গল্পের ম্যাজিক:: সোনালি কলম - কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়


সোনালি কলম

কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়


সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। সন্ধেবেলায় যখন জাস্টিস ইন্দ্রনীল গুপ্ত বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলেন তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল আর্দালি। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ছাতাটা খুলে পেছনের দরজার দিকে হাত বাড়াতে যেতেই দরজাটা নিজে খুলে নেমে এলেন জাষ্টিস গুপ্ত। অন্যদিন এরকম সময় হলে জাস্টিস গুপ্ত অপেক্ষা করেন। গাড়ির দরজাটা আর্দালি নিজের হাতে খুলে দিয়ে ছাতাটা মেলে ধরলে তারপর গাড়ি থেকে নামেন। আজ আর্দালি অবাক হল। গাড়িটা থামা মাত্রই জাস্টিস গুপ্ত নিজেই দরজাটা খুলে নেমে টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কেমন যেন অন্যমনস্ক আজ উনি। পেছন থেকে ছাতাটা মাথায় ধরে জাস্টিস গুপ্তর পেছন পেছন আর্দালিও এগোতে থাকল। অল্প মোরাম বিছানো পথ। পথটার দুদিকে কেয়ারি করা বাগান। জাস্টিস গুপ্তর বাগান করার খুব শখ। নিজের হাতে বাগান করেন। প্রত্যেকদিন সকালবেলায় নিজের হাতে বাগানের পরিচর্যা করেন। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। একটা গোলাপ গাছ। দিনকয়েক আগে একটা কুঁড়ি এসেছিল। প্রকৃতির হিসেবমতো আজকালের মধ্যেই কুঁড়িটা ফুটে যাওয়ার কথা। কিন্তু কুঁড়িটা মাথা ঝুঁকিয়ে পড়ে আছে। ডালটা কেউ যেন মটকে দিয়েছেজাস্টিস গুপ্ত নিচু হয়ে কুঁড়িটাকে ধরলেন। নাঃ! এটাকে বাঁচানোর আর কোনও উপায়ই নেই। একটা ব্যথাতুর শূন্যদৃষ্টি নিয়ে আর্দালির দিকে ফিরে তাকালেন। ঠিক তক্ষুনি আকাশ চিড়ে খেলে গেল একটা বিদ্যুতের শিখা। তারপরেই একটা কান ফাটানো আওয়াজ আর বৃষ্টিটা নামতে থাকল ঝমঝম করে।

শ্রীমতী গুপ্ত গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেয়েছিলেন। দরজা খুলে দেখলেন জাস্টিস গুপ্ত খুব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর খারাপ নাকি?

নাঃ! শান্ত গলায় উত্তর দিলেন জাস্টিস গুপ্ত। জুতো ছেড়ে পোশাক বদলাতে বাথরুমে ঢুকলেন। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে বুকের কাছটা অল্প একটু চিনচিন করে উঠল। সাদা জামার বুক পকেটে মাথা উঁচিয়ে আছে ওনার অত্যন্ত প্রিয় শেফার্স সোনালি কলমের ক্যাপটা। মুখেচোখে জলের ঝাপটা দিয়ে পোশাক বদলে পেনটা হাতে নিয়ে বাড়িতে নিজের চেম্বারে এসে চুপ করে বসলেন। এটাও আজকে ব্যতিক্রম। জাস্টিস গুপ্ত আদালতে রাশভারী হলেও বাড়িতে স্ফূর্তিবাজ মানুষ। আদালত থেকে বাড়িতে ফিরে এসে কোনদিন এই চেম্বারে ঢোকেন না। স্ত্রী কন্যার সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটান।

চেম্বারের তিনদিকের দেওয়ালে মোটা মোটা আইনের বইয়ে ঠাসা আলমারি। সামনের দেওয়ালে শুধু বড়ো একটা কাচের জানালা। জাস্টিস গুপ্ত চেম্বারে একটা আলো জ্বালালেন না। বাইরে দূরে একটা ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। বৃষ্টির মধ্যেই সেই হলদেটে মিয়ানো আলোতে সোনালি পেনটা হাতে নিয়ে নিজের সাধের বাগানের দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। দুর্যোগের হাওয়াতে ফুলের গাছগুলো প্রবলভাবে দুলছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলোর দ্যুতিতে আইনের বইগুলোর ওপর নীল আলো ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। বন্ধ জানালার চেরা ফাঁক দিকে শিসের মতো একটা আওয়াজ হচ্ছে। জাস্টিস গুপ্তর মনে হচ্ছে এসবের মধ্যে প্রকৃতি যেন কিছু বলতে চাইছে। তিনি সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।

       শ্রীমতী গুপ্ত চা জলখাবারের ট্রে নিয়ে চেম্বারে ঢুকে জাস্টিস গুপ্তকে কলম হাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। জাস্টিস গুপ্ত একজন সেশন জজ। হয়তো সাংঘাতিক কোনও জটিল মামলা নিয়ে বিচলিত উনি। ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে শ্রীমতী গুপ্ত টেবিলের ওপর চায়ের ট্রেটা নামিয়ে বললেন, “নাও। চা-টা খেয়ে নাও। এই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় গরম চা-টা ভালো লাগবে।

জাস্টিস গুপ্ত সোনালি কলমটা পেনস্ট্যান্ডে রেখে চুপ করে নিজের চেয়ারে বসে চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে চেয়ারের পেছনে মাথাটা হেলিয়ে দিলেন। শ্রীমতী গুপ্ত কী হয়েছে জানার সুযোগ খুঁজছিলেন। নরম গলায় বললেন, “জানি, আমি আইনের অত কিছু বুঝি না। কিন্তু কী হয়েছে যদি আমাকে বলতে পার, তোমার মনটা হয়তো হালকা হবে।

খুব ধীর গলায় জাস্টিস গুপ্ত বললেন, “একটা হয়তো অন্যায় করে ফেললাম।

কী অন্যায়? কোনও রায় দিয়ে মনে হচ্ছে যে তুমি কিছু ভুল করে ফেলেছ?

না, রায়টা আমার নয়রায়টা সর্বোচ্চ আদালতের। আমি শুধু আমার কর্তব্যটা করেছি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে একটা প্রথা মানিনি। অন্যায় করেছি।”

কী রায়? কীসের প্রথার কথা বলছ?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জাস্টিস গুপ্ত বললেন, “এক্সিকিউন অর্ডার...মৃত্যু পরোয়ানায় সই।

শ্রীমতী গুপ্তর গলাটাও একটু কেঁপে গেল, “ফাঁসির আদেশ?

জাস্টিস গুপ্ত শুধু মাথাটা অল্প নড়িয়ে হ্যাঁ বললেন। তারপর নিজের মনেই কেসটা বলতে থাকলেন, “কুড়ি বছরের পুরনো কেস। লোকটা জমিজমা নিয়ে বিবাদের হিংসায় নিজের এক বোবা ভাইপোকে কুপিয়ে খুন করেছিল। রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার কেস। নিম্ন আদালতেই ফাঁসির আদেশটা হয়েছিল। তারপর লোকটা হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রীমকোর্টে গিয়েছিল। কোথাও আদেশটা বদলায়নি। এমনকি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষাও করেছিল। ক্ষমা হয়নি। কাল ভোরবেলায় লোকটার ফাঁসি হবে।

শ্রীমতী গুপ্ত বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “যে লোকটা জঘন্য অপরাধটা করেছিল, সে তার উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু তুমি তার জন্য এরকম মনমরা হয়ে অন্ধকারে বসে আছ কেন? তুমি তো আর ফাঁসির আদেশটা দাওনি।

আমাদের দেশের আইন অনুসারে ফাঁসির অপরাধের কথাটা লিখে, ফাঁসির দিনক্ষণ লিখে আদেশনামাটা অর্থাৎ ফাইনাল এক্সিকিউন অর্ডারটা একজন সেশন জজকে সই করে আসামী যে জেলে রয়েছে সেই জেলের সুপারের কাছে পাঠাতে হয়। আজ সেই কাজটাই আমি করেছি।

অপরাধীর অপরাধ যাই হোক না কেন, আদপে একজন মানুষ তো আরেকজন মানুষের মৃত্যু পরোয়নায় সই করছেন! তাই এই মানসিক অস্থিরতাটা স্বাভাবিক। শ্রীমতী গুপ্ত স্বামীর মনের চাপটা বুঝতে পারলেন। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, “তুমি তো শুধু তোমার কর্তব্যটা করেছ। যেমন কাল ভোরবেলায় ফাঁসুড়ে তার কর্তব্যটা করবে। অন্যায় করলে তার শাস্তি তো পেতেই হবে। প্রথা না মেনে অন্যায়ের কথা বলছ কেন?

ফাঁসির আদেশনামার কাগজটা কেমন হয় জান? একটু বিশেষ রকমের। চারধারে কালো বর্ডার দেওয়া থাকে। প্রথা হচ্ছে, আদেশনামাটায় সই করে কলমের নিবটা ভেঙে ফেলা। কিন্তু সেই কাজটাই আমি করতে পারিনি। আদালত থেকে সই করার জন্য আমাকে একটা কলম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সই করার আগে আদেশনামাটা পড়তে পড়তে আমি এত আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম যে বুক পকেট থেকে আমার প্রিয় সোনালি কলমটা বার করে সেটা দিয়েই সই করে ফেলেছি। সইটা করার পরই হুঁশ ফিরল। আমার সবচেয়ে প্রিয় কলমের নিবটা আমি নিজের হাতে ভেঙে দিই কী করে! ষোল বছর ধরে সোনালি কলমটা আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী। কত মনের কথা লিখেছি কলমটা দিয়ে। প্রথা না মায়া? শেষপর্যন্ত মায়াই জিতে গেল। আমার প্রিয় শেফার্স কলমের নিবটা আর ভাঙতে না পেরে ক্যাপ লাগিয়ে কলমটা পকেটে রেখে দিলামকিন্তু সেই থেকে প্রথাটা না মেনে মনের মধ্যে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে।”

শ্রীমতী গুপ্ত জাস্টিস গুপ্তকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু স্বামীর মনের দোলাচলটা কিছুতেই দূর করতে পারলেন না। রাত্রে জাস্টিস গুপ্ত কিছুই খেলেন নাঅন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লেন।

পরেরদিন সকালে যখন জাস্টিস গুপ্ত ঘুম থেকে উঠলেন তখন ছটা বেজে গিয়েছে। সময়টা দেখেই বুঝতে পারলেন ফাঁসিটা হয়ে গিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। লোকটার আত্মার শান্তি কামনা করলেন। গতরাতের মনের ভারাক্রান্ত ভাবটা অনেকটাই কমে এসেছে। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে এলেন। গতকালের মেঘলা আকাশটা আজ ঝকঝকে পরিষ্কার। বৃষ্টিতে ভিজে সকালের নরম আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে বাগানটা। আর পাঁচটা দিনের মতোই দিনটা শুরু করলেন। চা খেয়ে বাগানের পরিচর্যা করলেনস্নান করলেন। প্রাতঃরাশ করলেন স্ত্রী মেয়ের সঙ্গে। তারপর আদালতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

আর্দালি এসে ওনার ব্যাগটা গাড়িতে নিয়ে গেল। জাস্টিস গুপ্ত স্ত্রী মেয়ের কাছে বিদায় চাইতে মেয়ে বলল, “বাবা, তুমি একটা জিনিস নিতে ভুলে যাচ্ছ।

কী?

মেয়ে বুক পকেটটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “তোমার সোনালি শেফার্স পেনটা!

জাস্টিস গুপ্ত একটু আশ্চর্য হলেন। এমন ভুল তো কোনদিন হয় না। আসলে কলমটা থাকে মানিব্যাগ আর চশমার সঙ্গে বেডসাইড টেবিলে। মনে পড়ে গেল গতকাল রাত্রে কলমটা হাতে নিয়ে চেম্বারে বসেছিলেন। ওখানেই পেনস্ট্যান্ডে রেখে এসেছেন কলমটা।

চেম্বারে গিয়ে পেনস্ট্যান্ড থেকে কলমটা নিয়ে বুক পকেটে রেখে বেরিয়ে এসে মেয়েকে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।

মেয়ে জাস্টিস গুপ্তর দিকে তাকিয়ে অস্ফু গলায় বলে উঠল, “বাবা!

জাস্টিস গুপ্ত দেখলেন মা মেয়ে দুজনই ওনার জামার পকেটের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের পকেটটা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সাদা জামার বুক পকেটটায় নীল একটা কালির ছোপ ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কলমটা বার করলেন জাস্টিস গুপ্ত। তারপর একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সোনালি খাপটার তলা দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কালি। ধীরে কলমের খাপটা খুললেনদেখলেন, ওনার অত্যন্ত প্রিয় সোনালি কলমটার নিবটা ভাঙা। ফাটল ধরেছে গোড়াটাতেও। সেখান থেকেই চুঁইয়ে সাদা জামার পকেটে ছড়িয়ে পড়ছে কালি।

(সব চরিত্র কাল্পনিক)

_____
ছবিঃ পম্পা প্রধান

9 comments:

  1. To render subject it requires control on medium and clarity on the thought process. Illustration not only reflects the mood, but also captures the theme so nicely that it will definitely catch the imagination of the readers.

    ReplyDelete
  2. সুন্দর গল্প, পড়ে ভাল লাগলো। সাথের অলংকরনটিও একদম যথাযথ হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় এই সময়ের সেরা লেখকদের একজন। সোনালি কলম গল্পটিতে তিনি নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। বিস্মিত করেছেন পম্পা, অনবদ্য ইলাস্ট্রেশন দিয়ে গল্পটিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।

    ReplyDelete
  4. ছোট্ট মোচড় আর তাতেই লেখাটা দারুণ হয়ে গেল

    ReplyDelete
  5. Khub valo, ek e aparer poripurak, pampa re bisaybastur opar subichar karay dhanyabad dilum,

    ReplyDelete