হরর ফাইলস:: ভিনদেশী বন্ধু - প্রদীপ্ত ভক্ত


ভিনদেশী বন্ধু
প্রদীপ্ত ভক্ত

গত মাসে নাকি ম্যাজিক ল্যাম্প-এ হেভ্ভি ঝামেলাবাজি হয়েছিল।  কারা নাকি রাতের বেলা এসে সম্পাদককে জোর থ্রেট দিয়ে গেছে। ইয়ার্কি পায়া (খাটের পায়া না), বলি আমাদের কচি কচি ভূতের ছানারা স্ক্রিনের আলো উপেক্ষা করে হামলে পড়ছে আর তোমাদের একটু ধর্মজ্ঞান নেই অ্যাঁ, সর্বক্ষণ খালি মনিষ্যিদের নিয়ে লেখা। তাদের ঘোরার খবর, তাদের মুক, তাদের তমু তা ম্যাজিক ল্যাম্প-এর সম্পাদক এমনিতে খারাপ তো নয়, কচি ভূতেদের দুঃক্ষু বুঝবে না তাও কি হয়? তা আমি ভূত নিয়ে কখনও লিখব ভাবিনি, কারণ আমার সাথে ভূতেদের খুব বেশি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। একটা ছানা ভূতকেই আমি চিনি খালি। তা সে ভারী লাজুক ছানা। বেশি লোক তাদের কথা শুনলে তার ভালো নাই লাগতে পারে। তা তাদেরকে আমার ফোনে সাবওয়ে সারফেস খেলতে দিয়ে, একখান আইসক্রিম (এটায় আমার অবশ্য আপত্তি ছিল) দিয়ে তাদের সাথে চুক্তি হয়েছে আমি ঘটনাটা লিখতে পারি।

গোড়া থেকেই বলি আমাদের দেশে যেমন ভূত চতুর্দশী হয়, মানে সেদিনটা ভূতেদের, মানুষরা সেদিন নগণ্য জীব, তেমনই এদেশে হ্যালোউইন এটা ভূতেদের নামে উৎসর্গ করা থাকে সে তো তোমরা সবাই জানো। বাচ্চাগুলো ট্রিক বা ট্রিট চায় ভূতেদের মুখোশ পরে। কিন্তু যেটা সবাই জানে না (আমিও জানতাম না ওই ছানাটার সাথে দেখা না হলে, ও হ্যাঁ ওর নাম ক্রিশ), ন্ধেবেলা এইসব মুখোশের আড়ালে ভূতেদের ছানারাও বেরিয়ে পড়ে। আমি সত্যি বলছি ভূত প্রেত এসব মোটে বিশ্বাস করতাম না আগে। ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তা সেবার Halloween-এ আমার অফিসে তো বেজায় ভিড়, সব্বাই তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। বাচ্চাগুলো নানারকম ঝলমলে সাজে সেজেছে। আমরা তাদের ট্রিক করছিই না, খালি ট্রিট। সব কটা খুদের জন্য চকলেট রাখা আছে তারা আসছে আর থ্যাঙ্ক ইউ বলে চকলেট নিয়ে চলে যাচ্ছে (ইয়ে আমিও কি আর দু’একটা ভাগ বসাইনি)




অফিসে, তখনও ক্রিশের সাথে দেখা হয়নি
এই সব করতে গিয়ে আমার অফিসের কাজ একটু কম হয়েছিল। তাই বাড়ি ফিরে এক মনে কাজ করছিলাম। তা বাড়িতেও আশপাশের বাড়ি থেকে বাচ্চারা আসছিল। অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই খেয়ালও করিনি কে আসছে কে যাচ্ছে, চকলেট রাখা ছিল আর বাচ্চাগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। তা হঠা ঘরটা দেখি কিরকম অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে গেল। সে সময় খুব শীত পড়ে না, তাই হিটার চালানোর ব্যাপার নেই। কী হলো? মুখ তুলে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। অস্বাভাবিক ফর্সা আর হাতে একটা স্পাইডারম্যান ট্যাটু। আর মুখে একটা স্পাইডারম্যান মুখোশ। ব্যাস। আমি ভাবলাম হয়ত বাবা মা খুব বেশি সাজিয়ে দিতে পারেনি। তাকে হাত নেড়ে কাছে ডাকলাম। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আমি বললাম ওকে, “স্যর, ইউ গট ইওর ট্রিট, ক্যান উই বি ফ্রেন্ডস দেন? এমনিতে এখানকার বাচ্চারা কিছু পেলেই ধন্যবাদটা জানাতে ভোলে না। আর এ খুব একটা কথা বলছে না দেখে বুঝলাম খুবই লাজুক হয়ত। আমি হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরতেই দেখি বরফ ঠান্ডা একটা হাত। ভূতের গল্প কত পড়েছি! এরকম হাত কাদের হয় ভালোই জানা আছে তায় আবার আজকের দিনটাও তো অন্যরকম। কিন্তু বিশ্বাস করবে না, ওই ছোট্ট ছানাটাকে দেখে মনেই হয়নি ও ভূত হতে পারে। আমি তাকে নাম জিগ্যেস করলাম আর বললাম, “তোমার মুখোশটা খুলবে নাকি, একটু আলাপ হোক। তাছাড়া আমি একটা ভালো গেম পেয়েছি, দিতে পারি” ধীরে ধীরে মুখোশটা খুলল। দেখি জ্বলজ্বলে চোখটায় দুষ্টুমি আর ভাব জমানোর ভাষা। আমি আবার নাম জিগ্যেস করলাম। কোন বাড়িতে থাকে তাও। কোনোদিন বিকেলে খেলতে দেখিনি তা নাই দেখে থাকতে পারি। তো আমায় বলল, “আমার নাম ক্রিশ, কী দেখাও কী গেম আছে তোমার” আমি দিলাম খানিকক্ষণ খেলার পর ভাব হয়ে গেলতখনই আমায় বলল যেন, “আমি না তোমাদের মতন না” আমি বললাম, “মানে? আমার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি মানুষ না, ভূত” সত্যি কথা স্বীকার করছি, ওই সময় আমার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল। মনে হয়েছিল চেঁচিয়ে পালাই বা সব কটা ক্যান্ডি ওকে বিলিয়ে দিই। আমার মুখচোখের পরিবর্তন দেখে ও দেখি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। আগের রাউন্ড-এই আমি ওকে সাবওয়ে সারফেস-এ হারিয়েছি। একটা ভূতের মুখে, তাও আমার হাঁটুর বয়েসী ছানা ভূতের মুখে এমন হাসি শুনলে রাগ হয় কিনা! রেগে যেতেই আর ভয় পাওয়ার কথা মনে এলো না। খুব কষে বললাম, “হাসছ যে বড়? ভূত একটা বিজাতীয় জিনিস শুনলে যে কেউই একটু চমকাবে তুমি কি ভাবলে আমি ভয় পাই? ফুঃ!” তাতে বেচারি করুণ মুখে বলল, “আরে আমায় দেখলে তো সবাই ভয় পায়, তাই। আর আমাদের মানুষদের সাথে মেশা মানা আছে। আমার বাবা টের পেলে খুব ঝাড় খাব” আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, “কেন মানা কেন?
“কারণ মানুষগুলো মহা হুজ্জুত করে, যেন আমরা একটা প্রাণী নই! কে ভিরমি খাচ্ছে, কে চেঁচাচ্ছে, সব মিলিয়ে হন্ডুরাস অবস্থা
আমি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললাম, “সেটা সত্যি অন্যায়।”
তারপর থেকেই ভূতের ছানা ক্রিশ-এর সাথে আমার বন্ধুত্ব।

এখানে আশেপাশে অনেক ন্যাশনাল বা স্টেট পার্ক আছে। পার্ক মানে আমাদের দেশের দোলনা আর কয়েকটা বেঞ্চওলা পার্ক না। পার্ক মানে সংরক্ষিত অঞ্চল। কোনও কোনও পার্কে কিছু হরি টরিন থাকে। কোনও পার্কে ভাল্লুক বা অন্য বন্যপ্রাণী থাকতে পারে, কিন্তু তার নোটিশ দেওয়া থাকে। আবার কিছু পার্ক খালি ঝিল, গাছপালা নিয়ে। যে সব পার্কে লেক থাকে সেখানে বোটিং বা কায়াকিং করা যায়। যেগুলোয় পাহাড় থাকে সেখানে হাইক করতে যাওয়া যায়। হাইকারদের জন্য ট্রেইল রোড থাকে তাদের সে পথ ধরেই যাওয়ার নির্দেশ থাকে, যাতে আশপাশের ছোট গাছ ফুলের ক্ষতি না হয়। জ্যোৎস্না আমার খুব প্রিয় জিনিস। এইসব পার্কগুলো যেগুলো রাতে খোলা থাকে, সেগুলো মোটামুটি নিরাপদ এমনি সাপখোপ থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণত সাপেরা মানুষের চলার পথে আসে না। আর আমাদের এদিকে ভাল্লুকের আনাগোনা কম শিয়াল থাকে হয়ত, বা কায়োটি, কিন্তু তারাও দূরেই থাকে। তো এইসব পাহাড়গুলোয় রাতের বেলা বা দিনের বেলায় আমি যাই হাইক করতে। বিশেষ করে জ্যোৎস্না রাতে হাইক করতে ভারি ভালো লাগে। চাঁদের আলোয় সমস্ত জায়গাটা ঝকঝক করে অদ্ভুত মায়া মায়া একটা পরিবেশ তৈরি করে। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো হরিণগুলো একটা সিল্যুয়ে ছবি তৈরি করে দেয়। এমন রাতেই পরীরা নেমে আসে। তো সেবার কী খেয়াল হল, ভাবলাম একবার অমাবস্যায় হাইক করা যাক। পাহাড়ের উপর থেকে তারা ভরা আকাশ দেখা যাবে, অনেক দূরে নিচের ডেনভার শহর। তা সেবার কোনও বন্ধুবান্ধব পাইনি, একাই গেছিলাম। এক মাইল স্টিফ হাইক ছিল একটা একটা চ্যাটালো পাথর দেখে বসে একটু জিরোচ্ছি হঠাৎ টাওয়ার-হীন মোবাইল-এ মেসেজ এলো, ক্রিশ হিয়ার, ক্যান আই জয়েন ইউ?

বোঝো! এ ব্যাটা মহা বিচ্ছু ভূত। এরকম শুনশান পাহাড়ে ঘোর অমাবস্যায় চমকে না দিলেই নয়? বলি ১০টা না ৫টা না একটা মাত্র প্রাণ, হুট করে চমকে খাঁচা ছাড়া হলেই গেছি আর কী! তবে এই বিচ্ছুটার সামনে সে কথা প্রকাশ করা যাবে না, ব্যাটা মহা ফচকে, নাকাল করে ছাড়বে। জানি আশপাশেই আছে ব্যাটা, হেঁকে বললাম চলে আসতে। একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল তা ক্রিশ আসতে জিগ্যেস করলাম, “কিরে, এখানে বুনো ফল-টল কিছু খাওয়া যায়? নাকি খেলে তোর দলে লোক বাড়বে?” তা ও কম যায় নাকি? বলল, “এই অন্ধকারে যে এসেছ তাতেই সম্ভাবনা বেড়ে গেছে খামোখা আমি আর দোষের ভাগী হব কেন? নাহ, এখানে ওসব পাবে না” যাই হোক বাকি রাস্তাটা ওর সাথে গপ্পো করতে করতে দিব্যি কেটে গেলসত্যি বলতে, ক্রিশ আসার আগে অব্দি একটু গা ছমছম করছিল, কিন্তু ও আসায় বেশ নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। পাহাড়ের মাথায় উঠে দুজনে চিৎ হয়ে শুয়ে তারা দেখছিলাম আর চিউইং গাম চিবোচ্ছিলাম। ক্রিশ পাশ থেকে আমায় চেনাচ্ছিল কোন ডাকটা কিসের, অন্ধকারে হরিণের চোখ জ্বললে যেন ভয় না পাই ইত্যাদি।

অনেকক্ষণ পর বাড়ি যাব বলে উঠলাম। ফেরার পথে ওকে এক প্যাকেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর নাগেট কিনে দিলাম আর আমি একটা কফি নিলামআমায় ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, এরকম দুমদাম যেখানে সেখানে আমি যেন হাইক করতে না যাই। আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি।
বাড়ি ফিরে সেদিন আমার মোবাইল-এ একটা এলার্ট পেয়েছিলাম, দুজন গানম্যান-কে নাকি আমি যে পাহাড়ে হাইক করতে গেছিলাম সেদিকেই দেখা গেছে
________
ছবি - লেখক

10 comments: