাবার বাসনা
জাগা খুবই স্বাভাবিক। তেমনই স্বাভাবিক মলাট দেখে এটা আশা করা, যে সেকাল-একালের
কুড়িজন লেখকের গল্পে ঠাসা এই বইয়ের গল্পগুলো হবে ছোটোদের, এবং হাসির। আমিও তেমন
আশা করে বইটা পড়লাম। তারপর কী হল?
সম্পাদকের অতি-সংক্ষিপ্ত
‘পূর্বকথা’-র পরেই আমরা ঢুকে পড়ি গল্পের রাজ্যে। গল্পক্রম মেনে যে সব গল্প তারপর
আমাদের কাছে আসে তারা হলঃ –
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
“নিশীথে”: শরীর আর মনের দুর্বলতা নিয়ে লেখা এ গল্প
সর্বার্থে ক্লাসিক, কিন্তু এ গল্প কোন মতেই কিশোরপাঠ্য নয়, এমনকি ভূতেরও নয়।
সম্পাদক এই বিশেষ সংকলনে এই গল্পটি না রাখলেই পারতেন।
২. যোগীন্দ্রনাথ সরকার-এর
“ভূতের বিপদ”: যুক্তি আর অ্যাডভেঞ্চারের এই ছোট্ট
গল্পটা পড়তে দিব্যি লাগে।
৩. উপেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী-র “জোলা আর সাত ভূত”: এই
সোনা-বাঁধানো গল্পটি হাজার বার পড়লেও পুরনো হবার নয়, হয়ও না।
৪. কুলদারঞ্জন রায়-এর “ভূতের
বাপের শ্রাদ্ধ”: ওল্ড যে সব সময়েই গোল্ড হয় না, তার
খাঁটি নমুনা এই গল্পটি, যা আজকের ছোটোদের কাছে গল্পের বদলে বাজে ধরনের ক্যারিকেচার
বলেই মনে হবে।
৫. বিভূতিভূষণ
বন্দোপাধ্যায়-এর “ভৌতিক পালঙ্ক”: লা-জবাব এই
গল্পটা আজ অবধি কত ভূতের গল্পের সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে, তার যেমন ইয়ত্তা নেই, তেমনই
পরিমাপ নেই গল্পটা প্রত্যেক বার পড়তে গিয়েই হওয়া শিরশিরানিটার।
৬. সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়-এর
“অদ্ভূত ভূতের গল্প”: অদ্ভূত নয়, বরং মানুষের দাপটে পিছু
হটা ভূতের এই নমুনাটিও আজ বেখাপ্পা ঠেকাতে পারে।
৭. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর
“নমস্কার”: আজকের তুখোড় ছেলেমেয়েদের কাছে এই
গল্পের প্রতিটি আনাচ-কানাচ প্রেডিক্টেবল মনে হবে। তাই সম্পাদক এই গল্পটিকেও বর্জন করতে
পারতেন বলেই আমার মনে হয়।
৮. হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর
“পোড়োবাড়ির আতঙ্ক”: ইশশ! হেমেন রায়ের এত-এত গায়ের লোম
খাড়া করে দেওয়ার মতো গল্প থাকতেও সম্পাদক কেন যে এমন একটা দুর্বল গল্প বাছলেন...।
৯. শিবরাম চক্রবর্তী-র
“ভুতুড়ে ইয়ার্কি”: নাঃ, এই গল্পটাও একেবারে নেতিয়ে
যাওয়া মুড়ির মতো ঠেকবে এই সময়ের পাঠকদের! সম্পাদক কি ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন?
১০. প্রভাত চৌধুরী-র “এলাটিং
বেলাটিং ভূত”: কেলেংকারি! এ গল্পে না আছে মজা, না
ভয়, না রোমাঞ্চ। তাহলে আছেটা কী? আছে প্রচুর ডায়লগ, ভূতের গল্পে নিতান্ত ভৌত
জিনিসপত্র গুঁজে গল্পটাকে ‘ট্রেন্ডি’ বানানোর চেষ্টা, আর শেষটায় গিয়ে “এই যাঃ,
এতগুলো পাতা ভরাট হয়ে গেছে...” ভেবে গল্পটা শেষ করে দেওয়া।
১১. শিশির বিশ্বাস-এর
“নীলকুঠির সাহেব-ভূত”: বেলাইন রেলগাড়ি আবার ট্র্যাকে ফেরা
শুরু হল এই গা-ছমছম গল্পটা দিয়ে।
১২. দেবজ্যোতি
ভট্টাচার্য-র “গভীর রাতে ব্রহ্মপুত্রে”: এই
বইয়ের সেরা, এবং আমার পড়া অন্যতম সেরা ভয়ের গল্প। শুধু এই একটা গল্পের জন্যেই বইটা
কেনা যায়।
১৩. গৌতম রায়-এর “তোকে কিন্তু
ছাড়ব না”: গল্পটায় ভূত নেই, পাঠকের জন্যে ভয়
পাওয়ার তেমন কোন বন্দোবস্তও নেই, আছে শুধু একটা ঘোর প্রেডিক্টেবল গল্প।
১৪. জয়দীপ চক্রবর্তী-র
“ডায়মন্ডহারবার লোকালের সেই লোকটি”: ইয়া হু!
সম্পাদক একটা সিরিয়াসলি রোমহর্ষক গল্প উপহার দিয়েছেন আমাদের। পরের বার ফাঁকা
কামরায় ওঠার আগে অন্তত বার পাঁচেক ভাবতেই হবে।
১৫. দেবার্চন বসু-র
“স্ট্যাম্প-অ্যালবাম”: আর্থার কোনান ডয়েলের “দ্য ব্রাউন
হ্যান্ড” থেকে পাতি ঝেড়ে দেওয়া এই গল্পটা এমন এক সংকলনে উপস্থিত থাকাটা বিশাল বড়ো
মাপের সম্পাদকীয় ত্রুটি বলেই আমি মনে করি। ‘অনুপ্রাণিত’ হওয়ার নামে পরের দ্রব্য
গ্রহণ করাটা যেখানে প্রায় মহামারীর আকার নিয়েছে, সেখানে এই ব্যাপারটা নিয়ে সচেতন
হওয়া উচিত ছিল।
১৬. রম্যাণী গোস্বামী-র “ছোটা
মাঙ্গুয়ার সেই বাংলোতে”: ভূতের নয়,
কিন্তু দারুণ ভয়ের, আর ততটাই মর্মস্পর্শী এই চমৎকার গল্পটার জন্যে লেখককে আন্তরিক
ধন্যবাদ জানাই। আশা রাখি, তাঁর আরও অনেক গল্প পড়ার সুযোগ হবে আমাদের।
১৭. বিবেক কুণ্ডু-র
“ভীমবেটকার সেই রাত”: কিশোর
ভারতী-তে পূর্ব-প্রকাশিত এই গল্পটা রহস্য, রোমাঞ্চ, কিংবদন্তী, আর একটা অন্য-রকমের
পরিসমাপ্তির জন্যে, নিছক ভূতের গল্পের থেকে অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছে গেছে। এমন গল্প
কেন আরও পেলেন না সম্পাদক?
১৮. দোয়েল বন্দোপাধ্যায়-এর
“ভূত বলে কি মানুষ নয়?”: এই বইয়ের
সবচেয়ে নির্ভার এবং মজাদার এই গল্পটার সর্বনাশ করেছে অসংখ্য ছাপার ভুল। এমন একটা
অনবদ্য গল্প প্রকাশের আগে ন্যূনতম পরিমার্জনাটুকুও না করা একটি ক্ষমার অযোগ্য
অপরাধ, এবং এজন্যে সম্পাদক ও প্রকাশককে হাতের কাছে পেলে আমি কিছু বাছাই করা কথা
শোনাব।
১৯. অভিজিৎ দাস-এর
“চিনিপোখরির সার্কিটহাউস”: বেশ ভালো,
বেশ রোমাঞ্চকর গল্প।
২০. বৈশাখী ঠাকুর-এর
“সবজিওয়ালি”: চমৎকার গদ্যে, ঠাসবুনোট নির্মাণে,
শেষ অবধি সব রকমের ভয় আর রোমাঞ্চ বাদ দিয়ে একেবারে নিরামিষ একটা গল্প দিলেন লেখক।
ধুত!
মাত্র ১০০ টাকায় পড়ার মতো
এতগুলো গল্প পড়তে দেওয়ার জন্যে প্রকাশককে কৃতজ্ঞতা জানাই।
সম্পাদনা করা একটি আদ্যন্ত
থ্যাংকলেস জব হলেও ২০টির মধ্যে অন্তত সাতটা খুব উঁচু মানের গল্প আমাদের কাছে তুলে
ধরার জন্যে সম্পাদককেও ধন্যবাদ জানাই।
কিন্তু, পরের সংকলনটার সময়ে
মুদ্রণের ব্যাপারে সতর্ক, এবং গল্প-নির্বাচনের ক্ষেত্রে আর একটু নির্মম না হলে
আজকের পাঠক, সে যতই আলোজ্বলা ঘরে বসে ভয় করতে ভালোবাসুক, বইটি কিন্তু পড়েও দেখবে
না, ফলে বই ছাপানোটা ‘ভূতের বেগার’ হয়েই থাকবে।
_______
ভীষণ ভীষণ ভীষণ সত আর সুন্দর রিভিউ! সব সময় আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগে।
ReplyDelete