অন্য ধরণের বিজ্ঞান
প্রকল্প
ভট্টাচার্য
এক
আচ্ছা, সপ্তায় মাত্র একটা রবিবার কেন আসে! অংকের ক্লাশ চারটে, বিজ্ঞান ভূগোলও তিনটে করে, শুধু
রবিবারের বেলাতেই এত কিপটেমি কেন! ভাল লাগে না টাপ্পুর। কিন্তু উপায় কী, ওই সবেধন নীলমণি রবিবারটাকে কিপটের মতো খরচ করা ছাড়া! আর
সেইজন্যেই আজ এত ভোরে ওঠা। তারিয়ে তারিয়ে যাতে সময়টা কাটানো যায়।
আজও
সেইজন্যেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ল টাপ্পু। এখনও অন্ধকার রয়েছে। মা, ঠাম্মা কেউ ওঠেনি। বেশ মজা তো! সবার থেকে আগে ঘুম থেকে উঠলে
সে রবিবারটা সবথেকে বেশীক্ষণ আনন্দ করতে পারবে! উত্তেজনায় টাপ্পুর বুকটা ধুকপুক
করতে লাগল। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে সে চুপিসাড়ে দরজাটা খুলল।
চাঁদের আলোয়
চারদিক ঝকঝক করছে। পাশের তালগাছটার পাতাগুলো মনে হচ্ছে রূপোলি। কী সুন্দর! পা টিপে
টিপে বারান্দায় বেরিয়ে বালতি থেকে জল নিয়ে চোখ মুখ ধুলো সে, কোনো শব্দ না করেই। এমন একটা ভোরবেলা কি কারও সাথে ভাগ করে
নিতে আছে! কিন্তু যায়ই বা কোথায় এখন সে? গাবলু, পুচাইরা তো নির্ঘাত নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। নাক ডাকাবার কথা
মনে হতেই টাপ্পুর হাসি পেয়ে গেল। হারাণদা যখন দুপুরে ঘুমোয়, এমন নাক ডাকে, আর গোঁফটা
তালে তালে... হি-হি-হি! হারাণদা! শুধু শুধু গতকাল কী বকাই না বকলো তাদের। কী দোষ
করেছিল তারা, না ঠাকুরদালানে লুকোচুরি খেলছিল।
পুজো আসছে তো, ওখানে পোটোকাকা মুর্তি গড়ছে। তা
দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি?
টাপ্পুর
আবার পোটোকাকার সঙ্গে খুব ভাব।
- ‘কাকা, সিংহের
মাথাটা ওদিকে ঘোরানো কেন?’
- ‘ওরেব্বাবা! মহিষাসুরের এক থাপ্পড়ে!’
- ‘মহিষাসুরের গায়ে অনেক জোর, না
কাকা?’
- ‘জোর বলে
জোর! ত্রিভুবনে কেউ পারেনি তাকে ঠেকাতে। একমাত্র এই দেবী সিংহবাহিনীই!’
ভক্তিভরে প্রণাম
করে কাকা। কেউ প্রণাম করবার সময় বিরক্ত করতে নেই। টাপ্পু জানে। তাই বাকিটা না শুনেই
চলে আসে। পুচাইকে জিগ্যেস করে লাভ হয় না। অগত্যা ঠাম্মা।
- ‘ঠাম্মা, মহিষাসুরের
গায়ে অতো জোর, কিন্তু সিংহবাহিনী দেবী তাকে হারিয়ে
দিল কী করে?’
ঠাম্মা
মুচকি হাসে। ‘দেবী হলেন স্বয়ং শক্তি। শক্তিকে কি কেউ হারাতে পারে!’
- ‘শক্তি? কিন্তু আমরা
তো মা বলে ডাকি!’
- ‘মা ও তো শক্তি! সব মায়েরাই শক্তির অংশ।’
- ‘আমার মা-ও তাহলে শক্তি? আমাকেও
তাহলে মহিষাসুর কোনোদিন কিছু করতে পারবে না?’
এর মধ্যে মা
চলে আসে ঘরে। ‘মহিষাসুর ভাল ছেলেদের তো কিছু করে না, কিন্তু
যারা বাবা মায়ের কথা শোনে না, পড়াশোনা করে
না, অসভ্যতা করে, তাদের
মহিষাসুর খুব শাস্তি দেয়।’
মায়ের খালি
পড়াশোনা করার কথা। যে কোনও প্রশ্নের উত্তরেই ঠিক টেনে আনবে। টাপ্পু বোঝে। তবু
দুষ্টুমি করে বলে, ‘কেন মা, যারা পড়াশোনা করে না, তাদের
মায়েরাও তো শক্তি। তাদের ছেলেদের কেন শাস্তি দেবে মহিষাসুর?’
ঠাম্মা তো
শুনে হেসেই অস্থির, ‘শোনো কথা ছেলের!’
আচ্ছা, মা দুর্গাও কি তাঁর ছেলে মেয়েদের পড়তে বসান না? ভোরবেলা তুলে দেন নিশ্চয়ই! কার্ত্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী
এদের স্কুলেও পুজোর ছুটির কাজ দেয় না? সারাদিন তো
ওরা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে পড়াশোনা
কখন করে? নির্ঘাত ভোরবেলা! টাপ্পুর খুব জানতে
ইচ্ছে করল। এখন তো হারাণদা দেখতে পাবে না, কেউই
জানতে পারবে না। চট করে একবার ঠাকুরদালানটা ঘুরে আসা যাক।
পা টিপে
টিপে টাপ্পু ঠাকুরদালানে উঠল। অন্ধকারে
এত চেনা ঠাকুরদালানটাও কেমন অচেনা লাগে। এত লম্বা ছিল কি দালানটা? ওদিকে কিসের দরজা? টাপ্পু
মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোল। বাইরে মাঠ, জোছনায়
ফুটফুট করছে, আর তার মধ্যে... ও কে!! মা-গো!!
দুই
হৈমির খুব
দুঃখ। তার কোনও বন্ধু নেই। থাকবে কী করে, তার মামী তো
তাকে কারও সঙ্গে খেলতেও দেয় না, গল্প করতেও
দেয় না! সবসময় বাড়ির কাজ করায়। তাদের গ্রামের সব মেয়েরা কেমন দল বেঁধে বুড়ি
বাসন্তী, এক্কা দোক্কা খেলে, ওকে তখন উঠোনে গোবর নিকোতে হয়, গোয়ালে
জাবনা দিতে হয়। কান্না পায় তার, কিন্তু কীই
বা করে! যাদের মা থাকে না, তাদের রা
থাকে না। হৈমির মা নেই, তাকে জন্ম
দিয়েই আকাশের তারা হয়ে গেছে। তারপর থেকে মামার বাড়িতেই থাকে সে। মামা খুব ভালমানুষ, তাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু সারাদিন তো মুদির দোকান চালাতে
হয়। তার বাবা গঞ্জে কী চাকরি করে, আসা যাওয়ায়
অসুবিধে তাই ওখানেই থাকে। মাঝে মাঝে ছুটি পেলে তাকে দেখতে আসে, সঙ্গে কিছু পুতুল কিম্বা রান্নাবাটি...
- ‘হৈমবতী! কেমন আছিস মা?’
- ‘ভাল আছি বাবা। তুমি এতদিন পরে এলে কেন?’
- ‘ছুটি পাইনি যে! এবার খুব শিগগির আসব।’
- ‘বাবা, আমাকে তোমার
সঙ্গে গঞ্জে নিয়ে যাবে? তোমার সব
কাজ করে দেব। আমার এখানে একটুও ভাল লাগে না। নিয়ে যাবে বাবা?’
বাবা
অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন চিন্তা করে। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হৈমির মাথায় হাত
বোলায়, আর বলে, ‘হ্যাঁ
মা, নিশ্চয়ই। আর একটু অপেক্ষা কর, একটু সামলে নিই!’
শুধু তারই
নয়, সকলেরই কষ্ট আছে, বোঝে হৈমি। আর কথা বাড়ায় না। তাদের পাশের বাড়ি খোকাদারা
থাকে। তার বৌকে সবাই ফুলবৌ বলে। হৈমিও তাইই ডাকে। ফুলবৌ হৈমিকে খুব ভালবাসে।
কুমড়োফুলের বড়া ভাজলেই এ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। হৈমি খুব ভালবাসে কিনা! তাতেও মামীর
আপত্তি। বলে ‘ঈশ, আদিখ্যেতা!’
ফুলবৌ জানতে
পেরে হাসে, বলে ‘জানিস হৈমি, তোর মামী আসলে খুব ভাল। কিন্তু ভগবান ওকে ছেলেমেয়ে দেয়নি তো, তাই...’
- ‘কেন গো ফুলবৌ ছেলেমেয়ে দেয়নি ভগবান?’
- ‘আহা রে, ছেলেমেয়ে
দিলে তোকে মানুষ করত কে!’
হৈমি বোঝে না।
ভগবান তাকে মা দেন নি বটে, কিন্তু
ছেলেমেয়ে তো সকলকেই দেন। মামীকে দিলেন না কেন! ভগবানের সঙ্গে কখনও দেখা হলে সে
জানতে চাইবে ঠিক। ভগবান কে, সে জানে।
দুগগাঠাকুর। তাদের ঠাকুরঘরে মূর্তি আছে। মুখটা কী সুন্দর, ঠিক
ফুলবৌয়ের মতো। তার মাকেও কি ঐ রকমই দেখতে ছিল? নিশ্চয়ই
তাই হবে। আজ ভোরবেলা ঘুমচোখে জল আনতে বেরিয়ে কে জানে কেন খুব মায়ের জন্যে মন কেমন
করছিল তার। মামি টেনে তুলে দেয়, আলো ফোটার
আগে ঘোষেদের পুকুরে চান করে জল আনতে হয় রোজ। কই, তার
অন্য বন্ধুদের তো উঠতে হয় না! আসলে তাদের তো মা আছে। হৈমির মা থাকলে তাকেও নিশ্চয়ই
আর একটু ঘুমোতে দিত।
হোঁচট খেতে
খেতে আধো অন্ধকারে হৈমি হঠাৎ দেখতে পেল, কে যেন একটা
লোক দাঁড়িয়ে আছে! বুকটা ছাঁত করে উঠল! কী অদ্ভুত পোষাক পরা... কে এ! কোথা থেকে এল!
নিশি বা ভুলো নয় তো! সর্বশক্তি দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ও
মা গো!!!’
তিন
কালোকে
সব্বাই বলে মিথ্যেবাদী, গুলবাজ।
পাড়ার মা মাসীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বারণ করেন কালোর সঙ্গে মিশতে, বলেন ‘ওটা মহা গুলবাজ! মিশিসনি ওর সঙ্গে, নয়তো তুইও কিন্তু...’ কালোর কোনও বন্ধু নেই। না, ভুল। কালোর একটা বন্ধু আছে। ঐ পাড়ারই ছোট্ট মেয়ে সোনালী।
সোনালী হাঁটতে পারে না, হুইলচেয়ারে
বসে বসেই তার দিন কাটে। কালো তাকে এনে দেয় জলছবি, ডাকটিকিট...
গল্প শোনায় নানা দেশের।
- ‘কালোদা, তুমি
আমেরিকা গেছ?’
- ‘যাইনি আবার! এই তো গত বছরেই পুজোর ছুটিতে! আমার মেজমামা তো
ওখানেই থাকে!’
- ‘কীভাবে গেলে? প্লেনে?’
- ‘আবার কী! এই চড়লাম, এই
হু-উ-উশ পৌঁছে গেলাম!’
- ‘ভয় করেনি তোমার?’
- ‘নাঃ! ভয় কীসের! এরপর গেলে তোকেও নিয়ে যাব, বুঝলি?’
কিছুক্ষণ
দুজনেই চুপ করে থাকে। সোনালী ভুলে যায় যে সে হাঁটতেই পারে না, নীল আকাশে মেঘের মধ্যে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কালোও মনে
মনে হারিয়ে যায় এরোপ্লেনের ছবিটার মধ্যে... গতকালই দেখেছে সে। সোনালীর মা দেখেন সব, বোঝেনও। কিন্তু অসহায় মেয়েটার এইটুকু খুশী কেড়ে নিতে মন চায়
না। কালোর ওপর এক অদ্ভুত মায়া হয়। বলেন, ‘এই কালো, মুড়ি নারকেল খাবি?’ কল্পনাবিলাসী ছেলেটা আমেরিকার গল্প
ভুলে গোগ্রাসে মুড়ি খেতে থাকে। তারপর বলে, ‘মাসিমা, সোনালীকে একটু বাইরে ঘুরিয়ে আনি?’ সোনালীর মা রাজী হন।
- ‘বেশী
দূর যাস না কিন্তু!’
কালো যখন
সোনালীর হুইল চেয়ার ঠেলে এগোয়, সোনালীর
মুখে চোখে আনন্দ উপচে পড়ে। ‘কালোদা, এবার পুজোর
ছুটিতে আমায় বেড়াতে নিয়ে যাবে?’
গম্ভীর মুখে
কালো বলে ‘হুম’।
- ‘কালোদা, ভাগ্যিস মা
দুগগা অসুরটাকে মারলো, তাই আমরা একমাস ছুটি পেলুম, না গো?’
কালো অন্যমনস্ক
হয়ে যায়। তার মাও তাকে খুব মারে। সে পড়া পারে না, তার
নামে হাজারটা অভিযোগ, বাড়ি ফিরলেই শুরু হয় মায়ের
মার। কিন্তু তারপর রাত্তিরে সে যখন কালশিটে পড়া পিঠের যন্ত্রনায় ঘুমোতে পারে না, তখন মা-ই তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কোলে টেনে এনে গায়ে পিঠে সেঁক দেয়। ব্যথার
তাড়সে, ঘুমঘোরেও কালো টের পায় মা তখন
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহিষাসুরকে মেরেও নিশ্চয়ই মা দুর্গা খুব কাঁদে...
এক মাস ধরেই
কি! ইস্কুল না থাকলে কালো সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। সোনালী ছাড়া কারও বাড়িতে
তার ঠাঁই জোটে না, পুকুরপাড়ে, ঝুপসি গাছের ছায়ায় সে বসে থাকে, কত
কীই চিন্তা করে! কচুপাতাগুলো রক্তবীজের মতো সংখ্যায় বাড়ে, রাক্ষসের
দল আক্রমণ করতে আসে তাকে। কিন্তু সে ভয় পায় না। একটা ঢিল তুলে নিয়ে পুকুরে ছুঁড়ে
দিলেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে রাক্ষসের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তার মা-ই তো দুর্গাঠাকুর, সে কেন ভয় পাবে! ভাবে, সোনালীকে
একবার নিয়ে আসবে এই পুকুরপাড়ে, দেখাবে সে
কেমন বীর! কালই আনবে। দেরি করলে যদি আবার ইস্কুল খুলে যায়! সেদিন কাকভোরে ঘুম
ভেঙ্গে গেল তার। কীসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে বাইরে? কে
যেন হেঁটে গেল? ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। অন্ধকারে ঠাহর
করা যায় না, তবু, মনে
হচ্ছে যেন কেউ একজন ছায়ার মতো হেঁটে যাচ্ছে। ডাকাত নয় তো! নাঃ, ডাকাত তো একা আসে না। ব্যপারটা দেখতে হচ্ছে! কে হতে পারে? এই সব ভাবতে ভাবতে সে যে কখন পুকুরপাড়ে চলে এসেছে, নিজেও খেয়াল করেনি। সেই ঝিম ধরা পরিবেশ, ঝোপের মধ্যে হিসহিসিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস, আর... আর ওটা কি! কে দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে! কী ভয়ঙ্কর
দেখতে!
কালোর
মাথাটা কেমন টলে গেল... ‘মা!’ বলে ডেকে উঠল শুধু...
চার
হুঁশ ফিরতে
টাপ্পু দেখল তারই বয়সী একটা মেয়ে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কে মেয়েটা? তাদের ঠাকুরদালানে কী করছে? সে
কিছু বলবার আগেই মেয়েটা বলে উঠলো, “কে রে তুই? আমাদের পুকুরপাড়ে কী করছিস?”
পুকুরপাড়? সত্যিই তো! টাপ্পু এতক্ষণ খেয়াল করেনি। কোথায় তাদের
ঠাকুরদালান! এ তো একটা পুকুরের ধারে শুয়ে আছে সে! এখানে কী করে এল! ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়ে কিছু বলবার আগেই আর একটা ছেলে কোথা থেকে এসে বলল, “তোদের
পুকুরপাড়! মানে? কবে থেকে হলো শুনি? কে তুই, আগে তো কখনো
দেখিনি!”
হৈমি বুঝতে
পারল, এরা নির্ঘাত ভুলো ভূত। ওকে ভুলিয়ে
নিয়ে চলে যাবে। সে জোরে চিৎকার করে উঠল, “ও মামি! দেখ
না, কারা এসে আমায় বকছে!”
কালো একটু
অপ্রস্তুত হয়ে গেল, “ছিঃ! কী মিথ্যুক রে তুই! কখন আবার বকলাম! আমি তো
পাশের ওই বাড়িটাতেই...” বলে আঙ্গুল তুলে দেখতে পেল পাশে কেন, ধারেকাছেই কোনও বাড়ি নেই, ধূ-ধূ
মাঠ শুধু!
সহজে ভয়ডর
না পাওয়া কালোর বুকটা এবার ছাঁত করে উঠল। ভয়
টাপ্পুও পেয়েছিল, কিন্তু তার থেকেও বেশি কৌতূহল
হল তার, “হ্যাঁরে, তুই
মা-কে না ডেকে মামিকে ডাকছিস কেন রে?”
- “আমার যে মা নেই!” হৈমির স্বর কেঁপে ওঠে।
-
“ভালোই হয়েছে
মা নেই। আমার মা আমাকে খুব মারে,” কালো তাকে সান্ত্বনা দিতে চায়।
টাপ্পু
প্রতিবাদ করে, “না না! মায়েরা খুব ভাল হয়! আমার মা
তো...”
তিনজনেই চুপ
করে মায়ের কথা ভাবে। টাপ্পু বলে, “চল তোরা
দু’জন, আমার বাড়ি চল, মাকে দেখবি!”
হৈমি আর কালো
খুব অবাক হয়। কেউ কখনও তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায় না। এই ছেলেটা কে! কোথা থেকে এল?
“তোর মা কি দুগগাঠাকুর?” কালো বলে ওঠে।
হৈমি সায়
দেয়, “ঠিক বলেছিস! ওইজন্যেই অত ভালো।”
টাপ্পু খুব
খুশী হয়, বলে, “সব
মায়েরাই দুগগাঠাকুর। সিংহবাহিনী তোদেরও মা, আমারও
মা!”
হৈমির মনে
পড়ে ফুলবৌয়ের মুখটা, কালো ভাবে সোনালীর মায়ের কথা।
পরক্ষণেই তার হুঁশ হয়, “সে না হয় হ’ল, কিন্তু একটা মুশকো মতো লোক যে তখন এখান দিয়ে হাঁটছিল...”
-
“হ্যাঁ আমিও
দেখেছি!” হৈমি বলে ওঠে।
- “ওই...
ওইখানটায় শুয়েছিল!”
-
“কী ভয়ঙ্কর
দেখতে তাই না রে!” টাপ্পু বলে ওঠে।
- “ওটাই
নির্ঘাত অসুর! সিংহবাহিনী মা আমাদের রক্ষা করবার জন্যে ওকে মেরে ফেলেছেন!”
-
“ঠিক
বলেছিস!” কালোর চোখ চকচক করে ওঠে।
- “ভাগ্যিস!”
- “সিংহবাহিনী মা থাকতে আমাদের আর ভয় নেই!” টাপ্পু বলে।
- “উনি তাহলে আমারও মা, তাই
নারে?” হৈমি
জানতে চায়।
-
“অবশ্যই!” কালো
ভরসা দেয়।
-
“শুধু মা-ই নয়, বন্ধুও। এই দ্যাখ না, বেচারা
সোনালীর...”
সোনালীর কথা
মনে পড়তেই তার বুক শুকিয়ে যায়, “কিন্তু আমি
এখন বাড়ি ফিরব কী করে!”
টাপ্পু আর
হৈমিও ঘাবড়ে যায়। তারপর কী ভেবে তারা একসঙ্গে ডাকতে থাকে, “হে
মা সিংহবাহিনী, আমরা হারিয়ে গেছি, আমাদের রক্ষা করো! বাড়ি পৌঁছে দাও! হে মা...”
পাঁচ
সকালে
টাপ্পুকে তার মা খুঁজে পান। ঠাকুরদালানে, মা দুর্গার
মুর্তির তলায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তুলে ঘরে নিয়ে আসেন। কী সব নাকি স্বপ্ন দেখেছে, আরও একটা ছেলে আর একটা মেয়ের কথা বলতে থাকে বারবার। হৈমির
মামী দেখতে পেলেন মেয়েটা জলের কলসি হাতে পুকুরপাড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা। বকতে গিয়েও
বকেন না তিনি, মা-মরা মেয়েটার ওপর কেমন যেন মায়া
হয়। ডেকে দিতে সে ফ্যালফ্যাল করে মামীর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে, আর কী যেন খোঁজে।
- মামী!
-
কী রে! কী হয়েছে তোর?
- আমি
হারিয়ে গেছিলুম গো! আবার ফিরে এসেছি!
- যাঃ!
কেউ আবার হারায় নাকি! সকলেই থাকে। হয়তো চোখের আড়াল হয় একটুখানি, কিন্তু থাকে ঠিক।
- আমার
বাবার মতো, না মামী? সময়
হলেই চলে আসবে!
- আসবেই
তো!
-
আর... আমার মা? সেও আছে?
- আছে
রে আছে। জানিস, তখন আমি নতুন বৌ এসেছি। ঠিক এই
জায়গাতেই একদিন আমি আর তোর মা কত্তো গল্প...
হৈমি অবাক
হয়ে ভাবে। ঠিক এই জায়গাতেই একদিন ওর মা ছিল... নেহাত সময়টা বদলে গেছে...
কালোকেও তার
মা পুকুরপাড় থেকে ঘুমন্ত তুলে আনেন, কিন্তু
মারেন না। উঠতি বয়সের ছেলে, হয়তো রাগ
করে চলেই যাচ্ছিল বাড়ি থেকে। মারধোর একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
- জানিস
কালো, তোকে খুঁজে না পেয়ে আমার বুকটা কেমন
ধড়ফড় করছিল এতক্ষণ!
-
মা, ওই
মেয়েটা আর ছেলেটা কোথায়?
-
কোন মেয়েটা? সোনালী?
- না
গো সোনালী নয়, ঐ যার মা নেই গো! আর ছেলেটার মা নাকি
একেবারে দুগগাঠাকুরের মতো!
-
কাদের কথা বলছিস বল তো?
কালো হাসে।
“ও তুমি বুঝবে না মা। সিংহবাহিনী মায়ের ছেলেমেয়ে ওরা, আমার
বন্ধু। আমার খুব খিদে পেয়েছে, কী রান্না
করেছ গো আজ?”
টাপ্পুর
ঠাম্মাও বলেন, “ভূত বলে কিছু হয় না, ঠিক, কিন্তু কেউ
কেউ সময়ের চাকায় আটকে যায়, আর বেরোতে
পারে না!”
-
সময়ের চাকা কী গো ঠাম্মা?
- এই
যে তুমি এখন এইখানে বসে আছো, ঠিক একমাস
আগে হয়তো অন্য কেউ ছিল। এক বছর বা দশ বছর আগে অন্য কেউ। যদি সময়টা মুছে যায় তাহলে
সবাইকেই একসাথে দেখতে পাওয়া যাবে, তাই না?
টাপ্পুর
মুখে হাসি ফোটে। বুঝতে পারে কালো আর হৈমির রহস্য। আর বোঝে অসুরটাকে কেন সবাই দেখতে
পেয়েছিল! জয় মা সিংহবাহিনী! একটু বেলায় পোটোকাকা এলে টাপ্পু তার কাছে আসে গল্প
শোনবার লোভে। পোটোকাকা বলে, “জানো ভাই, এই যে তোমাদের ঠাকুরদালান, এর
পিছনে অনেক আগে একটা পুকুর ছিল।”
-
“হ্যাঁ জানি
তো!” টাপ্পু বলে, “তার পাশেই হৈমিদের বাড়ি ছিল, জল
আনতো রোজ সকালে। আর ছিল কালো।”
পোটোকাকা অবাক
হয়ে তাকায়, “তুমি জানো! কিন্তু সে তো অনেক বছর
আগের কথা! আর হৈমি কে! কালোই বা কে!”
- “এ মা, তুমি জানো
না! আরও বলছি শোনো। ওই পুকুরপাড়েই মা সিংহবাহিনী দুষ্টু
অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলেছিলেন। আমি যুদ্ধটা দেখতে পাইনি, তবে অসুরকে দেখেছি। হৈমি আর কালোও দেখেছে!”
কিচ্ছু
বুঝতে না পেরে পোটোকাকা হতভম্ব হয়ে মা দুগগার মূর্তিটার দিকে তাকায়। সকালের
রোদ্দুর এসে মায়ের মুখে পড়েছে, ঠিক যেন মনে
হচ্ছে মা সিংহবাহিনী মুচকি মুচকি হাসছেন। সম্মতির হাসি!
________
ছবিঃ আন্তর্জাল
valo golpo...but time frame gulo emni emni merge kano korlo? only gravity and love can pass through space and time..if that true then all three character are in love with Durga as singularity.. So supernatural power of durga ma has created a affair of love in her enormous singularity that taken away three kids in a journey of time where three diff spaces has been merged just behind the "Dalanbari" . In zone of singularity light becomes a physical object..so all the optical images of Kalo and other girl transfers to existence for a specific time untill tapur was disturbed by his mami
ReplyDelete