ফ্যারাও ও সমাধির অভিশাপ
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
এমনিতেই মিশর নিয়ে আমাদের
কৌতূহলের শেষ নেই। আবার তার ওপর যদি তুতেনখামেনের গল্প হয়। বালক রাজা তুতেনখামেনের নাম আমরা সবাই জানি। গোল্ডেন মাস্ক পরা সেই ছবি ইতিহাস বইতে প্রত্যেকেই
দেখেছি। আমরা এটাও জানি যে তিনি দেবতাদের অভিশাপ পেয়েছিলেন। এই অভিশাপেই তাঁর
মৃত্যু হয়। ইতিহাসে তিনি অভিশপ্ত রাজা। কিন্ত অভিশাপ কি কখনও সত্যি হতে পারে? নাকি
এগুলো গল্পকথা? কে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেবে? চিরদিনই তিনি রহস্যের আড়ালে রয়ে
যাবেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন অভিশপ্ত রাজা তুতেনখামেন।
তিনি কখনও বিশাল কোনও
যুদ্ধযাত্রা করেননি। মিশর রাজ্যের সীমানাও বাড়েনি তাঁর সময়ে। তবু তিনি বিখ্যাত হয়ে
আছেন শুধু তাঁর রহস্যময়তার কারণে।
ঊনবিংশ শতকের সবচেয়ে
বিস্ময়কর আবিষ্কার হল তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার। ১৯২২-এর ৪ঠা নভেম্বর ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এর
পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তাঁর সমাধি আবিষ্কার করেন হাওয়ার্ড কার্টার। ২৬ নভেম্বর তাঁরা সমাধিকক্ষে
প্রবেশ করেন।
এই সমাধি আবিষ্কারের পূর্ব
পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল বেশিরভাগ সমাধিই ডাকাতরা লুঠে নিয়ে গেছে। কারণ, এইসব সমাধিতে অনেক মূল্যবান ধনরত্ন থাকত। বেশ কিছু সমাধি ডাকাতরা লুঠে
নিলেও তুতেনখামেন-এর সমাধি অক্ষত ছিল। ডাকাতদের হাত থেকে কোনও এক আশ্চর্য উপায়ে এই সমাধি
রক্ষা পেয়েছিল।
এবার চোখ রাখব তুতেনখামেমেনের জীবনে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। আট অথবা নয়
বছর বয়সে তিনি সম্রাট হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন সম্রাট আখেনতেন। তিনি ধর্মীয় কিছু
প্রথা এবং বিশ্বাস যা শত শত বছর ধরে চলে আসছিল তার পরিবর্তন করেছিলেন। বহু পুরোহিত
এবং নাগরিক তাঁর ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন।
তুতেনখামেন যে মিশরের সম্রাট হয়েছিলেন তা ছিল ক্রুদ্ধ এবং অশান্ত। তাঁর মায়ের নাম ছিল
কিরা। তবে এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু এখনও জানা যায় না।
তুতেনখামেন পূর্ব
নাম ছিল তুতেনখাটেন। যার অর্থ ছিল আটেনের জীবন্ত প্রতিরূপ।
নিজের ছেলেবেলা তিনি
কাটিয়েছিলেন শিকার, সাঁতার এবং লেখাপড়া নিয়ে। তাঁর কবরে কিছু খেলাধূলার সামগ্রী
পাওয়া গেছে। অনেকেই মনে করেন যে তিনি জন্ম থেকেই অসুস্থ ছিলেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি
সিংহাসনে বসেন এবং আখেঁসেনপাটেনকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন আখেনতেন এবং নেফারতিতির
কন্যা। পিতার মতোই টুটও একেশ্বরবাদী ছিলেন। আটেনের
উপাসক। কিছু বছর পর তিনি নিজের এবং নিজের রানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন তুতেনখামেন এবং
আঁখেসোনামুন। দেবতা আমেনের ভক্ত হয়ে পড়লেন। নিজের পিতার রাজধানী আমর্না ত্যাগ করার
সিদ্ধান্ত নিলেন। আধুনিক কায়রোর কাছে মেমফিসে নতুন রাজধানী স্থাপন
করেন। একজন মন্ত্রী আয় এবং সেনাপতি হোর্মহেব-এর পরামর্শে টুট চলতেন। কারণ, তিনি ছিলেন বালক রাজা। রাজ্যশাসন
করার মতো বুদ্ধি তাঁর ছিল না। একটি মত প্রচলিত আছে যে আয় টুটকে
হত্যা করে ফ্যারাও হয়ে বসেন। আয় ছিলেন নেফারতিতির বাবা।
চার বছর রাজত্ব করার পর তাঁর মৃত্যু হয়। আবার
এটাও অনুমান করা হয় যে এক রথ দুর্ঘটনায় টুট পায়ে চোট পান এবং সেই চোট থেকেই তাঁর
মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু নিয়ে বহু গল্প চালু আছে। গোল্ডেন ডেথ মাস্ক আসলে তাঁর
বিমাতা নেফারতিতির জন্য বানানো হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি করে তাঁর সমাধি নির্মিত
হয়েছিল। কারণ, তাঁর মৃত্যু ছিল অপ্রত্যাশিত। বিখ্যাত সেই মুখোশ তোমরা দেখতে পাবে কায়রো
মিউজিয়ামে। তিনি ছিলেন ৫ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা।
প্রচলিত জনশ্রুতি ছিল, যে
তাঁর সমাধি আবিষ্কার করবে তার ওপর ফ্যারাওয়ের অভিশাপ নেমে আসবে।
তুতের কোনও উত্তরাধিকারী
ছিল না। আঠার-উনিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান (জন্মঃ ১৩৪১ খ্রিস্টপূর্ব, মৃত্যুঃ ১৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব)। কথিত আছে যে দেবতার অভিশাপে তিনি মারা যান। আসলে তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত
হয়েছিলেন। আগেই বলেছি যে তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কেউ বলছেন তিনি
দূরারোগ্য হাড়ের অসুখে ভুগে মারা গেছেন। আবার কেউ বলেন তিনি ম্যালেরিয়ায় মারা
গেছিলেন। পুরোহিতরা বিধান দিয়েছিলেন যে রাজার প্রাসাদের সব ধনরত্নেও অভিশাপের
ছোঁয়া লেগেছে। এই ধন যে ব্যবহার করবে তারই অভিশাপ লাগবে এবং সাংঘাতিক রোগের কবলে পড়ে
অল্প সময়ের মধ্যেই সে মারা যাবে।
তুতের সমাধি আবিষ্কারের
কাজে লর্ড কার্নারভনের নাম জড়িয়ে আছে কার্টারের সঙ্গে।
তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। শরীরের কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। ডাক্তাররা
বলেছিলেন হার্টফেল। প্রায় দশ বছর ধরে এমন একটা নির্জন জায়গায় ছিলেন। স্নানাহার নিয়মিত ছিল না। নার্ভের ওপর
প্রচুর চাপ পড়েছিল। মানসিক অবস্থা ও স্বাস্থ্য দুইই খুব খারাপ হয়ে গেছিল। এই গল্পের
সাথে আরেকটি গল্প চালু আছে। তা হল
গালে মশার কামড় থেকে মারাত্মক রকম ইনফেকশানে আক্রান্ত হন লর্ড কার্নারভন। এই
ইনফেকশানেই তিনি মারা যান। তুতের ডেথ মাস্ক তোলার পর দেখা গেল সম্রাটের গালেও ঠিক
একই জায়গায় এক রকমের একটা ক্ষতচিহ্ন। ঠিক যে মুহূর্তে লর্ড কার্নারভনের মৃত্যু হয়
ঠিক সেই সময় কায়রোর সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিল। লন্ডনে তাঁর পোষা কুকুর সুসি গর্জন
করতে করতে মারা যায়। আর যেদিন তুতের কবর খোলা হল সেদিন কার্টারের পোষা হলুদ রঙের
ক্যানারি পাখিটাকে খেয়ে গেল এক বিষধর সাপ।
যাই হোক, তুতের সমাধি আবিষ্কৃত হয় কার্টার এবং লর্ড কার্নারভনের চেষ্টায়। এবার
সম্রাটের সমাধিকক্ষের ভেতর ঢোকা যাক।
দরজা ভেঙ্গে
পুরাতাত্ত্বিকরা ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে বাসি
ফুল বা পুরনো আতরের গন্ধ। ঘরের ভেতর
জমাট অন্ধকার। সবার হাতে পেট্রোম্যাক্সের আলো। মেঝেতে পড়ে আছে কিছু ডালাভাঙ্গা
বাক্স, সিন্দুক এবং মূল্যবান প্রাচীন কাপড়চোপড়, সোনা, হীরে, মণি-মাণিক্য,
রত্নখচিত অজস্র দেবতামূর্তি, কারুকার্যময় পাত্র, দেওয়াল জুড়ে প্রচুর ছবি। সামনে
আরেকটা ছোটো দরজা। তার জোড়ে তুতেনখামেনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা সিলমোহর।
ভাঙ্গা হল সেটা। এটা একটা ঘর, মধ্যিখানে কফিন। ভেতরে সম্রাটের
মমি। অভিশপ্ত বালক রাজা ঘুমিয়ে আছেন চিরঘুমে। এই ঘরেও পোড়ামাটির পাত্র ভর্তি প্রচুর রত্ন।
তুতেনখামেন এর সমাধি আবিষ্কারের সঙ্গে
যারা যুক্ত ছিলেন প্রত্যেকেই ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হন। কেউ কেউ খুন হলেন। খুনোখুনি থেকে যারা বেঁচে গেলেন তারা দেশে ফিরে
যান। এরা প্রত্যেকেই অদ্ভুত রোগে ভুগে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মারা যান।
একদিন সকালে কার্টারকেও
নিজের বিছানায় মৃত দেখা গেল। মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। অনেকে এটাও মনে করেন যে
অভিশপ্ত সম্রাটের ছোঁয়া লেগেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের শুরু। তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের সাথে জড়িত প্রায়
প্রত্যেকেরই অপঘাত মৃত্যু হয়।
লর্ড কার্নারভন মারা যান ৫ এপ্রিল ১৯২৩। জর্জ জে গোল্ড সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন। মারা গেলেন ১৬ মে ১৯২৩। প্রিন্স আলি
কামাল বে ১০ জুলাই ১৯২৩ মারা গেলেন নিজের স্ত্রীর গুলিতে।
কার্নাভনের এক ভাই হারবার্ট অন্ধ হয়ে গেলেন। মারা যান ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৩। স্যার আর্চিবোল্ড ডোগলাস রেডিওলোজিস্ট
যিনি তুতের মমির এক্সরে করেছিলেন। ১৫
জানুয়ারি ১৯২৪-এ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান।
স্যার লি স্টাক, সুদানের গভর্নর জেনারেল ১৯
নভেম্বর ১৯২৪-এ মারা যান কায়রো শহরে ড্রাইভিং
করার সময়।
এ সি মেস ১৯২৮-এ আর্সেনিক বিষে মারা যান। কার্নাভনের আরেক ভাই ২৬ মে ১৯৩৯ সালে মারা যান
ম্যালেরিয়ায় ভুগে। রিচার্ড বেথেল কার্টারের সেক্রেটারি ১৯২৯-এর ১৫ নভেম্বর বিষ খেয়ে আত্মহত্যা
করেন। তাঁর বাবা রিচার্ড লুট্রেল পিলকিংটন বেথেল ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৩০-এ মারা যান আটতলা থেকে পড়ে গিয়ে। কার্টার মারা যান ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ।
তাহলে দেখলে তো তুতেনখামেন-এর সমাধি আবিষ্কারের সাথে যারা জড়িয়ে ছিলেন
প্রত্যেকেই কী ভাবে শেষ হয়ে গেছেন। সব রহস্যের কখনও সমাধান হয় না। মানুষ সব কিছু
যদি জেনে ফেলে তাহলে আর বাকি থাকবে কী? আবিষ্কারের উন্মাদনাও আর থাকবে না। তোমাদের
গল্প শোনাতে গিয়ে বিস্তর নেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে। মৃত রাজা তুত কিন্তু পছন্দ
করেন না কেউ ওনাকে নিয়ে বেশি চর্চা করুক। তাই জানিনা কপালে কী আছে! তোমাদের লেখাটা
কেমন লাগল জানাতে ভুলো না।
________
ছবি ও তথ্যসূত্রঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment