কল্পবিজ্ঞানের গল্প
নির্মাল্য সেনগুপ্ত
এক
আড্ডাটা সবে জমতে শুরু করেছিল পরিতোষের বাড়িতে। ঠিক তখনই
লোডশেডিংটা হল। মনোজ বিরক্তির স্বরে বলে উঠল "এটাই মুশকিল 'পরি' তোর বাড়িতে। মাংসের পকোড়া খাওয়াস ঠিকই, কিন্তু তার পরে এই যে নিজেরা পকোড়া
হই এই ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগে না। পরিতোষ কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, "কী করি
বল তো ভাই, এ এক নতুন
জ্বালা হয়েছে। আগে এমন মোটেই হত না। গত দুই বছর ধরে ঠিক এই সন্ধ্যেবেলায় এক
ঘন্টা... দাঁড়া পরের মাসের মাইনেটা পেয়েই একটা ইনভার্টার কিনছি।
প্রতীক ফাজিল চরিত্রের ছেলে। মাঝখান দিয়ে টিপ্পনী কাটল,
"এই মাসের মাইনে দিয়ে মোমবাতিটা কিনেছিস তো?"
একটা ঝামেলা বাধত। আমি কাজিয়াটা থামিয়ে দিয়ে বললাম,
"দয়া করে একটু আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা কর। আমি কারও মুখ দেখতে পারছি না। মনে
হচ্ছে ভূতের সাথে কথা বলছি।"
অংশুমান কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করছে। শুধু ফিজিক্স
নয়, যাবতীয়
বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তু নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা ওর শখ। আপাতত অংশুর বিষয় হল ভূত। আমার
কথাটা তাই গিলে নিয়ে বলল, "নির্মাল্য, ভূত ব্যাপারটা জানিস তো, শুধু যে
মানুষের মনস্তাত্বিক বিষয় অথবা হ্যালুসিনেশন তা কিন্তু মোটেই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে
আছে বিজ্ঞান। প্যারাসাইকোলজি নিয়ে যদি কিছু পড়িস কখনও, জানতে পারবি পৃথিবীর লাইফ আর বিয়ন্ড লাইফ নিয়ে আজ অবধি কুড়ি
হাজারের উপর থিসিস আছে যা বৈজ্ঞানিকরা বাতিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেও পুরোপুরি
অস্বীকার করতে পারছেন না। কোয়ান্টাম ফিজিক্স-এর বৈজ্ঞানিক ডক্টর উইলিয়াম ফ্রেজারের
মতে...”
আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম, "ক্ষমা কর, ক্ষমা কর। এই অন্ধকারে আর ভূতের
আলোচনা নয়। আগে আলো আসুক। তারপর..."
মনোজ হেসে বলল, "এই তো, আবার জমছে আড্ডা। একটু গরম সহ্য করতে হবে কিছুক্ষণ ঠিকই, তবে এমন উপাদেয় বিষয়বস্তু থাকলে
আমি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী অবধি নিয়ে নিতে রাজী আছি।"
পরিতোষ চারটে বিশাল মোমবাতি নিয়ে হাজির হয়ে বলল, "নে, বিজলীবাতির থেকে বেশি আলো হবে এতে।
আর জানলাগুলো খুলে দিচ্ছি, গঙ্গার হু হু হাওয়া, কোথায় লাগে তোদের যান্ত্রিক পাখা..."
প্রতীক ফোড়ন কাটল, "একদা এক শৃগাল কিছু বলেছিলেন
আঙ্গুর ফল সম্বন্ধে..."
আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। আমাদের পাঁচ জনের বন্ধুত্ব
প্রায় ষোল বছরের। তখন সবার বয়স নয় কি দশ। আমরা সবাই এক পাড়াতে থাকতাম। বাগবাজারের
ঘাটপাড়ায়। পাড়ার ফুটবল মাঠে আলাপ। এরপর কাজের সূত্রে হোক কি অন্য কারণে, সবাই কলকাতার বিভিন্ন দিকে ছিটকে
গেছি। মনোজ ইঞ্জিনীয়ার, অফিসের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে সল্টলেকে। প্রতীক
বাংলার প্রফেসর। রবীন্দ্র সদনে বাড়ি। অংশুমান ওর গবেষণাগারের হস্টেলে থাকে। পরিতোষ
সরকারী চাকুরীজীবি। ও এখনও বাগবাজারের পৈতৃক বাড়িতেই থাকে। যদিও
পরিতোষের পরিবারে আর কেউ বেঁচে নেই। আমি গল্পকার। ছোট গল্প লিখি বিভিন্ন পত্রিকায়।
নাগেরবাজারে থাকি। আপাতত কম মাইনের চাকরী করছি একটা কম্পানীতে আর হন্যে হয়ে
বিভিন্ন খবরের কাগজে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে নিজেদের কাজে সবাই যেমনই
ব্যস্ত থাকি সারা সপ্তাহ, রবিবার করে আড্ডা বসে আমাদের। এই আড্ডার স্থান হয় প্রতি
সপ্তাহে এক একজনের বাড়ি। রাত দশটা অবধি আড্ডা চলে, তারপর খাওয়া দাওয়া। এই সপ্তাহে পরিতোষের পালা এসেছে।
মনোজ বলল, "তা তোর এই ফ্রেজারবাবুর বক্তব্য কী?"
অংশুমান নাক চুলকে বলল, "ডিটেইলসে বললে তোরা
সায়েন্টিফিক টার্মগুলো বুঝবি না। সংক্ষেপে বললে ব্যাপারটা হল যে, তোরা জানিস তো পৃথিবীটা আসলে নিজেই
একটা ম্যাগনেট যার সাউথ পোল এবং নর্থ পোল আছে?"
আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম "হ্যাঁ..."
"তো ব্যাপারটা হচ্ছে এইরকম যে এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা
চুম্বকক্ষেত্র তৈরী হয় পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা তরল পদার্থের স্রোতের জন্য। ফ্রেজার
এর সঙ্গে টেনেছেন 'আলো'কে।"
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "সেটা কী রকম?"
অংশু বলল, "আমি বেশি গভীরে যাচ্ছি না, তাহলে তোদের
বুঝতে অসুবিধে হবে। সরল করে বললে যা হয় সেটা হল আলোর সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিমত আছে সেটা
জানিস তো?"
পরিতোষ বলল, "ক্লাস সেভেনে পড়েছিলাম। একটু বল।"
অংশু নড়ে চড়ে বসল। বরাবরই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ
পেলে ছেলেটা খুব উত্তেজিত হয়। অংশু শুরু করল, "আলোর দুটো সংজ্ঞা। ক্রিশ্চিয়ান
হিউগেনের মতে আলো হল তরঙ্গ। তিনি এর জন্য অনেক উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা দিলেন। এরপরে
আইনস্টাইন বললেন, আলো
হল ফোটন কণার সমষ্টি। এর আনুকুল্যে আবার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গেল। এখন ফ্রেজারবাবু
বলছেন এই চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং আলোর তরঙ্গ কোথাও কোথাও ধাক্কা
খেয়ে একটা ঘরের মত জায়গা তৈরি করে। এটার নাম উনি দিয়েছেন 'হলো রুম'। এবার
মানুষের প্রাণও হল আসলে একটা তরঙ্গ। এই তরঙ্গটা চলে যায় মহাশূন্যে। এখন কথা হচ্ছে
যেসব মানব তরঙ্গ এই 'হলো রুম'এ আটকে যায় সেগুলো আর বেরিয়ে যেতে
পারে না। সেই তরঙ্গগুলোই হচ্ছে চলতি কথায় যাকে বলে 'ভূত'।"
আমরা চুপ করে ছিলাম। মনোজ বলে উঠল, "যতসব গ্যাঁজাখুরির
একশেষ। যা ইচ্ছে একটা বলে দিলেই হল নাকি? ভাই পাতি কথা প্রাণ হল নিউক্লিক অ্যাসিডের রাসায়নিক
পরিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া একটা এনার্জী যা কোষের বৃদ্ধি ঘটিয়ে একটা শরীর দেয়, একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি শক্তিটা
থাকে, তারপর টাইম
এলে ফুরুৎ..."
অংশু গম্ভীর হয়ে বলল, "শক্তি কখনও ফুরুৎ হয় না মনোজ। ক্লাস সেভেনের সায়েন্স। তোদের যেটা বললাম
সেটা সারাংশ। ডক্টর ফ্রেজার বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের থিসিস এবং ইকোয়েশন ফলো করে..."
পরিতোষ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আচ্ছা যাই হোক, ভূত আছে কি নেই, এই যুদ্ধ কোনোদিন থামবে না। তাই আপাতত তোরা আরেকটা
গৃহযুদ্ধের সূচনা করিস না।"
অংশু মাথা নেড়ে বলল, "তোদের বাঙ্গালীদের এই একটা
মুশকিল। বিদেশীরা কিছু বের করলেই সেটা ভুল প্রমাণ করার জন্য তৈরি থাকিস।"
আমি এবার বলে উঠলাম, "বাঙ্গালী তুলে কোনও কথা হবে না
ভাই। সত্যেন্দ্রনাথ বোস থেকে জগদীশ চন্দ্র, বিজ্ঞানে বাঙ্গালীরা কোথাও পিছিয়ে নেই। কি বলিস, পরিতোষ?"
"কারেক্ট," পরিতোষ হেসে বলল,
"বাঙ্গালী যে পিছিয়ে নেই তার উদাহরণ আমার পরিবারেই আছে এবং আমি তা একশ শতাংশ
মানি।"
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। "তোর পরিবারে বাঙ্গালী
বিজ্ঞানী আছে নাকি?"
পরিতোষ বলল, "উঁহু, বিজ্ঞানী নয়, পাইলট। আমার পিতামহ সুবিনয় তালুকদার ছিলেন বৃটিশ
এয়ারফোর্সের একজন সিনিয়র পাইলট। ওনার আন্ডারে প্রায় ষোলটা ফাইটার প্লেন ছিল। ইংরেজরা
স্যালুট করত তাকে সেই সময়..."
প্রতীক বলল, "এটা আগে বলিসনি তো! নাকি এটা ফ্রেজার
সাহেবের ভূতের থেকেও এক কাঠি উপরে?"
পরিতোষ হেসে বলল, "নো স্যর। ইন্টারনেটে একবার ঘেঁটে
দেখ। ওনার সাহসিকতা এবং অন্তর্ধান রহস্য গুগলে পেয়ে যাবি।"
আমি বললাম, "অন্তর্ধান রহস্য? সেটা কীরকম?"
পরিতোষ বলল, "ঊনিশশো সাতষট্টি সালে নর্থ অ্যাটলান্টিক
মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঠাকুর্দা সহ আরও সাতটা প্লেন বৃটিশ এয়ারফোর্সের
আওতার বাইরে চলে যায়। তারপর থেকে তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা প্লেনের টিকিও
না..."
অংশু চুপ করে ছিল। চমকে উঠে বলল, "ঊনিশশো সাতষট্টি? বৃটিশ এয়ারফোর্স? নর্থ অ্যাটলান্টিক?"
পরিতোষ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ, কেন তুই পড়েছিস নাকি?"
অংশুর চোখ জ্বলজ্বল করছে তা মোমবাতির আলোতেও আমি স্পষ্ট
দেখতে পেলাম। অংশু উত্তেজিত হয়ে বলল, "দ্য বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল..."
মনোজ বলল, "বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল? সে তো পুরো গাঁজাখুরি।"
অংশু ওর দিকে বিরক্তির সাথে তাকিয়ে বলল, "না জেনে
সবকিছু গাঁজাখুরি বলা বন্ধ কর। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যা সমাধান করতে পারেনি
বলেই মানুষ ভাবে সেটা ভুল। ডক্টর ফ্রেজার এই বিষয় নিয়েও কাজ করছেন।"
আমি বললাম, "তোর ঠাকুর্দার সম্বন্ধে তুই এমন কিছু কি
জানিস যা গুগলে পাব না?"
পরিতোষ একটু ভেবে বলল, "উনি হারিয়ে যাওয়ার আগে অনেকবার
এয়ারবেসের সাথে কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করেছিলেন, এক দু'বার লেগেছিল কিন্তু শেষে আর কিছু পাওয়া যায়নি। ওনার ডায়েরী, ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং সেই
এয়ারবেসের রেডিও যাতে শেষবার ওনার গলা শোনা গিয়েছিল, সেগুলি আমাদের পরিবারে দিয়ে দেওয়া হয়, যার ঐতিহাসিক মূল্য বিশাল।"
অংশু উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "সেগুলো কি এখনও আছে?
নাকি কোনও মিউজিয়ামে দিয়ে দিয়েছিস?"
পরিতোষ মাথা নেড়ে বলল, "একেবারেই না। সেগুলো আমাদের
পরিবারের সম্ভ্রম। বহুবার নানা লোভনীয় প্রস্তাব এসেছে। যখন বাবা বেঁচেছিলেন তখন
তিনি সেগুলো রক্ষা করেছেন, এখন আমি করছি।"
অংশু বলল, "এই বাড়িতেই আছে? একবার দেখাতে পারবি?"
পরিতোষ ইতস্তত করে বলল, "হ্যাঁ, এ বাড়িতেই আছে, কিন্তু ঠাকুর্দার ঘরে, সেই ঘর সচরাচর খোলা হয় না সুরক্ষার
খাতিরে..."
অংশু এবার পরিতোষের পাশে এসে বলল, "একবার দেখিয়ে দে
রে। বুঝিসই তো আমার এইসব নিয়ে প্রচন্ড ইন্টারেস্ট। এটা জানার পর না দেখতে পেলে
আমার ঘুম আসবে না রাত্তিরে..."
পরিতোষ হেসে বলল, "আচ্ছা চল..."
দুই
আমরা পাঁচজন সিড়ি দিয়ে উঠতে থাকলাম উপরে। সবার সামনে পরিতোষ
আর অংশু, হাতে
মোমবাতি নিয়ে, পিছনে আমরা তিনজন।
এই অন্ধকারে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার আমার খুব একটা যে ইচ্ছে ছিল তা নয়, কিন্তু বেশ একটা গল্পের প্লট
পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছিল, তাই প্রতিবাদ করিনি। দোতলায় লম্বা বারান্দা। দক্ষিণ দিকে
একদম কোণার ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পরিতোষ। একটা বিশাল তালা লাগানো দরজায়। পরিতোষ
দেওয়ালের কোন ফাঁকফোকর দিয়ে একটা লম্বা চাবি বের করে আনল। তারপর দরজাটা খুলল।
ভেতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ এল নাকে। অনেকদিন আটকে থাকা হাওয়ার গন্ধ। যেমন
মানুষের প্রাণ আটকে থাকে তরঙ্গের বেড়াজালে...
পরিতোষ একটা আধভাঙ্গা টুলের উপর মোমবাতিটাকে কোনোমতে দাঁড় করিয়ে
সামনের কাঠের আলমারিটা খুলল। এরপর বের করে আনল একটা ডায়েরি, একটা জরাজীর্ণ সুটকেস, আর একটা যন্ত্র। তারপর বলল, "ডায়েরিটা
প্লিজ সাবধানে খুলিস। পাতাগুলো একদম নষ্ট হয়ে গেছে। সুটকেসটা দেখতে পারিস। আর এই
হচ্ছে সেই রেডিও।"
সুটকেসটা খুলল প্রতীক। টুথব্রাশ, দাড়ি কামানোর ক্ষুর, রুমাল, একটা কম্পাস, কিছু সেই আমলের ইংরেজী খবরের কাগজ, সবই সাদামাটা জিনিস। প্রতীক অতি সাবধানে ডায়েরির পাতা
উল্টাচ্ছিল। আমি আর অংশু যন্ত্রটাতে মন দিলাম। একটা চৌকো বাক্স, যেটা বুঝলাম ট্রান্সমিটার। তার
সাথে যুক্ত একটা হেডফোন আর কথা বলার জন্য একটা লম্বা চোঙ্গাকৃতির মাউথপিস। অংশু
মোমবাতিটা ধরে ট্রান্সমিটারের সামনের দিকটা পড়ার চেষ্টা করল। কাঁচের ওদিকটা মাকড়সার
ঝুল আর ময়লায় ভরে গেছে। ফ্রিকুয়েন্সির নম্বরগুলোও সব আবছা।
অংশু ট্রান্সমিটারের পেছন থেকে একটা মোটা তার বের করল। একটা
বড় মোবাইল চার্জারের মত প্লাগ। সামনের প্লাগ পয়েন্টে সেটা গুঁজে দিল, হেডফোনটা লাগাল মাথার উপর।
প্রতীক হেসে বলল, "কী রে? আকাশবাণী শুনবি নাকি?"
অংশু প্রতীকের কথায় পাত্তা না দিয়ে ট্রান্সমিটারের নব'টা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, "নর্থ
অ্যাটলান্টিকের উপর যে অংশটাকে বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল বলে তার তিনটে কোণ হল যথাক্রমে
মায়ামি, ফ্লোরিডা
পেনিনসুলা এবং বার্মুডা আইল্যান্ড। যদিও এই ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে প্রচুর মতবিরোধ
আছে। প্রথম বিমান বা জাহাজের অন্তর্ধান খবরে আছে উনিশশো পঞ্চাশ সালের ষোলই সেপ্টেম্বর।
ফ্লাইট নাম্বার নাইন্টিন।"
মনোজ জিজ্ঞেস করল, "সেটা কী?"
অংশু বলল, "আমেরিকার পাঁচটা বোমারু প্লেন ট্রেনিং
করছিল এই অঞ্চলের কাছাকাছি। পাঁচটিই অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তাদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া
যায় না। এরপর ডোনাল্ড ক্রোহার্স্ট নামের এক আকাশপথে পৃথিবী পরিক্রমণকারী ব্যক্তিরও
একই ভাবে অন্তর্ধান ঘটে। এরপর থেকেই ক্রমানুযায়ী বিভিন্ন জাহাজ এবং বিমানের অদৃশ্য
হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক যার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিছু বিজ্ঞানী বলে
সেখানের চৌম্বকীয় আকর্ষণ এতটাই বেশি যে কোনও যন্ত্র কাজ করে না, কেউ কেউ বলে জলীয় বাষ্প এবং আলোর
বিচ্ছুরণের জন্য অদ্ভুতভাবে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় যার ফলে বিমানচালকরা ভাবে নীচের
দিকে অর্থাৎ আসলে যে দিকে সমুদ্র, সেইদিকে আকাশ আছে এবং তারা কোনও কারণে বিমানটাকে উলটে ফেলে
জলের দিকে উড়ছে। সেটা ঠিক করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। পাইলট বিমান নিয়ে সোজা জলে গিয়ে
গোত্তা মারে। এমন বহু তথ্য আছে যার কোনও সমাধান নেই।"
আমি বললাম, "তা এই বিষয়ে তোর ফ্রেজার সাহেবের কী মতামত?"
পরিতোষ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল বারান্দার। কারেন্ট এসে
গেছে। পরিতোষ হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো জ্বালাল। হঠাৎ একটা পিপ শব্দে আমরা চমকে উঠে দেখলাম... ট্রান্সমিটারে আবছা একটা সবুজ আলো জ্বলছে, অংশু ওর বাঁ হাতটা হেডফোনের
একপাশের স্পিকারের উপর রেখে চোখ বড় বড় করে আছে... পরিতোষ চেঁচিয়ে উঠে বলল, "এটা
এখনও চালু? এত বছর পরে? কোনোদিন ভাবিওনি এটা চালানোর
কথা..."
অংশু বলল, "আওয়াজ আসছে হেডফোনটা থেকে। আস্তে, তবু আসছে।
আমি অংশুর থেকে হেডফোনটা নিলাম। শোঁ শোঁ করে আওয়াজ, যেমন সাধারণ রেডিওতে কোনও চ্যানেল
না ধরলে আওয়াজ হয়। পালা করে সবাই শুনে দেখল একবার। এরপর পরিতোষ কানে লাগাল। অংশু
নবটা ঘোরাতে ঘোরাতে মনোজের দিকে তাকিয়ে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে বলল, "দেখলি
বিলিতি জিনিস কাকে বলে? প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও জিনিসটা চলছে।"
মনোজ বলল, "আমি কখন বললাম যে বিলিতি জিনিস খারাপ? কথা হচ্ছিল বৈজ্ঞানিক নিয়ে। আর
বাছাধন ওই রেডিও জিনিসটিও জান তো এক বাঙ্গালীর আবিষ্কার। স্যর জগদীশ চন্দ্র বোস।
মার্কনী সাহেব নয়..."
এই নিয়ে নিশ্চিত একটা তর্ক বাধতে যাচ্ছিল। বাধা পড়ল। একটা
গোঙ্গানির শব্দে। আমরা ঘুরে তাকিয়ে দেখি পরিতোষ। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি
দেখলাম ওর মুখটা আস্তে আস্তে সাদা হয়ে আসছে।
"অংশু...এটা থেকে...আওয়াজ আসছে..."
অংশু পরিতোষের থেকে হেডফোনটা নিতে যাচ্ছিল। আমি উত্তেজনার
বশে সেটা পরিতোষের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কানে দিলাম। আস্তে, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলাম। শোঁ শোঁ শব্দটা কম। একটা
মানুষের গলা। কেউ যেন বহু দূর থেকে চেঁচিয়ে বলছে... মেডে মেডে, উই ক্যান নট লোকেট আওয়ার কারেন্ট
পজিশন, মেডে
মেডে...
তিন
আমি হতভম্ব হয়ে অংশুকে হেডফোনটা দিয়ে দিলাম। অংশু কিছুক্ষণ
কানে নিয়ে শুনল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, "কোনও একটা ফ্রিকুয়েন্সী ধরে
ফেলেছে রে। আজব কান্ড। কিন্তু এটা ইন্ডিয়ান ফ্লাইট হবে। এর থেকে বেশি দূরের
ফ্রিকুয়েন্সী ধরা সম্ভব নয়।"
আমি মনোজের দিকে তাকালাম। বেচারার আর কিছু বলার নেই। পঞ্চাশ
বছর পুরনো একটা রেডিও এখনও প্রভুভক্তের মত নিজের কাজ করে চলেছে!
হঠাৎ অংশু বলে উঠল,
"ও মাই গড! এটা অসম্ভব! অসম্ভব!"
আমরা সবাই জিজ্ঞেস করলাম, "কী? ইন্ডিয়ার বাইরের ফ্লাইট নাকি?"
অংশু কিছু না বলে ট্রান্সমিটারটার চারিদিকে কিছু খুঁজতে
লাগল। তারপর একটা বোতাম টিপে দিতেই আমরা সবাই আওয়াজটা শুনতে পারলাম। "মেডে, মেডে, দিস ইজ ফ্রন্ট ক্যমান্ডার এস ট্যালুকডার, মেডে, উই ক্যান নট লোকেট আওয়ার কারেন্ট পজিশন, মেডে... দিস ইজ ফ্রন্ট ক্যমান্ডার
এস ট্যালুকডার..."
প্রতীক ঢোক গিলে বলল, "এস ট্যালুকডার? মানে সুবিনয় তালুকদার? মানে এটায় কি রেকর্ড করার কোনও সিস্টেম
আছে নাকি?"
অংশু কিছু বলল না। মাউসপিসটা হাতে নিয়ে মুখের সামনে এনে ধরা
গলায় বলল, "ক্যান ইউ হিয়ার মি ক্যমান্ডার?"
উত্তর এল, "হু ইজ দেয়ার? ইস দিজ অফিসার ডিয়েগো? উই ক্যান নট লোকেট আওয়ার কারেন্ট পজিশন স্যর..."
আমাদের কারোর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। অংশু মাউথপিসে ঠোঁট
রেখে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বলে উঠল, "হোয়াট ইজ দ্য সিচুয়েশন ক্যমান্ডার?"
পরিষ্কার ইংরেজীতে উত্তর এল, "স্যর আই ক্যান নট
আন্ডারস্ট্যান্ড। আমরা সামনে সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পারছি। কিন্তু প্লেন এক ইঞ্চি
নড়ছে না। গত এক ঘন্টা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি এক জায়গায়। এদিকে ফুয়েল শেষ হয়ে আসছে।
কিছুক্ষণ পরেই তেল শেষ হয়ে যাবে। অন্য প্লেনগুলোর পাইলটদের সাথেও যোগাযোগ করতে
পারছি না। প্লিজ হেল্প মি স্যর..."
পরিতোষ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। আমরা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি।
অসহায় লাগছে নিজেদের। অংশু চুপ করে রইল। ওইদিক থেকে আওয়াজ আসতেই থাকল - "মেডে
মেডে, ক্যান ইউ স্টিল
হিয়ার মি স্যর? মেডে
মেডে..."
পরিতোষ ডুকরে উঠে বলল, "প্লিজ কিছু কর অংশু..."
অংশু মাউথপিসটা দূরে সরিয়ে রেখে বলল, "সবকিছু জলের মতন
তরল হয়ে গেল বুঝলি। ডক্টর ফ্রেজার ওয়াজ রাইট। প্রচন্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ড আর আলোর
তরঙ্গের জন্য বিশালাকৃতির 'হলো রুম' তৈরি হয় বার্মুডা ট্রায়াঙ্গলে, যেখানে সবকিছু আটকে যায়। শব্দ, সময়, সবকিছু। এই রেডিওটায় একটা ফ্রিকুয়েন্সি লিঙ্ক তৈরি হয়ে ছিল
সেই উনিশশো সাতষট্টি থেকে। কারণ সেই সময় এই রেডিওটা থেকে বেরনো ফ্রিকুয়েন্সি আটকে
গেছিল সেই হলো রুমে। যা এখনও যুক্ত থেকে গিয়েছিল। যার ফলে আমাদের আওয়াজ পিছিয়ে চলে
গেছে পঞ্চাশ বছর আগের একটা সময়ে। আর পঞ্চাশ বছর আগের একটা লোক, সে জানেও না যে, মারা যাওয়ার আগে সে যার সাথে কথা
বলেছিল, তার যুগে
ওনার কথা ইন্টারনেটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে।"
এখনও সুবিনয়বাবুর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে কমে
আসছিল আওয়াজ। পরিতোষ হঠাৎ উঠে এসে দাঁড়াল ট্রান্সমিটারের সামনে। মাউথপিসটা হাতে
নিল। তারপর ঠোঁটটা মাউথপিসে ঠেকিয়ে কাঁপা গলায়
বলে উঠল, "সার, ক্যান ইউ হিয়ার মি?"
উত্তর এল, "ইয়েস স্যর। দ্য ভয়েস ইজ নট ক্লিয়ার। বাট
স্টিল আই ক্যান হিয়ার ইউ। প্লিজ হেল্প মি স্যর..."
পরিতোষের চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বাঁ হাতের কনুই
দিয়ে গালটা মুছে নিয়ে বলল, "উই আর প্রাউড অফ ইউ স্যর... রেস্ট ইন
পিস..."
কিছুক্ষণ চুপ। তারপর উত্তর এল, "হু ইজ দিস?"
পরিতোষ কিছু বলল না। মাউথপিসটা রেখে দিল। সুবিনয়বাবুর আওয়াজ
আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তবু যেন আমার কানের পাশে কেউ সশব্দে চেঁচিয়ে চলেছে,
"মেডে, মেডে... প্লিজ
হেল্প মি..."
পরিতোষ কাতর গলায় বলল, "প্লিজ বন্ধ কর এটা অংশু। আর
পারছি না।"
অংশু এগিয়ে গেল প্লাগ পয়েন্টের দিকে। কিন্তু কিছু করার আগেই
ট্রান্সমিটার থেকে যান্ত্রিক কিছু আওয়াজ বেরিয়ে এল। কারও একটা আর্তনাদ। এরপর কয়েক
সেকেন্ড শোঁশোঁ শব্দ। তারপরে চুপ। আমি দেখলাম অংশু সুইচ নেভানোর আগেই রেডিওর সবুজ
আলোটা নিভে গেল। অংশু এগিয়ে এসে রেডিওর বোতামগুলো টিপল। ট্রান্সমিটারটা ধরে
ঝাঁকাল। প্লাগের তারটা নাড়িয়ে দেখল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ওর আওয়াজ চিরকালের
জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রতীক অস্ফুটে বলে উঠল, "শক্তি ধ্বংস হয় না কখনও... শক্তির
রূপান্তর ঘটে...”
________
ছবিঃ আন্তর্জাল
অসামান্য। আমি আপনার লেখা এর আগে বিশেষ পড়িনি, তবে এবার থেকে খুঁজে-খুঁজে পড়ব, কথা দিচ্ছি।
ReplyDeleteUfff, kokhhon jeno Golper modhhey dhhukey nijekei ekta charitro mone hochhilo. Sarthhok tomar lekhha vai. Proud of U bro.
ReplyDeleteDarun.
ReplyDeletebah! besh laglo.
ReplyDeleteবাহ, এটা কিন্তু সত্যি ভাল লেগেছে
ReplyDeletekhub bhalo lekha.
ReplyDeleteShaked my heart...!!
ReplyDelete